অনামা বীরাঙ্গনা
দিল্লির প্রথম আফগান সুলতান হচ্ছেন লোদী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বহলল। ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসন অধিকার করেন। ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে সুবিখ্যাত প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরের কাছে পরাজিত হওয়ার পর আফগানরা আর কখনও ভারতের ওপরে কর্তৃত্ব করতে পারেনি।
বহলল জীবনে অনেক যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়েছেন, কিন্তু সে-সবের কথা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। আমরা এখানে একটি বিশেষ যুদ্ধের কাহিনি বলতে চাই। ভারতে মুসলমান রাজত্বের ইতিহাসে এরকম কাহিনি দুর্লভ। ‘তারিখ-ই-সালাতিন-ই-আফগান’ নামক গ্রন্থ থেকে কাহিনিটি সংগৃহীত।
সিন্ধু প্রদেশে আহম্মদ খাঁ ভাট্টি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, তিনি আর মূলতানের শাসনকর্তার হুকুম তামিল করতে রাজি নন। তিনি গঠন করেছেন এক বৃহৎ সেনাদল এবং তার মধ্যে অশ্বারোহী সৈনিকের সংখ্যা বিশ হাজারের কম নয়। এই ফৌজ নিয়ে তিনি মূলতানের যত্রতত্র হানা দিয়ে বেড়ান—কোথাও লুঠতরাজ করেন, কোথাও কোনও শহর দখল করেন। দিনে-দিনে বেড়ে উঠছে তাঁর শক্তি ও সাহস। জীবনযাপন করেন তিনি স্বাধীন নৃপতির মতো।
দিল্লিতে গিয়ে পৌঁছোল এই দুঃসংবাদ। সুলতান বহললের বুঝতে বিলম্ব হল না যে, অবিলম্বে এই বিদ্রোহ দমন করতে না পারলে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াবে রীতিমতো গুরুতর।
দিল্লি থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়ল সুলতানের তিরিশ হাজার সুশিক্ষিত সাদী-সৈনিক, তাদের পুরোভাগে রইলেন সেনাপতি উমর খাঁ ও রাজপুত্র বেয়াজিদ।
কিন্তু খবর শুনে আহম্মদ খাঁয়ের মুখ শুকিয়ে গেল না, আত্মশক্তির ওপরে তাঁর অটল বিশ্বাস। সবদিক তলিয়ে না বুঝে তিনি অস্ত্রধারণ করেননি। সুলতানের ফৌজকে উত্তপ্ত অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্যে তিনিও প্রস্তুত হতে লাগলেন।
সুলতানের মতো তিনিও স্বশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন না। সেনাপতি করলেন নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র নওরং খাঁকে এবং সুলতানের তিরিশ হাজার অশ্বারোহীর বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন মাত্র পনেরো হাজার অশ্বারোহী। নিশ্চয়ই তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, তাঁর এক-একজন লোক শক্তিতে দুজন শত্রুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
নওরং খাঁ বয়সে নবীন, বীরধর্ম পালনের চেয়ে আমোদ-আহ্লাদের দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। প্রথমেই নিজের তরবারি কোষমুক্ত করবার ইচ্ছা তাঁর হল না।
দাউদ খাঁ নামে এক সেনানীকে ডেকে বললেন, ‘দশ হাজার সৈন্য নিয়ে তুমি শত্রুদের মুণ্ডপাত করে এসো। দরকার হলে আমি সাহায্য করব।’
তিরিশ হাজারের বিরুদ্ধে দশ হাজার! কথাটা শুনতেও হাস্যকর। কিন্তু দাউদ খাঁ মুখে কোনও প্রতিবাদ করলেন না, সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন যথাসময়ে।
যুদ্ধ হল। তিরিশ হাজার তরবারিকে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলে দশ হাজার তরবারি। কিন্তু পারবে কেন? জয়ী হল সুলতানের পক্ষ। রক্তাক্ত মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়ল দাউদ খাঁর মৃতদেহ। মারা পড়ল বা জখম হল তাঁর অনেক সৈন্য। বাকি সবাই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এল।
ছুটে গেল নওরং খাঁর আমোদ-আহ্লাদের স্বপ্ন। কেমন করে তিনি আর পিতৃব্যের কাছে মুখ দেখাবেন? বিলাসের আসন ছেড়ে নেমে এসে তিনি সজ্জিত হতে লাগলেন রণসজ্জায়।
এখন তিনি মরিয়া। নেই তাঁর মৃত্যু-ভীতি। তিনি প্রমাণ করতে চান, তাঁরও ধমনিতে প্রবাহিত হচ্ছে বীরের রক্ত, যোদ্ধার রক্ত।
তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন এক নারী। ইতিহাস তাঁর প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছে। কিন্তু আকৃতির কথা বলেনি। তাঁর নামও আমরা শুনিনি। কেবল এইটুকু জানতে পেরেছি, তিনি ছিলেন নওরং খাঁর প্রিয়বান্ধবী। বর্ণনার সুবিধার জন্যে আমরাও তাঁকে বান্ধবী বলে ডাকব।
বান্ধবী বললেন, ‘বন্ধু, আমিও তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাই।’
নওরং খাঁয়ের আপত্তি হল না। সেকালকার অনেক রাজা-বাদশা নারীদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করতেন।
পরাজিত সৈন্যদের সঙ্গে নিজের নূতন সেনাদল নিয়ে নওরং খাঁ ছুটলেন শত্রুদের গতিরোধ করবার জন্যে। মনে-মনে তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা—হয় জিতব, নয় মরব।
আবার দুই দল হল মুখোমুখী। বাজল কাড়া-নাকাড়া, দুলল যোদ্ধাদের মন, জাগল ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি। আরম্ভ হল সংঘর্ষ।
হ্রেষারবে চতুর্দিক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে, ধূলিপটলে আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন করে তুলে দুই পক্ষের অশ্বরা পরস্পরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সওয়ারদের শাণিত অস্ত্রগুলো দিকে-দিকে সৃষ্টি করতে লাগল চোখ-ধাঁধানো বিদ্যুৎ-চমক। কত সওয়ার, কত ঘোড়া মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে-করতে একেবারে স্থির ও নিঃসাড় হয়ে গেল, কত হুঙ্কারের সঙ্গে কত আর্তনাদ মিলিত হয়ে বিদীর্ণপ্রায় করে দিতে লাগল কর্ণপটহ।
লড়াই করছেন নওরং খাঁ মত্তহস্তীর মতো—যেখানে বিপদ সেখানেই তিনি এবং সেইখানেই ঝকমকিয়ে উঠছে তাঁর অশ্রান্ত হাতের তরবারি। শত্রুসৈন্যরা দলে-দলে হতে লাগল পপাত-ধরণীতলে!
কিন্তু বৃথা! নওরং খাঁ নিহত হলেন অবশেষে। নায়কের মৃত্যু দেখে হতাশ হয়ে তাঁর সৈন্যরা রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে উদ্যত হল। সেই সময়ে ঘটল এক অভাবিত ঘটনা। কোথা থেকে সবেগে ছুটে এল এক তরুণ সুকুমার বীর, পরনে তার যোদ্ধার সাজ, চক্ষে তার তীব্র দীপ্তি এবং কণ্ঠে তার দৃপ্ত চিৎকার—’যুদ্ধ করো, যুদ্ধ করো! আমি আহম্মদ খাঁর পুত্র, আমিই তোমাদের চালনা করে যুদ্ধ জয় করব। ফিরে দাঁড়াও, যুদ্ধ করো!’
ফিরে দাঁড়াল আবার পলায়মান সৈন্যগণ। এই নবীন নায়কের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখবার অবসরও তাদের হল না, কিন্তু যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে দৃঢ়পদে ও ক্ষিপ্রহস্তে তারা করতে লাগল অস্ত্রচালনা এবং শত্রুসংহার।
নবীন নায়ক এসে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। সংখ্যায় দ্বিগুণ হয়েও দিল্লির সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে আর তিষ্ঠতে পারলে না, ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারল পলায়ন করতে লাগল ঊর্ধ্বশ্বাসে। বিজয়গৌরব অর্জন করে তরুণ নায়কের চারিপাশে দাঁড়িয়ে আহম্মদ খাঁয়ের সৈন্যরা গগনভেদী স্বরে জয়ধ্বনির পর জয়ধ্বনি করতে লাগল।
এই তরুণ নায়ক হচ্ছেন নওরং খাঁয়ের অনামা বান্ধবী!
বন্ধুর মৃত্যু দেখে পুরুষের ছদ্মবেশে তিনি ক্রুদ্ধ সিংহীর মতো প্রতিশোধ নিতে ছুটে এসেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
আহম্মদ খাঁ এই সংবাদ পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। এবং বীরাঙ্গনার কাছে উপহার পাঠিয়ে দিলেন দশ হাজার টাকার অলঙ্কার। পনেরো শতাব্দীতে দশ হাজার টাকার মূল্য ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি।
ভারতের মুসলমানদের মধ্যে সৈন্যচালনা করেছেন এমন আরও দুই বীরনারীর নাম অতি বিখ্যাত। রাজিয়া এবং চাঁদবিবি। কিন্তু তাঁরা ছিলেন সুলতানা এবং রাজধর্ম পালনের জন্যে লোকের ওপর কর্তৃত্ব করতে অভ্যস্ত। আর নওরং খাঁয়ের বান্ধবী সাধারণ নারী হয়েও অসাধারণ বুদ্ধি, বীরত্ব ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়ে বিস্মিত করেছিলেন সবাইকে। এইরকম দ্বিতীয় ঘটনা ইতিহাস তন্ন-তন্ন করে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
সুলতান বহলল আবার আহম্মদ খাঁয়ের বিরুদ্ধে অসংখ্য সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু সে হচ্ছে ভিন্ন গল্প।