অনাম্নী ঝরনা

অনাম্নী ঝরনা

বায়পসি রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নির মতো কুয়াশা সরে গেল। ঝলমল করে উঠল প্রকৃতি। কাঠের কটেজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে বাসব। সামনের ছোট্ট লনে দোলনা। পাশেই পিছনে ফিরে কলি। এতক্ষণ পর্যন্ত কলির শাল চাপা দেওয়া শরীর কোমর পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল, ঘাড় নিচু করে মন দিয়ে কিছু একটা দেখছিল কলি। কুয়াশা সরে যেতে দেখা গেল ওর পায়ের কাছে অজস্র হলুদ ফুল। লনের শেষ ওখানেই, তারপরই খাদ। সেটা কতটা গভীর এখনও দেখেনি বাসব। কলি মুখ ফেরাল। বালিকাসুলভ হেসে বাসবকে জিজ্ঞেস করল, যাবে নাকি? সামনের পাহাড়ারশ্রেণির দিকে তাকিয়ে বাসব আন্দাজ করল, কুয়াশা ফিরে আসার এক্ষুনি আর কোনও সম্ভাবনা নেই। সাদা মেঘ আছে দূর পাহাড়ের কোলে। রোদের ওপর এখানকার আকাশ যেন দোয়াত ওলটানো নীল কালি। বাসব বলে, গেলেই হয়। গাউন আর শাল জড়ানো কলি পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে কটেজের দিকে। ড্রেস চেঞ্জ করবে। কুয়াশা ভেজা ধবধবে গালে, কপালে সেঁটে আছে মাথা থেকে নেমে আসা চুল। আঙুল চালিয়ে সেগুলো কানের পাশে রেখে কলি ঢুকে গেল ঘরে। বাসবের চেঞ্জ করার কোনও দরকার নেই। জুতোটা শুধু পরে নিতে হবে। এখানে আসার পর থেকে জিম্স, জ্যাকেট কোনওটাই খোলেনি। বেশ ভালই ঠান্ডা!

‘রিশপ’-এ বাসবরা পৌঁছেছে বেলা এগারোটা নাগাদ। লাভা থেকে ট্রেক করে এসেছে। রাস্তা মাত্র চার কিলোমিটার। বিশেষ কষ্ট হয়নি। চড়াই সামান্য ছিল, নিবিড় অরণ্য ভুলিয়ে দিচ্ছিল ক্লান্তি। সমস্যা বলতে একটাই, ঘন কুয়াশায় ছ’ফুটের বেশি কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। জলের কুলকুল শব্দ আর অচেনা পাখির মিষ্টি ডাক ছিটকে ছাটকে আসছিল সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিসীমার আড়াল থেকে। সন্তর্পণে হাঁটছিল দু’জন। ক্রমশ প্রতীয়মান হতে থাকে শব্দের উৎস। পথ কেটে যাচ্ছে ছোট্ট অনামী সব ঝরনা, গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে বসছে বর্ণিল পাখি। সারাক্ষণ বাসব, কলিকে ঘিরে ছিল ভেজা বনজ গন্ধ। কুয়াশা বাসবদের সঙ্গী হয় পাকদণ্ডির গোড়া থেকেই। ললিতা তামাং বলেছিল পোর্টার কাম গাইড সঙ্গে নিতে। অজানা অচেনা রাস্তা, ওয়েদার খারাপ… রাজি হয়নি বাসব। এখান থেকে ঘুরে যাওয়া বন্ধুদের মুখে শুনেছে, পথ হারানোর ভয় নেই। রাস্তা শুধুমাত্র রিশপেই গেছে। প্রকৃতির গভীর নির্জনতায় কলিকে সে আগে কখনও পায়নি। নৈকট্যর প্রত্যাশাও ছিল অনেক দিনের। কলিরও নিশ্চয়ই ছিল, তাই তো আবছা অস্পষ্ট পাকদণ্ডি দেখে সে একটুও ঘাবড়ায়নি। তবে আধ ঘণ্টা হাঁটার পরই দু’জনেই উপলব্ধি করেছিল, গাইড কাম পোর্টারের প্রয়োজনীয়তা। পাহাড়ে ট্রেক করার অভিজ্ঞতা ওদের নেই। চড়াই ভাঙতে গিয়ে

অল্প লাগেজের নিজেদের রুকস্যাক দুটো কী ভীষণ ভারী লাগছিল আর হামেশাই মনে হচ্ছিল পথ ভুলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। রাস্তা তেমন যত্ন করে বানানো নয়, কুয়াশার কারণে দূরের পথরেখাও অদৃশ্য। এরকম বার কয়েক থমকে যাওয়ার পর, সাহস সঞ্চারের জন্যে দু’জনেই পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে একে অপরের ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল দীর্ঘক্ষণ ধরে। পুরুষ হিসেবে বাসবকেই উদ্যোগ নিতে হয়েছিল প্রথমে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চুমু ওদের স্বপ্নের বাস্তবতা। আকণ্ঠ তৃষ্ণাও ছিল ওই চুম্বনে। কারণ, কাল রাতে পাশাপাশি শুয়েও ওরা পরস্পরকে আদর করতে পারেনি। প্রকৃতিতে উসকানি ছিল প্রচুর, দেওয়ালের ওপারে সারাক্ষণ হাওয়ার শনশন আর তেমনই মারাত্মক ঠান্ডা।

বাসবরা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে এসেছিল লাভাতে। দীর্ঘ পথ। যখন পৌঁছাল, প্রায় সন্ধে। সমস্ত হোটেল বুকড। কোথাও রুম না পেয়ে বিপুল অনিশ্চয়তা সহকারে বাসব, কলি কফি খেতে ঢুকেছিল ললিতা তামাঙের রেস্তরাঁতে। ললিতাকে বলেছিল সমস্যার কথা। লোকাল মেয়ে, যদি কোনও ব্যবস্থা করে দেয়। ললিতা বলেছিল, পুজোর পর এই সময়টায় লাভাতে রুম বুক না করে আসা খুবই বোকামি হয়েছে বাসবদের। লাভায় হোটেল কম। এখন ভীষণ রাশ। ললিতা একটা ব্যবস্থাই করতে পারে, এক রাতের জন্যে থাকতে দিতে পারে ওদের বাড়িতে। পরের দিন রিশপে গেলে জায়গা পাওয়া যাবে।

তখনকার মতো নিশ্চিন্ত হয়েছিল বাসব, কলি। এই ঠান্ডায় বাইরে তো আর রাত কাটানো যায় না। ললিতাদের বাড়ির সামনের ঘরটাই বার অ্যান্ড রেস্টোরেন্ট অ্যান্ড স্টেশনারি শপ। বাসবদের থেকে একটু তফাত রেখে স্থানীয় মানুষ নিশ্চুপে মদ্যপান করছিল। তাদের ছোট ছোট চোখ, সরল মুখমণ্ডল। উচ্ছ্বাসহীন ওই পানভোজন যেন মানুষগুলোর দিনের একটা দরকারি কাজের মতোই। কলির মধ্যে তাই কোনও অস্বস্তি দেখা যায়নি। এমনিতে মদ্যপায়ীদের খুবই অপছন্দ করে। ললিতাদের পিছনের ঘর দুটোয় ফ্যামিলির আটজন থাকে। একটা ঘরে বাসবদের খাট ছেড়ে দিলেও, মুখে অজস্র কুঞ্চন, চোখ প্রায় দেখাই যায় না এমন চারজন বৃদ্ধা শুয়ে ছিল মেঝেতে। ওদের মঙ্গোলয়েড মুখের কারণে বাসবের মনে হচ্ছিল, তারা বুঝি কোনও চৈনিক উপকথায় চরিত্র হিসেবে প্রবেশ করেছে। চার বৃদ্ধাকে রাখা হয়েছে, বাসব, কলির সংযম পরীক্ষার জন্যে। গোটা বাড়িটাই কাঠের। নড়াচড়া করতে আশঙ্কিত হচ্ছিল, এই বুঝি আওয়াজ ওঠে। ওদের বাড়ির স্যাঁতসেঁতে লেপ টেনে ঘুমানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না দু’জনের।

গত রাতের জমিয়ে রাখা উষ্ণতা বাসব, কলি বিনিময় করছিল পাকদণ্ডি বেয়ে আসার পথে। শেষ বারের চুম্বনের সময় একটা পাখি অলক্ষ্যে খ্যাকখ্যাক করে ডেকে উঠেছিল। বিচ্ছিরি ডাক। যেন বিদ্রূপ। হানিমুন কাপলের মতো ছেলেমানুষি দেখে পাখিটা বোধহয় মজা পেয়েছিল। বাসব আটত্রিশ, কলি চৌত্রিশ। এখন কি আর এত আবেগ মানায়? হাঁটতে হাঁটতে বাসবরা কখন যেন এসে পড়েছিল এই রিসর্টে। পিছন রাস্তা দিয়ে ঢুকেছিল, নামটাও দেখতে পায়নি। কুয়াশার আস্তরণে নিঝুম গোটা পাঁচেক কটেজ। গাছপালা, মাটি সবই আবছা। একটা ছায়া শরীর সামনে এসে স্পষ্ট হয়েছিল। রিসর্টের বয়। বাসব জানতে চায়, রুম মিলেগা?

মিলেগা বাবু৷ পুরা কটেজ লেনা পড়েগা। বলে ছেলেটি কটেজের চার্জ বলেছিল। ভাড়া বেশ চড়ার দিকে। না হওয়ার কিছু নেই। যথেষ্ট রিমোট এলাকা। বয় বিল্লু গুরুং সবচেয়ে ভাল পজিশনের কটেজটাই দিয়েছে বাসবদের। কটেজের নাম্বারও এক। ঘরে বসেই সরাসরি তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়। সর্বমোট আটটা পিকের দেখা মেলে রিশপে। বিশাল রেঞ্জ। আশপাশের আর কোনও ট্যুরিস্ট স্পটের এই সুনাম নেই। উপত্যকাটা বাটির তলার অংশের মতো। গোল করে ঘিরে আছে সবুজ পাহাড়, জঙ্গল। এখন বরফশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে না। মেঘ জমে আছে উত্তরে। দুপুরে লাঞ্চ সার্ভ করার সময় বিল্লু বলেছিল, মওসম আচ্ছা হো যানে সে তো আপলোগ টিফিনদাঁড়া যা সকতে হ্যায়। বহুত আচ্ছা সানসেট দেখনে মিলেগা।

খানিক আগে সেখানেই যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে ড্রেস চেঞ্জ করতে গেল কলি। ওই ভিউ পয়েন্টের কথা বন্ধুদের থেকে জেনেছে বাসব। নামটা টিফিনদাড়া নাকি থ্রি পিন দারা এই নিয়ে মতভেদ আছে। জায়গাটা খুবই সুন্দর, দেড় কিলোমিটার টানা খাড়াই ভেঙে উঠতে হয়। আশা করা যায় কলি ধকলটা নিতে পারবে। কাজের জায়গায় যথেষ্ট পরিশ্রম করে। মাল্টিন্যাশনাল ফোন কোম্পানির একজ়িকিউটিভ র‍্যাঙ্কে আছে। পোস্টিং কলকাতায়। বারোচোদ্দো ঘণ্টা থাকে অফিসে। তুলনায় বাসবের চাকরি সুখের। সরকারি অফিসার সে।

কলি বেরিয়ে এল। পায়ে স্নিকার, কমলা রঙের সালোয়ার-কামিজ, সবুজ কার্ডিগান। বাইরে বেরোচ্ছে বলে অভ্যেসবশত পারফিউম ইউজ করেছে। এখানে যার কোনও দরকার নেই। বলল, কী হল, চলো!

