অনিন্দিতা

অনিন্দিতা

মেয়েটাকে রোজ দেখি৷ না, না, মায়াবনবিহারিণী হরিণী-টরিনি নয়, তাকে দেখলে আমার শিরদাঁড়া শিরশির করে না, ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা ভায়োলিনও বাজে না৷ সারে চারটেয় স্কুল ছুটি হলে সে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়৷ আমিও৷ তারপর সাঁইতিরিশ নম্বর বাস এলে সে উঠে পড়ে, আমি অপেক্ষা করি পরের বাসটার জন্য—এই৷ বিশ্বাস করুন৷ এর বেশি আর কিচ্ছু নয়৷ গল্প কিন্তু আমার এইটুকুই, আর কিচ্ছু বলার নেই৷ বোর হচ্ছেন? একটু অন্যভাবে বলব কি? বেশ, শুনুন তবে৷ একটু ঘুরিয়ে বলছি৷

মেয়েটার নাম অনিন্দিতা৷ নামখানা জানার জন্য বেজায় কাঠখড় পুড়িয়েছি৷ এমনকি তার এক গুণগ্রাহী উড়ো ফোন করে আমাকে ‘কেলিয়ে লাট’ করে দেবে বলেও শাসানি দিয়েছে৷ অবশ্য আমি তাতে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি৷ আচ্ছা আপনারা কি ভাবছেন আমার মেয়েটাকে ভালো লেগে গেছে? ভাবাটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়৷ নাহলে অকারণে একটা মেয়ের নাম জানতে যাব কেন? আর জানলেই বা সেকথা এখানে লিখতেই বা যাব কেন৷ আসলে ভুলটা আমারই৷ আগে নিজের কথা না বলে মেয়েটার কথা বলতে শুরু করেছি৷ তাই পুরো ব্যাপারটা আপনাদের কাছে গুলিয়ে গেছে৷

দেখুন আমার নাম, ধাম, অমুক-তমুক বলে আপনাদের বেকায়দায় ফেলতে চাই না৷ যেকোনও একটা নাম ধরে নিন না৷ আসল কথাটা হল যে আমার একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে৷ অবশ্য ক্ষমতা বলা ঠিক হল কি না জানি না কারণ ব্যাপারটাকে আমি মোটেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না৷ থেকে থেকে যে ছবিগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেগুলো আমি শুধু অস্পষ্ট স্ক্রিনে সিনেমার মতো দেখে যেতে পারি৷ কিছু কিছু মানুষের সামনে দাঁড়ালে, তাদের চোখের দিকে তাকালে আচমকাই আমার চারপাশের পরিবেশ পালটে যায়৷ মিনিট কয়েক ঘোরের মধ্যে থাকি, কথা বলতে পারি না, চোখ ছাড়া শরীরের বাকি ইন্দ্রিয়গুলো কিছুক্ষণের জন্য ছুটি নেয়৷ তারপর আবার হুঁশ ফিরলে আমি স্বাভাবিক হই৷ ব্যাপারটা আপনাদের বিশ্বাস হল না সেটা মুখ দেখেই বুঝতে পারছি৷ কিন্তু আমি কী করতে পারি বলুন তো? প্রথম প্রথম আমিও ব্যাপারটাকে স্বপ্ন ভাবতাম, কিন্তু এখন বুঝি সেগুলো আমার কল্পনা নয়৷ সেগুলো জীবন্ত বাস্তব৷ শুধু প্রতিদিনকার মতো করে নয়৷ একটু অন্য ভাবে৷ কীভাবে, সেটা একটু পরে বলছি৷ আপাতত প্রসঙ্গে আসা যাক৷

হ্যাঁ তো যে কথা বলছিলাম৷ অনিন্দিতা৷ তাকে নিয়ে আমার এত মাথাব্যথা কেন? এমনিতে তাকে দেখতে মোটেই আহামরি কিছু নয়৷ সরু ডিমের মতো মুখ, বোঁচা নাক, রোদে পুড়ে মুখের চামড়া তামাটে—কিন্তু গলার কাছ থেকে লুকানো সাদা রং উঁকি দেয়৷ একমাত্র দেখার মতো হল চোখদুটো৷ আমার বোনের একটা রূপকথার বইতে সিন্ডারেলার ছবি দেখেছিলাম, বড়োবড়ো গোল চোখ, অনেকটা পেঁচার মতো৷ লক্ষ্য করেছি, স্কুলে পরীক্ষা বা দরকারি কিছু থাকলে সে বাবার সঙ্গে আসে, নাহলে একা৷ এখন কথা হল যদি আমি তার প্রেমে নাই পড়ে থাকি তাহলে অকারণে তার দিকে তাকিয়ে থাকি কেন৷ সেটা বলতে গেলে আবার অন্য একটা দিনের কথা বলতে হয়৷ বেশ, গোড়া থেকেই শুনুন তবে৷

স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি মাঝেমাঝে আমড়া খেতাম৷ তো বাসস্ট্যান্ডে আসতে একটু দেরি হয়ে যেত৷ ফলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ফেরা হত না৷ আমড়ার ঠোঙাটাকে লাথি মারতে মারতে যখন স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতাম তখন বিকেল হয়ে আসত৷ বাড়ি ফেরার তাড়া প্রায় কোনওদিনই থাকত না৷ ফিরেই তো সেই পড়তে বসতে হবে৷ তার থেকে বাস ফাঁকা হোক৷ ধীরেসুস্থে ফিরব৷ সেদিনও এরকমই দেরি হয়ে গেছিল৷ আমি যথারীতি কাগজের দলা পাকানো ঠোঙাটাকে সিমেন্টের উপর পৌঁছে দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম, এমনিতে জায়গাটা পরিষ্কার, এক কোণে একটা ঘুমন্ত কুকুর শুয়ে আছে, তার পাশেই পড়ে আছে একটা ছেঁড়া পুতুল৷ আজ কিন্তু বাসস্ট্যান্ডটা ফাঁকা নেই৷ না, আমার কোনও বন্ধু নয়৷ একটা আমারই বয়সি মেয়ে৷ সম্ভবত কাছেপিঠে কোনও স্কুলে পড়ে৷ কিন্তু সে এখনও বাসে ওঠেনি কেন? মেয়েটার মুখ দেখে ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পারলাম৷ কোনও ঝামেলায় পড়েছে৷ মুখটা প্রায় কাঁদোকাঁদো৷ আমি ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দিইনি৷ মেয়েরা এমনিতেই থেকে থেকে কেঁদে ফেলে৷ এখন আমি সাহায্য করতে গেলে উলটে দু-কথা শুনিয়েও দিতে পারে৷ তার থেকে যা আছে থাক৷ আমার বাস এলে আমি উঠে যাব৷ আমাকে নিরুত্তাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা একবার গলা খাঁকরানি দিল৷ বুঝলাম সাহায্য দরকার৷ কিন্তু অত সহজে গলে পড়ার পাত্র নই আমি৷ বিশেষ করে অচেনা উটকো সমবয়সী মেয়েকে যেচে সাহায্য করা বেশ রিস্কের ব্যাপার৷ কাশুক, কেশে যাক৷ আমি কান দেব না৷ বেশ কয়েকবার গলা খাঁকরানির পরেও যখন আমি তার দিকে ফিরলাম না তখন সে বাধ্য হয়ে শেষ পথ বেছে নিল৷

‘ও ভাই, একটু শুনবে?’

‘আমি চারপাশে একবার তাকালাম৷ নাহ, আর কেউ নেই৷ তার মানে আমাকেই ডেকেছে৷ কিন্তু ‘ভাই’৷ আমি বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকালাম, মেয়েটা কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে নেই৷ আমাকে ডেকেই সে মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছে৷ আমি ভদ্রতার খাতিরে একটু এগিয়ে গেলাম৷ আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে সে ফিরে তাকাল, তবে মুখের দিকে নয়, পায়ের দিকে, ‘আসলে একটু সমস্যায় পড়েছি৷’

সে আর আমার জানতে বাকি নেই৷ ঝামেলায় পড়েছে বলেই নিজে থেকে এত ডাকাডাকি, নাহলে এমন ভাব দেখাত যেন স্বর্গ থেকে সাক্ষাৎ ক্লিওপেট্রা নেমে এসেছে৷

‘বাস পাচ্ছেন না? কী একটা চাক্কা বনধ না কী যেন আছে৷’

‘না আসলে ঠিক তা নয়…’ এখনও তার মাথাটা নীচের দিকে৷ আমার দিকে তাকালে কি অন্ধ হয়ে যাবে নাকি? যত আদিখ্যেতা৷ আমি আর কোনও আগ্রহ দেখালাম না৷ বেশি পাত্তা দিলেই মাথায় উঠে বসবে৷

‘আপনার কাছে খুচরো হবে?’

আমি একটু থমকালাম৷ খুচরো ছিল বটে কিন্তু সেটা দিয়ে তো আমড়া খেলাম৷ এখন আমার কাছে শুধু বাড়ি ফেরার মতো টাকাই আছে৷ আমার কেমন যেন অস্বস্তি হল৷ মেয়েটার হয়তো টাকার দরকার৷ অথচ আমার টাকাটা তাকে দিয়ে দিলেও আমাকে পাঁচটা স্টপেজ হেঁটে ফিরতে হবে৷ বিবেক-টিবেক নিয়ে আমার কোনওকালে মাথাব্যথা ছিল না৷ কিন্তু এইমুহূর্তে মনে হল আমড়াটা না খেলেই ভালো ছিল৷ তারপরেই খেয়াল হল মেয়েটা তো খুচরো চেয়েছে, মানে নোট আছে তার কাছে, সামনে একটা দোকান আছে এখানে, এতক্ষণে খুলে গেছে হয়তো, গিয়ে দেখতে দোষ কী? বললাম, ‘আমার কাছে তো নেই, কিন্তু এই ব্রিজের ওপারেই একটা দোকান আছে, ওখানে গেলে ভাঙিয়ে দেবে৷’

