অধ্যায়-৭ – ব্ল্যাকহোল (কৃষ্ণগহ্বর) এবং কোয়েসার
পূর্বের অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, কোনও নক্ষত্রের ভর তিন সূর্য ভরের বেশি হলে তার নিউট্রন ফার্মিচাপ ও নিউট্রনগুলোর অন্যান্য বহির্মুখী চাপ মধ্যাকর্ষীয় বলের অন্তর্মুখী চাপকে প্রতিরোধ করতে পারে না। এমনকি প্রকৃতিতে এমন কোনও বল নেই যা মধ্যাকর্ষীয় বলকে সামলাকে পারে। ফলে নক্ষত্রটি সংকোচিত হয়ে পড়ে। নক্ষত্রটি সংকোচিত হতে হতে খুব ক্ষুদ্র আয়তনে পৌঁছায় আর তখন নক্ষত্রটির
ঘনত্ব বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে নক্ষত্রটির চূড়ান্ত গঠন কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে তা আমাদের সঠিকভাবে জানা নেই। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় সূত্রানুসারে যখন একটি নক্ষত্রের সকল পদার্থ অতি ক্ষুদ্র আয়তনে চলে যায় তখন বস্তুর ভিতর থেকে কোনও আলোক রশ্মি ত্যাগ করলেও তা মধ্যাকর্ষীয় বলের প্রভাবে কেন্দ্রের দিকেই ফিরে যায়। ফলে এই ক্ষুদ্র আয়তনের বস্তুর ভিতরের অংশের সঙ্গে বাহির থেকে আর কোনও যোগাযোগ সম্ভব হয় না অর্থাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর তখন আমরা পাই একটি ‘ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর’। একে ব্ল্যাক বা কালো বলা হয় কারণ এর ভিতর থেকে কোনও প্রকারের বিকিরণই বাহিরে আসে না। নক্ষত্রটি প্রাথমিকভাবে ঘূর্ণমান না হলে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার পর এটি শীঘ্রই গোলাকার আকৃতি ধারণ করে। ব্ল্যাকহোলটির ব্যাসার্ধ (যেখান থেকে কোনওকিছুই বাহিরে আসতে পারে না) মোট ভরের ওপর নির্ভর করে হয়। M ভরের ক্ষেত্রে ব্ল্যাকহোলের ব্যাসার্ধ 2GM/C^2। এখানে G হচ্ছে নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, C হচ্ছে আলোর বেগ এবং M নক্ষত্রের ভর। নক্ষত্রের এই ব্যাসার্ধকে ‘শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ’ বলা হয়। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জশিল্ড (১৮৭৩-১৯১৬) এর নামানুসারে এই ব্যাসার্ধের নামকরণ হয়েছিল। তিনিই প্রথম ব্ল্যাকহোল সম্পর্কিত আইনস্টাইনের সমীকরণের সমাধান খোঁজে বের করেছিলেন। এবার যদি সূর্যের ভর (M) হয় ২×১০ গ্রাম তাহলে এই শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ অনুযায়ী এর ব্যাসার্ধ হবে প্রায় ২.৯৫ কিলোমিটার। পৃথিবীর ভর (M) প্রায় ৫.৯৮×১০^২৭ গ্রাম হলে এই ব্যাসার্ধ হবে প্রায় ০.৮৯ কিলোমিটার। জোরালোভাবেই বলতে হয় যে, ব্ল্যাকহোলের আয়তন বর্ণনা করতে হবে তার পরিধির সাহায্যে ব্যাসার্ধের সাহায্য নয়। কারণ যেহেতু, কোনওকিছুই ব্ল্যাকহোলের ভিতরে প্রবেশ করে আবার বের হতে পারে না তাই এর ব্যাসার্ধ সরাসরি মাপা যাবে না।
একটি নক্ষত্রের ভর তিন সূর্য ভরের বেশি হলে নক্ষত্রটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। কিন্তু ব্ল্যাকহোলের ভর তিন সূর্য ভরের কমও হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্ল্যাকহোলটি কেবল মধ্যাকর্ষীয় বলের শক্তি দিয়েই তৈরি হয় না, বাহিরের কোনও অতিরিক্ত বলের কারণে হয়। আর মহাকাশে এই অতিরিক্ত বল আসে সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সুপারনোভা বিস্ফোরণ হতে হলে নক্ষত্রের ভর হতে হবে প্রায় ৬ সূর্য ভরের বেশি। যাই হোক, একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণে অন্তঃস্থল বা কেন্দ্র সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং সেই সঙ্গে এই কেন্দ্রের ভরও অনেক কমে যায়। এই সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরে কেন্দ্রটি নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হয় অথবা অন্তর্মুখী চাপ যথেষ্ট পরিমানে শক্তিশালী হলে ব্ল্যাকহোলেরও সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের পৃথিবীকে বাহিরের বল দ্বারা পিষ্ট করে প্রায় ৫.