হ্যাঁ, যাই। জুতোটা পরে নিই। বলে, বেতের চেয়ার ছেড়ে উঠল বাসব

কটেজের গা বেয়ে মোরামের রাস্তা উঠেছে রিসর্টের মূল টেরাসে। চারটে সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চ, দুটো লোহার ফ্রেমের দোলনা। ইতিউতি নানারঙের ফুলের বেড। বাসব এসে দেখল একটা দোলনায় দুলছেন ষাট ছুঁইছুঁই বাদামি চুলের এক বৃদ্ধা। চুল অবশ্যই ডাই করা। পরনে সাদাটে সালোয়ার-কামিজ, কালো শাল। মহিলা এক দৃষ্টিতে দেখছেন বাসব, কলিকে। শহরের ভিড়ে অচেনা কাউকে না দেখারই চেষ্টা করে মানুষ। নির্জনতায় এলে স্বভাবটা বদলে যায়। বাসররাও একটু বেশি সময় ধরে দেখছিল ভদ্রমহিলাকে। দোলনার পিছনের ধাপ থেকে উঠে এলেন সাদা ফ্রেঞ্চকাট, অল্প চুলের বৃদ্ধ। ট্র্যাকসুট ছাড়াও একটা জ্যাকেট পরেছেন। বিল্লুর থেকে বাসব জেনেছে, গতকাল এঁসেছেন এঁরা। থাকছেন রিসর্টের পিছনের দিকে পাঁচ নাম্বার কটেজে। বাসবদের আগে এসেও কেন এক নাম্বার কটেজ নেননি, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ওটার ভিউ সাইড সবচেয়ে ভাল।

বাসব এগিয়ে যাচ্ছিল কিচেন কাম ডাইনিং কটেজটার দিকে। বিল্লুকে দরকার। বলে দেবে টিফিনদাঁড়ার রাস্তা। এমন সময় পিছন থেকে ভদ্রলোক ডেকে উঠলেন, হ্যালো, আপনি কি বিল্লুকে খুঁজছেন?

দাঁড়িয়ে পড়ে বাসব। ঘাড় ফিরিয়ে বলে, হ্যাঁ।

ভদ্রলোক বলেন, এইমাত্র লাভায় গেল দোকানবাজার করতে। ডাইনিংয়ে এখন ওর ওয়াইফকে পাবেন।

বাসবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে, বিল্লুর বউকে কি জিজ্ঞেস করবে ভিউ পয়েন্টের রাস্তা? এ এক অদ্ভুত রিসর্ট, মালিক বসে আছে লাভায়। বিল্লুই সব দেখাশোনা করছে। এখনও রেজিস্টারে নাম লিখতে হয়নি বাসবদের। মালিক সুশীল শেরপা আজ রাতে এসে লেখাবে।

আপনারা কি কোথাও বেরোচ্ছিলেন?

জানতে চেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসেন

ভদ্রলোক।

বাসব বলে, টিফিনদাঁড়ায় যেতাম। কোন দিক দিয়ে যেতে হবে জানি না। তাই বিল্লুকে…

কথা কেড়ে নিয়ে ভদ্রলোক সহাস্য মুখে বলে ওঠেন, আমি তা হলে ঠিকই আন্দাজ করেছি। আরে ভাই, আমরা তো আপনাদের জন্যেই বসে ছিলাম।

কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বাসব, কলির মুখেও ফুটে উঠেছে সপ্রশ্ন বিস্ময়। ভদ্রলোক দোলনার দিকে মুখ ফিরিয়েছেন, ডাকছেন স্ত্রীকে, চলে এসো, পার্টনার পেয়ে গেছি।

এবার যেন ব্যাপারটা খানিক আন্দাজ করতে পারছে বাসব। দোলনা থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন মহিলা। ভদ্রলোক বাসবের দিকে ফিরে বলেন, টিফিনদাঁড়ার রাস্তা আমি জেনে নিয়েছি। বুড়োবুড়ি যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আপনাদের মতো ইয়াং পার্টনার খুঁজছিলাম। প্রোভাইডেড ইফ ইউ অ্যাগ্রি।

কলি বলে ওঠে, এ কী বলছেন। আমাদের ভালই লাগবে একসঙ্গে যেতে।

ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন। নমস্কারের ভঙ্গি করে বললেন, আমি বনলতা। ভদ্রলোককে উদ্দেশ করে বলেন, ও নিশ্চয়ই এখনও নিজের নামটাই বলেনি। খালি কাজটাই বোঝে আগে।

অপ্রতিভ হলেন ভদ্রলোক। বললেন, ওহ সরি, আমি অমিতাভ রায়।

নমস্কার সহযোগে বাসব নিজের নাম বলে। কলি বলে পুরো নাম, কথাকলি। পদবি বলার চল ইদানীং উঠে গিয়েছে। অমিতাভবাবু বলেন, চলুন, দেরি না করে যাত্রা শুরু করে দিই। ঘণ্টাখানেক মতো লাগবে।

দুটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল বাসবদের পাশ দিয়ে। থমকে দাঁড়াল। খানিক আগেই দু’জনকে গেট পেরিয়ে ঢুকতে দেখেছে বাসব। এদের দলটা অবশ্য দুপুরবেলা এসেছে, গাড়ি করে। তিনটে কাপল। দুটো বাচ্চা। এখন কোথায় গিয়েছিল বোঝা যাচ্ছে না। একটি ছেলে বলে, আপনারা কি সানসেট দেখতে যাচ্ছেন ভিউপয়েন্ট থেকে?

প্রমাদ গোনে বাসব, এরাও নিশ্চয়ই সঙ্গী হতে চাইবে। গ্রুপটা খুবই ইয়াং, সবারই তিরিশের নীচে বয়স। এদের সঙ্গে ঠিক মানাতে পারবে না সে। তবু মিথ্যে তো বলা যায় না। বাসব বলে, হ্যাঁ। টিফিনদাড়ায় যাচ্ছি।

প্লিজ, একটু ওয়েট করুন। আমরাও যাব আপনাদের সঙ্গে। আর্তিমাখা গলায় বলল ছেলেটি। দু’জন প্রায় দৌড়ে নেমে গেল নিজেদের কটেজের দিকে। বাসব আড়চোখে কলিকে দেখে, এতজন জুটে যাওয়া ব্যাপারটা ওর নির্ঘাত পছন্দ হচ্ছে না। দু’জনেই চেয়েছিল তিনটে

দিন নির্জনতম জায়গায় গিয়ে কাটাতে। দার্জিলিং মেল থেকে নেমেই যে যার সেলফোনের সুইচ অফ করে দিয়েছে। এখন অবধি টানা একদিনের নির্জনতা পায়নি। আর বোধহয় পাওয়া যাবে না। এত ক’জনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেলে কোলাহল বাড়বেই।

কলিকে দেখে ধরা যাচ্ছে না কতটা অসন্তুষ্ট হয়েছে। চেয়ে আছে রিসর্টের পিছনের ঘন জঙ্গলের পাহড়ের দিকে। বনলতা কিন্তু খুশি হয়েছেন। বলছেন, ভালই হল টিমটা বড় হয়ে। বেশি ফাঁকা আমার আবার ঠিক ভাল লাগে না। কাল তো গোটা রিসর্টে শুধুমাত্র আমরাই ছিলাম। বাবা, দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন।

মহিলার কথায় মন দিয়েছিল কলি। প্রশ্ন করে, আচ্ছা, লাভাতে অত ভিড়, এখানে এত ফাঁকা কেন?

বনলতা উত্তর দেওয়ার আগেই অমিতাভ বলে ওঠেন, সে কী, আপনারা জানেন না! বিল্লু বলেনি আপনাদের?

কী বলুন তো? জানতে চায় বাসব। অমিতাভ বলেন, এখানে তো সাত দিন ধরে ইলেকট্রিসিটি নেই। লাইনে কাজ হচ্ছে। গোটা রিশপ এখন অন্ধকার। ট্যুরিস্টরা এসে যখনই শুনছে, চলে যাচ্ছে লোলেগাঁও। এদের দলটা দেখলাম রয়ে গেল।

ছেলেগুলোর কটেজের দিকে নির্দেশ করে বললেন অমিতাভ। বাসব বলে, আমরা ট্রেক করে এসেছি তো, জানে, ক্লান্ত আছে এক্ষুনি আর কোথায়ও যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই বোধহয় বলেনি।

কলি বলে, না, আমার যতদূর মনে পড়ছে, বিল্লু একবার বলল, ঝড়বৃষ্টিতে তার ছিঁড়ে গেছে, আজকের দিনটা লণ্ঠনে চালাতে হবে। বাথরুমে জল দিয়ে রাখবে ওরা।

ইনফর্মেশনটা হয়তো অনেক কথার মাঝে টুক করে বলে নিয়েছে বিল্লু, বাসব খেয়াল করেনি। যুবক-যুবতীর দল উঠে এসেছে বাগান চত্বরে। বউদের মধ্যে একজন শাড়ি, পারবে সামলে উঠতে? বাচ্চা দুটো দু’-আড়াই বছরের হবে। যার মধ্যে একটি কন্যা।

বাসবদের অবাক করে তিন যুবক শুধু এগিয়ে আসছে হাসিমুখে। বাচ্চা, বউ পড়ে রইল পিছনে। কলি ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করে, ওঁরা যাবেন না?

