অধ্যায়-৬ – নক্ষত্রের মৃত্যুর ধরন

অধ্যায়-৬ – নক্ষত্রের মৃত্যুর ধরন

এই অধ্যায়ে আমরা নক্ষত্রদের জন্ম এবং বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করব। সেই সঙ্গে কিছুটা বিস্তারিতভাবে বিবেচনা করব—কীভাবে শেষপর্যন্ত এরা মৃত্যুবরণ করে। একটি নক্ষত্র তিনটি চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছায়। এই চূড়ান্ত অবস্থাগুলো হচ্ছে—শ্বেত বামন, নিউট্রন নক্ষত্র এবং ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। এই তিনটি অবস্থায় একটি নক্ষত্র মৃত বলে বিবেচিত। আমরা সুপারনোভার কিছু বিষয় নিয়েও আলোচনা করব যে বিষয়গুলো কিছু নক্ষত্রের চূড়ান্ত পর্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

নক্ষত্র সৃষ্টির সঠিক উপায় পরিষ্কারভাবে জানা নেই। পর্যবেক্ষণ বলে নক্ষত্রদের মধ্যবর্তী অঞ্চল শূন্য নয় বরং এসব অঞ্চলে রয়েছে গ্যাসীয় মেঘ, হাইড্রোজেনের আধিক্যতা এবং রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ধূলিকণা। এসব মধ্যবর্তী স্থানে বস্তু সুষমভাবে বিন্যস্ত নয় বরং সামঞ্জস্যহীন ভঙ্গিতে ছড়িয়ে আছে। অধিকাংশ স্থানে গ্যাসের ঘনত্ব খুব কম। তবে স্বাভাবিক ঘনত্ব হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ১০^-১৯ কিলোগ্রাম অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে প্রায় একশত মিলিয়ন (১০^-৮) হাইড্রোজেন পরমাণু আছে। এখন বস্তুর দুই অংশের মধ্যবর্তী আকর্ষণ বল তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। উদাহরণস্বরূপ, দূরত্ব দ্বিগুণ হলে মধ্যাকর্ষীয় বল হবে এক চতুর্থাংশ। এই বল আবার অংশদ্বয়ের ভরসমূহের সরাসরি সমানুপাতিক। যদি উভয় অংশের তরঙ্গসমূহ দ্বিগুণ হয়, তবে বল হবে চার গুণ শক্তিশালী। সুতরাং একটি গ্যাসীয় মেঘের ঘনত্ব যত বেশি হবে বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক মধ্যাকর্ষণ বলও তত বেশি।

মধ্যাকর্ষণ বলের দরুন কখনও কখনও একটি মেঘ পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘন এবং ভারী হয়। এই মধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে মেঘটি একত্রে আঁটসাঁট হয়ে যায়। ধারণা করা হয় যে, সুপারনোভা বিস্ফোরণের পাশেও এমনটি ঘটতে পারে যা পরবর্তীকালে ব্যাখ্যা করা হবে। মেঘ স্বয়ং নিজেকে একত্রে গুটাতে শুরু করে বলে ঘনত্ব বেড়ে যায়। ফলে মেঘের মধ্যে কণাসমূহের এলোমেলো ছুটাছুটি সৃষ্টি হয়। এই এলোমেলো গতি তাপ হিসেবে প্রাদুর্ভূত হয় যাতে করে গ্যাসের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। অবশেষে ক্ষীণ লাল প্রভার সঙ্গে একটি নক্ষত্র আবির্ভূত হয়। এই পর্যায়ে নক্ষত্রটি মধ্যাকর্ষীয় বলের দ্বারা জ্বলজ্বল করে অর্থাৎ মধ্যাকর্ষীয় কার্যকর শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয় বলে নক্ষত্রটি দ্যুতিমান হয়ে ওঠে। আর এই অবস্থায় নক্ষত্রটিকে বলা হয় প্রোটোস্টার বা আদি নক্ষত্র। উদাহরণস্বরূপ, কালপুরুষ (Orion) এ অবস্থিত একটি বড়ো নীহারিকা নক্ষত্র সৃষ্টির স্থান। নীহারিকাটি প্রায় ১৫০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই নীহারিকায় বহু সংখ্যক আদি নক্ষত্র রয়েছে। এই আদি নক্ষত্ররা তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালির অবলোহিত খণ্ডে অত্যধিক পরিমাণে বিকিরণ নির্গত করে। কালপুরুষ নীহারিকায় এইসব অবলোহিত বিকিরণকারীদের শনাক্তকরণ এই মতকে সমর্থন করে যে, এখানে নক্ষত্রদের জন্ম হয়। এই কালপুরুষ (Orion) নীহারিকাকে ৬.১ নম্বর চিত্রে দেখানো হল।

কেবল মহাকর্ষীয় শক্তিই যদি কোনও নক্ষত্রের একমাত্র শক্তির উৎস হয়ে থাকে তবে নক্ষত্রটি হয়ত দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হবে না। দেখানো যেতে পারে যে, এরকম একটি উৎসের দরুন সূর্য কেবল ২০ মিলিয়ন বছর বা তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এদিকে ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে পৃথিবীর বয়স গড়পড়তায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর। সুতরাং, অবশ্যই সূর্য কমপক্ষে ততদূর বয়স পেরিয়ে এসেছে। অতএব দেখানো যেতে পারে, মহাকর্ষীয় উৎস ছাড়াও সূর্যের আরও শক্তির উৎস আছে।

প্রকৃতপক্ষে, নক্ষত্রেরা তাদের অধিকাংশ শক্তি নিউক্লিয়ার দহন বা কেন্দ্রীণ সংশ্লেষণ থেকে লাভ করে। এই বিষয়টি নিম্নরূপে ব্যাখ্যা করা হল—

যখন নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কিছু মিলিয়ন ডিগ্রিতে উন্নীত হয় তখন এতে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটে। নক্ষত্রটির কেন্দ্রে বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করে। এই উচ্চতাপমাত্রায় হাইড্রোজেন পরমাণু ইলেকট্রন অবমুক্ত করে। আর অপরিহার্যরূপে মুক্ত ইলেকট্রন ও মুক্ত প্রোটন কণাদের একটি গ্যাস সৃষ্টি হয়। এরকম উচ্চ তাপমাত্রায় ইলেকট্রন ও প্রোটন কণাগুলোর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত সংঘর্ষ তৈরি হয়। নিউট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ও এন্টিনিউট্রিনোতে পরিণত হয়। অধিকাংশ নিউট্রিনোরা সৃষ্টি হওয়ার পর শীঘ্রই নক্ষত্র থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ অন্য কণাসমূহের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় এরা চরমভাবে দুর্বল। প্রোটন ও নিউট্রনের মিশ্রণ থেকে হিলিয়াম কেন্দ্রীণ তৈরি হয়। একটি হিলিয়াম কেন্দ্রীণে থাকে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন। একটি হিলিয়াম কেন্দ্রীণকে আবার আলফা কণাও বলা হয়। এক সময় যে হিলিয়াম কেন্দ্রীণটি তৈরি হয় এতে নিউট্রন কণা স্থায়ী হয়ে যায় অর্থাৎ এটি আর ক্ষয় হয় না বা ভেঙে যায় না। মূলত হিলিয়াম কেন্দ্রীণটি প্রোটন ও নিউট্রন থেকে ডিউটেরিয়াম, ট্রিটিয়াম এবং হিলিয়াম-৩ এর মধ্যবর্তী ধাপসমূহের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। সামগ্রিক প্রভাব হল এই

কালপুরুষ নীহারিকা

চিত্র-৬.১ : কালপুরুষ নীহারিকা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আণবিক মেঘ এবং নক্ষত্র জন্মের স্থান।

সামগ্রিক প্রভাব হল এই যে, চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলিত করলে একটি হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াটি এক বিরাট শক্তি বিমুক্ত করে। এবার প্রশ্ন হল এই শক্তি কোথা থেকে আসে? চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমন্বিত ভর একটি হিলিয়াম পরমাণুর ভরের থেকে কিছুটা বেশি। হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হওয়ার পর হাইড্রোজেন পরমাণুদের বাড়তি ভরটুকু শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই শক্তি তৈরি হয় তড়িৎ চুম্বকীয় রেডিও তরঙ্গরূপে, যেমন—আলো, তাপ প্রভৃতি। এই রূপান্তর সংঘটিত হয় আইনস্টাইনের E= mc^2 সূত্রানুসারে। এখানে ‘E’ হচ্ছে

Mc^2 বিমুক্ত শক্তি এবং m হচ্ছে ভর যা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এক গ্রাম ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গড়পড়তায় ১০^২১ আর্গ শক্তি উৎপন্ন করে। হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি ‘ফিউশন বিক্রিয়া’ নামে পরিচিত। আর এই ফিউশন বিক্রিয়া থেকে একটি হাইড্রোজেন বোমার ভয়ংকর শক্তি উৎপন্ন হয়। আশা করা যায় এই প্রচণ্ড শক্তি শান্তিপূর্ণ অভিপ্রায়ে ব্যবহার করা হবে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ থেকে নক্ষত্রগুলো শক্তি লাভ করে।

তাপ ও বিকিরণ প্রথমত মধ্যাকর্ষীয় শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় দ্বিতীয়ত, নক্ষত্রের মধ্যে নিউক্লিয়ার দহনের দ্বারা। আর তাপ ও বিকিরণ উৎপন্ন হওয়ার ফলে নক্ষত্রদের মধ্যে একটি বহির্মুখী চাপের সৃষ্টি হয়। এই বহির্মুখী চাপ মধ্যাকর্ষীয় টানের মোকাবিলা করে নক্ষত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে। নক্ষত্র তখন ‘metastable’ (গড়পড়তায় স্থায়ী পর্যায়) পর্যায় অর্জন করে। নক্ষত্রের এই পর্যায় স্থায়ী হয় কয়েক মিলিয়ন বছর থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর্যন্ত। নক্ষত্রদের এই পর্যায়টি নির্ভর করে তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর। এই পর্যায়কালব্যাপী একটি নক্ষত্রকে ধরা হয় এটি তার মূল পর্যায়ে রয়েছে। এই সময়কাল নক্ষত্রের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম। সচরাচর অধিকতর বড়ো নক্ষত্রে ভর যে হারে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় তা ছোটো নক্ষত্রের মধ্যে উৎপন্ন শক্তির চেয়ে অধিকতর বেশি। সূর্য তুলনামূলকভাবে কম ভরের একটি নক্ষত্র। এইমতে, সূর্য ২ আর্গ গ্রাম^-১ সেকেন্ড^-১ হারে শক্তি উৎপন্ন করে। অন্যদিকে একটি অধিকতর ভরবিশিষ্ট এবং অধিকতর উজ্জ্বল নক্ষত্র ২০০০ আর্গ গ্রাম ১ সেকেন্ড ১ হারে শক্তি উৎপন্ন করে। সুতরাং অধিকতর বড়ো নক্ষত্রের ক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার দহনের এই মূল পর্যায় কেবল কয়েক দশ বিলিয়ন বছর স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু, আমাদের সূর্যের ক্ষেত্রে এই পর্যায় কমপক্ষে ৪.৫ বিলিয়ন (পৃথিবীর বয়স অনুযায়ী) বছর অতিক্রম করে এসেছে এবং আরও অনেক বিলিয়ন বছর স্থায়ী হবে। নক্ষত্রের মধ্যে নিউক্লিয়ার দহন কেবল হাইড্রোজেনের হিলিয়ামে রূপান্তরের দরুনই চলতে থাকে না হিলিয়ামের রূপান্তরের দরুনও এমনটি হয়। অর্থাৎ হিলিয়াম ভারী পদার্থে রূপান্তরিত হয় বলেও এই নিউক্লিয়ার দহন ঘটে। কিন্তু পরবর্তী ধাপ অধিকতর উচ্চ তাপমাত্রা দাবি করে। যখন নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশে বা অন্তঃস্থলে সব হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয় তখন অন্তর্মুখী মধ্যাকর্ষণ টানের মোকাবিলা করতে কেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। তাই নক্ষত্রের অন্তঃস্থল সংকুচিত হতে শুরু করে। অন্তঃস্থল সংকুচিত হয় বলে মধ্যাকর্ষীয় শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ফলে এটি উত্তপ্ত হয়ে যায়। নক্ষত্রের তাপমাত্রা তখন বেড়ে গিয়ে এমন একটি অবস্থায় পৌঁছে যেখানে নিউক্লিয়ার দহনের পরবর্তী ধাপ এগিয়ে চলে। এই ধাপগুলোতে হিলিয়াম কার্বনে রূপান্তরিত হয় তারপর কার্বন রূপান্তরিত হয় অক্সিজেনে আর অক্সিজেন হয়ে যায় নিয়ন। এভাবে আরও অনেক রূপান্তর ঘটে। এই ক্রমের প্রতিটি পর্যায়ে হিলিয়াম কেন্দ্রীণ বা আলফা কণার যোগ-সংযোজনের দ্বারা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এই প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় হাইড্রোজেন নিঃশেষিত হওয়ার পর। প্রত্যেক প্রজাতির গঠন পূর্ণ হওয়ার পর এই ধরনের প্রক্রিয়া স্বয়ং নিজেই পুনরাবৃত্তি ঘটায়। অর্থাৎ বহির্মুখী চাপের অভাবে নক্ষত্রের অন্তঃস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ে। যেহেতু এটি সংকুচিত হয় সেহেতু এর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার পরবর্তী ধাপকে পুনরায় আরম্ভ করে। কিন্তু প্রতি ধাপের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া অন্তঃস্থলের এই সংকোচনকে সাময়িকভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর অতি উচ্চ তাপমাত্রায় অধিকতর ভারী কেন্দ্রীণ তৈরি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন দহনে দুটি কার্বন কেন্দ্রীণ বিস্ফোরিত হয়ে একটি ম্যাগনেসিয়াম কেন্দ্রীণ তৈরি হয় আর যথারীতি ফিউশন বড়ো ধরনের শক্তি বিমুক্ত করে। কিন্তু, একটি নির্দিষ্ট ভর ছাড়া কেন্দ্রীণ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না এবং শক্তি বিমুক্ত হওয়ার মাধ্যমে উচ্চতাপমাত্রায় প্রয়োজনীয়ভাবে ভারী কেন্দ্রীণ তৈরি করতে পারে না। ফলে উপরের প্রক্রিয়াটি সীমিত হয়ে যায়। এই সীমা আয়রণ গ্রুপ কেন্দ্রীণে পৌঁছায়। এই গ্রুপে রয়েছে লৌহ, কোবাল্ট এবং নিকেল। তাদের প্রত্যেকেই মোট ছাপ্পান্নটি নিউট্রন ও প্রোটনের অধিকারী হয়।

যখন এইসব বিক্রিয়া নক্ষত্রের অন্তঃস্থলে চলতে থাকে তখন এটি সংকোচিত ও উষ্ণতর হয়ে যায়। আর এই অন্তঃস্থলের বাহিরের আচ্ছাদন প্রসারিত এবং শীতল হয়ে যায় (৬.২ নম্বর চিত্রে দেখানো হল)। বাহিরের আচ্ছাদনের সঠিক কারণ সহজে ব্যাখ্যা করা যাবে না যদিও বাস্তবে সমীকরণ দ্বারা নক্ষত্রের বর্ণনা থেকে ফলাফলটি পাওয়া যায়। বাহিরের কোনও পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হবে নক্ষত্রটি আকৃতিতে বড়ো হয় এবং দেখতে অনেক বেশি লাল মনে হবে (শীতলীকরণের দৃশ্যমান প্রভাব)। আর আমরা তখন পাই তথাকথিত একটি ‘লাল দানব’। যে কোনও হারে একটি নিম্নভরের নক্ষত্রের সঙ্গে এটি ঘটে।

লাল দানবে পরিণত

চিত্র-৬.২ : একটি অল্প ভরের নক্ষত্রের কেন্দ্রস্থল সংকোচিত হয় এবং এর বাহিরের আচ্ছাদন প্রসারিত হয়ে নক্ষত্রটিকে লাল দানবে পরিণত করে।

উদাহরণস্বরূপ, সূর্য সম্ভবত অবশেষে একটি লাল দানবে পরিণত হবে এবং মার্কারি, ভেনাস বা এমনকি পৃথিবীর কক্ষপথের দিকে সম্প্রসারিত হবে। বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্রদের সঠিক বিবর্ধনমূলক প্রক্রিয়া পুঙ্খানুঙ্খরূপে আমাদের জানা নেই। যাহোক, আমরা এখানে মূলত নক্ষত্রদের চূড়ান্ত পর্যায়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত আর এই বিষয়গুলো ভালোভাবে জ্ঞাত। অধিকাংশ হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয় আর হিলিয়াম রূপান্তরিত হয় ভারী পদার্থে। ফলে শেষপর্যন্ত নক্ষত্রদের নিউক্লিয়ার জ্বালানি শেষ হয়ে যায়। মধ্যাকর্ষীয় আকর্ষণের দরুন নক্ষত্রের ভিতরের দিকে যে বল চাপ সৃষ্টি করে সেই অন্তর্মুখী চাপের মোকাবিলা করতে নক্ষত্রের মধ্যে আর পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় না। তাই নক্ষত্র সংকোচিত হতে থাকে। নক্ষত্র সংকোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বস্তুগুলো অধিকতর ঘন হতে থাকে। একটি পর্যায়ে ঘনত্ব এত বেড়ে যায় তখন নক্ষত্রের পদার্থের ইলেকট্রনগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নক্ষত্রটি হিলিয়াম কেন্দ্রীণ ও অধিকতর ভারী পদার্থের সমষ্টিতে পরিণত হয়। কেন্দ্রীণ থেকে সমস্ত ইলেকট্রন মুক্ত হয়ে যায় এবং নক্ষত্রটির সারাদেহে মুক্তভাবে ছুটাছুটি করতে থাকে। এই অবস্থায় ইলেকট্রনগুলো বহির্মুখী চাপ সৃষ্টি করে। এই বিষয়টি নিম্নরূপে বর্ণনা করা যেতে পারে।

মহাবিশ্বের সকল কণাকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—ফার্মিয়ন এবং বোসন। এই নাম দুটি যথাক্রমে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি (১৮৯৪- ১৯৭৪) এবং ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামানুসারে রাখা হয়েছিল। এই কণাগুলো খুব বেশি ঘন অবস্থায় এবং খুব নিম্ন তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করে। নিউট্রন প্রোটন এবং ইলেকট্রন কণাগুলো ফার্মিয়নের অন্তর্ভুক্ত। আর ফোটন হচ্ছে বোসন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ফার্মিয়ন কণাগুলো ফার্মি-দিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। কণাগুলোর আচরণের এই তত্ত্বটি বিজ্ঞানী ফার্মি ও দিরাক উপস্থাপন করেছিলেন। বোসন কণাগুলো বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের প্রণয়নকৃত পরিসংখ্যান মেনে চলে। ঘূর্ণন বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এই দুই ধরনের কণাগুলোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে এদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যায়। তত্ত্ব বলে যে, বোসনের স্পিন (ঘূর্ণন বৈশিষ্ট্য) পূর্ণসংখ্যক অর্থাৎ 0, ১ħ, ২ħ প্রভৃতি এবং ফার্মিয়নদের স্পিন বিজোড় অধপূর্ণ, যেমন (১/২)ħ, (৩/২)ħ প্রভৃতি। এখানে ħ (এইচ স্লাশ) হচ্ছে প্লাঙ্কের ধ্রুবক। সুতরাং, ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন কণাগুলো ফার্মিয়ন কারণ এদের স্পিন = (১/২) ħ। অন্যদিকে ফোটনের স্পিন ১ħ, তাই এটি বোসন। ফার্মিয়নদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুটি অভিন্ন ফার্মিয়ন একই অবস্থায় একইভাবে থাকতে পারে না। এই নীতি বিজ্ঞানী পাউলির নামানুসারে ‘পাউলির বর্জন নীতি’ নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন ‘অবস্থা’ বলতে ঠিক কী বুঝবেন? সাধারণত কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় এই ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কিন্তু, দুটি উদাহরণ এটির ব্যাখ্যা দিতে পারে। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুসারে পরমাণুতে ইলেকট্রন কণাগুলো কয়েকটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে। ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের দুটি দিক থাকতে পারে। পরমাণুতে একটি ইলেকট্রনের অবস্থা বলতে বোঝায় তার একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ ও ঘূর্ণন অবস্থা রয়েছে। ইলেকট্রনের এই ঘূর্ণন অবস্থা দুটি সম্ভাব্য দিকের একটি। পাউলির বর্জন নীতি অনুসারে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে একইসঙ্গে কেবল দুটি ইলেকট্রন থাকতে পারে যদি এদের ঘূর্ণন পরস্পর বিপরীতমুখী হয়। আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যদি আমরা বাক্সে বদ্ধ ইলেকট্রন গ্যাসের কথা বিবেচনা করি তাহলে বাক্সে একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেক অবস্থাকে ইলেকট্রন কণাদের মোট শক্তি, ভরবেগ এবং স্পিন দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। এই ভরবেগের ওপর শক্তির মান নির্ভরশীল। আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুসারে একটি বাক্সে বদ্ধ কতগুলো কণার শক্তি ও ভরবেগের পরিমাণ কেবল নির্দিষ্ট পৃথক পৃথক মানের হবে। যেহেতু একটি অবস্থায় কেবল একটি ইলেকট্রন থাকতে পারে, তাই অনেক ইলেকট্রন একটি ছোটো আয়তনে আবদ্ধ হলে সংকোচিত অবস্থা থেকে তাদের জায়গাকে প্রসারিত করতে বহির্মুখী চাপ সৃষ্টি করে। অতএব, এটি ইলেকট্রনের ফার্মিয়ন বৈশিষ্ট্য যা বহির্মুখী চাপ সৃষ্টি করে। এই বিষয়টি পূর্বের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই চাপকে ‘ফার্মি চাপ’ বা ‘অধঃপতিত ইলেকট্রন’ চাপ বলে।

নক্ষত্রের ওপর কেন্দ্রাভিমুখী যে মধ্যাকর্ষীয় বল সক্রিয় হয় তার পরিমাণ নির্ভর করে নক্ষত্রটির মোট ভরের ওপর। সাধারণত নক্ষত্রটি যত বড়ো হবে মধ্যাকর্ষীয় বল তত বেশি হবে। নক্ষত্রের ইলেকট্রনগুলোর বহির্মুখী ফার্মি চাপ মধ্যাকর্ষীয় বলের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে যদি ওই নক্ষত্রটির ভর ১.৪ সূর্যভর বা তারও কিছু কম হয়। ভারতীয় জ্যোতি : পদার্থবিজ্ঞানী এস চন্দ্রশেখরের নামানুসারে নক্ষত্র ভরের এই সীমা ‘চন্দ্রশেখর সীমা’ নামে পরিচিত। তিনি ১৯৩৫ সালে এই সীমা আবিষ্কার করেছিলেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। যদি নক্ষত্র-ভর ১.৪ সূর্য ভরের কম হয়, তাহলে ইলেকট্রনের ফার্মিচাপ মধ্যাকর্ষীয় বলের মোকাবিলা করে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। এই ধরনের নক্ষত্রই হচ্ছে তথাকথিত ‘শ্বেতবাসন নক্ষত্র’। এই ধরনের নক্ষত্রের ভর প্রায় সূর্য ভরের সমান তবে আয়তনের দিক দিয়ে প্রায় আমাদের পৃথিবীর সমান। উদাহরণস্বরূপ, ৪০ এরিডানি-বি নামক শ্বেতবামন নক্ষত্রটির ভর প্রায় ০.৪৪ সূর্য ভর কিন্তু এর ব্যাসার্ধ প্রায় সূর্যের ব্যাসার্ধের শতকরা ১.৫ মাত্র। এই ধরনের নক্ষত্রের বস্তুগুলো ঘন অবস্থায় আছে অর্থাৎ নক্ষত্রটির ঘনত্ব খুব বেশি। পানির ঘনত্বের তুলনায় এর ঘনত্ব প্রায় ১০ হাজার থেকে প্রায় ১০ লক্ষণ গুণ বা তারও অধিক বেশি। এই নক্ষত্র অবশেষে শীতল হয়ে যায় এবং উজ্জ্বলতা কমতে থাকে। আর উজ্জ্বলতা কমতে কমতে এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে ‘অবস্থায় নক্ষত্রকে কখনও কখনও ‘কৃষ্ণ বামন’ বলা হয়। শ্বেতবামন নক্ষত্রগুলো অনুজ্জ্বল হলেও অনেক শ্বেতবামন নক্ষত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম আবিষ্কৃত এক ধরনের শ্বেতবামন নক্ষত্র আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র লুব্ধকের সঙ্গে যুগ্ম অবস্থায় পাওয়া গেছে। এই শ্বেতবামন লুব্ধকের সহচর সঙ্গী হিসেবে পরিচিত। লুব্ধক (সিরিয়াস) ও তার সঙ্গীকে কখনও কখনও সিরিয়াস-এ এবং সিরিয়াস-বি বলা হয়।

যদি নক্ষত্রটি ভর ১.৪ সূর্য ভরের বেশি হয় তাহলে অন্তর্মুখী মধ্যাকর্ষীয় বল ইলেকট্রনের বহির্মুখী ফার্মি চাপের থেকে বেড়ে যায়। ফলে নক্ষত্রটি আবারও সংকুচিত হতে থাকে। নক্ষত্রটির পদার্থ অবশেষে এত ঘন হয় বিশেষ করে কেন্দ্রের নিকটে যে সব ইলেকট্রন যে সব ইলেকট্রন কেন্দ্রীণের প্রোটনদের সঙ্গে ভিড় জমায় তাদেরকে নিউট্রনে পরিণত করে। এমনকি সেই সঙ্গে নিউট্রিনোরও সৃষ্টি হয় কিন্তু এরা নক্ষত্রের বাহিরে চলে যায়। কেন্দ্রীণগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে নক্ষত্রের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে নিউট্রনের একটি বিরাট কেন্দ্রীণ সৃষ্টি করে। এই বিরাট কেন্দ্রীণে নিউট্রনগুলো স্থায়ী থাকে অর্থাৎ ভাঙ্গে না। নিউট্রনগুলো ফার্মিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তারা নিউট্রন ফার্মি চাপ সৃষ্টি করে ঠিক পূর্বে ইলেকট্রনগুলো যেমন ইলেকট্রন ফার্মি চাপ সৃষ্টি করেছিল। নিউট্রনগুলোর মধ্যে কেন্দ্রীণ বল থাকার দরুন এরা ফার্মি চাপ ছাড়াও আরও একটি বাড়তি চাপ প্রয়োগ করে। এই বাড়তি চাপ সম্পর্কে বর্তমানেও পুরোপুরিভাবে কিছু বলা যায় না। কারণ অতি অল্প পরিসরের কেন্দ্রীণ বলের ধরন জানা নেই। এক্ষেত্রে নিউট্রন দ্বারা যে ফার্মি চাপ তৈরি হয় সে চাপ মধ্যাকর্ষীয় বলের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে যদি নক্ষত্রটির ভর তিন সূর্য ভরের কম হয়। তিন সূর্য ভরের এই সীমা গড়পড়তায় ধরে নেওয়া হয়েছে। এই সীমাকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হলে নিউট্রনদের সমন্বয়ে গঠিত

বৃহৎ কেন্দ্রীণের বস্তুর তথাকথিত ‘অবস্থার সমীকরণ’ জানতে হবে। অতি অল্প দূরত্বে কেন্দ্রীণ বল কীরূপ সে বিষয়ে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য নিউক্লিয়ার পদার্থের এই সমীকরণ অজানা। যুক্তিসিদ্ধ সাধারণ মূলনীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে এই অবস্থার সমীকরণ সম্বন্ধে সাধারণ অনুমান তৈরি করা যেতে পারে।

যখন নক্ষত্রের ভর প্রায় তিন সূর্য ভরের কম হয় তখন আমরা পাই সেই নিউট্রন নক্ষত্রকে। এই নক্ষত্রের কেন্দ্রস্থলের বিরাট অংশজুড়ে নিউট্রন দ্বারা গঠিত একটি বিরাট কেন্দ্রীণের সৃষ্টি হয়। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ এ. হিউইস এবং তাঁর সহকর্মীগণ মহাকাশে এক ধরনের বস্তু আবিষ্কার করেছিলেন যা ‘পালসার’ নামে পরিচিত। এই বস্তুগুলো প্রতি সেকেন্ড পর পর নিয়মিতভাবে দ্রুত বিকিরণ স্পন্দন ছড়িয়ে দেয়। সাধারণত বিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, এই পালসারগুলো মূলত দ্রুত চক্রাকারে ঘূর্ণনশীল নিউট্রন নক্ষত্র। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টি. গোল্ড প্রথম এই প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে এ যাবৎ তিনশরও বেশি পালসার আবিষ্কৃত হয়েছে। পালসার আবিষ্কার আধুনিক বিজ্ঞানকে একটি উৎকৃষ্ট গবেষণাগার দান করেছে, যেখানে সব অজানা বিষয়ের গবেষণা করা যায়; যা পৃথিবীর গবেষণাগারে সম্ভব নয়। এদের স্পন্দনের পর্যায়কাল প্রায় কয়েক মিলি সেকেন্ড (১ হাজার মিলি সেকেন্ডে হয় ১ সেকেন্ড) থেকে চার সেকেন্ড পর্যন্ত। এই পর্যায়কাল বছরের পর বছর অতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। সুতরাং, এটি ধরে নেওয়া সংগতিপূর্ণ যে, নিউট্রন নক্ষত্ররা শক্তি ক্ষয় করছে। ফলে এদের ঘূর্ণন ধীর হয়ে আসছে অর্থাৎ ধীরে ধীরে এরা থেমে যাচ্ছে। নিউট্রন নক্ষত্রের পদার্থ অত্যন্ত ঘন যা প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১০^১৩ থেকে ১০^১৫ গ্রাম। পরমাণুর কেন্দ্রীণের ঘনত্ব হয় এই ধরনের। নিউটন নক্ষত্রের পদার্থ থেকে ছোটো এক চামচ পরিমাণ ওজন করলে তা পৃথিবীতে প্রায় কয়েক মিলিয়ন বা এক কোটি টন। একটি নিউট্রন নক্ষত্রের ভর সূর্য ভর তুল্য কিন্তু এর ব্যাসার্ধ মাত্র প্রায় ১০ কিলোমিটার থেকে ২০ কিলোমিটার।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে, বিজ্ঞানী চ্যাডউইক ১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কার করেছিলেন (৬.৪ নম্বর চিত্র দেখুন)। কথিত আছে যে, চ্যাডউইকের এই আবিষ্কারের খবর যেদিন কোপেনহেগেনে পৌঁছায় সেদিন সোভিয়েত পদার্থবিজ্ঞানী লেভ ডেভিডোভিচ ল্যান্ডাউ (১৯০৮-১৯৬৮) নিউট্রন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক নানা বিষয় নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এও কথিত আছে যে, মূলত নিউট্রন দ্বারা সৃষ্ট শীতল ও ঘন নক্ষত্রের অস্তিত্ব থাকতে পারে এ ধারণা প্রথম প্রকাশ করেছিলেন ল্যান্ডাউ।

টেলিস্কোপের দুটি এন্টেনা

চিত্র-৬.৩ : ক্যামব্রিজ শহরে মোলার্ড রেডিও এস্ট্রোনমি অবজারভেটরি’-তে এক মাইল টেলিস্কোপের দুটি এন্টেনা। এই টেলিস্কোপ ব্যবহার করে পালসারদের সঠিক অবস্থান জানা গিয়েছিল। অন্য একটি টেলিস্কোপ দিয়ে পালসার আবিষ্কার করা হয়েছিল যে টেলিস্কোপ দিয়ে পালসারদের সঠিক অবস্থানও জানা গিয়েছিল।

সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে ডব্লিউ বা’ডে এবং এফ জুইকি ১৯৩৪ সালে নিউট্রন নামের ধারণাটি প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁরা এও উপস্থাপন করেছিলেন যে, সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে এসব নক্ষত্রের সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৩৪ সালেই জুইকি প্রস্তাব করেন—সুপারনোভা বিস্ফোরণের বিশাল শক্তি ছোট্ট নিউট্রন নক্ষত্রের সৃষ্টি থেকে উৎপন্ন হতে পারে। কর্কট (Crab) রাশিতে নিউট্রন নক্ষত্র রয়েছে এই প্রস্তাবনার দাবিদারও জুইকি।

ক্যামব্রিজের ফ্রি স্কুল লেন

চিত্র-৬.৪ : ক্যামব্রিজের ফ্রি স্কুল লেন-এ অবস্থিত ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরি যেখানে চ্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করেছিলেন।

