অনাহূত
সকালে সুপ্রতিমের ফোনটা আসার পর থেকে অর্ঘ্য যে ভয়টা করছিল ঠিক সেইটাই হল৷ অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতে রোজই ওর ন-টা বেজে যায়, আজও তেমন সময়েই ফিরে সবে গ্লুকোজে চুমুক দিয়েছে এমন সময় কলিং বেল৷ স্মিতা ফেরে ওর ঘণ্টাখানেক আগে, তখনই রান্নার মাসি আসে৷ কিন্তু মাসি কাজ করে সবেমাত্র বেরিয়েছে, এখন কারুর আসার কথা নয়৷ স্মিতা জিজ্ঞাসু মুখে ওর দিকে একঝলক তাকিয়ে দরজা খুলতে উঠে গেল৷
অর্ঘ্য মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিল কীভাবে এই উটকো ঝামেলাকে কাটানো যায়৷ একে নিজের অফিস নিয়ে হিমশিম, তার ওপর যদি এখন পুলিশের খপ্পরে পড়তে হয়, তাহলে আর দেখতে হবে না৷ ইনফ্যাক্ট সকাল থেকেই ব্যাপারটা সাজাচ্ছে ও৷
স্মিতা ডাইনিং থেকে জোর গলায় বলল, ‘‘আরে বাবা! কী সৌভাগ্য আমাদের! অর্ঘ্য, দ্যাখো নীলাঞ্জন এসেছে! আয় আয়, ভেতরে আয়৷’’
অর্ঘ্য তেতো গলায় ঢোঁক গিলল, ভেবেছিল ডিনারে বসে স্মিতাকে ব্যাপারটা জানাবে, তার আগেই নীলাঞ্জন এসে গেল!
কী করবে ও এখন? এতদিনের পুরোনো বন্ধু, গলাধাক্কা দিয়ে বের তো করে দেওয়া যায় না!
সুপ্রতিম তখনই বলেছিল, ‘‘দেখবি, আমি পুলিশে খবর দিতে পারি টের পেয়ে ভোর হতে না হতেই পালিয়েছে; এবার তোর বাড়ি হানা দেবে, খুব সাবধান কিন্তু!’’
বলতে বলতে নীলাঞ্জন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, ‘‘কীরে? কেমন আছিস তুই?’’
অর্ঘ্য ক্লিশে হাসল, ‘‘আরে তুই! এত রাতে……ক-কী ব্যাপার?’’
নীলাঞ্জন স্মিতার দিকে একঝলক তাকাল, ‘‘স্মিতা এতদিন বাদে তোদের বাড়ি এলাম, একটু ভালোমন্দ খাওয়া! বিয়ের পর দুজনে তো পাত্তাই দিস না আমাদের!’’
স্মিতা হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘‘শোন, আজ কিন্তু ডিনারটা এখানেই করে যাবি, নো অজুহাত!’’
অর্ঘ্য স্মিতার দিকে আড়চোখে তাকালো৷ ইনি আর আতিথেয়তা দেখানোর সময় পেলেন না! একেবারে ডিনারের নেমন্তন্ন৷ তারপরেই ভাবল, স্মিতার আর দোষ কী! ওরা সবাই তো সত্যিই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কলেজে৷ ওদের পাঁচজনের সেই গ্রুপ, অর্ঘ্য, স্মিতা, সুপ্রতিম, নীলাঞ্জন আর বিদিশা৷ কত আড্ডা, কত হইহই৷ তারমধ্যে অর্ঘ্য আর স্মিতা সবথেকে আগে বিয়ে করে ফেলেছিল, তারপর একে একে অন্যরাও৷ এখন একটু ব্যবধান তো হয়েই গেছে, তা ছাড়া সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত!
স্মিতা চলে যেতেই নীলাঞ্জনের মুখচোখের চেহারা পালটে গেল৷ ফিসফিস করে বলল, ‘‘ভাই, বড় বিপদে পড়ে তোর কাছে ছুটে এসেছি, তুই আমাকে বাঁচা৷’’
বিপদে পড়িসনি, নিজে যেচে খাল কেটে কুমির এনে সেই কুমিরের কামড় খেয়েছিস, মনে মনে ভাবল অর্ঘ্য৷ সকাল থেকে সুপ্রতিমের কথাগুলো শোনা থেকে ও যতই ব্যাপারটা ভাবছে, স্তম্ভিত হয় যাচ্ছে৷ নীলাঞ্জনের মতো ছেলে এ কাজ করতে পারে?
