চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

অনশন

অনশন

আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়। ধারালো ছুরির ফলা নিয়ে ঘ্যাঁচোর ম্যাঁচোর করলে হাত কেটে যায়। বোমা নিয়ে লোফালুফি করলে ফেটে যায়। এই সবই হল ব্যবহারিক জ্ঞান। মানুষ হাতেনাতে শিখে ফেলে। বই পড়ার দরকার হয় না। মানুষ বিয়ে করে। করে শেখে। অনেক কিছু শেখে। নানা রকমের ফুল, লতাপাতা, গাছ আছে। এক-একরকম বর্ণ, গন্ধ। যেমন বিছুটি। লাগলেই চুলকোয়। যেমন লঙ্কা, চিবোলেই ঝাল। সেইরকম আমার অর্ধাঙ্গিনীর-স্বভাব হল, কিঞ্চিৎ রাগপ্রধান। তা সঙ্গীতের যেমন বিভিন্ন ধারায় রাগপ্রধানও আমাদের ভালো লাগে, সেইরকম রাগপ্রধান স্ত্রীকেও আমরা আমাদের জীবনে সইয়ে নিই। সাবধানে নাড়াচাড়া করি। করলেও দু-একবার বেসামাল হয়ে যেতে পারেই; তখন ভুলের মাশুল দিতে হয়। ভুল করাই তো মানুষের ধর্ম!

অ্যামোনিয়ার বোতলের গায়ে লেখা ছিল—কোনওক্রমে চোখে দু-এক ফোঁটা যদি ছিটকে লাগে, তা হলে চোখে ঠান্ডা জলের প্রচুর ঝাপটা মারবে। কী হলে, কি করতে হবে জানা থাকলে অনেক সুবিধে হয়। অনেক দিন ঘর-সংসার করার ফলে স্ত্রী ফেটে গেলে কী করতে হয় আমার জানা হয়ে গেছে, আর কী করলে ফাটবে তাও জানি। লেজ ধরে টেনো না। বাঘের একটা লেজ। আমার স্ত্রীর অনেক লেজ। বড় লেজ হল, শ্বশুরবাড়ির লেজ। শ্বশুরবাড়ির কারো সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা চলবে না। সে বাড়ির ইট ভালো, পলেস্তারা ভালো, এমনকি সিড়িঙ্গে বেড়ালটাও আসল, কাবুলি বেড়াল। শ্বশুরমশাইয়ের গোঁফজোড়া একেবারে খোদ স্ট্যালিনের গোঁফ। হাসিটা মোনালিসার পুং সংস্করণ। শ্বশ্রূমাতার ধরা-ধরা গলায় পারস্যের বুলবুল। তাঁরা দানধ্যানে কর্ণ, জ্ঞানে ভীষ্ম, ধর্মে যুধিষ্ঠির, বীরত্বে অর্জুন। শ্যালক শ্রীকৃষ্ণ। আমার নিজের ধারণা সকলেই অল্পবিস্তর পাগল। দিনে-রাতে এক-একজন বারচারেক স্নান করে। একইসঙ্গে টিভি, রেডিয়ো রেকর্ড -প্লেয়ার ও হইহই গল্প চলে। সকলেই বলতে চায় কেউ কিছু শুনতে চায় না। যে কেউ যখন খুশি ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আবার জেগে থাকার মেজাজ এসে গেলে বিছানার সঙ্গে তিন রাত কোনও সম্পর্ক থাকে না। সকলেরই স্বাস্থ্যবাতিক। অসুখ হওয়ার আগেই ওষুধ খেয়ে বসে থাকে। সব ভিটামিন-পাগল। শীতকালে খরগোশের মতো বাঁধাকপি আর গাজর কাঁচা চিবোয়। কথায় কথায় সকলকে উপদেশ—খুব শাক-সবজি খাও, গ্রিন ভেজিটেবলস। ফলে এই হয়েছে, নিমন্ত্রিতদের ভাবতে হয়—ওই বাড়িতে পাত পাতবে কিনা! সবাই তো আর ছাড়া গরু নয়, যে আস্ত একটা বাগান খেয়ে ফেলবে! শ্বশ্রূমাতা একটার সময় আহারে বসে দুটোর সময় ওঠেন—চিবিয়ে যাচ্ছেন, চিবিয়েই যাচ্ছেন, ডাঁটা। শ্যালক শ্রীকৃষ্ণ কথা বলতে বলতে ব্যায়াম করে। কবজি ঘোরাচ্ছে, ঘুরিয়েই চলেছে। এদিকে কথাও বলছে। রাস্তায় কারো সঙ্গে দেখা হল, তিনি হয়তো জিগ্যেস করছেন, কে কেমন আছে। ওই পাঁচটা মিনিটও যেন বৃথা না যায়—পায়ের আঙুলের ওপর ভর রেখে দেহটাকে ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। পায়ের গুলির ব্যায়াম। যিনি কথা বলছিলেন অবাক হয়ে বলছেন—ওরকম করছ কেন? শ্যালক বলবে —’আপনি বলে যান। মাইন্ড করবেন না।’ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন আসবে। হঠাৎ গোটাপঞ্চাশ বৈঠক মেরে দিল ঝপাঝপ। ডেন্টিস্টের চেম্বারে বসে আছে, হঠাৎ কি মনে হল পায়ের ব্যায়াম করতে গিয়ে সেন্টার টেবিল উলটে গেল। ম্যাগাজিন-ফ্যাগাজিন সব ছত্রাকার। অন্য যাঁরা বসেছিলেন, তাঁরা শুধু অবাক হলেন না, বিরক্তও। একগাল হেসে বললে, ‘লেগ-স্ট্রেচ করতে গিয়ে উলটে গেল।’ আমরা মরচি দাঁতের যন্ত্রণায় আর আপনি করছেন লেগ-স্ট্রেচ।’ দাঁত থেকে পায়ের দিকে মনটাকে ঘোরাবার চেষ্টা করছিলুম আর কী।’

সকলেরই যে ম্যাথার স্ক্রু ঢিলে, তার প্রমাণ, আমার সহধর্মিণীকে একবার পাগল বললেই হল। একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। তখন একেবারে অন্য চেহারা। নাকের পাতা ফুলে উঠল। চোখমুখ লাল। তখন বয়েসটাও যে কমে যায় অনেক। রাতের সমুদ্রের ফসফরাসের মতো দেহ-ত্বক জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। আমি ভুলেও পাগল বলি না। স্বামী হলেও বোকা-পাঁঠা নই। কী থেকে কী হয়, আমার সব জানা আছে। আমি জানি, স্ত্রী হল চিনে মাটির বাহারি ফুলদানি। সেই ফুলদানিতে জীবনের যত দু:খসুখের ফুল সাবধানে সাজিয়ে রাখতে হয়। অফিসের বড়কর্তার সঙ্গে ইয়ারকি চলে। ইয়ারকি চলে পুলিশ-সার্জেন্টের সঙ্গে। এমনকী চিড়িয়াখানার বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে চুমকুড়ি মারা যায়; কিন্তু ইয়ারকি চলে না স্ত্রীর সঙ্গে। সব সময় মন যুগিয়ে চলতে হয়। খুশ মেজাজে রাখতে হয়। দেশলাইকাঠি আর খোলের সম্পর্ক। বেশ ঘষলেই ফ্যাঁস। মাঝেমধ্যে পাগল বলে তারই পেটের ছেলে। একালের শ্যায়না ছেলে, সে পিতা স্বর্গও বোঝে না, বোঝে না জননী জন্মভূমিশ্চ। তার স্বার্থে ঘা লাগলেই সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়, আর রোজ, হয় প্রাতে না হয় সায়াহ্নে, মায়ের সঙ্গে বাক্য-যুদ্ধ লাগবে লাগবে, আর ঠিক হেরে যাওয়ার মুহূর্তে ছাড়বে সেই পাশুপত অস্ত্র—তুমি একটা পাগল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলের মা ফসফরাসের মতো জ্বলে উঠবে—তুই পাগল, তোর বাপ পাগল, তোর ঠাকুরদা পাগল, তোর চোদ্দো পুরুষ পাগল। আমার তখন লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে কোলা ব্যাঙের মতো; কিন্তু লাফাই না। আমি তখন মনে মনে বলি, পাগলে আর নারীতে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়। অর্থাৎ পাগল শব্দটি হল মধ্যম লেজ। কর্ণে প্রবেশমাত্রই বহ্নিমান অবস্থা। আমার চতুর্দশ পুরুষকে পাগল প্রমাণের পর অধস্তন চোদ্দো পুরুষকে ধরে টানাটানি। আমার ছেলে—তস্য ছেলে, তস্য ছেলের ছেলে। মানে ছেলে লেলে। চোদ্দো ভুবনের মতো—মাঝে ভু: মানে আমি, এই প্রতিবেদক। ঊর্ধ্বে, ভুব: স্ব: মহ, জন, তপ: সত্য। ছ’টি স্বর্গলোক। অধে পাতাল, তারও সাত ভাগ, অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল, পাতাল। সমস্ত তছনছ করে, নিজের রক্তের চাপ দুশো দশে তুলে অবশেষে সত্যই তিনি সাময়িক পাগল হলেন। ডাক্তার, বদ্যি কড়া ঘুমের ওষুধ। পনেরো দিনের মতো শয্যাশায়ী।

তৃতীয় লেজটি হল, অন্যের বউয়ের প্রশংসা। যদি কোনওভাবে একবার বলে ফেলেছি, আহা অমুকের বউটি কেমন সুন্দর, যেমন দেখতে তেমন স্বভাব। মিষ্টি মুখ, মিষ্টি কথা। শ্বশুরবাড়িটিও ভারী সুন্দর। তিন ভাই, তিনজনেই ডাক্তার। একজন দাঁতের। একজন কানের। একজন মাথার। গোটা পরিবারটাই মানুষের মুণ্ডু নিয়ে পড়ে আছে। ওর নীচে কেউ আর নামেনি। বউটি আবার শিল্পী। তুলির এক আঁচড়ে একটা মুখ। নিমেষে ঝরনা, পাহাড়, বনস্থলী। এই সব কথা, মধ্য রাতে, একান্তেই হতে পারে। অনেকটা আমার স্বগতোক্তির মতো। অলস মুহূর্তে মানুষ এইরকম করতেই পারে। তার করার হক আছে। ‘কী পেয়েছি, আর কী পাইনি’-র মতো উক্তির পর যেকোনও বাঙালি গলায় সুর থাকুক আর না-থাকুক, গুনগুন করে গাইবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গান—

 কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।

 আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি।

এই মধ্যরাতের একান্ত বিলাসিতাটুকু সব মানুষই প্রশ্রয় দিতে পারে। শ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস এই নিয়েই তো জীবন। যা চাই তা পাই না, যা পাই তা চাই না। এইটাই তো সত্য। সত্যেও ভদ্রমহিলার অসহ্য। সঙ্গে সঙ্গে বলবে—’যাও না, তার কাছেই যাও না। আমার কাছে কেন?’ কী কথা। এমন কথা কোনও ভদ্রলোকে বলে? ভদ্রমহিলারাই বলতে পারে। আমি যেন পরস্ত্রীর সঙ্গে পরকিয়া করার জন্যে এইসব কথা বলছি। আমার কি ভীমরতি হয়েছে? আমার এমন সোনার চাঁদ বউ থাকতে হুলো বেড়ালের মতো অন্যের হেঁশেলে ছোঁকছোঁক করতে যাব কেন? গিয়ে ধোলাই খেয়ে মরি আর কী! এরপর শুরু হয়ে গেল লং-প্লেয়িং —’জেনেশুনে দেখে-শুনেই তো বিয়ে করেছিলে। আমার জামরুলের মতো নাক, প্যাঁচার মতো চোখ,ঘুটঘুটে অমাবস্যার মতো গায়ের রং। শিরিষ কাগজের মতো গলা। বিয়েটা তখন না করলেই পারতে! আহা, কত কষ্টই না আমার জন্যে করেছিলে। ট্যাঁকে নিয়ে ঘুরেছিলে ময়দানে, ভিক্টোরিয়ার। আড়াই হাত লম্বা এক-একটা চিঠি। ধার করে উপহার। গাছতলায় বসে বসে ঘাসে টাক। তখন অত কসরত না করলেই পারতে। কে বলেছিল আমার জন্যে হেদিয়ে মরতে।’ ফোঁস আর দীর্ঘশ্বাস। তারপর খচমচ করে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে ধপাস। কিছুক্ষণ পরেই আমার সাধ্যসাধনা। একবার করে হাত ধরে টেনে তুলি পরক্ষণেই ল্যাৎ করে নেতিয়ে পড়ে। যেন প্ল্যাস্টিক গার্ল। দায় তো আমারই। সারা রাত মেঝেতে পড়ে থাকলে, পরের দিনই মিনিটে পঞ্চাশটা করে হাঁচি। ডাক্তার বদ্যি। কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ। নিজে বাঁচার জন্যে বউকে বাঁচাতে ছুটি। কে বলেছে, তোমার জামরুলের মতো নাক, প্যাঁচার মতো চোখ। অমাবস্যার মতো রং। তুমি আমার সায়রাবানু।

আমি জানি, বড় লেজটা ধরে টানলে, এক মাস বাক্যলাপ বন্ধ। মধ্যম লেজ টান মারলে সাত দিন। ছোট লেজে টান মারলে গোটা একটা রাত সাধ্যসাধনা। টেনে তুলি, আবার তুলি। ভীম ভবানী হলে পাঁজাকোলা করে মেঝে থেকে বিছানায় ফেলে ঠেসে ধরতে পারতুম। শরীরে সে শক্তি নেই। অবাক হয়ে ভাবি, হিন্দি ফিলমের নায়করা আস্ত একটা নায়িকাকে কেমন করে পাঁজাকোলা করে ঘুরে ঘুরে, সাড়ে সাতশো ফুট লম্বা একটা গান গায়। ওইরকম হিম্মৎ না থাকলে ব্যাচেলার হওয়াই ভালো।

সংসারে মোটামুটি সবই ভালো। দু:খ, সুখ, অসুখ-বিসুখ, টানাটানি, ছাড়াছাড়ি সবই সহ্য করা যায়, অসহ্য স্ত্রীর গোমড়া মুখ। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হলে আকাশ ছেয়ে যায় মেঘে। সূর্যের মুখ ঢেকে যায়। অন্ধকার বিষণ্ণ দিন। দিনের পর দিন। স্ত্রী যেন সেই বঙ্গোপসাগর। সব সময়েই নিম্নচাপ তৈরি হয়ে আছে। সদা মেঘলা। সেই মুখে এক চিলতে হাসির জন্যে কী সাধ্যসাধনা। যত তেল স্ত্রীকে ঢালা হয়, সেই তেল কড়ায় ঢাললে একটা তেলেভাজার দোকান সারা বছর অক্লেশে চালানো যায়। সব চেয়ে মারাত্মক হল, কথায় কথায় খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। সামান্য একটু ঠুকঠাক হল কী, খাওয়া বন্ধ। গোটা সংসারকে খাইয়ে, খাবারদাবার সব তুলে রেখে, একটা বই কী বোনা নিয়ে বসে পড়লেন। অন্য সময় বই কী বোনার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকে না। একটা সোয়েটার—সে যেন ধারাবাহিক উপন্যাস। বছরের পর বছর, চলছে তো চলছেই। ছিড়িক, ছিড়িক ইনস্টলমেন্ট। অন্য সময় ঘরদোর এলোমেলো, টেবিলে, চেয়ারে ধুলো, দেওয়ালের কোণে কোণে ঝুলের ঝালর। এইসময় তিনি মহা কর্মী। যত কাজের ধুম। উদ্দেশ্য, দেখানো, দ্যাখো, অনশনে আছি; কিন্তু কাজে দেহপাত করছি। আমি একপেট খেয়ে বিছানায় চিৎপটাং, তিনি শুয়ে আছেন পাশে খালি পেটে। দাঁতের ফাঁকে বড় এলাচের দানা। অন্ধকার ঘর। নীল মশারির ঘেরাটোপ। চারপাশ নিস্তব্ধ। শুধু দাঁতে বড় এলাচের দানা কাটার কুটকুট শব্দ। অনেকটা আমার বিবেকের দংশনের মতো। স্বার্থপর দামড়া। নিজে পেট ফুলিয়ে পড়ে আছ। পাশে তোমার স্ত্রী অনশনে, তোমারি দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দাঁতে দাঁতে বড় এলাচের দানার কিটিসকিটিস নয়, আমার বিবেক-ইঁদুরে আমারই জীবনকাব্য কাটছে মাঝরাতের অন্ধকারে। এই এক চালেই আমার মতো খেলোয়াড় কাত হয়ে যায়। প্রথমটায় বোঝা যায় না, মানে বুঝতেই দেয় না, যে খাওয়া বন্ধ হবে। নদীতে জল মাপার জন্য ব্রিজের পিলারে স্কেল লাগানো থাকে। জল বিপদসীমা লঙ্ঘন করছে কি না বোঝা যায়। স্ত্রী-নদীতে রাগ বিপদসীমা ছুঁয়েছে কি না বোঝার উপায় নেই। সামান্য কথা-কাটাকাটি—এই ইলেকট্রিক বিল নিয়ে, কী চিনির খরচ বেশি হচ্ছে বলে, কী হয়তো বলেই ফেললুম—আমার কি তেলকল আছে। আমার বাপের তেলকল দেখেছ, বলিনি; কারণ নিজেই নিজের বাপ তুলব, এমন ছোটলোক আমি নই। বা হয়তো বললুম—আমার কি চা-বাগান আছে। বলতে পারতুম—আমার শ্বশুরের কি চা-বাগান আছে—মাসে সাত কিলো চা—রোজ সাতটা মোষ এসে চা খেয়ে গেলেও এত খরচ হত না। এইসব অভিযোগ যে কোনও স্বামীই, যে কোনও স্ত্রীকে করতে পারে। না-ই যদি পারবে তা হলে বিয়ে করা কেন? এই তো আমার তিন বন্ধু, তিন জাঁদরেল মহিলাকে বিয়ে করেছেন—জজ, প্রিনসিপ্যাল আর শক্তিশালী রাজনৈতিকদলের নেত্রী—যে কোনও নির্বাচনে এম. এল. এ. বা এম. পি হয়ে যাবেন অক্লেশে, হেসে হেসে। আমার সেই তিন বন্ধু কি নতজানু হয়ে থাকে? কাঁধে তোয়ালে ফেলে—যো হুকুম মেমসাব বসে স্ত্রীকে প্রদক্ষিণ করে? কোর্টে তুমি জজ। রোজ একটা করে আসামিকে তুমি ফাঁসিতে লটকাও; কিন্তু বাড়িতে তুমি গদাইয়ের স্ত্রী। কথায় কথায় খেপে বোম হলে সংসার তো ভেটকে যাবে। দড়ির ওপর ব্যালেন্স করে কতক্ষণ হাঁটা যায়। হয়তো একটু চড়াগলায় বলে ফেললুম—’বাথরুম থেকে বেরোবার পর আলোটা নেবাতে হয়; তা না হলে হাতে হ্যারিকেন হয়। সংসার করার এই এ-বি-সিটা তোমার মা শেখাননি। এর জন্যে তো ডিগ্রি -ডিপ্লমার প্রয়োজন হয় না।’ মাসে মাসে পাঁচশো টাকা করে ইলেকট্রিক বিল এলে, কোনও আদমি কোনও অওরতকে সোনা আমার, মানু আমার, খেয়াল করে আলোটা একটু নিবিও; অকারণে পাওয়ার খরচ কোরো না, বলতে পারে কি! আমি তা-ও বলে দেখেছি। —দয়া করে আলোটা নেবাও। আমার এমনই নিখাদ নাইট্রিক অ্যাসিড ধোয়া প্রেম। তাও দেখি মুখের চেহারা জামবাটির মতো হয়ে গেল। টেবিলে কাপ নামল যেন আহম্মদ জান থেরকুয়ার তবলায় শেষ তেহাই। ব্যাপারটা কী; না, ওই দয়া শব্দটি। ওই শব্দটিতে হিমের মতো জমাট বেঁধে আছে শ্লেষ আর ব্যঙ্গ। এ তো মহা জ্বালা! ভাষাতাত্বিক চমস্কির কাছে গিয়ে ভাষাবিজ্ঞান শিখে এসে সংসার করতে হবে। পাঁচশো টাকা বিলটা বড় কথা নয়। ওটা তোমার ম্যাও। তুমি মা তুললে কেন? কেন বললে, এ-বি-সি শিখিনি? আমি নিরক্ষর? আরে ফার্স্টবুকের এ-বি-সি বলিনি রে ভাই। সংসারের এ-বি-সি-র কথা বলেছি। আর মা তুলব কেন? বাপ তুললে গালাগাল হয়। সে বুদ্ধিটা আমার আছে। তোমার মতো নই। তুমি তো সারাদিন বারদশেক আমাকে তোলো আর ফ্যালো। ছেলে যখনই মুখের ওপর চোটপাট করে বলে, পারবো না যাও। তুমি অমনি বলো, তোর বাপ পারবে। তা তুমি যখন ছেলের বাপ তোলো, তখন বেশ প্রেম-প্রেম লাগে।

কত বড় ডিপ্লাম্যাট। সংসার যত পাকছে ডিপ্লাম্যাসিটা তত বাড়ছে। রাত সাড়ে ন’টা, কী দশটার সময় হাঁক পড়ল—’সব খাবে এসো।’ আমরাও বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়লুম যে যার জায়গায়। সন্ধের দিকে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল—বিষয়টা খুবই তুচ্ছ—একটা গেঞ্জি। আমার একটা গেঞ্জি আমিই কেচে ছাতের তারে শুকোতে দিয়েছিলুম। এক দিন গেল, দু’দিন গেল, সাত দিন হয়ে গেল, কেউ আর তোলে না; যেন রাস্তার ইলেকট্রিক তারে লটকানো সুতো-ছেঁড়া ঘুড়ি। আমিও তুলি না। দেখছি। টেস্ট করছি, সংসারে আমার জন্যে কতটা ভালোবাসা আর কর্তব্যবোধ জমা আছে। কে কতটা ভাবে আমার কথা। দেখলুম, ভাঁড়ে মা ভবানী। তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে। দৌড়-ঝাঁপ চলছে। সহজে তুমি টাঁসছ না। টাকার পাইপলাইন ঠিকই চালু থাকবে। তবে আবার কী। সূক্ষ্ম সার্ভিসের কী প্রয়োজন। মোটা দাগের সেবাই যথেষ্ট। গজাল সার্ভিস। বাসের আসনে ছোট্ট একটা পেরেক উঠে থাকলে কে আর নিজের থেকে সার্ভিসিং করাতে যাচ্ছে। যতক্ষণ পাবলিক না প্যাঁদাচ্ছে। ইঞ্জিনটাই তো সব। বাস গড়াচ্ছে গড়গড়িয়ে। দানাপানি দিয়ে টাট্টুকে ছেড়ে দাও। যা ব্যাটা রোজগার করে আন। তারে গেঞ্জি তিন মাস কেন, অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া তক ঝুলবে। পাজামার লজ্জাস্থান ফেঁড়ে থাকবে। সেলাই আজও হচ্ছে, কালও হচ্ছে। বললেই, তীক্ষ্ম প্রশ্ন, ‘তোমার ওটা ছাড়া আর কোনও পাজামা নেই? জামা কিনে আনার পর যে-ক’দিন বোতাম থাকে। তারপর একটা একটা করে ঝরতে থাকে। বোতাম তো আর ঝরাপাতা নয়, জামাও গাছ নয়, যে শীতে ঝরিয়ে বসন্তে বোতাম গজিয়ে দেবে। প্রথমে গেল গলা, পরে গেল পেট, শেষে গেল বুক। সব হাওয়া। আর তো চলে না। জামা তো ব্লাউজ নয় যে গোটাগোটা সেফটিপিন লাগিয়ে ম্যানেজ করে নেব। মেয়েদের আটপৌরে ব্লাউজে বোতাম থাকে না। কে বসাবে। ওই গজালই সহজ রাস্তা। মেয়েদের তো বউ হয় না যে বসিয়ে দেবে। তারা নিজেরাই বউ। আর বউ হওয়ার পর তাদের কাজ এত বেড়ে যায় যে, তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় থাকে না। মাকালীর গলায় মুণ্ডমালা, মেয়েদের বুকে সেফটিপিনের মালা। বললেই বলবে পরোপকার প্রবৃত্তি। ওখানে না কি স্পেয়ারও থাকে। প্রয়োজনে অন্যকে ধার দিতে পারে। সাবেকি, ধারণা নিয়ে বিয়ে করলে অনেক দুর্ভোগ। জামা পাট, ইস্ত্রি, সেলাই, বোতাম বসানো, ফিতে পরানো, মাথা টেপা ইত্যাদি নিম্নবর্গের কাজ বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত এসেই খতম। প্রায়ই শুনতে হয়—নিজে করে নিতে পারো না। আমি একটা কেমেস্ট্রির লোক, টেলারিং তো শিখিনি। সিউয়িং কুকিং নার্সিং—এইসব আমার ছেলেকে শেখানো হবে, তা না হলেই মরবে। গৃহকর্মে সুনিপুণা বিশেষণ ঘুরে গিয়ে ছেলেদের গায়ে লাগবে—গৃহকর্মে সুনিপুণ। বলবে, কী রকম স্বামী? গ্যাস ফুরিয়ে গেলে তোলা উনুনও ধরাতে পারে। কেরোসিন স্টোভে পলতে পরাতে জানে। পোড়া কড়া মাজতে পারে। ছেলে ধরাও জানে। সবই যেন উলটেপালটে গেল।

তা ওই তুচ্ছ গেঞ্জি। যাকে বলে, তিল থেকে তাল। সিঁড়ি ভেঙে ছাতে উঠতে বুক ধড়ফড় করে। আচ্ছা করে। কিন্তু ট্যাংট্যাং করে এখানে, ওখানে ঘোরার সময় বুক ধড়ফড় করে না। ও, সেটা হল সমতলে। ভাইয়ের বিয়ের সময় একতলা, তিনতলা দাপিয়ে বেড়ালে? বেড়াতেই হল—কর্তব্য! গেঞ্জিটা নিজেও তো তুলতে পারতে? এইটুকু দয়া তো করা যেত। দেখছিলুম, তুমি করো কি না? না, তোমার তো কিছুই করা হয় না। তোমার আর একটা বউ এসে করে দেয়। সে বউ আছে কোথায়? কোথায় পুষছ তুমিই জানো—তা না হলে মাসে মাসে এত খরচ হচ্ছে কী করে? টাকায় থই পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার বুঝি সেইরকম ধারণা। তোমার বয়সের কোনও পুরুষকে বিশ্বাস নেই।

তারে ঝোলা একটা গেঞ্জি। কোথাকার জল কোথায় গড়াল। আমাদের পরিবেশন করা হয়ে গেল। সকলেই বসে গেল, তিনি বসলেন না। জিগ্যেস করলুম, ‘কী হল? তুমি বসলে না? গম্ভীর মুখে, খুব পসারওয়ালা ডাক্তারের মতো বললে, ‘খিদে নেই। পরে খাব।’ সেই পর আর সে-রাতে এল না, পরের রাতেও এল না। ব্যাপারটা লাগাতারের দিকে চলে গেল। শেষে যা হয়, দুহাত তুলে সারেন্ডার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা, এও তো এক ধরনের অপমান, সেই ছাত্রজীবনের মতো প্রায় কান ধরে নিলডাউনের অবস্থা। এমন কাজ আর করব না। যা হচ্ছে হোক। সংসার ভেসে যাক, চুলোয় যাক, আমাকে কেউ দেখুক, না দেখুক, চোখ-কান বুজিয়ে থাকবো। বয়েস হচ্ছে। রক্তের আর সে জোর নেই। দিনগত পাপক্ষয় করে যেতে পারলেই হল। বধূ-হত্যার যুগ পড়েছে, অনশনে প্রাণবিয়োগ হলে পুলিশে আর পাবলিকে পিটিয়ে লাশ করে দেবে।

 বেশ সাবধানে, তেল দিয়ে, তা দিয়ে মোটামুটি শান্তিতেই দিন কাটছিল। যাকে বলে ট্যাকটফুলি। অনেক প্ররোচনা এসেছিল ও তরফ থেকে। ফাঁদে পা দিইনি। তবু মানুষ তো, হঠাৎ একদিন লেজে পা পড়ে গেল। পড়ল, ছেলেকে উপলক্ষ করে। ঘটনাটা সেই ঘটল। মায়ে ছেলেতে অনেকক্ষণ চুলোচুলি হচ্ছিল বাজারের হিসেব নিয়ে। হিসেব না কী মিলছে না। একেবারে দশ টাকার তঞ্চকতা। শেষে সেই। ছেলে বললে, এটা একটা পাগল। বদ্ধ পাগল। সঙ্গে সঙ্গে কোপ পড়ল আমার ঘাড়ে—’কি শুনতে পাচ্ছো না। না এখন কালা হয়ে গেছ?’ পরিবেশটাকে সহজ করার জন্যে আমি গান গেয়ে উঠলুম—’যখন কেউ আমাকে পাগল বলে/ তার প্রতিবাদ করি আমি/যখন তুমি আমায় পাগল বলো ধন্য যে হয় সে পাগলামি।’ ফল আরও খারাপ হল। যেন আগুনে ঘি পড়ল। একটু ভাঙচুর হল! তরতরিয়ে ছাতে উঠে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। পড়ে রইল সংসার।

যখন আমার যৌবন ছিল, প্রেমে যখন টইটম্বুর হয়ে আছি, রসে-পড়া রসগোল্লায় মতো, সেই সময় এমত অবস্থায়, পাইপ বেয়ে কার্নিস বেয়ে, ‘যার প্রাণ যাক প্রাণ’ করে ছাদে গিয়ে ল্যান্ড করতুম স্করোমুশের মতো। সে বয়েস তো আর নেই। সে মনও নেই আর। এখন মনে বাজছে ধ্যাততেরিকা সুর। অনেক খোশামোদ করেছি, আর না। হয় ওসপার না এসপার। থাকো বসে ছাতের গোঁসাঘরে। মানভঞ্জন পালা আর গাইব না। তোমারও অনশন, আমারও অনশন। অনশনের লড়াই চলুক। দেখি, কে হারে আর কে জেতে! হেঁকে বলে দিলুম। —আমিও খাব না। ঢ্যাং করে যেন একটা শব্দ হল কোথাও। যাত্রার দলে যুদ্ধ শুরুর আগে যেমন বাজে। যে যতই সিটি মারুক, এবার আমি কৃতসঙ্কল্প। প্রথম রাতে যে-বেড়াল কাটা হয়নি। সেই বেড়াল আমি না হয় কাটব শেষ রাতে। মরতে হয় মরব। এ মরণ আমার আধ্যাত্মিক আখ্যা পাবে। আমি শহিদ হব। পথের ধারে বেদি না হয় না-ই হল। না-ই বা হল মঠ।

 ছেলে পরোক্ষে বললে, ‘যত সব বয়েস বাড়ছে ততই যেন খোকা হচ্ছে। দু’দিন তিন দিন অন্তর অন্তর দামামা বাজলেই হল। নাও, সব না খেয়ে মরো, আমি চিনে রেস্তোরাঁয় চাওমিন মেরে আসি।’ মনে মনে বললুম, ‘তুমি আর বুঝবে কী, সেদিনকার ছোকরা। বিবাহিত মানুষের আমরণ সংগ্রাম স্ত্রীর সঙ্গে। বাঁকা লেজকে সোজা করতে করতেই জীবন শেষ। যাওয়ার ক্ষণে শেষ কথা—আমি আর পারলাম না। হেরে মরে ভূত হয়ে ঘাড় মটকাব। স্বামীদের এমন বরাত, মরেই সোজা স্বর্গে। নরক-যন্ত্রণা স্ত্রীর হাতেই হয়ে যায় কিনা। ভূত হতে পারলে কত স্ত্রীর ঘাড় মটকে যেত!’

স্নানটান করে শুদ্ধ শরীরে, শুদ্ধ বস্ত্রে, মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী বের করে আনলুম খুঁজে পেতে বইয়ের তাক থেকে। সেই মৃত মহামানবই এখন আমার শক্তি। তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কতবারই না অনশন করেছিলেন। কোনওবার তিনদিন, কোনওবার সাত দিন, একবার বোধ হয় পনেরো দিন গড়িয়েছিল। আমার সঙ্গে তাঁর তফাত, আমার অনশন স্ত্রীর শাসনের বিরুদ্ধে। তফাতই বা বলি কেন। একই তো। স্ত্রীরাও তো হোয়াইট রেস। ফরসা রং আর সমান অত্যাচারী।

গান্ধীজি অনশনের সময় কী শুয়ে পড়তেন। আমার কাছে তাঁর জীবনের ঘটনাবলীর ছবি সমন্বিত একটা অ্যালবামও আছে। টেনে বের করে আনলুম। বেশ বড়সড়। এই তো একটা ছবি। সাদা বিছানায় সাদা চাদর গায়ে শুয়ে আছেন। উঁচু বালিশে মাথা। মাথার কাছে তাঁর স্ত্রী। তার মানে অনশনে শোয়া ‘অ্যালাউড’। অনশনেরও তো একটা শাস্ত্র আছে। সেই শাস্ত্র তৈরি করে দিয়ে গেছেন মহাত্মা গান্ধী। কত বড় দূরদর্শী ছিলেন। জানতেন দেশ থেকে ইংরেজ চলে যাওয়ার পরেও স্ত্রী থাকবে। স্বামীদের অনশনের অস্ত্র নিয়ে লড়তে হবে।

অনশন মানে অনশনই। খাওয়াদাওয়া কিছু চলবে না, এমনকি জল পর্যন্ত না। জিভ খুব শুকিয়ে গেলে জলে তুলো ভিজিয়ে একটু ‘ময়েস্ট’ করে দেওয়া যেতে পারে। এটা বইয়ে লেখা নেই। অ্যাটেনবরোর গান্ধী ছায়াছবি দেখে জেনেছি। অনশন ভঙ্গের দিন এক গেলাস কমলালেবুর রস তোমাকে খেতেই হবে। তা না হলে ভোঁচকানি লেগে মৃত্যু। হাউহাউ করে ‘সলিড’ কিছু খেলেই শেষ খাওয়া।

যাক, শোওয়া যখন যায় আর সেইটাই যখন অনশন-বিধি, তাহলে দোতলার বসার ঘরের পরিচ্ছন্ন সোফা-কাম-বেড-এ শেষ শয্যা গ্রহণ করি—করঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। হয় মন্ত্রের সাধন না হয় শরীর-পাতন। মন্ত্রটা অবশ্য তেমন জোরদার নয়—স্ত্রীর সঙ্গে লড়াই। ব্যাখা করলে একটা গুরত্ব অবশ্য পায়—স্ত্রী মানে শক্তি। চণ্ডী বলছেন, স্ত্রীয়া সমস্তা সকলা জগৎসু। তার মানে —নারী আদি-শক্তি। সেই শক্তি চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পৃথিবীর যাবতীয় স্ত্রী তৈরি করেছেন সেই বিশ্বস্রষ্টা। সেই স্ত্রীদের নানা চেহারা, ভাব আর ভাষা। সেই শক্তি, সেই আদি আর আদ্যাশক্তির সঙ্গে যে ধর্মযুদ্ধ, সেই যুদ্ধস্থলের নাম ‘সংসার সমরাঙ্গন’। আর অস্ত্র হল ‘অনশন’। এই নিয়ে ছেলেমেয়েরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলেও ব্যাপারটা তুচ্ছ, ছেলেখেলা নয়। স্বদেশি আন্দোলনের চেয়েও মহান। সে আন্দোলন স্বাধীনতার পরই খতম। এই আন্দোলন চলবে সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত। সংসার নামক অনাসৃষ্টি যত দিন থাকবে তত দিন। যৌবনে মানুষ হেলে লেলে করে বিয়ে করবে। তারপর ফুলশয্যার ফুল শুকোতে না শুকোতেই শুরু হয়ে যাবে ফাইটিং। একজোড়া হুলোহুলির জীবনযুদ্ধ।

বিচার-বিশ্লেষনের পর মনে বেশ আধ্যাত্মিক-শক্তি জড়ো হল। শুধু চোখ রাখলুম আমার প্রতিযোগী কী করছে। জল বা পান খাচ্ছে কি না। সংসারি মানুষের চা-ও এক দুর্বলতা। কাকের কা কা-র মতো মধ্যবিত্তের চা চা। এদিকে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা, এদিকে ক্ষণে ক্ষণে, ওরে চা চাপা।

মহিলা মারাত্মক, জলের ধারে কাছে গেলেন না। এত বড় পানাসক্ত কিন্তু একটাও পান খেলেন না। চায়ের জন্যে কোনও চাতকতা দেখা গেল না। অথচ আমার একইসঙ্গে জল খেতে ইচ্ছে করছে। চা খেতে ইচ্ছে করছে। ধমক ধামক দিয়ে সেই সব ইচ্ছে তাড়ালুম। মন দেখ ওই নারীকে, কী সাংঘাতিক মনের জোর। আগের জন্মে কোনও জৈন সাধু ছিল না তো! মন দ্যাখো শেখো। শেষে মন, কোথাও কিছু নেই, বলে কি না, মিছরি খাব। সে কি রে! মিছরি খাবি কি রে! মিছরি কেউ খায়! শেষে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করলুম। আর ঘুমিয়েও পড়লুম।

সন্ধের সময় কপাল গুণে এসে হাজির হলেন আমাদের কুল-পুরোহিত। তাঁর পিতার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ পরের দিন। যজমান তো, ‘তুমি কাল একবার এসো বাবা।’

‘আমি তো পারব না ভটচাজ মশাই। আমার নির্জলা উপবাস চলছে।’

‘কেন? ও বৈশাখ মাস। তুমি বুঝি পঞ্চতপা করছ। আহা। তা করবে না। কোন বংশের ছেলে তুমি। প্রথম দিকটায় তুমি যখন ভেস্তে গিয়ে, নিজের পছন্দ-করা পাত্রীটিকে বিয়ে করে আনলে, তখন তোমার পিতাঠাকুর বড় আঘাত পেয়ে বলেছিলেন, বংশের কুলাঙ্গার। আমি মনে মনে হেসেছিলুম—জানতুম তুমি ফিরবে। বোম্বাই-আম গাছে বোম্বাই-আমই হবে। আমার বিশ্বাস আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। তা তোমার উপবাস ভঙ্গের দিন একটা খবর দিও। কিছু অনুষ্ঠান তো আছেই। তা না হলে ব্রতের ফল বিফলে যাবে।’

তিনি চলে গেলেন। আমি আবার শুয়ে পড়লুম। এখন এনার্জি খরচ করা চলবে না। মানুষ একটা ব্যাটারি। যত ওঠা-বসা-ঘোরাফেরা করবে ততই খরচ হয়ে যাবে। শুয়ে শুয়ে একটা ধর্মপুস্তক পড়ার চেষ্টা করলুম। খাদ্যের শক্তিতে কী হয়। মল, মূত্র, কফ, পিত্ত। যাবতীয় কামনা-বাসনার উৎস, কলা-মুলা, ঘেঁচু-মেচু। আধ্যাত্মিক খাদ্যই তো খাদ্য। মনের শক্তিই তো শক্তি। আমি যদি বেঁচে যাই, তাহলে সংসার পানসে হয়ে যাবে। বৈরাগ্যের পথই আমার পথ, তখন বউকে মনে হবে কবিরাজী পাঁচন। উপকারী কিনা জানি না, তবে অখাদ্য।

রাতটা কেটে গেল। শেষ রাতে আবার স্বপ্নও দেখলুম। একটা গাধা, তার পিঠে অনেক বোঝা। গাধাটা ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে, আমিও চলেছি তার পেছন-পেছন, মাঠ-ময়দান, পেরিয়ে। একটা আটচালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখি বসে আছেন মহাদেব স্বয়ং, বাঘছাল পরে। ভস্ম-টস্ম মাখা। পাশে ত্রিশূল। তিনি বলছেন, কী রে গাধা! এই বুড়ো বয়সে এলি। আমি ইংরেজিতে উত্তর দিতে গেলুম—বেটার লেট দ্যান নেভার।’ আমার গলা দিয়ে তিনটে গাধার ডাক বেরোল, হ্যাঁককো, হ্যাঁককো। অবাক কাণ্ড, দেখি কি, আমি আর গাধা এক হয়ে গেছি। একটা মহা অশান্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠলুম—আমার ভেতর গাধাটা ঢুকল, না আমি গাধাটার ভেতর ঢুকে গেলুম!

বেলা বারোটা নাগাদ, আমার অনশন আর স্ত্রীর বিরুদ্ধে জেহাদ নয়, বৈজ্ঞানিক অনুসিন্ধৎসায় পরিণত হল। কারণ আমার বাঁদিকটা দুর্বলমতো হয়ে গেল। বাঁহাত আর বাঁপায়ে তেমন জোর পেলুম না, কেমন যেন থ্যাসথ্যাস করছে। মাথাটাও কেমন যেন ঝিম মেরে আসছে। সেই মুহূর্তে আমার রাগ-বিদ্বেষ সব উবে গেছে। তুচ্ছ সংসার তলিয়ে গেছে। নিজের কাছে তখন নিজে এক গিনিপিগ। দেখি না, একটু একটু করে কী কী যায়। পুরো ব্যাপারটা ঘুরে গেল জীববিজ্ঞানের দিকে। আহারের প্রয়োজন আছে কি না। কতটা আহার প্রয়োজন। মধ্যবিত্তের ফ্যামিলিতে একটা চাকুরিজীবী সকালে কোনওরকমে নাকে মুখে গোঁজে। সারাদিন সে পাখি। এই ছোলা, মুড়ি, বাদাম-মাদাম আর চা নামক তরল পদার্থ খেয়ে দিন চালায়। রাতেও আহমরি কিছু তেমন হয় না। মাঝেমধ্যে কোনও উপলক্ষে খাওয়ার মতো খাওয়া হয়—প্রাোটিন, ভিটামিন, ক্যালোরি, সব মিলিয়ে হল একটা। তা প্রতিদিনের ওই আহারেই শরীর চলে-ফিরে বেড়াচ্ছিল, ছোটমতো একটা ভুঁড়িও নামছিল। আমি মন করতুম—না খেয়েই তো বেশ বেঁচে আছি। তা নয়, ওই খাওয়াটাও খাওয়া ছিল। যাই হোক, এখন আমি দর্শক। আমার শরীরের দর্শক। কীভাবে, একে একে সব পড়বে। বাঁদিকে শুরু ডানদিকটা আছে এখনও। এই যে শুয়ে শুয়ে কাগজ ধরে চোখের সামনে তুলে পড়ছি, থেকে থেকে বাঁদিকটা কেতরে পড়ছে। কিছুতেই ধরে রাখা যাচ্ছে না। দৃষ্টিও ঘোলাটে হয়ে আসছে। যেন রাজকাপুর ধোঁয়া ছেড়েছেন আর নার্গিস নাচছেন।

সন্ধের সময় মনে হল, আমি একটা বোতল। আমার দুটো পাশ নেই। গোল ব্যারেল। লম্বা একটা গলা। আমাদের অনশনের খবর বাড়ি থেকে ছড়িয়ে গেছে পাড়ায়। যাবেই। বাড়ির কাজের লোক হল মধ্যবিত্তের সংসার সংবাদপত্রের রয়টার। সে-ই একেবারে হেডলাইন করে ছেড়ে দিয়েছে। তাঁরা সব একে একে এলেন। মেয়েরা চলে গেলেন আমার বউয়ের দিকে। পুরুষরা এলেন আমার দিকে। এঘর আর ওঘর। মাঝে পাতলা পার্টিশানের ব্যবধান মাত্র। চোখ আমার ঘোলাটে। দেহের দুটো পাশ পড়ে গেছে; কান দুটো কিন্তু ঠিক আছে। এইভাবেই একে একে যায়। প্রথমে বাঁদিক, তারপর ডান দিক, অবশেষে চোখ। কান দুটো কখন যায় দেখি। ক’দিনের অনশনে। মাথাটাকে ঠিক রাখছি রাগের খোঁচা মেরে। ক্রোধরূপী সর্পের ছোবলে বোধটাকে সজাগ রাখছি। তা না হলে কোমা স্টেজে চলে যাব। যেতে চাই সজ্ঞানে। রেকর্ডের গান যে-ভাবে ‘ফেড আউট’ করে। আমি যাবই, আমি যাব—যাব—যাব…

কানে আসছে আমার প্রতিবেশী মহিলাদের কণ্ঠস্বর। তাঁরা আমার স্ত্রীকে বলছেন, ‘কী আর করবে বলো, অমানুষের হাতে পড়লে এইরকমই হয়।’

আচ্ছন্ন অবস্থাতেই আমার ফোঁস—’ কোন শালা অমানুষ।’

সঙ্গে সঙ্গে আমার তরফের প্রতিবেশী পুরুষদের একজন আমার বুক চেপে ধরে বললে—উঁহু! শেষ সময়ে রাগে না, রাগে না। এই যে শালা বললে, অমনি তোমার শালার কথা মনে পড়ল। এখন যদি গয়া পাও তাহলে তোমাকে কিন্তু শালা হয়ে জন্মাতে হবে। মানে ‘ডিমোশান’ হল। স্বামী থেকে শালা।’

আমার সাপোর্টে একজন বললে, ‘স্বামী হওয়ার চেয়ে শালা হওয়া হাজার গুণ ভালো। আমি দেখছি তো আমার শ্যালকটি আমার সব চৌপাট করে দিলে। লাস্ট, আমার নতুন সাইকেলটা ছিল, সেটাও কাল হাওয়া।’

গম্ভীর গলায় একজন বলল,—’পরিবেশটা নষ্ট করবেন না আপনারা। এই সময়ে শুধু তাঁর কথা বলুন। ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে। কাকাবাবুর যা অবস্থা, হার্ডলি আর ঘণ্টাতিনেক।’

তার কথাও শেষ হল আর ও-ঘর থেকে এসে ঢুকলেন আমাদের পাড়ার বিখ্যাত খান্ডারনি মহিল। খান্ডারনি হলেও ভদ্রমহিলার গুণ অনেক। পরোপকারী। লোকের বিপদে আপদে সবার আগে তিনিই এগিয়ে যান। সবাই তাঁকে ভয় আর ভক্তি, দুটোই করেন। আমি মিটিমিটি চোখে দেখেছি—তিনি আমার সামনে এসে, কোমরে দুটো হাত দিয়ে দাঁড়ালেন। দেখতে-শুনতে বেশ ভালোই। চেহারায় বেশ একটা চটক আছে। বড় বড় মাদুর্গার মতো চোখ। ঘাড়ের কাছে ইয়া বড় এক খোঁপা লাট খাচ্ছে। চুপ করে থাকলে জগদ্ধাত্রী, মুখ খুললে রণচণ্ডী। আমাদের পাড়ার কমন বউদি।

তিনি আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ইয়ারকি হচ্ছে, বুড়ো বয়সে। সারা দেশে অশান্তির শেষ নেই। পাঞ্জাবে খালিস্তানী। কাশ্মীরে কাশ্মীরি। ওদিকে রামশিলা, বাবরি মসজিদ। মানুষ পটাপট মরছে। আর এঁরা দেবা-দেবী একজন এঘরে দেয়লা করছেন, আর একজন ওঘরে পেছন উলটে পড়ে আছেন। এ পাড়ায় ওসব চলবে না। গণধোলাই হবে, গণধোলাই। খুব হয়েছে, উঠে বসুন।’

আমার ‘ফরে-র একজন বললে, ‘ওঠার ক্ষমতা নেই বউদি। দুটো অঙ্গই পড়ে গেছে।’

‘তাই না কি? কত ভিরকুটিই জানে এই মাঝবয়েসি মিনসেরা। সারাটা জীবন শুধু জ্বালাবে। ভালোয়, ভালোয় উঠে বসুন, নয়তো সকলের সামনে বেইজ্জত করে দোব। আমি সব পারি। এই সব প্যান্তাখ্যাঁচা লোককে কী করে শায়েস্তা করতে হয় আমি জানি।’

ভয়ে ভয়ে উঠে বসলুম। মাথা ভোঁভোঁ করছে। আমার সামনেই ডুরে শাড়ি-পরা বউদির বুক। পেট। মরতে মরতেও শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। অনশন বিজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলুম বলেই মনে হল, বা চরম একটা সত্যের উপলব্ধি হল —আটচল্লিশ ঘণ্টা নির্জলা উপবাসে থাকলেও প্রবল একটা ইন্দ্রিয় বেশ টগবগেই থাকে।

বউদি আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘টেকো বুড়ো আর কত ভিরকুটি হবে। অমন দেবীর মতো বউটাকে বিধবা করার ইচ্ছে হয়েছে। একালে আর বিধবা হয়ে আলোচালের পিণ্ডি গেলে না, স্বামীর ছবির সামনে সন্ধেবেলা ধূপ জ্বালিয়ে—আছে দু:খ আছে মৃত্যু বলে গান গায় না।’

বুকে আমার মুখ জুবড়ে গেছে। অনেক দিনের আশা। আবার লজ্জাও করছে। পাঁচজনের সামনে।

বউদি হেঁকে বললেন,—’অনশন ভঙ্গ।’

আমার সাপোর্টাররা বললেন, —’তা হলে তো কমলালেবুর রস চাই।’

খোঁজপাত করে দেখা গেল, কমলালেবু অরেঞ্জ স্কোয়াশ কিছুই নেই। আনাজের ঝুড়িতে গোটাকতক করলা পড়ে আছে। তাই হোক। করলাও তো ‘ফ্রুট’। করলার ‘জুস’ খেয়ে অনশন ভঙ্গ হবে। তারপর ঠিক হল, পাতলা ঝোল আর সরু চালের গরম-গরম ভাত। একটু গাওয়া ঘি। শোনামাত্রই সেই ছেলেবেলার অবস্থা হল। পেটখারাপের উপবাসের পর ন্যাংলা সিঙ্গিমাছের ঝোল দিয়ে একথালা ভাত উড়িয়ে মনে হত পেটখারাপের কী আনন্দ!

মহিলারা ডাকাত পড়ার মতো রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন। কাটা, ছেঁড়া ধোয়া, ফোটানো, ফ্যাটানো, নিমেষে সব শেষ। খাবার টেবিলে সব সাজানো হয়ে গেল। আমার সাপোর্টাররা আগে কেটে পড়েছে। নারীবাহিনি এখন দু’ভাগ। একদল আমাকে নিয়ে, আর একদল আমার বউকে নিয়ে ঢুকল। এমন দর্শনীয় আহার জীবনে হয়নি।

আমি এইবার খুব সাবধানী। শেষ মুহূর্তে হারতে চাই না। ম্যাচ ড্র হবে। আমি বললাম, ‘দুজনে একসঙ্গে খাবার মুখে তুলব। আপনারা, ওয়ান, টু, থি বললেন। তা না হলে, কৌশল করে আমাকে হারিয়ে দেবে।’

‘বেশ তাই হবে।’ বলে বউদি তিন গুনলেন। দুজনের হাত উঠছে ভাতের নাড়ু নিয়ে। যেই আমি ঠোঁটের কাছে এনে খাওয়ার ভঙ্গি করেছি, খাইনি কিন্তু, আমার বউয়ের হাত নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে আমি চিৎকার করে বললুম, ‘ওই দেখুন খেল শুরু হয়ে গেছে।’

বউদি বললেন, ‘বউটাও তো কম শয়তানি নয়।’

তখন ঠিক হল, একসঙ্গে দুটো নাড়ু তিন গোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। তাই হল। ভঙ্গ হল অনশন।

তারপর সে কি হ্যাঁকোচ প্যাঁকোচ প্রেম আমাদের। যেন আবার নতুন করে ফুলশয্যা হচ্ছে আমাদের। আয় ভাই কানাই, মনের দু:খ কাহারে জানাই। তবু পিপড়ের স্বভাব যাবে কোথায়। বললে, ‘বউদির বুক কেমন লাগল? খুব মিষ্টি, তাই না!’

পাঁচ মিনিটের ভালোবাসা ‘ফিনিশ’। দুজনে দুপাশ ফিরে শুলুম। পিঠে পিঠ ঠেকে রইল। মনে মন। মাঝখানে কলহের মাখন। ওপাশ থেকে পাগলি বললে, ‘তুমি খেলে না কেন? খেলেই পারতে!’

আমি বললুম, ‘তুমি না খেলে খাই কী করে?’

আমার বউ হুড়ুম করে পাশ ফিরল। আমি হয়ে গেলুম একটা পাশবালিশ। পৃথিবীটা কত ছোট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *