অধ্যায় ৯ – সামাজিক অবস্থা
শিক্ষা ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও উৎসাহের প্রতি নির্ভরশীল
প্রতিটি যুগে ও দেশে জীবন আবর্তিত হত পুরুষরা কোন্ শিক্ষা গ্রহণ করছে সেটার উপরে ভিত্তি করে। আমরা যে-সময়ের বাংলার কথা বলছি, সেসময়ে বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষা পুরোটাই নির্ভরশীল ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে, যেগুলো প্রধানত স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় হত। রামেশ্বর তার শিবায়ন লিখেছেন বর্ধমানের রাজা যশোবন্তের আদেশের অনুবর্তী হয়ে; অনন্তরাম ক্রিয়াযোগসার লেখেন বিশারদ নামের এক ধনী ব্যক্তির নির্দেশে; দ্বিজ ভবানী রামায়ণ সংকলন করেন রাজা জয়চন্দ্রের (যার রাজধানী ছিল নোয়াখালীর কাছে-পিঠে) সভায়, আর এজন্য তিনি প্রতিদিন ১০ রুপি করে সম্মানী পেতেন। সংস্কৃত চর্চাকে উৎসাহ দিতে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিমাসে ২০০ রুপি করে বরাদ্দ করেছিলেন তার এলাকার চতুষ্পাঠীগুলোয় (সংস্কৃত শিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান) দূরদূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বৃত্তি হিসেবে। তার পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারতচন্দ্ৰ আনন্দমঙ্গল ও রামপ্রসাদ কৃষ্ণচন্দ্রের আত্মীয় রাজাকিশোর মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে কালীকীর্তন লেখেন।
উচ্চতর হিন্দু শিক্ষা
হিন্দুরা উচ্চতর শিক্ষা পেত চতুষ্পাঠীগুলোয়, যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ শহর ও গ্রামগুলোয় স্থাপন করা হয়েছিল। আর সেখানকার পাঠদানের ভাষা ছিল সংস্কৃত। এই চতুষ্পাঠীগুলোর প্রকৃতি ছিল বহুজাতিক, যেখানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্ডিতেরা পাঠদান করতে ও বিদ্যার্থীরা জ্ঞান আহরণ করতে আসতেন। রামপ্রসাদ বর্ধমানের একটি চতুষ্পাঠীর বর্ণনা লিখে গেছেন যেখানে দ্রাবিড়, উৎকল, কাশী ও তিরহুত থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হয়েছিল। তিনি এটাও লিখেছেন যে কীভাবে ছাত্রজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে হত এখানে আগত শিক্ষার্থীদের। তার শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছিল পঞ্চম বছরে, বিশেষ মঙ্গলজনক আয়োজনের ভেতর দিয়ে। প্রথমে তিনি চিঠি লেখা শিখেছিলেন, যার ফলে তিনি ব্যাকরণের সঙ্গে ভক্তিকাব্য, রঘুবংশম, কুমারসম্ভবমের মতো সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। এগুলো পড়ার পর তরুণ মেধাবী অলংকারশাস্ত্রের পাঠে মগ্ন হলেন। এরপর তার পাঠক্রমে ছিল যুক্তিবিদ্যা আর তারও পরে বিজ্ঞানের পরিণত শাখার জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো বিদ্যা, আর বিভিন্ন ধরনের দর্শন, যার মধ্যে বেদান্ত ও বৈদিক ছন্দ শাস্ত্রও ছিল।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ও উড়িষ্যায় মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চা করার মতো কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মধ্যে বাংলায় সেসময়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন ও শিবায়নের লেখক রামেশ্বর উল্লেখযোগ্য। সেসময়ের উড়িষ্যার কবিদের ভেতর উপেন্দ্র ভঞ্জ, রামদাস, কৃষ্ণ সিংহ, সদানন্দ কবিসূর্যব্রহ্ম, অভিমন্যু সামন্ত সিংহ ও ব্রজনাথ বরজেন নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। আমরা তাদের লেখা উড়িয়া ভাষায় পাই, তবে তাদের অনেকেই সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় বেশ দক্ষ ছিলেন।
শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কেন্দ্ৰ
যেসব এলাকায় সংস্কৃত ও অন্যান্য স্বদেশি ভাষায় জ্ঞানার্জনকে প্রাধান্য দেওয়া হত, নদীয়া তাদের মধ্যে অন্যতম জায়গা দখল করে আছে। প্রকৃতপক্ষে নদীয়া ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের কেন্দ্র, ন্যায়ায়িকদের (যুক্তিবাদীদের) ভূমি, যারা কার্য- কারণ খুঁজতেন ও তর্ক করতেন প্রতিটি বোধগম্য বিষয় নিয়ে, জ্যোতির্বিদদের আশ্রয়, যার পঞ্জিকা ও পাঁজি এখনও উৎসবের, পূজার, হিন্দুদের প্রতিদিনের গৃহস্থালি কর্মযজ্ঞের নিয়ন্ত্রক। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির একজন বড় পৃষ্ঠপোষক আর তার সভা ছিল বুদ্ধিমান নক্ষত্রের সমাবেশ (প্রায় ৮০ জন), যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দক্ষ ছিলেন। ভারতচন্দ্রের নাম আগেই বলা হয়েছে, মহারাজার নিজেরও সংস্কৃতে দক্ষতা ছিল। তিনি প্রায়ই সূক্ষ্ম সমস্যা নিয়ে হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি ও রামগোপাল সার্বভৌমের সঙ্গে যুক্তি-তর্ক চালিয়ে যেতেন, আর প্রাণনাথ ন্যায়পঞ্চানন, গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, রামানন্দ বাচস্পতি, রামবল্লভ বিদ্যাবাগীশ ও বীরেশ্বর ন্যায়পঞ্চানের সঙ্গে ধর্মবিষয়ে আলাপ করতেন। বানেশ্বর ছিলেন তার রাজকবি, তার সঙ্গে মিলে তিনি সংস্কৃত পদ লেখার চেষ্টা করতেন। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ রামরুন্দ্র বিদ্যানিধি তার সভাতেই বেড়ে উঠেছিলেন ও তার বিখ্যাত বই সারসংগ্রহ লিখেছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা
সেসময়ে আধুনিক সময়ের মতো মাধ্যমিক শিক্ষার প্রচলন ছিল না। কিন্তু প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ছিল পাঠশালা (প্রাথমিক বিদ্যালয়), যেখানে পড়া, লেখা, অঙ্ক কষা আর শারীরিক ও প্রাকৃতিক কিছু প্রারম্ভিক জ্ঞানের মূলসূত্র ধরিয়ে দেওয়া হত। হিন্দু অঙ্কবিদ শুভঙ্কর অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে নয়তো সপ্তদশ শতকের শেষভাগে খ্যাতি পেয়েছিলেন আর খুব সম্ভবত বাংলার পাঠশালাগুলোয় অষ্টাদশ শতক জুড়ে তারই কৌশল পড়ানো হত। ১৮৩৪-৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের নিয়োগপ্রাপ্ত ডব্লিউ অ্যাডাম তার দ্বিতীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন :- এই বিদ্যালয়গুলোতে অন্য জিনিসগুলোর ভেতর শুভঙ্করের নীতি লিখিত ছিল আর কেবলমাত্র ছন্দাকারে গাণিতিক সূত্রগুলো পড়ানো হত, যিনি বাংলায় ইংল্যান্ডের ককারের মতোই জনপ্রিয় ছিলেন, কেউ জানত না তিনি কে বা কী ছিলেন, আর তার জীবনকালই বা কী ছিল। আদৌ এই নামে কেউ ছিল কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তার নামে প্রচলিত ছড়ার মতো সূত্রগুলো ব্রিটিশরা ভারতে শাসনে বসার আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, আর মুসলিম শাসনের সময়ে তা বহাল ছিল, কারণ সেগুলোয় প্রচুর হিন্দুস্তানি ও ফার্সি শব্দের ব্যবহার রয়েছে, আর নজির রয়েছে প্রত্যন্ত এলাকায় মুসলমানদের সেগুলো ব্যবহারের ইংরেজির চর্চা বা গণনা পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার ছাড়াই।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাজের প্রতিটি স্তরেই বিস্তার লাভ করেছিল, উঁচু-নিচু সব শ্রেণির লোকেরাই এর সুবিধা আর আনন্দ উপভোগ করত। জনৈক মধুসূদন, জাতে নাপিত- ১৮০৯ সালে লিখেছিলেন নল-দময়ন্তী, আর উল্লেখ করেছিলেন যে তার বাবা ও দাদা দুজনেই ছিলেন বিখ্যাত লেখক। মধুসূদনের বাবা ও দাদার সাহিত্যকাল পাওয়া যায় না, তবে মধুসূদন যদি ১৮০৯ সালে খ্যাতিলাভ করেন তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে তার দাদা অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। বিদ্যালয় ছাড়াও আরও কিছু নির্দিষ্ট পন্থা ছিল যার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ খানিকটা আলোকিত হতে পারত। ধর্মীয় গান, সংকীর্তন, জনপ্রিয় লোকগল্প, হাস্য-রসাত্মক লোকগীত সমাজে বহুলপ্রচলিত ছিল আর তা সবশ্রেণির মানুষের মনে প্রভাব ফেলত কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও নান্দনিক বোধের মিশ্রণে। এগুলো সবাই এমনভাবে আউড়ে যেত যে সমাজের সবচেয়ে নিচুস্তরের অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে উঁচুতলার শিক্ষিত মানুষের পার্থক্য টের পাওয়া যেত না। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই মানুষগুলো জ্ঞানের সন্ধান করত কেবল সৎ বিনোদনের আর আত্মিক উন্নয়নের জন্য; তারা নিজেদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়ার জন্য বিদ্যার্জন করত না। মধুসূদনের দাদা তার পেশা ছেড়ে দেননি বিখ্যাত কবি বনে যাওয়ার পর, আর তার নাতিও সেই নাপিতই ছিলেন।
ফার্সি শিক্ষা
ফার্সি ভাষায় শিক্ষা বেশ বিস্তার লাভ করেছিল। মুসলিমদের জন্য এই মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য আর হিন্দুরাও খানিক আয়ত্ত করেছিল।
ফার্সিজ্ঞান বাস্তবিক প্রয়োজন ছিল হিন্দুদের জন্য
শাসকদের ভাষা হওয়ার কারণে ফার্সি তখনকার দাপ্তরিক ভাষা ছিল, আর হিন্দুরা নিজেদের নবাবের সরকারে ও কোম্পানির বিভিন্ন পদে যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার জন্যই এটা শিখত। এভাবে কোম্পানির কেরানি কবি রামপ্রসাদ সেন অল্প সময়ে একজন মৌলভীর সাহায্যে এই ভাষা আত্মস্থ করেন। তার রচিত বিদ্যাসুন্দর বইয়ে মাধব ভাটের কাঞ্চিপুরা যাত্রা আমাদের ধারণা দেয় তিনি ফার্সি ও উর্দুতে কতটা দক্ষ ছিলেন। ভরতচন্দ্রের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। চৌদ্দ বছর বয়সে, যখন তিনি সংস্কৃত বেশ ভালোভাবেই জানতেন ও মণ্ডলঘাট পরগণার তাজপুরের কাছে সারদা গ্রামের আচার্য পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করেন, তার বড়ভাই তাকে পুরোপুরি সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানার্জনের জন্য নিয়োজিত করেন, ফার্সি বাদ দিয়ে; যা হয়তো তখন বাস্তবজীবনে তাকে আরও বড় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারত। এটা অবশ্য তার জীবনে শাপে বর হয়, কারণ এর পরই তিনি হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়ার পশ্চিমে দেবানন্দপুরের হিন্দু কায়স্থ রামচরণ মুন্সির কাছে যান, আর জলদিই ফার্সি শিখে নেন। ধারণা করা যায় বাংলার অন্য গ্রামগুলোতেও হিন্দুসম্প্রদায়ে এমন আরও লোক ছিল যারা রামচরণ মুন্সির মতোই ফার্সি জানত। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে বাংলায় রচিত ধর্মমঙ্গলের লেখক নরসিংহ বসুর ফার্সিজ্ঞান ছিল উল্লেখ করার মতন, আর ১৭৫০ সাল নাগাদ শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফার্সি-শিক্ষক। আলীবর্দীর হিন্দু- কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিভাগে সন্তোষজনকভাবে কাজ করতে পারতেন না, যদিনা তাদের ফার্সিভাষায় দক্ষতা থাকত। তাদের মধ্যে একজন কিরাতচাঁদ, যিনি ফার্সিতে নির্ভুল ব্যাকরণে চমৎকার লিখতে পারতেন। আর আগেই বলা হয়েছে রাজা রামনারায়ণ ছিলেন বিখ্যাত ফার্সি-কবি।
নবাব ও মুসলিম অভিজাতদের ফার্সি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা
নবাব ও অনেক মুসলিম অভিজাতেরা ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আলীবর্দীর দরবার থেকেই একদল মেধাবী বিদ্বান বেরিয়ে আসে।
ফার্সি শিক্ষার কেন্দ্র পাটনা
আজিমাবাদ (পাটনা) ছিল ফার্সি শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। গোলাম হোসেন লিখেছেন :— সেই সময়ে আজিমাবাদে এমন লোক প্রচুর ছিল যারা জ্ঞান ও বিদ্যার্জনে আগ্রহী ছিল আর অন্যদের শেখানোর পাশাপাশি নিজেরা বিদ্যার্জনে নিয়োজিত ছিল; এবং আমার মনে পড়ে শহর আর তার আশেপাশে নয় থেকে দশ জন খ্যাতিমান অধ্যাপক ও তিনশো থেকে চারশো শিক্ষার্থী ও শিষ্য দেখেছিলাম, যা থেকে অনুমিত হয় অন্য শহরগুলোতেও ফার্সিভাষায় দক্ষ মানুষেরা ছিল। তাদের মধ্যে বিহারে খ্যাত ছিলেন মুযাফফার আলী উপাধির কাজী গোলাম মুযাফফার, যিনি মুর্শিদাবাদের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন আলীবর্দীর সময়ে। ২৪
ইরান থেকে পাটনায় বিদ্বানদের আগমন
ইরান থেকে প্রচুর বিদ্বান ব্যক্তিরা হিন্দুস্তানে আসেন আর নির্দিষ্টভাবে বিহার শহর ও আজিমাবাদ শহরে বসতি গাড়েন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য (১) আল মুহাম্মাদ মাদু বা আলী, বিখ্যাত কবি হাজিন, (২) শেখ মুহাম্মাদ হোসেন, (৩) সৈয়দ মুহাম্মাদ আলী ও (৪) হাজী বদিউদ্দিন।
ফার্সি শিক্ষার পাঠ্যক্রম ও প্রতিষ্ঠান
ফার্সি শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চপাঠক্রমে মূলত ফার্সি সাহিত্য, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান আর জ্যোতির্বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত ছিল। এধরনের শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানেরও অভাব ছিল না; আরবি ও ফার্সির জন্য অধ্যাপক পাওয়া যেত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোয় দ্রুত গড়ে ওঠা মসজিদ. ইমামবাড়া, আর মক্তবে।
ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষার চল হয়নি তখনও
সেসময় সাধারণভাবে বাংলার মানুষেরা ইউরোপীয় ভাষা জানতে আগ্রহী ছিল না। এডওয়ার্ড ইভেস লিখেছেন : যদিও সেখানে শিশুদের জন্য অনেকগুলো বিদ্যালয় রয়েছে, তবে সেগুলোর মাধ্যমে তারা মাতৃভাষার বেশি কিছু শিখতে পারে না। এটা আসলেই বিস্ময়কর যে তাদের মধ্যে প্রচুর ইংরেজরা স্থায়ী হয়েছে আর তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লেনদেন করছে কিন্তু তারা আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারছে না মাদাগাস্কারের বন্দরের লোকেদের মতোই। কিন্তু সেখানে কিছু মানুষ ছিল যারা কোনো-না-কোনোভাবে ইংরেজি ভাষা শিখেছিল। সংস্কৃত ও ফার্সি শেখার পর রামনিধি (নিধুবাবু নামেই জনপ্রিয়) খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকের (মিশনারি) মাধ্যমে ইংরেজির পাঠ নেন। কিছু খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকেরা স্থানীয় বাচ্চাদের ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা করেন। ম্যাপললোফট ১৭৫৪ সালে কলকাতা কাউন্সিলে আবেদন করেন :— আমরা আনন্দিত যে, এই আবেদন আপনাদের কাছে অযৌক্তিক মনে হবে না, কারণ এটা প্রমাণিত যে শিশুরা সুশিক্ষিত ও ইংরেজি ভাষায় নির্দেশনা ও হিসেব রাখতে পারলে, তারা সেখানকার ভদ্রলোকদেরই যে কেবল সাহায্য করতে পারবে তা নয়, সম্মানিত কোম্পানিরও কাজে আসবে। সম্ভবত সাগার্ফনামাহর লেখক ইতসামুদ্দিন, যিনি ১৭৬৬ সালে কোম্পানির দিওয়ানি লাভের পর ভারতীয় সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের দূত হয়ে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে গিয়েছিলেন, তিনি সম্ভবত ইংরেজি জানতেন, নইলে তিনি এধরনের কাজ করতেন না।
নারীশিক্ষা
নারীশিক্ষার ব্যাপারটা সেসময়ে অজানা ছিল না। ভারতচন্দ্রের ও রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দরের নায়িকা বিদ্যাকে দেখানো হয়েছে সুশিক্ষিতা হিসেবে তাকে এতটাই শিক্ষিত দেখানো হয়েছে, বলা হয়েছে সাহিত্য-তর্কে তাকে যে পরাজিত করবে, সে তাকেই বিয়ে করবে। নাটোরের রানী ভবানী তার সমসাময়িক ইন্দোরের অহল্যা বাইয়ের মতোই সুশিক্ষিত ছিলেন। নসিপুরের ব্রাহ্মণ যশোবন্ত রায়ার স্ত্রী বাংলা হিসাব-কিতাব জানতেন, আর রাজা নবকৃষ্ণের স্ত্রী পড়তে জানার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত ভাঁড় রসরাজার মেয়ে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে জানতেন নিজেদের ভেতরে। বৈরাগী ও সন্ন্যাসী নারীরা সংস্কৃত ভাষা জানতেন আর এখনও (১৯৩৯) তারা দেশীয় ভাষায় জনপ্রিয় কবিতার মাধ্যমে আলাপ চালিয়ে যান। উচ্চবংশীয় মুসলিম নারীরাও কিছু শিক্ষা পেতেন।
আর এভাবে আমরা দেখতে পারি সেসময়ের নারীরা অবহেলার অন্ধকারে ডুবে ছিল না। প্রত্যন্ত গ্রামেও মহিলা কবি ও লেখকদের দেখা যেত, যারা তাদের এখনকার উচ্চশিক্ষিত বোনদের থেকে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিল না। দ্য অক্সিলারি কমিটি অফ দ্য ইন্ডিয়ান স্যাচুটরি কমিশন ১৯২৯ সালে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয় যে, হিন্দু বা মুসলিম ধর্মের মধ্যে এমন কোনো উপাদান নেই যা নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলে। এমনকি আদিকালে এমন নারীদেরও পাওয়া যায় যারা প্রভূত জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন, বিশেষত পবিত্র ও প্রথাগত সাহিত্যে। এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে তাদের জন্য সেসময়ে ছেলেদের মতো বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা ছিল কি না। খুব সম্ভবত নারীশিক্ষার ব্যাপারটি ব্যক্তি উদ্যোগেই হত, কারণ সেসময়ে তাদের সেবাদানকারী হিসেবেই গড়ে তোলা হত, রাষ্ট্রনায়ক বা বাগ্মী হিসেবে নয়, যদিও আমরা কিছু নারীকে দেখি যারা রাষ্ট্রের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন।
নারীদের নির্ভরতা
নারীদের অবস্থান
নারীরা পুরোই তাদের অভিভাবকদের (স্বামী) মর্জির উপর নির্ভর করতেন, আর তাদের অনুমতির বাইরে কিছু করতেন না। তারা বাড়ির চারদেয়ালের ভেতরেই থাকতেন, আর বাইরের কারো সামনে যাওয়া বারণ ছিল। ভেরেস্ট লিখেছেন
নারীদের আটকে রাখার আইন পরিবর্তনযোগ্য নয়। ভারতজুড়ে এই চর্চা রয়েছে, আর এটা সেখানকার মানুষের রীতি আর ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নারীদের জনসম্মুখে আনার ব্যাপারে হিন্দুরাও মুসলমানদের থেকে কম অপমানজনক ভাবতেন না। মুখ বা মাথা অনাবৃত রেখে নারীদের প্রকাশ্যে আসার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল, আর আশা করা হত তারা বিনয়ী ও নম্র হবে তাদের আচার-ব্যবহারে। একজন সতী নারীর কাছে গোটা পৃথিবীতে তার স্বামীই একমাত্র সহায় ও আনন্দের উৎস, তার স্বামীর সুরক্ষা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনের আর কোনো আশ্রয় নেই, এমনকি তার বাবার বাড়িও নয়। সে তার বাবার বাড়িতেও যেতে পারে না স্বামীর অনুমতি ছাড়া। সেসময়ের গঙ্গানারায়ণের লেখা ভবানীমঙ্গলের পাণ্ডুলিপিতেও কবিকে সামাজিক জীবনে এ ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করতে দেখা যায়। আমরা গিরিরাজাকে দেখি গৌরিকে তার ঘরে নিয়ে যেতে ব্যাকুল হতে, আমার কন্যা, তুমিই ঠিক কর যা করনীয়। এর উত্তরে গৌরি জানায় যে শিবের অনুমতি ছাড়া সে কোথাও যাবে না। স্বাভাবিকভাবেই অষ্টাদশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শিব, গৌরি, গিরিরাজা ও মেনেকা সেসময়েরই বাংলার সমাজের শ্যালক-শ্যালিকা, শ্বশুর-শাশুড়ির সাধারণ প্রতিচ্ছবি।
নারীদের কদাচ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড
মাঝেমধ্যে, যদিও, নারীরা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে জরুরি ও বিশেষ ভূমিকা রাখতেন আর তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও দেওয়া হত। দান-দক্ষিণার জন্য পরিচিত রানী ভবানী এই শ্রেণির নারীদের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জমিদার হিসেবে তিনি প্রচণ্ড শক্তিশালী ও দৃঢ়চেতা আর পক্ষপাতহীন প্রশাসক ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা, দেশপ্রেম, প্রশাসনিক দক্ষতা, ধর্ম-কর্ম, গরীবের জন্য দয়া— সব মিলে তিনি দেশবাসীর অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে ও দানে তৈরি মন্দিরগুলোর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিদেশি পর্যটকেরা। লোকশ্রুতি রয়েছে যে, একদা কবি ভারতচন্দ্রের বাবা নরেন্দ্রনারায়ণ রায়া বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্রের মা মহানারী বিষ্ণুকামারীকে নিয়ে কটু কথা শুনয়েছিলেন জমি নিয়ে এক বিবাদের সময়ে। এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে মহারানী তার দুই রাজপুত সেনাপতি আলমচন্দ্র ও ক্ষেমচন্দ্রকে নির্দেশ দেন হয় নরেন্দ্রনারায়ণের শিশুপুত্রকে হত্যা করতে নয়তো সেই রাতেই তার জন্য ভুরশুট দখল করতে। রানীর প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সেনাপতিরা ভবানীপুর দুর্গ বা পেঁড়ো দুর্গ (নরেন্দ্রনারায়ণের আবাস) দখল করেন। পরদিন সকালে, বিষ্ণুকুমারী নিজে পেঁড়ো দুর্গে যান, নারী ও পুরোহিতদের সম্মান দেখিয়ে আর স্থানীয় দেবতার পুজোর ব্যবস্থা করে বর্ধমানে ফিরে যান। একই চিত্র দেখা যায় অন্য এলাকার নারী-জমিদারদের ক্ষেত্রেও। রংপুরের একটা অংশের জমিদার দেবী সিংহ এতটাই দমন-পীড়ন চালিয়েছিলেন যে অন্য জমিদাররা তো বটেই, তার নিজের রায়তরাও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। এক গীতিকবির মতে এই বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন জয়দুর্গা চৌধুরানী নামের এক সাহসী ও কুশলী নারী। এমন নারী মুসলিমদের মধ্যেও ছিল। নবাব সুজাউদ্দিনের স্ত্রী, জিবুন্নিসা প্রায়ই তার স্বামীকে রাষ্ট্র-প্রশাসন সংক্রান্ত কাজে সহায়তা করতেন। উড়িষ্যার প্রশাসক মুর্শিদ কুলির স্ত্রী দারদানা বেগম আলীবর্দীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে তার স্বামীকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। আলীবর্দীর বেগমকেও মাঝেমধ্যে স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে পাওয়া যেত, আর শীর্ষ রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন যখন আলীবর্দী মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন। মারাঠাদের থেকে হতাশ, আফগান সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতা, আর হাজী আহমাদ ও জৈনুদ্দিনের মৃত্যুর পর তিনি তার স্বামীকে উদ্দীপ্ত করেন। হলওয়েল তার সম্পর্কে লিখেছেন : এক নারী, যার জ্ঞান, বিশালতা, দানশীলতা আর বিভিন্ন সদ্গুণ, তার চরিত্রের উচ্চমর্যাদা ফুটিয়ে তুলেছিল। তিনি (আলীবর্দীর) উপদেষ্টাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। আলীবর্দী তার সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতেন, কেবল রক্তক্ষয়ী আর শঠতার ব্যাপারগুলো ছাড়া, কারণ তিনি জানতেন যখনই তিনি তাদের নিন্দা করতেন, তার স্ত্রী সেটার বিরোধিতা করতেন। আলীবর্দীর বেগম ধারণা করতেন এধরনের রাজনীতি তার পরিবারের ধ্বংস ডেকে আনবে। এভাবেই পৃথিবীর প্রশস্ত মাঠে আর আচ্ছাদনবিহীন তাঁবুর জীবনে, সেসময়ের নারীরা কালেভদ্রে পুরুষদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতেন। তারা কেবল ঘরের সেবাদাত্রীই নয়, তারা বড় পরিসরের দ্বন্দ্বেও জড়াত সক্রিয়ভাবে।
গার্হস্থ্য জীবনে গৃহকর্ত্রীর অবস্থান
পারিবারিক জীবনে, গৃহস্থবাড়িতে বাড়ির কর্ত্রীর স্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে। একজন ভালো ও ধার্মিক গৃহকর্ত্রী তার পরিবারের সেবাপ্রদানকারী হিসেবেই থাকত, আর খারাপ ও অধার্মিকদের ভাগ্য খারাপ নক্ষত্রে স্থির হত। একজন খারাপ স্ত্রীকে তার স্বামীর অসুখী থাকার জন্য দায়ী করা হত। একজন আদর্শ (উত্তম) স্ত্রী যদি স্বামী ভুল কিছুও করে থাকেন, তারপরও সবসময় স্বামীর ভালো চাইবেন; এরপর মধ্যমা স্ত্রীরা ভালোর বিনিময়ে ভালো, আর খারাপের বিনিময়ে খারাপ ব্যবহার করতেন; কিন্তু খারাপ (অধম) স্ত্রীরা ভালোর বিনিময়ে খারাপ ব্যবহার করতেন স্বামীদের সঙ্গে। কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর উপরে কোনো কারণ ছাড়াই রাগান্বিত হন, তাহলে তাকে চণ্ডী নায়িকা নাম দেওয়া হত।
হিন্দু যৌথ পরিবারে নারী
হিন্দু যৌথ পরিবারে স্ত্রীর অবস্থান অন্যদের আগ্রহ ও সুবিধে দিয়ে বিচার করা হত। তার কেবল স্বামী নয়, পরিবারের সবার প্রতিই কর্তব্য নির্ধারণ করা থাকত। রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দরে প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার আগে নায়িকা বিদ্যাকে দেওয়া তার মায়ের উপদেশ তুলনা করে দেখা যেতে পারে : প্রিয়, এটাই যেহেতু প্রথা, তাই আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। তোমার পরিবারের বয়স্কদের প্রতি অনুগত থাকবে, আর তাদের সন্তুষ্টির জন্য সেবা করে যাবে। যার ভেতরে ঘরের অন্যদের জন্য দয়া থাকে, সেই ঘরের কর্ত্রী হতে পারে
মেয়েদের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা
এটা ভাবা ঠিক হবে না যে কোনোরকম পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়াই মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে পরিবারের কঠিন কাজে নিয়োজিত করা হত। তাদের প্রথম দিনগুলোর নির্দোষ বিনোদন ও আমোদ-প্রমোদে তারা তাদের নিজেদের একটি কল্পনার জগৎ তৈরি করে নিত, যেখানে তারা গার্হস্থ্য জীবনের প্রাথমিক ব্যাপারগুলো জেনে যেত। আমরা সেসময়ের এক কবির বর্ণনায় এই রান্না-বাটি খেলার পরিষ্কার ধারণা পাই:- রাজকুমারী উমা তার সমবয়সি খেলার সাথী যশোদা, রোহিনী, চিত্রলেখাসহ অন্যদের সঙ্গে খেলছিল। উৎফুল্লভাবে উমা সবার মাঝখানে গিয়ে বসে কাদা দিয়ে বকুলগাছের নিচে একটি মন্দির তৈরি করল।
খড়িমাটি দিয়ে জয়া ও হিমাবতীর বানানো চুলো ও জ্বালানি দিয়ে সে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ধুলো দিয়ে তৈরি ভাতের পর গৌরি সেটা সবাইকে পরিবেশন করল। তারা সত্যি সত্যি সেগুলো খেল না, খাওয়ার ভান করল মুখের কাছে নিয়ে। তারা পানি ছাড়াই মুখ ধুয়ে পানের আবদার করল। এরপর সে কদমগাছের পাতা দিয়ে বিছানা তৈরি করে তার উপর শুয়ে পড়ল, প্রতি বিছানায় দুজন করে… কেউ আবার ঝাড়ু দিতে থাকল আর পানি ও গোবর দিয়ে লেপতে থাকল, যা সেসময়কার গার্হস্থ্য জীবনের অংশ ছিল। বাক্যগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ, আর এই বিবরণ সেসময়কার সমাজের গার্হস্থ্য জীবনকে সততার সঙ্গেই তুলে ধরেছে।
হিন্দু নারীদের নম্রতা
সাধারণত, হিন্দু নারীদের ব্যবহার হত নম্র , আর কণ্ঠ হত সুরেলা ও কোমল । তাদের মধ্যে অনেকেই সুর-সাধনা করতেন, বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন আর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গানও গাইতে পারতেন।
সুতো কাটা ও বোনায় নারী
সাধারণত, রাতের খাবারের পর প্রতিবেশী পরিবারের নারীরা এক হয়ে গল্প-গুজবে মেতে উঠত আর পুঁথি বা গল্প বা ধাঁধার বই নিয়ে বসত। এদের মধ্যে কেউ সুতো কাটত টাকু বা চরকায়, যা পরে তারা তাঁতীদের কাছে বিক্রি করত। এটা অনেক অভাবী পরিবারের আয়ের একটা উৎস হয়ে উঠেছিল। যদিও উচ্চমধ্যবিত্তরা এই ধরনের ঘরোয়া আয়কে তাদের সামাজিক অবস্থানে থেকে অপমানজনক ভাবত, তারপরও তাদের ঘরণীরা নিজেদের কাপড় তৈরির আড়ালে প্রচুর সুতো পাকানো ও কাটার কাজ করত আর বিক্রি করত তাদের থেকে নিচু সামাজিক মর্যাদার নারীদের সাহায্যে। এভাবে সুতো কাটার কর্মকাণ্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গরীব, অভাবী আর দুর্বলদের ঘরে, তারপর তাদের থেকে বেশ উঁচুপদমর্যাদার উচ্চ মধ্যবিত্তদের ঘরে বা বড়লোকদের ঘরেও তা ছড়িয়ে পড়ে।
সতী
সতী বা হিন্দু নারীদের নিজেদের মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় বা খুব কম ক্ষেত্রেই কবরস্থ হয়ে সহমরণের চর্চা ছিল প্রাচীন রীতি, যা বৈদিক সাহিত্য ও পৌরাণিক আচারে উল্লিখিত রয়েছে। এর ধারাবাহিকতা কমবেশি গুরুত্ব দিয়ে সেসময়কার সাহিত্য ও ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোতেও এর উল্লেখ রয়েছে। আকবর ও জাহাঙ্গীরের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই রীতিকে দমন বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, এটা আগের মতোই চলমান থাকে। আর তার প্রমাণ মেলে অষ্টাদশ শতকের ইভেস, ক্র্যাফটন, বোল্টস, গ্রস, ক্রফোর্ডের মতো ইউরোপীয় লেখকদের কলমে ও পাশাপাশি সেসময়ের বাংলা সাহিত্যেও।
ব্রাহ্মণ পুরাহিতেরা সতীদাহে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। যখন কোনো নারী নিজেকে সতী হিসেবে দাহ করত, তাকে স্পর্শ করা যেত না আর অ- হিন্দুর স্পর্শে কলুষিত করার কথা চিন্তায়ও আনা যেত না। ওলন্দাজ (ডাচ) পরিচালক সিকটারম্যান (১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ), পঁচিশ হাজার রুপি পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত ছিলেন এধরনের কাজ করতে। ৬১ সতীরা অকল্পনীয় সাহস ও মনোবল প্রদর্শন করত নিজেদের ভয়ানক এই চর্চায় অবিচলিতভাবে পার্থিব কোনো ভাবনা না টেনে উৎসর্গ করে। বোল্টস বলেছেন : পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করা সেই নারীরা, যাদের মন ও হৃদয় এই ধরনের দুর্দশা ও অসুবিধার সঙ্গে অপরিচিত, বা এই ধরনের সংকট যা জীবনকে হতাশায় ভরে দেবে, এমন সহিষ্ণুতার কথা ইউরোপীয়দের বিস্মিত করত, কিন্তু তারা স্বেচ্ছায় ভয়াবহ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে সহমরণের জন্য চিতায় ওঠার সাহসিকতা দেখাত। ৬২
সতী, মানবতাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিলেও, প্রায়ই এটা বৈবাহিক বিশ্বস্ততার শক্তিরও পরিচয় দিত। স্ক্র্যাফটন লিখেছেন : অনেক লেখকই এটাকে (সতী) মৃত স্বামীদের স্ত্রীদের কলুষিত হওয়া থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বলে বর্ণনা করেছেন; কিন্তু আমি মনে করি তারা এটাকে মেনে নেয় মর্যাদাকর ও দাম্পত্য ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবেই। হলওয়েল কাশিমবাজারে থিতু হওয়া এক মারাঠা- রামচাঁদ পণ্ডিতের উল্লেখ করেছিলেন, যিনি ১৭৪৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মারা গিয়েছিলেন। রামচাঁদ পণ্ডিতের স্ত্রী ছিলেন সপ্তদশী আর ধনী পরিবারের থেকে আসা। তার সব আত্মীয় ও কাশিমবাজারের সমস্ত বণিকেরা তাকে এটা থেকে বিরত করতে কোনো যুক্তিই বাকি রাখেননি। কিন্তু সপ্তদশী স্ত্রী কারো কথাই কানে তোলেনি, আর তার বন্ধুরাও তার দৃঢ় মনোভাব আর সংকল্প দেখে শেষ পর্যন্ত তার মতামত মেনে নেয়। সে শুধুমাত্র ফৌজদারের অনুমতির অপেক্ষা করেছিলেন সহমরণে যাওয়ার আগে। ওলন্দাজ পর্যটক স্ট্যাভোরিনাস চিনসুরায় ২৫ নভেম্বর ১৭৭০ সালে একটি সতীদাহের ঘটনা লিপিবিদ্ধ করেছেন : নির্ভীকভাবে সবকিছু মেনে নিয়ে, আর তার চেহারা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল, এমনকি যখন তাকে কাঠের স্তূপে তোলা হচ্ছিল। তিনি আরও লক্ষ্য করেছিলেন, তার পা নড়াচড়া করছে কি না, কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের ভেতর তার পা ছিল স্থির। কোনো কোনো সময় যে জোর করা হত না, তেমন নয়। একই লেখক লিখেছেন, তবে তার বেশি প্রয়োজন হত না, কারণ তারা যথেষ্ট উৎসাহ দেখাত স্বেচ্ছায় নিজেদের এই ভয়ংকর মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে। তিনি ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন বাঙালি দালালের কথাও বলেছেন, যার স্ত্রী আনন্দের সঙ্গেই সতী হতে চেয়েছিল, যদিও তার স্বামী যথেষ্ট লাম্পট্য দেখিয়েছিল আর তার সঙ্গ ত্যাগ করেছিল। তার বন্ধু ও আত্মীয়রা তার স্বামীর জীবনভর জঘন্য কৃতকর্মের দোহাই দিয়ে সতী হতে বাধা দিয়েছিল। তাই, সবসময়ে বলা যাবে না যে স্ত্রীরা সমাজের চাপে বা পুরোহিতদের ও আত্মীয়দের জোরাজুরিতে নিজেদের উৎসর্গ করতে বাধ্য হত।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে সতী হওয়ায় বাধা রয়েছে। শাস্ত্র গর্ভবতী মহিলাদের দাহ করতে অনুমতি দেয় না, আর যখন স্বামী দূরে কোথাও মারা যায়, তখন স্ত্রী নিজেকে দাহ করতে পারে না, যদিনা তিনি স্বামীর পাগড়ি ও কোমরবন্ধ চিতায় তুলতে পারেন। স্ক্র্যাফটন বলেছেন, এই চর্চা (সতী) সাধারণদের ভেতরে ছিল না, আর কেবল অভিজাত পরিবারেই এর প্রচলন ছিল। স্ট্যাভোরিনাস আরও বলেছেন এই চর্চা ছিল কিছু বর্ণের ভেতরে। কখনও আবার সতীদাহের স্থানে মন্দির তৈরি হয়ে যেত। ক্রফোর্ড এমন একটা জায়গা দেখেছিলেন, যেখানটায় সতীদাহ হয়েছিল, সেটা ঘিরে বাঁশ দিয়ে আবৃত করা হয়েছিল, একটু বাঁকা করে তৈরি করে সেখানে লতানো ফুলের গাছ লাগানো হয়েছিল। ভেতরটা ফুল দিয়ে গোলাকৃতি করে একদম শেষপ্রান্তে একটা ছবি রাখা হয়েছিল।
সামাজিক সংস্কারের দুটো উদ্যোগ—একদশীব্রতর কঠোর নিয়ম বিলোপ ও বিধবা বিবাহ চালু
চমকপ্রদ হলেও বিধবাদের ব্যাপারে সংস্কারের উদ্যোগ অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়েই নেওয়া হয়েছিল। রানী ভবানী তার বিধবা মেয়েকে নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিলেন, প্রথমেই তিনি একাদশীব্রতের (চাঁদের একাদশতম দিনে বিধবাদের উপোস) কষ্টটা লাঘব করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বাংলার অধিকাংশ পণ্ডিতের বিরোধিতায় তিনি সেটা করতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, বিক্রমপুরের (তৎকালীন ঢাকা জেলায়) রাজা রাজবল্লভের মেয়ে অল্পবয়সে বিধবা হলে ১৭৫৬ সালে তাকে আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তার এই প্রস্তাব অনেক পণ্ডিত মেনে নিলেও নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার সভার পণ্ডিতদের প্ররোচিত করে এর বিরোধিতা করান।
বাল্যবিবাহ
ছেলে ও মেয়ে, উভয়েরই বিয়ে বাল্যকালেই দেওয়ার রীতি ছিল। সামাজিক আইন অনুযায়ী বেশি বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ ছিল, আর এধরনের মেয়েদের অভিভাবকরা সামাজিকভাবে ঘৃণ্য বলে বিবেচিত হত। তাদের উপর নিরন্তর অভিশাপ বর্ষিত হত, মেয়েকে শিশু অবস্থায় বিয়ে দেওয়ার ধর্মের পবিত্র এই বিধি লঙ্ঘনের জন্য। এটা তখনকার হিন্দু সামাজিক জীবনের এমনই এক বৈশিষ্ট্য ছিল, যা ইউরোপীয় লেখকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। স্ক্র্যাফটন লিখেছেন : তাদের বিয়ে হয় শৈশবেই, ছেলেদের ১৪ বছর বয়সে আর মেয়েদের ১০ বা ১১ বছর বয়সে, আর ১২ বছর বয়সি মেয়েদের কোলে বাচ্চা দেখা খুবই সাধারণ ব্যাপার। বন্ধ্যা নারী বিরল তাদের ভেতরে। ১৮ বছর বয়সে মেয়েরা তাদের চেহারার লাবণ্য হারিয়ে ফেলে আর ২৫ বছর বয়সে রীতিমতো বয়সের ছাপ পড়ে যায়। ক্রফোর্ড ২৫ বছর পরও প্রায় একই কথা বলেছেন : হিন্দুরা কনের কুমারীত্বের ব্যাপারে এতটাই খুঁতখুঁতে যে তারা খুবই অল্পবয়সি মেয়েদের বিয়ে করে। এই বর্ণনাগুলো সেসময়কার সাহিত্যকর্মগুলোও সমর্থন করে।
