অনারেবল শম্ভুনাথ পন্ডিত (ভবানীপুর)
কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ সদাশিব পন্ডিতের পুত্র শম্ভুনাথ পন্ডিত ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার অনুমতি নিয়ে তাঁর পিতৃব্য তাঁকে পোষ্য নেন। এই পিতৃব্য ছিলেন প্রাক্তন সদর দেওয়ানী আদালতে পেশকার।
কলকাতার জলবায়ু শম্ভুনাথের সহ্য না হওয়ায়, তাঁকে তাঁর মামার কাছে লক্ষ্ণৌতে পাঠানো হয়, সেখানে তিনি উর্দু ও ফার্সী শেখেন। পরে ইংরেজি শিক্ষার জন্য তাঁকে রাখা হয় বারাণসীতে। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁকে কলকাতা এনে ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে ভর্তি করা হল; এখানে অন্যান্য বিসয়ে ভাল ফল করলেও, গণিতে তিনি আদৌ উন্নতি করতে পারেন নি। ১৮৪১-এ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে, মাসিক ২০ টাকা বেতনে তিনি সদর আদালতের নথিরক্ষকের সহকারীর চাকরিতে নিযুক্ত হন। ফার্সী ও বাংলা দলিলাদি অনুবাদ করে এখানে বাড়তি কিছু রোজগারও তিনি করতেন। তাঁর এই বিদ্যার জন্য মেসার্স ম্যাকলিয়ড অ্যান্ড কোম্পানি তাঁর সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করত। ১৮৪৫ এ তাঁকে স্যার রবার্ট বার্লোর অধীনে ‘ডিক্রীজারী মুহরার’ পদে নিয়োগ করা হয়; তাঁর কাজে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজের সভাপতি, তিনি ‘অব দি বীইং অব গড’ নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন; ১৮৪৬-এ তিনি তাঁর ‘নোটস অ্যান্ড কমেন্টস্ অন বেকস্ এসেজ’ প্রকাশ করেন; ক্যাপটেন রিচার্ডসন এই পুস্তকের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর অন দি ল রিলেটিং টু দি একজিকিউটার্স অব ডিক্রীজ’ নামক পুস্তিকাখানি সরকার ও সদর আদালতের বিচারকগণের অনুমোদন লাভ করে।
এর কিছুদিন পরে শম্ভুনাথ রীডার পদের জন্য আবেদন করেন, কিন্তু ঐ পদ না পাওয়ায় হতাশ হয়ে তিনি স্থির করেন সদর আদালতের ব্যবহারজীবী হবেন। উক্ত আদালতের রেজিস্ট্রার মিঃ কারপ্যাটরিক তাঁকে একটি উচ্চ শ্রেণির প্রশংসাপত্র দেন; তাঁর জোরে তিনি প্লিডারশিপ পরীক্ষা দেবার অনুমতি লাভ করেন ও উক্ত পরীক্ষায় বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৪৮ এর ১৬ নভেম্বর তখনকার প্রথা অনুযায়ী সনদ লাভ করেন। অত্যল্পকালের মধ্যে তিনি ফৌজদারী মামলার সফল উকিল হিসাবে নাম করেন, এই সময় হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় তিনি আইন বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন, এগুলি পড়ে বিচারকগণ খুশী হন। স্কুল বুক সোসাইটি পিয়ারসনের ‘বাক্যাবলী’ পুনর্মুদ্রণ করবার জন্য প্রস্তুত হলে, অনারেবল মিঃ বেথুন আইন ও আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েক পৃষ্ঠা লিখে দেবার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন; অনুরোধমত তিনি উক্ত পুস্তকের জন্য কয়েক পৃষ্ঠা লিখেও দেন।
১৮৫৩র ২৮ মার্চ সরকার তাঁকে জুনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার নিযুক্ত করেন। এর অল্পকাল পরে “একজন ক্রীতদাসকে হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত আমন আলি খান বাহাদুর প্রভৃতি মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের দরবার সদস্যগণের বিরুদ্ধে মামলা ‘পরিচালনার’ জন্য সরকার শম্ভুনাথকে প্রেরণ করেন। ১৮৫৫ তে সরকার তাঁকে মাসিক ৪০০ শত টাকা বেতনে প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘চেয়ার অব দি রেগুলেশন ল’ পদে নিয়োগ করেন। এই পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন প্রায় দু’বছর। এখানে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির কয়েকটি ঐ সময়ই তিনি তাঁর ‘ল লেকচার্স’ পুস্তকে প্রকাশ করেন। ১৮৬১তে তিনি বাবু রমাপ্রসাদ রায়ের স্থলে সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার পদে নিযুক্ত হম।
এর কিছুকাল পরে অনারেবল স্যার বারনেস পীকক্ বেঞ্চে যোগদানে তিনি ইচ্ছুক কিনা তাঁকে চিঠি লিখে জানতে চান। যথা সময়ে রাজকীয় পত্র দ্বারা তাঁকে (হাইকোর্টের জজ পদে) নিয়োগ করা হয়; রাজকীয় পত্রের সঙ্গে আসে সেক্রেটারী অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া স্যার চার্লস উড়ের একখানি ব্যক্তিগত পত্র। শম্ভুনাথ উক্ত উচ্চপদ গ্রহণ করেন। ‘লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারে পুর্নগ্রহণ সম্পর্কিত মামলাসমূহের নিষ্পত্তিতে চিফ জাস্টিসের সঙ্গে সক্রিয় অংশ নেওয়ায় তিনি সবিশেষ গুরুত্ব লাভ করেন। মামলার নিষ্পত্তিতে শম্ভুনাথ সব সময় ন্যায়পরায়ণ থাকতেন বলে সকল শ্রেণির মানুষই তাঁকে পছন্দ করতেন।
স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে তিনি উৎসাহী ছিলেন; তিনিই প্রথম তাঁর মেয়েকে মি: বেথুনের বিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। তাঁর জীবনধারণের পদ্ধতি ছিল সরল ও সাদাসিধা; সকলের সঙ্গে ব্যবহারে তিনি ছিলেন ভদ্র, নম্র ও অমায়িক। তাঁর চরিত্রের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তাঁর দানশীলতা। তাঁর উপার্জনের এক তৃতীয়াংশ তিনি রেখে দিতেন দরিদ্রদের চিকিৎসা ও ঔষধে ব্যয়ের জন্য; তছাড়া তিনি বহু অনাথ ও অভাবী ছাত্রের বিদ্যালয়ে পড়ার সকল ব্যয় বহন করতেন। ছিপে মাছ ধরা ছিল তাঁর প্রিয় পেশা আর ভালবাসতেন জাতীয় সকল প্রকার খেলাধূলা।
শম্ভুনাথ মাত্র ৪২ বছর বয়সে, ১৮৬৭র ৬ জুন, কার্বাঞ্চলে ভুগে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে হাইকোর্টের বিচারকবৃন্দ, বন্ধুবান্ধব ও গুণমুগ্ধ ব্যক্তিগণ গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি দুই পুত্র রেখে গেছেন, জ্যৈষ্ঠ প্ৰাৰ্থনাথ এম এ বি এল, সংস্কৃত নিয়ে এমএ পাস এবং সরস্বতী উপাধি লাভ করেন। কনিষ্ঠ বিশ্বস্তরনাথ এখনও সংস্কৃত কলেজের ছাত্র।
এখন প্রাণনাথ হাইকোর্টে জুনিয়র অ্যাডভোকেট। কলকাতার নিকটবর্তী ভবানীপুরে পৈতৃক বাসভবনে দুই ভাই বাস করছেন।