অধ্যায় ৭ : বাগানের পথ – এপিকিউরাস
আপনার নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানটি কল্পনা করুন। কেমন হবে সেটি? কে কে থাকবে সেখানে? কী বলবে তারা? আপনি যা কল্পনা করছেন তা অবশ্যই আপনার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যেন আপনি এখনও সেখানে উপস্থিত, আর কোনো একটি বিশেষ জায়গা থেকে সবকিছু দেখছেন, হয়তো উপর থেকে অথবা শোকাহতদের মধ্যে কোথাও বসে। বেশ, কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে একটি সত্যিকারের সম্ভাবনা আছে, আমরা মরে যাবার পরেও আমাদের শরীরের বাইরে আমরা টিকে থাকতে পারি খানিকটা অশরীরী কোনো আত্মার মতো যা কিনা এখনও দেখার ক্ষমতা রাখে এই পৃথিবীতে কী কী ঘটছে। কিন্তু বাকিদের জন্যে যারা কিনা বিশ্বাস করেন মৃত্যুই চুড়ান্ত, তাদের জন্য একটি সত্যিকারের সমস্যা আছে। প্রতিবারই যখন আমরা চেষ্টা করি কল্পনা করতে যে আমরা সেখানে নেই, আমাদের সেটি করতে হয় আমরা সেখানে আছি, আমরা যখন নেই সেখানে যা ঘটছে তা দেখছি এমন কল্পনা করে। নিজের মৃত্যু আপনি কল্পনা করতে পারেন কিংবা না পারেন, তবে কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা এই বিষয়টি নিয়ে অন্ততপক্ষে খানিকটা শঙ্কিত হওয়া খুব স্বাভাবিক। আর নিজের মৃত্যুকে বা কে ভয় পাবে না? কোনোকিছু নিয়ে আমাদের যদি সত্যি চিন্তিত হবার প্রয়োজনীয়তা থাকে, তবে মৃত্যুচিন্তা নিশ্চয়ই সেই তালিকার শীর্ষে। খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হবে নিজের অস্তি ত্বহীনতা নিয়ে ভাবনা, এমনকি যখন সেটি ঘটবে আজ থেকে বহুবছর পরে। এটি আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। জীবিত খুব কম মানুষই আছেন, যারা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবেননি।
কিন্তু প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস (৩৪১-২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রস্তাব করেছিলেন যে, মৃত্যুর ভয় করা আসলেই সময়ের অপচয় এবং এই ভয়টির ভিত্তিতে আছে খুবই বাজে কিছু যুক্তি। এটি মনের একটি অবস্থা, যা আমাদের অবশ্যই জয় করতে হবে। আপনি যদি খুব স্পষ্টভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবেন, দেখবেন মৃত্যু নিয়ে আমাদের আসলেই শঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। একবার যখন আপনি বিষয়টি নিয়ে আপনার চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিতে পারবেন এই মুহূর্তে এখানে বেঁচে থাকার এই সময়টিকে অনেক বেশি উপভোগ করতে পারবেন, যা এপিকিউরাস মনে করতেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।দর্শনের মূল বিষয়টি হচ্ছে, তিনি বিশ্বাস করতেন, আপনার জীবনকে আরো বেশি উত্তম করে তোলা, দর্শন আপনাকে সাহায্য করবে কীভাবে সুখী হওয়া যায়। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে আসলেই নিজের মৃত্যু নিয়ে বেশি ভাবনা অবশ্যই অসুস্থতা, কিন্তু এপিকিউরাস ভাবতেন এটাই আসলে আরো তীব্রভাবে বেঁচে থাকার উপায়।
ইজিয়ান সাগরে সামোস নামের একটি গ্রিক দ্বীপে এপিকিউরাসের জন্ম হয়েছিল। তবে তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন এথেন্সে, যেখানে তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন প্রায় ধর্মগুরু পর্যায়ের এক ব্যক্তিত্বে, যাঁর অনুসারী হবার জন্য আকৃষ্ট হয়েছিল একদল শিক্ষার্থী, যারা সবাই কমিউন বা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে একসাথে বসবাস করতেন। এই গোষ্ঠীতে এমনকি নারী কিংবা ক্রীতদাসরাও ছিলেন। প্রাচীন এথেন্সের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি তাই খানিকটা অস্বাভাবিক ছিল। স্পষ্টতই এইসব কারণে নিজের অনুসারীরা ছাড়া তিনি খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না বাকি এথেন্সবাসীদের কাছে। তবে তাঁর অনুসারীরা তাঁকে প্রায় উপাসনাই করত। তিনি তাঁর দর্শনের এই স্কুলটি পরিচালনা করতেন একটি বাগানসহ বাড়ি থেকে। সেই থেকেই এটি পরিচিত ছিল ‘দ্য গার্ডেন’ বা বাগান।
অন্য অনেক প্রাচীন দার্শনিকদের মতো (এবং কিছু আধুনিক দার্শনিক, যেমন পিটার সিঙ্গার) এপিকিউরাস বিশ্বাস করতেন দর্শনকে হতে হবে ব্যবহারিক, যা প্রয়োগ করা যাবে ব্যবহারিক এবং দৈনন্দিন জীবনে। এটি আপনি কীভাবে বাঁচবেন সেটি পরিবর্তন করার ক্ষমতা থাকা উচিত। সুতরাং যারা তাঁকে তাঁর বাগানে অনুসরণ করেছিলেন, তাদের জন্য শুধুমাত্র শেখা নয় বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই দর্শনকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করার বিষয়টি।
এপিকিউরাসের জন্য জীবনের কেন্দ্রীয় বিষয়টি হচ্ছে আমরা যে সবাই আনন্দ আর সুখ খুঁজি সেই বিষয়টিকে শনাক্ত করা, আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে সেই বিষয়টি, আমরা যখনই পারি যন্ত্রণা আর কষ্টকে এড়িয়ে চলি। এই বিষয়টি আমাদের জীবনের মূল চালিকাশক্তি। জীবন থেকে কষ্ট আর যন্ত্রণাকে বাদ দেয়া এবং সুখের পরিমাণ বৃদ্ধি করলেই এই জীবনটি আরো উত্তমভাবে কাটানো সম্ভব হবে। তাহলে বেঁচে থাকার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে এটি: খুবই সাধারণ একটি জীবনযাত্রাকে বেছে নেয়া, আপনার চারপাশে সবার প্রতি দয়াশীল হওয়া, নিজেকে চারপাশে পরিবেষ্টিত করে রাখুন সত্যিকারের বন্ধুদের দিয়ে। এভাবেই আপনি আপনার প্রায় সব কামনাগুলো পূর্ণ করতে পারবেন। আপনার আর এমন কোনো চাহিদা থাকবে না যা আপনি পূর্ণ করতে পারবেন না। কোনো প্রাসাদের মালিক হবার জন্য মরিয়া বাসনা নিজের অন্তরে পোষণ করা আপনার জন্য ভালো হবে না, যখন কিনা প্রাসাদ কেনার মতো টাকা আপনার কখনোই হবেনা। আপনার সাধ্যের বাইরে কোনোকিছু পাবার জন্য সারাজীবন পরিশ্রম করে ব্যয় না- করাই ভালো। একারণে খুব সাদামাটাভাবেই জীবন কাটানো অনেক উত্তম। আপনার ইচ্ছাগুলো যখন সাধারণ, তখন নেই ইচ্ছাগুলোকে সন্তুষ্ট করাও সহজ এবং আসলেই আপনার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো উপভোগ করার জন্যে আপনার সেই সময় ও শক্তিও অবশিষ্ট থাকবে। সুখের জন্য এটাই ছিল এপিকিউরাসের প্রস্তাবিত পথ এবং এটি যথেষ্ট বাস্তবসম্মতও বটে।
এই শিক্ষাটি ছিল একধরনের থেরাপি বা মনোচিকিৎসার মতো। এপিকিউরাসের লক্ষ্য ছিল তাঁর শিক্ষার্থীদের মানসিক কষ্ট তিনি লাঘব করবেন, এবং প্রস্তাব করেছিলেন কীভাবে শারীরিক যন্ত্রণাকে আমরা লাঘব করতে পারি অতীতের আনন্দগুলো স্মরণ করার মাধ্যমে। তিনি আমাদের দেখিয়ে দেন সুখানুভূতিগুলো অবশ্যই উপভোগ্য যখন সেটি ঘটছে, কিন্তু সেগুলো এমনকি তখনো উপভোগ্য থাকে যখন আমরা পরে সেই ঘটনাগুলো স্মরণ করি, সুতরাং আমাদের কল্যাণে তাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা আছে। যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় এবং কষ্ট অনুভব করছিলেন, তিনি তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন, কীভাবে তিনি তার মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত করেছিলেন তার অসুস্থতা থেকে তাদের পুরোনো একটি কথোপকথনের উপভোগ্য সেই স্মৃতি স্মরণ করার মাধ্যমে। এই সবকিছুই কিন্তু তাঁর নামের সাথে সংশ্লিষ্ট ইংরেজি শব্দ ‘এপিকিউরিয়ান’ বলতে আজ যা বোঝায় তার থেকে খুবই ভিন্ন। একেবারেই বিপরীত বলাই শ্রেয়। শব্দটি বলছে যে, একজন ‘এপিকিউর’ হচ্ছেন এমন কেউ, যিনি সুস্বাদু ভালো খাওয়া খেতে পছন্দ করেন, এমন কেউ যিনি ইন্দ্রিয়ানুভূতির আনন্দ আর বিলাসিতায় নিমগ্ন। কিন্তু এপিকিউরাসের অনেক সাদামাটা রুচিরোধ ছিল, এই শব্দটি যা বোঝাতে চাইছে তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে পরিমিত হতে হয়, লোভাতুর ক্ষুধার কাছে আত্মসমর্পণ করা মানে আরো বেশি বাসনা সৃষ্টি করা, যার পরিণতিতে সৃষ্টি হয় অপূর্ণ চাহিদার মানসিক চাপ। এই ধরনের জীবন যেখানে চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে, তা এড়িয়ে চলা উচিত। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা বিলাসী নয় বরং সাধারণ রুটি আর পানি খেয়ে জীবন যাপন করতেন। আপনি যদি দামি মদ পান করতে শুরু করেন, তাহলে অচিরেই আপনি আরো বেশি মূল্যবান মদ পান করতে চাইবেন এবং সেই অপূর্ণ চাহিদার ফাঁদে আটকে যাবেন, যেখানে আপনি যা পাবেন না সেই জিনিসই আপনি কামনা করবেন। তা সত্ত্বে এপিকিউরাসের শত্রুরা দাবি করেছিল যে তার সেই ‘গার্ডেন’ কমিউনে এপিকিউরাসের অনুসারীরা সারাদিন খাওয়া,পান করা ও নানা ধরনের আমোদ- ফুর্তি যেমন নিরন্তর সম্মিলিত যৌনসঙ্গমের আসর বসাতেন। আর এপিকিউরাসের শত্রুদের এই কুৎসা থেকেই এই এপিকিউরিয়ান শব্দটির আধুনিক অর্থ এসেছে। সত্যিকারার্থে এপিকিউরাস এবং অনুসারীরা এ-ধরনের কোনো জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল না। কারণ এ-ধরনের আচরণ এপিকিউরাসের দর্শনের বিরোধী। ক্ষতিকর মানসিকতা নিয়েই এই কুৎসাগুলো সম্প্রচার করা হয়েছিল।
এপিকিউরিয়ান শব্দটি এখনও সেই দুর্নাম বহন করে চলছে। একটি কাজ করতে এপিকিউরাস নিশ্চিতভাবে সময় ব্যয় করছিলেন সেটি হলো লেখালেখি। প্রচুর লিখেছিলেন তিনি। তথ্য জানাচ্ছে প্রায় ৩০০-র বেশি বই তিনি লিখেছিলেন, সবই প্যাপিরাসের রোলে, যদিও তার কোনোটারই অস্তিত্ব নেই। তাঁর সম্বন্ধে আমরা যেটুকু জেনেছি সেটি মূলত এসেছে তাঁর অনুসারীদের নানা লেখা থেকে, যারা তাঁর সব বই মূলত মুখস্থ করেছিলেন এবং লিখিতভাবে তারা গুরুর শিক্ষা তাদের লেখায় প্রচার করেছিলেন। তাদের লেখার অংশবিশেষ এখনও টিকে আছে, আগ্নেয়গিরি ছাইয়ের নিচে সুরক্ষিত হয়ে ছিল হারকিউলেনিয়ামে, পম্পেই- এর কাছাকাছি যে শহরটাও ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হয়েছিল। এপিকিউরাসের দর্শন শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র একটি দীর্ঘ কবিতা, On the Nature of Things, যার রচয়িতা ছিলেন রোমের দার্শনিক কবি লুক্রেশিয়াস। এপিকিউরাসের মৃত্যুর প্রায় ২০০ বছর পর এটি লেখা হয়েছিল। এই কবিতাটাই তাঁর স্কুলে যা শেখানো হতো, সেটাই সারসংক্ষেপ করেছিল।
সুতরাং, আবার আমরা ফিরে যাই সেই প্রশ্নটিতে, এপিকিউরাস যে-প্রশ্নটি আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কেন আপনার মৃত্যুকে ভয় পাওয়া উচিত না? একটি কারণ আপনি মৃত্যুসংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করবেন না। আপনার মৃত্যু এমন কিছু না যা আপনার সাথে ঘটবে, কারণ যখন সেটি ঘটবে তখন আপনি সেখানে থাকবেন না। বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক লুদভিগ ভিটগেনস্টাইনও তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন যখন তিনি তাঁর Tractatus Logico-Philosophicus fa, Death is not an event in life বা মৃত্যু জীবনের কোনো ঘটনা নয়। এখানে মূল ধারণাটি হচ্ছে কোনো ঘটনা বা ইভেন্ট হচ্ছে এমন কিছু যা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা অনুভূত হই। কিন্তু আমাদের নিজেদের মৃত্যু হচ্ছে সেই অভিজ্ঞতা অনুভব করার সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয়া, এমন কোনোকিছু না যে-বিষয়ে ঘটনাটি ঘটার পরও আমরা সচেতন থাকব বা মৃত্যুর মধ্যদিয়েও আমরা বেঁচে থাকব। যখন আমরা আমাদের নিজের মৃত্যু কল্পনা করি, এপিকিউরাস লক্ষ্য করেছিলেন, আমরা অধিকাংশই ভুল করে ভাবি মৃত্যুর পর আমাদের মৃতদেহের সাথে যা-কিছুই ঘটুক না কেন, আমাদের কিছু অবশিষ্টাংশ রয়ে যাবে অনুভব করার জন্যে। কিন্তু এটি আমরা আসলে কী সেই বিষয়ে একটি ভুল-বোঝাপড়া, আমরা কোনো একটি নির্দিষ্ট শরীরের সাথে যুক্ত, আমাদের সুনির্দিষ্ট হাড়মাংসের শরীর
এপিকিউরাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা আসলে পরমাণু (বা অ্যাটম) দিয়ে তৈরি (যদিও এই শব্দটি দিয়ে তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন, সেটি আধুনিক বিজ্ঞানীরা এই শব্দটি দিয়ে যা বোঝাতে চান তার থেকে কিছুটা ভিন্ন)। একবার যখন মৃত্যুর পর এই অ্যাটমগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আমরা আর সচেতনভাবে অনুভব করার মতো সত্তা থাকিনা। এমনকি যদি কেউ খুব সতর্কতার সাথে এইসব বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশগুলোকে আগের অবস্থায় বিন্যস্ত করেও এবং পুনর্গঠিত সেই শরীরের জীবনের নিশ্বাস যুক্ত করে, সেটা কোনোভাবেই আর আমি থাকব না। এই নতুন জীবন্ত শরীরটি আমি হব না, যদিও সেটি আমার মতো দেখতে। আমি তার কষ্ট অনুভব করব না, কারণ যখনই কোনো শরীর তার কাজ থামিয়ে দেয়, কোনোকিছুই তাকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারেনা। এই আত্মপরিচয়ের শৃঙ্খল তখনই ছিন্ন হয়ে যায়।
আরেকটি উপায়ে এপিকিউরাস ভেবেছিলেন তিনি তাঁর অনুসারীর মৃত্যুভয়কে নিরাময় করতে পারবেন, সেটি হচ্ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা যা অনুভব করি আর আমরা অতীত নিয়ে যেভাবে অনুভব করি, তার মধ্যে পার্থক্যটি দেখতে সাহায্য করার মাধ্যমে। আমরা একটিকে ভাবি, অন্যটিকে নিয়ে নয়। আপনার জন্মের আগের সময়ের কথা ভেবে দেখুন, তখন সেই সুবিশাল প্রায় অনন্ত সময় ছিল যখন আপনার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। শুধুমাত্র সেই সপ্তাহগুলোই না যখন আপনি আপনার মায়ের জরায়ুতে ছিলেন, যখন কিনা আপনি হয়তো আরো আগেই জন্ম নিতে পারতেন। অথবা মায়ের জরায়ুতে আপনার যাত্রা শুরু হবার আগ পর্যন্ত আপনি আপনার বাবা-মায়ের জন্যে শুধুমাত্র একটি সম্ভাবনা ছিলেন, আপনি আসার আগেই বহু ট্রিলিয়ন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, আমাদের জন্ম না-হওয়া সেই অজস্র হাজার বছর নিয়ে আমরা সাধারণত চিন্তা করিনা। কারোরই চিন্তা করা উচিত সেই সময় নিয়ে যখন কিনা তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু যদি সেটি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে মৃত্যুর পর আমাদের অস্তিত্বহীন সেই লক্ষকোটি বছর নিয়ে আমাদের কেন এত ভাবা উচিত? আমাদের চিন্তাগুলোকে এপিকিউরাস মনে করতেন ভারসাম্যহীন এবং অপ্রতিসম। জন্মের আগের সময় নিয়ে ভাবনার চেয়েও মৃত্যুর পর সময় নিয়ে চিন্তা করার দিকে আমাদের অনেক বেশি ঝুঁকে থাকার প্রবণতা আছে। কিন্তু এপিকিউরাস ভাবতেন এটি ভুল। একবার যখন আপনি বিষয়টি বুঝতে পারবেন, আপনারও উচিত মৃত্যু-পরবর্তী সময় নিয়ে ঠিক একইভাবে চিন্তা শুরু করা ঠিক যেভাবে আপনার জন্মের আগের সময় নিয়ে আপনি ভাবেন। তাহলে বিষয়টি আর খুব বড় কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না।
কিছু মানুষ খুবই চিন্তিত যে তারা হয়তো মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের শাস্তি পাবেন। এপিকিউরাস সেই চিন্তাও বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে দেবতারা আসলেই তাদের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তিত নন। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে তাঁর অনুসারীদের বলতেন, তাদের অস্তিত্ব আমাদের থেকে আলাদা, তারা এই পৃথিবীর সাথে নিজেদের জড়িত করেনা। সুতরাং আপনার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই, এটাই কিংবা এই যুক্তিগুলোরই নানা রকমফের তাঁর প্রস্তাবিত নিরাময় ছিল। যদি এটা কাজ করে তাহলে ভবিষ্যতে আপনার অস্তিত্বহীনতা নিয়ে কোনো বড় সমস্যা হবার কথা না। এপিকিউরাস তাঁর সমস্ত দর্শনের সার কথাটি একটি বাক্যে তাঁর সমাধিফলকের উপর লিখেছিলেন : I was not; I have been; I am not; I do not mind অর্থাৎ আমি ছিলাম না, আমি ছিলাম, আমি নেই, আমি বিষয়টি নিয়ে কিছু মনে করি না। আপনি যদি বিশ্বাস করেন আমরা শুধুমাত্র শারীরিক কোনো সত্তা, যার সৃষ্টি হয় পদার্থকণা দ্বারা এবং মৃত্যুর পর সত্যিকারের কোনো ঝুঁকি নেই শাস্তি পাবার, তাহলে এপিকিউরাস হয়তো আপনাকে প্ররোচিত করতে পারে যে আপনার মৃত্যু নিয়ে কোনো ভয় পাওয়া উচিত নয়। আপনি হয়তো তারপরও চিন্তা করতে পারেন মারা যাবার প্রক্রিয়াটি নিয়ে, কারণ প্রায়শই ব্যাপারটা যন্ত্রণাময় এবং অবশ্যই অভিজ্ঞতায় আমাদের সেটি অনুভব করতে হবে। এটি সত্যি, এমনকি যখন শুধু মৃত্যু-ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করা অযৌক্তিক। তাসত্ত্বেও মনে রাখতে হবে, এপিকিউরাস বিশ্বাস করতেন ভালো স্মৃতি সব যন্ত্রণাকে লাঘব করতে পারে, সুতরাং এই বিষয়ে তাঁর একটি উত্তরও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন আপনি শরীরের খাঁচায় আটকে থাকা একটি আত্মা, এবং শারীরিক মৃত্যুর পরও আত্মা বেঁচে থাকে, এপিকিউরাসের চিকিৎসা আপনার জন্য কাজ করবে না: কারণ আপনার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হবার পরও আপনি আপনার অস্তিত্ব টিকে থাকবে বলে কল্পনা করতে পারবেন।
এপিকিউরাস ও তাঁর অনুসারীরাই একমাত্র দার্শনিক নয় যারা ভাবতেন দর্শন একধরনের থেরাপি হতে পারে। বেশিরভাগ গ্রিক ও রোমান দার্শনিকরাই তাই ভাবতেন। স্টয়িক বা বৈরাগ্যদর্শন মতবাদের অনুসারীরা, বিশেষ করে সুবিখ্যাত মানসিকভাবে কীভাবে দৃঢ় থাকা যায় জীবনের সব বিপর্যয়ে সেই বিষয়ে শিক্ষা দান করার জন্য। স্পষ্টতই তাঁর সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন তিনি। তাঁকে যে-বিষয়টি বিখ্যাত করেছিল সেটি হলো একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর তাঁর দক্ষ আর বিরামহীন মনোযোগঃ সুখ। এর আগে দার্শনিকরা সবাই জানতে চেয়েছিলেন কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়, কিন্তু এপিকিউরাসই প্রথম তাঁর চিন্তাকে ব্যবহার করেছিলেন কীভাবে সুখী হওয়া যায় সেই সত্যান্বেষণে। খুব কম দার্শনিকই তাঁর মতো এত সুস্পষ্টভাবে তাদের আগ্রহের বিষয় সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি করেছিলেন। এবং বিষয়টি বহু মানুষকে ধাক্কা দিয়েছিল, বিশেষ করে যখন তারা শুনেছিল, এপিকিউরাস সুখী হবার প্রশিক্ষণ দেবার জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এথেন্সবাসীদের কাছে এই বিদ্যালয়টি ছিল রহস্যময়তায় ঘেরা, ভিতরে সেখানে কী ঘটছে সেই বিষয়ে নানা গুজব যেমন মানুষকে হতবাক করেছে এবং একই সাথে জন্ম দিয়েছে তীব্র কৌতূহলেরও। কিছু অসন্তুষ্ট এপিকিউরাসের প্রাক্তন অনুসারী সেই স্কুলে কী ঘটছে সেই বিষয়ে বেশকিছু মিথ্যা তথ্য পাচার করেছিল, অবশ্য যার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। যেমন টিমোক্রাতিস নামের একজন প্রাক্তন এপিকিউরাস-অনুসারী বলেছিলেন, এপিকিউরাসকে দিনে দুইবার বমি করতে হয়, কারণ তিনি তার পুরো সময় কাটান একটি গদির উপর বসে, সেখানে তাকে নানা মুখোরোচক খাদ্য আর পানীয় সরবরাহ করে ক্রীতদাসদের একটি দল। এবং ডাওটিমাস দ্য স্টয়িক প্রায় ৫০টি অশ্লীল চিঠি প্রকাশ করেছিলেন, যেগুলো তার ভাষ্যমতে এপিকিউরাস নাকি তার এক শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন যখন তিনি মদ্যপ এবং তীব্র যৌনতাড়নায় আক্রান্ত থাকতেন। এইসব গুজব ও কুৎসার জন্য এখনও আমরা ‘এপিকিউরিয়ান’ বিশেষণটি ব্যবহার করি যখন আমরা কারো বিলাসী আর অবক্ষয়ের জীবনকে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু এই বিশেষণটি সংশ্লিষ্ট কুৎসিত ইঙ্গিতগুলো আসলেই এপিকিউরাসের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মিথ্যা কিছু অভিযোগ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।
এপিকিউরাসের জীবন উত্তেজনাপূর্ণ ছিল কম ঠিকই,তবে অবশ্যই কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। এই অদ্ভুত গ্রিক দার্শনিক সত্যিকারভাবে মনোযোগ দিয়েছিলেন সুখ এবং আনন্দ কী সেটি ব্যাখ্যা করতে; বিলাসী জীবন, দামি খাওয়া কিংবা বাছবিচারহীন যৌনাচারের কোনো উপস্থিতি সেখানে ছিল না। তাঁর দুটো মাত্র আলখেল্লা ছিল। রুটি, পানি, অলিভ এবং কদাচিৎ হয়তো এক টুকরো পনির ছিল তাঁর এবং তাঁর শিষ্যদের খাদ্যতালিকায়। তিনি তাঁর জীবন কাটিয়েছিলেন ধৈর্য ধরে বহুবছর ধরে সুখ ও আনন্দের প্রকৃতি কী, সেই ভাবনায়। তাঁর সেই দার্শনিক ভাবনাগুলো সাহায্য করেছিল সুখী হবার জন্য আসলেই আমাদের কী দরকার সেই বিষয়ে একগুচ্ছ উল্লেখযোগ্য এবং বৈপ্লবিক কিছু উপসংহারে উপনীত হবার জন্য। আর তাঁর সেই উপসংহারগুলো তাঁর সময়ের ধারণা তো বটেই এবং আমাদের নিজেদের সময়ের ধারণার সাথে মেলে না। এপিকিউরাস প্রস্তাব করেছিলেন আমরা সাধারণত তিনটি ভুল করি যখন সুখ বিষয়ে ভাবি :
এক, আমরা মনে করি আমাদের রোমান্টিক কোনো সম্পর্কের প্রয়োজন : এপিকিউরাসের সেই যুগেও, এখনকার মতোই ভালোবাসা নিয়ে মানুষ মোহাচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু এপিকিউরাস লক্ষ্য করেছিলেন যে সুখ এবং ভালোবাসা (এবং বিয়ে তো বটেই) প্রায় কখনোই পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় অর্থাৎ তাদের একসাথে পাওয়া যায় না। কারণ অনেক বেশি ঈর্ষা, ভুল-বোঝাবুঝি এবং তিক্ততার উপস্থিতি এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে। যৌনসম্পর্ক সবসময়ই জটিল এবং প্রেমের সাথে তাদের কদাচিৎ প্রীতিকর মিশ্রণ হতে পারে। একারণেই, এপিকিউরাস উপসংহার টানেন, সবচেয়ে ভালো হবে সম্পর্কের মধ্যে খুব বেশি বিশ্বাস না- রাখা। এর বিপরীত, তিনি লক্ষ করেছিলেন, বন্ধুত্ব কত পরিপূর্ণতা দিতে পারে: যে সম্পর্কে আমরা নম্র, ভদ্র, ঐক্যমতে পৌঁছানোর চেষ্টা করি, বন্ধুত্বে পরস্পরকে আমরা যেমন গালমন্দ করিনা, তেমনি অপমানিত করি না, আর ঈর্ষায় কোনোকিছু নিয়ে আধিপাত্যপ্রবণ আচরণও করিনা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সত্যিকারের বন্ধুদের সাথে আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ সময় কাটানো হয়ে ওঠে না। আমরা আমাদের কাজ এবং পরিবারকে জীবনে অগ্রাধিকার দিই। আমরা যথেষ্ট পরিমাণ সময় বের করতে পারিনা, কারণ সেই বন্ধুরা আমাদের সাথে নয়, দূরে বাস করেন।
দুই, আমরা মনে করি, আমাদের অনেক বেশি পরিমাণ টাকা দরকার: এখনকার মতো তখনও মানুষ তাদের পেশা নিয়ে বিশেষভাবে ব্যস্ত ছিল, যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আরো বেশি অর্থ-উপার্জন এবং আরো বেশি বাহবা কুড়ানো, সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করা। কিন্তু এপিকিউরাস অন্য কারো অধীনে এইভাবে কাজ করার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছিলেন: ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, কুৎসা রটনা এবং হতাশাপূর্ণ জীবনাকাঙ্ক্ষা। যে জিনিসগুলো কাজকে সত্যিকারের সন্তুষ্টি দেবার গুণটি দিতে পারে, এপিকিউরাসের মতে, যখন আমরা অনুভব করতে পারি, আমরা হয় একা একা কাজ করতে পারি অথবা খুব ছোট গোষ্ঠী হিসাবে, যখন এটি অর্থবহ মনে হয় আমাদের কাছে, যখন আমরা অনুভব করতে পারি আমরা কোনো-না-কোনোভাবে এই পৃথিবীর কল্যাণে কাজ করছি বা কারো উপকারে আসছে আমাদের সেই কাজ। টাকা কিংবা বাড়তি চাকচিক্য আমরা আসলে খুঁজি না, আমরা কাজের মাধ্যমে আমাদের জীবনের পরিপূর্ণতা খুঁজি।
তিন, বিলাসবহুল জীবনের প্রতি আমাদের বাড়তি আগ্রহঃ আমরা বিলাসী দ্রব্যের স্বপ্ন দেখি। একটি খুব সুন্দর বাড়ি, চমৎকার আভিজাত্যপূর্ণ ঘর, যেখান থেকে বাইরের দৃশ্য হবে মনোমুগ্ধকর। আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দর কোনো জায়গায় বেড়াতে যাবার, যেখানে আমরা বিশ্রাম নেব আর অন্যরা আমাদের দেখাশুনা করবে। কিন্তু এপিকিউরাস সুখের লক্ষ্যে এইসব কামনাগুলোর সাথে একমত ছিলেন না। বিলাসী কোনো ভাবনার কল্পনার আড়ালে, তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি আসলে মনের প্রশান্তি চান। কিন্তু এই প্রশান্তি শুধুমাত্র অর্জন করার কোনো সম্ভাবনা নেই দৃশ্য-পরিবর্তন কিংবা চোখ-ধাধানো কোনো দালানের মালিক হবার মাধ্যমে। প্রশান্তি হচ্ছে মনের অভ্যন্তরীণ একটি প্রকৃতি এবং অবস্থা যা বহু বিশ্লেষণের ফলাফল; এটি আমরা অর্জন করি যখন আমরা আমাদের ভাবনাগুলোকে ভালো করে ছেঁকে আলাদা করতে এবং সঠিকভাবে বুঝতে পারি। সেকারণে আমাদের যথেষ্ট সময় দরকার পড়ার, লেখার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভালো শ্রোতার নিত্য সাহচর্য, একজন সহমর্মিতাপূর্ণ, দয়াশীল এবং বুদ্ধিমান মানুষ, এপিকিউরাসের সময় যে-মানুষটি হয়তো দার্শনিক ছিলেন, বর্তমানে যাকে আমরা তুলনা করতে পারি কোনো থেরাপিস্ট-এর সাথে। সুখ নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ মনে রেখেই এপিকিউরাস তাঁর জীবনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিলেন:
প্রথমত, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর সব বন্ধুদের সাথে বসবাস করবেন। মাঝেমধ্যে তাদের সাথে দেখা হওয়া তাঁর জন্যে যথেষ্ট ছিলনা আর। এথেন্সের বাইরে মোটামুটি কম খরচে তিনি একখণ্ড জমি কেনেন এবং সেখানে একটি বড় বাড়ি বানান, উদ্দেশ্য তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ থাকবে, এছাড়া নিচের তলা আর খোলা মাঠে সবার একত্র হবার জায়গা তো আছেই। এভাবেই এপিকিউরাস নিশ্চিত করেছিলেন সমমনারা যেন একসাথে বসবাস করতে পারেন, যারা পরস্পরের সাহচর্য উপভোগ যেমন করবেন, তারা পরস্পরের প্রতি সহমর্মী ও দয়াশীল আচরণ করবেন। নিয়ম করে সবাই দায়িত্ব নেবে শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য। সবার জন্যে একসাথে খাবার ব্যবস্থা থাকবে। কেউ চাইলে গভীর রাতেই বারান্দা কিংবা করিডোরে বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারবেন। এপিকিউরাসের এই বাড়িটি পরিচিত ছিল ‘দ্য গার্ডেন’ নামে, বিশ্বের প্রথম সত্যিকারের কমিউন।
দ্বিতীয়ত, কমিউনে বাস করা সবাই অন্য কারো জন্য চাকরি করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারা তাদের আয় যথেষ্ট পরিমাণ কমে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন, কারণ তারা সবাই সেখানে জীবনকে পরিপূর্ণ করার কাজে মনোযোগের সাথে নিয়োজিত হতে পেরেছিলেন। এপিকিউরাসের কিছু বন্ধু তাদের শ্রম দিয়েছিলেন কৃষিকাজে, কেউ আসবাবপত্র নির্মাণে, কেউবা শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রচেষ্টায়। অবশ্যই সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ বা অর্থবিত্ত ছিল না ঠিকই, তবে সবাই যথেষ্ট পরিমাণ অন্তর্নিহিত সন্তুষ্টিকে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
তৃতীয়ত, এপিকিউরাস এবং তাঁর বন্ধুরা অন্তর্দৃষ্টি আর যৌক্তিক বিশ্লেষণের দ্বারা মানসিক প্রশান্তি অনুসন্ধান করার লক্ষ্যেতাদের নিজেদের নিবেদন করেছিলেন। প্রতিদিনই তারা তাদের সময় ব্যয় করেছিলেন তাদের সব চিন্তা আর দুশ্চিন্তাকে বিশ্লেষণ আর ব্যবচ্ছেদ করার জন্য, যা তাদের মনকে শুধু তীক্ষ্ণই করেনি, দর্শনের সেরা কিছু প্রশ্নকে মোকাবেলা করার দক্ষতাও তারা অর্জন করেছিলেন।
এপিকিউরাসের জীবন যাপনের এই পরীক্ষা খুব সহজে আকর্ষণ করেছিল বহু মানুষকে। একই ধরনের এপিকিউরিয়ান কমিউনিটির পত্তন ঘটেছিল ভূমধ্যসাগরের চারপাশে বহু জায়গায়, যা হাজার হাজার অনুসারীকে আকর্ষণও করেছিল। বহু প্রজন্ম ধরেই তারা দারুণভাবে বসবাসও করছিলেন, কিন্তু আগ্রাসী এবং ঈর্ষান্বিত খ্রিস্টীয় চার্চ পঞ্চম শতাব্দীতে এইসব কমিউনিটিগুলোকে নৃশংসভাবে নিপীড়ন করেছিল। এমনকি তারপরও মূল সেই তাড়নাটি কখনোই হারিয়ে যায়নি, যাদের অনেকগুলোই রূপান্তরিত হয়েছিল মঠ কিংবা সন্ন্যাস আশ্রমে। আধুনিক যুগেও এপিকিউরাসের গুরুত্ব দেখতে পাই আমরা। কার্ল মার্ক্স পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিলেন এপিকিউরাস, এবং তিনি তাঁকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় দার্শনিক হিসাবেই ভাবতেন। যাকে আমরা কমিউনিজম বলে ডাকি, সেটি মূলত আকারে এপিকিউরানিজমেরই আরো বড়, এবং বলা যায় আরো বেশি কর্তৃত্ববাদী এবং আনন্দবিবর্জিত একটি সংস্করণ। এমনকি আজও এপিকিউরাসকে উন্নত ভোগবাদী পুঁজিবাদী সমাজের জীবনের অপরিহার্য পথপ্রদর্শক হিসাবে মনে করা হয়, কারণ বিজ্ঞাপন, যার উপর এই পুরো ব্যবস্থাটির ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে, তা কাজ করে খুব চালাকির সাথে, সুখী হবার জন্য কী প্রয়োজন সেই বিষয়ে মানুষকে সংশয়গ্রস্থ করার মাধ্যমে। প্রায় অবিশ্বাস্যসংখ্যক বিজ্ঞাপন তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে তার ক্ষতিকর প্রভাবটিকে কার্যকর করে, এপিকিউরাস যাদের চিহ্নিত করেছিলেন সুখের মিথ্যা প্রলোভন হিসাবে : রোমান্টিক ভালোবাসা, পেশাগত সামাজিক অবস্থান এবং বিলাসিতা। এত সফলতার সাথে বিজ্ঞাপনগুলো কখনোই কাজ করতে পারত না, যদি সেগুলো আমাদের আসল প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সত্যিকারের বোধ নিয়ে কাজ করতে চাইত। তারপরও তারা আমাদের আকর্ষণ করে, সেই চাহিদাগুলোকে প্ররোচিত করে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরিভাবে সেই তৃষ্ণা মেটাতে অস্বীকৃতি জানায়। এপিকিউরাস আমাদের আমন্ত্রণ জানান নিজেদের বিষয়ে বোঝাপড়াটিকে পরিবর্তন করতে এবং সেভাবে সমাজ পরিবর্তন করতে। সেইসব জিনিসের কামনায় আমাদের নিজেদেরকে এবং এই পৃথিবীকে নিঃশেষ করা উচিত হবে না, যেগুলো আমাদের সম্ভবত কখনোই সন্তুষ্ট করবে না, এমনকি যদি আমরা সেটি অর্জনও করি। আমাদের প্রয়োজন দর্শনের কাছে ফিরে যাওয়া এবং সুখী হবার আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ পথগুলোর আন্তরিকভাবে অনুসন্ধান করা।