অধ্যায় ৯ : মাসাদার ঘটনা ও মহাবিদ্রোহের ইতি
একটা কথা না বললেই নয়। জোসেফাসের মতে, বাইতুল মুকাদ্দাস প্রথমে ভাঙতে নির্দেশ দেননি টাইটাস। প্রথম ক্ষতিটা করে ইহুদীরাই। তারা বাইতুল মুকাদ্দাসের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগুন লাগিয়ে দেয়, যেন রোমানদের অগ্রগতি থামানো যায়। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে দেখেই কেবল রোমান সেনারা পরে আর কোনো রাখ ঢাক রাখেনি। আগুন থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণের তোপে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে বাইতুল মুকাদ্দাস, এরপরও ইহুদীরা আরও ক্ষতি করতে থাকে। ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক মনে হলেও, তারা আত্মরক্ষার চিন্তা থেকে করছিল কাজটি।
এই পুরো অবরোধ ও পরবর্তী যুদ্ধ মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ মানুষ মারা যায় বলে জোসেফাস জানান। সংখ্যাটা এত বেশি, কারণ জেরুজালেমে ঈদুল ফিসাখ উপলক্ষ্যে কুরবানি দিতে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন এসেছিল তখন, আর সেই সময়ই রোমানরা আক্রমণটা চালায়। এতে মারা পড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লোক, যাদের অনেকেই জেরুজালেমবাসী নয়।
কেবল সশস্ত্র বিদ্রোহীদেরই নয়, বরং দুর্বল বেসামরিক লোকদেরও রোমানরা হত্যা করে। জেরুজালেমের জীবিত সবাই রোমানদের বন্দীতে পরিণত হলো। কয়েকজন নেতাসহ প্রায় ৯৭,০০০ বন্দীকে দাসত্ব বরণ করতে হয়। এই ৯৭,০০০ জনের মাঝে কয়েক সহস্র লোক গ্ল্যাডিয়েটরে পরিণত হয়, অর্থাৎ তাদের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে হয় আবদ্ধ অ্যারিনায় (যেখানে গ্ল্যাডিয়েটর ম্যাচগুলো হতো)। অনেক ইহুদীকে বিখ্যাত কলোসিয়াম বানানোর কাজে লাগিয়ে দেয়া হয় জোর করে, আর অনেককে লাগানো হয় রোমের শান্তি মন্দির বা টেম্পল অফ পিস নির্মাণে। কলোসিয়ামের দিকে ফিরে থাকা মন্দিরটি ছিল রোমান শান্তির দেবী প্যাক্সের প্রতি উৎসর্গকৃত। ১৭ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাদের বিক্রি করে দেয়া হলো।
অবশ্য অনেকেই জোসেফাসের এই লাশের সংখ্যাকে অতিরঞ্জন বলে দাবি করেছেন, কারণ তখন নাকি এত জনসংখ্যা ছিলই না ফিলিস্তিনে।
সে যাই হোক, টাইটাস আর তার সেনারা রোমে ফিরে ইহুদীদের পবিত্র মেনোরা আর অন্যান্য জিনিসপাতি নিয়ে রাস্তায় মিছিল করতে করতে বিজয়োল্লাস করল। এই জিনিসগুলো এর আগ পর্যন্ত রক্ষিত ছিল বাইতুল মুকাদ্দাসের পবিত্রতম কক্ষে, কেবল প্রধান ইমামের চোখে পড়ত এগুলো। আজ সেগুলো রোমের রাস্তায় উন্মুক্ত।
টাইটাসের জেরুজালেম বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘আর্চ অফ টাইটাস’ বা ‘টাইটাস তোরণ’ নির্মাণ করা হয় রোমে। সম্রাট টাইটাস মারা যাবার পর, ৮১ সালে ছোট ভাই সম্রাট ডমিটিয়ান এ তোরণ নির্মাণ করেন। এ তোরণ রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ান ও টাইটাসের ইহুদীদের ওপর বিজয়ের সদা স্মারক। আর্চের গায়ে সেদিনগুলোর সব ঘটনাই লিপিবদ্ধ করা আছে। আমরা আর্চের গায়ে আঁকা দেখতে পাই তৎকালীন সময়ের হেরোদের সংস্কার করা বাইতুল মুকাদ্দাসের নানা উপকরণের বাস্তব প্রতিকৃতি। এই আর্চের গায়ে আঁকা মেনোরাকে মডেল ধরেই ইহুদী সমাজে মেনোরা তৈরি করা হয়।
মেনোরা হলো বাইবেলে বর্ণিত সাতটি প্রদীপ সংবলিত প্রাচীন হিব্রু বাতি। খাঁটি সোনা দিয়ে নির্মিত এই বাতি মূসা (আ) শরীয়ত সিন্দুক বা আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট রাখার জন্য যে তাঁবু খাটাতেন, তাতে রাখা হতো। পরবর্তীতে রাখা হতো বাইতুল মুকাদ্দাসে। প্রতিদিন এতে দেওয়া হতো টাটকা জলপাই তেল। আজকে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় প্রতীক মেনোরার দুপাশে শান্তির প্রতীক জলপাই পাতা, আর নিচে হিব্রুতে লেখা ইসরাইল। ১৯৪৮ সালে ডিজাইন প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ প্রতীক বাছাই করে নেয়া হয়। তাওরাতের হিজরত কিতাবের ২৫:৩১-৪০ শ্লোকে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় মেনোরার।
জেরুজালেম আর এহুদিয়ার পতনের পর নানা অঞ্চল জুড়ে ইহুদীরা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এরকম বিভিন্ন স্থানে টিকে থাকা স্বল্প সংখ্যক ইহুদীর ক্ষুদ্র সমাজকে একেকটি ‘ডায়াসপোরা’ বলা হয়। প্রত্যেক ডায়াসপোরারই ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় টাইটাসের তোরণে আঁকা মেনোরা। এই আর্চ দেখে দেখে পরে আরও অনেক বিজয় তোরণ বানানো হয়েছিল। আর্চ অফ টাইটাস টিকে আছে আজও।
টাইটাসের বিজয়-অনুষ্ঠানগুলো সারা বছর ধরেই চলে নানা শহরজুড়ে। অনুষ্ঠানের সময় এমনও হয়েছে যে ইহুদী বন্দীদের হিংস্র পশুর মুখে ফেলে দিয়ে উদযাপন করা হচ্ছে, আর গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে দাঁড়া করিয়ে দেয়া তো আছেই।
পরের বছরগুলোতে রোমানরা বাকি দুর্গগুলো দখল করে নিলো। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্ভবত ৭৩ সালে মাসাদা দুর্গের পতন।
অবশ্য, হিব্রু মেসাদা মানেই দুর্গ, সেখান থেকেই মাসাদা বলা হয়। ইসরাইলের দক্ষিণে প্রাচীন মাসাদার অবশেষ এখনও দেখতে পাওয়া যায়। পর্বতচূড়ার এক সমতলে অবস্থিত এ দুর্গটি ইহুদীদের গর্ব করার মতো একটি দুর্গ ছিল। আরাদ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এহুদিয়া মরুভূমির পূর্ব প্রান্তে মৃত সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল মাসাদা। ৩৭ থেকে ৩১ খ্রিস্টপূর্বের মাঝে হেরোদ দ্য গ্রেট এই পাহাড়ের ওপর দুটো প্রাসাদ বানিয়েছিলেন নিজের জন্য। এ দুর্গের কাজ ছিল প্রাসাদ দুটোকে নিরাপত্তা দেয়া। একটা ব্যাপার না বললেই নয়। ইহুদীদের একসময়ের গণআত্মহত্যার এ স্থানটি ইসরাইলের সবচেয়ে বিখ্যাত টুরিস্ট স্পটগুলোর একটি। বছরে প্রায় পৌনে দশ লাখ মানুষ এসে ঘুরে যায় জায়গাটি।
৭৩ সালে, এহুদিয়ার রোমান গভর্নর লুসিয়াস ফ্ল্যাভিয়াস সিলভা একটি রোমান লিজিয়ন নিয়ে রওনা দেন মাসাদার উদ্দেশ্যে। রোমান বাহিনী মাসাদাকে ঘিরে একটি অবরোধ দেয়াল তৈরি করলো। এরপর পশ্চিম দিক থেকে র্যাম্প বসানো হলো। নব্বইয়ের দশকের খননকাজ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, মাসাদার পতনের সময় যে র্যাম্প বসানো হয়েছিল, তা ছিল ৩৭৫ ফুট দীর্ঘ, বানানো হয়েছিল প্রাকৃতিক পাথর দিয়েই। মাসাদা আসার আগে দুই তিন মাস ধরে এটি বানিয়ে আনা হয়েছিল। এর সাহায্যে রোমানরা সে বছর ১৬ এপ্রিল শেষমেশ দুর্গের দেয়াল ব্যাটারিং র্যাম দিয়ে ভেঙে ফেলতে সমর্থ হয়। অবাক করা হলেও সত্য, আগে বন্দী করা সেই ইহুদীদেরকে ব্যবহার করেছিল রোমানরা এই মাসাদার পতনের কাজে সাহায্য করতে। সৈন্যসহ মোট ১৫,০০০ লোক এ অভিযানে অংশ নেয়।
ঐতিহাসিক জোসেফাসের মতে, রোমানরা অবশেষে যখন দুর্গে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তখন তারা আবিষ্কার করলো, সবগুলো গুদামে আগুন জ্বলছে। আর ইহুদীরা সবাই আত্মহত্যা করেছে, কিংবা একে অন্যকে খুন করেছে। সব মিলিয়ে ৯৬০ জন। সিকারি দলের নেতারা কোন দুটো বক্তৃতা দিয়ে ইহুদীদেরকে এই আত্মহত্যায় লেলিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাও আমরা জোসেফাসের বিবরণীতে উল্লেখিত পাই। মাত্র দুজন নারী আর পাঁচজন শিশুকে জীবিত পাওয়া গেল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অভিযানে, অন্তত ২৮টি দেহ পাওয়া যায় এখানে। জোসেফাস ধ্বংসপ্রাপ্ত হাম্মামখানার কথাও উল্লেখ করেছিলেন।
বহু বছর পর হযরত মুহাম্মাদ (সা) যখন মদিনার শাসক, তখন সেখানকার ইহুদী গোত্রকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে। বনু কুরাইজা নামের সেই ইহুদী গোত্রের নেতারা দুর্গে অবরুদ্ধ অবস্থায় নিজেদের জন্য যে তিনটি বিকল্প উপায় উপস্থাপন করেছিলেন, তাদের একটি ছিল এই মাসাদার মতো গণআত্মহনন।
জেরুজালেমের পতন আর বাইতুল মুকাদ্দাস ধ্বংসের পর, ইহুদীদের বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছিল। এর মাঝে প্রধান তিনটি দুর্গতুল্য জায়গা ছিল হেরোদিয়াম, মাক্যারোস (মিকওয়ার) আর এই মাসাদা। প্রথম দুটোর পতন হয় রোমান বাহিনীর হাতে আগেই, আর সবশেষে পতন হয় ৭৩ সালে মাসাদার।
মাসাদার পতনের মধ্য দিয়েই হয় এই মহাবিদ্রোহ তথা প্রথম ইহুদী-রোমান যুদ্ধের ইতি।