একটি ছেলে বলে, ওরা পারবে না পাহাড়ে উঠতে।

কেন পারব না। ওই তো ওঁরা দু’জন যাচ্ছেন। ঝাঁঝ মেশানো অভিমান নিয়ে বলে উঠল একটি বউ। কলি, বনলতার উদাহরণ দেখিয়ে বলল কথাটা।

অন্য একটি ছেলে বউদের বলল, এঁদের পাহাড়ে ওঠার অভ্যেস আছে। জুতো পরেছেন দেখেছ, তোমাদের তো সব চটি।

বাচ্চা দুটো মায়েদের হাত ঝাঁকিয়ে বায়না করছে পাহাড়ে উঠবে বলে। মায়েরা বলছে, যা না, বাবাকে বল।

কলি তিন যুবককে বলে, সাবধানে হাঁটলে চটিতে সমস্যা হবে না। নিয়ে নিন ওঁদের। না বউদি, এদের ঝামেলা আপনি জানেন না। চার পা চড়াই ভাঙতে গেলেই হাঁপিয়ে !

বসে পড়ে। সারা রাস্তা যা খেল দেখাচ্ছে

মোটেই না। তখন শরীরটা খারাপ ছিল আমার। প্রতিবাদ জানায় এক বউ।

ছেলেটি গ্রাহ্য না করে বলতে থাকে, ইচ্ছে ছিল লাভা থেকে ট্রেক করে এখানে আসব। তখন ওরা না না করল। এখন আপনাদের দেখে শখ হয়েছে। কিন্তু জানি পারবে না। মাঝরাস্তা থেকে ফিরে আসতে হবে আমাদের। তারপর বাচ্চা দুটো রয়েছে, ওরা অতটা পারে নাকি?

বাসবের বলতে ইচ্ছে করছিল, বাচ্চারাই পারে। ওদের বডিওয়েট কম। মেজাজ ভাল থাকলে অনেক দূর টেনে দিতে পারবে।

বলে না। ছেলেগুলো ভাবতে পারে তিনটে ইয়াং বউয়ের সংসর্গ পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে বাসব। এদের রুচিও তেমন উঁচু পরদার নয়, কোনও আলাপ ছাড়াই কেমন চট করে কলিকে বউদি ডেকে বসল। সারা রাস্তা এরা নানা ধরনের খেলো গল্প, ইয়ারকি করতে করতে যাবে। দমে যাওয়া মন নিয়ে বাসব এগোতে থাকে গেটের দিকে।

রিসর্ট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের খাড়াই রাস্তাটা গিয়েছে টিফিনদাড়ায়। কিছুটা ওঠার পর তিন যুবক পিছন ফিরে রেখে আসা স্ত্রী-সন্তানকে দেখে। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাসব অবাক হয়। ভেবেছিল, বউয়েরা নিশ্চয়ই অভিমান ভারী শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাস্তবে ঘটছে উলটো, তিন যুবতী এবং বাচ্চা দুটো সোৎসাহে হাত নাড়ছে। এ পাশে যুবকরাও হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে পায়ে পায়ে এগোয়। এই পরিস্থিতিটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে বাসব, দাম্পত্যের নিরুপায় অ্যাডজাস্টমেন্ট, নাকি সহজ সরল ভালবাসা?

রাস্তা প্রথম থেকেই খাড়াই। যথেষ্ট পরিশ্রম হচ্ছে উঠতে। বাসব সিগারেট ধরিয়ে ছিল। আধখানা খেয়ে ফেলে দিতে হয়েছে। এখনও অবধি দলের কেউ অবশ্য বসে পড়েনি। বয়স্ক দু’জন সবার আগে হাঁটছেন। তারপর তিনটি ছেলে। সব শেষে বাসব, কলি। হাঁটার শুরু থেকেই কলি বাসবের হাত ধরে নিয়েছে। সেটা ছুঁয়ে থাকার বাসনায়, নাকি নিজেকে তিন যুবকের নজরের বাইরে রাখার জন্যে, বুঝে উঠতে পারছে না বাসব। সৌজন্যবশতই ছেলেগুলো তাদের অন্তরঙ্গতায় বিঘ্ন ঘটাতে আসবে না। তবে ওই তিনজনের সম্বন্ধে বাসবের যে আশঙ্কা হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটা এখনও অবধি লক্ষ করা যায়নি। নিজেদের মধ্যে সাধারণ কথাবার্তায় মেতে আছে। অভব্য আচরণ, অরুচিকর মন্তব্য কোনও কিছুই করেনি। ওদের চেহারায়, উপস্থাপনায় একটু পালিশের অভাব আছে এই যা। বহিরঙ্গ দেখে ওদের বিচার করা উচিত হয়নি বাসবের। ভুলটা অবশ্য অনেকেই করে।

নির্জনতার মাঝে সামান্য আড্ডা, হাসি আবহকে অন্য মাত্রা দেয়। পরিবেশটা জিয়ন্ত হয়ে ওঠে। দল বেঁধে পাহাড়ে উঠতে ভালই লাগছে বাসবের, কলিও উপভোগ করছে নিশ্চয়ই। এই মুহূর্তে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বিষম বাঙ্ময়। বড় বড় গাছের ডালপালা ভেদ করে নেমে এসেছে শেষ বিকেলের আলো, আলপনার মতো চিত্রিত হয়েছে পথ। বাসবের মনে হয় তারা যেন বিরামহীনভাবে বহু বছর পিছনে ফেলে এই পথ ধরে চলেছে। কলির কি এমনটাই অনুভূত হচ্ছে? জানতে বাসব জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগছে? বাসবের গায়ে আরও একটু ঘেঁষে এসে কলি বলে, অসাধারণ! ইচ্ছে হচ্ছে বাকি জীবনটা এখানেই থেকে যাই।

বাসব হাসে। বলে, বেড়াতে এসে বেশিরভাগ মানুষেরই এই ইচ্ছেটা হয়। কলি বলে,

ঠিক আছে মানলাম, বাকি জীবনটা এখানে কাটানো যাবে না। ওঁদের মতো বুড়ো বয়েস পর্যন্ত আসতে তো পারি। দু’জনের মধ্যে কী মিল দেখেছ! এই বয়েসে এসেও ওঁদের ভালবাসা ফুরিয়ে যায়নি। তুমি পারবে আমাকে এতদিন ভালবাসতে?

কিছু প্রশ্ন থাকে, উত্তর পাওয়ার জন্যে করা হয় না। জিজ্ঞাসামাত্রই জানিয়ে দেওয়া হয় মতামত। কলির প্রশ্নটা সেরকমই। বাসব তিন যুবকের মাথার ওপর দিয়ে দেখে অমিতাভ, বনলতাকে। সত্যিই দু’জনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং দারুণ! ছেলেমেয়ে অথবা কমবয়েসি আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই আছে; তাদের ওপর নির্ভর না করে চলে এসেছেন পাহাড়ে। ইচ্ছে আরও একটু ওপরে ওঠার। বাসবদের দেখা না পেলে, একে অপরের ওপর বল-ভরসা করে উঠে যেতেন ঠিক। দাঁড়িয়ে পড়েছেন অমিতাভ। হাঁফাচ্ছেন। বনলতা বললেন, একটু জল খেয়ে নাও। কষ্ট কম হবে।

কাঁধঝোলা থেকে জলের বোতল বার করলেন বনলতা। ছেলের দলও এক বোতল জল নিয়েছে। বাসবদের নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। তেষ্টা পেলে এদের থেকে নিয়ে চালাতে হবে।

জল খেয়ে বোতল ফেরত দিলেন অমিতাভ। বনলতা সেটা ব্যাগে ঢোকাচ্ছেন, তিন যুবকের একজন এগিয়ে গেল, দিন ম্যাডাম, ব্যাগটা আমায় দিন। বইতে কষ্ট হচ্ছে আপনার।

না না, কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না। ঠিক আছি আমি।

বনলতার আপত্তিতে কর্ণপাত না করে, ছেলেটি ব্যাগটা প্রায় কেড়েই নিল। কে বলবে, মাত্র আধ ঘণ্টা আগে দু’জনের পরিচয় হয়েছে! যেন নিজেরই কোনও মাসি-পিসির জন্যে করল কাজটা। রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন বৃক্ষরা এরকম দৃশ্যের সাক্ষী হওয়ার প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।

অবশেষে দলটা উঠে এল টিফিনদাঁড়ায়। সিমেন্ট বাঁধানো লালচে চত্বর। আঁকাবাঁকা অনেক ফাটল। বৃষ্টি, কুয়াশার কারণে ঘন সবুজ শ্যাওলার আস্তরণ এদিক ওদিক। ফাটলে মাথাচাড়া দিয়েছে ঘাস, গুল্ম। সিমেন্টের দুটো বেঞ্চ। একটাতে বাসবরা, অন্যটাতে অমিতাভ, বনলতা। ছেলে তিনজন চাতাল থেকে নেমে জঙ্গলে পায়চারি করছে। সকলেই একটু বিমর্ষ, এখনও তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়নি। একগুঁয়ে সাদা মেঘ রয়ে গিয়েছে উত্তরে। পাশের বেঞ্চে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় বাসব, কী মনে হচ্ছে, দেখা যাবে না পিকগুলো? আর একটু পরেই তো সন্ধে নামবে।

অমিতাভ বললেন, চান্স এখনও আছে। দুপুরের পর থেকে মেঘ নীচের দিকে নামতে থাকে। ওটাও কিছুটা নামবে আশা করা যায়।

বাসব সিগারেট ধরিয়ে উত্তর দিকে চেয়ে বসে আছে। কলি খুবই ক্লান্ত, মাথা রেখেছে বাসবের কাঁধে। ক্লান্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, এতটা একটানা উঠে আসার পরিশ্রম তো আছেই, দুপুরেও শোয়নি। লাঞ্চের পরেই চলে গিয়েছিল লনে। কুয়াশায় প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। দেখছিল, না দেখতে পাওয়ার রহস্যময়তা। কলিকে রেস্ট নিতে বলাতে, এমনটাই উত্তর দিয়েছিল। চাতালের নীচে একটা শোরগোল মতো ওঠে। সচকিত হয়

বাসব, কলি মাথা তুলে নিয়েছে কাঁধ থেকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে ওপরে। প্রবল উত্তজনায় আঙুল তোলে উত্তর দিকের এক কোণে। বলে, ওই দেখুন, দেখা যাচ্ছে!