মেয়েটা থতমত খেয়ে কী যেন ভাবল৷ কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ৷ আমিও ভাবছি ঝামেলা মিটে গেছে, আবার আগের জায়গায় ফিরে যাই৷ এমন সময় একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেল৷ ভাবনাচিন্তা সব সরিয়ে রেখে মেয়েটা আচমকা ভ্যা করে কেঁদে ফেলল৷ আমার পিলে প্রায় চমকে উঠেছিল৷ কোনওরকমে সামলে নিলাম৷ মেয়েটার বেঁকানো ঠোঁট আস্তে আস্তে সোজা হয়ে আছে৷ বুঝলাম কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলতে চায় সে৷ আমি ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম, প্রায় অস্পষ্ট, শুধু কয়েকটা শব্দ নিশ্বাসের ধাক্কায় একটু জোরে শোনা যাচ্ছে, ‘টাকা… ভ্যা… বোতল… আমার.. ভ্যা… কেউ, ব্যাগে… ভ্যা…’

বোতল টাকা আর ব্যাগের কী সম্পর্ক আমি আর ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম না, বুঝলাম খুচরো-টুচরোর কোনও ব্যাপার না, মেয়েটার কাছে বাড়ি ফেরার টাকা নেই৷ আমার কেমন যেন করুণা হল৷ তার থেকেও বেশি হল অস্বস্তি৷ মেয়েটা এমন চিৎকার করে কাঁদছে যে আমাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকে ভুল ভাবতে পারে৷ আবার সব ছেড়ে-ছুড়ে নিজের মতো বাসে উঠে পড়লেও ব্যাপারটা খারাপ দেখায়৷ নাহ, আজ আমার ভাগ্যে হেঁটে বাড়ি ফেরাই লেখা আছে৷ ব্যাগের চেন খুলে পাঁচটাকার একটা কয়েন বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম, মিহি স্বরে বললাম, ‘এটা রাখুন৷’

কয়েনটা দেখেই তার কান্নাটা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল৷ নিঃশব্দে আমার হাত থেকে সেটা নিয়ে আবার ফোঁপাতে লাগল৷ এতক্ষণে আমার বিরক্তির জায়গায় বেশ মজা লাগতে শুরু করেছে৷ মেয়েটা উঠে দাঁড়াল৷ আমি হাঁটা লাগাতে যাচ্ছিলাম কিন্তু থেমে গেলাম৷ মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে, এই প্রথম আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে সে৷ আমিও তাকালাম৷ আর ঠিক তখনই ঘটে গেল ব্যাপারটা৷ আরে না মশাই, প্রেম-টেম নয়৷ আমার সেই ব্যাপারটা৷ মনে হল তাকে আগে থেকে চিনি আমি৷ পুরোটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়৷ ছবিটা ঝাপসা৷ একটা সাদা জামা-পরা লোক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কার যেন কান্নার আওয়াজ আসছে৷ কিন্তু এসবের সঙ্গে মেয়েটার সম্পর্ক কী?

হলফ করে বলতে পারি তাকে এর আগে দেখিনি আমি৷ তাহলে কী কেস? ভূতের ব্যাপার নাকি? ইচ্ছা করল তাকেই একবার জিজ্ঞেস করি কিন্তু ততক্ষণে সে বাসের দিকে এগিয়ে গেছে৷ কী বেইমান! একবার থাঙ্কু পর্যন্ত বলল না৷ ভেবেছিলাম পরের দিন বাসস্ট্যান্ডে দেখা হলে জিজ্ঞেস করব৷ কিন্তু সেখানেও এক গেরো৷ ওমা! আপনারা সেটা শুনতেও আগ্রহী!

পরের দিন আমি আর আমড়া কিনিনি৷ কি জানি টাকাটা আবার কী কাজে লেগে যায়৷ দ্রুত পা চালিয়ে আমি বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম৷ আজ লাথি মারার মতো একটা ঢিল খুঁজে নিলাম৷ প্রায় সিমেন্টের উপরেই এনে ফেলেছিলাম কিন্তু শেষ মুহূর্তে চিপ করতে গিয়ে সেটা প্রজেক্টাইল হয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল একটু দূরে৷ ধুর৷ হতাশায় আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল৷ কালকের কুকুরটাকে আজ দেখতে পেলাম না৷ ছেঁড়া পুতুলটা অবশ্য আগের মতোই পড়ে আছে৷ মুহূর্তের জন্য কালকের মেয়েটার কথা ভুলে গেছিলাম৷ শেডের তলার ঢুকতে তাকে দেখতেই কালকের ভ্যা কান্নাটার কথা মনে পড়ল৷ আজ কিন্তু মুখ বেশ হাসিখুশি৷ দেখে মনে হল যেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল৷ বিবেক জিনিসটা এবার থেকে প্র্যাকটিস করতে হবে৷ আমি এগিয়ে গেলাম৷ কিন্তু ও হরি৷ মেয়েটার সঙ্গে আজ একটা কুঁদো লোকও উপস্থিত৷ সম্ভবত বাবা গোছের কিছু হবে৷ আমি পিছিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম, মেয়েদের বাবা শ্রেণিকে আমি একরকম এড়িয়েই চলি৷ আমার বাবার এক বন্ধু আছেন, আমি ছোটো থেকে মিহিরকাকু বলে ডাকি৷ আমার সঙ্গে বেশ খোলামেলা বন্ধুর মতোই আচরণ করতেন৷ ইদানীং তাঁর মেয়ে বোর্ডিং ছেড়ে বাড়িতে এসে থাকতে লেগেছে, তার পর থেকেই মিহিরকাকু আমার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছেন৷ এমন একখানা ভাব যেন সুযোগ পেলেই আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসি৷ যাক গে যে কথা বলছিলাম৷ তো সেই বাবাকে দেখে আমার মুখের হাসি শুকিয়ে গেল৷ আজ হতচ্ছাড়া বাসটাও আসতে দেরি করছে৷ ধুর শালা৷ পালাই কোথায়? হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েটা আঙুল তুলে আমার দিকে দেখিয়ে সেই বাবাকে কী যেন বলছে৷ আমি ভেবে কূল পেলাম না৷ কাল কি খারাপ কিছু করেছিলাম? কই মনে তো পড়ছে না৷ তবে আমাকে এভাবে দাগিয়ে দিচ্ছে কেন? ওই ধামসা হাতের একখানা ঘুসি খেলে উড়ে গিয়ে বাসের নীচে পড়ব৷ আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম৷ বাবা ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে এলেন৷ সেই কিংকংয়ের মতো হাতটা রাখলেন আমার পিঠে৷ সেটা রাখলেন, না চাপাটি মারলেন বুঝতে পারলাম না৷ পরের মুহূর্তে বাবার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘তুমি তো ভারী উপকারী ছেলে হে, আজকাল এমনটা দেখা যায় না৷’

আমি বুকে বল পেলাম৷ মারধর করতে আসেনি তার মানে৷ ভাবলাম এই সুযোগ৷ মেয়েটাকে কিছু ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করাই যায়৷ কাল সারারাত ভেবেও মাথা থেকে ব্যাপারটা তাড়াতে পারিনি৷ আগে কোথায় দেখেছি আমি? বিশেষ করে চোখদুটো৷ ভীষণ চেনা, কিন্তু মনে পড়ছে না৷

‘তুমিও বাচ্চা, এই নাও তোমার টাকাটা, নাও নাও৷’ আমি বেশি ভদ্রতা দেখানোর চেষ্টা করলাম না৷ নিয়ে নিলাম৷ বাবা ফিরে গেলেন৷ আজ কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে কথা হল না৷ সে শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসল৷ ধন্যবাদ সুলভ হাসি৷ আর সেই প্রথম আমার মনে হল হাসিটা সে বাবার থেকে লুকাতে চাইছে৷ যেন তার নিজের মতো করে আমাকে একান্তে কিছু বলতে চায়৷ আমার বেশ মিষ্টি একটা হাসি আছে, ওটা এমনি আসে না, প্রয়োজন পড়লে বের করি৷ সেটাই হাসার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু শেষ মুহূর্তে মুখের মাংসপেশিগুলো বিশ্বাসঘাতকতা করল৷ একটা বোকাবোকা ভ্যাবলাকান্তমার্কা হাসি বেরিয়ে গেল৷ সেখানে সেই দিনের মতোই ইতি৷ তখন আমার মনে প্রেমের একদানা বাষ্পও উদয় হয়নি৷ মেয়েটার কথা ভাবলে শুধু তার চোখদুটোর কথাই মনে পড়ত৷ কোথায় দেখেছি? কতদিন আগে? তারও কি আমাকে চেনা লাগছে? উঁহু, দেখে তো মনে হয় না৷ খোঁজ নিতেই হবে৷

স্কুল ড্রেস দেখে স্কুলের খোঁজ নেওয়াটা অসুবিধার কিছু না৷ সেখান থেকে নামও জোগাড় হল৷ কিন্তু তার বেশি কিছু এগোয় না৷ পরদিন থেকে আবার যে কে সেই৷ বাসস্ট্যান্ডে দেখা হলে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না৷ আগের মতোই অচেনা হয়ে গেছি৷ কয়েকদিন যাওয়ার পর ব্যাপারটা ভুলেই যেতাম কিন্তু তার আগেই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল৷ ইদানীং আমার মেয়েটাকে কেমন জানি অবাস্তব লাগতে শুরু করেছে৷ চুপচাপ পাথরের মতো বসে থাকে, বাস এলে উঠে চলে যায়৷ এর বাইরে কিছু নয়৷ একবারও অন্যদিকে তাকায় না৷ অথচ আমার তাকে চেনা মনে হয়৷ অনেকদিন আগের একঝলক দেখার স্মৃতি৷ আর কাউকে দেখে মনে হয় না৷

কিন্তু কোথায় দেখেছি মনেও পড়ে না৷

এর মাস দুয়েক পরের কথা৷ স্কুলের পর একটা নতুন কোচিংয়ে পড়তে যাওয়া শুরু করেছি৷ স্কুল ছুটি হলে আমরা তিনজন একসঙ্গে যাই৷ আমি, দীপ্ত আর শান্ত৷ তিনজনে গল্প করতে করতে হাঁটছি৷ অন্য কোনওদিকে খেয়াল নেই৷ রাস্তাটা মোটামুটি ফাঁকা৷ বাঁ-পাশ জুড়ে একটা বড়ো ঝিল৷ মাঝেমাঝে রাস্তায় পাথর পড়লে সেটা লাথি মেরে ঝিলের জলে ফেলে দিচ্ছি৷ হঠাৎ মনে হল পাশ দিয়ে কে যেন হেঁটে যাচ্ছে৷ ব্যাপারটা সেরকম অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু জানি না কেন সেদিন চমকে ফিরে তাকিয়েছিলাম৷ সেই মেয়েটা৷ মানে বাসস্ট্যান্ডের সেই মেয়েটা! একটা বই হাতে মাথা নীচু করে আমাদের উলটোদিকে চলেছে৷ চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম সেই হোঁতকা বাবাটা নেই৷ আমি দীপ্তকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বললাম, ‘ওই দেখ৷ সেই মেয়েটা৷’

দীপ্ত একটু থতমত খেয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে বলল, ‘কোন মেয়েটা?’

‘আরে মরণ, বাসস্ট্যান্ডের মেয়েটা৷’

‘সেই যে কেঁদে ফেলেছিল?’

দু-জনেই আমার পিছন ফিরে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করল৷ তারপর আবার আগের মতো মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কোথায়?’

অন্য মেয়ে তো দূরের কথা, রাস্তায় সে ছাড়া অন্য কোনও লোকও নেই৷ অথচ আমার বন্ধু দু-জন তাকে দেখতে পাচ্ছে না, আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল, ‘শালা ইয়ার্কি মারছিস? ওই তো৷’

‘রাস্তা তো ফাঁকা৷’ শান্ত অবাক গলায় বলল কথাটা৷

কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়ছিল দু-জনে আমার সঙ্গে মশকরা করছে৷ কিন্তু তাই বা কেন করবে? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না৷

‘তুই শালা নির্ঘাত প্রেমে পড়েছিস৷ যেখানে সেখানে মেয়ে দেখছিস৷’

আমার কেমন একটা খটকা লাগল৷ ওরা দু-জনেই আমার অনেক দিনের বন্ধু৷ যতটা চিনি তাতে এই মুহূর্তে ওরা অভিনয় করছে বলে মনে হল না৷ কিন্তু আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মেয়েটাকে৷ এখনও আগের মতোই মাথা নীচু করে হেঁটে যাচ্ছে৷ নাহ, কিছু একটা ব্যাপার আছে৷

‘তোরা এগো, আমি একটু পরে যাচ্ছি৷’

কথাটা বলে আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না৷ দৌড় দিলাম মেয়েটার দিকে৷ ছুটতে ছুটতে মনে হল আমার বন্ধু দু-জন হতভম্ব হয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে৷ বোধহয় ভেবেছে আমার মাথায় কিছু গন্ডগোল হয়ছে৷ যা-ই হোক, আমার সব ক-টা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আমি ফিরব না৷ একটু দৌড়াতেই মেয়েটার প্রায় পিছনে এসে দাঁড়ালাম৷ আমার পায়ের আওয়াজে সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, এবার পিছন ফিরে তাকাল, আমি একটুও না ভেবে আসল প্রশ্নটাই করে ফেললাম, ‘বল, তোকে আগে কোথায় দেখেছি আমি?’

মেয়েটা পাঁচ সেকেন্ড অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, গলকণ্ঠাটা দু-বার ওঠানামা করল, তারপর আমতা আমতা করে বলল, ‘কই, জানি না তো৷’ উত্তর যে পাব সেটা আমিও আশা করিনি৷ আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ধেয়ে এল, ‘তোকে আর কেউ দেখতে পায় না কেন?’

‘আ… আমি কী জানি৷’ আবার থেমে থেমে উত্তর৷

অনেকক্ষণ ধরে আমার মনে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল, এবার আর সেটাকে ধরে রাখতে পারলাম না, ‘তুই কি ভুত?’

কথাটা শুনেই মেয়েটার মুখ থেকে হতভম্ব ভাব মুছে গিয়ে কেমন একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল৷ তারপর আমার দিকে এক পা এগিয়ে এসে যা বলল, ‘যদি হই?’

‘তবে সেদিন কাঁদছিলি কেন? ভূতেদের তো বাড়ি যেতে পয়সা লাগে না৷’

‘তুই আগে ভূত দেখেছিস?’

‘না৷’

‘তবে জানলি কী করে?’

আমি ব্যাপারটা ভালো করে ভাবার চেষ্টা করলাম৷ সব কিছু বেশ গুলিয়ে গেছে, মেয়েটা এখনও আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, উলটে মজা করছে৷

‘কিন্তু শুধু আমিই তোকে দেখতে পাই কেন?’

মেয়েটাকে দেখে মনে হল এবার সেও চিন্তায় পড়েছে৷ কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে ভেবেচিন্তে বলল, ‘কী জানি, ভূত মানে অন্য কিছুও হতে পারে৷’

‘অন্য কিছু বলতে?’ আমি কিছুই আঁচ করতে পারছি না৷

‘মানে অতীত৷ পাস্ট৷’ এতক্ষণে আমার কৌতূহলটা আর আগের মতো খোঁচা দিচ্ছে না৷ একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এখনও পড়তে যাওয়ার সময় আছে৷ কিন্তু যেতে ইচ্ছা করছে না৷ তাছাড়া গেলেও স্যারের কাছে ঝাড় খাব আর বন্ধুদের কাছে টিপ্পনী৷ বললাম, ‘তোর জন্য আজ পড়তে যাওয়া হল না৷’

মেয়েটা এবার চোখ গোল করে আমার দিকে তাকাল, ‘আমার জন্য! আমি কী করলাম? তোকে দৌড়াতে কে বলেছিল?’

‘না দৌড়ালে জানতাম কী করে যে তুই ভূত?’

এতক্ষণে দু-জনে হাঁটতে শুরু করেছি৷ কোথায় যাচ্ছি নিজেরাও জানি না৷ বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ, হঠাৎ মনে পড়ল আজ সকালে একটা চিউইংগাম কিনেছিলাম, এক পাউচে দুটো থাকে, তার একটা আমি খেয়েছি আর একটা এখনও বুক পকেটে পড়ে আছে৷ সেটা বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম, সে নির্দ্বিধায় প্যাকেট খুলে চিউইংগামটা মুখে পুরে দিল৷

‘এবার সত্যি করে বলবি?’

‘কী?’ এতক্ষণের কথা যেন সে বেমালুম ভুলে গেছে৷

‘তোকে আমি ছাড়া কেউ দেখতে পায় না কেন?’

‘জানি না৷’ মেয়েটা চিউইংগাম চিবোতে চিবোতে বলল৷

‘আমাকে আগে দেখেছিস তুই?’

‘তাও জানি না৷’

আমি যে অদ্ভুত কিছু কিছু ঘটনা দেখতে পাই এ কথাটা সাধারণত কাউকে বলি না আমি৷ কেউ কেউ ভাবে অ্যাটেনশন গেন করার জন্য করছি কেউ ভাবে স্রেফ নির্ভেজাল মিথ্যে বলছি৷ আজ কিন্তু কথাটা মেয়েটাকে বলতে ইচ্ছা করছে, একটা সম্ভাবনার কথাও মাথায় আসছে৷ সেটাও পরিষ্কার করা দরকার৷ চারপাশে লোকজন প্রায় নেই, তাও ফিসফিস করে বললাম, ‘জানিস, আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই৷’ মেয়েটা ভিভিয়ান রিচার্ডসের মতো চিউইংগাম চেবাতে চেবাতে নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘বাঃ৷ আমারটা দেখে বলতো মাধ্যমিকটা পাশ করব কি না?’

‘ওসব নয়,’ আমি ইয়ার্কি করছি না সেটা বোঝাই কী করে, ‘ইচ্ছা করলেই দেখতে পাই না৷ নিজে থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে৷’

সে এবার আমার দিকে ফিরে আমাকে নীচ থেকে উপর পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হাওয়ায় ফুঁ দিতে দিতে বলল, ‘ধুর, গুলতাপ্পি৷ বিশ্বাস করি না৷’

‘তাতে আমার কী, কিন্তু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে৷’

‘কী কথা?’

‘হয়তো তোকে আমি ভবিষ্যতে দেখব কোনওদিন৷’

সে কী যে বুঝল জানি না, গোটা ব্যাপারটাই হয়তো এখনও ইয়ার্কি ভাবছে৷ মাথা দুলিয়ে বলল, ‘তার মানে আমি এখন এখানে নেই, অন্য কোথাও আছি৷’

‘হয়তো তুই আমার কল্পনা৷’

‘আমি কল্পনা নই৷’

আমি কথাটা বলেই সে আমার দিকে ফিরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ তার গলার স্বর আর আগের মতো নেই, কঠিন রুক্ষ গলা, যেন তার মনের গভীরের কোনও অন্ধকারে আঘাত করেছে আমার কথাটা৷

আমি বুঝলাম এ নিয়ে আর কথা বাড়ানো উচিত হবে না৷ একটু হেসে বললাম, ‘এখন কথা হচ্ছে ভবিষ্যতে তোকে আমি কী হিসেবে দেখব?’ (ব্যাপারটা প্রেমের দিকে গড়াচ্ছে কি? না দাদারা, প্রেমটেম অমন টুক করে হয়ে যায় না৷ এটা যাকে বলে একটা প্রেম-প্রেম ভাব৷)

‘তোর কী মনে হয়৷’

আমি কিছু বললাম না৷ বিকেলের পড়ে আসা ছায়ায় রাস্তাটা আলোআঁধারি হয়ে আছে৷ অনিন্দিতার চোখের চশমায় থেকে থেকে রোদ ঝলসাচ্ছে৷ দু-পাশে মাঝে মধ্যে মনিহারি দোকান পড়ছে, দু-একটা খাবার দোকানও, সেখান থেকে সিদ্ধ ভাতের গন্ধ আসছে৷ আমরা দু-জনে কোনও একদিকে এগিয়ে যাচ্ছি৷ তাকে কি সত্যি কোনওদিন দেখতে পাব আমি? কিন্তু চিনব কী করে? যদি অন্যরকম দেখতে হয়? হঠাৎ মনে হল দেখতে পাওয়ার ইচ্ছাটা আমার বেড়ে উঠছে কেন? এতদিন সেটা শুধু কৌতূহল ছিল৷ এখন কি তবে অন্য কিছু?

‘কী ভাবছিস রে?’ আমি উত্তর দিচ্ছি না দেখে সে আবার করেছে প্রশ্নটা৷ ‘ভাবছি, পরে যদি আমি তোকে দেখতেও পাই, চিনব কী করে? তাছাড়া আমার মনে থাকলেও তোর আমাকে মনে নাও থাকতে পারে৷’

ব্যাপারটা ভেবে সেও যেন গম্ভীর হয়ে গেল৷ এতক্ষণ চিউইংগামের খালি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দলা পাকাচ্ছিল৷ হঠাৎ তার চোখ চিকচিক করে উঠল, আমার দিকে ফিরে বলল, ‘এই প্যাকেটটা৷’

‘প্যাকেটটা কী?’ আমি বুঝতে পারলাম না৷ মাথা খারাপ হল নাকি মেয়েটার৷

‘না, কিছু না৷’

আমি আবার চুপ করে গেলাম৷ মাথায় খুব ক্ষীণ একটা যন্ত্রণা শুরু হয়ছে৷ সেটা ধীরে ধীরে বাড়ছে৷ শরীর খারাপ হল নাকি? বাড়ি ফিরে যাব?

‘শোন৷’ মেয়েটার গলাটা আচমকা কেমন হয়ে গেছে৷ আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে অথচ গলাটা যেন দূর থেকে আসছে৷

‘আমি অতীত নই… আমি কল্পনা নই… আমি অনিন্দিতা…’

কথাগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে এল, কী আশ্চর্য৷ বাংলাতেই কথা বলছে সে কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছি না কেন৷ যেন ধীরে ধীরে ভাষাটা ভুলে যাচ্ছি আমি৷

তা কী করে হয়? একটা একটানা যান্ত্রিক শব্দ আসছে, একটা সাদা কোট পরা লোক, মহিলা কণ্ঠ ভেসে আসছে৷ আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, আমি চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, প্রথমে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল তারপর সেই চিৎকারটা কান্নায় বদলে গেল, কিন্তু আমি তো কাঁদছি না… তবে কি…

* * *

ডাক্তার ঘোষাল কাঁপা কাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে তুলে ধরলেন৷ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে সে এইমাত্র৷ বিছানার পাশ থেকে পড়ে চোট লেগেছে মাথায়৷ একমাসের বাচ্চার পক্ষে তারপরেও বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের৷ দুটো হাত ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে বাচ্চাটা৷ এতটা চোট লাগার জন্য কোনও ব্রেন ড্যামেজ বা অ্যাবনরমালিটি সিনড্রোম গ্রো করতে পারে বড়ো হয়ে৷ অবশ্য হেড ইনজুরির ব্যাপারের বাড়ির লোককে কিছু জানানো হবে না৷ পায়ের শব্দ হতে ডাক্তার ঘোষাল পিছন ফিরে তাকালেন, মিনতি এসে দাঁড়িয়েছে৷ তাকে দেখেই ঘোষালের মনটা বিষিয়ে উঠল, তিনি ডাক্তার, ভাড়াটে খুনি নন৷ তাহলে রোজ কেন আসে মেয়েটা৷ মিনতি ঘরের ভিতর ঢুকে এল, কোলের বাচ্চাটাকে নামিয়ে রাখল পাশের বেডে, একটা সদ্যোজাত বাচ্ছা৷ মেয়ে, ধবধবে ফরসা গায়ের রং৷

ঘোষাল প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আবার তুমি এসেছ৷ লজ্জা করে না নিজের বাচ্চাকে খুন করতে?’

মিনতি উত্তর দিল না, মাথা নীচু করে একইভাবে বসে থাকল৷

‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে৷’ ঘোষাল মুখ ফিরিয়ে নিলেন৷

‘কোথায় যাব?’ মিনতি মুখ তুলে প্রশ্ন করে৷

‘জাহান্নামে, কেন? তোমার বাপের বাড়িতে যাও৷’

‘তারা নেবে না৷’

ডাক্তার ঘোষাল ভাবলেন আজকালকার দিনেও একটা সদ্যোজাত বাচ্চাকে শুধু মেয়ে বলে খুন করতে যাদের হাত কাঁপে না তাদের বাড়িতে কী সুখে মানুষ হবে মেয়েটা? আদৌ মানুষ হবে কি? মিনতির শ্বশুর হুমকি দিয়েছে যে কোনও দিন শ্বাস আটকে মারবে বাচ্চাটাকে৷ তার থেকে এই হসপিটালের বেডে মরে যাওয়াই ভালো৷ একটা ইঞ্জেকশনের ব্যাপার৷ তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন বাচ্চাটার দিকে৷ পাশ ফিরে শোয়ানো আছে, চোখ দুটো খোলা৷

‘নাম কী রেখেছ?’ ডাক্তার ঘোষাল জিজ্ঞেস করলেন৷

‘রাখিনি, কী হবে রেখে?’ কথাটা বলে মিনতি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ ঘোষাল বিছানার উপর খানিকটা ঝুঁকে পরে ফিসফিস করে বললেন, ‘বাঁচতে না দিক, একটা নামও দেবে না তোকে? তা কী করে হয়? জন্মেছিস যখন একটা নাম তো চাই৷’

বাচ্চাটা হাত বাড়িয়ে ঘোষালের মুখ ধরার চেষ্টা করল৷ ঘোষাল ডান হাতের দুটো আঙুলে তার কবজিটা ধরে একটু হেসে বললেন, ‘তোর নাম অনিন্দিতা, আর কিছু নয়, শুধু অনিন্দিতা৷’

পাশের বেডেই শোয়ানো আছে আর একটা সদ্যোজাত শিশু, সে বাঁচবে, সে ছেলে, একটু পরেই বাড়ির লোক দেখতে আসবে তাকে৷ মায়ের কোলে, অনেক গাল টেপা আর আদরে সে বেড়ে উঠবে৷ আর এই বেডের মেয়েটা, আর কয়েক ঘণ্টা পরে হসপিটালেরই কোনও ওটিতে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে তার উপর নেমে আসা ছুরি-কাঁচিগুলোর দিকে৷

* * *

আমড়ার প্যাকেটটা শেষ করে সেটাকে দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেললাম পুকুরের জলে, সামনের মোড় ঘুরলেই বাসস্ট্যান্ড৷ স্কুল ছুটি হয়ছে অনেকক্ষণ আগে৷ দীপ্তর আজ বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল তাই আগেভাগে বাসে উঠে গেছে, আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি না৷ ফিরলেই তো সেই বই খুলে বসতে হবে৷ তার থেকে ধীরে সুস্থে ফেরা ভালো৷ হেলে দুলে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম৷ ভিতরটা ফাঁকা, একটু দূরে একটা কুকুর শুয়ে ঘুমাচ্ছে৷ আমি এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম৷ একটা বাস আসছে, ভালো করে তাকিয়ে হতাশ হলাম৷ থার্টিসেভেন, ধুর আমার বাস নয়৷ নীচে তাকালাম, আমার ঠিক জুতোর কাছে উড়ে বেড়াচ্ছে একটা ফাঁকা চিউইংগামের প্যাকেট৷ কে খেয়ে ফেলেছে কে জানে৷ আমি পায়ে করে সেটা সরিয়ে দিলাম৷ সরাতে গিয়ে বুঝলাম সেটা ফাঁকা নয়৷ প্যাকেটে দুটো থাকে, কেউ একটা খেয়ে বাকিটা ফেলে দিয়েছে৷ মুখের সামনে দিয়ে সাঁইতিরিশটা হুশ করে বেরিয়ে গেল৷ তার হাওয়ায় প্যাকেটটাও উড়ে অনেক দূর গিয়ে পড়ল৷ আমি মুখ তুলে দেখলাম… খানিকটা দূরেই আমার বাস আসছে৷ একটু এগিয়ে গিয়ে উঠে পড়লাম…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *