অধ্যায় ৭ : রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
আবার ফিরে আসা যাক ইতিহাসের পাতায়। আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কীভাবে জুদাহ রাজ্য একটি রোমান প্রদেশে পরিণত হয়েছে, যার দায়িত্বে থাকেন একজন প্রিফেক্ট বা প্রোকিউরেটর। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন রোমান শাসনের অধীনে ইহুদীদের রাজা হলেন হেরোদপুত্র হেরোদ অ্যান্টিপাস।
রোমানরা ইহুদীদের জনসংখ্যা গুণতে চাইলো, এবং সেজন্য পদক্ষেপ নিলো। কিন্তু ইহুদী আইনে এভাবে আদমশুমারি নিষিদ্ধ। রোমানদের এ কাজের বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষেপে উঠলো। গালিলির জুডাসের নেতৃত্বে এক আন্দোলন চলতে শুরু করল, যাকে ‘জিলটস’ (Zealots) বলা হয়।
হিব্রুতে একে ‘কানাই’ ডাকা হতো, মানে স্রষ্টার জন্য অন্ধ। জিলট বলতে ধর্মান্ধ বোঝানো হয়। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল রোমান শাসনের ইতি টানা, পবিত্র ভূমি থেকে তাদের তাড়ানো।
ইতিহাসবিদ জোসেফাস সাদুকি, ফারিসি, এসিনের পাশাপাশি চতুর্থ দল হিসেবে জেলটদের কথা উল্লেখ করেন, যার প্রতিষ্ঠাতা জুডাস। সিরিয়ার রোমান গভর্নর কুইরিনিয়াস ৬ সালে জুদাহ রাজ্যে আদমশুমারির আয়োজন করেন।
জেলটদের মাঝে একজন ছিলেন সাইমন বা শিমোন। তিনি পরে যীশুর সাহাবী হয়েছিলেন। আদমশুমারির কারণে শুরু হওয়া এ আন্দোলন যীশুর ধর্মপ্রচারের সময়ও ছিল। ৬ সাল থেকে ৭৩ সাল পর্যন্ত চলে জেলটস বিদ্রোহ। ইহুদীদের তালমুদে জেলটদেরকে ‘বিরইয়োনিম’ বা বর্বর জংলি বলা হয়েছে। জেলটদের একটি দলের নাম ছিল সিকারি, যার অর্থ ছোরাওয়ালা। রোমানদের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহের বিপক্ষে কোনো ইহুদী টু শব্দ করলেই তাদের পরপারে পাঠিয়ে দিত সিকারিরা।
জেলটদের পাশাপাশি এ সময়ে অনেকেই মেসায়ার দাবিদার হয়েছিলেন। অবশ্য সব ধরনের আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন সাদুকিরা। তারা রোমানদের সহায়তা করেন পুরোদমে। বিনিময়ে রোমানরা সাদুকিদের মধ্য থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রধান ইমাম বাছাই করে দিত। রোমানদের ছত্রছায়ায় ইহুদীদের সানহেদ্রিন আবার প্রতিষ্ঠিত হলো।
১৪ সালে রোমান সম্রাট টাইবেরিয়াস সিংহাসনে আরোহণ করলেন। তিনি তার রক্ষীদের প্রধান কমান্ডার সেজানুসের পরামর্শকে খুব মূল্য দিতেন। সেজানুস ইহুদীদের পছন্দই করতেন না। কারণ? কারণ, হাসিনাই আর হানিলাই নামের দুই ইহুদী পার্থিয়ান ব্যবিলনের নিহার্দিয়াতে স্বায়ত্বশাসিত সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। সেজানুস আশংকা করতেন, এমন স্বায়ত্তশাসনের ইচ্ছা জুদাহ রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
জুদাহ রাজ্যে চতুর্থ বা পঞ্চম রোমান প্রিফেক্ট হয়ে আসলেন পন্টিয়াস পাইলেট। তিনি বেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন ইহুদী সমাজে। সম্রাটের নামধাম প্রতিকৃতি বয়ে বেড়ানো সামরিক লোক পন্টিয়াস পাইলেটের কর্মকাণ্ডকে পৌত্তলিক বিবেচনা করতে লাগলো ইহুদীরা। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা হতো জেরুজালেমে; এরপর সেই প্রতিবাদ হতে লাগলো তার সরকারি বাসভবন সিজারিয়া ম্যারিটিমার সামনে, এমনকি স্টেডিয়ামেও। পাইলেট একটি নালা নির্মাণের জন্য ইহুদী কোষ থেকে অর্থ ব্যবহার করার পর জনরোষেও পড়েছিলেন। হেরোদের সাবেক প্রাসাদে তিনি সোনায় মোড়া বর্ম তুলে রাখেন, যাতে তার আর সম্রাটের নাম খোদাই করা ছিল। ইহুদীরা তা মোটেও পছন্দ করেনি। অবশ্য যীশুকে ক্রুশে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করায় ইহুদীরা খুশি হয়েছিল। তবে পাইলেট নিজে নাখোশই ছিলেন তাদের প্রতি। ৩৬ সালে রোমান প্রিফেক্ট হিসেবে তার এ দায়িত্ব শেষ হয়।
সম্রাট টাইবেরিয়াসের পর তার উত্তরাধিকারী হন ভাতিজা ক্যালিগুলা। সম্রাট ক্যালিগুলা ( ৩৭-৪১) ছিলেন ভয়ংকর পাগলাটে, কিন্তু অদ্ভুত কারণে ইহুদীদের প্রতি সদয়। হেরোদ যখন রোমে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি থাকতেন সম্রাট অগাস্টাস আর টাইবেরিয়াসের আবাসে। সেখানে তিনি যাদের সাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন, তাদের মাঝে ছিলেন ক্যালিগুলা, তাদের বন্ধুত্বের কারণে ইহুদীদের প্রতি একটা সদয় অনুভূতি কাজ করত ক্যালিগুলার।
ক্যালিগুলা হাজার হাজার লোক হত্যা করেছিলেন, যার মাঝে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তো ছিলেনই। বলা হয় তিনি নিজেকে দেবতা বলতেন- অ্যাপোলো, জিউসের সাথে নিজের মূর্তিও দাঁড়া করিয়েছিলেন। তার নিজের রক্ষীরাই তাকে হত্যা করেছিল।
ক্যালিগুলার আমলে মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়ার ইহুদীরা এক কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে রোমানদের সাথে। এই ইহুদীরা পূর্ণ নাগরিকত্ব চাইছিল। কিন্তু গ্রিক সমাজ তা মানতে নারাজ। গ্রিকরা ইহুদী উপাসনালয়গুলোতে ঢুকে সম্রাটের মূর্তি স্থাপন করতে লাগলো। মিসরে তখন রোমান গভর্নর অলাস অ্যাভিলিয়াস ফ্ল্যাকাস। তিনি ইহুদীদের কাউন্সিলের আটত্রিশজন সদস্যকে জনসম্মুখে চাবুক দিয়ে পেটাতে বললেন। ইহুদী নারীদের জোর করে শুকরের মাংস খাওয়ানো হলো। অবশেষে হেরোদ দ্য গ্রেটের নাতি হেরোদ (যার সাথে ক্যালিগুলার খাতির) তার প্রভাব খাটিয়ে গভর্নরের এই আদেশ রদ করান।
৪০ সালে গ্রিক ও ইহুদীরা উভয়ই এ বিষয়টি পেশ করতে রোমে ক্যালিগুলার দরবারে আসে। ইহুদীদের দলটির নেতা দার্শনিক ফাইলো বলেন, ক্যালিগুলা তাদেরকে পাগল বললেন যখন তারা তার ঐশ্বরিকত্ব অস্বীকার করল। অর্থাৎ রায় ইহুদীদের পক্ষে যায়নি
জুদাহ রাজ্যের তীরে গ্রিকরা সম্রাটের মূর্তি স্থাপন করল। ইহুদীরা রেগে গিয়ে সেটি ভেঙে ফেলল। এতে করে সম্রাট ক্যালিগুলাও রেগে গেলেন, তিনি রাজা অ্যান্টিয়কাসের সেই হেলেনিজম রীতি ফিরিয়ে আনলেন, এখন থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসসহ সকল ইহুদী উপাসনালয় রোমান দেবতাদের মন্দিরে পরিণত হবে।
সিরিয়ার গভর্নর পেট্রোনিয়াসকে আদেশ করা হলো, জেরুজালেমে জিউস অর্থাৎ রোমান দেবতা জুপিটারের বেশে ক্যালিগুলার বিশাল মূর্তি স্থাপন করতে হবে।
গভর্নর জানেন, এ কাজ ইহুদীরা করতে দেবে না সহজে। তার দুই লিজিয়ন সেনা লাগবে। প্রতি লিজিয়নে প্রায় ৪,২০০ সেনা। রাজা হেরোদ অবশ্য তাকে রাজি করালেন যেন তিনি এ মূর্তি স্থাপন না করেন। তবে শর্ত মেনে নেন যে, ইহুদীরা আর এখন থেকে সম্রাট পুজোয় বাধা দেবে না অ-ইহুদীদেরকে। কিছুদিন পরেই অবশ্য ক্যালিগুলা মারা যান। ইহুদীরা সেদিন ঈদের মতো আনন্দ করেছিল।
ক্যালিগুলার পর সম্রাট হয়ে আসেন ক্লডিয়াস (৪১-৫৪)। তিনি এসেই আলেক্সান্দ্রিয়ার এই ইহুদী বনাম গ্রিক দ্বন্দ্ব পেলেন সামনে। তিনি দুপক্ষকে চিঠি লিখলেন। বললেন, তারা যেন এক দল অন্য দলের প্রতি সহনশীল হয়। ইহুদীরা যেন অন্য ধর্মের দেবতাদের ব্যাপারে কুৎসা না রটায়। ইহুদীদের প্রতি সদয় হয়ে তিনি জুদাহ রাজ্যে সরাসরি রোমান শাসন সরিয়ে নেন, জুদাহ রাজ্যকে স্বায়ত্তশাসিত করে দেন। জুদাহ রাজ্যের রাজা তখন হেরোদই, তবে এবার তার মাথার ওপরে রোমান ঝামেলা নেই।
কিন্তু হেরোদ মারা যেতেই জুদাহ প্রদেশের এ সাময়িক শান্তির ইতি টানা হলো। জুদাহ আবারও রোমান প্রদেশে পরিণত হলো। গভর্নররা শাসন করতেন জুদাহ। অনেক সমস্যার সৃষ্টি হলো রাজ্য পরিচালনায়। ধনী-গরিবের প্রবল বৈষম্য, স্বঘোষিত নবীদের উপস্থিতি, ইত্যাদি। বিশাল এক খরা হয় এ সময়, প্রিফেক্ট টাইবেরিয়াস জুলিয়াস আলেকজান্ডারকে (৪৬-৪৮) সামাল দিতে হয় এ খরা। প্রিফেক্ট ভেন্টিডায়াসের আমলে (৪৮-৫২ ) সংঘটিত হয় দাঙ্গা, বাইতুল মুকাদ্দাসে এক গণহত্যা, সামারিটান আর গ্যালিলিয়দের দ্বৈরথ, ইত্যাদি। যখন প্রিফেক্ট হিসেবে এলেন অ্যান্টোনিয়াস ফেলিক্স (৫২-৬০) তখন তিনি পেলেন স্বাধীনতা যোদ্ধাদের, আর পেলেন কয়েকজন অলৌকিক নিরাময়কারীদের ছড়াছড়ি, তারা মেসায়ার আশায় উন্মুখ।
মোদ্দা কথা, ইহুদীদের ওপর তখন রোমানরা ত্যক্ত বিরক্ত।