বাসবরা তড়িঘড়ি পায়ে ছেলেটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর আঙুল বরাবর তাকিয়ে চমকে ওঠে, সদ্য সিঁদুর দানের কপালের মতো একটি শৃঙ্গ! এই অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা খানিক আগেই হয়েছে, তুষারশৃঙ্গ অনেকটাই উঠেছে জেগে। বেঞ্চে বসে থাকার কারণে গাছের আড়ালে রয়ে গিয়েছিল দৃশ্যটা। আরও অনেকগুলো বরফচূড়া ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হচ্ছে। নেমে যাচ্ছে মেঘ, সামনে এখন আশ্চর্য এক হোলিখেলা। দলের কারও মুখে কোনও কথা নেই। রুদ্ধশ্বাসে দেখে যাচ্ছে অপার সৌন্দর্য। এমন সময় বাসবের দৃষ্টি টেনে নেয় চাতালের নীচের একটা দৃশ্য। ছবিটা চেনা চেনা অথচ ঘোর অবাস্তব। হুঁশ ফেরে বাসবের, পাশে কলি নেই। চাতালের নীচে চলে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে তুষারশৃঙ্গের দিকে চেয়ে। সূর্যাস্তের আলোয় ওকেই এখন লাগছে রডোড্রেনডন গাছ।

বাসব দ্রুত চাতাল থেকে নেমে কলির পাশে দাঁড়ায়। বলে, কী হল, এখানে নেমে এলে! কলির পা থেকে ফুট চারেক দূরত্বে খাদ। সে দিকে তাকিয়ে কলি বলে, ঝাঁপ মারব। কোন দুঃখে? মজার সুরে জানতে চায় বাসব।

দুঃখে নয়, আনন্দে। এরকম একটা দৃশ্য দেখে নিয়ে মরে যাওয়াটা বড় মনোরম হবে। এ ছাড়া মৃত্যু মানে তো হসপিটালের গন্ধ অথবা রাস্তার অ্যাক্সিডেন্ট।

কলি কথাগুলো ইয়ারকি করে বলছে জেনেও, ইচ্ছেটাকে আরও তরল করে দিতে বাসব বলে, তুমি মরে গেলে আমার কী হবে?

কলি বলে, তা হলে চলো, হাতে রুমাল বেঁধে দু’জনে একসঙ্গে ঝাঁপ মারি।

অ্যাটেম্পটটা আজ না নেওয়াই ভাল। সঙ্গে অনেকে আছে, যেই দু’জনে হাতে রুমাল বাঁধতে যাব, ওরা আমাদের অভিসন্ধি বুঝে যাবে। আর ব্যাপারটা বড্ড নাটুকে। কলিকে হাসানোর জন্যে বিশেষ ভঙ্গিসহ কথাগুলো বলল বাসব।

হাসল না কলি, বাসবের বুকের কাছে এসে বলল, আসলে তুমি ভয় পাচ্ছ।

হ্যাঁ, পাচ্ছি। এখন চলো তো ওপরে। বলে, কলির হাত ধরে এগোয় বাসব। তিন যুবকের একজন ক্যামেরা তাক করে সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, দাদা, এক মিনিট। পিছনে সানসেট রেখে আপনাদের একটা ছবি তুলে দিই।

একদম না। হাত তুলে বেশ রূঢ়ভাবে আপত্তি জানিয়ে ফেলে কলি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমার ছবি একেবারেই ভাল ওঠে না।

প্রথম ধাক্কাতেই ছেলেটা এমন গুটিয়ে গিয়েছে, ক্যামেরা নামিয়ে সে এখন কেটে পড়তে পারলে বাঁচে।

সূর্যাস্ত পুরোটা দেখা হল না। তাড়া দিলেন অমিতাভ। বললেন, আমাদের কারও কাছেই টর্চ নেই। সন্ধের আগে রিসর্টে ফিরতে হবে।

বিকেল ফুরোয়নি, এখনই জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝির ডাক। ঝিঁঝি নাও হতে পারে, ডাকটা বেশ চড়া। বাসবদের দল গল্প করতে করতে নেমে আসছে। ওঠার

তাড়ায় তিন যুবকের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় হয়নি। ভিউ পয়েন্ট থেকে নেমেই বনলতা নতুন করে আলাপপর্ব সারলেন। যুবক ত্রয়ীর নাম, অশেষ শুভঙ্কর পল্লব। প্রথম দু’জন রেলে চাকরি করে, পল্লবের বিল্ডিং মেটেরিয়ালের ব্যাবসা।

ফেরার পথে অমিতাভ একটা বিশেষ জরুরি কাজ করাচ্ছেন দলের সবাইকে দিয়ে। কাজটা প্রথমে নিজেই শুরু করেছিলেন, বাসবদের যখন সানসেট দেখা ফুরোচ্ছে না, অমিতাভবাবু ততক্ষণে সিন্থেটিক ঝোলায় পুরছেন চাতালে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের জঞ্জাল। কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল, চকোলেট, বিস্কুটের ফয়েল, মানে প্লাস্টিকের যাবতীয় কিছু। এ সবই ট্যুরিস্টের দান প্রকৃতিকে। চাতাল থেকে নেমে আসার পর পল্লব বলল, আপনি স্যার শুধু ঝোলাটা ধরে থাকুন, জিনিসগুলো আমরা তুলে দিচ্ছি।

সেইমতো কাজ চলছে। বনলতাকেও নিরস্ত করা যায়নি। ঝোলা হাতে, সাদা ফ্রেঞ্চকাটের অমিতাভবাবুকে এখন চার্চের ফাদারের মতো দেখতে লাগছে। বনলতার কাছে জানা গেল, উনি পাহাড়ে গেলেই ঝোলাটা সঙ্গে নিয়ে যান। বড় ছেলে টোরেন্টোতে থাকে, ওর ওখানে গিয়ে এনেছিলেন ব্যাগটা। খুবই হালকা এবং নরম, সহজেই পকেটে ঢুকে যায়। কথায় কথায় বাসব নিজের একটা কৌতূহল মিটিয়ে নিয়েছে। বনলতাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, আপনারা তো আমাদের আগে এসেছেন, এক নাম্বার কটেজ ফাঁকাই ছিল, নিলেন না কেন? ওটাই তো বেস্ট পজিশন।

বনলতা বললেন, জেনেবুঝেই নিইনি। আমার কর্তাটি স্লিপ ওয়াকার। রাতে কখন ঘুমের ঘোরে দরজা খুলে বেরিয়ে যাবে, আপনার এক নাম্বারের লনে কোনও বেড়া নেই। সরাসরি খাদ…

বাসব তখনই মনে মনে ঠিক করে নেয়, রাত্রে দরজায় ভিতর থেকে তালা দিয়ে শোবে। চাবি রাখবে নিজের কাছে। কলি তো জেগে থাকা অবস্থাতেই ঝাঁপ মারতে যাচ্ছে খাদে।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে রিসর্টের গেটটা দেখা যাচ্ছে। নামটা এখনও পড়া যাচ্ছে না। টিফিনদাঁড়ার উদ্দেশে বেরোনোর সময় নামটা অবশ্য দেখে নিয়েছিল বাসব, ন্যাওড়াভ্যালি রিসর্ট। ন্যাওড়াভ্যালি হচ্ছে রিসর্টের পিছনের পাহাড়টা। ঘন জঙ্গল সেখানে। বিল্লু বলছিল জঙ্গলে নাকি বড়সড় জন্তুজানোয়ার আছে, দু’-চারবার এ দিকেও চলে এসেছিল। তবে অনেকদিন হল আর আসেনি, হয়তো রিশপে ইলেকট্রিসিটি এসে যাওয়ার কারণে। বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে বছর চারেক হল।

বাসবদা, আর একটা সিগারেট দিন। চাইল শুভঙ্কর। তিন বন্ধু এই নিয়ে পাঁচটা সিগারেট ধ্বংস করল বাসবের। বলেছে, নীচে নেমে বাসবের জন্যে প্যাকেট কিনে এনে দেবে। ওদের স্টক শেষ। বিকেলে দুই বন্ধু সিগারেট কিনতেই বেরিয়েছিল। অনেকটা হাঁটার পর একটাই দোকান, তাও তখন খোলেনি। ওরা যখন ফিরে আসছে, বাসব, অমিতাভের আলোচনায় কান পেতে বুঝেছিল টিফিনদাঁড়ায় যাওয়া হচ্ছে। চান্সটা মিস করেনি।

শুভঙ্করকে সিগারেট দিয়ে বাসব বলল, এই তো এসেই গেলাম। এখন আবার ধরাবে কেন? চা খেয়েই খেয়ো।

নিজের পকেট থেকে দেশলাই বার করে সিগারেট ধরায় শুভঙ্কর। ধোঁয়া ছেড়ে বলে,

সাহস সঞ্চারের জন্যে দাদা, ওই দেখুন, এখন ওদের গিয়ে ফেস করতে হবে।

শুভঙ্করের দৃষ্টি নিশানা বরাবর তাকিয়ে বাসব দেখে, রিসর্টের বাগানে ঠিক আগের জায়গায় একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন বউ, দুই বাচ্চা। যাওয়ার সময় যেমন দেখে গিয়েছিল বাসবরা, তার থেকে একচুলও যেন নড়েনি। এখন শুধু মুখে সেই উচ্ছ্বাসটা নেই। আসল ঘটনা তো তা নয়, ওরা ছিল কটেজেই, সেখান থেকেই দলটাকে নেমে আসতে দেখে, বাগানে এসে দাঁড়িয়েছে।

গেট পেরিয়ে ঢোকার আগে বাসব একবার পিছন ফিরে দেখে ফেলে আসা টিলাটাকে, আগের চেয়ে যেন বেশি পরিচ্ছন্ন লাগছে। জানে মনের ভুল। হাতে করে জঞ্জাল সাফ করার জন্যে এমনটা মনে হচ্ছে। আবার এটাও ঠিক, এরপর যে ট্যুরিস্ট যাবে ওই পথে, পাহাড়টাকে শুদ্ধ, নির্মল মনে হবে। প্লাস্টিক আবর্জনা ফেলার আগে দুবার ভাববে।

হারিকেনের পলতে নামিয়ে দেওয়ার মতো বিকেল নিভে যাচ্ছে রিসর্টের বাগানে। অশেষ, শুভঙ্কর, পল্লব বউদের মান ভাঙাতে ব্যস্ত। হারিকেনের অনুষঙ্গে বাসবের খেয়াল পড়ে, লণ্ঠনের আলোয় কাটাতে হবে আজ সন্ধে থেকে রাত। এক দিক থেকে ভালই, নিজেদের কোনও উদ্যোগ ছাড়াই ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার সারা যাবে।

বাচ্চা দুটো বাবাদের খুব বিরক্ত করছে, আমাদের জন্যে কী কিনেছ দাও। এরা জন্ম থেকে দোকান চিনে যায় খুব। মনে করে পৃথিবীর সব প্রান্তে একটা দোকান থাকবেই। বিল্লু ফিরে এসেছে। রিসর্টের মালিক এখনও আসেনি। কাল সকালে হয়তো আসবে। অমিতাভ গারবেজের ঝোলাটা বিল্লুকে দিয়ে দেন। তিন যুবকের মান ভাঙানোর পর্ব এখন প্রায় ঝগড়ায় পর্যবসিত হয়েছে। মীমাংসার আগে এদের ছেড়ে কটেজে ফিরে যেতে অস্বস্তি হচ্ছে, থার্ড পার্সন হিসেবে কিছু করার এক্তিয়ারও নেই। বাগানের বেঞ্চে বসে সিগারেট ধরিয়েছে বাসব। তুষারশৃঙ্গের আবছা লালচে অবয়ব এখানে বসেও দেখা যাচ্ছে। অমিতাভ, বনলতাও কটেজে ফিরতে পারেননি। ওঁরাও নিশ্চয়ই কলহ-বিবাদ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছেন। নিজেরা অবশ্য বেঞ্চে বসে জুড়ে দিয়েছেন গল্প। কলি কিন্তু স্বভাববিরুদ্ধভাবে শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে অল্প দূরত্ব বজায় রেখে ঝগড়াটা দেখছে। ওর কৌতূহলের কারণটা বোঝা যাচ্ছে না। কলহরত তিন দম্পতির মধ্যে যে সব কথাবার্তা চলছে, তা অত্যন্ত মেঠো টাইপের। কলির স্ট্যাটাস ওই সব ঝগড়া থেকে অনেক উঁচুতে। এইমাত্র যেমন অশেষ তার বউকে বলছে, নিজের ওজনটা দেখেছ, অতটা খাড়াই উঠতে পারবে তুমি? ইচ্ছে থাকলেই শুধু হয় না, বডিটাও ফিট রাখা দরকার। কত দিন ধরে বলছি, সকালে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করো।

ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরোলে তোমার অফিসের ভাত দেবে কে শুনি? কটা দাসীবাঁদি রেখেছ? বলল অশেষের বউ।

শুভঙ্করের বউ তো কানে আঙুল দিয়ে রেখেছে। লাগাতার বুঝিয়ে যাচ্ছে শুভঙ্কর, তোমার পায়ের ব্যথার কথাটা ভাবো। হাঁটাহাঁটির ফলে যদি শুরু হয়ে যায় পেন, এখানে ডাক্তার কোথায় পাব?

কানে আঙুল দেওয়া সত্ত্বেও শুভঙ্করের বউ সব শুনতে পেল। বলল, তুমি ভাল করেই জানো, ওষুধ আমি নিয়ে এসেছি।

এবার পল্লবের কথায় কান পাতে বাসব। পল্লব বউকে বোঝাচ্ছে, আরে বাবা, তোমরা এখানে বসে যা দেখেছ, আমরা ওপরে গিয়ে তাই দেখেছি। পাহাড়গুলো তো সেই এক।

একদম ভুলভাল কথা বলবে না। ভিউ পয়েন্টটা তা হলে তৈরি হয়েছে কেন? ভালভাবে দেখা যায় বলেই তো! আমরা এখানে বসে বসে বোর হলাম।

বউয়ের কথা শুনে উপহাসের হাসি হাসে পল্লব। বলে, তোমরা তিনজন একসঙ্গে থাকলে বোর! সারাক্ষণই তো বকবক করে যাচ্ছ।

আর তোমরা বুঝি কিছু কম যাও? বাড়ির লোক, পাড়ার লোক দেখল বউবাচ্চা নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে। আসলে তো তা নয়। তোমরা আমাদের দিকে ঘুরেও দেখো না। নিজেদের নিয়ে মেতে আছ। আর একটু পরেই তো বোতল খুলে বসে যাবে।

পল্লবের বউয়ের কথা শেষ হতে না হতেই কলি ঢুকে গেল ওদের মধ্যে। বলল, এই শোনো, তোমরা সবাই আমাদের কটেজে চলে এসো। টি পার্টি হবে। জমিয়ে আড্ডা দেব। ট্রিট দেব আমি।

কাজিয়া থেমে গেল ওদের। কলি এবার ঘাড় ফেরাল অমিতাভ বনলতার দিকে। বলল, আপনারাও আসুন।

বনলতা বললেন, শুনে নিয়েছি। ফ্রেশ হয়ে যাচ্ছি এক্ষুনি।

কলির প্রস্তাবে ম্যাজিকের মতো শান্ত হয়ে গেল পরিস্থিতি। ম্যানেজমেন্টে কাজ করার ফল। যে যার কটেজে ফিরে যাচ্ছে। শুধুমাত্র শুভঙ্কর এগোল গেটের দিকে। বলল, নাঃ, দেখি, দোকানটা খুলল কি না। বাসবদার অনেক কটা সিগারেট খেয়েছি। পরম নিশ্চিন্তে সন্ধে নামল রিসর্টের বাগানে।

কলির কোলাহল আমন্ত্রণে বেশ অবাক হয়েছে বাসব। ওদের প্ল্যানই ছিল ক’টা দিন যথাসম্ভব লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকবে। দু’জনেই অফিস থেকে বেরিয়ে শিয়ালদায় এসে ট্রেন ধরেছে। তারপর থেকে ঘুরেই মরছে কেবল। লাভাতে চার জনের পাশে রাত কাটাল। এখানেও দু’দণ্ড সুস্থির হয়ে বসেনি দু’জনে। সানসেট দেখতে যাবে, জুটে গেল পাঁচজন সঙ্গী। সন্ধের পর থেকে একান্তে কাটানোর সুযোগ ছিল, বাতিল করল কলি। কটেজে ঢোকার আগে বাসব গিয়েছিল কিচেনে। বিল্লুকে অর্ডার দিয়েছে, চিকেন পকোড়া, ফিঙ্গার চিপস আর কফির। বলেছে, আড্ডা শুরু হওয়ার মিনিট পনেরোর মধ্যে নিয়ে আসতে। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাসব এখন পাজামা-পাঞ্জাবি আর শাল জড়িয়ে বসে আছে বিছানায়। দুটো হারিকেন দিয়ে গিয়েছে বিল্লু। একটা সোফার সেন্টার টেবিলে, অন্যটা ড্রেসিং আয়নার পাশের টুলে। সেখানে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম মাখছে কলি। পরনে পশমের হাউসকোট, সাদা বেসের ওপর লাল-নীল সুতো দিয়ে কলকা করা হাউসকোটটা সম্ভবত কাশ্মীরের। পশমের তলায় কলির কবোষ্ণ শরীরটাকে কল্পনা করে বাসব। মুখ ফুটে বলে ফেলে, ওদের না ডাকলেই পারতে।

বাহুতে ক্রিম ঘষতে ঘষতে মুখ ফেরায় কলি। বলে, কেন, ডাকলে অসুবিধেটা কী? মোম মসৃণ কলির হাতের দিকে চোখ রেখে বাসব মনের কথা চেপে যায়। বলে, ঠান্ডাটা

যা জমিয়ে পড়ছে, ওদের কি আর ঘর ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করবে। একগাদা খাবার অর্ডার দিয়ে এলাম।

কলি কোনও উত্তর না দিয়ে আয়নার দিকে ফেরে। চিরুনি তুলে নিয়ে ব্রাশ করছে চুল। গ্রীবা বেঁকে যাচ্ছে ধনুকের মতো। হারিকেনের হলুদ আলোকসম্পাতে অসামান্য মনোহারিণী হয়ে উঠেছে সে। কলিকে ভীষণভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে করে বাসবের। এই সুন্দর মুহূর্তটাকে অপচয় করাটাই অন্যায়।

খাট থেকে নেমে আসে বাসব। এমন সময় দরজায় ঠক ঠক। কোনও মানে হয়! অগত্যা দরজার দিকেই যেতে হয় বাসবকে। ছিটকিনি খুলতে প্রথমে ঘরে ঢোকে শুভঙ্কর, হাতে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট, চিপস, চানাচুর। এই প্রত্যন্তেও খালি হাতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বেধেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি পারে বটে! পিছন পিছন ঢুকল বাকিরা। হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানাল কলি। যেন কতদিনের চেনা। বাচ্চা দুটো দৌড়ে উঠে গেল বিছানায়। অমিতাভ, বনলতা এখনও আসেননি। বাসব বারান্দায় যায়। আকাশ পরিষ্কার, প্রবল হাওয়া দিচ্ছে। পাঁচ নাম্বার কটেজের দিকে তাকাতে দেখে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একে অপরকে ধরে, হাওয়ার ঝাপটা সামলে এগিয়ে আসছেন। কোনও একজনের হতে জ্বলন্ত টর্চ।

কটেজের রুম বেশ প্রস্তুত। ডাবল বেডের দুটো খাট, সোফা, চেয়ার, টুল সব মিলিয়ে সকলেই ভালভাবে বসতে পেরেছে। আড্ডা চলছে। এখনও ঠিক জমাট বাঁধেনি। এলোমেলো কথাবার্তা বিনিময় হচ্ছে গ্রুপ ওয়াইজ। হ্যারিকেনের আলোর কারণে অদ্ভুত একটা আলোআঁধারির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের থেকে তার ছায়া এখন অনেক বড়। এমনকী বাচ্চা দুটোরও। ওরা খুব একটা দুষ্টু নয়, বিছানার ওপর নিজেদের নিয়ে মেতে আছে। বিল্লু এখনও খাবার নিয়ে আসেনি। হাওয়া আছড়ে পড়ছে বন্ধ দরজায়। মনে হচ্ছে, ওই বুঝি বিল্লু এল। তিন বউয়ের নাম জানা গিয়েছে—পারমিতা, রত্না, লাবণি। বরেদের ওপর এদের রাগ কমেছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। এমনিতে হাসিখুশি আছে। এরকম একটা উপযুক্ত পরিবেশ সত্ত্বেও আলাপ আলোচনা কেমন যেন ছেঁড়াছেঁড়া। একত্র করার ফন্দি আঁটে বাসব। ঘোষণার মতো করে বলে ওঠে, এখন আমরা একটা খেলা খেলব।

সকলেই বেশ উৎসাহিত হয়। কেউ কেউ বলে, কী খেলা? কী খেলা? কলির হাসিমুখ, কপালে ভাঁজ। বাসব ফের বলে, খেলাটা অবশ্যই মহিলাদের ফেভারে। যেহেতু আজ তিন মহিলাকে আমরা অপরূপ সুর্যাস্ত দেখা থেকে বঞ্চিত করেছি।

স্বাভাবিকভাবেই তিন ইয়াং বউয়ের মুখে কৌতূহল উজ্জ্বল হয়। বাসব বলতে থাকে, শুধু তিনজন নয়, এই ঘরের পাঁচ মহিলাই এক এক করে তাদের স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবে। এই অভিযোগ হয়তো এতদিন চার দেওয়ালের মধ্যে স্বামীকে জানিয়েছিল অথবা জানানো হয়নি। আজ বলতে হবে সকলের মাঝে।

পল্লব বলে ওঠে, হয়ে গেল তা হলে। আমার বউ একাই রাত কাবার করে দেবে। আমার বিরুদ্ধে লাবণির অনেক অভিযোগ। বাসব বলে, না। একটা, বড়জোর দুটোর বেশি অভিযোগ শোনা হবে না। মহিলাদের তাই প্রধান অভিযোগগুলো বেছে নিতে হবে।

পল্লব ফের বলে, লাবণির দোষারোপ আপনি আলাদা করতে পারবেন না। একটার

সঙ্গে একটা এমন বুনে দেবে, ব্যাবসার কাজের সময় ওর ফোন এলে আমি তো ঘামতে শুরু করে দিই।

পল্লবের পাশের চেয়ারে বসেছেন অমিতাভ। পল্লবের পিঠে হাত রেখে বললেন, ব্রাদার, তুমি কিন্তু খেলাটাকে পণ্ড করতে চাইছ। হোয়াটস দ্য ম্যাটার? হোয়াই ইউ আর ফিলিং আন কমফর্টেবল? হ্যাভ স্পোর্টসম্যান স্পিরিট।

অসহায় মার্কা হেসে চুপ করে যায় পল্লব। বাসব বলে, খেলার মোক্ষম শর্তটাই তো এখনও বলা হয়নি। বউয়েরা যেমন ইচ্ছে অভিযোগ জানাতে পারে, সেটা কতটা সত্যিমিথ্যে, যুক্তিপূর্ণ এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে পারবে না স্বামীরা। শুধু শুনে যেতে হবে। আজ ওদের দিন। অন্য সময় তো ওদের আমরা পুরোটা বলতে দিই না। তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে ফেলি।

সকলেই মিটিমিটি হাসছে। বনলতা বললেন, খেলাটা থেকে আমাদের বাদ দেওয়া যায় না? আম্পায়ারের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। অনেক দিন বিয়ে হয়েছে আমাদের। এখন আর নালিশযোগ্য কিছুই নেই। সমস্ত অভিযোগ ঝাঁঝ হারিয়েছে। এই বয়েসে সবই টেকেন ফর গ্রান্টেড।

বাসব মাথা নাড়ে। বলে, না, আপনার অনুযোগও আমাদের শোনা প্রয়োজন। দীর্ঘ দাম্পত্যের পর স্ত্রীর অভিযোগের লক্ষ্য কোন কোন বিষয়ের ওপর থাকে, জানা হয়ে যাবে আমাদের।

অমিতাভ বললেন, ও কে, ইটস অল রাইট। আইডিয়াটা দারুণ। তবে এটাকে খেলা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। ইটস এ ফান। আমাদের কনজুগাল লাইফে যদি মিনিমাম বিশ্বাসটুকু থাকে, এই মজাতে সম্পর্কের কোনও ক্ষতি হবে না। রাদার ইমপ্রুভ করতে পারে। লেটস স্টার্ট।

দরজায় নক হল কয়েকবার। ওপারে বিল্লুর গলা, সাব, কফি।

অশেষ উঠে গিয়ে দরজা খুলল। বিল্লুর হাতে বড় ফ্লাস্ক, কফিমগ। পিছনে ট্রেতে খাবার সমেত ওর বউ। দরজা খোলার কারণে বাইরের ঝোড়ো ঠান্ডা হাওয়া এসে ঘরের গুমোট অনেকটাই কাটিয়ে দিল। সোফার নিচু টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে বিল্লু। বাচ্চা দুটো বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে এসে হাতে তুলে নিল ফিঙ্গার চিপস, পকোড়া। শুভঙ্কর বারান্দায় চলে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। বন্ধ ঘরের কারণে খেতে পারছিল না। বাসবও উঠে যায় ধোঁয়া টানতে।

বিল্লুরা চলে যেতে বাসব, শুভঙ্কর ফিরে আসে। দরজা বন্ধ করে দেয়। কাঠের বাড়ি তো, দরজাটা খোলা-বন্ধের সময় ভূতের বাড়ির গল্পের মতো ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করছে।

পাঁচ বউ অন্যমনস্কভাবে কফিতে চুমুক দিচ্ছে, কথা গুছিয়ে নিচ্ছে ভিতর ভিতর। বাসব নিজের চেয়ারে এসে বসতে পারমিতা বলে, কে শুরু করবে?

বাসব বলে, আপনিই করুন।

খাবার লাগা হাত ঝেড়ে পারমিতা বলতে যাবে, ওর বর অশেষ বিছানায় আধশোয়া হয়। বলে, জীবনে কখনও ওপেনিং করতে নামিনি, এই প্রথম। বাকিরা মৃদু হাসলেও,

পারমিতা গম্ভীর। বলতে থাকে, আমাদের প্রেম করে বিয়ে। সাত বছরের প্রেমে অশেষের চরিত্রের একটা দিক আমার কাছে অজানা থেকে গিয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। বিষয়টা এমনই, বিয়ের পরই বোঝা যায়। অশেষ আমাকে কখনও দশ টাকাও দিয়ে রাখে না। যখন যা দরকার চেয়ে নিতে হয়। খরচের হিসেব চায় ও, কিছু বাঁচলে নিয়ে নেয়। হিসেবের খাতা আছে ওর। লকারের চাবি রাখে নিজের কাছে। অফিসেও নিয়ে যায়। এমনকী ল্যান্ডফোনেও তালা মেরে রাখে। বলে, ফোন খোলা থাকলে বাপের বাড়ির সঙ্গে কথা বলে বিল বাড়িয়ে দেব আমি। অথচ বাপের বাড়ি আমার পাশের পাড়ায়। ফোনে কথা বলার দরকার পড়ে না। যখন ইচ্ছে হয় চলে যাই। বিয়ের আগে থেকে প্রচুর টিউশান পড়াতাম। বিয়ের পরও পড়িয়েছি বেশ কয়েক মাস। বন্ধ করে দিতে হল অশেষের জন্যে। টিউশনের টাকা গুনে গেঁথে নিত আমার থেকে। এমনও অনেকবার হয়েছে, অভাবের কারণে কোনও স্টুডেন্ট সেই মাসে টাকা দিতে দেরি করছে। অশেষ আমার কথা বিশ্বাস করত না। ওর ধারণা ওই টাকাটা আমি বাপের বাড়ির জন্যে খরচ করেছি। যাচাই করার জন্যে ছাত্রীকেই জিজ্ঞেস করে বসত, কেন টাকাটা দিতে পারছে না। লজ্জা, ঘেন্নায় সব কটা টিউশনি ছেড়ে দিলাম। মাসে এত ক’টা টাকা রোজগার কমে গেল, তা নিয়ে অশেষের কোনও বিকার নেই। যখন যা চাইছি, “হয়তো বেশি করেই চাইছি, দিয়ে যাচ্ছে। তবে বাপের বাড়ির জন্যে কিছু করা চলবে না। আমার কোনও অভাব রাখেনি। তাই অনুযোগও খুব একটা জোরালো হয় না। ফ্ল্যাটে আমরা দু’জনেই শুধু থাকি। কারও সঙ্গে দুঃখটা শেয়ার করতে পারি না। কেউ ফোন করলে, তবেই কথা বলতে পারি। লকার, ফোনের মতো আমার নিজেকেও কেমন যেন চাবি লাগানো বউ মনে হয়।

আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে অশেষ। শান্তভাবেই বলে, বিয়ের পর পর বাপের বাড়ির জন্যে তোমার খরচের বহরটাও বলো। আমি যদি না আটকাতাম…

পুরোটা বলতে দিলেন না অমিতাভ। বললেন, খেলার রুল কিন্তু ভাঙা হচ্ছে। সেলফ ডিফেন্স এখানে চলবে না।

শর্ত খেয়াল পড়ে অশেষের। চিপস, পকোড়া মুখে পুরে, নিজের জন্যে নতুন করে আধ কাপ কফি নেয়। বাসব বলে, জানি, আবহাওয়া ভারী হয়ে যাচ্ছে। তবে একজন যখন মনের কথা বলে ফেলেছে, বাকিদেরও বলা উচিত। নয়তো অশেষের ওপর অবিচার করা হবে। বনলতা বললেন, না, না। চলুক। খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে ব্যাপারটা। মেয়েরা তো এভাবে বলার সুযোগ পায় না। নেক্সট কে বলবে?

আমি বলি? অনুমতি চাইল রত্না। সঙ্গে সঙ্গে কানে আঙুল দিল শুভঙ্কর। রত্না বলল, অ্যাই, না শুনলে কিন্তু চলবে না। খেলার নিয়ম।

আমি যখন বলতে যাই, তুমি যে আঙুল দাও কানে, বউকে বলল শুভঙ্কর। রত্না বলে, দেখো ব্যাপারটা লাইট করার চেষ্টা কোরো না। তোমার বদমাইশি আমি বুঝি।

শুভঙ্করের কান থেকে হাত নামিয়ে দেয় অশেষ। রত্না শুরু করে, আমাদেরও প্রেম করে বিয়ে। এক কলেজে পড়তাম। ও আমার থেকে দু’বছরের সিনিয়ার। অত দিনের আলাপ পরিচয়, এক দিনের জন্যেও ওদের বাড়ি নিয়ে যায়নি। বলত, একবারে যাবে।

বরটা তো চেনা হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়িটা অচেনা থাক৷ নতুন জীবন শুরু করতে যাবে অজানা জায়গায়। তার একটা আলাদা থ্রিল। আমি শুভঙ্করকে বিশ্বাস করেছিলাম। তখন বুঝিনি, কেন বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইত না। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শোভাবাজারে আমার শ্বশুরবাড়ির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রাচীন ধ্যানধারণার, অন্ধবিশ্বাসের ছাপ। ব্রত, পার্বণ, উপোস তো লেগেই আছে, সপ্তাহের প্রত্যেকটা দিনেই কিছু না কিছু করতে নেই, খেতে নেই। আচারবিধির যেন পাহাড়। তারপর শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরা চলবে না। একদিন ম্যাক্সি পরা অবস্থায় আমাকে দেখে, শ্বশুরমশাইয়ের মুখ হাঁড়ি হয়ে গেল। ছেলেকে ডেকে বললেন, বউমাকে বালিশের খোল পরে ঘুরে বেড়াতে বারণ করো। এ বাড়ির একটা ঐতিহ্য আছে।

আর একটু হলেই হেসে ফেলত বাসব, কোনওক্রমে গিলে নেয়। শুভঙ্করের বাবার উপমা টানার ক্ষমতা আছে বলতে হবে। রত্না বলে যায়, এই সব বাড়াবাড়ি নিয়ে আমি যখন কমপ্লেন করি শুভঙ্করের কাছে, বলে, একটু মানিয়ে নাও। বিরুদ্ধে গেলেই তো বাবা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। এত বড় সম্পত্তি ভোগ করবে একা বড়দা। আজকালকার দিনে টাকার কী মূল্য আমি বুঝি। তাই মুখ বুজে সহ্য করে আছি। শোয়ার ঘর বন্ধ করার পর এবং বেড়াতে গেলে শুভঙ্কর আমায় সব রকম স্বাধীনতা দেয়। আমার সালোয়ার সুট, জিন্‌স, নাইটির যা স্টক আছে দোকান দিয়ে দেওয়া যাবে। নব্বই ভাগই শুভঙ্করের কিনে দেওয়া। বাপের বাড়ি অথবা বেড়াতে গেলে পরি। কিন্তু যে দিন দেখলাম আমার আড়াই বছরের মেয়ের বায়না শুনে শাশুড়ি ছোট গরদের শাড়ি কিনে দিয়েছেন এবং কুঁচি না দিয়ে সেটা পরে মেয়ে ঠাকুরঘরে বসেছে ঠাকুরমার পাশে, মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। মেয়ে আজকাল ওর ঠাকুরমার মতোই আমাকে ধমকায়। তখন মনে হয় ওর বয়েসি সব মেয়ে যখন সামনের দিকে এগোচ্ছে, সম্পত্তির লোভে ওকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি অতীতে।

যাকে নিয়ে কথা হল, তার সরল হাসির শব্দ এখন ঘরে। বন্ধুর সঙ্গে খেলছে। বাকিরা চুপ। শুভঙ্কর হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে রত্না বলে ওঠে, কোথায় চললে? কোথাও নয় বাবা, বাথরুমে যেতে হবে। বলে, শুভঙ্কর বাসবের কাছে অনুমতি নেয়, আপনাদেরটা একটু ইউজ করছি।

আরামসে। নো প্রবলেম। বলে বাসব। শুভঙ্কর এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে। বনলতা বলেন, এবার তা হলে লাবণি বলুক। ইয়াংদের বলা শেষ হয়ে যাক আগে। পল্লব নার্ভাসনেস থেকেই বোধহয় বন্ধ ঘরে সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। বাসব উঠে গিয়ে জানলার একটা পাল্লা খুলে দেয়। পরদা আছে। খুব একটা ঠান্ডা ঢুকবে না। খাবারের প্লেট কখন জানি শেষ। ফ্লাস্কের মাথা প্রেস করে কফিও পেল না বাসব। বলল, আর একবার কফি আনাব নাকি?

সকলেই না না করে উঠল। অমিতাভ বললেন, সন্ধেবেলাই যা খাওয়ালেন, ডিনারটা মনে হচ্ছে স্কিপ করতে হবে। বয়েস হয়েছে তো।

ফিরে এল শুভঙ্কর। শুরু করে রত্না, আমার প্রেম করে বিয়ে হয়নি। বিয়ের আগে পল্লব আমাকে একবারই দেখেছিল, মেয়ে দেখতে এসে কথা পাকা হওয়ার পর প্রায়ই ফোনে আমাদের কথা হত। দুষ্টুমিষ্টি কথার মাঝে আমরা একে অপরের সম্বন্ধে জেনে নিতাম। পছন্দ,

অপছন্দ, হ্যাবিট, শখ। তখনই পল্লব আমাকে জানিয়েছিল সিগারেটের নেশা ওর আছে, ড্রিঙ্ক করে খুব কম, ব্যাবসার প্রয়োজনে যতটুকু না খেলে নয়। ড্রিঙ্ক করা ব্যাপারটা আমি ছোট থেকেই দু’চক্ষে দেখতে পারি না। আমার বাপের বাড়িতে এ সবের চল একেবারেই নেই। পল্লবের অল্পস্বল্প মদ খাওয়াটা গা করিনি দুটো কারণে, এক আজকাল অনেকেই খায়। বেশি রিজিড হওয়াটা এক ধরনের পিছিয়ে থাকা। দুই, পল্লবকে আমার ভাল লেগে গিয়েছিল ওই এক দেখায় এবং ফোনে কথা বলে। কিন্তু ও যে আমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেল করবে ভাবতেও পারিনি। মদ ও নিয়মিতই খায়। পরিমাণও বেশ বেশি। কিছু বলতে গেলে বলে, তোমাকে তো আমি কিছু লুকিয়ে যাইনি। বিয়ের আগেই বলেছিলাম মদ খাই। আমি বলি, এত খাও তো বলোনি! তখন ও বলে, তোমার কাছে যেটা বেশি মনে হচ্ছে, আমার কাছে কম। দুটো মানুষের স্বভাব যেমন ভিন্ন, পরিমাপের ধারণাও তাই। আমি অনুরোধ করতাম, আমার মুখ চেয়ে মাত্রাটা কমাও।

কে শোনে কার কথা। সন্তান এল আমাদের। ছেলের মুখ চেয়েও নেশা কমাতে পারল না। চেপে ধরলে বলে, আমি একজনকে ভুলতে চাই। কথাটাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে পারি না। একজন কেউ আছে, যার জন্যে ফুলশয্যার দিন দরজা পুরো বন্ধ করেনি। সে ও বাড়ির আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই ছিল। পল্লব তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করতে পারেনি। সেরকম যদি কেউ… বলে যাচ্ছে লাবণি। পল্লব ঠিকই বলেছিল। একটা অভিযোগের সঙ্গে আরেকটা দিব্যি গেঁথে দিচ্ছে। বাসব থামাতে বাধ্য হয়, আপনার কিন্তু দুটো নালিশ বলা হয়ে গেল।

লাবণি থমকে যায়। হাসছে পল্লব, ভ্রূ নাচিয়ে ইশারায় বাসবকে বলে, বলেছিলাম না। অশেষ বলে, সব তো নেশা করার বাহানা। আমরা ওর এতদিনের বন্ধু, কারও সঙ্গে রিলেশন থাকলে জানতাম না!

শুভঙ্কর আবার ভিন্ন সুর ধরে, বন্ধু বলেই কি সব বলতে হবে? হয়তো কাজিন নিয়ে কেচ্ছা। লজ্জায় আমাদের কাছে বলতে পারেনি। লাবণি, তুমি ছেড়ো না। ড্রিঙ্ক করা আটকাও। নেশা করতে করতে যদি সত্যিই মেয়েটাকে ভুলে যায়, তুমি তো নামটাও জানতে পারবে না।

ধ্যুৎ, ইয়ারকি মারছেন। আমি উঠে যাব। বলেও লাবণি যায় না। হাওয়ার জোর আরও বেড়েছে, বারে বারে ধাক্কা মারছে দরজায়। মনে হচ্ছে বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকা কোনও বউ ভিতরে এসে মনের কথা বলতে চাইছে।

এবার তা হলে কলি বলুক। অ্যাজ পার এজ। বললেন বনলতা।

কলি বলল, না, আমি হোস্ট, সব শেষে বলব। আপনি আগে বলুন।

আপত্তি করলেন না বনলতা। নড়েচড়ে বসে বলতে যাবেন, দেখেন, অমিতাভ তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছেন। কপট ধমকসহ বনলতা বলেন, ওভাবে দেখছ কী। তোমার যেন কোনও দোষ থাকতে পারে না।

চোখ সরিয়ে নিয়ে অমিতাভ বলেন, না না, তা কেন! তুমি বলো। বনলতা বলতে থাকেন, দেখো ভাই, তোমরা আজ আমাকে বিষম উৎসাহের সঙ্গে

পাহাড়ে উঠতে দেখেছ। আমাদের মধুর সম্পর্ক দেখে, আশা করি তোমাদের ভালই লেগেছে। মনে মনে ভেবেছ, তোমরাও বুড়োবুড়ি হলে এভাবে বেড়াতে আসবে। রিয়েলিটি কিন্তু উলটো। এই বয়েসে এভাবে পাহাড় ভাঙতে মোটেই আমার ভাল লাগে না। ইনফ্যাক্ট রীতিমতো কষ্ট হয়। এ দিকে আমি যদি না বেরোই, ও একাই বেরিয়ে যাবে। বয়েস ওরও হয়েছে, কে দেখাশোনা করবে? আমার ছেলে আমেরিকায়, মেয়ে সুইডেনে। দু’জনেই ওদের ওখানে গিয়ে থাকতে বলে আমাদের। ও যাবে না, আমি শেষ বয়েসে একটু আরামে থাকতে চাই। নাতিনাতনির সঙ্গে ভালই সময় কাটবে আমার। এই বয়েসে ছেলে অথবা মেয়ে কেউ একটা পাশে থাকলে, জীবনটা সার্থক মনে হয়। ওর কারও প্রতিই টান নেই। খালি ঘুরে বেড়ানোর নেশা। তবে এই ভারতটুকুই। ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনির কথা তুললে বলে, সন্তানদের মানুষ করে দেওয়ার পর আমার দায়িত্ব শেষ। আর নাতিনাতনি তুমি বেড়াতে গিয়ে অনেক পাবে।… থামলেন বনলতা। একটু চিন্তা করে নিয়ে বললেন, আমার কেমন জানি সন্দেহ হয়, যে মানুষের রক্তের সম্পর্কের ওপর টান নেই, সে আমাকে ভালবাসে তো? নাকি শেষ বয়েসের প্রয়োজনীয় সঙ্গী হিসেবে কাছে রেখেছে? বাচ্চা দুটো বাদে সকলে চুপ করে আছে। বড় দীর্ঘশ্বাসসহ নীরবতা ভাঙলেন অমিতাভ। বললেন, প্রথম তিনজন হাজব্যান্ড আমার চেয়ে ভাগ্যবান, বউদের কমপ্লেনগুলো আগে শোনা ছিল। মেন্টাল প্রিপারেশন ছিল একটা। আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ফার্স্ট টাইম শুনলাম। তার জন্যে বাসবকে থ্যাঙ্কস। এরকম অভিনব আড্ডার বিষয় চ্যুজ না করলে, আমার প্রতি স্ত্রীর মনোভাব জানতেই পারতাম না। যাই হোক এবার কলি, তুমি বলো। কলি এতক্ষণ বাসবের পিছনে আলোছায়ায় বসে ছিল। টুল টেনে এল সামনে। বাসব প্রতীক্ষা করছে কলির অভিনয় কুশলতা দেখার জন্যে। এককালে কলি বাসবদের গ্রুপে নাটক করত। গলা ঝেড়ে নিয়ে কলি বলে, আড্ডার রুল অনুযায়ী আমার কিন্তু অভিযোগ জানানোর অধিকার নেই। তবু বলব, না বললে আপনাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে।

কান গরম হতে থাকে বাসবের। বুঝতেই পারছে কী মারাত্মক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে চলছে এখন। কলি কেন এমন করছে! আজ বিকেলেই তো বাসবের সঙ্গে ফোটো তুলতে চায়নি। মনোভাব বদলে গেল কেন? ওকে থামানোর কোনও রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না বাসব। শুরুটাই এত আকর্ষকভাবে করেছে, প্রত্যেকেই আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে কলির দিকে। অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে থাকে কলি, আমরা স্বামী-স্ত্রী নই। বাসব আমার প্রেমিক, বাল্যসঙ্গী বললে ঠিক বলা হয়। কবে থেকে আমাদের মধ্যে প্রেম এসেছিল মনে করতে পারি না। হয়তো না বোঝার বয়েস থেকেই। বাসব আমাকে পড়াত। একসঙ্গে নাটক করেছি। ডুয়েট আবৃত্তি করতে যেতাম নানা মঞ্চে। কোনও দিন মনেও আসেনি, কখনও আলাদা হয়ে যাব। আমার যখন বিয়ের বয়েস হল, ক্রমশ অ্যালুফ হয়ে যেতে থাকল বাসব। জিজ্ঞেস করলে বলত, চাকরিবাকরির চেষ্টা করছি। বিয়ে-থা করতে হবে তো। আসলে ওসব কিছুই করত না। আরও বেশ বেশি করে কালচারাল ফিল্ডে জড়িয়ে যাচ্ছিল। একসময় চলে গেল দিল্লিতে, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায়, নাটক শিখবে। আমার সঙ্গে সমস্তরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। ভাবলাম, হয়তো আমারই ভুল। ভালবাসা চিনতে

পারিনি। বাড়ির দেখে দেওয়া পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করলাম। তার কিছু দিন পরেই কোর্স ইনকমপ্লিট রেখে বাসব ফিরে এল। চাকরিও পেল। অল্পদিনের আলাপে বিয়েও করল ওর কোলিগকে। আমাদের কিছু কমন ফ্রেন্ড ছিল। তারা গিয়ে ধরল বাসবকে। সংসার যখন পাতলি, কলিকে বঞ্চিত করলি কেন? ও তোকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসত।

বাসব বলেছিল, তখন চাকরি ছিল না। কলিকে অপেক্ষা করতে বলার সাহস হয়নি। এখন বুঝছি, ভুল করেছিলাম। কলির বিয়ের খবর শোনার পর পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম আমি। দিল্লি থেকে চলে আসা সেই কারণেই। কলিকে একবার দেখব বলে। এটাও জানতাম, আমার এই চাওয়ার মধ্যে কতটা বিপদ লুকিয়ে আছে। সংসার ছারখার হয়ে যাবে কলির। ওকে ভোলার জন্যেই বিয়ে করলাম। তবে আজও এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, কলি যদি কোনওদিন সমস্ত পিছুটান ফেলে, আমাদের বাড়ির দরজায় এসে বলে, বাসব বেরিয়ে এসো—এবার থেকে আমরা একসঙ্গে থাকব। — আমি ওর কাছে না গিয়ে পারব না।… দম নেওয়ার জন্যে থামল কলি। ফের বলল, বাসবের শেষ কথাটাতেই আমার হৃত ভালবাসা ফেরত পেয়েছিলাম।

মন উঠে গেল নিজের সংসার থেকে। বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, আমি আসলে বাসবের ছিলাম, থাকব। ইতিমধ্যে আমার সন্তান এসে গেছে, বুঝতেই পারছিলাম ওই পরিমণ্ডল থেকে বেরোতে একটু দেরি হবে। যোগাযোগ রাখতাম বাসবের সঙ্গে, ফোনে অথবা কোনও কফি শপে এক ঘণ্টার জন্যে। তখনও ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বলিনি। এ দিকে বরের সঙ্গে আমার ডিস্ট্যান্স বাড়তে লাগল। বিয়ের পরই আমার হাজব্যান্ড খানিকটা আন্দাজ করেছিল আমি কোনও দিন ওর হতে পারব না। চাকরিটা পেয়ে যেতে হাজব্যান্ডকে বলেই দিলাম বাসবের কথা। ও একটুও রাগারাগি না করে ট্রান্সফার নিয়ে দিল্লি চলে গেল। বলে গেল, আমি যে দিন চাইব ডিভোর্স দিয়ে দেবে। আমি এখন ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই আছি। আর মাঝে মধ্যেই ঘ্যানঘ্যান করি বাসবের কাছে, বেরিয়ে এসো। একসঙ্গে থাকি। তোমার বউ তো চাকরি করে, ওর কোনও অসুবিধে হবে না। আমাকে ভালবাসো অথচ বউয়ের সঙ্গে থাকছ, এটা তো অপমানই করা হচ্ছে। বাসব একটাই কথা বলে যায়, এখনও সময় হয়নি। কবিতা তোমার ব্যাপারে কিছুই জানে না। ছেলেটাও ছোট।…আমি বাসবের পিছু ছাড়ি না। অবশেষে এই প্রথমবার ও আমার সঙ্গে কয়েকটা দিনের জন্যে বেরিয়ে এসেছে। ভালবাসার বিনিময়ে অনাচারে কাটানোর দিন। আমাদের পরিচিত জনেরা এই আউটিং-এ কথা জানে না।

কাঁধ থেকে মাথা ঝুলে গিয়েছে বাসবের। কার্পেটের দিকে চেয়ে থেকেও খেয়াল করে রত্না শরীর ঝামটে বিছানার কাছে গেল। নিজের বাচ্চাকে টেনে তুলে হনহন করে ঘর ছাড়ে। সেই রত্না, পুরনো ধ্যান ধারণায় যার প্রবল আপত্তি। নীরবে বাকিরাও ওকে অনুসরণ করল। রেস্তরাঁর নোংরা টেবিলের মতো পড়ে রইল বাসবদের ঘর। পায়ে পায়ে বারান্দায় যায় বাসব। ঝোড়ো হাওয়া আড়াল করে সিগারেট ধরায়। আকাশে অজস্র তারা। এত গ্রহনক্ষত্র কলকাতার আকাশে দেখা যায় না। পাশে এসে দাঁড়াল কলি। ওই বিশাল ঘন তারা পরিবারের নীচে নিজেদের ভীষণভাবে ব্রাত্য মনে হচ্ছে।

বাসব বলে, কথাগুলো বলে ঠিক করোনি। প্র্যাক্টিকাল সমস্যা দেখা দেবে। আমাদের চেনা-পরিচিতের পরিধি বেশ বড়। আজকের মুখরোচক গল্প ওরা বহু মানুষকে বলে বেড়াবে। আমাদের চেনা কেউ না কেউ খুব তাড়াতাড়ি জানবে সব।

একটু সময় নিয়ে কলি বলে, খেলা তুমি শুরু করেছিলে। পরিস্থিতি এমন হল, না বলে পারলাম না।

বাসবের আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। বলেও লাভ হবে না। দু’জনের মাঝে নিরেট নির্জনতার দেওয়াল উঠে গিয়েছে। সিগারেট ফেলে ঘরে আসে বাসব। ভাগ্যিস এ-ঘরে দুটো খাট।

ভোর ভোর বিল্লুকে তুলে বিল পেমেন্ট করেছে বাসব। দু’জনে লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে বিড়াল পায়ে রিসর্ট ছাড়ছে। বাকি বোর্ডাররা ঘুম থেকে ওঠেনি। ওদের কটেজের বারান্দায় কুয়াশা বসে আছে জবুথবু হয়ে। ট্রেক করেই ফিরবে বাসবরা। লাভার রাস্তায় দু’পা এগোতেই পিছন থেকে অমিতাভবাবুর গলা, বাসব।

ঘাড় ফেরায় দু’জনে। অমিতাভর পাশে বনলতাও এসে দাঁড়ালেন। বললেন, আবার কোথাও বেড়াতে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে ভাল লাগবে।

কুয়াশালাঞ্ছিত রোদের মতো হেসে ফেরার পথে পা বাড়ায় বাসব। এবার কানে আসে শিশু কণ্ঠের টা-টা।

বিষম অবাক হয়ে ঘাড় ফেরায় দু’জনেই। শুধু বাচ্চারা নয়, তাদের বাবা-মায়েরাও এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার মাথায়। সকলেই হাত নাড়ছে। টিফিনদাঁড়ার টিলার চেয়েও নির্মল, শুদ্ধ লাগছে ওদের। দ্বিধাগ্রস্ত হাত তুলে বিদায় জানায় বাসব, কলি। পথের বাঁক পেরোতেই যমজ ঝরনা নামে কলির চোখ বেয়ে। পাহাড় পথে আরও অনেক অনামী অখ্যাত ঝরনার মতো। তবে এই ঝরনাদ্বয়ের জলোচ্ছ্বাস একটু বেশিই। নাম না থাকুক, বহুদিন অপেক্ষার পর কিছুক্ষণ আগেই সামান্য স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আর বাধ মানছে না।

সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *