অধ্যায় ৭ – বাংলার বাণিজ্য
ক. এশীয় বাণিজ্য
বাণিজ্যে বাংলা অনন্য
নানারকমের প্রাকৃতিক সুবিধার কারণে আদিকাল থেকেই বাংলা গড়ে তুলতে পেরেছিল বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক আর অষ্টাদশ শতকে এসে সেটা আর কেবল এশীয় দেশগুলোর ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইল না, ইউরোপ আর আফ্রিকাতেও জাল বিছিয়েছিল। উর্বর মাটি, অনুকূল আবহাওয়া আর এখানকার মানুষদের শ্রম- প্রচুর পরিমাণে বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদনে সহায়ক ছিল। বাংলা প্রদেশের প্রায় সব জায়গায় প্রবাহিত প্রমত্তা নদী ও তার অসংখ্য শাখা, গণনাতীত খাল ও বিল দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অল্প খরচে পণ্য পরিবহনে বিশেষ ভূমিকা রাখত।
নৌ–পরিবহনের ব্যবস্থা
ডাও বলেছেন, সহজ নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা এখানকার মানুষের মধ্যে বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। প্রতিটি গ্রামেই খাল ছিল, প্রতি পারগানায় (পরগণা) ছিল নদী, আর পুরো রাজত্বে গঙ্গা নানাভাগে বিভক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে যা সাগরপথে নিত্যপণ্য ও উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করেছিল। জরিপ করার সময়ে রেনেল বাংলার ভূগোলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন : গাঙ্গেস (গঙ্গা) ও বুররামপুটের (ব্রহ্মপুত্র) তাদের অসংখ্য শাখানদী ও উপনদী দিয়ে বাংলাকে বিভিন্ন দিক থেকে এমনভাবে বিভক্ত করেছে যে সহজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়। নদীর মতোই বিস্তৃত খালগুলো বাংলার ষষ্ঠ অংশ হিসেবে পরিগণিত বর্ধমান ও বীরভূম সংলগ্ন এলাকা বাদে বাংলার সমতলভূমিতে ব্যাপ্ত ছিল, আর সাবধানতা বজায় রেখে বললে এগুলো গ্রীষ্মকালেও সর্বোচ্চ ২৫ মাইল পর্যন্ত চলাচলের মতো থাকত, আর সাধারণ খালগুলোয় এর এক-তৃতীয়াংশ পথ পাড়ি দেওয়া যেত। ধারণা করা হয় এই নৌপথ একসঙ্গে ৩০ হাজার জেলের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম ছিল। এটা জানার পর আর বিস্ময়ের অবকাশ থাকে না যে, বাংলা ও বাংলার উপর নির্ভরশীল এক কোটি মানুষের সমস্ত লবণ আর খাবারের বেশিরভাগই নৌপথের উপর নির্ভরশীল ছিল। এর সঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি- রপ্তানি করা পণ্য, পুরো দেশজুড়ে উৎপাদিত দ্রব্য ও পণ্য বিনিময়; মাছের ব্যবসা ও অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ পণ্যের চলাচলে বছরশেষে আয় হত প্রায় বিশ লক্ষ স্টার্লিং।
পলাশীর আগে বাংলার অনুকূলে বাণিজ্যিক ভারসাম্য
প্রাক-পলাশী সময়ে বাণিজ্যের পাল্লা অন্যসব জাতির থেকে বাংলার দিকেই বেশি ঝুঁকে ছিল; আর এটা ছিল এমন এক কূপ যেখানে সোনা ও রুপা হারিয়ে যেত কোনোরকম ফেরত আসার সম্ভাবনা ছাড়াই। ১৭৬৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের উদ্দেশ্যে লেখা বাংলার সিলেক্ট কমিটির চিঠি থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলার বিপুল বাণিজ্যকে ভাবা যেতে পারে কেন্দ্র হিসেবে যা ভারতের সমস্ত ধনীদের আকৃষ্ট করত… ধাতব মুদ্রার প্রবাহ ছিল হাজার হাজার মাধ্যম দিয়ে… ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের জোগাড় করে আসত দেশে; উপসাগরগুলো (মোকা বা আল-মাখা ও পারস্য) তাদের সম্পদ ঢেলে দিয়েছিল এই নদীতে (গঙ্গায়)। এভাবে প্রদেশ উল্লেখযোগ্য রকমের লাভবান হয়েছিল তার বিস্তৃত ও সবল বৈদেশিক বাণিজ্যে।
এশিয়া ও আফ্রিকার উপকূলে বাংলার উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য
প্রায় প্রতিবছরই, প্রচুর পারসিক, আবিসিনীয়, আরব, চৈনিক, তুর্ক, মুর, ইহুদি, জর্জীয়, আর্মেনীয় ও এশিয়ার অন্যান্য এলাকা থেকে প্রচুর বণিকদের আগমন ঘটত বাংলায়, আর জাহাজ বোঝাই করে এখানে তৈরি পণ্য আর খাদ্য ও মশলার মতো কৃষিপণ্য কিনত। বাংলার বাণিজ্য লাক্ষাদ্বীপ, মালদ্বীপ ছাড়াও পূর্ব এশিয়ার চীন, পেগু, মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জেও বিস্তৃত হয়েছিল। বার্থোলোমিউ প্লাইস্টেড ১৭৫০ সালে লিখেছেন যে বালেশ্বরের ইউরোপীয় ফ্যাক্টরিগুলো মালদ্বীপের দ্বীপগুলোতে ভাত ও অন্য খাদ্যশস্যের ব্যবসায় বেশ ভালো করছিল। অন্তত ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত, করোমণ্ডল ও মালাবার উপকূল, পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগর, এমনকি ম্যানিলা, চীন ও আফ্রিকার উপকূল ও বাংলার প্রতি নির্ভরশীল ছিল তুলা, গোলমরিচ, ওষুধ, ফল, চক, কড়ি, টিন প্রভৃতির জন্য; অন্যদিকে বাংলা থেকে যেত এমন সব পণ্য যেগুলো ছাড়া তাদের চলত না, যেমন কাঁচা রেশম ও তার থেকে তৈরি বিভিন্ন পণ্য, আফিম, প্রচুর পরিমাণে সূতি কাপড়, চাল, আদা, হলুদ, পিপুল মরিচ ইত্যাদিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য। এসব দেশে চিনি ও গম ছিল বাংলার অন্যতম দুটি রপ্তানি পণ্য। ১৭৫৬ সালের ঠিক আগে প্রতিবছর চিনি রপ্তানির পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ হাজার মণ, যার থেকে লাভই হত ৫০%, যার বিনিময় মাধ্যম ছিল ধাতব মুদ্রা। ১৭৬৯-৭১-এ বাংলায় ঘুরে যাওয়া ডাচ-পর্যটক স্ট্যাভোরিনাস বলেছেন ধানের পাশাপাশি বাংলায় ভালো গম হত, যা আগে বাটাভিয়ায় পাঠানো হত।
এশীয় দেশগুলোতে ও বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাণিজ্যের সমাপ্তি
এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মতো বাংলায়ও সেটা ঘটে যাওয়ায় পশ্চিম এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার সঙ্গে ধীরে ধীরে বাংলার বিস্তৃত বাণিজ্য হ্রাস পেতে থাকে।
ক) এশীয় দেশগুলোয় বিশৃঙ্খলা
১৭৪৭ সালে নাদির শাহকে হত্যার পরপর একসময়কার সমৃদ্ধ পারসিক সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল হয়ে ভেঙে গেল আর শুরু হল নিরবচ্ছিন্ন গৃহযুদ্ধ । পারস্যের সঙ্গে সমস্যার ভাগিদার জর্জিয়া ও আর্মেনিয়াকেও অপ্রীতিকর ভাগ্য বরন করতে হয়েছিল। দারিদ্র্য … বাণিজ্যের দ্বার রুদ্ধ করে; আত্মশ্লাঘা … দূরীভূত হয় সম্পদের সঙ্গেই, আর জনগণকে খুশি থাকতে হয় নিজেদের দেশের মোটা কাপড় নিয়েই । তুর্কি সাম্রাজ্যের দক্ষিণ ও পূর্ব সীমান্তের পতন ঘটে। মিশর বিদ্রোহী হয়; ব্যাবিলনীয়া তাদের বাশা-র (পাশা) অধীনে বিদ্রোহ করে। মিশরের নৈরাজ্যকর অবস্থা … সুয়েজ থেকে কায়রো কাফেলা বা ক্যারভানের মাধ্যমে ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার মতো হয়; কায়রোতে বাংলায় উৎপাদিত পণ্য সাগরপথে গিয়ে অটোমানদের অধীনে থাকা সব বন্দরে পৌঁছে যেত। বাগদাদের বাশা-র (পাশা) লোভের কারণে, … তার দখল করা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি শক্তিশালী স্থায়ী বাহিনী প্রতিপালনের প্রয়োজন পড়ে, বুসসোরাহর (বসরা) দেয়ালে ত্রাসের সৃষ্টি করে, যে-কারণে, এর সঙ্গে সিরিয়ার সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়
খ) বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন
পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে বাংলার রাজনৈতিক বিপ্লবের পরিণামে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তার দালাল ও গোমস্তাদের প্রভাব, বাংলার স্থানীয় বণিকদের এশীয় বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছিল। ভেরেলস্ট বলেছেন, পূর্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য… পারস্য ও লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর সমস্যাগুলোর কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা তখন (১৭৫৭) ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর বাড়াবাড়ির প্রভাবে, যারা বাংলার সমকল উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করত। এমনকি ইংরেজ পরিচালকদের প্রয়োজনীয় পরিমাণ কাপড়ের টুকরো উৎপাদনের জন্য এতটাই কঠোর নিয়ম ছিল যে, নবাবকেও ইংরেজ এজেন্টদের কাছে আর্জি পেশ করতে হত তার গৃহস্থালির কাপড়ের সরবরাহের জন্য। বাংলা এভাবেই পুবের দেশগুলো থেকে বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত সোনা-রুপা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে আর পলাশীর পর প্রদেশে রুপার সংকটের একটি কারণ ছিল এটা।
এশীয় দেশগুলোতে কাপড় রপ্তানিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একক স্বত্ব লাভ
পলাশীর যুদ্ধের কয়েক বছর পর, ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কাপড় বুসসোরাহ (বসরা), জিদ্দা (জেদ্দা) ও মোকায় একক স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এই যৌথ উদ্যোগের পণ্য খালাস করতে গভর্নর ও কলকাতার কাউন্সিল জাহাজ তৈরি করে, যেগুলোকে ফ্রেইট শিপ বা মালবাহী জাহাজ বলা হত, যেগুলোতে প্রথমে নিজেদের পণ্য বোঝাই করা হত, তারপর অবশিষ্ট ধারণক্ষমতার অন্য পণ্য বহন করা হত।
এই চর্চার কুফল
পুরো কাজটা সম্পন্ন হত কলকাতার কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে, যিনি পণ্যের ভারপ্রাপ্ত অধিকারী হিসেবে থাকতেন আর এজন্য একটা গুদামঘরও রাখতেন যেটাকে কলকাতায় সবাই ফ্রেইট ওয়্যারহাউজ বা পণ্যের গুদামঘর নামেই জানত। কোম্পানির তরফ থেকে এধরনের চর্চা ব্যবসায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বোল্টস লিখেছেন, বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা জানা যায় ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা করা বণিকদের পণ্য সম্পর্কে, এমনকি ইউরোপীয় কিন্তু অন্য জাতের যেমন আর্মেনীয়, মঙ্গোল, জেন্টু (হিন্দু) এই একচ্ছত্র আধিপত্যের শিকার হয়, রাস্তায় তাদের আটকে জোর করে গুদামে নিয়ে যাওয়া হত আর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের বাধ্য করা হত কোম্পানির জাহাজে (যেগুলো সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছিল তাদের, আর গন্তব্য আর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেরও ফারাক ছিল) তাদের পণ্য বোঝাইয়ে; এই অযাচিত কাজের জন্য এসব বণিকেরা তাদের ব্যবসায়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে, পণ্য নষ্ট হতে থাকে আর কখনও পণ্য হারিয়েও যেতে থাকে।
খ. আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য
প্রাক–পলাশী সময়ে বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে বাংলার সক্রিয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক
প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম বাধা থাকলেও অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক আর অন্য ব্যাপারগুলোয়, ভারতীয় প্রদেশগুলো একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল ছিল। বাণিজ্যের দিক থেকে বাংলার সঙ্গে অন্য প্রদেশগুলোর সক্রিয় সম্পর্ক ছিল আমাদের আলোচ্য সময়কালে। বিভিন্ন এলাকার বণিকেরা যেমন কাশ্মিরি, মুলতানি, পাটান (পাঠান), শেখ, সন্ন্যাসী, পোগ্নিয়া (মধ্যদেশীয় বণিক, যাদের মাথায় পাগড়ি থাকত), বেট্রেয়া (ভুটিয়া) ও অন্যরা বছরে একবার হলেও বাংলার শরণ নিত কাফেলায় করে, বা হাজার হাজার মানুষের দল গঠন করে গরুর গাড়িতে করে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেত, বর্ধমানের কথা বলতে গিয়ে ১৭৫৬ সালে হলওয়েল বলেছেন, প্রশান্ত সময়ে এই জায়গা প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে সীসা, তামা, সাধারণ কাপড়ের দ্বিগুণ চওড়া উন্নত পশমি কাপড়, টিন, গোল মরিচ, টুটানেজ (ফিলাগ্রি) বিক্রি করত। দিল্লি ও আগ্রার পুরিয়াহ বণিকেরা প্রতিবছর এই বিশাল হাটে আসত, আর আবারও (হয়তো) আসবে যদি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় :- তারা উপরের পণ্যগুলো কিনত, নগদ অর্থ বা আফিম, অপরিশোধিত সোহাগা (বোরাক্স), শোরা ও ঘোড়ার বিনিময়ে। কাশ্মিরের বণিকেরা অনেক আগে থেকেই সুন্দরবনের মোলাংগেদের (মোলাঙ্গি) অগ্রিম অর্থ প্রদানে অভ্যস্ত ছিল সেখানকার নূনখোলায় কাজ করাতে। কাশ্মিরি ও আর্মেনীয় বণিকেরা বাংলা ও নেপালে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আনা-নেওয়া করত, এমনকি তিব্বত অবধি তাদের যাতায়াত ছিল। কাশ্মিরি বণিকেরা যারা তিব্বতে ব্যবসা করত, তারা বাংলায় প্রতিনিধি রাখত। বাংলা থেকে তিব্বতে বেশি যেত দ্বিগুণ চওড়া উন্নত পশমি কাপড়, আতর, চামড়া, নীল, মুক্তা, প্রবাল, তৃণমণি (অম্বর), তামাক, চিনি, মালদার ডোরা স্যাটিন কাপড়, আর নানাধরনের সাদা কাপড় আর তিব্বত থেকে বাংলায় আমদানি হত সোনার গুঁড়ো, কস্তুরী আর গরুর লেজ।
সমসাময়িক সাহিত্যে এর উল্লেখ
একইভাবে বাংলার বণিকেরাও হিন্দুস্তানের উপরাংশের (উত্তর ভারত) অনেক জায়গাসহ আসাম, কাছার, মালাবার, করোমণ্ডল উপকূল, ও গুজরাটে যেতেন। ১৭৭২ সালে জয় নারায়ণের লেখা হরিলীলা নামের বাংলা বইয়ে পাওয়া যায় :- বৈশ্য হিসেবে তার পরিবারের খরচ মেটাতে তাকে বিশ্বের অনেক জায়গায় যেতে হত, যেমন হস্তিনা (দিল্লি), কর্ণটা (আরকোট), বঙ্গ (বাংলা), কলিঙ্গ, গুর্জর (গুজরাট), বারানসী (বেনারস), মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর, পাঞ্চাল (রোহিলখণ্ড), কাম্বোজ (তিব্বত), ভোজ (শাহাবাদ), মগধ, জয়ন্তী (?), দ্রাবিড় (দক্ষিণ ভারত), নেপাল, কাঞ্চি (কঞ্জিভেরাম), অযোধ্য (আওধ), অবন্তী (মালওয়া), মথুরা, কম্পিল্যা (ফাররুখাবাদ জেলা), মায়াপুরী (হরিদ্বার), দ্বারবর্তী (দ্বারকা, কাঠিওয়াড়), চীন, মহাচীন (মঙ্গোলিয়া), কামরূপ (আসাম)। মধ্য-অষ্টাদশ শতকে লেখা চন্দ্রকান্তের থেকে জানা যায় যে বীরভূম ও মল্লভূমের (বাঁকুড়া) বণিকেরা বাণিজ্য করতে গুজরাটেও যেত।
বাংলার পণ্য যেত ভারতের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও
বাংলায় তৈরি পণ্য ভারতের দুর্গম এলাকাগুলোতেও নিয়ে যাওয়া হত, আর এত কম খরচে লবণ গঙ্গার সমস্ত শাখা দিয়ে পরিবহন করা হত যে তা পরিণত হয় হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরভাগে একটি লাভজনক বাণিজ্য পণ্যে। বাজার থেকে প্রচুর পরিমাণে (লবণ) পাঠানো হত বেনারস ও মির্জাপুরে, যেখান থেকে এটা অযোধ্যা ও আল্লাহাবাদ প্রদেশে, বুন্দেলার রাজার এলাকায় আর মালওয়ার ছোটখাটো (এলাকাগুলোর) কাছে যেত। নৌকাবোঝাই সুপারি, তামাক, লবণ, আর সূতির খণ্ড-কাপড় ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনা ধরে আসামে যেত, আর বিনিময়ে আসত রেশমি কাপড়, লাক্ষা, মুগা ধুতি (রেশমি কাপড়), হাতির দাঁত ও কাঠ। বাংলার ব্যবসায়ীরা কাছার থেকে আগর, হাতির দাঁত ও নেপাল থেকে দেবদারু জাতীয় গাছের কাঠ আনতেন। বণিকেরা লোহা, পাথরের তৈজসপত্র, চাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র বালেশ্বর থেকে কলকাতায় পাঠাতেন আর তামাক ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে যেতেন বালেশ্বরে। হলওয়েল উল্লেখ করেছেন যে বালেশ্বরের পাথরের থালা-বাটির উপর কলকাতার বাজারে শুল্ক আরোপিত হয়েছিল।
আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য পতনের কারণ
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মূলত দুটো কারণে বাংলার আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য কমতে শুরু করে।
ক) স্বাধীন প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বতন্ত্র আইন
এর একটি হল স্বাধীন প্রাদেশিক শাসকদের উত্থান যা ধীরে ধীরে দিল্লির সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বকে ম্লান করে দেয়। প্রাদেশিক শাসকেরা স্বতন্ত্র পরিবহন ও শুল্ক আইন তৈরি করতে থাকে তাদের নিজ নিজ এলাকায়, যা বণিকদের কাছে মহাসমস্যায় পরিণত হয়। যতদিন মুঘল সাম্রাজ্য সংগঠিত ও একতাবদ্ধ ছিল, বণিকেরা নিরাপদে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল করতে পারতেন, আর এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে প্রবেশের সময় চৌকিগুলোতে (শুল্ক আদায়ের ঘর) তাদের উপর বড় ধরনের অন্যায় দাবি চাপিয়ে দেওয়া হয়নি; কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে জেগে ওঠা স্বাধীন রাজ্যগুলো হিন্দুস্তানের উপরের অংশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যকে প্রায় ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়, কারণ প্রতিটি স্বাধীন শাসক তাদের নিজ নিজ এলাকার উপর দিয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি পণ্যের উপরে ভারী করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
খ) সেসময়ে ব্যবসায় নিরাপত্তাহীনতা
সেসময়ে দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে পণ্য বিকিকিনির নিরাপত্তাহীনতা বাড়তে থাকা আরেকটি কারণ। ডাও ১৭৬৮ সালে পর্যবেক্ষণ করেছেন— গঙ্গার মোহনায় যেসব বণিকেরা পণ্য কিনতে আসতেন, তারা বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। শুধুমাত্র মাশুলের কারণে এটা ধ্বংস হয়নি, দস্যুতার কারণেও অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল। আওধ (অযোধ্যা) ও আসামের সঙ্গেই কেবল বাংলার বাণিজ্য এখনও সচল রয়েছে।
গ. ইংরেজ কল-কারখানা ও বিনিয়োগ
ইউরোপীয় বাণিজ্য – বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রভাবশালী উপাদান
আমাদের আলোচ্য সময়কালে ইউরোপীয়রা বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি শক্ত ও প্রভাবশালী জায়গা নিয়ে রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে বাণিজ্যিক পণ্যের পসরা নিয়ে বাংলা ছিল ইংরেজ বণিকদের জন্য বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে লাভজনক , কদাচ নবাবের বাধা-বিপত্তির পরও। সমসাময়িক এক ফরাসি লেখকও বাংলাকে ভাবতেন কোম্পানির (ফ্রেঞ্চ) জন্য ভারত সবচেয়ে দরকারি স্থান । ডাচেরাও এখানে দেড়শো বছর ধরে ব্যবসা করে (১৭৫৬-এর আগে ১৫০ বছর) অগুনতি সম্পদ অর্জন করেছে আর বিপুল পরিমাণে পণ্যপরিবহন করেছে।
বাণিজ্যকুঠির বিস্তৃতি
বাংলা থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক আর উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে বাণিজ্যকুঠি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফ্রেঞ্চরা চান্দেরনাগোর (চন্দননগর), কাশিমবাজার, সায়দাবাদ (কাশিমবাজারের কাছে), পাটনা, বালেশ্বর, রংপুর, ঢাকা, জুগদিয়া, বীরভূম জেলার সুপুরে বাণিজ্য ও অন্যান্য সংস্থার দফতর , খিরপাই, কানিখোলা, মহানপুর ( মোহনপুর, মেদিনীপুর জেলায়), সেরামপুর (শ্রীরামপুর), চট্টগ্রাম, মালদহ ছাড়াও অন্যান্য স্থানে বাণিজ্যকুঠি প্রতিষ্ঠা করেছিল যেগুলো মূল বাণিজ্যকুঠির শাখা হিসেবে কাজ করত ।
এমনকি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও বাণিজ্যকুঠি তৈরি করা হয়েছিল। সেসময়কার বাংলা লেখক গঙ্গারাম লিখেছেন ডাচদের কুঠি মুর্শিদাবাদের কাগ্রাম আর বর্ধমানের মোগরানামার মতো প্রত্যন্ত এলাকাতেও ছিল I ইংরেজ কোম্পানিরও শাখাকুঠি আর আড়ং ছিল সুরির কাছে ইলামবাজারে, বোলপুরের কাছে সুরুলে, আর বীরভূমের সিনথিয়ার কাছে গনুতিয়া এলাকায়। আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইংরেজ কুঠি ছিল :–পাটনা, কাশিমবাজার, রংপুর, রামপুর- বোয়ালিয়া (রাজশাহী), কুমারখালি, শান্তিপুর, বুরান, সোনামুখি, রাধানগর, খিরপাই, হরিপাল, গোলাগড়, জঙ্গিপুর, সারদা, জুগদিয়া, ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, কোলিন্দা, বালেশ্বর, বলরামগড়ি, মালদহ, বরানগর, ধনিয়াখালি, বাদাল, ও হরিয়াল এলাকায়।
পাটনা ছিল ব্যবসার জন্য খুবই সুবিধেজনক স্থান ; সেখানে শোরা, সূতি ও রেশমি কাপড়, আফিম, ও অন্যান্য পণ্য পাওয়া যেত। কাশিমবাজার থেকে কোম্পানি সংগ্রহ করত কাঁচা রেশম, রেশমি কাপড়, আর দুসুতি ও গুররাহ (মোটা সূতি কাপড়ের দুই ধরন)। ঢাকা ছিল কোম্পানির সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিন বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। জুগদিয়া, কোলিন্দা ও লক্ষ্মীপুরের কুঠি থেকে সংগ্রহ করা হত বাদামি বা সাদা বাফতা (এক ধরনের সাদা সূতি), গুররাহ, দিমিতি সহ নানাধরনের কাপড়। কুমারখালি ও শান্তিপুর থেকে কোম্পানি সংগ্রহ করত সূক্ষ্ম মসলিন মলমল ও কোসা (খাসা)। মালদহ ও রামপুর-বোয়ালিয়া থেকেও কোম্পানি সূক্ষ্ম মসলিন সংগ্রহ করত। বালেশ্বর ও বলরামগড়ি থেকে কোম্পানির সংগ্রহে যোগ হত নানাধরনের কাপড় চুকলাই (চাকলা, স্মৃতি আর রেশমি কাপড়ের মিশ্রণে তৈরি), পিনিয়াস্কো, জিঙ্গাম, সান্নো (সানু, পাট বা শনের কাপড়)।
কুঠির প্রশাসন
বাণিজ্যকুঠির প্রধান ও তার অধীনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কলকাতার কাউন্সিলের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণে ছিলেন।
ক) বাণিজ্যকুঠির প্রধান ও কর্মকর্তাদের উপর কলকাতার কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণ :
২৯ জুলাই, ১৭৪৫ সালের কোম্পানির নির্দেশ থেকে জানা যায় যে কোম্পানির চাকরিতে নিযুক্ত নয় এমন যে-কোনো ভারতীয় চাকুরেদের, বাণিজ্যকুঠি থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত বানিয়ান (বেনিয়া) ও গোমস্তাদের মতো উৎপাদনকারীদের যে-কোনো কাজ যথাযথ ভাবে সম্পাদন করা উচিত, আর বণিকদের স্বাক্ষরসহ সমস্ত বণিক ও আসামীদের হিসাবের বার্ষিক ভারসাম্য ঠিক রাখা উচিত। কাউন্সিল নিয়মিত বিভিন্ন কুঠি থেকে আসা পণ্য পরিদর্শন করত আর কুঠিয়ালদের কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করা হত খারাপ মানের পণ্য পাঠালে, সেটা ফেরত পাঠানো হত কুঠিপ্রধানের কাছে, কড়া আদেশ আর ভবিষ্যতে ভালো বিনিয়োগের নির্দেশনাসহ } ঢাকার কুঠিয়ালরা ১৭৫৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কাপড় পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়, কাপড়গুলো ঠিকমতো সাজানো না-থাকার কারণে সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ১৭৫২ সালের ১২ নভেম্বরে ঢাকার কুঠি থেকে কলকাতায় পাঠানো ৮৭ ও ৮৯ গাদি কাপড়, কলকাতার কাউন্সিলের সদস্যরা ৬ সেপ্টেম্বর ও ১০ অক্টোবর পরিদর্শনের সময়ে দেখেন যে সেগুলো যেন-তেনভাবে বাছাই করা আর ভেতরের কাপড়ের সঙ্গে বাইরের অংশের কোনো মিলই নেই। বিশেষত বাফতাগুলো খারাপভাবে ভাঁজ করা ছিল আর ভেতরের ভাঁজগুলো খুবই পাতলা ছিল বাইরের অংশের থেকে আর সুতার মানও ভালো ছিল না। তাই তারা ঢাকার কুঠিয়ালদের বলেন যে ত্রুটিগুলো না সারিয়ে যেন আর কোনো কাপড় তারা সংগ্রহ না করে। তারা এটাও পর্যবেক্ষণ করেন (কাপড়ে) ফুলের নকশা অনেক মোটা সুতায় করা হয়েছিল, ফুলগুলো খুবই উদাসীনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল আর ভেতরেরগুলোর অবস্থা ছিল ভয়াবহ; আর কুঠিয়ালদের নির্দেশ দেওয়া হয় ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকতে আর ফুলের নকশার কাপড়গুলোর ত্রুটি দূর করতে বলা হয় বিশেষত যেগুলোয় মোটা সুতোর ফুল রয়েছে । একইভাবে যখন ১৭৫৩ সালে কাশিমবাজার থেকে পাঠানো পণ্য কলকাতার কাউন্সিল পর্যবেক্ষণ করে, দেখে গুজেরাত সিল্ক বা রেশমি কাপড় খুবই খারাপ মানের ছিল। তাই বিভিন্ন গাদি থেকে অল্প পরিমাণে প্রতিটি চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত করে কাশিমবাজারের কুঠির লোকদের পাঠানো হয় যেন তারা নমুনার সঙ্গে তাদের তৈরি করা কাপড়ের তুলনা করতে পারে , আর তাদের থেকে জানতে চাইতে পারে রেশমি কাপড়ের মানে এত তারতম্যের কারণ কী ।
কোম্পানির চাকুরেরা, যারা কুঠিতে কাজ করার সুযোগ পেত, তাদের জামানত দিতে হত। কোর্ট অফ ডিরেক্টরস আর কলকাতার কাউন্সিলের সম্মতিতে ১৭৪৬ সালের ৮ মার্চে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে কাশিমবাজার, পাটনা আর ঢাকার কুঠিগুলোর প্রধানেরা প্রত্যেকে ৫০ হাজার রুপি করে জামানত দেবেন, জুগদিয়া ও বালেশ্বরের কুঠিপ্রধানেরা দেবেন ৩০ হাজার রুপি করে, অধীনস্থ কুঠির কাউন্সিলের সদস্যরা দেবেন প্রত্যেকে ১৬ হাজার করে আর রাইটাররা দেবেন প্রত্যেকে আট হাজার করে।
খ) কুঠিপ্রধান ও অধীনস্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য; ভারতীয় সৈন্য, সিপাহী নিয়োগ ও কুঠিতে নারী :
কুঠির প্রধানেরা ও তাদের সহকারীরা যারা স্বল্প বেতন পেতেন, তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের অনুমতি ছিল আর সেখান থেকে লাভও করতেন। ভারতীয় সৈন্য ও সিপাহীদের নিয়োগ করা হত কুঠির প্রহরা, আড়ং থেকে পণ্য কুঠি পর্যন্ত নিয়ে আসা আর সেখান থেকে কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছানোর কাজে। এটা বেশ মজার যে ভারতীয় মহিলা শ্রমিকরাও কাজ পেতেন কুঠিগুলোয়, বিশেষত ঢাকায় সুতো দিয়ে কাপড়ে নকশা ও ফুল তোলার কাজে। কলকাতার কাউন্সিল প্রায়ই ঢাকার কুঠিতে নানাধরনের কাপড় পাঠাত ফুলের নকশা করার জন্য, যেমন হুমুম, কোসাজুরা মলমল (মেদিনীপুরের কাসিজোড়া এলাকায় তৈরি মলমল), কোসিজুরা ডোরিয়া (কাসিজোড়ায় তৈরি ডোরা নকশা করা কাপড়) ইত্যাদি। উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত নারীরা কোম্পানির কুঠিতে কাজ পেত।
বিনিয়োগের উদ্দেশ্য
প্রতিবছর বিনিয়োগের তালিকা সংগ্রহ করা হত আর সেগুলো সংগ্রহ করার জন্য সোনা বা রুপার পিণ্ড (বুলিয়ন) বা নগদ অর্থ বছরের শুরুতে কুঠিগুলোতে পাঠাত কলকাতার কাউন্সিল। কাঁচা রেশমের নমুনা ও রেশম ও সূতির মিশ্র কাপড়ের নমুনা যেগুলো কেনা প্রয়োজন, তাও পাঠানো হত একইসঙ্গে। দালালদের মাধ্যমে কুঠিগুলো পণ্য কিনত, যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হত। এই দালালেরা আবার পণ্যের আনুমানিক মূল্যের অর্ধেক বা তিন- চতুর্থাংশ দাদনি বা অগ্রিম হিসেবে নগদ অর্থ পেত কুঠির প্রতিনিধির থেকে তাঁতীদের প্রয়োজনীয় অগ্রিম হিসেবে। একসময় এধরনের অগ্রিম বণিকদের ও তাঁতীদের সরাসরি দেওয়া হত। এভাবে দালাল, বণিক ও উৎপাদনকারীদের অগ্রিম দেওয়ার মধ্য দিয়ে কোম্পানি পণ্য নেওয়ার অগ্রাধিকারের চুক্তিতে বিনিয়োগ করেছিল, আর এভাবে ভারতে তাদের পণ্য কেনা বিনিয়োগ বলে পরিচিত হয় ।
বণিকদের উপর কোম্পানির কঠোর নিয়ন্ত্ৰণ
কোম্পানি সবসময় জামানত দিয়ে দাদনি নেওয়া বণিকদের কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করত, আর প্রায়ই সতর্ক করত খারাপ মানের কাপড় সরবরাহের ক্ষেত্রে। তাদের কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করা হত কাঁচা রেশম আর রেশমি ও সূতি কাপড়ের বিপরীতে, যদি সেগুলো তারা চুক্তির সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ হত। যদি তারা দাদনির বকেয়া বা ধার্য করা জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হতেন, তাহলে তাদের জামানত থেকে সেই টাকা তুলে নেওয়া হত। চুক্তির ব্যর্থতায় দায়ী বণিকদের কখনও আবার কারারুদ্ধও করা হত। কোম্পানি সবসময় চেষ্টা করত বণিকদের সঙ্গে সমস্ত হিসেব-নিকেশ বাণিজ্যকুঠিতেই শেষ করার, আর এ- ব্যাপারে তারা এদেশের মানুষদের (বাংলার) নাক গলানো পছন্দ করত না।
দালালদের প্রভাব
কোম্পানির বাণিজ্যিক কিছু সুবিধার জন্য তাদেরই নিয়োগ করা দালালেরা প্রায়ই ঝামেলার সৃষ্টি করত। ১৭৫২ সাল নাগাদ কলকাতার দালালেরা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রগুলোয় বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের একটি নিয়মিত ইউনিয়ন গড়ে তোলে, আর কলকাতায় সভা করত আর আগেভাগেই ইংরেজদের কাছ থেকে কাপড়ের জন্য কত টাকা নেওয়া হবে তা ধার্য করত। একই বছরের অক্টোবর মাসে, ঢাকার দালালেরা নবাবের থেকে জুগদিয়ার কাপড়ের ও ঢাকার সমস্ত আড়ং নিজেদের হাতে রাখার পরোয়ানা লাভ করে। মাঝেমধ্যে দালালেরা কোম্পানির বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে দ্বিধা করত না গলাকাটা কমিশন রেখে : যেমন ১৭৫৪ সালে জুগদিয়ার দালালেরা পণ্যের জন্য ১৫ শতাংশ করে দাম রাখে আর এধরনের দস্তুরিকে প্রথা হিসেবে দাবি করে।
১৭৫৩ থেকে পণ্য কেনার পরিবর্তিত পদ্ধতি
জুন ১৭৫৩ থেকে কোম্পানি পণ্য সংগ্রহের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনে। তারা বাংলার বণিকদের সঙ্গে চুক্তি না করে আগের মতো সরাসরি আড়ং থেকে গোমস্তাদের বা প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে, আর বাংলার বণিকদের জানিয়ে দেওয়া হয় তারা আর কোম্পানির দাদনি বণিক নয়। এর পেছনের কারণ হল বণিকেরা চুক্তির শর্তমতো পুরো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হত আর তাদের দাদনির হার বেড়ে পণ্যের মূল্যের ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল
কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের পণ্য সংগ্রহের নতুন প্রথার অনুমোদন
পণ্য সংগ্রহের নতুন প্রক্রিয়ায় কোর্ট অফ ডিরেক্টরস কোম্পানির পক্ষেই তাদের মতামত দেন আর সেইসঙ্গে কলকাতার কাউন্সিলকেও ভবিষ্যতের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয় ১৭৫৫ সালের ৩১ জানুয়ারি লেখা চিঠিতে। তারা কুঠির কর্মচারীদের কাজ-কর্মের প্রতি যত্নশীল হতে বলেছিলেন, সেইসঙ্গে বিভিন্ন কুঠি ও আড়ং থেকে পণ্য কেনার জন্য তদারকি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিলেন। আর সেই অনুসারে কলকাতার কাউন্সিলের সভাপতি রজার ড্রেক, চার্লস ম্যানিংহ্যাম, রিচার্ড বেকার ও উইলিয়াম ফ্রাংকল্যান্ড – চারজনকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয় আড়ং আর বাণিজ্যকুঠিগুলোর দেখভালের জন্য। কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের ইতিবাচক মনোভাবে কলকাতার কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে ১৭৫৫ সালের ১০ মার্চ তারিখে ঘোষণা করে যে সরাসরি আড়ং থেকে ক্রয় করার রীতিটাই টিকিয়ে রাখা হবে।
নতুন পদ্ধতির সমস্যা; পুরনো পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া
কিন্তু এই প্রথাও খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না। যাদের বিশ্বাস করে কোম্পানি ক্ষমতা দিয়েছিল—গোমস্তা ও প্রতিনিধিরা তারা এই সুযোগের অপব্যবহার করেছিল; আর কেবলমাত্র কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা এক কমিটি, কোম্পানির উঁচুপর্যায়ের চাকুরেদের কল্যাণে নতুন ধরনের দমন-পীড়নের উৎসে পরিণত হয়। তাদের প্রভাব শিল্পের জন্য ধ্বংসাত্মক বলে প্রমাণিত হয়, পলাশী যুদ্ধের কয়েক বছরের ভেতরেই কলকাতার কাউন্সিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বণিকদের মাধ্যমে আগের মতোই পণ্য কিনতে শুরু করে।
বিশৃঙ্খলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পণ্য ক্রয়ে বাধা
আমাদের আলোচ্য সময়ে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য আর পণ্য ক্রয় বিভিন্ন কারণে প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ত, আর এই সমস্যাগুলো মুখ্যত সেই সময়ের বিশৃঙ্খলা থেকেই সৃষ্টি হত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবান্বিত করত। তাই, বাংলা যখন বাইরের শত্রুর আক্রমণে আর ভেতরের সমস্যায় জর্জরিত, তখন সেখানে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যের সহজ আর মসৃণ পথ আশা করতে পারত না।
ক) মারাঠা আক্রমণ : মারাঠা আক্রমণ এই প্রদেশের জন্য ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেয়, যা এখানকার লোকেদের অর্থনৈতিক জীবনকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে প্রতিটি দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল। হলওয়েল বলেছেন, যা এই প্রদেশ (বাংলা) অনুভব করেছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে; খাদ্যশস্যের অভাব ছিল পুরোদেশে, শ্রমিকের মজুরি প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য হত ভ্রান্ত বিশ্বাসের অসুবিধা ও নিপীড়নের ভেতর দিয়ে। ১১৫ক এটা কোম্পানির পণ্য কেনায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। ওর্ম লিখেছেন মারাট্রোরা (মারাঠা) যুদ্ধকালীন সময়ে মাত্র একবারই ইংরেজ বাণিজ্যে বিবেচনা করার মতো লুট করেছিল। ১৭৪৮ সালে যখন তারা কাশিমবাজার থেকে কলকাতাগামী ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজের বহর আটক করেছিল, আর কোম্পানির ৩০০ গাদি কাঁচা রেশম লুট করেছিল। তবে ইউরোপীয় বাণিজ্য অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রদেশের দুর্দশার সঙ্গেই, যা কাপড়ের দাম বাড়িয়ে তুলেছিল আর একইসঙ্গে উৎপন্ন কাপড়ের মানেরও পতন ঘটিয়েছিল।
সমসাময়িক ইংরেজ কোম্পানির রেকর্ডে মারাঠা আক্রমণে বাংলার বাণিজ্যের অবস্থা নিয়ে প্রচুর তথ্য মেলে। ১৭৪২ সালের মে মাসের মারাঠা তাণ্ডবে, মারাঠারা আসার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সমস্ত বণিকেরা আর তাঁতীরা পালিয়ে গিয়েছিল । ১৭৪৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতার কাউন্সিল কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে লেখে : এটা উদ্বেগজনক, পণ্যের সংগ্রহ এই মৌসুমে কম হয়েছে, উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, তুলার দুর্মূল্য আর মোরাট্টোদের (মারাঠা) সৃষ্ট সমস্যার কারণে কিছু পণ্য স্বাভাবিকভাবেই ভালো মানের ছিল না । পশ্চিমবাংলার প্রত্যন্ত এলাকার কথা বলাই বাহুল্য, খোদ কলকাতার কাউন্সিলও পণ্য সংগ্রহ করতে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, আর সেটা কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে ১৭৪৩ সালের চিঠিতে জানানো হয় : পরবর্তী সমস্যার (মারাঠা আক্রমণ) কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির কারণে (তারা) প্রচুর সমস্যায় ভীত ছিল কলকাতায় পণ্য সরবরাহ করতে। দ্বিতীয় মারাঠা আক্রমণেও (মার্চ থেকে মে ১৭৪৩) উপস্থিত হয়েছিল আগেরবারের সমস্ত অপ্রীতিকর ঘটনার ফলাফল নিয়ে, তাদের পথ অনেকটাই অপরিবর্তিত ছিল, শহর ছাড়া বাকি সবই পুড়ে গিয়েছিল। নবাবের বাহিনীও কম তাণ্ডব চালায়নি, ফলে গুররাহ তৈরির আড়ংগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে, আর কলকাতা, কাশিমবাজার ও পাটনায় কিছু সময়ের জন্য বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় । বণিকদের দেওয়া দাদনি র কারণে কোম্পানির প্রচুর ক্ষতি হয়; কারণ তারা এর বিনিময়ে কোনো পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, আর অর্থও ফেরত দিতে পারেনি। ১৭৪৫ সালের জুন মাসে মারাঠা তাণ্ডব নতুনভাবে তেজোদ্দীপ্তভাবে শুরু হয়, যা প্রদেশে প্রচুর দ্বিধার সৃষ্টি করে, আর বিভিন্ন আড়ংয়ে কোম্পানির বাণিজ্যে প্রচুর বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি করে। এইবারে তারা বিহারে প্রবেশ করে ফুতওয়াহে (ফাতুহা) তাণ্ডব চালায় আর ইংরেজ কোম্পানির ৪২০০ টুকরো কাপড় লুট করে ও ৭ হাজার ১৬৮ মণ শোরা বোঝাই এক গুদাম জ্বালিয়ে দেয়। তাই, সেই মৌসুমে কোম্পানি পাটনা থেকে কোনো কাপড় বা শোরা সংগ্রহ করতে পারেনি। ১৯২৪ বিহার থেকে ফেরার সময় মারাঠা- বাহিনীর মূল অংশ কাটোয়ায় শিবির স্থাপন করে, আর কয়েকটি দল বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে। এটা কোম্পানির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ গুররাহ সংগ্রহে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৭৪৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কাশিমবাজার কুঠির প্রধান কলকাতার কাউন্সিলকে লিখে পাঠান, মারাট্টোরা (মারাঠা) তখনও তাদের আশেপাশে অবস্থান করছে ফলে গাদি (কাপড়ের নিরাপদে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না । ১৭৪৬-এর এপ্রিলে যখন কলকাতার কাউন্সিল বণিকদের কাছে চুক্তিমতো গুররাহ দিতে ব্যর্থ হওয়ার কৈফিয়ত চায়, তারা জবাব দেন, দেশের ভেতরের সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল চুক্তিমতো পণ্য (গুর্রাহ) সরবরাহে, কারণ মারাট্টোরা (মারাঠা) প্রধানত দেশের গুর্রাহ উৎপাদিত হয় এমন সব এলাকায় অবস্থান করছিল । বালেশ্বরের কোম্পানির আবাসিক প্রতিনিধি (রেসিডেন্ট) কাউন্সিলকে ১৭৪৭ সালের ২৫ জানুয়ারি এক চিঠিতে লিখেছিলেন, আট হাজার অশ্বারোহী, ২০ হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে মীর হাবিবের (মারাঠাদের মিত্র) শিবির বালেশ্বর থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থান করে সেখানকার কোম্পানির বাণিজ্যকুঠির পণ্য সংগ্রহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ সমস্ত কর্মী পালিয়ে গিয়েছিল আর ধোপাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মীর হাবিবের কাজে, ফলে তাঁতীদের ঘরে প্রচুর প্রস্তুত করা কাপড় থাকলেও, তা ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা যায়নি। সেসময়ের বিভিন্ন দলিলপত্রের উল্লেখ থেকে জানা যায় যে মারাঠা আক্রমণের কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলো প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল ১৭৫১ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ নবাবের সঙ্গে মারাঠাদের সন্ধি হওয়া পর্যন্ত। আর তারপরেও এই সমস্ত আক্রমণের ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক পতন কোম্পানির বিনিয়োগকেও প্রভাবিত করেছিল।
খ) মগ আক্রমণ : পূর্ববাংলা মারাঠা আক্রমণের থেকে মুক্ত থাকলেও প্রতিবছর আরকান ও চট্টগ্রাম থেকে আসা মগদের আক্রমণ কোম্পানির পণ্য সংগ্রহে বিশাল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রতিবছর মগেরা সুন্দরবনের খালগুলো ধরে আক্রমণ চালাত আর প্রায়ই তারা বজবজ (দক্ষিণ ২৪ পরগণার পৌরসভা এলাকা) পর্যন্ত উঠে আসত তাণ্ডব চালাতে। পর্তুগিজেরা একসময়ে তাদের আক্রমণের সঙ্গী ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৭৪২ সালে ইংরেজ কুঠিতে মগ আক্রমণ হলে ১০ জন ইউরোপীয়কে কলকাতা থেকে জুগদিয়ায় পাঠানো হয়। ১৭৪৬ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা কুঠির প্রধান কলকাতার কাউন্সিলকে জানান, মগরা বেশ উৎপাত করছে সেখানে আর বাকেরগঞ্জের মধ্যকার জায়গাগুলোয় আর তারা ইংরেজদের কিছু জাহাজেও তাণ্ডব চালিয়েছে। সালের শুরুতে মগেরা ঢাকায় প্রচুর ক্ষতি করেছিল । জুগদিয়ার ফরাসি বণিকেরাও মগদের তাণ্ডবের ভয়ে ছিল ১৭৫০-৫১ সালে। ১৬ নভেম্বর ১৭৫২ সালে জুগদিয়া কুঠিপ্রধান কলকাতার কাউন্সিলকে অনুরোধ করেন, পরবর্তী মাসের শেষে একটি পানসী যেন তাদের (জুগদিয়া কুঠি) দেওয়া হয়, যেন তারা নিরাপদে কাপড় ও সিন্দুক ভর্তি ভালো গুঁড়া নিয়ে যেতে পারে- একটি বা দুটি লণ্ঠনের সঙ্গে , যেহেতু মগদের আক্রমণের সময় ঘনিয়ে আসছিল। মগদের উৎপাত ইংরেজদের এরপরেও অনেক ভুগিয়েছে, আর এতটাই ভীতির সঞ্চার করেছিল যে ১৭৬০ সালের দিকে কলকাতার কাউন্সিল হুগলি নদীর নিচে শিকল দিয়েছিল গার্ডেন রিচ এলাকায়, আধুনিক বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে।
গ) সফদর জংয়ের অগ্রযাত্রা : প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাগুলোও বিপত্তি ঘটিয়েছিল কোম্পানির পণ্যক্রয়ে। ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরে সফদর জংয়ের বিহারের দিকে এগিয়ে আসার কারণে পাটনার কুঠি থেকে প্রয়োজনমাফিক পণ্য সংগ্রহ করতে পারেনি কোম্পানি। কেবল দুটো ছিটকাপড়ের রুমাল (চিন্টেড হ্যান্ডকারচিফ) ছাড়া কোনো ছিটকাপড় (চিন্টজ) ও লাক্ষ্ণৌরি সুলভ ছিল না, আর ১৭৪৩ সালের শুরুতে কলকাতার কাউন্সিল কেবল ১২ হাজার ২১২ ব্যাগ শোরা পেয়েছিল পাটনা থেকে, যার দাম ছিল মণপ্রতি চার রুপি করে।
ঘ) আফগান বিদ্রোহ : একইভাবে ১৭৪৫ ও ১৭৪৮ সালের আফগান বিদ্রোহ আর বাংলায় চলে আসা ধারাবাহিক বিশৃঙ্খলা ইউরোপীয়দের ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছিল কোনো-না-কোনো ভাবে। কলকাতার কাউন্সিলকে ১৭৪৫ সালের ২৯ জানুয়ারিতে লেখা কাশিমবাজারের কুঠিপ্রধানের চিঠি থেকে জানা যায় নবাব ও মুস্তাফা খানের মধ্যকার বিরোধে, নির্দিষ্ট কোনো চুক্তি করা বা দাদনি দেওয়া বিচক্ষণতার পরিচয় হবে না। ১৭৪৫-এর বিদ্রোহের থেকে ১৭৪৮-এর বিদ্রোহ আরও প্রবল হলে তা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করে। বিদ্রোহের নেতা শামশির খান তিন ইউরোপীয় কোম্পানির (ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসি) কাছে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার রুপি দাবি করেন সাধারণ কর হিসেবে। আর তার সৈন্যরা ফাতুহার ডাচ-কুঠিতে আক্রমণ করে সাদা কাপড় ও অন্যান্য পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৬৫ হাজার রুপির পণ্য লুট করে।
ঙ) নবাবের অতিরিক্ত অর্থ আদায় : বাংলার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো বাধ্য হয়েছিল নবাবের সরকারকে অনুদান দিতে। সাধারণভাবে, আলীবর্দী ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে ন্যায়সংগত ও ন্যায্য আচরণ করলেও, অপরিমেয় সমস্যাগুলোর চাপের কারণে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন তাদের থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করতে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে, যারা তার প্রদেশে ব্যবসায়িক সুবিধা নিচ্ছে তাদের অবশ্যই সেখানকার সুরক্ষার খরচের ভারও বহন করা উচিত— এই যুক্তিতে।
চ) নবাবের কর্মকর্তাদের আচার-আচরণ : প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোম্পানির বাণিজ্যকুঠিগুলোর কর্মকাণ্ডে প্রায়ই নবাবের কর্মকর্তারা নাক গলাতেন। নবাব যদিও তার কাছে অভিযোগ গেলে সেটার সমাধান করার চেষ্টায় কার্পণ্য করতেন না। ছোটখাটো অভ্যন্তরীণ বিবাদ কোম্পানির ব্যবসায়ীদের জন্য অন্তরায় প্রমাণিত হয় পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে। ১৭৫১ সালের ১২ অগাস্ট যখন কলকাতার কাউন্সিল ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসা করেছিল তারা আমোররা(?) পণ্য সরবরাহ করতে পারবে কি না, তখন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিল সেখানকার রাজা মৃত্যুবরণ করেছে, তার ভাই উত্তরাধিকার নিয়ে লড়ছে আর তাদের মা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির হাতে রাজ্যের সরকার তুলে দিতে উদ্যত, (তাই) তারা সেখানে তাদের টাকা পাঠানোর চিন্তা করছে না পণ্য সংগ্রহের জন্য, আর ভয় পাচ্ছে তাদের গোমস্তারা লুণ্ঠিত হতে পারে ।
ছ) রসদের দুর্মূল্য আর পণ্যের উচ্চমূল্য : রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি অন্যকিছু কারণে রসদের মূল্য বেড়ে যায় আর তুলা, নীল ও অন্যান্য উপকরণের মূল্যও বেড়ে যায়, যা কোম্পানির বিনিয়োগকে প্রভাবিত করেছিল। কারণ তাদের বণিক, দালাল আর গোমস্তারা সংকটের এই সময়ে প্রায়ই চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হত, আর প্রায়ই চড়া দাম আর নগদ মূল্য চাইত লেনদেনে। সেসময়কার কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে এই অবস্থা আমাদের আলোচ্য সময়কালের পুরোটা জুড়েই বিদ্যমান ছিল।
জ) মুদ্রা সমস্যা : সেসময়কার তীব্র মুদ্রা সমস্যা কোম্পানির বিনিয়োগে প্রায়ই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত। বাংলায় পণ্য কিনতে, ইংরেজ কোম্পানি ইংল্যান্ড থেকে সোনা-রুপার পিও এনেছিল, যা এখানে ধাতব মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় হয়েছিল জগৎ শেঠ ও অন্যান্য শ্রফদের ব্যাংকের মাধ্যমে। ১৫১ কিন্তু এটা কাজ করত ধাতব মুদ্রার প্রাচুর্যের কারণে সৃষ্ট নির্দিষ্ট কিছু অসুবিধার ভেতর দিয়ে, যার মান কখনোই এক থাকত না আর নির্ভর করত সেগুলো ব্যবহারের সময়ের অনুপাতে চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন হারের বাট্টা বা ছাড়ের উপর। কলকাতার কাউন্সিল, কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে ১৭৪২ সালের ৮ জানুয়ারি জানায় : নতুন সিক্কাগুলো বাণিজ্যে ওঠানামা করছে না, শফরা বাট্টা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করেছে, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১০-এ সাড়ে ১৫ পুরনো সিক্কা, মাদ্রাজ রুপিতে ১০, আর ওজনের আরকোটে আট শতাংশ বাট্টা ধরার, যেন কলকাতার চলমান রুপির সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ১৭৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে কাউন্সিল আবারও লেখে : মারাট্টোরা (মারাঠা) চলে গেলেও বিক্রির মতো রুপা ছিল না, টাকশাল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি সমস্ত পিণ্ড ২৪০ সিক্কা ওজনের বিনিময়ে ২০৩ সিক্কা রুপিতে বিক্রি করে দেয় ।
ঝ) অর্থের সংকট ও কোম্পানির আর্থিক সমস্যা : মারাঠাদের একের-পর- এক আক্রমণ বাংলায় অর্থের মহাসংকট তৈরি করেছিল। জগৎ শেঠের ব্যাংক থেকে প্রচুর অর্থ লুট করা হয়েছিল; নবাবের কোষাগার লুট করে নিয়ে যাওয়ার পথেও তারা নবাবের প্রাপ্ত খাজনাও তুলে নিয়ে গিয়েছিল; গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলো আবারো অর্থ ও পণ্যের মজুদহীন হয়ে পড়ে, আর সাধারণ মানুষ তাদের জীবনরক্ষায় অর্থলোভী মারাঠা সৈন্যদের অর্থ দিতে বাধ্য হয়। নবাবকে বালাজি রাওয়ের মিত্রতা কিনতে প্রচুর অর্থ দিতে হয়েছিল, আর নিজের বাহিনীকেও সন্তুষ্ট রাখতে অর্থ আর বিভিন্ন ধরনের উপহার দিতে হয়েছিল। অর্থ-সংকট আরও চরম আকার ধারণ করে যখন শ্রফ ও পশ্চিমবঙ্গের অন্য ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদ মারাঠাদের ভয়ে মহানদী (গঙ্গা) পার করেন । কলকাতার কাউন্সিলের সভাপতি তাই মাদ্রাজ কাউন্সিলের কাছে ১৭৪৬ সালের ৫ মে লেখেন, তাদের জন্য আসা সমস্ত অর্থ যেন কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর তারা যেন তাদের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে যতটা অর্থ পাঠাতে পারে, ততটাই যেন পাঠানো হয় । এই চিঠির উত্তরে মাদ্রাজ কাউন্সিল ৩০ জুন, ১৭৪৬ তারিখে দশটি সিন্দুকে মোট ৮৬ হাজার রুপি আর একটি সিন্দুকে ৪৩২টি সোনার মোহর পাঠায় ১৭৪৬ সালের ১৩ মে, সভাপতি ও বোম্বে কাউন্সিলকেও অনুরোধ করা হয় তারা যেন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সঞ্চয় করে কিছু অর্থ কলকাতায় পাঠায়; আর সেই অনুসারে তারা কিছু সোনা ও রুপার পিণ্ড পাঠিয়ে দেয়।
এমন সময়ে, কোম্পানি প্রায়ই বাধ্য হত জগৎ শেঠ কলকাতার আনন্দীরাম ও শ্রীকৃষ্ণ প্রমুখদের মতো বাংলার ব্যাংকারদের থেকে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে অর্থ ধার নেওয়ার, যাদের মূল ব্যাংক ছিল মুর্শিদাবাদে আর শাখা ছিল গুরুত্বপূর্ণ শহরে। ১৭৪৭ সালের ২৮ অগাস্ট কলকাতার কাউন্সিল অর্থাভাবে বিব্রত কাশিমবাজার কুঠিকে পরামর্শ দেওয়া জগৎ শেঠের কাছ থেকে ঋণ করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর। ১৭৪৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শ্রীকৃষ্ণ ও আনন্দীরাম তাদের নিজস্ব গোমস্তাদের দিয়ে কাউন্সিলকে জানায় তারা সুরাট থেকে খবর পেয়েছে দুটো ৫০ হাজার রুপির হুন্ডি (বোম্বে কাউন্সিলের সভাপতি ওয়েকের মাধ্যমে) কলকাতার কাউন্সিলের জন্য তোলা হয়েছে আর তাদের সঙ্গে যে অর্থ রয়েছে সেটা তারা কাশিমবাজারের কুঠিতে জমা দেবে । কোম্পানির অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো বিবেচনা করে, কাউন্সিল কাশিমবাজারের কুঠিয়ালদের এই অর্থ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয় আর কলকাতায় ৫০ হাজার সিক্কা রুপি পাঠাতে বলে। তাদের এরপর একই বছরের ২ মে তারিখে পণ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়; কিন্তু সে- মাসেরই ২৪ তারিখে তারা জবাব দেয় কোনো ধরনের পণ্য কেনা বাস্তবসম্মত নয়, তাদের বণিকেরা অর্থ ও অগ্রিম দাবি করছে, আর গতবছরের সরবরাহ করা পণ্যের বকেয়া তিন লক্ষ রুপির জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। জুলাই মাসে বণিকেরা কোম্পানির কাছে বকেয়া নগদ অর্থে পাওয়ার জন্য গণ্ডগোল শুরু করে, আর তারা শান্ত হয় কাউন্সিলের এই আশ্বাসে যে, হাতে টাকা এলেই প্রথমে তাদের বকেয়া শোধ করা হবে। ৬ সেপ্টেম্বরে তারা কাশিমবাজারের কুঠিয়ালদের তাগাদা দিতে থাকে যেন কাউন্সিলকে বোম্বে ক্যাসেল অনুযায়ী সম্পদের ভাগ দেওয়ার ব্যাপারে কথা বলে, যা কিছুদিন আগেই কলকাতায় এসে পৌঁছেছিল। জগৎ শেঠ মাহতাবচাঁদও ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন এর ভাগ না পেয়ে, যদিও তিনি বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছিলেন ইংরেজদের বিভিন্ন কুঠিতে। কলকাতার কাউন্সিলের কাছে তার মন জুগিয়ে চলা ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না, তাই কাশিমবাজারের কুঠিয়ালদের লিখে পাঠানো হয় : আমাদের সুদিনে সবসময় তাকে সেবা দিতে পারলেই আমরা খুশি, কিন্তু বোম্বে ক্যাসেল থেকে আসা জোগান এতটাই অপ্রতুল যে আমরা নিজেদের বিনিয়োগের পর তাকে তুষ্ট করার মতো কিছু থাকবে না আর তাই বোধ করি আরও কিছুকাল প্রতীক্ষায় তিনি মনোক্ষুণ্ণ হবেন না, কারণ আমরা পরবর্তী চালানগুলো থেকে বড় জোগানের আশায় রয়েছি । পরের বছরও (১৭৪৯) কাশিমবাজারের কুঠি থেকে অর্থপ্রেরণের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে তাদের জন্য আলাদা করে রাখা পাঁচ সিন্দুকভর্তি সোনা-রুপার পিণ্ডের জন্য। কিন্তু বড় প্রহরী-বাহিনী দিয়ে এই ছোট অঙ্কের জোগান সরবরাহ করার ব্যয় হিসেব করে সেটা না পাঠিয়ে, কাউন্সিল ৬ এপ্রিলে জনৈক রামকৃষ্ণ শেঠের মাধ্যমে ২৩ হাজার ৪০০ রুপির হুণ্ডি করে পাঠায় ১৬ এপ্রিল, ১৭৪৮ কলকাতার কাউন্সিল ঢাকার কুঠিয়ালদের আট সিন্দুক সোনা-রুপার পিণ্ড পাঠায়, যা জুনের মাঝামাঝি সময়ে খরচ হয়ে যায় আর জুলাই মাসের মধ্যবর্তী সময়ে আরও অর্থের প্রয়োজনে ব্যবসা থমকে যায়। ১৬৯ ঢাকা কুঠি থেকে কলকাতার কাউন্সিলে ২৫ জুলাই চিঠিতে জানানো হয়, তাদের যদি জলদি অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থা না করা হয়, তারা অল্পকিছু পণ্য কিনতে পারবে, কিন্তু পুটুন (পাটনি) কেনা সম্ভব হবে না আর তারা ১২ শতাংশ হারে সুদের কমে ঋণও করতে পারবে না। যদি কাউন্সিল অনুমতি দেয় তবে তারা কিছু অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে দেখতে পারে। কাউন্সিল কাশিমবাজারের কুঠিয়ালদের চিঠি লিখে অনুরোধ করে তারা যেন জগৎ শেঠের টাকা দিয়ে ঢাকার কুঠিয়ালদের সাহায্য করে, আর অগাস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকার কুঠিয়ালরা কাশিমবাজারের কুঠি থেকে জগৎ শেঠের ২৫ হাজার সিক্কা রুপির নোট পায়। কিন্তু ২৩ অগাস্ট তারিখে কাউন্সিলের কাছে লেখা চিঠিতে তারা আবারও অভিযোগ করেন যে এই পরিমাণ অর্থ তাদের পণ্য ক্রয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। ১৫ নভেম্বর তারা কাউন্সিলকে তাদের অক্ষমতা জানিয়ে লেখেন : তারা বিনিয়োগ করতে অপারগ, তাদের কাছে মাসের খরচ চলার মতো অবস্থাই নেই, সম্পদ নিয়ে কোম্পানির জাহাজ না-আসায় কেউ তাদের একটা রুপি ধারও দিচ্ছে না । কিন্তু কিছুদিনের ভেতরেই তারা অল্প হলেও স্বস্তি পেয়েছিলেন কাশিমবাজারের কুঠি থেকে ৫০ হাজার রুপি পেয়ে
ঞ) কোম্পানি-চাকুরেদের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড : কোম্পানির আগ্রহের জায়গা মাঝেমধ্যে পক্ষপাতদুষ্ট হত তার চাকুরেদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে। আমরা এমন দুটো বড় ঘটনার উল্লেখ পাই কাশিমবাজার কুঠির স্যার ফ্রান্সিস রাসেল আর পাটনা কুঠির হামফ্রেস কোলের কর্মকাণ্ডে।
কাশিমবাজারে রাসেল : স্যার ফ্রান্সিস রাসেল কাশিমবাজার কুঠির দায়িত্ব বুঝে নেন ১৭৪১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিন, রিচার্ড আয়ারের থেকে আর মারা যান পাণ্ডুরোগে (জণ্ডিস) ১৭৪৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে। কাশিমবাজারে তার দায়িত্ব পালনের সময়ে, তিনি স্থানীয় বণিকদের হিসাব-নিকাশ ঠিকমতো সম্পাদন করেননি, তার মৃত্যুর পর চারজন তাদের হিসেব নিয়ে কোম্পানির কাছে ১৪ হাজার রুপির বকেয়া দাবি করেন যেগুলো দাদনি হিসেবে তাদের পাওনা ছিল, যদিও তাদের কাছে দাদনির টাকা বুঝে পাওয়ার স্বাক্ষরিত রশিদ ছিল, কিন্তু তারা সেই অর্থ স্যার ফ্রান্সিসের কাছেই জমা রাখেন একটি নোটের বিনিময়ে । ফতেহচাঁদও ২৫ হাজার রুপির দাবি জানান কাশিমবাজার কুঠিপ্রধানের কাছে ঋণ স্বীকারের দলিল বা হ্যান্ডনোট পাঠিয়ে, যা স্যার ফ্রান্সিস রাসেল ব্যক্তিগতভাবে তার থেকে ধার করেছিলেন। এর উত্তরে কুঠিপ্রধান জানান যে কলকাতার মেয়র কোর্ট ইতোমধ্যেই কজন প্রশাসক নিয়োগ করেছেন স্যার ফ্রান্সিস রাসেলের এই সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে, তার সমস্ত সম্পদ একত্রিত করার পর, পাওনাদারদের মধ্যে আনুপাতিকভাবে তা বিতরণ করা হবে। কিন্তু ফতেহচাঁদের গোমস্তারা কুঠিপ্রধানকে জানিয়ে দেন যে তাদের অধিকর্তা কোম্পানি ছাড়া কাউকে চেনেন না। আর কোনো ঝামেলা এড়াতে, কলকাতার কাউন্সিলের বেশিরভাগ সদস্য ফতেহচাদের সঙ্গে হিসাব নিষ্পত্তি করতে চান, যিনি বিনিয়োগ করা অর্থ ছাড়া আর কিছুই নেবেন না , কিন্তু তিনি সাময়িকভাবে তুষ্ট হন যখন কাশিমবাজারের কুঠির প্রধান তাকে ২৫ হাজার রুপির সুদের হ্যান্ডনোট প্রদান করেন।
পাটনায় কোল : পাটনা কুঠিতে বার্কারের পর ১৭৩২ সালে কুঠি প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন হামফ্রেস কোল, তার অপপ্রশাসনে থাকে ১৭৪৩ পর্যন্ত আর এই সময়টায় কোম্পানিকে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অমিচাঁদ ও তার ভাই দীপচাঁদ ছাড়াও পাটনার অনেক বণিকের সঙ্গে তিনি হিসাবের নিষ্পত্তি করেননি, কিন্তু যারা হিসাবের নিষ্পত্তির জন্য হট্টগোল শুরু করেছিল, তাদের সবাইকে বন্দী করে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে ১৭৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে নবাব-সরকারের হস্তক্ষেপে তারা মুক্ত হন আর কোল পাটনা ত্যাগ করলে তারা কোম্পানির কাছে তাদের পুরনো হিসেবের ন্যায়সংগত নিষ্পত্তি দাবি করেন। কলকাতার কাউন্সিল কয়েকজন অধিকর্তা নিয়োগ করেন পাটনার গোলমালের কারণ তদন্ত করতে, আর অভিযোগকারীদের দাবি সত্যি হলে তার ন্যায়সংগত ব্যবস্থা করতে। ১৭৪৬ সালের ২১ অক্টোবর তদন্তকারীরা পাটনায় পৌঁছায়, কিন্তু তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেও কোনো দলিল-দস্তাবেজ না-থাকায় আর কোল ও তার চাকুরেদের অসহযোগিতায়—সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি ক্রমাগত ক্ষতির কারণে কলকাতার কাউন্সিল ১৮৪৭-এর ২৮ অক্টোবর সিদ্ধান্ত নেয় যে পাটনার কুঠিয়ালরা যেন প্রস্তুত থাকেন পরবর্তী জানুয়ারি মাসের যে-কোনো সময়ে তাদের কুঠিগুলো তুলে নেওয়ার জন্য । পাটনার কুঠি শেষপর্যন্ত ১৮৪৮ সালের শেষের দিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়, পরে ১৭৫৭ সালে পুনরায় স্থাপিত হয়।
ট) শুল্ক-ঘরগুলোয় অতিরিক্ত অর্থ আদায় : সম্রাট শাহ শুজা (১৬৫৬) ও ফররুখশিয়ারের (১৭১৭) ফরমান থাকার পরও কোম্পানির বাণিজ্য প্রায়ই নির্ভর করত চৌকির (শুল্ক-ঘরের) দেশের উপরিভাগে ও নিম্নাঞ্চলে আরোপিত ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের উপর, আর একই ব্যাপার প্রযোজ্য ছিল পণ্য পারাপারের জলযানের ঘাটগুলোতেও। কোম্পানির মালবহনকারী বাহনগুলো নবাবের কর্মকর্তারা চৌকিতে, আবার কখনও খেয়া-পারাপারের ঘাটেও আটকে দিত, আর নির্ধারিত পরিমাণ শুল্কের চেয়ে বেশি অর্থ না দিয়ে মুক্তি পেত না, আর দস্তুরি তো ছিলই। কলকাতার কাউন্সিল নবাবের কাছে বেশ কবার অভিযোগও জানায় এই অবৈধ অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ব্যাপারে, খানিকটা সফলও হয়েছিল কাশিমবাজার কুঠির প্রধান (১৭৫২ থেকে) ওয়াটসের উদ্যোগে। তিনি সর্বোচ্চ (আলীবর্দী) ও ছোট নবাবের (সম্ভবত সহ-প্রশাসক বোঝানো হয়েছে) থেকে পরোয়ানা জোগাড় করেন, যা সুবাহগুলোকে, রাজাদের ও জমিদারদের বাধা প্রদান করে ইংরেজদের উত্ত্যক্ত বা তাদের (ইংরেজদের) দস্তকের পণ্য আটকে রেখে তাদের সর্বোচ্চ অসন্তুষ্টি সৃষ্টির কোনো উদ্দেশ্যে ।১৯১ এই পরোয়ানা—এত কঠোরভাবে লেখা হয়েছিল যে সেটা কোম্পানির কাছে বহুল আশাপ্রদ মনে হয়েছিল যে তারা ভাবতে শুরু করেছিল নিকট ভবিষ্যতেই সেই চৌকিগুলোয় অতিরিক্ত অর্থের দাবিতে আর বাধার সম্মুখীন হতে হবে না । নবাব সমস্ত রাহাদার, গুজারবুন, চৌকিদার, ইজারদার, ও গোলদের, মুর্শিদাবাদের পেচোওত্রার (পানছত্রের) অধীনে, ইংলিশ কোম্পানির গোমস্তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নাবোব (নবাব) বাংলা সুবাহদারির তাদের সমস্ত ঘাটের (ফেরি) জন্য পারওয়ানাহ (পরোয়ানা) দিয়েছেন, যা আগের নীতির বিরোধী ছিল যে রাহাদারি নতুন কোনো কর যোগ করতে পারবে না তাদের পণ্যে, ইত্যাদি। কারণ তাদের ফরমান রয়েছে দিল্লি সম্রাটের ও সুবাহর সনদ রয়েছে এধরনের আরোপের বিপরীতে তিনি ঘাটে কোম্পানির বাহনের পারাপারের দরও ঠিক করে দেন।
ঠ) ইউরোপীয় ও এশীয় বণিকদের প্রতিযোগিতা : ইংলিশ কোম্পানিকে অন্য ইউরোপীয় কোম্পানি আর এশীয় বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছিল। কেবল ডাচরাই যে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বাংলার বাণিজ্যে ইংরেজদের একমাত্র ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল—এটা সত্যি নয়। ফরাসি, পর্তুগিজ, প্রুশীয়, দিনেমারের মতো ইউরোপীয় বণিকরা ছাড়াও, আর্মেনীয়, মুঘল, পাঠানসহ তাদের মতো আরও এশীয় বণিকেরা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ব্যবসা করছিল। তারা তাদের গোমস্তাদের আড়ংগুলোয় পাঠিয়ে কাপড়ের আর অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করত, যা ইংরেজ কুঠিয়ালদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করত। এভাবে ১৭৪১ সালে পাটনায় স্থানীয় ডাচ-বণিকদের সঙ্গে ইংরেজ বণিকদের প্রতিযোগিতায় শোরার দাম উঠে গিয়েছিল ছয় এলি (হালি বা তখনকার রুপি)-তে। ১৭৪৪ সালে ঢাকার ইংরেজ কুঠিয়ালরা তাঞ্জিব (একধরনের সূতি কাপড়) আর মলমল (একধরনের উন্নত মসলিন) কিনতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন, কারণ পাঠান, মুঘল আর আর্মেনীয়রা এর মূল্য চড়াভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৭৫১ সালে কলকাতার বণিকেরা বিভিন্ন ধরনের কাপড় কেনার জন্য কোম্পানির কাছে অগ্রিম অর্থ চেয়ে বসে, কারণ ফরাসি আর ডাচ-বণিকদের বড় চালানের চুক্তির কারণে সেগুলোর মূল্য বেড়ে গিয়েছিল । ১৭৪৯ থেকে ঢাকা কুঠির দায়িত্বে থাকা নিকোলাস ক্লেরিমবল্ট ১৭৫২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কলকাতার কাউন্সিলকে লেখেন পরবর্তী সময়ে ফরাসিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিষ্পত্তির পর তিনি বাধ্য হয়েছিলেন নিকৃষ্ট ধরনের কাপড় পরিমাণের চেয়েও বেশি করে কিনতে, কোম্পানিকে পরিমাণমতো পণ্যের চালান জোগাড়ের নিরাশা থেকে রক্ষা করতে ।
ড) জমিদারদের বাধা : ইংলিশ কোম্পানির বাণিজ্য মাঝেমধ্যেই বাধাগ্রস্ত হত স্থানীয় জমিদারদের কারণে। ১৭৪১ সালে দুজন ইউরোপীয় আর কিছু লস্করসহ হেনরি ক্যাম্পিয়ন প্রিন্সেস অগাস্টা য় চেপে বেনকুলেন থেকে আসার পথে উড়িষ্যার উপকূলে নামেন রসদ আর পানির জন্য। কনিকার রাজা তখন তাদের আটক করেন ও দু হাজার রুপি, এক টুকরো লাল কাপড়, আর একটি সোনার ঘড়ি দাবি করে বসেন তাদের মুক্তিপণ হিসেবে। কোম্পানিকে দাবি মেনে রাজাকে খুশি করে, তাদের মুক্তি কিনতে হয়। ১৭৪৮ সালে কোম্পানির কিছু বণিকের পণ্য আটক করেন রাজা অনুপনয়ন (?) হুজিরুহাটি এলাকায় (?), আর পণ্যের কিছু অংশ হারিয়ে যায়। একই বছরে ফুলতার জমিদার ইংলিশ দস্তকের কিছু নৌকা আটকে রেখে কোম্পানির বণিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে। ১৭৫৫ সালে বর্ধমানের রাজা তিলকচাঁদ তার এলাকায় কোম্পানির সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন কোম্পানির কুঠিগুলোর আশেপাশে চৌকি বসিয়ে আর গোমস্তাদের গ্রেফতার করে। কলকাতার কাউন্সিল এটাকে অত্যন্ত অসম্মানজনক ও আপত্তিকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে আর সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সভাপতির উচিত নবাবকে জানানোর, আর সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে একজন চুবদার পাঠানোর, যেন রাজার অপমানজনক ও অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডের কারণে কোম্পানির বাণিজ্যে বাধাদানের অভিযোগ দেওয়ার পাশাপাশি নবাবের প্রদেশে তিনি কতটা প্রভাবহীন তা জানানো, আর তার জোর দেওয়া উচিত এক যুৎসই ভর্ৎসনা পাঠানো রাজার প্রতি আর কোম্পানির কাজে সাধারণ মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করা তার এলাকার আড়ংগুলোতে । নবাবের কাছে এই নিবেদন পৌঁছালে তিনি আশানুরূপ সাড়া দেন, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বর্ধমানের রাজাকে আদেশ করেন কোম্পানির বাণিজ্যের পথে সকল বাধা দূর করার।
কোম্পানির প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ : প্রয়োজনের সময়ে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানির তরফ থেকে কোনো অনীহা ছিল না। ১৭৪৬ সালের অগাস্ট মাসে রঙ্গশালা চৌকির স্থানীয় এক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেশ সমস্যার কারণ হচ্ছিলেন, সুপ আর নৌকা আটক করছিলেন। কলকাতার কাউন্সিল তখন একজন কর্মকর্তাকে বিশজনের বাহিনী নিয়ে চৌকি দখল করে ঐ চৌকির কর্মকর্তাকে আটক করে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। ২৮ সেপ্টেম্বর কর্মকর্তা রঙ্গশালা থেকে ফিরে কাউন্সিলকে জানান যে যদিও জমিদার (ফুলতার) তাদের দিকে গোলাগুলি শুরু করেছিল, তারপরও তার মানুষেরা সেখানে নামে ও চৌকি জ্বালিয়ে দেয় , আর জমিদার পাশের জঙ্গলে পালাতে সক্ষম হলেও সেখান থেকেই নিশ্চিত করেছেন যে তিনি আর কোনো ইংরেজ-পতাকাবাহী নৌকো আটক করবেন না। একই মাসে মীর জাফরের প্রতিনিধি দলপত রায়, হুগলি নদীতে কোম্পানির দস্তকের কিছু নৌকো আটক করেন আর কুৎদলপাড়ায় (?) নিয়ে যান তার লোকের মাঝে লুট করা পণ্য বিলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যখন কোম্পানির উকিলেরা এই ঘটনায় অভিযোগ করেন হুগলির নায়িব ফৌজদারের কাছে, তখন দলপত দাবি করেন এই ঘটনায় তার কোনো হাত নেই, আর এই মানুষগুলোর উপর তার কোনোরকম কর্তৃত্বও নেই। তখন কলকাতার কাউন্সিলের মনে হল এই নৌকোগুলো বলপ্রয়োগ করে হলেও উদ্ধার করা জরুরি, তাই তারা ক্যাপ্টেন রবার্ট হ্যামিল্টনকে একদল সৈন্য দিয়ে এই কাজে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করলেন আর দুটো নৌকো তৈরি রাখলেন ভবিষ্যতে জরুরি অবস্থার জন্য। ক্যাপ্টেন রবার্টকে হুগলি নদী পর্যন্ত গিয়ে কোম্পানির দস্তকের সব নৌকো মুক্ত করার আদেশ দেওয়া হয়, আর তা বন্ধ করতে বলা হয়েছিল যদি ভালোয় ভালোয় অন্যভাবে সম্ভব হয় আর নইলে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে নৌকোগুলোকে মুক্ত করে কলকাতার দিকে ভাটিতে নামিয়ে আনতে বলা হয়, আর তাকে সসৈন্য নুদ্দিয়ার (নদীয়া) দিকে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয় কাশিমবাজার থেকে আসা কোম্পানির কিছু নৌকোর জন্য।
বাণিজ্যে সর্বোচ্চ স্বত্ব পেতে ইংলিশ কোম্পানির উদ্যোগ : এই সময়ে ইংলিশ কোম্পানিও চেষ্টা করে যাচ্ছিল বাংলায় অন্যদের থেকে আরেকটু সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়ার। আর তাই বাণিজ্যের সর্বোচ্চ স্বত্বলাভের জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা বজায় ছিল তাদের। ১৭৫১ সালে কলকাতার কাউন্সিল সেখানে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গদের (স্থানীয় বণিক) কঠোরভাবে সতর্ক করেছিল, ফরাসিদের সঙ্গে ইউরোপীয় বাজারের উপযোগী পণ্যের সওদার বিরুদ্ধে। একই বছরে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের আদেশ নিয়ে কলকাতার কাউন্সিল আর্মেনীয়দের জানায় যে তাদের রপ্তানিপণ্যে অবশ্যই পণ্য সুরক্ষা-শুল্ক দিতে হবে সমানভাবে চুক্তিবদ্ধ চাকুরেদের সঙ্গে , আর দুর্গের তোরণগুলোয় সাঁটানো হয় গণ-বিজ্ঞপ্তি, কোম্পানির এলাকায় থাকা সকল ব্যক্তি পণ্য সুরক্ষা-শুল্ক আদায়কারীর অনুমতি ছাড়া কলকাতা থেকে পণ্য রপ্তানি করতে পারবেন না। স্বাধীন বণিকেরা আবারও চক্ষুশূল হল কোম্পানির চাকুরেদের কাছে, কারণ তারা কোম্পানির বাণিজ্যে নাক গলাচ্ছিল। ১৭৫৩ সালের জানুয়ারির শুরুতে জন উড নামের এক স্বাধীন ব্যবসায়ী কলকাতার কাউন্সিলের কাছে দস্তকের আবেদন করেন কারণ এটা ছাড়া তিনি ভিনদেশি বা নীচু কৃষ্ণ-বর্ণের স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাতারে অবনমিত হয়ে যাবেন। কিন্তু এই অনুরোধ কলকাতার কাউন্সিলের পছন্দ হয়নি। তারা এর কঠোর সমালোচনা করেন ১৭৫৩ সালের ১৫ জানুয়ারিতে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে : আমরা সম্মানের সঙ্গে আপনাকে জানাতে চাই, সাধারণভাবে এধরনের স্বাধীনতা এই স্থানের প্রচুর ক্ষতি করতে পারে, যদি একে অনুমোদন করা হয়, একজন স্বাধীন ব্যবসায়ী নিজের কোনো মূলধন ছাড়াই তাদের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসা করবে স্থানীয়দের সুসম্পর্ক আর সহযোগিতায়, সে হয়তো সবসময় স্থলপথেই বাণিজ্যযাত্রা করবে আর এই অঞ্চলের বাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে, আর চাকুরে ভদ্রলোকদের স্বার্থে আঘাত করবে ।
দস্তকের অপব্যবহার : এ সময় বাংলার বাণিজ্যের বেশ অস্বস্তিকর এক বৈশিষ্ট্য ছিল কোম্পানির দস্তকের অপব্যবহার, তাও কোম্পানির চাকুরেদের হাতেই। তারা অহরহ এটা ব্যবহার করত তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে, এমনকি তারা সেটা মাঝেসাঝে কৃষ্ণবর্ণের বণিকদের (স্থানীয় ব্যবসায়ী) কাছে বিক্রি করে দিত, যাদের পণ্য এভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেত বিনাশুল্কে। এটা বন্ধ করতে কোম্পানি ১৭৫২ সালে ঘোষণা দেওয়া দস্তকে পণ্যের আসল মালিকের নাম উল্লেখ থাকতে হবে। ইংরেজদের ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও (ডাচ ও ফরাসি) কোম্পানির চাকুরেরা পণ্য সরবরাহ করত নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে, আর এই পণ্যগুলো ইংলিশ কোম্পানির দস্তকের কল্যাণে বিনাশুল্কে পার হয়ে যেত। ১৭৫৫ সালের ৩১ জানুয়ারি কোর্ট অফ ডিরেক্টরস কলকাতা কাউন্সিলকে লেখে : দস্তকের সমস্ত অপব্যবহার রোধে আপনাদের সর্বোচ্চ যত্নশীল থাকতে হবে, কারণ সরকারের হয়তো এই বিষয়ে হস্তক্ষেপের কোনো ইচ্ছে নেই, তারপরও আমরা ভীত যদি তারা এ-ব্যাপারে কখনও জিজ্ঞাসাবাদ করে বসে। দস্তকের এই অপব্যবহার কোম্পানির কিছু ক্ষতির পাশাপাশি, নবাব সরকারের প্রভূত রাজস্ব ঘাটতির কারণ হয়েছিল করের উৎসে, আর প্রচণ্ড কষ্টের কারণ হয়েছে করপ্রদানকারী বাংলার দরিদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে। ডেভিড র্যানি এই অসংগতির এক বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে : যাদের সৌজন্যে তারা এখানে বণিক হিসেবে বেঁচে-বর্তে রয়েছে, সেই মুরদের (মুহাম্মাদান) প্রতি অবিচার, নিজেদের রক্ষা করতে তারা স্থানীয়দের তাদের চাকর হিসেবে দেখত আর বিনাশুল্কে ব্যবসা করতে, আমরা ভান করতাম যে নবাববের প্রজাদের রক্ষা করতাম যা আমাদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করত, যদিও তারা আমাদের চাকর বা ব্যবসায়ী কোনোটাই নয়, আর আমাদের দস্তক বা পাস প্রচুর স্থানীয়দের মাঝে বিলি করে তাদের বিনাশুল্কে ব্যবসার সুযোগ করে দিতাম, যা নবাবের রাজস্বে বাধা হয়ে দাঁড়াত; শুধু তাই নয়, আমরা আমাদের এলাকায় সেই ব্যবসায়ীদের নিয়ে আসা পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করতাম, আর আরো বেশকিছু ব্যাপার আরোপের পর (কোম্পানির আয় বাড়াতে), যার মধ্যে কিছু আমাদের নিজেদের জন্যই ধ্বংসাত্মক হয়ে গিয়েছিল যেমন বিয়ে, পণ্য, ভূমি সম্পদ হস্তান্তর ইত্যাদির উপর ধার্য করা শুল্ক, ইত্যাদি স্থায়ী গণ্ডগোলের সৃষ্টি করে আমাদের বিরুদ্ধে কোর্টে অভিযোগের কারণ হয়েছিল ।
সিরাজ-উদ-দৌলার প্রতিবাদ : এই অপব্যবহার সিরাজ-উদ-দৌলার নজর এড়িয়ে যায়নি, তিনি অভিযোগ করেন ব্রিটিশরা তাদের ফরমানে দেওয়া বাণিজ্য সুবিধার অপব্যবহার করছে । কিন্তু পলাশীর যুদ্ধ শীঘ্রই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল আর তারপরের বিশৃঙ্খলা এই ক্ষমতা অপব্যবহারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পলাশীর পর বাণিজ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধি : ১৭৫৭ সালের ১৫ জুলাই মীর জাফর কোম্পানিকে নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে সনদ প্রদান করেন, আর ইংরেজ বাণিজ্যে কোনো ধরনের বাধা প্রদানের বিরুদ্ধে নির্দেশ দেন। কারিগরিভাবে বললে, বাণিজ্যের ব্যাপারে মীর জাফরের কাছ থেকে কোনো নতুন সুবিধা চাওয়া হয়নি, ১৭১৭ সালের দেওয়া চুক্তির শর্তে খুশি থাকা কোম্পানিও কিছু চায়নি; কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পলাশীর বিজয় তাদের সম্মান ও প্রভাব বাড়িয়ে দিয়েছিল। জলদি এই প্রভাব টের পাওয়া গিয়েছিল যখন অনেক নতুন ব্যাপার কোম্পানির অধীনস্থ কর্মকর্তারা বা তাদের অধীনে চাকরি করা লোকেরা চর্চা করতে শুরু করে । তারা এমন কিছু পণ্যের ব্যবসা শুরু করে যা আগে তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল , আর তারা কোম্পানির আমদানি-রপ্তানি করা পণ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের পণ্যেও শুল্ক থেকে অব্যাহতি দাবি করেছিল। ওম যথাযথভাবেই বলেছেন : … কিন্তু মানুষের চরিত্রই হল ভাগ্যের বিপুল পরিবর্তনের সঙ্গে ভুলপথে ধাবিত হওয়া, অনেকেই বিপ্লবের মাধ্যমে পাওয়া নির্বিবাদ সুবিধাতেও সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি, তারা সঙ্গে সঙ্গেই তখন পর্যন্ত ইউরোপীয়দের জন্য নিষিদ্ধ লবণ ও অন্যান্য পণ্যের বাণিজ্য আরম্ভ করে; … । তাদের বেআইনি বাণিজ্যের বাড়ন্ত অবস্থা চলে ১৭৫৭ ও ১৭৭২ সালের দুইটি স্বাধীন দ্বৈতশাসনের কালে।