অনাদিদেব! অনন্ত ভব!
শতং জীব! সহস্রং জীব!!
একদা শান্তিনিকেতন আশ্রমে সঙ্গীতের কর্ণধার ছিলেন– অবশ্য কবিগুরুকে বাদ দিয়ে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। পরম শ্রদ্ধেয় সমাজসম শ্ৰীযুত অনাদিকুমার দস্তিদার (শতং জীব, সহস্রং জীব!) তখন ছাত্র। কিন্তু আমি তাঁকে কখনও ছাত্র বলে ভাবতেই পারিনি। তার আসন কার্যত এই দুই গুরুর পদপ্রান্তে ছিল বটে, কিন্তু অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় ফরাসি-ইংরেজি-বাংলা ক্লাসে আমার সতীর্থা, সুকণ্ঠী, সুবিনয়ী অনন্ত সুরলোকবাসিনী শ্রদ্ধেয়া রমা মজুমদার যার অকাল মৃত্যুতে কবিগুরুর শোক তার পরমাত্মীয়া-বিয়োগ শোককেও প্রায় অতিক্রম করেছিল একমাত্র ইনি ছাড়া শ্ৰীঅনাদি ছিলেন অনেক উচ্ছে; দুই গুরুর আদেশনির্দেশ শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রভৃতি সর্বকর্মের অব্যবহিত প্রধান। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনায় মনোনিবেশ করলেন। অভিজ্ঞজনমাত্রই জানেন, এক সঙ্গীতসাধনাই মানুষকে অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে, তদুপরি তার স্কন্ধে চাপানো হল বিশ্বভারতীর সাহিত্য সভার সম্পূর্ণ কর্মভার। ওইটিই ছিল সেকালে বিশ্বভারতীর মায় কলাভবনাদির বয়স্ক ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকদের সাহিত্যচর্চার একমাত্র মুক্ত, পাঞ্চজন্য প্রতিষ্ঠান। গুরুদেব শান্তিনিকেতনে থাকলে সর্বদাই এর অনুষ্ঠানাদির সভাপতিত্ব করতেন। একে তো অধিকাংশ আশ্রমবাসী, সহজেই অনুমেয় কারণে, শুরুদেবের সম্মুখে প্রবন্ধ পাঠ করতে সংকোচ এমনকি কিঞ্চিৎ শঙ্কা অনুভব করতেন, তদুপরি গুরুদেবের নিয়মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, রুচিসম্মত পদ্ধতিতে সভার আয়োজন করা, পরবর্তী সভায় পূর্ব সভার সুষ্ঠু প্রতিবেদন রচনা করা যেকোনো আর্টস্ বিভাগের ছাত্রদের পক্ষেই নিঃসন্দেহে সুকঠিন কর্মরূপে বিবেচিত হত; এবং অনাদিদা ওই সময়ে যুগপৎ অভ্যাস করছেন শাস্ত্রীয় ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, তদুপরি নবাগতদের সঙ্গীতে শিক্ষাদান, এবং স্বরলিপি রচনায় প্রচুর কালক্ষেপণ। ইতোমধ্যে যদি বাইরের কোনও কলেজ থেকে ক্রিকেট বা ফুটবল টিম খেলার নাম করে শান্তিনিকেতনের চিড়িয়াখানা দেখতে আসত তখন অনাদিদার ওপরেই ভার পড়ত সন্ধ্যাবেলায় তাদের জন্য সঙ্গীতামোদের ব্যবস্থা করা।
অজাতশত্রু নিরীহ, স্বল্পভাষী এই লোকটির স্কন্ধে যে কতপ্রকারের গুরুভার বে-দরদ চাপানো হয়েছিল তার ফিরিস্তি তিনি, স্বয়ং, আজ আর দিতে পারবেন না।
হয়তো-বা আমিই সেই লাস্ট স্ট্র দ্যাট ব্রোক দি ক্যাসেলস্ ব্যাক!
তাই যদি হয়, তবে সে অপরাধের জন্য অংশত দায়ী শ্ৰীযুত অনাদি।
অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই এস্থলে বলে রাখি, অনাদিদার রবীন্দ্রসঙ্গীতানুভূতি ও জ্ঞান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পটভূমিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ, সে সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ বিবর্তন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচলিত স্বরলিপির মূল্যায়ন, সে-যুগে দিবা কলকাতাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রবর্তন–এর কোনওটা সম্বন্ধেই আমার মতামত প্রকাশ করাটা হবে অমার্জনীয় অপরাধ। বাইরের থেকে শুধু এইটুকু বলতে পারি, সর্বশেষের কর্মটি করতে গিয়ে তাঁকে বিস্তর তিক্ততা, অর্থকৃচ্ছতা, রুচিহীনের সদম্ভ প্রলাপ এবং উপদেশ, একাধিক স্থলে বাধ্য হয়ে ভঁয়সকে সামনে বীণ বাজানো অর্থাৎ সুর-কালা প্যাচাগলা মুর্গি-মগজ কলচর-লোভিনী বিত্তবান-নন্দিনীকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার বন্ধ্যাগমন (শেষোক্তটি অনাদিদার জনৈক শুভাকাক্ষীর মুখে শোনা) ইত্যাদি নানাপ্রকারের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়েছিল। যে নম্রস্বভাব স্বল্পভাষী তরুণকে প্রায় মুখচোরা বলা যেতে পারে, তার ছিল, সুপ্রতিষ্ঠিত জনের পক্ষে প্রশংসনীয়, নবীন পন্থা নির্মাণকারীর পক্ষে নিন্দনীয় একটি অপরিবর্তনীয় স্বভাব– তর্কাতর্কির প্রতি প্রকৃতিগত সহজ অনীহা, কিন্তু প্রচুরতম সহিষ্ণুতা মিশ্রিত। সহিষ্ণুতা মিশ্রিত ধৈর্যকে কুরান শরিফ এক শব্দে বলেন সর যার থেকে বাংলা সবুর সুদ্ধমাত্র অপেক্ষা করা, স্থল-বিশেষ ধৈর্য ধারণ করা অর্থে ব্যবহার হয়। আল্লাতালা অগণিতবার তাঁর প্রেরিত পুরুষকে অবিশ্বাসীদিগের প্রতি সবর করতে আদেশ দিয়েছেন। অনাদিদেব অকৃপণ হস্তে এই মহৎ গুণটি অনাদিদার ওপর বর্ষণ করেছিলেন।
এসব গুণ নির্ণয় আমার পক্ষে ধৃষ্টতা–কিন্তু অনাদিদার অফুরন্ত সবই আমার ভরসা। কারণ তিনি শব্দার্থে, ভাবার্থে, সর্বার্থে ছিলেন আমার গার্জেন, এখনও তাঁকে গার্জেনরূপেই মানি। আমি স্থির প্রত্যয়, তিনি আমাকে কখনও বর্জন করতে পারবেন না। আমি পাষণ্ডতর আচরণ করলেও তার স্নেহ আমার নিকৃষ্ট রচনাকে আদরের চোখে দেখে।
একে বাঙাল– খাজা বাঙাল– তদুপরি বাঁচাল, সর্বোপরি সহজ মেলামেশায় অভ্যস্ত মহিলা মিশ্রিত ব্রাহ্মসমাজ ঘেঁষা তৎকালীন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আবহাওয়া বাবদে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, বয়স ষোলো বছর হয়-কি-না-হয়, চঞ্চল প্রকৃতির মুসলমান ছেলের পক্ষে সে বাতাবরণে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উকট সংকট, বিভীষিকাময় খণ্ড প্রলয় থেকে তাকে উদ্ধার করেন, আশ্রয় দেন, প্রথম দিন থেকেই; স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, সম্ভ্রান্তবংশজাত অতি সহজ আড়ম্বরহীন আচরণ দ্বারা, পথ-নির্দেশ করেন সামান্যতম নিতান্তই অবর্জনীয় দু চারটি শব্দ দ্বারা অনাদিদা। শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমার গার্জেন। তাঁর শান্ত সমাহিত আচরণ সংযতবা দিকনির্দেশ আমাকে প্রথমদিনই মুগ্ধ করেছিল, তিনি তাবৎ ছাত্রদের মধ্যমণিরূপে কতখানি সম্মানিত সে সত্য নির্ধারণ করতে আমাকে আশ্রম পরিক্রমা করতে হয়নি– এদের মধ্যে আছেন আশ্রমপালিত লেখকদের সর্বশ্রেষ্ঠ শ্ৰীযুত প্রমথনাথ, পাণ্ডিত্য তথা রসময় সর্বরচনপদ্ধতিতে সিদ্ধহস্ত বাগবিদগ্ধ গোস্বামীগৌরব শ্ৰীযুত পরিমল, অহরহ চটুল হাস্যরসে উচ্ছ্বসিত শ্ৰীযুত অনিলকুমার, প্রসিদ্ধ চিত্রকর সত্যেনদা, বিনোদবিহারী, সিংহলাগত কিশোর শ্রমণ শরণাঙ্কর সাধু, একাধিক ভাষায় অগ্রগামিনী এবং স্বল্পকাল মধ্যেই নৃত্যকুশলীরূপে সুপরিচিতা শ্রীমতী হটসিং (ঠাকুর), সর্বসঙ্গীত প্রচেষ্টায় অনাদিদার প্রীতিময়ী সহচারিণী রমা মজুমদার… কিন্তু এ নির্ঘণ্ট অফুরন্ত। স্বয়ং গুরুদেব, দিনেন্দ্রনাথ, পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী তাকে শুধু যে অশেষ মেহের চোখে দেখতেন তাই নয়, ছাত্রদের মধ্যে তিনি যে রবিসঙ্গীতের ভাণ্ডারী, কার্যত সেটা বারবার স্বীকার করেছেন তাই নয় আমার মনে হয়, শিষ্যকে গুরু যে স্বীকতি যে সম্মান দিতে পারেন অনাদিকুমার পেয়েছিলেন সেটি পরিপূর্ণমাত্রায়। তার পূর্বে বা পরে কোনও শিষ্য গুরুপদপ্রান্ত থেকে এতখানি সম্মান আহরণ করতে পারেননি।
কিন্তু আজ যতই প্রাচীন দিনের ছবি চোখের সামনে তুলে ধরি ততই মনে হয়, এসব কারণ তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রতিদিন গভীরতর করেছে বটে কিন্তু তিনি আমার গার্জেন ছিলেন একেবারে অকারণে, আমি তাঁর প্রথম আদেশই দ্বিধাহীন চিত্তে কেন পালন করেছিলুম তার কারণ অনুসন্ধান করার কোনও প্রয়োজন আমি কম্মিনকালেও অনুভব করিনি। বাহান্ন বৎসর পর আজও তিনি আমার গার্জেন। কারণ অনুসন্ধান করে আমার কোন মোক্ষলাভ হবে? এই বৃদ্ধ বয়সে আমি গার্জেনহীন হতে চাইনে।
[ইন্দিরা সঙ্গীত শিক্ষায়তন স্মারক গ্রন্থে প্রকাশিত।]