দেড়বছর আগে নীলাঞ্জনেরই বিয়েতে, কত মজা হয়েছিল৷ নীলাঞ্জনের অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, স্ত্রী সোহিনীর সঙ্গে সবাইকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সেদিন৷ মাত্র দেড়বছরের মধ্যে এত কী তিক্ততা হল ওদের মধ্যে যে নীলাঞ্জন এতটা জড়িয়ে পড়ল অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে?
নীলাঞ্জন যেন ওর মনের কথা পড়ে ফেলল, বলল, ‘‘তোরা হয়তো জানিস না, সোহিনী চাপা স্বভাবের মেয়ে, আমি ওকে ঠিক বুঝতে পারিনি৷ ও যদিও মুখ ফুটে কিছু বলেনি কোনোদিন, তবু ভেতরে ভেতরে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম৷ কিছুটা ক্ষণিকের দুর্বলতাতেই হোক, বা কিছুটা মনের মিল হওয়াতে আমি ছ-মাস আগে হঠাৎ আমার অফিসেরই একটা মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম৷’’
অর্ঘ্য না জানার ভান করে বলল, ‘‘সে কী! সোহিনী তো তোকে যথেষ্ট ভালোবাসত বলে জানতাম রে!’’
নীলাঞ্জন মুখ দিয়ে আপশোশের শব্দ করে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল, ‘‘ভাই আমার কী মতিভ্রম হয়েছিল আমি জানি না রে! সোহিনীর মতো একটা এত ভালো বউ থাকতে আমি কি না জড়ালাম কোয়েলের মতো মেটেরিয়াল-সর্বস্ব একটা মেয়ের সঙ্গে!’’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে ও বলে চলছিল, ‘‘কোয়েলের মোহে আমি সাময়িক জড়িয়ে পড়েছিলাম রে৷ এমনকি, চারমাস আগে ইচ্ছে করে ট্রান্সফার নিই ক্যানিং-এর দিকে৷ ব্যান্ডেল থেকে ক্যানিং রোজ যাতায়াত করা খুব কষ্টের এসব বাড়িতে বুঝিয়ে আমি ক্যানিং-এ ঘর ভাড়া নিই৷ জানিস সোহিনীর স্কুল অনেক দূর হয়ে যাবে জেনেও ও আমার সাথে আসতে চেয়েছিল, আমি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে রেখে ক্যানিং-এ গিয়ে কোয়েলের সাথে থাকতে শুরু করি৷’’
—‘‘কী বলছিস তুই! ছি ছি নীলাঞ্জন! তোর কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না৷’’ অর্ঘ্য এবার সত্যিই আহত গলায় বলল, ‘‘তারপর?’’
—‘‘তখনো বুঝিনি রে কোয়েল কত বড় শয়তান৷ প্রথম প্রথম ওর আকর্ষণে মেতে থাকলেও মাসদেড়েক পর থেকেই ও খালি বলতে শুরু করেছিল সোহিনীকে ডিভোর্স দিতে হবে৷ নাহলে ও সব ফাঁস করে দেবে৷ কিন্তু….কিন্তু তুই বিশ্বাস কর অর্ঘ্য, ততদিনে আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছিলাম! ফিরে যেতে চাইছিলাম সোহিনীর কাছে আমি৷ কোয়েলের সস্তা শারীরিক টানের নেশা ছুটে গিয়েছিল আমার৷ ওর মোটা দাগের কথাবার্তা, চটুল হাবভাব, চিন্তাভাবনা অসহ্য হয়ে উঠেছিল আমার কাছে৷ সোহিনী তো কিছুই জানত না, সরল বিশ্বাসে ফোন করত আমায় দু-বেলা, আমি ঠিকমতো খেয়েছি কিনা, বারবার জানতে চাইত কবে বাড়ি যাব, বাবা-মাও অনুযোগ করত, শনি-রোববার কেন বাড়ি যাই না৷ আমি ভেতরে ভেতরে গ্লানিতে মরে যেতাম বিশ্বাস কর!’’
অর্ঘ্য একটা সিগারেট ধরাল, শেষটা যদিও ওর জানা, তবু বলল, ‘‘তারপর?’’
—‘‘কিছুদিন বাদেই কোয়েলের আসল স্বরূপ বেরিয়ে পড়ল৷ ওর আসল লোভ আমার টাকা আর বাবার সম্পত্তির ওপরে৷ ওর বয়ফ্রেন্ডও আছে একটা৷ ইউনুস নাম তার৷’’
অর্ঘ্য বলল, ‘‘তুই ছেড়ে এলি না কেন?’’
—‘‘ক্রমাগত ব্ল্যাকমেল করছিল তো৷ বলছিল আমার নামে উলটোপালটা ব্লেম দেবে পুলিশের কাছে গিয়ে৷ আসলে ও আর ওর বয়ফ্রেন্ড প্ল্যান করেই আমাকে ফাঁসিয়েছে রে, টাকার লোভে৷’’ নীলাঞ্জন কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল, তারপর হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল, ‘‘কাল কোয়েলের সাথে আমার অশান্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, ও বলছিল তক্ষুনি সোহিনীকে ফোন করে সব জানিয়ে দেবে৷ আমি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ওকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছি রে অর্ঘ্য!’’
অর্ঘ্য এটা দ্বিতীয়বার শুনলেও শিউরে উঠল, ‘‘অ্যাঁ! কী বলছিস তুই!’’
নীলাঞ্জন চিৎকার করে অর্ঘ্যর হাতদুটো জড়িয়ে ধরল, ‘‘তুই আমায় বাঁচা ভাই!’’
—‘‘আ-আ-আমি তোকে কী করে বাঁচাব রে! পুলিশ তোকে ধরে ফেলবে তো!’’
নীলাঞ্জন মাথা নাড়ল, ‘‘পুলিশ অন্তত সাতদিনের আগে কিছু টের পাবে না৷ বডিটা আমি ফ্রিজে ঢুকিয়ে এসেছি৷ আশপাশের লোকজনের গন্ধ পেতে দেরি হবে৷ ততদিনে আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যাব৷’’
অর্ঘ্য নিজের হাতদুটো ছাড়িয়ে নিয়ে ছটফটিয়ে উঠল, ‘‘এরকম ভাবে কতদিন পালিয়ে থাকবি তুই! একদিন না একদিন পুলিশ তোকে ঠিক খুঁজে বের করবে৷’’
নীলাঞ্জন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘‘তুই আজ রাতটা থাকতে দে আমায়, আমি কাল ভোর হতেই চলে যাব, প্লিজ! পুরোনো বন্ধুকে এটুকু হেল্প কর!’’
অর্ঘ্যর এই অবস্থাতেও খটকা লাগল৷ নীলাঞ্জন তো কাল রাতে খুন করেনি, করেছে পরশু রাতে, কাল রাতে; তো এই একই কথা বলে ও সুপ্রতিমের বাড়িতে ছিল৷
অর্ঘ্য সন্দিগ্ধভাবে বলল, ‘‘কবে করেছিস তুই এই কাজ?’’
নীলাঞ্জন আবার ওর চোখের দিকে চেয়ে বলল, ‘‘কাল রাতে৷ ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে এসেছি ফ্ল্যাট থেকে, সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, তারপর তোর কাছে এসেছি৷’’
অর্ঘ্যর এবার রাগ হয়ে গেল৷ খুন করে এসে আশ্রয় চাইছে আবার মিথ্যে কথাও বলছে নীলাঞ্জন৷ ও আর কিছু না বলে বলল, ‘‘ক্যানিং-এ কোথায় ফ্ল্যাট তোর?’’
নীলাঞ্জন ঠিকানাটা হড়বড় করে বলেই আবার কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, ‘‘ভাই তুই আজ রাতটা আমায় থাকতে দে, কাল সকাল হতেই আমি চলে যাব৷’’
অর্ঘ্য ততক্ষণে মনস্থির করে নিয়েছে৷ বলল, ‘‘দ্যাখ, আমি সরকারি চাকরি করি৷ পুলিশে ছুঁলে আঠেরো ঘা জানিস তো!’’
নীলাঞ্জন আশ্রয়হীন পাখির মতো কাতর চোখে ওর দিকে তাকাল, ‘‘প্লিজ অর্ঘ্য৷ এ-একটা রাত!’’
অর্ঘ্য বেশ বুঝতে পারছিল, ওর না-টা হ্যাঁ না হওয়া পর্যন্ত নীলাঞ্জনকে নিরস্ত করা যাবে না৷ ও বিরস কণ্ঠে কড়াভাবে বলল, ‘‘তুই এত করে বলছিস যখন আজ রাতটা থাক, কাল সকাল হলে প্লিজ চলে যাস৷’’
নীলাঞ্জন এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে সোজা হয়ে বসল৷ স্মিতা খাবারের ট্রে নিয়ে ঢুকেছে, স্মিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘কী গরম রে তোদের বাড়ি! এসিটা একটু চালা না!’’
স্মিতা একটু অবাক হয়ে তাকাল, বলল, ‘‘এই ঠান্ডায় তোর গরম লাগছে?’’
নীলাঞ্জন হাসল, ‘‘সারাদিন অফিসে এসিতে থাকি তো, বাড়িতেও তাই৷ তাই অভ্যেস হয়ে গেছে৷’’
অর্ঘ্য মুখে বলল, ‘‘আমাদের এই ঘরটায় এসি নেই রে!’’ মনে মনে ও বিশাল চটে যাচ্ছিল, শালা খুন করে এসে বড় বড় কথা বলছে৷ করিস তো ওই ইন্স্যুরেন্সের দালালি, চন্দননগরের বাড়িটা তো ভেঙে পড়ছে, সোহিনী মেয়েটা সত্যিই ভালো বলতে হবে৷ শালা বাড়িতে বাপ-মা-বউকে কষ্টে রেখে রাঁড়কে নিয়ে থাকার জায়গায় এসি লাগিয়েছে আবার বড় বড় কথা বলছে৷
লজ্জাও লাগে না!
রাতে শুয়ে শুয়ে সব কথা অর্ঘ্য খুলে বলল স্মিতাকে৷ স্মিতা মাথা ঠান্ডা করে সিদ্ধান্ত নিতে জানে৷ প্রথমে দিশেহারা হয়ে গেলেও পরে বলল, ‘‘শোন, খুন করা যেমন ক্রাইম, খুনিকে আশ্রয় দেওয়াও কিন্তু ক্রাইমের মধ্যেই পড়ে৷ কিছু হয়ে গেলে তোমার কিন্তু চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে৷ পুলিশ ইজিলি ধরে ফেলবে তোমাকে৷’’
অর্ঘ্য এমনিই রাগে ফুঁসছিল, নীলাঞ্জন খাওয়ার পরেও এসি এসি করে ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছিল, ওর নাকি এসি ছাড়া ঘুম হবে না, স্মিতা শেষমেশ বাধ্য হয়ে ওদের বেডরুমটাই ছেড়ে দিয়েছে ওকে৷ নীলাঞ্জনের খুন করে কি মাথাটাই বিগড়ে গেছে? অর্ঘ্য তেড়ে উঠল, ‘‘তুমি কী বলে ওকে আমাদের বেডরুমে শুতে দিলে? শালা একটা খুনি………!’’
স্মিতা হাত নেড়ে ওকে থামাল, ‘‘চেঁচিও না, কিছু আন্দাজ করে ফেললে আমাদেরই মুশকিল হবে৷ আমি ভোর ভোর উঠে ঠিক ওকে আটকে রাখব৷ ততক্ষণে তোমরা পুলিশের কাছে যাবে৷ তুমি বরং সুপ্রতিমকে ফোন লাগাও একবার৷’’
* * * *
সকাল হতে না হতেই অর্ঘ্য আর স্মিতার ঘুম ভেঙে গেল৷ স্মিতার তো তেমন ঘুম হয়নি বললেই চলে, উদ্বেগে ছটফট করেছে সারারাত৷ ভোর হতে না হতেই উদ্বিগ্ন মুখে ওরা বেডরুমে এসে ঢুকল৷ খুনিকে আশ্রয় দেওয়াটা অবশ্যই অন্যায়, কিন্তু তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে নিশ্চয়ই সেই অপরাধ লাঘব হয়ে যাবে৷
কিন্তু বেডরুমে এসে ওরা হাঁ হয়ে গেল৷
পাখি ফুড়ুৎ! এসি চলছে, ফ্যান চলছে, বিছানাও পরিপাটি করে রাখা, নীলাঞ্জনের চিহ্নমাত্র নেই৷
অর্ঘ্য রাগে ফেটে পড়ল, ‘‘পালিয়েছে! কী হবে এখন? পুলিশ এসে তো আমাকে ধরবে!’’
স্মিতাও অবাক, কী করে পালাল নীলাঞ্জন? তবে কি ও কাল রাতে দেখে নিয়েছিল ফ্ল্যাটের দরজার চাবি ওরা কোথায় রাখে? কিছু আঁচ করে অমনি পালিয়েছে? ও চাবিটা কোথায় খুঁজতে যাচ্ছিল, তার আগেই অর্ঘ্য রাগে গনগন করতে করতে সুপ্রতিমকে ফোন করল৷
ঘণ্টাদুয়েক বাদে ওরা সবাই যখন পুলিশের জিপে করে ক্যানিং-এ নীলাঞ্জনের ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছল তখন বেলা হয়ে এসেছে৷ খবর পেয়ে বিদিশাও ওর বর সঞ্জয়কে নিয়ে এসেছে৷
সবার মুখই থমথমে, নীলাঞ্জন ঝোঁকের বশে এটা কী করল!
অর্ঘ্যর এবার একটু অপরাধী লাগছিল নিজেকে, এভাবে পুলিশের কাছে নীলাঞ্জনকে ধরিয়ে দেবার জন্য, কিন্তু সুপ্রতিম বোঝাল, ‘‘দ্যাখ, ও আজ হোক, কাল হোক, ধরা পড়বেই৷ মাঝখান থেকে তুই-আমি ওকে থাকতে দিয়েছি পুলিশ জানলে আমরাও ফেঁসে যাব৷ তার থেকে আগেভাগে পুলিশকে আমরা পুরো ব্যপারটা বলে দিলে আমরা বেঁচে যাব বুঝলি!’’
জিপে যেতে যেতে ইনস্পেক্টর দুবার বলেছেন, ‘‘আপনারা শিওর তো? গেলে বডি পাওয়া যাবে তো?’’
অর্ঘ্য বলল, ‘‘ও তো তাই বলেছিল স্যার৷ আমি তো বুঝতে পারিনি সকাল হবার আগেই ও পালাবে৷’’
ইনস্পেক্টর বেশ প্রসন্নভাবে বললেন, ‘‘বডি পাওয়া গেলে কোনো চাপ নেই, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ধরে ফেলব বাছাধনকে৷’’
নীলাঞ্জনের বলা ঠিকানা অনুযায়ী ফ্ল্যাটটা খুঁজে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না৷ ফ্ল্যাটবাড়ি বলতে কোনো ঝাঁ-চকচকে কমপ্লেক্স নয়, ঘুপচি গলির মধ্যে সাবেকি আমলের বাড়ির ভেতার অজস্র পার্টিশন করে ফ্ল্যাট বের করা হয়েছে৷ আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই নীলাঞ্জনদের দরজাটা দেখিয়ে দিল৷
পুরোনো আমলের মরচে পড়া তালা, বারকয়েক জোরে চাপ দিতেই খুলে গেল৷
ইনস্পেক্টর আর সাথে দুজন কনস্টেবল ঢুকে এদিক-ওদিক খুঁজতে শুরু করল৷ অর্ঘ্যর বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করছে, ও বলল, ‘‘স্যার, ফ্রিজের ভেতর রেখেছে বলেছিল৷’’
ডাইনিং-এর কোনো বালাই নেই, কেবল ছোট ছোট দুটো ঘর৷ জিনিসের বাহুল্যে এবং অগোছালো গার্হস্থে পুরো ফ্ল্যাটটাই যেন কর্পোরেশনের ভ্যাট হয়ে রয়েছে৷ আসবাবপত্রেরও কোনো ঠিকঠিকানা নেই৷ খাটের উপরে জামাকাপড় স্তূপাকৃতি করে রাখা, তার পাশেই খাটের ওপরেই একটা চেয়ার বসানো৷ আরেক পাশে ছোট একটা আলমারি, কিন্তু তার দরজা খোলা, ভেতরে এলোমেলো জিনিসে ভর্তি৷
অন্য ঘরে ঢুকতেই ঘরের মাঝখানে বেখাপ্পা ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রিজটা চোখে পড়ল সবার৷
বিদিশার বর সঞ্জয় অস্ফুটে বলল, ‘‘এই স্মিতা আর বিদিশা, এদিকে সরে এসো তোমরা৷’’
কনস্টেবল দুটো গিয়ে ফ্রিজটা খুলতেই পচা একটা গন্ধ ভক করে এসে ঝাপটা মারল সবার নাকেমুখে৷
অর্ঘ্য হিমচোখে দেখল একটা মৃতদেহকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে ঠেসেঠুসে ঢোকানো হয়েছে ফ্রিজটার মধ্যে, মেয়েটার চুলটা এলোমেলো হয়ে বিছিয়ে রয়েছে গোটা শরীরে, ঘাড়টা নির্দয়ভাবে জানুর মাঝে গোঁজা৷
সব মিলিয়ে বীভৎস একটা দৃশ্য!
কনস্টেবল দুটো ধরাধরি করে লাশটাকে ফ্রিজ থেকে বের করে সামনের মাটিতে রাখতেই স্মিতার মুখ দিয়ে ‘আঁক’ করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল৷
মেয়েটার চোখদুটো যেন খরচোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে৷
সুপ্রতিম এগিয়ে গিয়ে বলতে যাচ্ছিল, ‘‘স্যার, আমাদের কিন্তু কোনো দোষ নেই৷ আ-আমরা কিন্তু জানতে পেরেই আপনাকে….’’ হঠাৎ ফ্রিজের দিকে চোখ পড়তেই ও বিস্ফারিত চোখে একটা আর্তনাদ করে অর্ঘ্যর গায়ে ঢলে পড়ল৷
অর্ঘ্য ওকে সামলাতে গিয়ে সামনে তাকাতে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল৷ ফ্রিজের মধ্যে পেছন দিকে দুমড়ে-মুচড়ে ঢোকানো রয়েছে আরো একটা মৃতদেহ, ফ্রিজের হিমায়িত তাপমাত্রায় রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মড়াটা অন্তত একমাসের পুরোনো, পচা মাংসের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল ওর৷
সামনে শুইয়ে রাখা মড়াটা একজন মহিলার, গায়ে সবুজ রঙের নাইটি, আর অন্য মড়াটার গায়ে একটা সাদা টি-শার্ট, এই টি-শার্টটা অর্ঘ্যর চেনা, কাল এটা পরেই নীলাঞ্জন গিয়েছিল ওর বাড়ি৷
কিছু বোঝার আগেই ওর চারপাশটা কেমন দুলে উঠল, মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারাল অর্ঘ্য৷
অর্ঘ্যকে ধরার জন্য সবাই ছুটে এল৷
ছুটে এল ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা নীলাঞ্জনও৷ কিন্তু ওর দিকে কেউ তাকাল না৷ তার মানে কি কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে না?
ফ্রিজের ভেতর ওর নিজের মৃতদেহটাকে দেখে কাঁপছিল নীলাঞ্জন!
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ইনস্পেক্টরটি কী সব বলে যাচ্ছেন হাত-পা নেড়ে, ওর কানে কিছুই ঢুকছে না৷
ওর যে সব মনে পড়ে গেছে৷
কোয়েল কোনোভাবে মরার আগে ওর পুরোনো প্রেমিক ইউনুসকে ফোন করে দিয়েছিল৷ সে এসে প্রেমিকার মৃতদেহ দেখে আর নিজেদের প্ল্যান পুরো বানচাল হয়েছে দেখে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে একইভাবে নীলাঞ্জনকেও খুন করে৷ করে কোয়েলের সাথে নীলাঞ্জনকেও ঢুকিয়ে দেয় ফ্রিজে৷
তীব্র মাথার যন্ত্রণায় চিরঘুমে ঢলে পড়েছিল যেন নীলাঞ্জন৷
তারপর ঠিক কাল রাতের মতোই গত একমাস ধরে প্রত্যেকদিন ও অর্থাৎ নীলাঞ্জনের অশরীরী আত্মা কোনো না কোনো বন্ধুর বাড়ি গিয়ে রাতে উঠেছে, সেখানে গিয়ে এক রাত থাকার আশ্রয় চেয়েছে৷ কাল রাতেও একইভাবে ও অর্ঘ্যর বাড়ি গিয়েছিল৷
ভাবতে ভাবতে নীলাঞ্জনের আত্মা আবার তলিয়ে যাচ্ছে তার অতিপ্রাকৃত রূপের মাঝে৷ তার অবচেতন মনে বাবা, মা, সোহিনীর ভালোবাসা, কোয়েলের ব্ল্যাকমেল সব তন্দ্রার মতো মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে গভীর অতলে৷ আবার আজ রাতে সে সব ভুলে গিয়ে জেগে উঠবে৷ অনিচ্ছাসত্ত্বেও হয়তো গিয়ে এক রাতের আশ্রয় চাইবে কোনো বন্ধুর বাড়ি৷
দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছিল বিদিশা!
এবার কার বাড়িতে আশ্রয় চাইতে আসবে নীলাঞ্জন? কার বাড়িতে এসে কাকুতি-মিনতি করবে একরাত থাকার জন্য?
কিন্তু ফ্রিজের মধ্যে থেকে থেকে হওয়া এসির অভ্যেসটার কী করবে ও, ওর বাড়িতে তো এসি নেই!
সমাপ্ত