অধ্যায়-৮ – গ্যালাটিক ও সুপার গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল
পূর্বের দুই অধ্যায়ের আলোচনা থেকে দেখা গেল যে, একটি সাধারণ গ্যালাক্সির সকল নক্ষত্র অবশেষে শ্বেতবামন, নিউট্রন-নক্ষত্র এবং ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। আবার আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস থেকে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হবে। এভাবে অধিকাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হবে নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি থেকে এবং এসব নক্ষত্র অবশেষে মারাও যাবে। অবশিষ্ট অল্প পরিমাণ গ্যাস ছড়িয়ে থাকবে। এ গ্যাস অত্যন্ত শীতল হয়ে পড়বে যা থেকে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হবে না। সুপারনোভার বিস্ফোরণ থেকে যেভাবে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল তাও একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ অবশেষে বিস্ফোরণের এই অবশিষ্টাংশে পদার্থগুলো এতটাই ভারী হবে যা থেকে নক্ষত্র সৃষ্টির নতুন প্রক্রিয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। সুতরাং যথেষ্ট সময় শেষে গ্যালাক্সিতে কেবল শীতল শ্বেতবামন, নিউট্রন নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল এবং বিভিন্ন ধরনের আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুরাই বিচরণ করবে। এসব আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু হচ্ছে—এস্টোরয়েড, উল্কা, পাথর ও ধূলিকণা প্রভৃতি। একটি সাধারণ গ্যালাক্সি শক্তির পরিমাণ থেকে দেখানো যেতে পারে যে, এই অবস্থায় পৌঁছতে গ্যালাক্সির এক হাজার বিলিয়ন (১০^১২) বা তারও বেশি বছর সময় লাগবে না। আন্তঃছায়াপথীয় স্থানে সমস্ত গ্যালাক্সি শক্তি হারাতে থাকবে। এই আন্তঃছায়াপথীয় ফাঁকা স্থানটিকে বিশাল ‘আধার’ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই স্থানে গ্যালাক্সির সমস্ত শক্তি স্রোতের ন্যায় নির্গত হবে তবে এতে গ্যালাক্সিগুলোর কোনও তাপমাত্রা বৃদ্ধি হবে না। গ্যালাক্সিগুলোর এই পরিণতি উভয় কারণেই ঘটতে পারে যেহেতু মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে গ্যালাক্সিসমূহের মধ্যে শূন্যস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্য কারণটি হচ্ছে গ্যালাক্সিগুলোর লোহিত সরণ ঘটছে ও তারা বিকিরণ ত্যাগ করে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। বিকিরণের কিছু শক্তি মহাবিশ্বের প্রসারণের কাজে চলে যায়। হাজার বিলিয়ন (১০^১২) বা তারও কিছু বেশি বছরে গ্যালাক্সি থেকে কদাচিৎ বিকিরণ নির্গত হবে। মহাবিশ্বের সর্বত্র আকাশ তখন মানব চক্ষুর মত কুচকুচে কালো বর্ণ ধারণ করবে। রইবে কেবল গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে আসা বিকিরণ ও আলোর বিরল ক্ষণিক প্রভা। গ্যালাক্সি তথা মহাবিশ্বের এরূপ অবস্থা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখতে পাব। এই অধ্যায়ে এবং পরবর্তী কটি অধ্যায়ে (অর্থাৎ অধ্যায় ১১ পর্যন্ত) আমরা মহাবিশ্বকে ‘মুক্ত মহাবিশ্ব’ হিসেবে বিবেচনা করব। এটি চিরকালই প্রসারিত হবে। এর মানে হচ্ছে ভবিষ্যতের সময় অসীম।
হাজার বিলিয়ন (১০^১২) বছর বা তারও কিছু পরে শীতল শ্বেত বামন, নিউট্রন নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল এবং অন্যান্য আকৃতির নাক্ষত্রিক বস্তুসমূহ গ্যালাক্সিকে নিথর করে রাখবে। এরা সবাই পারস্পরিক মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়বে। এই অবস্থার অতি দীর্ঘ স্থিতিকালের বা দীর্ঘকাল শেষে তার পরিণতি সঠিকভাবে এমনকি গড়পড়তায়ও ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই কঠিন। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি অমীমাংসিত সমস্যা। যাই হোক কেউ একটি খুবই মোটামুটি বিশ্লেষণ সম্পন্ন করতে পারেন যা থেকে একটি যুক্তিসংগত ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে পারেন। এই সমস্যাটির একটি সাধারণ বিষয় নিয়ে শুরু করা যাক। এক্ষেত্রে ‘দ্বি-দেহী’ একটি অবস্থার বিবেচনা করা যাক। অর্থাৎ দুটি বস্তু পারস্পরিক মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে পরস্পরের চারপাশে ঘূর্ণমান। তারা পারস্পরিক মধ্যাকর্ষণ বলের অধীনে ঘুরছে।
ধরা যাক দুটি নিউট্রন নক্ষত্র পরস্পরের চারপাশে ঘূর্ণমান। নিউটনের মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব অনুযায়ী তারা প্রত্যেকেই ফোকাসে (ফোকির একবচন ফোকাস) ভর কেন্দ্র দ্বারা কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার পথ অঙ্কন করবে। যখন কেউ এই অবস্থার সুদীর্ঘ ধরনের কথা বিবেচনা করবে তখন এই অবস্থাও যথাযথ নয়। নিউট্রন নক্ষত্রগুলো সম্প্রসারিত বস্তু অর্থাৎ এরা কোনও নির্দিষ্ট বিন্দুতে নিবিষ্ট নয়। নিউটনের মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব অনুযায়ী দুটি নক্ষত্রের এই কক্ষপথগুলো তখনই মেনে নেওয়া যেতে পারে যখন তাদেরকে অসম্প্রসারণশীল বিন্দু বস্তু বা দেহ বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, প্রতিটি বিন্দুই উপবৃত্তাকার কক্ষপথ তৈরি করবে। এই রকম দুটি অসম্প্রসারিত বিন্দু বস্তুর ক্ষেত্রে এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথগুলো চিরস্থায়ী হবে। সুতরাং, এই ধরনের ধারণাসংবলিত ক্ষেত্রে নক্ষত্রদের সুদীর্ঘসময় ঘূর্ণনের ধরন জানা যায়। এই ‘দ্বি-দেহী’ অবস্থাটি খুব জটিল। প্রথমত অসম্প্রসারণশীল বিন্দু বস্তু দুটির পরিবর্তে যদি সম্প্রসারিত দুটি নক্ষত্র নিউটনের তত্ত্বে বিবেচনা করা হয়, দ্বিতীয়ত ওই দুটি বিন্দু বস্তুর ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের তত্ত্ব খুব যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে। এবার দ্বিতীয় জটিলতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। আইনস্টাইনের তত্ত্বে দুই বিন্দু বস্তুর ঘূর্ণনের (পরস্পরের চারদিকে) সমস্যাটি পুরোপুরিভাবে সমাধান হয় না। কিন্তু গড় হিসাব তাই বলে যে, এই বস্তুগুলো উপবৃত্তাকার পথ অনুসণ করে না। কিন্তু এরা গড়পড়তায় উপবৃত্তাকার পথ অনুসরণ করে যাতে উপবৃত্ত আবর্তনের জন্য মোড় নেয়। দুটি বস্তু পরস্পরের বরাবর ভিতরের দিকে পাক খেতে থাকে আর তখন এরা একই সঙ্গে বিকিরণ ত্যাগ করে। এই বিকিরণ তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ নয়, এই বিকিরণ মধ্যাকর্ষীয় তরঙ্গ নামে পরিচিত। এই বিকিরণ দ্বি-দেহী অবস্থাটি থেকে শক্তি বহন করে চলে যায়।
চিত্র-৮.১ : এখানে একটি মরণাপন্ন গ্যালাক্সিতে মৃত নক্ষত্রদের অভিযান দেখানো হল। মৃত নক্ষত্ররা হ’ল শ্বেতবামন নিউটন নক্ষত্র ও ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। দৃশ্য a এবং b তে ছোটো একটি নক্ষত্র অন্য একটির চারপাশে ঘুরছে। গ্যালাক্সিতে গড় নক্ষত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে ছোটোরা স্থানচ্যুত হয়ে গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে যায়। বাকিরা পরস্পরের সঙ্গে দৃঢ় সংলগ্ন হয়। এরকম ত্রি-দেহী ও বহু-দেহী মিথস্ক্রিয়ার পর গ্যালাক্সিতে একটি ঘন কেন্দ্রস্থলের সৃষ্টি হয় (c)। অবশেষে কেন্দ্র একটি গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয় (d)।
দুটি বস্তুই দৃঢ়সংলগ্ন হয় অর্থাৎ এরা একটি ছোটো আয়তনে সীমাবদ্ধ হয়। যদিও আইনস্টাইনের তত্ত্ব দ্বারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল তথাপি এই তরঙ্গগুলো প্রবল চেষ্টায় শনাক্ত করা যায়নি। বিশেষত ম্যারিলেন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জে. ওয়েবার এগুলো শনাক্ত করতে পারেননি। গবেষণা বলে যে, দুটি সম্প্রসারিত বস্তু সংযুক্ত হয়ে একটি একক দেহে পরিণত হয়, যদি না অন্য কোনও প্রক্রিয়া এদের মাঝখানে কাজ করে।
দ্বিতীয় জটিলতা হচ্ছে আইনস্টাইনের তত্ত্বের প্রভাব বা সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদী প্রভাব যা মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র বিশিষ্ট দৃঢ় বস্তুদের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—দুটি নিউট্রন নক্ষত্রের ক্ষেত্রে। কিন্তু পৃথিবী-সূর্য বা পৃথিবী-চন্দ্ৰ এই অবস্থাগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রভাব খুবই কম। মূলত এক্ষেত্রে দুটি নিউট্রন নক্ষত্র বিবেচিত যারা পরস্পরের চারদিকে ঘূর্ণনশীল। এ বিষয়টি যুগ্ম পালসার ‘পি.এস আর ১৯১৩+১৬’-এর পরিস্থিতির সঙ্গে মিলে যায়। জে.এইচ. টেইলর এবং তাঁর সহকর্মীগণ মাসাচুসেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুটি পালসারের ঘূর্ণন পথ বিস্তারিতে বিশ্লেষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ইঙ্গিত রয়েছে যে, আইনস্টাইনের তত্ত্বের পূর্বাভাস অনুযায়ী যুগ্ম পালসারে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদী কিছু প্রভাব রয়েছে। এই পালসার দুটির উপবৃত্তাকার কক্ষপথও রয়েছে এবং এরা মধ্যাকর্ষীয় তরঙ্গও নির্গত করে। এই ফলাফলগুলোই চূড়ান্ত নয়। এক্ষেত্রে স্থায়ী বা সঠিক ফলাফলের আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও অধিক পর্যবেক্ষণ আবশ্যক।
দুটি নিউট্রন নক্ষত্রের পরস্পরের চারদিকে ঘূর্ণনের ক্ষেত্রে সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পৃথিবী ও চন্দ্রের ঘূর্ণনের অবস্থায় অন্যান্য প্রভাব কাজ করে। তাই প্রথম জটিলতা প্রসঙ্গে অর্থাৎ নিউটনের তত্ত্বে দুটি সম্প্রসারিত বস্তুর ঘূর্ণন ব্যবস্থা হিসেবে পৃথিবী-চন্দ্রের ঘূর্ণন ব্যবস্থাকে বিবেচনা করা যায়। নিউটনের তত্ত্বে দেখানো যেতে পারে যে, একটি পুরোপুরি গোলাকার বস্তুর মধ্যাকর্ষীয় ক্ষেত্র বস্তুর বাহিরে কাজ করে এবং মনে হয় যেন ভর বস্তুর কেন্দ্রে ঘনীভূত রয়েছে। ওই দুটি বিন্দু বস্তুর তুলনায় দুটি গোলাকার বস্তুর জটিলতা দূর করতে বস্তু দুটিকে গোলাকার হওয়ার পাশাপাশি পুরোপুরি অনমনীয় হতে হবে। বস্তুগুলো পুরোপুরি অনমনীয় না হলে প্রতিটি গোলাকার বস্তু পরস্পরের টাইড্যাল (জোয়ার-ভাটার মত) মধ্যাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাব অনুভব করে। ফলে এদের দীর্ঘমেয়াদের গতিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু পৃথিবী এবং চাঁদ পুরোপুরি গোলাকারও না আবার পুরোপুরি দৃঢ় বা কঠিনও (rigid) না। পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র কেবল চাঁদের ঘূর্ণনই সৃষ্টি করে না চাঁদের দেহে একটা চাপও তৈরি করে। একইরূপে চাঁদের মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র পৃথিবীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাবের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল পৃথিবীতে সাগরের জোয়ার-ভাটা। পৃথিবী এবং চাঁদের যে চাপ সৃষ্টি হয় তা পরস্পরের চারদিকে ঘূর্ণনের কক্ষপথগুলোকে প্রভাবিত করে। এই অবস্থায় আরও একটি বিষয় হচ্ছে পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপর আবর্তন করে যেমনটি চাঁদও করে (১ লুনার মাসে ১ বার)। জোয়ার-ভাটার ফলে আরেকটি জটিল বিষয়ের সৃষ্টি হয়—পৃথিবীর কৌণিক ভরবেগের কিছুটা চাঁদে অপসারিত হয়। ফলে দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে চলেছে প্রতি ১০০ বছরে প্রায় ২ মিলি সেকেন্ড, পৃথিবীর ঘূর্ণন হয়ে আসছে ধীর। অন্যদিকে চাঁদ পাক খেয়ে খেয়ে পৃথিবী থেকে প্রতি বছরে প্রায় ৩ সেন্টিমিটার দূরে চলে যাচ্ছে। সুতরাং দ্বি-দেহী অবস্থায় বস্তুগুলোর পাক খাওয়ার জন্য দায়ী মধ্যাকর্ষীয় বিকিরণ তবে পৃথিবী চাঁদের এই স্বল্পমেয়াদি প্রক্রিয়া বিবেচনায় এ প্রভাব অতি নগণ্য। পৃথিবী চাঁদ অবস্থায় অন্যান্য প্রভাব কাজ করে। পৃথিবী থেকে চাঁদের কৌণিক ভরবেগ অপসারিত হয়। আর এই প্রভাবটি এক্ষেত্রে প্রভুত্ব করে। যখন এই কৌণিক ভরবেগ পর্যাপ্ত পরিমাণে চাঁদে স্থানান্তরিত হবে তখন দূর ভবিষ্যতে চাঁদ তার সরণ থামিয়ে দিবে। তখন সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রভাব হয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সে অবস্থা তৈরি হওয়ার পূর্বেই ঘটবে অন্য এক ঘটনা। সূর্য ততক্ষণে লাল দানবে পরিণত হয়ে যাবে যে দানব গিলে খাবে আমাদের পৃথিবী এবং চন্দ্রকে।
উপরের দ্বি-দেহী ব্যবস্থার সারসংক্ষেপ থেকে কক্ষপথগুলো সম্পর্কে গড়পড়তায় জানা গেল। কিন্তু এদের অতি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব কঠিন। এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। কিন্তু সম্ভাবনা এই যে, দ্বি-দেহী ঘূর্ণনের ওপর অন্য কোনও বাহিরের প্রক্রিয়া মধ্যস্থতা না করলে তারা ঘুরপাক খেতে খেতে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে যাবে অর্থাৎ দুয়ে মিলে একদেহে পরিণত হবে। এখানে ‘দ্বি-দেহী’ অবস্থাটি বিবেচনা করেছি এই সাধারণ বিষয়গুলোর সুপরিচিত সমাধান চিত্রিত করার জন্য। কিন্তু যখন আমরা দূর ভবিষ্যতের দিকে থাকাই এই সমাধানগুলো কখনও কখনও অমীমাংসিত হয়ে যায়।
এবার ‘ত্রি-দেহী’ অবস্থা বিবেচনা করা যাক। বস্তুগুলো পরস্পরের মধ্যাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের অধীনে থেকে ঘুরছে। বিজ্ঞানী নিউটনের তত্ত্বের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটিও সঠিকভাবে সমাধান করা যাবে না। এমনকি বস্তুগুলোকে বিন্দু-দেহ বিবেচনা করলেও সমস্যাটি সঠিকভাবে সমাধান করা যাবে না। তাদের গতি নির্ণয় করে কম্পিউটারে সংখ্যাসূচকভাবে সমীকরণগুলোকে সমাধান করতে হবে। এরকম সংখ্যাসূচক বিচারের ওপর ভিত্তি করে কেউ একটি গুণগত বিশ্লেষণ দিতে পারেন। দ্বি-দেহী অবস্থার মতই ত্রি-দেহী অবস্থার তিনটি বস্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নির্গমন করে এবং এরা অধিকতর দৃঢ় সংলগ্ন হয়। কিন্তু মহাকর্ষীয় শক্তি নির্গত হওয়ার পূর্বে তাদের কক্ষপথগুলোর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব লক্ষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বস্তুগুলোর কোনও একটি অন্য দুটির কাছে এসে প্রচণ্ড ধাক্কায় দূরীভূত হয়ে যায়। হয়ত নিক্ষিপ্ত এই বস্তু একেবারেই অবস্থার বাহিরে চলে যায় আর বাকি দুটি বস্তু সিস্টেমের মধ্যেই অবস্থান করে। সুতরাং, এই ত্রি-দেহী ঘূর্ণন অবস্থার সুদীর্ঘ প্রক্রিয়াটি এইরূপ— দুটি বস্তু অবস্থায় থাকবে আর একটি বস্তু সম্পূর্ণ বাহিরে চলে যাবে।
যদি আমরা এক্ষেত্রে অধিক থেকে অধিক-দেহী অবস্থা বিবেচনা করি তাহলে সমস্যাটি অধিকতর জটিল হয়ে দাঁড়ায়। হাজার বিলিয়ন বছর শেষে একটি সাধারণ গ্যালাক্সিতে মূলত ‘শত বিলিয়ন ব্যবস্থা’র সমস্যাটি তৈরি হবে। অবশেষে এই অবস্থাটির কী ঘটবে? যেহেতু পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে এরকম একটি অবস্থার সঠিক পরিণতি কী হবে—তার ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব কঠিন। কিন্তু কিছু গুণগত বিশ্লেষণ তৈরি হতে পারে যা আবার কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণও হতে পারে। ইঙ্গিত রয়েছে যে, এই অবস্থায় গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রদের দ্বারা একটি ঘন কেন্দ্ৰস্থল সৃষ্টি হবে আর এই কেন্দ্রস্থলের চারপাশে থাকবে নক্ষত্রদের হালকা ঘন বলয়। এখানে নক্ষত্র বলতে মৃত নক্ষত্রদের বোঝানো হয়েছে। যেমন—শ্বেতবামন, নিউট্রন নক্ষত্র ও ব্ল্যাকহোল। সুদীর্ঘ সময় শেষে ভবিষ্যতে এই আকৃতির পরিবর্তন হবে। তখন গ্যালাক্সিতে ত্রি-দেহী সংঘর্ষ এবং এরকম আরও অধিক-দেহী অবস্থার সৃষ্টি হবে যাতে কিছু নক্ষত্র উচ্চ বেগ প্রাপ্ত হবে। অধিকাংশ সময় উচ্চ বেগ প্রাপ্ত নক্ষত্রগুলো গ্যালাক্সির মধ্যাকর্ষীয় ক্ষেত্রেই রয়ে যাবে। সম্ভবত এরা সম্প্রসারিত বলয়ের অংশ হবে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বহুদেহী সংঘর্ষ থেকে কোনও নক্ষত্র এত উচ্চ বেগ প্রাপ্ত হবে যা গ্যালাক্সি থেকে একেবারেই বেরিয়ে যাবে। বিলিয়ন বিলিয়ন (১০১৮) বছরে বা মিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন (১০২৪) বছরে এভাবে গ্যালাক্সির অধিকাংশ নক্ষত্ৰ গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু এ ধরনের ত্রি-দেহী এবং বহু-দেহী মোকাবিলার বিষয়টি বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের ব্যবধানে হবে দুর্লভ। গ্যালাক্সিতে বাকি নক্ষত্রগুলো ঘন কেন্দ্রস্থল তৈরি করবে। এরা অধিক থেকে অধিকতর দৃঢ় সংলগ্ন হবে অর্থাৎ তারা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর আয়তনে আবদ্ধ হবে। এই বিষয়টি শক্তির সংরক্ষণশীলতার বিবেচনাকে অনুসরণ করে। কেন্দ্রস্থল অধিক থেকে অধিকতর ঘন হবে অর্থাৎ নক্ষত্রগুলো সংযুক্ত হয়ে অতি অধিক ভরবিশিষ্ট একটি নক্ষত্রের সৃষ্টি করবে। কিন্তু শ্বেতবামন, নিউট্রন নক্ষত্র এত অধিক ভরবিশিষ্ট হতে পারে না। সুতরাং গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে গাঁটবন্দি অবস্থা থেকে যে একটি একক নক্ষত্রের সৃষ্টি হবে তা হবে ব্ল্যাকহোল। গ্যালাক্সিতে একটি একক গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হওয়ার সময় জোরালো সংঘর্ষ থেকে কিছু আতশবাজি উৎপন্ন হবে। অর্থাৎ গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে আলো এবং নানা ধরনের বিকিরণ বেরিয়ে আসবে। কোয়েসাররা যেভাবে শক্তি নির্গত করে এক্ষেত্রে তার সঙ্গে মিল আছে। উদাহরণস্বরূপ, যেভাবে একটি কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোল মৃত নক্ষত্রদের ভক্ষণ করে অতিকায় হয়ে ওঠে। এই ব্ল্যাকহোলের ঢেউ সদৃশ মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র তখন ওইসব নক্ষত্রকে তছনছ করবে। ফলে বিকিরণের আকৃতিতে শক্তি উৎপন্ন হবে। কিন্তু কী পরিমাণ নক্ষত্র গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে যাবে আর কী পরিমাণ নক্ষত্র থেকে যাবে একটি গ্যালাটিক বা দানবীয় ব্ল্যাক তৈরি করতে তা আবার বলা খুব মুশকিল। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি। আমরা পরীক্ষাচ্ছলে সম্ভবত বলতে পারি যে ৯৯ শতাংশ নক্ষত্র বেরিয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট ১ শতাংশ নক্ষত্ৰ গ্যালাক্সিতে রয়ে যাবে। এক্ষেত্রে গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলটির ভর হবে প্রায় ১ বিলিয়ন সূর্য ভরের সমান। এর ব্যাসার্ধ হবে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে প্রায় ৩ বিলিয়ন কিলোমিটার বা ২-৩ আলোক ঘণ্টা। এই ব্যাসার্ধের দূরত্ব মোটামুটিভাবে সূর্য থেকে সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ পুটো পর্যন্ত দূরত্বের অর্ধেক।
মহাবিশ্বের প্রসারণ চলমান থাকলেও গ্যালাক্সিদের স্তবক মহাকর্ষীয় বলে আবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে অর্থাৎ স্তবকের মধ্যে গ্যালাক্সিগুলোর সরণ ঘটবে না। ধরা যাক একটি স্তবকে প্রায় একশত গ্যালাক্সি রয়েছে। উপরের বর্ণনার মতই, স্তবকে প্রতিটি গ্যালাক্সি ছায়াপথীয় কৃষ্ণগহ্বরে (গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল) পরিণত হবে। অতি ভবিষ্যতে সমগ্র স্তবকটি একটি একক সুপার গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলে রূপ নেবে। এক্ষেত্রে ৯৯ শতাংশ নক্ষত্র গ্যালাক্সি তথা স্তবক থেকে বেরিয়ে যাবে। এই অতি দানবীয় ব্ল্যাকহোলটির ভর হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন সূর্য ভরের সমান। শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে এর ব্যাসার্ধ হবে প্রায় তিনশত বিলিয়ন কিলোমিটার বা প্রায় ১ আলোক সপ্তাহ। একটি স্তবক সুপারগ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে সময় লাগবে সম্ভবত বিলিয়ন বিলিয়ন (১০^১৮) বছর থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন (১০^২৭) বছর। পুরো স্তবকটি কতগুলো গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার পূর্বে মূলত এটি একটি একক গ্যালাক্সিতে পরিণত হবে। এই ঘটনাটি ঘটবে একটি গতিশীল সংঘর্ষ থেকে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, অপেক্ষাকৃত বড়ো গ্যালাক্সিগুলো তাদের ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশীদের ভক্ষণ করে নেবে।
একটি গ্যালাক্সি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে হয়ত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নির্গমনের প্রক্রিয়াটি কাজ করবে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দ্বারা গ্যালাক্সিদের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পূর্বে উপরে বর্ণিত চলমান প্রভাবগুলো প্রভূত ভূমিকা রাখবে। কিন্তু মধ্যাকর্ষীয় বিকিরণ দ্বারা একটি গ্যালাক্সি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে সময় লাগবে খুব সম্ভবত ১০৪ থেকে ১০০ বছর। সুতরাং, একটি গ্যালাক্সি বা স্তবক একটি একক ব্ল্যাকহোলে বা সুপারগ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মোটকথা ১০^২৭ বছরে বা তারও কিছু বেশি সময়ে সকল গ্যালাক্সি এবং স্তবক গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল বা সুপারগ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হয়ে থাকবে। আর আন্তঃছায়াপথীয় বা ইন্টারগ্যালাটিক স্থানের চির প্রসারণশীল শূন্যতায় অসংখ্য মৃত নক্ষত্র এবং অন্যান্য পদার্থ অর্থাৎ যেসব পদার্থ গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে এসেছিল তারা যে যার মত বিচরণ করতে থাকবে। এই অধ্যায়ে আলোচিত সময়ের মাপকাঠিগুলো তখনই সম্ভব যদি মহাবিশ্ব হয় মুক্ত অর্থাৎ মহাবিশ্ব যদি চিরকালই প্রসারিত হয়।