স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেয়েদের অসহায় নীরবতা
স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেয়েদের কোনো কথা বলার সুযোগ ছিল না, আর তাদের মতামতকে গ্রাহ্য করার কথা ভাবাও হত না। তাই দেখা যেত, কখনও পরিপূর্ণ ও লেখাপড়া জানা মেয়ে বিয়ে করছে বধির ও কৃষ্ণবর্ণের কাউকে, আবার সুন্দরী কোনো মেয়ে বিয়ে করছে অন্ধলোককে যে ঝগড়া-বিবাদে দিন কাটাত, এক কিশোরী বিয়ে করছে বৃদ্ধকে, কোনো এক তন্বী, সুগঠিত শরীরের মেয়ে বিয়ে করছে কলুষিত এক মানুষকে, আবারও ১২-১৩ বছর বয়সি ছেলে বিয়ে করছে পূর্ণ যৌবনে উপনীত মেয়েকে। মেয়েদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না— কথায় বা কাজে সমাজের অলঙ্ঘনীয় আইনের বিরোধিতা করার, যা তাদের দুর্ভাগ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল। বিবেক ও অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তারা কেবল মাঝেমধ্যে কাঁদতে আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে পারত।
কুলীনতার কুফল
সেসময়কার কুলীনতার প্রসারের কারণে প্রচুর সমস্যার উদ্রেক হয়েছিল, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রাহ্মণদের ভেতরে মুখোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ও বন্দ্যোপাধ্যায় যথাক্রমে কুলীনতার দিক থেকে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। কায়স্থদের ভেতরে যথাক্রমে ঘোষ, বসু, মিত্র পরিবার ছিল কুলীন। কুলীনদের রীতিনীতি এতটাই সংকীর্ণ ও অনমনীয় ছিল যে তারা তাদের থেকে নিচুস্তরে থাকা মানুষদের অপদস্থ তো করতই, পাশাপাশি বসার পর্যন্ত অধিকার ছিল না। তারা কুলীনতাকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে চলছিল, আর ধনিকশ্রেণির স্বার্থে এই নিয়মের শিথিলতা ভাঙার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি, এমনকি ধনী ব্যক্তি যদি নিচু বর্ণের হয় তারপরও।
ঝগড়া–বিবাদ
কুলীন পরিবারের বিয়ে কখনোই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হত না। কোনো-না- কোনোভাবে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া-বিবাদ বেধে যেতই।
বহুগামিতা ও যৌতুক
এই কুলীনতা চমকে দেওয়ার মতো নির্যাতনের জন্ম দিত। কুলীনদের ভেতর বহুগামিতা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ তারা প্রতিটি বিয়েতেই যথেষ্ট পরিমাণ যৌতুকের আশা করত। এরকম পরিবেশে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর আন্তরিক সম্পর্ক খুব একটা হওয়ার কথা নয়, আর অশিক্ষিত ও মিল না-হওয়া স্বামীদের চাপে অসহায় মেয়েদের জীবন কাটত দুঃখজনকভাবে। মেয়েরা বেশিরভাগ সময়েই বাপের বাড়িতেই থাকত, যেখানে স্বামীরা বছরে দুতিনবার যাতায়াত করত কেবল টাকার প্রয়োজন পড়লে। যদিও অল্পবয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল, তবে কুলীনদের ক্ষেত্রে প্রায়ই এই নিয়ম উপেক্ষা করা হত। তার অভিভাবকরা অপেক্ষা করত বিয়ের যৌতুকের প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ের। মাঝেমধ্যে অর্থিক অবস্থার কারণে একাদশ বা দ্বাদশ বর্ষীয়া মেয়েদের পাকা চুলের স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হত।
অন্ত্যজদের ভেতরে যৌতুকপ্রথা নমনীয় ছিল
অন্ত্যজদের মধ্যে যৌতুকপ্রথা এতটা কঠোর ছিল না। স্ট্যাভোরিনাস বহুগামিতা ও কৌলীন্যপ্রথার কুফল পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, এটা অন্য বর্ণের থেকে বেশি ব্রাহ্মণদের ভেতরেই মারাত্মক আকারে ছিল ।
হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্ক
রীতিনীতি ও চিন্তাধারার পারস্পরিক আত্তীকরণ
শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করার কারণে হিন্দু ও মুসলিম দুই সমাজই পরস্পরের কিছু রীতিনীতি আপন করে নিয়েছিল। যখন পাশাপাশি দুটো সভ্যতা একে অন্যের সংস্পর্শে আসে, স্বাভাবিকভাবেই তখন একটি অন্যটির উপর প্রভাব বিস্তার করে, সামান্য হলেও। হিন্দুত্ব অবিচল ও ধৈর্য ধরে ছিল ইসলামি সামরিক শক্তির মিইয়ে যাওয়া পর্যন্ত। আর যখনই মুসলিম অভিযানের ঝড় কমে এল, হিন্দুত্ব তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ইসলামের অনুসারীদের মাঝে। একইভাবে কিছু ক্ষেত্রে ইসলামও প্রভাব বিস্তার করে হিন্দুসমাজে। শত শত বছর ধরে ভারতীয়দের ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ায় সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়া ও উদার সংস্কার আন্দোলনের বিস্তৃতিতে, নিয়মনীতির আত্তীকরণ ও বিনিময়ের ভেতর দিয়ে দুই সম্প্রদায় আরো কাছাকাছি চলে আসে।
আওরঙ্গজিবের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম
এটা বলা প্রয়োজন যে সম্রাট আওরঙ্গজিব যাকে সবচেয়ে কট্টর মুসলিম বলে মানা হয়, তার সময়কার রীতিনীতির পারস্পরিক আদান-প্রদানের কিছু চিত্র আমাদের সামনে এসেছে। সপ্তদশ শতকে আলওয়াল নামের এক মুসলিম কবি হিন্দি পদ্মাবতের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন আর বৈষ্ণব পদাবলিও লিখেছেন। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন : এখন পর্যন্ত পাওয়া পদ্মাবতের পাণ্ডুলিপিগুলোর সবই মিলেছে আরাকান-চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী বনে, ফার্সি ভাষায় রচিত এটা সংরক্ষিত হয়েছিল সেখানকার মুসলিমদের মাধ্যমে। কোনো হিন্দু সেটা পড়ার প্রয়োজন মনে করেনি। এটাই প্রমাণ করে মুসলিমদের রুচি কতটা মগ্ন হয়েছিল হিন্দু-সংস্কৃতিতে। এই বই যেটা আমরা ভেবে এসেছি ধর্মের ব্যাপারে দীর্ঘ আলাপ ও সংস্কৃত অলংকারের কারণে কেবল হিন্দু-পাঠকদের কাছেই আগ্রহের, আশ্চর্যজনকভাবে আওরঙ্গজিবের সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করেছিল মুসলিমেরা, যাদের কাছে এর কোনো আকর্ষণ থাকার কথা নয়, যাদের কাছে এটা অবশ্যই বিদ্বেষপূর্ণ হওয়ার কথা। মুসলিম মন্ত্রী মাগন ঠাকুরের সময় থেকে চট্টগ্রামের শেখ হামিদুল্লাহর সময় পর্যন্ত, যিনি ১৮৯৩ সালে এটা প্রকাশ করেন; মাঝের ২৫০ বছর ধরে এটা লিখিত হচ্ছে, পঠিত হচ্ছে আর চট্টগ্রামের মুসলিমরা পছন্দও করেছে। সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে লেখা ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গলে উল্লেখ রয়েছে যে, লখিন্দরের জন্য ইস্পাতের একটি ঘর তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে মনসা দেবীর ক্রোধ এড়াতে অন্যসব পবিত্র কবচের সঙ্গে একটা কোরান শরীফ ও রাখা হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পারস্পরিক মেলামেশা আরও অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল। শাহামাত জং ও সওলাত জং মুর্শিদাবাদের মতিঝিলের বাগানে সাতদিন ধরে হোলি উৎসব পালন করেছিলেন। এই উপলক্ষে প্রায় ২০০ পুকুর রঙিন পানি দিয়ে ভরা হয়েছিল, জাফরান আর আবিরের স্তূপ হয়ে গিয়েছিল, ৫০০-রও বেশি নৃত্যশিল্পী দামি আঙরাখা আর রত্নে সজ্জিত হয়ে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় বাগানের বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হত। আলীনগর চুক্তির পর (৯ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৭), নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা মুর্শিদাবাদে রওনা হন ও হোলি- উৎসব পালন করেন বাংলার মসনদে বসার পরপরই তার তৈরি মনসুরাগঞ্জ প্রাসাদে। একবার যখন নবাব মীর জাফর পাটনায়, তখন গঙ্গা পেরিয়ে শহরের সভ্যসমাজের সঙ্গে মিলে হোলি উৎসব পালন করেছিলেন। বলা হয় মৃত্যুশয্যায় মীর জাফর নন্দকুমারের অনুরোধে কিরীটেশ্বরীকে নিবেদন করা কয়েক ফোঁটা জল পান করেছিলেন। মুসলিমরা হিন্দু মন্দিরে পূজা যেমন করা শুরু করেছিল, তেমনি হিন্দুরাও মুসলিমদের মসজিদে সিন্নি দিতে শুরু করেছিল। সেসময় চট্টগ্রামের হামিদুল্লাহ রচিত বাংলা কবিতা বেহুলা সুন্দরীতে পাওয়া যায়, নায়কের যাত্রার শুভক্ষণ ঠিক করতে ব্রাহ্মণেরা কোরান শরীফেরও শরণ নিয়েছিল। নায়ক গোঁড়া হিন্দু বণিকের ছেলে, কিন্তু তিনি এমনভাবে আদেশ অনুসরণ করলেন যেন তারা বেদে শুয়ে আছেন, আর যাত্রা শুরু করলেন আল্লাহর কাছে নিরাপত্তার প্রার্থনা করে । ১৭৫০ সালে চট্টগ্রামের আরেক মুসলিম কবি আফতাবুদ্দিনের লেখা জামিল দিলারাম কবিতায় এক মুসলিম পাতাললোকে যাত্রা করেছিলেন হিন্দুদের সপ্তর্ষির থেকে বর নিতে।
সত্যপীরের মতো সর্বজনীন দেবতার পূজা
এই রীতিনীতি, বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদানের ফলে অনেক আগেই সত্যপীরের আবির্ভাব হয় যাকে হিন্দু ও মুসলিম – উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই পূজা করত। আমরা ভারতচন্দ্রের কবিতায়ও সত্যপীরকে দেখি। সদানন্দ নামের এক হিন্দু বণিক সত্যপীরের কৃপায় এক মেয়ে-সন্তান লাভ করে এবং এর জন্য সে কিছু অর্ঘ্য নিবেদন করার প্রতিজ্ঞাও করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বণিক তার প্রতিজ্ঞা ভুলে যায় আর দেবতার রোষে পড়েন, ফলে তার মেয়ের জামাই খুব অল্প বয়সেই মারা যায়।
মুসলমানদের হিন্দু দেবতার উপাসনা
এটা সেসময়ের সাহিত্যকর্ম শমসের গাজীর পুঁথি র সঙ্গে সম্পর্কিত যে, এক রাতে এক হিন্দু দেবী গাজীর স্বপ্নে তিনবার দেখা দিলেন, আর প্রতিজ্ঞামতো গাজী পরদিন সকালে উঠে ব্রাহ্মণের সহায়তায় হিন্দুরীতি অনুযায়ী তার উপাসনা করেন।
বৈষ্ণব ধর্মীয় ব্যাপারে মুসলমানদের স্বাক্ষরিত দলিল
১৭৩২ সালের একটি বাংলা দলিলে গোঁড়া বৈষ্ণব মতবাদের উপর সহজিয়া মতবাদের বিজয় উল্লিখিত রয়েছে, সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে স্বাক্ষর করেছে মুসলিমরা। এটা আসলেই উল্লেখ করার মতো যে সামাজিক, এমনকি ধার্মিক পরিবর্তনের ব্যাপারেও মুসলিম ভাইদের মতামত ও প্রামাণিক বিবৃতির প্রয়োজন পড়ত হিন্দু ভাইদের।
মুসলিমদের ভেতরে হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস ও পালন
অনেক মুসলিম হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রের মূল বক্তব্যে আস্থা রাখত ও হিন্দুদের মতোই তা পালনও করত। আগেই বলা হয়েছে কীভাবে জ্যোতিষীদের সঙ্গে শলা- পরামর্শ করে সারফারাজ ও আলীবর্দী শুভক্ষণ বের করে যাত্রা বা যুদ্ধযাত্রা শুরু করতেন। মীর কাশিম নিজে অল্প জ্যোতিষশাস্ত্র জানতেন, এর নীতি ও পূর্বাভাসে বিশ্বাস রাখতেন। তিনি তার এক সন্তানের রাশি আঁকিয়েছিলেন অভিজ্ঞ জ্যোতিষী দিয়ে ।
বৈষ্ণব সাহিত্যকর্মে মুসলিম লেখক
মুসলিম লেখকেরা হিন্দু দেব-দেবীদের ও হিন্দু সংগীত নিয়ে প্রচুর প্রশংসাবাক্য লিখে রেখে গেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বৈষ্ণবদাস, সেসময়ে লেখা তার পদকল্পতরু সংকলনে ১১ জন মুসলিম কবির পদ (বৈষ্ণব দেবতাদের স্তুতি) উল্লেখ করেছিলেন
দৈনন্দিন জীবনে সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সম্পর্ক
এটা দেখায় যে বৈষ্ণব ও গোঁড়া হিন্দু মতবাদ ও ধারণা গভীর প্রভাব ফেলেছিল বাংলার মুসলিম সমাজের ভেতরে। এভাবে দুই সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পাশাপাশি সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে দু-পক্ষের অন্তত উল্লেখযোগ্য সদস্যরা কোনোরকম তিক্ত সম্পর্ক ছাড়াই দরবার-চত্বরের আশেপাশে বসবাস করতেন। এটা পরবর্তী সময়েও বহাল ছিল, কিন্তু এখন সেই পুনর্মিলন আর সম্ভব নয়।