একটি নিউট্রন নক্ষত্রের ভর ১.৪ সূর্য ভরের কম হতে পারে, যদিও এই ভরে শ্বেত বামনকে পাওয়া সম্ভব। মাঝে মাঝে নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশ একটি আকস্মিক অন্তর্মুখী চাপ অনুভব করে অথবা নক্ষত্রের বাহিরের স্তরে বিস্ফোরণ সংঘটিত হওয়ার ফলে একটি ‘কেন্দ্রীভূতীকরণ’ সৃষ্টি হয় (৬.৬ নম্বর চিত্র দ্রষ্টব্য)। এই অন্তর্মুখী চাপের কারণে ইলেকট্রন ফার্মিচাপ মধ্যাকর্ষীয় বল সামলাতে পারে না। ফলে ইলেকট্রনগুলো প্রোটনদের সঙ্গে মিশে নিউট্রনে পরিণত হয়। আর এভাবেই নক্ষত্রের কেন্দ্রটি নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হয়ে যায় এবং বাহিরের অংশ আশেপাশের শূন্যে ছড়িয়ে পড়ে। ভেতরের অংশের ভর ১.৪ সূর্য ভরের কম হয়ে গেলে আমরা ১.৪ সূর্য ভরের চেয়ে কম ভরের একটি নিউট্রন নক্ষত্রকে পাই। মূলত একটি নিউট্রন নক্ষত্রের ভর ০.২ সূর্য ভরের সমানও হতে পারে। নক্ষত্রের ভর তিন সূর্য ভরের বেশি হলে শেষপর্যন্ত এটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। এই ব্ল্যাকহোল নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। এখানে উল্লিখিত বিস্ফোরণের বিষয়টি পূর্বোল্লিখিত তথাকথিত সুপারনোভাতে দেখা যায়। এই সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে একটি নক্ষত্র হঠাৎ করে পূর্বের থেকে সহস্র কোটি গুণ উজ্জ্বল হয়ে যায়। চীনের জ্যোতির্বিদগণ ১০৫৪ সালে এই ধরনের একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ দেখেছিলেন।

ক্র্যাব নেবুলা

চিত্র-৬.৫: একটি ক্র্যাব নেবুলা বা কর্কট নীহারিকা। এটি একটি সুপারনোভা বিস্ফুরণের অবশিষ্টাংশ।

এই বিস্ফোরণের অবশিষ্টাংশ এখনও কর্কট রাশির মেঘের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। মেঘটিতে একটি পালসারও পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার এটাই বলে যে, সুপারনোভা বিস্ফোরণে নিউট্রন নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু নিউট্রন নক্ষত্রের জন্ম সব সময়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় অর্থাৎ প্রত্যেক নিউট্রন নক্ষত্রের জন্ম সুপারনোভা থেকে হয় এমন নয়। আমাদের গ্যালাক্সিতেও সুপারনোভা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, টাইক’স নোভা, কেপলার নক্ষত্র ইটাকারিনী। এরা যথাক্রমে ১৫৭২, ১৬০৪ এবং ১৮৪৩ সালে শনাক্ত হয়েছিল। অন্যান্য গ্যালাক্সিতেও সুপারনোভা দেখা গেছে। এই শতাব্দীর উজ্জ্বলতম সুপারনোভা হচ্ছে ১৯৩৭ সালে আবিষ্কৃত সুপারনোভা। এই সুপারনোভাটি ‘আই.সি-১৪৮২ স্প্যাইরাল’ গ্যালাক্সিতে অবস্থিত। এই সুপারনোভাটি গ্যালাক্সির কোটি কোটি সমস্ত নক্ষত্রের চেয়ে শতগুণ উজ্জ্বল।

কৃষ্ণগহ্বর

চিত্র-৬.৬: একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণে নক্ষত্রের বাহিরের মোড়ক বাইরের দিকে বিদীর্ণ হয়ে যায় আর ভেতরের অংশ অর্থাৎ কেন্দ্র আরও সংকোচিত হয়ে যায়। এই সংকোচিত অবশিষ্টাংশ হতে পারে একটি নিউট্রন নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোল (কৃষ্ণগহ্বর)।

সুপারনোভা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে; এখানে আমি সুপারনোভাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাবলির একটি সম্ভাব্য ক্রম তুলে ধরেছি অর্থাৎ এক ধরনের সুপারনোভার বর্ণনা দিয়েছি। সুপারনোভা উদ্ভবের সঠিক কারণগুলো এখনও পরিষ্কার নয়। নক্ষত্রদের মধ্যে গতিশীল তাপের সঙ্গে পারমাণবিক কেন্দ্রীণের বিক্রিয়াগুলো এই বিস্ফোরণের জন্য আংশিক দায়ী। নিউট্রন নক্ষত্র সৃষ্টির সময় অভিঘাত তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এই অভিঘাত তরঙ্গ দ্বারাও আসল বিস্ফোরণটি ঘটতে পারে। কোনও তরঙ্গে মাধ্যমের বৈশিষ্ট্যের (যেমন-চাপ ও ঘনত্ব) আকস্মিক তীক্ষ্ণ পরিবর্তনই হচ্ছে অভিঘাত তরঙ্গ (Shock wave)। প্রায়শ মাধ্যমের পদার্থের গতি শব্দের গতির থেকে বেশি হলে অভিঘাত তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। নিউট্রন নক্ষত্র সৃষ্টি হওয়ার সময় অসংখ্য নিউট্রিনো কেন্দ্রস্থল ত্যাগ করে বাহিরে এসেছিল। নিউট্রিনোদের বাহির হওয়ার সময়ও একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, একটি ইলেকট্রন ও একটি প্রোটন মিলিত হয়ে একটি নিউট্রন তৈরি করার সময় এই প্রক্রিয়া থেকে তখন একটি নিউট্রিনোরও জন্ম হয়। নিউট্রিনোদের প্রবাহ অথবা অভিঘাত তরঙ্গ নক্ষত্রটির বাহিরের মোড়কে উচ্চ তাপমাত্রার সৃষ্টি করে। সবচাইতে বাহিরের স্তরটি সম্ভবত হাইড্রোজেনের যাতে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটার জন্য তাপমাত্রা কখনই সাধারণত এত উচ্চ হয় না। পরবর্তী স্তর সম্ভবত হিলিয়াম এবং ভারী পদার্থের কেন্দ্রীণ দিয়ে গঠিত। এসব মাধ্যমের ওপর অভিঘাত তরঙ্গ আপতিত হলে উচ্চ তাপমাত্রার সৃষ্টি হয় এবং নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটে। এই প্রক্রিয়াকে ‘বিস্ফোরক কেন্দ্রীণ সংশ্লেষণ’ বলে। কিন্তু এই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এখনও জানা যায়নি। এ নিয়ে বিজ্ঞানীগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কিছু ইঙ্গিত রয়েছে যে, সুপারনোভা বিস্ফোরণে নক্ষত্রের ভিতর থেকে অভিঘাত তরঙ্গ মহাকাশের চারপাশের গ্যাসের ওপর ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন নক্ষত্র সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। স্মরণ করা যাক, মহাজাগতিক বস্তুর ঘনত্ব কম হলে মহাকর্ষীয় শক্তিতে আদিনক্ষত্র বা প্রোটোস্টারের জন্ম হয় না। বস্তুর ঘনত্ব বেশি হলেই আদি নক্ষত্রের সৃষ্টি হতে পারে। অভিঘাত তরঙ্গ সুপারনোভা থেকে চারপাশের মাধ্যম দিয়ে যাওয়ার সময় কোনও কোনও অঞ্চলের বস্তুর ঘনত্ব পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়ে যায়। আর এই ঘনত্ব নতুন নক্ষত্র সৃষ্টির উপযুক্ত হয়ে ওঠে। কিছু ইঙ্গিত রয়েছে যে, এভাবে কিছু নতুন নক্ষত্রের জন্ম হতে পারে।

আমরা এই ব্যাপারে জ্ঞাত আছি যে, একটি নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণ তখনই হবে যখন নক্ষত্রটির ভর সূর্য ভরের ৬ গুণ হবে। তাই আমাদের সূর্য সুপারনোভা হওয়ার অনুপযোগী। সূর্য প্রথমে লাল দানবে পরিণত হবে। তারপর সম্ভবত শ্বেত বামন রূপ নেবে।

নক্ষত্রের কেন্দ্রের ভর প্রায় ৩ সূর্য ভরের বেশি হলে নিউট্রন ফার্সি চাপ ও নিউক্লিয়ার মিথস্ক্রিয়ার বলসমূহ মধ্যাকর্ষণ বলকে সামলাতে পারে না। আর এই ক্ষেত্রেই আমরা পাই একটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

একটি নক্ষত্রের ভর সূর্য ভরের তুলনায় খুব কম না হলে সেই নক্ষত্রটি শ্বেত বাসন, নিউট্রন নক্ষত্র এবং ব্ল্যাকহোল (কৃষ্ণগহ্বর) এই তিনটি চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছতে পারে। আমাদের পৃথিবী বা এক খণ্ড পাথরের অল্প ভরের ক্ষেত্রে মধ্যাকর্ষীয় বলকে বস্তুর সাধারণ চাপ সামলে রাখতে পারে। ফলে পদার্থের সংকোচন প্রতিরোধ হয়। মূলত এক টুকরা পাথর বা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বস্তুগুলোর গঠনে মধ্যাকর্ষীয় বলের তেমন কোনও ভূমিকা নেই। এই গঠন নির্ধারিত হয় মূলত পরমাণুগুলোর মধ্যে তড়িৎবল দ্বারা। যদিও পৃথিবী এবং চাঁদের গঠনে মধ্যাকর্ষীয় বলের ভূমিকা রয়েছে (যেমন—এ বলের জন্যই পৃথিবী ও চাঁদ প্রায় গোলাকার), তবে অন্তর্মুখী মধ্যাকর্ষীয় বলকে পদার্থের বহির্মুখী চাপ সামলে রাখতে পারে। তাই এরা যতই না শীতল হোক এদের আকার, আকৃতি বা আয়তনের যৎ সামান্য পরিবর্তনই ঘটে। কোনও নক্ষত্রের ভর বৃহস্পতির ভরের সমান হলে তার আকার ও আয়তন পরিবর্তনে মধ্যাকর্ষীয় বল সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে (চিত্র-৬.৭)। বৃহস্পতির ভর পৃথিবীর ভরের সহস্র গুণ বেশি।

নক্ষত্র কতটুকু সংকোচিত হবে

চিত্র-৬.৭ : মহাকর্ষীয় বলের দরুন একটি নক্ষত্র কতটুকু সংকোচিত হবে তা নির্ভর করে নক্ষত্রের প্রাথমিক ভরের ওপর। এক সৌর ভরের নক্ষত্র কী কী চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে এখানে তা দেখানো হল। সূর্যের বর্তমান ব্যাসার্ধ ৭০০০০০ কিলোমিটার প্রায়। এখন থেকে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছর শেষে সূর্য লাল দানবে পরিণত হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম জ্বালানি শেষ করে শ্বেত বামনে পরিণত হবে। কিন্তু অধিকতর ভারী নক্ষত্র আরও শতগুণ সংকোচিত হয়ে নিউট্রন নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *