অধ্যায়-৬ দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মূসা (আ:) এর জন্ম
ইসরাইল (আ:) বলতে যাকে বোঝানো হয় তিনি হলেন নবী হযরত ইয়াকুব (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ) এর পিতা। হযরত ইউসুফ (আ:) এর উচ্চপদে আসীন হবার সুবাদে তিনি সপরিবারে তাঁর পিতাকে মিসরে বসবাসের সুযোগ করে দেন। সেই জায়গার নাম ছিল গোশেন। কীভাবে মিসররাজের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়া শুরু করল বনী ইসরাইল? আর মূসা (আ:) এর জন্মের ঘটনার সূত্রপাত এ কাহিনীর কোন পর্যায়ে?
হযরত ইয়াকুব (আ:) যখন মিসরে গিয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল একশ ত্রিশ বছর, ইহুদী হিসেব তা-ই বলে। তিনি মিসরে জীবিত ছিলেন সতেরো বছর। সেক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হবার কথা একশ সাতচল্লিশ বছর। কিন্তু ইহুদী সূত্রে তাঁর মৃত্যুকালীন বয়স একশ চল্লিশ উল্লেখ করা হয়, যা ভুল বলে উল্লেখ করেন ইবনে কাসির (র) তাঁর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে।
ইউসুফ (আ) চিকিৎসকদের বললেন, তাঁর বাবার মরদেহ দাফনের জন্য প্রস্তুত করতে। ইবনে কাসির (র) বর্ণনা করেন, চিকিৎসকেরা চল্লিশ দিন সময় নেন কাজটি করতে। আর, সত্তর দিন পর্যন্ত শোক পালন করা হয় মিসরে।
শোকের দিনগুলো শেষ হবার পর ইউসুফ (আ) মিশররাজের কাছে মিনতি করেন, “আমার বাবাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, যখন তিনি মারা যাবেন তখন তাঁর মরদেহ যেন কানান দেশে তাঁরই খনন করা কবরে দাফন করা হয়। তাই আমাকে সেখানে যেতে দিন। এরপর আমি ফিরে আসব।”
রাজা বললেন, “যাও, তোমার বাবাকে দাফন করে আসো। তোমার দেয়া কথা রাখো।”
ইউসুফ (আ) এর সাথে রাজার গুরুত্বপূর্ণ সভাসদরাও কানান দেশে গেলেন, আর সাথে ইউসুফ (আ) এর ভাইয়েরা তো ছিলই সপরিবারে।
জর্ডান নদীর কাছে আতাদ নামের এক জায়গায় তারা থামলেন, সেখানে শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হত। অতিরিক্ত সাত দিন শোক পালন করার পর ইসরাইল (আ)-কে দাফন করা হলো। যেখানে দাফন করা হলো সেটি ছিল ব্রেনের একটি গুহা। ইফ্রন ইবনে সাখার নামের এক হিট্টিট লোকের কাছ থেকে নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) নিজেই সেটা কিনেছিলেন নিজ স্ত্রীর দাফনের জন্য।
মিসরে ফিরে আসবার পর ইউসুফ (আ) এর ভাইয়েরা ভাবছিলো, বাবা নেই দেখে এখন বুঝি তাদের শাস্তি দেবেন তিনি। কিন্তু ইউসুফ (আ) তাদের অভয় দেন। তাদের ভরণপোষণের কোনোই সমস্যা যে হবে না সেই বিষয়েও তিনি আশ্বাস দিলেন।
ইউসুফ (আ) বেঁচে ছিলেন ১১০ বছর, নিজের নাতিদেরও দেখে যান তিনি। মারা যাবার আগে তিনি ভাইদের ডেকে বলেন, “আমি মারা যাচ্ছি। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের সাহায্য করবেন। তিনি এ দেশ থেকে তোমাদের বের করে নিয়ে যাবেন সেই ভূমিতে যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুব (আ)-কে। কথা দাও, এখানে থেকে চলে যাবার সময়, আমার লাশ নিয়ে যাবে এবং আমার বাপ-দাদার কবরের পাশে দাফন করবে।”
ফলে মৃত্যুর পর হযরত ইউসুফ (আ) এর লাশ সুগন্ধি দিয়ে আবৃত করে একটি সিন্দুক বা কফিনে রাখা হয়। বহুদিন পর যখন মূসা (আ) বনী ইসরাইলকে মিসর থেকে বের করে নিয়ে যান, তখন সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ইউসুফ (আ) এর লাশবাহী সেই সিন্দুক। সে কাহিনী আসবে আরো পরে, যথাস্থানে।
কেউ কেউ মনে করেন, ইউসুফ (আ) এর হাত ধরেই একেশ্বরবাদ আসে মিসরে, তবে সেটি বড় মাত্রায় ছড়ায়নি। ইসরাইলিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে আদোনাই বা এলোহিম বলে ডাকত সবসময়ই অর্থাৎ কানান থেকেই, মিসরে তাঁর উপাসনা ইউসুফ (আ) প্রচলন করেন। এমনটা হওয়া অসম্ভব নয় যে, যে আতেনিজম (Atenism) ধর্মবিশ্বাসের দেখা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের মিসরে মেলে, সেটি উজির ইউসুফ (আ) এর সূচিত বা অনুপ্রাণিত।
ফারাও চতুর্থ আমেনহোতেপ (যিনি নিজের নাম ধারণ করেন আখেনাতেন= আখেন+আতেন) এর প্রবর্তন করেন বলে জানা যায় ইতিহাসে। অন্য সকল দেব- দেবী বাদ দিয়ে সূর্যদেবতা রা এর আরেক রূপ আতেনের একক উপাসনা চালু করেন তিনি। তিনি ছিলেন আদি ও সর্বোচ্চ দেবতা মিসরীয় ধর্মে। ২০ বছর পর্যন্ত একেশ্বরবাদী ধর্ম আতেনিজম ছিল মিসরের রাজধর্ম। আখেনাতেন তাঁর শাসনের পঞ্চম বর্ষে এ ধর্ম চালু করেন। প্রথমদিকে অবশ্য অন্য দেব-দেবীর উপাসনার অনুমতি দিতেন। তিনি তাঁর নতুন রাজধানী করেন আজকের আমার্না নামের জায়গায়, নাম দেন তিনি আখেতাতেন, যার মানে ‘আতেনের দিগন্ত’।
নবম বছরে গিয়ে তিনি আতেনকে একমাত্র দেবতা হিসেবে ঘোষণা করেন, যিনি হলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, আর তিনি নিজে হবেন ঈশ্বরের সাথে মর্ত্যের সংযোগ। তিনি মূর্তি নিষিদ্ধ করেন, কারণ অদেখা ঈশ্বর আতেনের কোনো জানা মূর্তি হতে পারে না। আতেনকে বোঝাতে সূর্যের আকৃতির একটি ডিস্ক ব্যবহার করা হতো। তাঁর সময় আতেনের জন্য যে শ্লোক (Great Hymn to the Aten) পাঠ করা হতো সেটি ছিল: “হে একক ঈশ্বর যিনি ছাড়া আর কেউ নেই (০ Sole God beside whom there is none) i’
তবে এরপর তিনি নিজেকে আতেনের পুত্র বলে ঘোষণা করেন এবং সকলকে অনুপ্রাণিত করেন তাঁর উপাসনা করতে, আদেশ বলা যায় না ঠিক। আতেনের উপাসনা করার অধিকার ছিল কেবল দুজনের। একজন ফারাও আখেনাতেন নিজে। আর অপরজন ইতিহাসবিখ্যাত নারী, আখেনাতেনের স্ত্রী- রানী নেফারতিতি (Nefertiti )।
এরপরের শাসকেরা এসে আগের বহু দেবতার ধর্মে ফেরত যান, এবং আতেনিজম সংক্রান্ত ফারাওদের রেকর্ড মুছে ফেলেন।
আতেনের প্রতি বছর পাসওভারের সময় বিশ্বব্যাপী ইহুদীরা স্মরণ করে থাকে মূসা (আ) এর নেতৃত্বে বনী ইসরাইলের মিসর থেকে পরিত্রাণের ঘটনা। কিন্তু, ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্ববিদ্যায় বনী ইসরাইলের আদৌ মিসরে থাকার প্রমাণ নেই, লোহিত সাগর দু’ভাগ করে পেরিয়ে যাবার ঘটনা তো পরের কথা। তাই বনী ইসরাইলের মিসর পর্যায়ের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা কেবল ইসলামি আর ইহুদী সূত্র (যা একইসাথে খ্রিস্টধর্মেরও সূত্র) থেকেই উদ্ধৃতি দিতে হবে।
নীলনদের বাৎসরিক বন্যায় বেশ ভালো ফসল হতো মিসরে। তাই দুর্ভিক্ষের সময় আসলেই নানা দেশ থেকে মানুষ মিসরে এসেছিল, সেটা আমরা জানতে পারি ইতিহাস থেকেই। এবং এদের মাঝে কেউ কেউ যে সেমিটিক ছিলেন তা-ও সত্য। বিশেষ করে কানান দেশ থেকেই তারা আগত। তাছাড়া নানা উপায়েই কানানদেশিরা স্থান করে নেয় মিসরে। যেমন- একটি প্যাপিরাসে আমরা পাই এক মিসরীয় ধনাঢ্য ব্যক্তির কথা, যার ৭৭ জন দাসের মাঝে ৪৮ জন ছিল সেমিটিক বা শামদেশীয়।
তাওরাতে হিব্রু দাসদের ঠিক যেভাবে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হবার কাহিনী আছে, মিসরীয় প্যাপিরাস বলৌনা ১০৯৪-তে ঠিক সেরকম নির্যাতনের কাহিনী আছে, যেখানে দুই পলাতক দাস ধরা পড়বার পর নির্যাতন করা হয়েছিল। তাওরাতের বিবরণের সাথে সেই ঐতিহাসিক বিবরণের মিল পাওয়া যায়।
৩,২০০ বছর আগের প্যাপিরাস ষষ্ঠ আনাস্তাসিতে দেখা যায়, মিসরীয় কর্তৃপক্ষ কীভাবে এদোম (Edom) থেকে আসা একদল যাযাবর সেমিটিককে পিথমের হ্রদে গবাদিপশু নিয়ে যেতে দেয়। সেই সেমেটিকেরা নাকি ইয়াহওয়ের উপাসনা করত। ইয়াহওয়ে হলো ইহুদী ধর্মে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নাম।
এরপর ৩,২২৬ বছর আগের (খ্রিস্টপূর্ব ১২১০ সাল) মারনেপ্তাহ ফলকে লেখা দেখা যায়, “ইসরায়েল ধ্বংস হলো, তাদের বীজ আর নেই।“
যা-ই হোক, এর বেশি প্রমাণাদি আসলে নেই।
ইসরাইল নামটা ইয়াকুব (আ) এর জীবদ্দশায় কিংবা তাঁর মারা যাবার অব্যবহিত পরে খুব প্রচলিত হয়ে যায় কি না সেই বিষয়ে নিশ্চয়তা না থাকলেও, মিসরে যে তখনও এ নাম বিখ্যাত হয়নি সেটা নিশ্চিত। তখন মিসরে বনী ইসরাইলদের ডাকা হত হিব্রু জাতি বলে। আসলে সেমিটিক ভাষায় কথা বলা মিসরে আসা যে কাউকেই হিব্রু ডাকা হত। হিব্রু বা ইব্ৰী (২7২y)। এর আক্ষরিক অর্থ ‘পার হয়ে আসা’। তাওরাতে ইব্রাহিম (আ)-কে প্রথম হিব্রু বলে ডাকা হয়, কারণ তিনি ফোরাত নদী পার হয়ে এসেছিলেন’। তারপর কোনোভাবে ইসরাইলিরা এ নামে পরিচিত হয়ে যায়। তবে হিব্রু ডাকার কারণ হিসেবে আরো অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। উল্লেখ্য, তাদের ভাষাকেই হিব্রু ভাষা বলা হয়, আরবিতে যাকে ইব্রানি ভাষা বলে ডাকা হয়।
‘ফারাও’ শব্দে আসা যাক। প্রাচীন মিসরের ফার্স্ট ডাইনেস্টি (অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩১৫০ সাল) থেকে রোমানরা ৩০ সালে মিসর অধিকার করে নেয়া পর্যন্ত যত সম্রাট ছিলেন সবাইকে এখন ফারাও উপাধি দেয়া হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার, আজকে যা-ই বলা হোক না কেন। মোটামুটি ১২০০ খ্রিস্টপূর্ব সাল থেকে আসলে ফারাও উপাধি দিয়ে ডাকা শুরু হয় মিসরের রাজাদের। অদ্ভুত হলেও সত্য, ফারাও বলতে কিন্তু আক্ষরিকভাবে মানুষটাকে বোঝায় না, বোঝায় মানুষটি যেখানে থাকেন।
অর্থাৎ, মূল শব্দ ‘pr-৩’ (প্রাচীন মিসরীয় যে শব্দের উচ্চারণ আসলে বাংলাতে করাই সম্ভব না) এর অর্থ আসলে ‘প্রাসাদ’। কিন্তু বোঝাতো প্রাসাদের মালিক রাজাকেই। দ্বাদশ ডাইনেস্টি বা সাম্রাজ্য থেকে শব্দটা এমনভাবে লেখা শুরু হয় যার পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় মিসরীয় ভাষায় ‘প্রাসাদ বেঁচে থাকুক দীর্ঘদিন’।
নিউ কিংডমের তৃতীয় থুতমোস (Thutmose III) থেকেই আসলে সরাসরি ফারাও উপাধি দিয়ে বোঝানো হতে থাকে সম্রাটকে। আপনি জানেন কি, প্ৰথম ফারাও বলে সম্বোধনের রেকর্ড পাওয়া যায় কোন শাসকের ক্ষেত্রে? তিনি হলেন একটু আগে বলা একেশ্বরবাদী ফারাও আখেনাতেন। উল্লেখ্য, মিসরীয় রাজউপাধি ফারাওকে আরবি ভাষায় ফিরাউন বলা হয়। হিব্রুতে সেটি ফারোহ।
তো, ফিরে যাই ধর্মীয় ইতিহাসেই। ইয়াকুব (আ) এর সন্তানাদি আর নাতি-নাতনি মিলিয়ে মোট ৭০ জন আশ্রয় নেন মিসরে। ইউসুফ (আ) যখন মারা যান, তারপর পেরিয়ে যেতে থাকে যুগের পর যুগ। ইসরাইলিরা সংখ্যায় বাড়তে থাকে বহুগুণে।
পরে যে ফারাও এলেন, তার কাছে বহুদিন আগের ইউসুফ (আ) এর গুরুত্ব ছিল না। বরং তিনি এই ইসরাইলিদেরকে মিসরীয়দের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে লাগলেন। বললেন, দেখ, ইসরাইলিরা সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। এখনই তাদের ব্যবস্থা করতে হবে একটা।
নাহলে, তাদের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। যুদ্ধ লাগলে দেখা যাবে তারা শত্রুদেশের পক্ষে যোগ দিয়েছে।”
ফারাও এর নির্দেশে তখন মিসরীয়রা ইসরাইলিদের দাসে পরিণত করতে লাগল। তাদেরকে দিয়ে বানানো হলো পিথম আর রামেসিস নামের শহর। কিন্তু যতই নির্যাতন চলুক না কেন, ইসরাইলিদের সংখ্যা বেড়েই চলল। মিসরীয়রা একদমই দয়া দেখাতো না তাদের। কঠিনতম কাজগুলো তাদের দিয়ে করাতো।
দুজন হিব্রু নারীর কথা পাওয়া যায়, নাম ছিল তাদের শিঘ্রাহ আর পুয়াহ। তারা ধাত্রী ছিল। ফারাও তাদের ডেকে পাঠালেন, বললেন, তারা যেন মেয়ে শিশুদের বাঁচতে দেয়, কিন্তু ছেলে হলে মেরে ফেলে। কিন্তু তারা সেটা করল না। ফারাও যখন তাদের আবার তলব করলেন, তারা উত্তর দিল, “হিব্রু নারীরা মিসরীয় নারীদের মতো না। আমরা পৌঁছানোর আগেই তাদের বাচ্চা হয়ে যায়।”
ইবনে আব্বাস (রা) থেকে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ফারাও স্বপ্নে দেখলেন, এক অগ্নিশিখা এসে মিসরের বাড়ি-ঘর ও কিবতীদের সকলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল, কিন্তু মিসরে থাকা ইসরাইলীদের কোনো ক্ষতি করল না। ফারাও জেগে উঠে ভীত হয়ে পড়লেন। জ্যোতিষী ও জাদুকরদের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। তারা তখন বললেন, এক যুবক বনী ইসরাইলে জন্ম নেবে এবং তারই হাতে মিসরবাসী ধ্বংস হবে। (কিংবা, ফারাও ধ্বংস হবেন)
তখন ফারাও নির্দেশ দিলেন, “প্রত্যেক হিব্রু শিশু বালককে নীল নদে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু প্রত্যেক হিব্রু মেয়ে শিশুকে বাঁচতে দিতে হবে।”
কিন্তু, সভাসদরা বলল, তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে, দাসের অভাব পড়বে। তাই, আদেশ দেয়া হলো, এক বছর মারা হবে, পরের বছর মারা হবে না। (মূসা (আ) এর ভাই হারুন (আ) সেই বছর জন্মগ্রহণ করেন, যে বছর মারা হয়নি ছেলেদের)
এরকম হত্যাযজ্ঞ চলাকালীন এক সকালেই ফারাও এর প্রাসাদের ঘাটে নদীর জলে এসে ভিড়ল এক ঝুড়ি। আর তাতে ফুটফুটে এক ছেলেশিশু।
পবিত্র কুরআন (২৮:৮) অনুযায়ী, ফারাও এর পরিবারের কেউ সেই ঝুড়িটি তুলে নিল পানি থেকে- “অতঃপর ফিরাউন পরিবার মূসাকে কুড়িয়ে নিল, যাতে তিনি তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হয়ে যান। নিশ্চয়ই ফিরাউন, হামান ও তাদের সৈন্যবাহিনী অপরাধী ছিল।”
ইহুদীদের বক্তব্য, অর্থাৎ তাদের তাওরাত (যাত্রাপুস্তক ২:৫) অনুযায়ী, ফিরাউনের পরিবারের সদস্য ছিল ফিরাউনেরই মেয়ের দাসী। কিন্তু তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ করা আছে, পরিবারের সদস্য বলতে ফিরাউনের নিজ স্ত্রীর দাসীদের বোঝানো হয়েছে। দাসীরা শিশুটিকে কুড়িয়ে নিয়ে যায় ফিরাউনের স্ত্রীর কাছে। নাম তাঁর আসিয়া (৮) বিনতে মুযাহিস। তিনি দেখেই বুঝতে পারেন, এ এক হিব্রু শিশু, ফিরাউনের চোখে যা যম। তাই ফিরাউনের স্ত্রী আসিয়ার ইচ্ছে শিশুটিকে রেখে দেবার, লালনপালন করবার। কিন্তু ফিরাউনকে যে বোঝাতে হবে! তাওরাত জানায়, তখন শিশুটির নাম রাখা হয় হিব্রুতে ‘মোশে’, আরবিতে যার উচ্চারণ ‘মূসা’। বনী ইসরাইলের ভাষা হিব্রুতে শব্দটির অর্থ ছিল “তুলে আনা (পানি থেকে)’, “আমি তাকে পানি থেকে তুলে আনলাম (মেশিতিহু)”।
ফিরাউনের তখনও জানা ছিল না, যে শিশুকে হত্যা করতে মিসরে এত রক্তের বন্যা বয়ে গেল, সেই শিশুটি বড় হয়ে উঠবে তারই ঘরে, রাজকীয় হালে। বেড়ে উঠবে রাজপুত্র হয়ে।
কিন্তু মূসা (আ:) এর পিতা-মাতার দিক থেকে ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল? ইতিহাসের ফলকে কি মূসা (আঃ) এর নাম আছে কোথাও খোদাই করা? মূসা (আঃ) এর সময়ের ফারাও কে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়? কীভাবে একজন মিসরীয় যুবরাজ থেকে হিব্রুদের ত্রাণকর্তা বনে গেলেন মূসা (আঃ)?
এবার আসা যাক প্রশ্নোত্তরের পালায়।
প্রশ্ন: কিবতী কী?
উত্তর: কিবতী শব্দটি আরবি। কিংবা, আক্ববাত। ইংরেজিতে তাদেরকে ‘কপ্ট’/ ‘কপ্টিক’ (Coptic) বলে। কপ্টিক ভাষার শব্দ ‘কুবতি’ থেকে কিবতী এসেছে। এর মানে ‘মিসরীয়’। প্রাসঙ্গিক গ্রিক শব্দ ‘Aiyóntoç— অর্থও মিসরীয়। এ অধ্যায়ের ঘটনায় কিবতী বলতে মিসরে বসবাস করা আদি বাসিন্দাদের বোঝানো হয়েছে, কানান বা কেনান থেকে আসা হিব্রুদেরকে নয়। হিব্রুদের থেকে আলাদা করে বলবার জন্যই তাদের কিবতী ডাকা হয়। তবে বহু পরে মুসলিমরা মিসর বিজয় করবার পর থেকে মিসরীয় খ্রিস্টানদেরকে কেবল কিবতী বা কপ্ট বা কপ্টিক খ্রিস্টান ডাকা হয়ে থাকে।