অধ্যায় ৮ – অর্থনৈতিক অবস্থা
১. কৃষি
কৃষি বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
কৃষিকাজ সবসময়েই বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর ভূমি আর চলাচলযোগ্য প্রচুর নদীর পানিতে পুষ্ট এই প্রদেশ যেন প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া পৃথিবীর সবচেয়ে আবাদযোগ্য ভূমি । এর সঙ্গে সেচকাজের জন্য ছিল নদী, খাল ও দিঘির পানি, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য প্রতি মৌসুমে তৈরি হওয়া প্রচুর অস্থায়ী বাঁধ, আর এগুলো সরকার রক্ষা করত জনসাধারণের ব্যবহারের লক্ষ্যে, প্রতিটি মানুষ তার নিজের অংশের পানির জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করত।
মূল কৃষিপণ্য ছিল ধান, গম, ডাল, বিভিন্ন তেল-বীজ, পাট, আখ, তামাক, তুলা, পান ইত্যাদি। ওর্ম লিখেছেন : তাদের খাবারের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ছিল চাল, যা প্রদেশের নিচের দিকে প্রচুর উৎপন্ন হত, আর দুই পাউন্ড বিক্রি হত এক ফার্সিংয়ে; এছাড়াও অন্য চাষযোগ্য শস্য, প্রচুর বৈচিত্র্যময় ফল আর সবজি, রুচিমতো বিভিন্ন মশলাও চাষ করা হত, একইভাবে : চিনি, যার আরও নিবিড় যত্নের চাষ প্রয়োজন, সব জায়গাতেই উৎপন্ন হয়…। ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষিজাত পণ্যগুলো বাংলা থেকে তাদের দেশে রপ্তানি করত না, কিন্তু উপরে উল্লেখ করা পণ্যগুলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করত।
দুর্যোগপূর্ণ সময়ে প্রভাবিত কৃষি
এ সময়ে জারি হওয়া প্রজা-স্বত্বের প্রথায় বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু মারাঠা আক্রমণ, আর পর্তুগিজ ও মগদের তাণ্ডব, অবশ্যই বাংলার অনেক কৃষিজীবীদের আগ্রহকেই ম্লান করে দিয়েছিল। বাংলার গ্রামীণ এলাকায় তাদের প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না। প্রকৃতপক্ষে তারা গ্রামের মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রাও বিঘ্নিত করেছিল। ১৭৫৭ সালের পর বাংলা প্রদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ১৭৬৫ সালের পর আমিলদের (রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা) চাপে বাংলার কৃষিজীবীদের উপর আরও দুর্দশা যোগ হয়, যারা ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে প্রচণ্ড কষ্টে নিপতিত হয়েছিল। ১৭৭২ সালের দিকে পাতুলোর পর্যবেক্ষণ : প্রতিবছর বাংলায় খাজনা বৃদ্ধির নির্বোধ চর্চা তার ধ্বংসাত্মক চরিত্র দেখিয়ে দেয় প্রচুর এলাকা জনশূন্য হয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে।
২. বাজার ও দ্রব্যমূল্য
নগরে বাজার
প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের সীমানার ভেতর বাজার ছিল। এমন সব এলাকায়ও বাজার গড়ে উঠেছিল যেগুলো আদপেই বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল না নগরের বাজারগুলোর দোকানে প্রয়োজনীয় থেকে বিলাসদ্রব্য সবই মিলত যেমন ধান, চাল, কাঠ-কয়লা, মিষ্টান্ন, চিনি, ভুরা (অপরিশোধিত চিনি), দুধ, ঘি, পান, সুপারি, জয়ত্রী, জায়ফল, চন্দন, জাফরান ইত্যাদি
বর্ধমানের বাজারের বর্ণনা
তৎকালীন বাঙালি লেখক রামপ্রসাদ ধনাঢ্য ও জনারণ্য শহর বর্ধমানের বাজারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : এগুলো ছাড়াও কবি (সুন্দর) রাজার বাজার দেখতে পেল, যেখানে হাজার হাজার বিদেশি বণিক বসেছিল। সেখানে শত শত লেন- দেনকারী, দোকানদার, অগণিত রত্ন, মুক্তা আর চুনি ছিল। সেখানে নানাধরনের চমৎকার ও সুন্দর কাপড়ও ছিল যেমন বনাট (রেশমি কাপড়), মখমল, পট্ট, ভুশনাই, বুটাদার (বুটিদার), ঢাকাইয়া, মালদাই, ও অন্যান্য ধরনের কাপড় যা আমিরদের (ধনী) পছন্দ ছিল। সেখানে বিলাতি ঘরানার বিভিন্ন দাম ও ঢংয়ের নকশাদার পণ্যও মিলত, যেগুলো স্তূপ করে রাখা হত ক্রেতাদের জন্য। সবকিছুই সস্তা ও সুলভ ছিল…। যমদূতের মতো গর্বভরে বাঘাই কোতোয়াল হাতির পিঠে রক্তবর্ণ চোখে সেখানে উপস্থিত থাকত। মালদার বওয়ানিগঞ্জ (ভবানিগঞ্জ) শহরে, শিবগঞ্জ (তৎকালীন মালদা জেলা, এখন চাঁপাই নবাবগঞ্জে ), স্বরূপগঞ্জ (মালদা জেলায়), জামালগঞ্জ (তৎকালীন দিনাজপুর জেলা, এখন জয়পুরহাটে) বিখ্যাত ছিল শস্যের বাজারের জন্য, যা নাম থেকেই বোঝা যায়। বহরমপুর থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলায় শস্য, তেল আর ঘিয়ের গুরুত্বপূর্ণ বাজার ছিল; সেখান থেকে রপ্তানি করা শস্যের উপর বার্ষিক কর ধার্য করা হয়েছিল তিন লক্ষ রুপি। হুগলি নদীর পূর্বপাড়ে পঞ্জেলিতে ভুট্টার একটি বাজার ছিল, আর সেখান থেকে প্রচুর চালও রপ্তানি হত।
বাজারগুলোর নিয়ন্ত্রণ
জমিদাররা তাদের নিজ নিজ এলাকায় শহুরে বাজারগুলো সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। কোতোয়ালদের (পুলিশ পরিদর্শক) অন্যতম কাজ ছিল এই বাজারগুলোর তদারকি করা, সবধরনের গণ্ডগোল প্রতিহত করা, বিক্রিত পণ্যের পরিমাপ, পরিমাণ আর গুণগত মান যাচাই করা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। যে আদর্শ নিয়ম ভাঙত, তাকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হত। খুচরা কেনাকাটার জন্য বাংলা অঞ্চলে বিনিময়ের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মাধ্যম কড়ি ব্যবহৃত হত।
কলকাতার বাজার
কোম্পানির তত্ত্বাবধানে এসময়ে কলকাতায় অনেকগুলো বাজার ছিল, যেমন বড় বাজার, শোভা বাজার, ধোবাপাড়া বাজার, হাটখোলা বাজার, বাগ বাজার, চার্লস বাজার, শ্যাম বাজার, নতুন বাজার, বেগম বাজার, ঘাসতলা বাজার, জন নগর ও গুঙ্গে বা মণ্ডি বাজার (গোবিন্দপুর জেলায়)। এই বাজারগুলোর আয় কোম্পানির জন্য লাভজনক ছিল। রাজস্ববিভাগের কালেক্টর ও ডেপুটি কালেক্টর নিয়মিত ইজারা দিতেন আর রাজস্বও আদায় করতেন। বাজারে কৃষকদের বিক্রি করার মতো প্রত্যেকটি পণ্যের উপর উপর শুল্ক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইজারার ক্ষেত্রে হয়তো দুর্নীতির চর্চাও হত।
দুর্নীতির দায়ে গোবিন্দরাম মিত্র অভিযুক্ত
হলওয়েল মনে করেন, ১৭৫২ সালের জুলাই মাসে, কালেক্টর অফিস তখনকার কালো কালেক্টর (ডেপুটি কালেক্টর) গোবিন্দরাম মিত্রকে ১৭৪৯ থেকে ১৭৫১ সালের কোম্পানির বাজারের ইজারা দেওয়ার সময় অনিয়মের অভিযোগে বরখাস্ত করে, চরম দুর্নীতি র দায়ে সন্দেহভাজন হিসেবে। তিনি বলেন এই ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া জনসম্মুখে বা জমিদারদের উপস্থিতিতে নিলামে হয়নি, বরং গোবিন্দরামের বাড়িতেই দর ঠিক করা হত, যেখানে গোবিন্দরাম বেনামে নিজের জন্য ভালোগুলো রাখতেন, আর বাকিগুলো বিলি-বণ্টন করতেন আত্মীয় ও বন্ধুদের মাঝে; আর এই দর নিশ্চিত করতে তিনি বিভিন্ন জমিদারদের কাছে পাঠাতেন, আর অনেকগুলো পট্ট জারি করা হত সেভাবে কাজ এগোনোর জন্য।
কলকাতার কাউন্সিল কর্তৃক তার অব্যাহতি
কিন্তু কলকাতা কাউন্সিলের বেশিরভাগ সদস্যই গোবিন্দরামের পক্ষে ছিলেন যে এই তিন বছরে তিনি ইজারা দেওয়ার থেকে কোনো সুবিধা বা লাভ ভোগ করেননি, আর তাই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
দ্রব্যমূল্য
এই সময়ের কয়েক বছরের দ্রব্যমূল্য বিবেচনা করলে, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারোপযোগী দ্রব্যের দাম ছিল কম। ১৭২৯ সালে মুর্শিদাবাদে, ক) সবচেয়ে ভালো মানের বাঁশফুল চাল এক রুপিতে এক মণ ১০ সের মিলত, দ্বিতীয় মানেরটা প্রতি রুপিতে এক মণ ২৩ সের আর তৃতীয় মানেরটা ১ মণ ৩৫ সের মিলত; খ) মোটা দেসনা চাল প্রতি রুপিতে চার মণ ২৫ সের; গ) মোটা পূৰ্বী চাল প্রতি রুপিতে চার মণ ২৫ সের; ঘ) মোটা মুনসারা চাল প্রতি রুপিতে পাঁচ মণ ২৫ সের; ঙ) মোটা কর্কশালী প্রতি রুপিতে চাল সাত মণ ২০ সের; চ) সবচেয়ে ভালো মানের গম রুপিতে তিন মণ আর দ্বিতীয় সারিরটা তিন মণ ৩০ সের; ছ) বার্লি প্রতি রুপিতে আট মণ; জ) ভেনত (ঘোড়ার খাদ্যশস্য) এক রুপিতে চার মণ ৩৫ সের; ঝ) ভালো মানের তেল এক রুপিতে ২১ সের ও দ্বিতীয় সারির তেল ২৪ সের; ঞ) সবচেয়ে ভালো মানের ঘি রুপিতে সাড়ে ১০ সের ও দ্বিতীয় সারির ঘি রুপিতে সাড়ে ১১ সের মিলত। ১৭৩৮ সালে ঢাকায় প্রতি রুপিতে দুই মণ ২০ সের থেকে ৩ মণ চাল ও এক মণ কার্পাস (কাঁচা তুলা) মিলত দুই থেকে আড়াই রুপিতে।
কিন্তু ১৭৪০ সালের পর বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে এই পণ্যগুলোর মূল্য বেড়ে যায়। ১৭৪৩ সালে বালেশ্বরে জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়ে যায় যে সেখানকার তাঁতীরা এক রুপিতে মাত্র ১০ সের চালই কিনতে পারত, আর এ অবস্থা সেখানে বেশ কবছর স্থায়ী হয়েছিল। একই বছরে কলকাতায় কোম্পানির বণিকেরা তুলে ধরেন যে কার্পাস ও অন্যান্য পণ্যের মূল্য এতটাই বেড়েছে যে অনেক পণ্যের দাম বাড়াতেই হবে। ১৭৪৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার কাউন্সিল কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে জানায় : চালের দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছে এক রুপিতে মাত্র ৩০ সের বিক্রি হচ্ছে, আর নির্দেশ দেয় মোটা চাল বাজারে প্রতি রুপিতে এক মণের নিচে যেন না বিক্রি হয়, শস্য ও ধানের উপর ভূমিকর উঠিয়ে নেওয়া হয়। সেই বছরেরই অগাস্ট মাসে কোম্পানির কলকাতার ব্যবসায়ীরা কলকাতার কাউন্সিলকে জানায় তুলার অত্যধিক দামের জন্য তারা গুররাহ সরবরাহ করতে পারছে না। সিল্কের দামও অনেক চড়া ছিল সেসময়ে। ১৭৫১ সালে কোম্পানি বুঝতেও পারেনি যে ধান ও তেলের উপর বসানো প্রায় ৫০০ রুপির কর মানুষের জন্য চরম দুর্দশা ও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে আর ঐ দুই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। এছাড়াও চালের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় এভাবে : নভেম্বর বুন্দ চাল প্রতি রুপিতে ৩৫ সের, আর সাধারণ চাল এক মণ ১০ সের। কলকাতার কাউন্সিল সমস্ত বাজারে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় যে, কেউ যেন বাড়তি দামে তা না বিক্রি করে, নইলে এর জন্য চরম শাস্তি রয়েছে। এভাবে সেবছর কলকাতায় এক মণ ৩২ সের চাল এক রুপি চার আনায়, খাদ্যশস্য প্রতি রুপিতে এক মণ, এক রুপি চার আনায় এক মণ ৩২ সের গম, তিন রুপিতে এক মণ তিন সের আটা, পাঁচ রুপিতে এক মণ তেল বিক্রি হতে শুরু করেছিল। কিন্তু পরের বছর এই পণ্যগুলোর দাম আবার বেড়ে যায়, দুই রুপি আট আনায় এক মণ ১৬ সের চাল, এক মণ ১২ সের খাদ্যশস্য তিন রুপি পাঁচ আনা ছয় পাই, চার রুপি ১১ আনায় এক মণ ছয় সের গম, আটা এক মণ আট রুপি, আর তেল ১১ রুপিতে এক মণ। ১৭৫৪ সালে কলকাতায় এক রুপিতে সাড়ে ৩২ সের উন্নতমানের চাল মিলত, আর মোটা চাল মিলত ৪০ সের। ঢাকায় ১৭৫২ সাল নাগাদ বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের দাম ১৭৩৮ সালের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। একই বছরের ২৮ অক্টোবর জুগদিয়ার ইংরেজ প্রতিনিধিরা কলকাতার কাউন্সিলকে জানায় যে তুলার প্রচণ্ড অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাফতার দাম সাধারণ দামের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ, যেখানে তুলার দামের কোনো ওঠা-নামা হয়নি আর সাধারণত টাকায় দুই মণ পাওয়া যেত, তা তখন ২৫ সেরে নেমে এসেছিল। তাই একখণ্ড জুগদিয়া কাপড় তৈরি করতে খরচ দুই আনা থেকে বেড়ে পাঁচ আনায় পৌঁছেছিল। এভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েই চলেছিল যতদিন না বাংলার মানুষের দুর্ভোগ চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছয় আর ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পরিণত হয়।
প্রাক্-পলাশী সময়কাল বিচার করলে চারটি বিষয় উপরে উল্লেখ করা পণ্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল: ক) মারাঠাদের তাণ্ডব ও তার কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়, খ) কলকাতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের উপর উচ্চহারে কর
নির্ধারণ, গ) বিদেশি বণিকদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও ঘ) প্রায়ই ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
ক) মারাঠা আক্রমণ
কোম্পানির রেকর্ডে মারাঠা আক্রমণের প্রচুর তথ্য রয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে বাংলার মানুষের জন্য প্রচণ্ড দুর্ভোগ আর অভাবের কারণ হয়েছিল এটা আর চাল, তেল, অন্যান্য শস্য আর কাপড়ের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিরও কারণ হয়েছিল। তখনকার সাহিত্য থেকে মারাঠা আক্রমণকারীদের ফলে সৃষ্ট মানুষের দিশেহারা অবস্থার একটা চিত্র পাই। গঙ্গারাম লিখেছেন : বর্গীরা (মারাঠা) লুটতরাজ করেছিল আর সামনে যাদেরই পাচ্ছিল হত্যা করছিল, এর ফলে কোনো পণ্যই পাওয়া যাচ্ছিল না; চাল, সবধরনের ডাল, তেল, ঘি, আটা, চিনি, লবণের মতো জিনিস প্রতি সের এক টাকায় বিক্রি হতে শুরু করে। মানুষের দুর্ভোগ এতটাই চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে তারা ভিখিরির পর্যায়ে নেমে আসে। প্রচুর মানুষ অনাহারে মারা যায়, সবধরনের সবজির পাশাপাশি গাঁজা আর তামাকও কেনা যাচ্ছিল না। আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি বর্ধমানে পণ্যের উচ্চমূল্যের কথা, ভারতচন্দ্রের লেখায় সুন্দরের জন্য মালিনীর বাজার করার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার ভেতর দিয়ে। মালিনী তার বাজারের ফিরিস্তি দিয়েছিলেন সুন্দরকে। মালিনী এক সের মিষ্টি কিনেছিল এক কাওনে (এক রুপি); আধা সের চিনি আট পণে (আনা); চন্দন কাঠ, লবঙ্গ ও জয়ত্রী দুর্মূল্য ছিল বাজারে; পুরো বাজার খুঁজে ঘিয়ের সন্ধান পেতে হয়েছিল; এক পণ (২০ গণ্ডা) পানপাতা কিনেছিল দুই পণে (দুই আনা); আর আট আঁটি জ্বালানি কাঠ আট পণে (আট আনায়)। এই ধরনের মূল্যকে অস্বাভাবিক ধরে নেওয়া যেতে পারে, আর দাম দিনকে-দিন বেড়েই গিয়েছে। এই আশঙ্কার কথাও জানা যায়। ভারতচন্দ্র এই লেখা শেষ করেছিলেন ১৭৫২ সালে, আর সম্ভবত তার বর্ণনা করা বর্ধমানের বাড়াবাড়ি রকমের দ্রব্যমূল্য মারাঠা-তাণ্ডবের ফলে হয়েছিল; বলা ভালো এই শহর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এসবে।
খ) ভারী কর আরোপ
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর ভারী কর আরোপ কলকাতার মানুষের জন্য প্রচুর কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই বাড়তি করের বোঝা সামাল দিতে বণিকেরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়, যা বহন করতে হয় সাধারণ ক্রেতাদেরই, যারা শারীরিক আর মানসিক প্রশান্তি ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় খাবারই কিনতে পারত না।
গ) বিদেশি বণিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা
বিদেশি বণিকদের নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা সৃতি ও রেশমি (সিল্ক) কাপড়ের দাম বৃদ্ধিতে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজেদের বিনিয়োগ দ্রুত তুলে নিতে ইউরোপীয় প্রতিনিধিরা এসব পণ্যের জন্য ব্যবসায়ী ও তাঁতীদের অনেক বেশি মূল্য প্রস্তাব করে। বাংলার সাধারণ মানুষদের এ বিনিয়োগ থেকে কোনো লাভ তো হয়ইনি, বরং লম্বা সময়ের জন্য নিজেদের পোশাকের জন্যও উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিল।
ঘ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বন্যা ও আকালের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও কৃষিজপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল। ১৭৫২ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতা কাউন্সিলের সভাপতি ড্রেককে গোবিন্দরাম মিত্র লিখেছিলেন যে ১৭৫১ সালে বৃষ্টি মহাদুর্যোগ তৈরি করেছিল নিম্নভূমিতে লাগানো সবকিছুকেই প্লাবিত করেছিল এর আগের অন্তত ৬৩ বছরে আর এমন গভীর প্লাবন দেখা যায়নি যার এর ফলে প্রচুর অধিবাসী ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে শহরেই মারা গেছে, এই সত্যটা সবারই জানা, আর পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক চড়ে গিয়েছিল।
৩. উৎপাদন শিল্প
উন্নতমানের সূতি ও রেশমি কাপড়ের উৎপাদনকারী
বাংলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিহিত ছিল মূলত এর বিস্তৃত ও বিচিত্র সব সূতি ও রেশমি কাপড়ের উৎপাদক হিসেবে। বাংলা কাজসহ ও কাজ ছাড়া সবধরনের কাপড়, সবচেয়ে সুন্দর মসলিন, সিল্ক (রেশমি কাপড়) উৎপাদন করত। পাণ্ডুলো ১৭৭২ সালে জানিয়েছেন যে বাংলায় উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কখনোই কমেনি, কারণ এর মান এতটাই স্বতন্ত্র ছিল যে বিশ্বের অন্য কোনো জাতি তার সমকক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।
কৃষি ও শিল্প একসঙ্গে চলছিল
অবশ্যই কৃষি গুরুত্বপূর্ণ আর বিশাল জনগোষ্ঠীর পেশা ছিল বাংলায় কিন্তু ওম বলেছেন, কৃষির বাইরেও জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিলাসিতা দেখাতে পেরেছিল, যার কারণে তারা নিজেদের তাঁত-শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে বাকি সাম্রাজ্যে যতটুকু স্মৃতি আর রেশমি কাপড় উৎপন্ন হত, তার তিনগুণ কেবল বাংলাতেই উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছিল, তাও অনেক কম দামে। এগুলোর বেশিরভাগ কাপড় ও রেশম রপ্তানি হত ইউরোপে, আর বাকিগুলো স্থলপথে ও জলপথে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যেত। এভাবেই বাংলায় কৃষি ও শিল্প হাতে হাত রেখে চলেছিল।
রেশম ও সূতির উৎপাদনের স্থানিকীকরণ
তাঁত কারখানাগুলো পুরো দেশে ছড়িয়ে ছিল আর প্রতিটি জেলার নিজস্ব ধরনের কাপড় তৈরির নজির ছিল। মালদহ, হরিয়াল, শেরপুর, বালিকুশি, কাগমারির মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু জেলা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারিতে ছিল যেগুলো এই কাপড় তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল – ক) ইউরোপীয় বাজারের জন্য কোসা (খাসা= কোনাকুনি নকশার উন্নত কাপড়) ছিল , এলাচ, হাম্মাম, চৌখা (বা চৌথায়ি= চার ভাঁজ করা কাপড়), উতালি, সুসি (সুসি বা ডোরাকাটা মোটা কাপড়), সিরসুকার (সার শিখর=পাগড়ি)…; খ) বসরা, মোকা, জেদ্দা, পেগু, আচিন ও মালাক্কার বাজারে বিভিন্ন ধরনের খাসা, বাফতা (একধরনের কালিকো বা সূতি কাপড়, সম্ভবত বাফত হাওয়া মসলিন), শানোস (শন, উদাহরণ হালকা হলুদ রঙের অথবা পাট বা শনের কাপড়), মুলমুল ( মলমল, উন্নতমানের কারুকাজহীন মসলিন), তাঞ্জের (তাঞ্জিব=একধরনের উন্নতমানের মসলিন), কেঁচি ইত্যাদি। ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শন, মলমল আর তাঞ্জিব সংগ্রহ করত রংপুর, ঘোড়াঘাট, সন্তোষ ও বাদালের আড়ং থেকে, যার সবকটাই সন্তোষের রাজার জমিদারির ভেতরে ছিল। বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন ডোরিয়া (ডোরা নকশার কাপড়), টেরেন্ডাম (তিরান্দাম), কাট্টিনি, সুসি, সুত রুমাল সূতি কাপড়ের রুমাল) গুররাহ, সেস্তেরসয়, সান্তন কুপি, চেরিদেরি (চুড়িদার?) চিলি, কুস্তা, দুসুতা (দুসুতি – একধরনের মোটা সূতি কাপড়), তৈরি হত বর্ধমান, খিরপাই, রাধানগর, আর দেওয়ানগঞ্জে, যা ছিল বর্ধমানের রাজা তিলকচাঁদের অধীনে, আর কিছু নিম্নমানের পণ্য, যেমন সিরবান্দ (পাগড়ি), গলাবান্দ (গলাবন্ধ) ইত্যাদি তৈরি হত এই এলাকায়। নিম্নমানের রেশমি ও সূতি কাপড় তৈরি হত বাঁকুড়া জেলায়, বিশেষত বিষ্ণুপুরের কাছে। চারকোনা (চারখানা, চৌখুপি নকশাদার মসলিন), চাকলা (চাকলা, রেশমি ও সূতির মিশ্রণে তৈরি), পেনাইকো, সুরসুচার, সাল-বাস্তা (শাল-প্রস্থ, সূতির শাল) ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সূতি কাপড় তৈরি হত মেদিনীপুরে। পিপলিতে শানি (শানু), খাস্সা (খেসি-চাদর বা পোশাক, দিমিত্তি, মুলমুল (মলমল), রেশমি রুমাল আর রেশমি ও সূতি কাপড়ের মিশ্র রুমাল, গুরাহ, ও লুঙ্গি তৈরি হত। নীলরঙা মোটা সূতির রুমাল তৈরি হত কলকাতার কাছে বরানগরে। বীরভূমের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা (যার ভেতর এলামবাজার অন্যতম) ছিল কাপড় উৎপাদনের কেন্দ্র। নদীয়া আর মুর্শিদাবাদের খ্যাতি ছিল বিভিন্ন ধরনের স্মৃতি ও রেশমি কাপড় উৎপাদনের জন্য। শান্তিপুর, বুরান প্রভৃতি জায়গায় ইউরোপীয় বাজারের জন্য তৈরি হত মলমল, খাসা ও অন্যান্য কাপড়। গ্রস বলেছেন কাশিমবাজারের বাসিন্দারা অসম্ভব রকমের পরিশ্রমী, বিভিন্ন উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত ছিল…। তাদের ছিল তািেত্তও (তাতো), আর ছিল দেশের সবচেয়ে সুন্দর সূতি কাপড়। ৬৯ স্ট্যাভোরিনাস বলেছেন সাধারণভাবে ছাপা সূতিকে বলা হত চিন্টজ (ছিট) যা বাংলায় উৎপাদিত হত না, বিহার প্রদেশের পাটনা ছাড়া, যার কারণে একে বলা হয় পাটনা চিন্টজ । আগেই বলা হয়েছে, পাটনা কাপড় উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। সূতি কাপড়, শতরঞ্জি, দুলিকা ও গালিচার মতো বিভিন্ন ধরনের নকশাদার গালিচা তৈরি হত বিহারের বিভিন্ন প্রান্তে।
সূতি কাপড় ও চমৎকার মসলিন উৎপাদনে ঢাকা ছিল শীর্ষে
সবচেয়ে চমৎকার মসলিন ও বিভিন্ন ধরনের সূতি কাপড় তৈরিতে পুরো বাংলায় ঢাকা ছিল শীর্ষস্থানে। এখানকার মসলিনের ব্যবসা অনেক বিস্তৃত ছিল, আর তৈরি করত সবচেয়ে সূক্ষ্মগুলো, যেগুলোর ইউরোপে প্রচুর চাহিদা ছিল। স্ট্যাভোরিনাস ১৭৭০ সালে উল্লেখ করেছেন : মাঝেমধ্যে মসলিন এত সূক্ষ্মভাবে বোনা হত যে ২০ গজের বা তারও বেশি দৈর্ঘ্যের একখানা কাপড় অনায়াসে ঢুকে যেত পকেটে বহনযোগ্য তামাকের কৌটায়। পুরো ব্যাপারটা এত তুচ্ছতার সঙ্গে সাধারণ যন্ত্রে করা হত আর ইউরোপীয়রা সেটার নিখুঁততায় এমন বিস্মিত হত, এখানে যা অন্যসব হস্তশিল্পের জন্যও প্রযোজ্য, যেগুলো তৈরি হত খুব অল্প আর ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রের মাধ্যমে । ১৭৫৫ সালের ১৯ ডিসেম্বরে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের কলকাতার কাউন্সিলে পাঠানো চিঠিতে ঢাকায় উৎপাদিত এই কাপড়গুলোর উল্লেখ ছিল :- সরবর্তি (সরবতের জন্য কাচের পানপাত্রের মতো প্রায় স্বচ্ছ রঙিন, ফলের রসের রং) মলমল, আলাবল্লি, তাঞ্জিব, তেরিন্দাম, নয়নসুখ ( চোখের সুখ ), সারবান্দেওনা (পাগড়ি), ডোরিয়া (ডোরা নকশার মসলিন, জামদানি (কারুকাজ করা মসলিন) ইত্যাদি। সংক্ষেপে, ঢাকার তাঁত থেকে বিভিন্ন মানের কাপড় বেরোত, আঞ্চলিক রাজাদের জেনানার বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত পাতলা মসলিন থেকে শুরু করে রায়তদের গায়ের মোটা পুরু চাদর পর্যন্ত।
ঢাকাই মসলিন– সূক্ষ্ম , সূক্ষ্মতর , সূক্ষ্মতরের থেকেও সূক্ষ্ম, সাধারণ, ডোরা, ছক কাটা, নকশাদার ও রঙিন
ঢাকায় তৈরি প্রত্যেকটি মসলিনেরই তিন-চারটি ধরন বা মান ছিল , যা কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে পরিচিত ছিল অর্ডিনারি বা সাধারণ, ফাইন বা সূক্ষ্ম, সুপারফাইন বা সূক্ষ্মতরের থেকেও সূক্ষ্ম নামে। মসলিন তৈরি হত বিভিন্ন ধরনের— সাদা, ডোরা, ছক কাটা, নকশাদার ও রঙিন।
কাপড়ে সূচীকর্ম ও ফুল-লতাপাতার নকশা
এছাড়াও ঢাকা বিখ্যাত ছিল কাপড়ের উপর সুঁই-সুতো ও ফুল-লতাপাতার নকশার কাজ। আবে ডি গুইয়োঁ ১৭৪৪ সালে লিখেছেন, ঢাকা থেকে সেরা ও সূক্ষ্মতম সোনা, রুপা, বা সিল্কের সুতোর কাজ আসত, আর সেই সুঁই-সুতোর কাজের গ্রীবাবন্ধ আর সূক্ষ্ম মসলিনগুলো দেখা যেত ফ্রান্সে। কলকাতার কাউন্সিলও প্রায়ই ঢাকায় কাপড় পাঠাত এই সুঁই-সুতোর কাজ আর লতাপাতার নকশার জন্য।
উৎপাদকদের জন্য বাংলার বাইরে থেকে তুলা আমদানি
ঢাকা জেলায় ও বাংলার অন্য এলাকাগুলোয় উৎপন্ন হওয়া বিপুল পরিমাণ তুলোর সবটাই ব্যবহার হত এখানকার কাপড় তৈরিতে। কিন্তু এত বিস্ময়কর পরিমাণের কাপড় এখানে তৈরি হত, আর এতগুলো তাঁত এখানে ছিল যে সপ্তদশ- অষ্টাদশ শতকে পুরো পৃথিবীব্যাপী কাপড়ের চাহিদা মেটাতে বোম্বে (মুম্বাই) আর সুরাট থেকেও তুলা আমদানি করা হত। ৪ ডিসেম্বর, ১৭৫২ সালের ফোর্ট উইলিয়াম কনসাল্টেশন্স থেকে জানা যায় : — সেখানকার (বোম্বে) ভদ্রলোকদের উদ্দেশ্যে আমরা তার (হেক্টর নামের জাহাজ) মাধ্যমে লিখতে সম্মত হয়েছি আর পরামর্শ দিয়েছি জাহাজে থাকা আমাদের মালপত্র বিলিবণ্টনের, আর যখন জাহাজ ফিরে আসবে মৌসুমের শুরুতে, তাদের কাছে আশা করছি ডুরিংটনের জন্য তুলার সেরা ব্রোচ…। নাটোরের উল্লেখ করে হলওয়েল বলেছেন : এই দেশে কোপোসও (কার্পাস) হয়, বা বাংলা তুলো, যার থেকে আগে উল্লেখ করা পণ্যগুলো তৈরি হত। তবে সেগুলো তৈরির বা ব্যবহারের কোনো আনুপাতিক হিসেব ছিল না, তাই বিদেশি বাজারগুলোর আর সুরাটের বন্দরের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছিল। স্ট্যাভোরিনাস এটাও উল্লেখ করেছেন যে বাংলার তাঁতকলগুলোর বাইরে থেকে তুলা আমদানির প্রয়োজন পড়ত, বিশেষত সুরাট থেকে।
রেশমি ও সূতি কাপড় ছাড়াও অন্য শিল্প; পাটের কাপড় বোনা
রেশমি ও সূতি কাপড় উৎপাদন ছাড়াও আরও কাপড় উৎপন্ন হত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। পাটের কাপড় বোনা কলকাতাসহ আরও কিছু জায়গায় বেশ প্রচলিত ছিল। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিনিয়োগের তালিকা থেকে জানা যায় গুন্নির (পাটের কাপড়) কথা, আর কলকাতার বাজারে বিক্রির তালিকাতেও এর উল্লেখ রয়েছে। চিনি উৎপন্ন হত প্রচুর, যা এশিয়ারই অন্য দেশগুলোয় প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হত, ফলে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ছিল এই প্রদেশে। অন্য মূল্যবান বস্তুর ভেতরে শোরা, আফিম ও রজন আঠাও প্রচুর পরিমাণে তৈরি হত বিহারের বিভিন্ন জায়গায়।
বন্দুক প্রস্তুতকারী
এসময়ে বাংলায় বেশ উন্নতমানের বন্দুক তৈরি হত। ৪ ডিসেম্বর, ১৭৫২ তারিখের কন্সাল্টেশন্সে উল্লেখ রয়েছে যে ভারী কামান টানার চাকাওয়ালা গাড়ি তৈরি হত কলকাতা ও কাশিমবাজারে; আর কলকাতারগুলো, কাশিমবাজারের তুলনায় সস্তায় ও ভালো মানের হত। মঙ্গির (মুঙ্গের) বিখ্যাত ছিল বন্দুক-কামান তৈরির কেন্দ্র হিসেবে। পরে নবাব মীর কাশিম (মঙ্গির থেকে) যুদ্ধের জন্য যতটা সম্ভব কামান ও ফ্লিন্ট মাস্কেট সংগ্রহ করেছিলেন।
নৌকো তৈরি
নৌকো নির্মাণ শিল্প অনেক ছুতারের পেশা ছিল, যারা জানত কীভাবে বিভিন্ন আকৃতির আর নকশার নৌকো বানাতে হয়, যেমন, বজরা, যেমন, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, পালুরারা (পালোয়ার), সেরিঙ্গা (সরঙ্গা), ও পাঞ্চোয়ে (পানশী)।
রেশমি ও সূতি শিল্পের পতন :–বহু বছরের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া
বাংলার এই শিল্পগুলো, বিশেষত তার বিখ্যাত সূতি আর রেশম শিল্প তাদের পুরনো মান আর গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল, বিভিন্ন কারণে প্রায় মরতে বসেছিল বাংলার ইতিহাসের বাঁকে, কালের স্রোতে। বাংলার সূতি ও রেশম শিল্পের পতন প্রদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের দুঃখজনক এক গল্প। এর শুরু বা শেষ কোনো নির্দিষ্ট তারিখে হয়নি, কিন্তু প্রক্রিয়াটি ছিল বহু বছরের।
মারাঠা আক্রমণের প্রভাব
কোনো সন্দেহ নেই যে, অর্থনৈতিক জীবনের অন্যান্য খাতগুলোর মতোই, মারাঠা আক্রমণের প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছিল বাংলার সূতি ও রেশমি কাপড়ের উৎপাদকদের উপর। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছিল বণিকদের ভেতরে, আর তাই এই শিল্প তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। অনেক অধিবাসী, তাঁতী ও কৃষক পালিয়ে গিয়েছিলেন, আড়ংগুলো বিপর্যয়করভাবে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল, জমি শূন্য হয়ে পড়েছিল আর হতভাগ্যরা, যারা পালিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী আর সন্তান আর দুহাতে যা ধরে— এমন জিনিস ছাড়া কিছুই নিতে পারেনি, ভেবেছিল (পদ্মা নদীর) পূর্বপাড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা নিরাপদ নয়। এমনকি গুররাহ ও তার কাছাকাছি মানের অমসৃণ কাপড়ও পাওয়া কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল। মারাঠা তাণ্ডবের ধ্বংসাত্মক প্রভাবে রেশমি কাপড়ের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; এ ব্যাপারে আমাদের বলা হয়, তাঁতী ও বাসিন্দারা পালিয়ে গেলে, অযত্নে কাটিমে রেশমের সুতো পড়ে ছিল, যেগুলো কাপড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিল – এলোমেলোভাবে কিছু কাপড়ও পড়ে ছিল কাটিমের বাইরে, যার কয়েকটি দ্বিধান্বিতভাবে দ্রুত শেষ করা হয়েছিল ১৭৫১ সালে কাশিমবাজার কুঠি থেকে কলকাতার কাউন্সিলের কাছে পাঠানো একটি চিঠি থেকে জানা যায় : বিগত কিছু বছর যাবৎ কাঁচা রেশম আর রেশমি কাপড়ের দুর্মূল্যের কারণ হিসেবে তারা খুঁজে পায় – মারাট্টাদের (মারাঠা) বাংলার অভ্যন্তরে ঢুকে তাণ্ডব চালানো, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া আর প্রধান আড়ংগুলো ধ্বংস করার কারণে এর সঙ্গে জড়িত কর্মজীবীদের পালিয়ে যাওয়াকে, সেখানে অন্য ভদ্রলোকদের কোনো কুকীর্তি দায়ী নয়। একই বছরে, বলরামগড়ী (বলরামগড়) থেকে কেলসাল লেখেন মারাঠাদের ফিরে আসার কারণে সৃষ্ট ঝামেলায় তিনি কোনো পণ্য কিনতে পারেননি, অধিকাংশ তাঁতীই বাধ্য হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
অর্থনৈতিক পতনের শুরু
আলীবর্দীর শাসনামলে বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের সবদিক বিবেচনা করলে এটা বলা যায় যে, পশ্চিমবাংলার অর্থনৈতিক অবনতির সূত্রপাত তখনই হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের পরপরই বাংলার শিল্পের পতনের জন্য কোম্পানির চাকর আর গোমস্তাদের উপর এককভাবে দোষারোপ করাটা কেবল মুদ্রার একপাশ দেখার মতো। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে পলাশীর পর দমনমূলক নীতি বাংলার শিল্প-কারখানায় ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে যে বাংলার অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি তার আগেই অন্য কীটেরাও শুষে নিতে শুরু করেছিল। এখান থেকে বাড়াবাড়ি রকমভাবে সম্পদ নিঃসরণ হতে শুরু করেছিল, পণ্যের উৎপাদন তো কম হচ্ছিলই তার সঙ্গে মানও পড়তে শুরু করেছিল, আর কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে, যখন মারাঠা আক্রমণের ভয়াবহ ঝড় বয়ে যায় বাংলার মাটিতে। কোম্পানির চাকরেরা এই বাজে অবস্থাকে আরও খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও তাঁতীদের সঙ্গে অন্যায় ও নিষ্ঠুর আচরণের ভেতর দিয়ে। বোল্টস ঠিকঠাকভাবে ধরতে পেরেছিলেন যে কোম্পানির চাকুরে ও গোমস্তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম উৎপাদনকারীদের সর্বনাশ তরান্বিত করেছিল যা প্রথম শুরু হয়েছিল নাবোবদের (নবাব) উৎখাত করার অনিয়মের মাধ্যমে আর মারাহটাদের (মারাঠা) লুণ্ঠনে। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, পলাশী-পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক পতন ১৭৫৭ সালের আগে থেকে চলে-আসা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ধারাবাহিকতায় স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কিন্তু যুদ্ধের পর সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তক্ষেপে। ঢাকার অর্থনৈতিক পতনের ব্যাপারে রেনেল ১৭৬৫ সালের অগাস্ট মাসে লিখেছেন :- . আমরা এর পতনের কারণ হিসেবে সহজেই শেষের দিকের একের-পর-এক লেগে থাকা যুদ্ধগুলোকে দায়ী করতে পারি যা পুরো দেশকে (বাংলা) বরবাদ করে দিয়েছিল, আর এটার ভেতরে আমাদেরও বেশ বড় অংশগ্রহণ ছিল। একই কথা বলা যায় বাংলার অন্যান্য এলাকা নিয়েও।