৫৮ সেন্টিমিটার পরিধি বিশিষ্ট করলে একটি ব্ল্যাকহোলে পরিনত হবে।
১৭৯৮ সালের শুরুর দিকে ফ্রান্সের গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী পিয়র সাইমন ল্যাপ্লাস (১৭৪৯-১৮২৭) লিখেছিলেন, ‘আমাদের পৃথিবীর ঘনত্বের সমান ঘনত্ব বিশিষ্ট একটি নক্ষত্র যার ব্যাস সূর্য ব্যাসের প্রায় ২৫০ গুণ বেশি তার মধ্যাকর্ষীয় বলের জন্য আমাদের কাছের কোনও রশ্মি আসতে পারে না। তাই সম্ভবত মহাবিশ্বের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলোও অদৃশ্য রয়ে যায়। ল্যাপ্লাস তাঁর অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, কোনও কোনও পরিস্থিতিতে মধ্যাকর্ষীয় বল খুব বেশি হতে পারে। ফলে আলো মধ্যাকর্ষণ ভেদ করে বাহির হতে পারে না। এই অর্থে তিনি ব্ল্যাকহোলকেই প্রত্যাশা করেছিলেন অর্থাৎ এই ধরনের মহাজাগতিক বস্তুটিই হতে পারে ব্ল্যাকহোল। যাই হোক, ল্যাপ্লাস যে নক্ষত্রের কথা চিন্তা করেছিলেন এটি অধঃপতিত হয় এবং ব্ল্যাকহোলের রূপ লাভ করে। ব্ল্যাকহোলকে একটিমাত্র স্থিতিমাপে বা একটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা সূচিত করা যায়। যেমন এর ভর দ্বারা একে সূচিত করা যায়। এই অর্থে ব্ল্যাকহোল একটি সরল বস্তু। শর্ত হচ্ছে ব্ল্যাকহোলটি ঘূর্ণনশীল না হলে এটি কেবল ভর দ্বারা চিহ্নিত হয়। কিন্তু ব্ল্যাকহোলটি ঘূর্ণনশীল হলে তার ভর ও ঘূর্ণন গতি জানতে হবে। একটি ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হয় একটি ঘূর্ণনশীল নক্ষত্র হতে। ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোল গোলাকার হয় না বরং মেরু অঞ্চল একটু চ্যাপ্টা হয়। নিউজিল্যান্ডের আর.পি. কের ১৯২৩ সালে আইনস্টাইনের সমীকরণের একটি সমাধান থেকে ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোলের বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি দুটি বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ভর এবং কৌণক ভর বেগ থেকে এই ধরনের ব্ল্যাকহোলের বর্ণনা দিয়েছিলেন। আর এই ভর এবং কৌণিক ভরবেগ ব্ল্যাকহোলটির ঘূর্ণন গতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ব্ল্যাকহোলের চারপাশের অংশ যেখান থেকে কোনও সংকেতই বাহিরে আসতে পারে না সে অংশকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত বা দিগন্ত। প্রকৃতপক্ষে একটি ব্ল্যাকহোল কী রকমের হতে পারে তার আবিষ্কার করেছিলেন বি. কার্টার, এস. ডাব্লিউ হকিং, ডাব্লিউ. ইজরায়েল এবং ডি. সি. রবিসন। তাঁরা দেখিয়েছিলেন যে, একটি ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির সময় তার দিগন্ত অনিয়মিত এবং দ্রুত কম্পনশীল হয়। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের সময়ে দিগন্তটি একটি অনন্য মসৃণ বা সুষম আকৃতি ধারণ করে। প্রথম থেকেই ব্ল্যাকহোলটি ঘূর্ণমান না হলে তার আকৃতি পুরোপুরি গোলাকার হয়। ব্ল্যাকহোলটি ঘূর্ণমান হলে তার মেরু অঞ্চল চ্যাপ্টা হয় এবং এ চ্যাপ্টা হওয়ার পরিমাণ নির্ভর করে ব্ল্যাকহোলটির ঘূর্ণন গতির ওপর। ব্ল্যাকহোলের ভিতরে যা কিছুই ঠাঁই নিয়েছিল বা যা কিছু দিয়ে সৃষ্ট সে তার কোনওকিছুই স্মৃতিতে নেই। তার মধ্যকার পদার্থসমূহের সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিলীন হয়ে গেছে কেবল তার মোট ভর এবং কৌণিক ভরবেগই রয়ে গেছে। এমনকি তার অভ্যন্তরের পূর্বের পদার্থগুলো কণা বা প্ৰতিকণা দ্বারা সৃষ্টি ছিল কি না সে তথ্যটাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু ব্ল্যাকহোলে বস্তুর একটি বৈশিষ্ট্যে অর্থাৎ বৈদ্যুতিক আধানের সমষ্টি থেকে যায়। এই আধানের মান শূন্য। ব্ল্যাকহোল নক্ষত্রের বস্তু থেকে সৃষ্ট আর নক্ষত্রের বেলায় এই আধান শূন্য হয় যেহেতু নক্ষত্রের বস্তুর বৈদ্যুতিক আধান শূন্য হয়।
আলোর ওপর ব্ল্যাকহোল যে মধ্যাকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তা বর্ণনা করা যেতে পারে। বিষয়টি ৭.১ নম্বর চিত্রে দেখানো হল। এখানে ব্ল্যাকহোলের বড়ো বৃত্তটি হচ্ছে ঘটনা দিগন্ত। ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রটির প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের বেশি কিছু জানা নেই। এই কেন্দ্রটি তথাকথিত ‘অদ্বৈতবিন্দু’ নামে পরিচিত। এই কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান, কালের বৈশিষ্ট্য হয়ে যায় অদ্ভুত রকমের। এই ক্ষেত্রে বিন্দুগুলোর যে কোনও বিন্দু থেকে আলোক রশ্মি সৃষ্টি হয় এবং তাৎক্ষণিক কিছু সময় পরই গোলাকার পৃষ্ঠতল বা গোলক দখল করে (ছোটো ছোটো বৃত্ত) তা তরঙ্গমুখ নামে পরিচিত। ব্ল্যাকহোল থেকে দূরে কিন্তু পৃষ্ঠতলের বা তরঙ্গমুখের কেন্দ্রে এই উৎসবিন্দু অবস্থিত। ব্ল্যাকহোলের মধ্যাকর্ষণ বলের জন্য তার নিকটবর্তী জায়গায় তরঙ্গমুখ ব্ল্যাকহোলটির দিকে সরে যায়। গোলাকার তরঙ্গ-মুখ দিগন্তে উপস্থিত হলে তা দিগন্তের ভেতরে মিশে যায় এবং কখনই এর মুক্তি মিলে না। দিগন্তের ভেতরে যদি তরঙ্গমুখের উৎসবিন্দু হয় তাহলে আলোকরশ্মি নির্গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রবিন্দু বা অদ্বৈতবিন্দু সে রশ্মি চুষে নেয়। এভাবেই কোনও আলোকরশ্মি ব্ল্যাকহোল থেকে বের হতে পারে না। ব্ল্যাকহোল থেকে কোনও বিকিরণ বের হতে পারে না বলে একে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আশেপাশের বস্তুর ওপর এর মধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাব পড়ে। আশেপাশের বস্তুর ওপর এ প্রভাব পরিলক্ষিত করে ব্ল্যাকহোলকে পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি অন্য একটি নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরে যুগ্ম তারা সৃষ্টি করে। এই ধারণা পোষণ করে ১৯৬৪ সালে ইয়্যা বি. জেল’ডভিচ (Ya. B. Zel’Dovich) এবং ও খ গোজেনভ এই দুই সোভিয়েত জ্যোতিপদার্থবিদ্যা বর্ণালি বীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে একটি নিয়মাবদ্ধ গবেষণা করেছিলেন। সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেও এরকম দুটি নক্ষত্রকে মনে হয় একটি নক্ষত্র। কিন্তু তাদের বর্ণালি গবেষণা করলে দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে এখানে দুটি নক্ষত্রই আছে। এক্ষেত্রে এদের বর্ণালির নীল সরণ ও লোহিত সরণ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে একটি নক্ষত্রের নীল সরণ ঘটেছে আর এটি খানিকটা আমাদের পৃথিবীর দিকে আসছে। অন্যদিকে আরেকটি নক্ষত্র আমাদের দূরে সরে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় যে, যুগ্ম-নক্ষত্রের দুটিই পরস্পরের চারদিকে ঘুরছে। কখনও কখনও বর্ণালিবীক্ষণ বিশ্লেষণ থেকে সরাসরি দুটি নক্ষত্রের অস্তিত্ব বোঝা যায় না। কিন্তু তাদের কোনও একটির গতি থেকে অর্থাৎ এটির নীল সরণ ও লোহিত সরণ থেকে শনাক্ত করা যায় যে, একটি নক্ষত্র অপর একটি অদৃশ্য সঙ্গীর চারপাশে ঘুরছে। এরকম যুগ্ম নক্ষত্রের অদৃশ্যটিই হতে পারে ব্ল্যাকহোল। অবশ্য এই অদৃশ্য নক্ষত্রটির বেলায় অন্য একটি কারণও থাকতে পারে হয়ত নক্ষত্রটি খুবই অনুজ্জ্বল বা ক্ষীণ। এই যুগ্ম প্রক্রিয়ার বিভিন্ন বিষয় অর্থাৎ নক্ষত্রদের ঘূর্ণনের পর্যায়কাল এবং অন্যান্য বিষয় পর্যবেক্ষণ করে নক্ষত্র দুটির ভর নির্ধারণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে এদের একটি যদি ব্ল্যাকহোল হয়, তবে অবশ্যই এর ভর হবে তিন সূর্যভরের চেয়ে বেশি।
চিত্র-৭.১ : এখানে বড়ো বৃত্তটি ব্ল্যাকহোলের (গহ্বর) দিগন্ত বা ঘটনা দিগন্ত। ছোটো বৃত্তগুলো তরঙ্গমুখের অবস্থান যাদের ঠিক সামনেই নিকটের বিন্দুগুলো হতে আলোক তরঙ্গ নির্গত হয়। উৎস বিন্দুগুলো কেন্দ্রের কাছাকাছি হলেই অদ্বৈতবিন্দু বা কেন্দ্রবিন্দু তরঙ্গমুখগুলোকে তার দিকে টেনে নেয়।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে কী করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, যুগ্ম অবস্থায় অদৃশ্য নক্ষত্রটি বাস্তবিকই একটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর? ঘনিষ্ঠ যুগ্ম অবস্থায় অর্থাৎ দূরত্ব বেশি নাহলে ব্ল্যাকহোল তার সঙ্গী নক্ষত্রটির গ্যাস ও অন্যান্য পদার্থ তার দিকে টেনে নেবে। পদার্থ ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তে পতিত হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই বিকিরণ সৃষ্টি করবে। দিগন্তের কাছাকাছি মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র খুবই শক্তিশালী তাই পদার্থ এই ক্ষেত্রে পতিত হওয়া মাত্রই বিপুল বেগ ও গতি প্রাপ্ত হবে। পদার্থটি এক্স-রশ্মির আদলে বিকিরণ ত্যাগ করবে। দিগন্ত অতিক্রম পূর্বেই পদার্থ এ বিকিরণ ছড়িয়ে দেয় কেননা দিগন্তে প্রবেশ করার পর পদার্থের বিকিরণ ব্ল্যাকহোল চুষে নেয়। ফলে কোনও বিকিরণ বাহিরে আসতে পারে না। এই যুগ্ম অবস্থা থেকে সৃষ্ট এক্স-রশ্মি পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌঁছায় না। কারণ এক্স-রশ্মি বায়ুমণ্ডল ভেদ করতে পারে না। তাই পৃথিবী থেকে কোনও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এই এক্স-রশ্মি শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাই আমেরিকা ও ইতালি যৌথভাবে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে উরুহু উপগ্রহে একটি এক্স-রে দুরবিন পাঠিয়েছিল। সেই উপগ্রহ থেকে এই দুরবিন তথ্য উপাত্ত ধারণ করেছিল। ১৯৭২ সালের মধ্যে যথেষ্ট উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছিল যা থেকে একশটিরও বেশি এক-রশ্মির উৎসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু জেল’ডোভিচ ও গোজেনভের তালিকা থেকে রঞ্জন-রশ্মির (x-ray) কোনও উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার মানে এই নয় যে, যুগ্ম নক্ষত্রে কোনও ব্ল্যাকহোল নেই। এদিকে উরুহুর তালিকা থেকে ছয়টি এক্স-রশ্মির যুগ্ম উৎস পাওয়া গিয়েছিল যা ইতঃপূর্বে শনাক্ত হয়নি। এদের মধ্যে দুটি যুগ্ম উৎস ছিল যেগুলোকে নিউট্রন নক্ষত্রের উৎস হিসেবে ধরা হয়েছিল। কারণ এদের এক্স-রশ্মিতে পালসারের মত নিয়মিত স্পন্দন ছিল। এরকম নিয়মিত স্পন্দন ব্ল্যাকহোল থেকে আসে না, কারণ ঘূর্ণায়মান নিউট্রন নক্ষত্রের মত ব্ল্যাকহোলে তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র নেই। নিউট্রন নক্ষত্রের ঘূর্ণমান গতি ও তার প্রবল তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়তার এই নিয়মিত স্পন্দন বেরিয়ে আসে।
অন্য চারটি যুগ্ম উৎস ব্ল্যাকহোল থাকার সম্ভাবনায় নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ব্ল্যাকহোল পাওয়ার সবচেয়ে আশাপ্রদ উৎস হচ্ছে এক্স-রশ্মির যুগ্ম উৎস সিগনাস- এক্স-১। এই যুগ্ম নক্ষত্রে একটি অদৃশ্য সঙ্গী আছে যেটি এক্স-রশ্মির উৎস যার ভর প্রায় ৮ সূর্য ভর থেকে ১০ সূর্য ভরের সমান এবং এটি খুবই অবিস্তৃত অর্থাৎ এর আয়তন ছোটো। সুতরাং এই অদৃশ্য নক্ষত্রটির আয়তন ও ভর ব্ল্যাকহোলের আয়তন ও ভরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সিগনাস-এক্স-১ এর জন্য বিকল্প কিছু মডেল প্রস্তাবিত হয়েছে। সিগনাস-এক্স-১ এর অদৃশ্য সঙ্গীটি ব্ল্যাকহোল কি না তা সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিজ্ঞানীগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদি প্রমাণিত হয় যে, সিগনাস-এক্স-১ যুগ্ম নক্ষত্রে প্রকৃতপক্ষে ব্ল্যাকহোল রয়েছে, তাহলে এটি হবে শতাব্দীর চমকপ্রদ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি।
সৃষ্টিতত্ত্বে অন্য আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপ্ত বিষয় হচ্ছে ‘কোয়েসার’। এই বস্তুটির সঠিক প্রকৃতি সম্পর্কে ভিন্ন মত রয়েছে। এখানে ৩-সি-৪৮ এবং ৩-সি- ২৭৩ এই দুটি কোয়েসার বিবেচনা করা যাক। ‘৩-সি’ দ্বারা ‘তৃতীয় ক্যামব্রিজ ক্যাটালগকে বোঝানো হচ্ছে। এই ক্যাটালগে এরা যথাক্রমে ৪৮তম এবং ২৭৩তম। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদগণ ১৯৫৯ সালে তৃতীয় ক্যামব্রিজ ক্যাটালগ (Three Cambridge Catalogue)-টি প্রকাশ করেছিলেন। এটি রেডিও তরঙ্গ উৎসের একটি তালিকা। ‘রেডিও তরঙ্গ উৎস’ হচ্ছে মহাকাশে এইসব উৎস যেগুলো রেডিও তরঙ্গ আকারে শক্তিশালী তরঙ্গ নির্গত করছে। পৃথিবীর রেডিও টেলিস্কোপে এই তরঙ্গ শনাক্ত হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলো সব ধরনের রেডিও তরঙ্গ বা তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। কোনও কোনও নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি দৃশ্যমান বর্ণালির শক্তিশালী বিকিরণ করে অর্থাৎ আলো বিকিরণ। সুতরাং এসব বিকিরণ দৃশ্যমান উজ্জ্বল। আবার কিছু কিছু মহাকাশীয় বস্তু অধিক রেডিও তরঙ্গ বিকিরণ করে। ৩-সি-৪৮ এবং ৩-সি-২৭৩ এই দুটি রেডিও তরঙ্গ উৎসকেও আলোক দুরবিন দ্বারা শনাক্ত করা হয়েছিল। এদেরকে সাধারণ নক্ষত্র বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু এদের বিকিরণ অদ্ভুত বা অসাধারণ। পূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছিলাম যে, কিছু নক্ষত্রের বাহিরের শীতল গ্যাস তাদের নির্গত আলোকে শোষণ করে বলে তাদের বর্ণালিতে কীভাবে অন্ধকার রেখা বা অঞ্চল দেখা যায়। অন্যদিকে বিকিরণ নির্গমনের পথে উষ্ণ গ্যাস বা অন্যান্য পদার্থের উপস্থিতির কারণে কিছু কিছু নক্ষত্রের বা গ্যালাক্সির বিকিরণ বর্ণালিতে উজ্জ্বল রেখা বা অঞ্চল দেখা যায়। বিকিরণের প্রণালিগুলো লোহিত সরণ (বা নীল সরণও) দেখাতে পারে। ৩-সি-৪৮ এবং ৩-সি-২৭৩ কে আমাদের গ্যালাক্সির নক্ষত্র হিসেবে ধরা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল উৎস দুটির বিকিরণ অদ্ভুত। অবশেষে দেখা গেল যে, এই বস্তুগুলোর বিকিরণ প্রণালি পরিচিতই ছিল। এদের লোহিত সরণ ঘটছিল যথাকমে z=0.367 ও z=০.১৫৮। বিজ্ঞানী হাবলের ব্যাখ্যানুযায়ী এই কোয়েসারগুলোর দূরত্ব আমাদের পৃথিবী থেকে যথাক্রমে ৫ বিলিয়ন ও ৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে।
এই দুটি কোয়েসার বিংশ শতাব্দীর ষাট এর দশকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। ইতোমধ্যে নক্ষত্র সদৃশ আরও অনেক কোয়েসার আবিষ্কৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ৩-সি-৯ যার লোহিত সরণ z=২.০১২। যদি মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে এই লোহিত সরণ সংঘটিত হয় তবে এই কোয়েসারটি আমাদের থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এমনকি অতি দীর্ঘ লোহিত সরণ (2=০.৩৫৩) এর কোয়েসারের সন্ধানও পাওয়া গেছে।
কোয়েসারের একটি বৈশিষ্ট্য ধাঁধার সৃষ্টি করে তা হল অনেক কোয়েসার প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে তাদের উজ্জ্বলতায় যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন তাদেরকে সাধারণ গ্যালাক্সির চেয়ে ১০ গুণ বেশি উজ্জ্বল দেখায়। এখন বিষয় হল এই যে, এদের উজ্জ্বলতা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বা কয়েক মাসের মধ্যে পরিবর্তন হয় বলে তাদের এই বিকিরণের অঞ্চলটি কয়েক আলোক সপ্তাহ বা কয়েক আলোক মাসের সমান বড়ো হবে। কার সমগ্র অঞ্চলটি শক্তি উৎপন্ন করছে আর এ অঞ্চলের বিভিন্ন অংশ পরস্পরকে আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে প্রভাবিত করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, এই শক্তির উৎসের তুলনায় আমাদের গ্যালাক্সির এ প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত প্রায় ৮০ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বের সমান। সুতরাং, কয়েক আলোক সপ্তাহ বা কয়েক আলোক মাস দূরত্বসম অঞ্চল থেকে যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় সে শক্তির মান আমাদের গ্যালাক্সির শক্তির প্রায় ১০ হাজার গুণ বেশি। কীভাবে কোয়েসারের এমন ছোট্ট জায়গা থেকে এত বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় তা সত্যি এক বিরাট ধাঁধা! একটি সম্ভাব্য উত্তর হল–কোয়েসারের কেন্দ্রে একটি বিরাট ব্ল্যাকহোল রয়েছে যার ভর হতে পারে প্রায় এক শত মিলিয়ন সূর্য ভরের সমান। শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ অনুযায়ী এই ব্ল্যাকহোলের ব্যাসার্ধ হবে প্রায় ১৬ আলোক মিনিট অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের দ্বিগুণ। আর ব্ল্যাকহোলটি নক্ষত্রদের গিলে ফেলছে। এই ভক্ষণ প্রক্রিয়ায় ব্ল্যাকহোলের মধ্যাকর্ষণ বলের ‘হ্রাস-বৃদ্ধি’ ঘটছে। এক্ষেত্রে কারণ হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্র থেকে নক্ষত্রের বিভিন্ন অংশের দূরত্বের ব্যবধান। নক্ষত্রের যে অংশ ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রের কাছে অবস্থিত সে অংশ তুলনামূলক বেশি টান অনুভব করবে। এই রকম ভাঙন প্ৰক্ৰিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। এমন একটি প্রক্রিয়া কোয়েসারদের বেলায় ঘটে বলে মেনে নেওয়া হবে যদি এ বিপুল শক্তির উৎপাদন কোটি বছরের বেশি টিকে না থাকে। এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে কোয়েসার কোটি বছরের বেশি বাঁচে না। কোয়েসারদেরকে বিবেচনায় এনে এই ‘ব্ল্যাকহোল মডেল’ সফল হতে পারে যা পরোক্ষভাবে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এক অংশ মনে করেন যে, কোয়েসারদের লোহিত সরণের ক্ষেত্রে মহাবিশ্বের প্রসারণের চেয়ে অন্যান্য কারণই বেশি দায়ী। সুতরাং লোহিত সরণ ইঙ্গিত দেয় যে, কোয়েসাররা এত বিশাল দূরত্বে অবস্থিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, কোয়েসারগুলো কিছু গ্যালাক্সি থেকে বিশেষ করে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে বেশি বেগে বেরিয়ে এলে তাদের উচ্চ লোহিত সরণ ঘটেছিল। কিন্তু আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এনন ঘটনা ঘটেছিল বলে মনে হয় না। যদি কোয়েসারগুলো অন্য গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে আসে তবে আমরা লোহিত সরণের পাশাপাশি নীল সরণও দেখব। সুতরাং কিছু কোয়েসার আমাদের দিকে কিছু পথ আসতে পারে।
প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রড হয়েল মনে করেন যে, কোয়েসারগুলো অতি বিশাল দূরে অবস্থিত নয়। কোয়েসারগুলো গ্যালাক্সি থেকে পরিত্যাক্ত এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে কেন এদের নীল সরণ আমরা দেখতে পাই না। ক্যালিফোর্নিয়ার হেল মানমন্দির থেকে এইচ.সি. আপ পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন যে, কোয়েসারগুলো ‘কসমোলজিক্যাল’ নয় অর্থাৎ অতি বেশি দূরে নয়। আর্প বিভিন্ন অবস্থার অনেক গ্যালাক্সি খুঁজে পেয়েছেন। ফটোগ্রাফিক ফলকে তিনি এসব গ্যালাক্সিকে পরস্পরের কাছাকাছি দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু এদের লোহিতসরণ ভিন্ন ভিন্ন (৭.২ নম্বর চিত্র দ্রষ্টব্য)। উদাহরণস্বরূপ, তিনি পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি শৃঙ্খল পেয়েছিলেন যাদের চারটির লোহিত সরণ (z=০.০৫) একই। আর পঞ্চমটির লোহিত সরণ ছিল অনেক বেশি যা z=০.১২। দাবি রয়েছে যে, পাঁচটি গ্যালাক্সিই পরস্পরের কাছাকাছি রয়েছে। কিন্তু পঞ্চমটির অতি বেশি লোহিত সরণের পেছনে মহাবিশ্বের প্রসারণ ছাড়াও অন্য আরও কারণ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন যে, আর্পের উদাহরণগুলো দৃশ্যরেখা বরাবর সোজা সজ্জিত কিছু গ্যালাক্সি থেকে উঠে এসেছে। অনেক লোহিতসরণের গ্যালাক্সিটি প্রকৃতপক্ষে অনেক দূরে অবস্থিত, কিন্তু আলোকচিত্রে মনে হয় এটি অন্যান্যের নিকটেই আছে। এবার কোয়েসারগুলো যদি অতি বেশি দূরে হয়ে থাকে তবে এদের থেকে আসলেই বিশাল পরিমাণ শক্তি নির্গত হচ্ছে। আর যদি এসব কোয়েসার স্থানীয় হিসাবে অর্থাৎ কাছে রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয় তাহলে এদের মধ্যে বৃহৎ ব্ল্যাকহোল রয়েছে এ ভাবনার আবশ্যকতা নেই।
চিত্র-৭.২ : গ্যালাক্সিদের একটি শৃঙ্খল যা আর্প ০৩২৪ নামে পরিচিত।
সুতরাং এদের শক্তি উৎপন্ন হয় অতি গতানুগতিক প্রক্রিয়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে কোয়েসারগুলো কাছে না অতি দূরে অবস্থিত? এ বিষয়টি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণাধীন রয়েছে।