অধ্যায় ৬ – আলীবর্দীর শাসনের সমাপ্তি তার চরিত্র ও প্রশাসন
১৭৫১ সালের পর সেনাবাহিনীর ব্যয় সঙ্কোচন ও পদে রদবদল
১৭৫১ সালের জুন মাসের পর আলীবর্দী মারাঠাদের ত্রাস থেকে মুক্ত হয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। আপাতভাবে আর কোনো বাইরের বিপদ না দেখে, তিনি সেনাবাহিনী থেকে সৈন্য কমিয়ে ফেলতে শুরু করেন। তিনি তার প্রশাসনে সময়ের দাবি অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এতদিন তার গুপ্তচর বিভাগের প্রধান হয়ে থাকা রাজারাম সিংকে মেদিনীপুরের নতুন ফৌজদার করা হয়, তার ভাই নারায়ণ সিংকে গুপ্তচর বিভাগের প্রধান করা হয়। মুযাফফারনামাহর লেখক করম আলী উত্তরবঙ্গের চাকলা ঘোড়াঘাটের ফৌজদারি লাভ করেন। নবাবের পুরনো দিওয়ান বিরু দত্ত এসময়ে মারা গেলে রাজা কিরাতচাঁদ তার স্থলাভিষিক্ত হন, আর তার সহকারী হিসেবে আসেন উমিদ রায়। কিরাতচাঁদ ছিলেন বিখ্যাত কর্মকর্তা রায়রায়ান আলমচাঁদের ছেলে। পাটনায় জৈনুদ্দিনের দপ্তরে দিওয়ান হিসেবে কাজ করার সময়ে বেশ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তিনি, আর জৈনুদ্দিনের মৃত্যুর পর আতাউল্লাহ খান রাজমহলে নিযুক্ত হন। বাংলা থেকে আলীবর্দীর নির্দেশে আতাউল্লাহ খান যখন অযোধ্যার দিকে যান, তখন কিরাতচাঁদ বারাণসী পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকার পর তাকে ত্যাগ করেন। তাকে তখন আলীবর্দী মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠান ও উপরে উল্লেখ করা দপ্তরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। দপ্তরের কিছু কাগজপত্র নিরীক্ষা করে অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলার অনেক জমিদার- ধনাঢ্য ব্যক্তিদের রাজকোষে অর্থ-সংক্রান্ত ব্যাপারে এক কোটি কয়েক লক্ষ রুপির গোঁজামিলের অকাট্য প্রমাণ বের করেন, এর মধ্যে জগৎ শেঠ, মাহতাবচাঁদ, তিলকচাঁদ ও বর্ধমানের মহারাজাও ছিলেন। পুরো অর্থ উদ্ধার করার পাশাপাশি কিরাতচাঁদ তার মৃত্যুর আগে দুবছর পূর্ণ ক্ষমতা ও কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে করেন, তার মৃত্যুর পর তারই সহকারী উমিদ রায়কে রায়রায়ান উপাধি দিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ১৭৫২ সালে বিহারের সহকারী প্রশাসক রাজা জানকিরামের মৃত্যুর পর তার জায়গায় বসানো হয় তার দিওয়ান রামনারায়ণকে। রাজা জানকিরামের ছেলে দুর্লভরাম তার বাবার জীবদ্দশাতেই নবাব সরকারের সেনাবিভাগে সহকারী দিওয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন, আর এসময়ে তিনি সেই দপ্তরেরই দিওয়ান নিযুক্ত হন আর রামনারায়ণ তাকে তার উকিল হিসেবে মুর্শিদাবাদের দরবারে নিয়োজিত করেন।
রামনারায়ণের প্রাথমিক কর্মজীবন
বিহারের শাহাবাদ জেলার সাসারাম পরগণা নিবাসী রঙ্গলাল নামের এক শ্রীবাস্তব কায়স্থের ছেলে ছিলেন রামলাল। ইউসুফ আলী বা গোলাম হুসাইন কেউই আলীবর্দীর সঙ্গে রঙ্গলালের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলেননি। করম আলী ও কল্যাণ সিং একজন রঙ্গলালের উল্লেখ করেছেন যিনি গিরিয়ার ময়দানে গাউস খানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু এই দুই রঙ্গলাল এক কি না সে-ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই। আমরা যদিও অন্য সূত্র থেকে জানি, রামলালের বাবা রঙ্গলাল আলীবর্দীর একজন দিওয়ান ছিলেন, সম্ভবত আলীবর্দী যখন বিহারের সহকারী প্রশাসক ছিলেন তখন থেকেই। যাই হোক. রামনারায়ণের বাবা আলীবর্দীর অধীনে কাজ করেছেন ও তিনি নিজেও শুরু থেকে আলীবর্দীর পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন, রামনারায়ণের চিঠি থেকেও স্পষ্ট এটা, কারণ তিনি সেখানে নিজেকে উল্লেখ করেছেন বংশানুক্রমিক ভৃত্য ( আলীবর্দীর) , ভৃত্যের সন্তান , যাকে আপনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ও নবাবের (হাইবাত খান) হত্যাকারী হিসেবে। রামনারায়ণ তার কর্মজীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন বিহারে একজন কেরানি হিসেবে মাসিক পাঁচ রুপির বিনিময়ে। এরপর ইতিহাস-লেখক গোলাম হোসেনের বাবা হিদায়াত আলীর সহায়তায় জৈনুদ্দিন বিহারের সহকারী প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পরপরই রামনারায়ণ তার খাসনবিশ বা ব্যক্তিগত সচিবে পরিণত হন। ১৭৪৫ সালে তিনি জৈনুদ্দিনের পক্ষে মুস্তাফা খানের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তিনি ধীরে ধীরে ফার্সি ও আরবি ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করেন, আর ইস্পাহানের ফার্সি ও উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি শেখ আলী হাজিন পাটনায় এলে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এ দু-ভাষায় কবিতাও লিখতে শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রশাসনিক দক্ষতা ও সক্ষমতাও অর্জন করেন, ফলে জানকিরামের সময়ে তিনি দিওয়ান পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল বাঙালি সহকারী প্রশাসকের সঙ্গে বিহারি দিওয়ানের, যিনি বেশকিছু চিঠিতে ঋণ স্বীকার করেছেন তার প্রভুর কাছে, আর তার সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সন্তোষজনকভাবে দৃঢ় করতে সহায়তা করেন। এভাবেই তিনি বিহারের সহকারী প্রশাসক হিসেবে তার পৃষ্ঠপোষকের জায়গায় যোগ্য হয়ে ওঠেন। আর্থিক ব্যাপারে দক্ষ, আর একজন কুশলী রাজনীতিবিদ হিসেবে রামনারায়ণ দক্ষতার সঙ্গে আলীবর্দীর লক্ষ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিহার শাসন করেন। তিনি নবাবকে নিয়মিত প্রতিটি প্রশাসনিক ব্যাপারের খুঁটিনাটি জানাতে থাকতেন আর তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তিনি নিয়মিত কর সংগ্রহের আয়োজন করতেন, নিবিড়ভাবে ছত্রধারী সিং, উদ্যন্ত সিং উজ্জয়ন ও শাহাবাদের পালোয়ান সিং, সামাই ও নারহাটের কামগার খান মাইয়ি টিকারির সুন্দর সিংয়ের মতো বিহারের ক্ষমতাবান জমিদারদের গতিবিধি পর্যক্ষেণ করতেন, আর তাদের বাধ্য করতেন বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করতে। তিনি দিল্লি ও আওধের (অযোধ্যা) দরবারের ঘটনাবলির দিকে নজর রাখতেন চতুরতার সঙ্গে সাতজন হরকরার (চর) মাধ্যমে।
আলীবর্দীর পরিবারের সদস্য একরামুদ্দৌলার মৃত্যু
বিহারে এধরনের সক্ষম সহকারী প্রশাসক আলীবর্দীর জন্য বেশ মূল্যবান সম্পদ ছিল। কিন্তু তখন ৭৬ বছর বয়সি নবাবের কপালে শান্তিপূর্ণ শাসন লেখা ছিল না। তার শেষদিনগুলো বেশ অসুখী কেটেছিল তারই পরিবারের সদস্যদের কিছু অপরিণত সাহসিকতায়। সিরাজ-উদ-দৌলার ছোটভাই একরামুদ্দৌলা যত্নের সঙ্গে নিঃসন্তান শাহামাত জংয়ের পালিত পুত্র হিসেবে বেড়ে ওঠার পর ১৭৫২ সালে মারা গিয়েছিলেন গুটি-বসন্তে। এটা কেবল শাহামাত জং নয়, গোটা আলীবর্দী- পরিবারের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। এমনকি গোলাম হোসেনও উল্লেখ করেছেন, নবাবের পরিবার ঐশী শাস্তি ভোগ করেছেন পরাজিত নবাব সারফারাজের হারেমের মহিলাদের সঙ্গে হাজী আহমাদের অপমানজনক ব্যবহারের, ভাইয়ের মৌন সম্মতিতে। একরামুদ্দৌলার মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত শাহামাত জং শোথরোগে মৃত্যুবরণ করেন ১৭ ডিসেম্বর, ১৭৫৫ তারিখে।
শাহামাত জং
তার মৃতদেহ মতিঝিল বা মুক্তোর হ্রদে নিয়ে যাওয়া হয়, যেটা তিনি খনন করে সাজিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের দেড় মাইল দক্ষিণ-পূর্বে, আর তারই নির্দেশে তৈরি মসজিদের উঠোনে একরামুদ্দৌলার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছিল। তার মৃত্যুতে অনেকেই শোকাক্রান্ত হয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন উদার মনের ও দানশীল। ব্যক্তিগত নৈতিকতার ঘাটতি থাকলেও তার দয়ালু হৃদয় ছিল, যা দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য আর্দ্র ছিল। গোলাম হোসেন তার বহু দানশীলতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন তিনি প্রতিমাসে আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে সকল বৃদ্ধ ও অক্ষম লোকেদের জন্য প্রায় ৩৭ হাজার টাকার ভাতা বরাদ্দ তো করেছিলেনই, এছাড়াও মুর্শিদাবাদে এমন বিধবা ও অনাথ খুব কমই আছে যারা কোনো-না-কোনোভাবে তার থেকে উপকৃত হয়নি।
এবং সাওলাত জং
আলীবর্দীর শোক আরও বেড়ে যায় সাওলাত জং ১৭৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তার ভাইয়ের অনুবর্তী হলে, আর তাকে সমাহিত করা হয় পূর্ণিয়ার এক মনোরম বাগান জাফরি বাগে। সাওলাত জং পুরো সাতবছর (১৭৪৯-৫৬) পূর্ণিয়ার প্রশাসনে ছিলেন সবার প্রতি সমভাবাপন্ন ও নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ দিয়ে প্রজাদের উন্নয়নে, ফলে সমাজের উঁচু-নিচু সকলেই শান্ত ছিল তার সরকারের অধীনে। তার মৃত্যুর পর পূর্ণিয়ার শাসনভার চলে আসে তার ছেলে শওকত জংয়ের হাতে, যিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী ও উড়নচণ্ডী স্বভাবের।
আলীবর্দীর শোথরোগ
এই দুর্যোগগুলো বৃদ্ধ নবাবের মনে ভয়াবহ বিষণ্নতা তৈরি করে আর তার শরীরেও সেটার প্রভাব পড়তে থাকে। তিনি শোথরোগে আক্রান্ত হন ১৭৫৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে, আর ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে তাকে জলপান থেকে বিরত রেখে ও খাবারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এরপর তাকে প্রথাগত চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু হাকিম হাজী খান ও কাশিমবাজার কুঠির সার্জন ডাক্তার ফোর্থের মতো সেরা সব চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টায়ও তিনি স্বস্তি পেলেন না। তিনি যখন বুঝলেন তার শেষ ঘনিয়ে এসেছে, তখন সিরাজ-উদ-দৌলাকে তলব করে আনিয়ে বললেন : প্রিয়! বার্ধক্যের দুর্বলতার জায়গায় এখন তারুণ্যের শক্তির জায়গা করে নেওয়ার পালা আর মৃত্যুও সন্নিকটে। আল্লাহর কৃপায় আমি তোমার জন্য একটি সম্পদশালী এলাকা তৈরি করেছি। তোমার কাছে আমার শেষ উপদেশ, তোমার শত্রুদের দমন করবে ও বন্ধুদের তুলে ধরবে, আর নিজেকে নিয়োজিত করবে জনগণের অবস্থার উন্নতিতে এবং অত্যাচার ও বিশৃঙ্খলা দমনে। রাজ্যের সমৃদ্ধি নির্ভর করে একতা ও সহযোগিতার উপর আর ঝগড়া-বিবাদ তা নষ্ট করে; তোমার সরকার স্থিতিশীল হবে যদি জনগণের উন্নয়নের উপর তার ভিত্তি স্থাপন করা হয়। আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে যেন তোমার জীবদ্দশায় শত্রুরা কোনো ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু তুমি যদি বিদ্বেষ ও শত্রুতা বেছে নাও তাহলে সমৃদ্ধির উদ্যান শুকিয়ে যাবে ।
মৃত্যু
নবাবের অসুস্থতা তার জীবনের জন্য প্রাণনাশী হিসেবেই দেখা যায়। তিনি ৮০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল, ভোর পাঁচটায়। তাকে দাফন করা হয় মতিঝিলের ঠিক উল্টোদিকে, ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে খোশবাগে মায়ের কবরের নিচে।
আলীবর্দীর ব্যক্তিজীবন, উচ্চমানের আদর্শের পরিচায়ক
ব্যক্তিগত জীবনে আলীবর্দী ছিলেন উচ্চমানের আদর্শের ধারক। প্রারম্ভিক প্রতিকূলতার পাঠ আচারনিষ্ঠতার ছাঁচে তার মেজাজ গড়া ছিল, আর যুবক বয়স থেকেই তিনি ভোগবিলাস আর পানাসক্তি থেকে দূরে ছিলেন। ওম তার সম্পর্কে সঠিকভাবেই বলেছেন যে, তার ব্যক্তিজীবন ইন্দোস্তানের অন্য মুসলিম রাজাদের থেকে ভিন্ন ছিল; তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল, প্রমোদ-বিলাসহীন, হারেম রাখেননি কোনো, আর সবসময় এক স্ত্রীর সঙ্গেই ছিলেন। ১ তার গান-বাজনা ও নর্তকীতে আগ্রহ ছিল না আর নিজের পরিবারের বাইরের মহিলাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তিনি নারীদের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তা প্রমাণিত হয় তার চরম বিরোধী শামশির খানের বিধবা স্ত্রী ও মেয়ের প্রতি তার উদার ও দয়ালু আচরণে, আর মারাঠা শিবিরে তাকে ছেড়ে যাওয়া মীর হাবিবের পরিবারের নারীদের সেখান থেকে সম্মানের সঙ্গে মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করা হয়। তিনি মনেপ্রাণে ধার্মিক ছিলেন আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা। শত্রুর সঙ্গে বিভিন্ন লড়াইয়ের প্রতিকূল মুহূর্তেও তিনি ঈশ্বরের সহায়তা চাইতেন আর এভাবেই তিনি উৎসাহ পেতেন প্রবল বিক্রমে লড়াইয়ের।
তার প্রাত্যহিক অভ্যেস
নিত্যদিনের কাজে আলীবর্দীর কিছু অভ্যেস ছিল, আর সেভাবেই তিনি প্রতিদিনের সময় ভাগ করে রাখতেন যেন প্রতিটি দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারেন। তিনি সূর্যোদয়ের দুঘণ্টা আগে বিছানা ছাড়তেন, প্রাতঃকৃত্য শেষে অজু করে প্রার্থনায় বসতেন। সকালের প্রার্থনাশেষে নির্দিষ্ট কিছু বন্ধুর সঙ্গে কফি পান করতেন। সকাল সাতটায় তিনি দরবারে আসতেন ও প্রশাসনিক ব্যাপারগুলোর দেখভাল করতেন। এরপর তিনি প্রধান নাগরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সমস্যাগুলো শুনতেন ও সমাধা করতেন। দুঘণ্টা পর তিনি তার খাস কামরায় চলে যেতেন যেখানে শাহামাত জং, সাওলাত জং ও সিরাজ-উদ-দৌলার মতো তার কিছু কাছের বন্ধু ও আত্মীয়রা সঙ্গ দিতেন। সেখানে তিনি পুরো একঘণ্টা সময় কাটাতেন, কবিতা ও গল্প শুনতেন। তিনি ভালো ও সুস্বাদু খাবার পছন্দ করতেন। মাঝেমধ্যে তিনি নিজেই রান্নার ব্যাপার তদারকি করতেন, আর খানসামাদের নতুন সব রান্নার প্রক্রিয়া চেষ্টা করে দেখতে বলতেন। তিনি প্রচুর মেহমান ছাড়া দুপুরের খাবার খেতে বসতেন না। খাওয়ার পর তিনি গল্প-কথকদের সান্নিধ্য উপভোগ করতেন আর তারপর প্রহরীদের প্রহরায় খানিক দিবানিদ্রা। বেলা একটায় উঠে দুপুরের নামাজ পড়তেন, তারপর বিকেলে নামাজের আগে পর্যন্ত কাটাতেন কোরআন শরিফ পড়ে। পানি খেতেন বরফ বা শোরা দিয়ে ঠাণ্ডা করে, অবশ্য সেটা মৌসুম অনুযায়ী। এরপর তার সামনে আসতেন ধার্মিক ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা, যাদের তিনি সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানাতেন। এই লোকগুলো চলে যাওয়ার পর তিনি আবারো ঘণ্টাদুয়েক সরকারি কাজে মগ্ন থাকতেন। রাতের আগমন হলে তিনি নামাজ পড়তেন, এরপর তার বেগম, সিরাজ-উদ-দৌলার বেগম ও তার পরিবারের অন্য নারীরা তার সামনে আসতেন। রাতের খাবারে তিনি কেবল কিছু ফল আর মিষ্টান্ন খেতেন এই মহিলাদের সঙ্গে। এরপর তিনি বিছানায় যেতেন, গল্প-কথক তাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন, আর প্রহরীরা সারারাত সতর্ক হয়ে তাকে পাহারা দিত।
আত্মীয়, কর্মকর্তা ও অন্যদের প্রতি তার দয়াশীলতা
আলীবর্দী তার আত্মীয়, কর্মকর্তা ও সাধারণ ভূত্যের প্রতিও দয়াশীল ছিলেন, আর প্রায়ই তাদের অঢেল পুরস্কার দিতেন। তার মনে বিধবা, শিশুদের জন্য কোমল স্থান ছিল আর দিল্লিতে শুরুর দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে তাকে সাহায্য করা দিল্লির আত্মীয়স্বজনদেরও তিনি তার আনুকূল্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, হয় অর্থ দিয়ে নাহয় তার সরকারে উঁচুপদে অধিষ্ঠিত করে।
তার চারিত্রিক ত্রুটি
কিন্তু তার চরিত্রকে ঠিক নিখুঁত বলা যায় না সবদিক বিচার করে। জিন ল তাকে সঠিক মূল্যায়ন করেছেন, তিনি ছিলেন প্রতারক ও সর্বোচ্চমাত্রায় উচ্চাভিলাষী । তার নির্দেশে বিহারের সহকারী প্রশাসক আবদুল করিম খান রুহেলাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করা হয়, সারফারাজের প্রতি তার কৃতকর্ম সবচেয়ে অকৃতজ্ঞতার নিদর্শন, আর যেভাবে তিনি ভাস্কর ও তার অনুসারীদের উপর তাণ্ডব চালিয়েছিলেন ভাগীরথী তীরের মানকারায় সেগুলোর পেছনে যুক্তি দাঁড় করানো খুবই ঘৃণ্যতম কাজ হবে। তার কর্মজীবন আমাদের সামনে তার ব্যক্তিগত শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাই তুলে ধরে অনেকটা রাজা ডেভিড আর তৃতীয় এডওয়ার্ডের মতোই, শেষজীবনে তিনি ভীমরতির ভেতরেই পড়েছিলেন, যে-কারণে তিনি তার বখে যাওয়া নাতি সিরাজকে তার উত্তরাধিকার নির্বাচন করে যান। হেনরি বেভারিজ বলেছেন, ছোট পর্যায়ে এই ভুলকে তুলনা করা যেতে পারে মা(র)কাস অরিলিয়াসের কর্মকাণ্ডের খারাপ পরিণতির সঙ্গে, যখন তিনি রোমের ভাগ্য ছেড়ে দেন কমোডাসের দয়ার উপর। মা(র)কাস অরিলিয়াস কমোডাসের ত্রুটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, তাই তারটা মেনে নেওয়া গেলেও আলীবর্দীর ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কষ্টকর, কারণ তিনি তার নাতির দোষগুলো জানতেন।
আলীবর্দীর প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা, পশুর লড়াই দেখা আর শিকার
ঘোড়া, কুকুর আর বিড়ালসহ নানা ধরনের প্রাণী পালতে পছন্দ করতেন আলীবর্দী, আর ভালোবাসতেন পশুর লড়াই দেখতে আর শিকারে যেতে। ১৭৪৬ সালের ১১ জানুয়ারি সুরাটের ফরাসি প্রধান লে ভার্নিয়েরের কাছে চন্দননগরের (চান্দেরনাগোর ) ফ্রেঞ্চ কাউন্সিলের লেখা চিঠিতে রয়েছে : নবাব অনেকদিন ধরেই আমাদের অনুরোধ করছেন পারস্য বেড়ালের (পার্সিয়ান ক্যাট) জন্য। আপনি কি পারেন না মে মাসে আপনার এলাকা থেকে গঙ্গার দিকে ছেড়ে আসা আর্মেনীয় জাহাজগুলোকে দুটো বিড়াল পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলতে? তিনি সাদা রঙের পুরুষ বিড়াল চেয়েছেন। ১৫৭ ১৭৪৯ সালে কলকাতার ইংরেজরা তাকে আরবীয় ঘোড়া দিয়ে খুশি করতে চেয়েছিল, আর ১৭৫৪ সালে তারা একটি পারসিক বিড়ালও তাকে উপহার দিয়েছিল, যেন তার দরবার বন্ধুত্বের আড়ালে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে কোম্পানির বাণিজ্য। মৃগয়ার জন্য নবাব শীতের মৌসুমে রাজমহলের পাহাড় আর জঙ্গলে যেতেন, ফিরতেন প্রচুর মৃত বাঘ আর হরিণ নিয়ে। সেখানে তিনি সকালবেলায় বন্যপ্রাণীর পিছু ছুটতেন আর বিকেলে তিনি দাক্ষিণাত্যের মোরগ ও হাতির লড়াই দেখতেন। তার ভাতিজা সাওলাত জং প্রায়ই পূর্ণিয়া থেকে তার এই শিকার অভিযানে অংশ নিতে আসতেন আর তার সঙ্গে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত চলে আসতেন।
রণাঙ্গনে বীরত্ব
নবাব ছিলেন সাহসী, নতুন সব ব্যাপারে আগ্রহী আর বীরযোদ্ধা। জিন ল লিখেছেন, তিনি জানতেন, কীভাবে একটি সেনাদলকে নেতৃত্ব দিতে হয় । গোলাম হোসেন উল্লেখ করেছেন, সেনাপতিত্বে তার সময়ে আসাফ ঝা নিজাম- উল-মুল্ক ছাড়া তার সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না। তার মারাঠা ও আফগানদের বিরুদ্ধে অভিযান যুদ্ধক্ষেত্রে তার অসাধারণ বীরত্ব, কৌশল আর দূরদর্শিতার পরিচায়ক।
শিল্প-সাহিত্যে তার পৃষ্ঠপোষকতা
নাচ-গানে আগ্রহ না থাকলেও, অবসর কাটানোর জন্য আলীবর্দীর অন্য আনন্দ ও বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। তিনি অনেক চারু ও কারু শিল্প, আর শারীরিক কসরতের সমঝদার ছিলেন আর যারা এগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের উঁচু চোখেই দেখতেন অবসর সময়ে তিনি প্রায়ই ধর্ম ও ইতিহাসের বই পড়তেন, আর জ্ঞানী ও বিদ্বানদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বিশিষ্ট আলেমদের একটি দল তার দরবারে বেড়ে উঠেছিল, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- মৌলভী নাসির আলী খান, তার ছেলে দাউদ আলী খান, যাইর হুসাইন খান, মীর মুহাম্মাদ আলিম, মৌলভী মুহাম্মাদ আরিফ, মীর রুস্তম আলী, শাহ মুহাম্মাদ আমিন, শাহ আদম, হায়াত বেগ, শেখ খিজুর, সৈয়দ মীর মুহাম্মাদ সাজ্জাদ, সিয়ারের রচয়িতা গোলাম হোসেনের দাদা সৈয়দ আলিমুল্লাহ, গোলাম হোসেনের দাদার মামা শাহ হায়দারি ও কাজী গোলাম মুযাফফার, যাকে আলীবর্দী স্বয়ং মুর্শিদাবাদের সর্বোচ্চ বিচারকের দপ্তরে উন্নীত করেছিলেন।
আলীবর্দীর প্রশাসনের প্রকৃতি
গোলাম হোসেন আর করম আলী দুজনেই আলীবর্দীর প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে প্রসংশাসূচক শব্দে ভরিয়ে তুলেছেন। গোলাম হোসেন এমনকি এটাও বলেছেন যে এসময়টা ছিল ক্ষমাশীলতার আর নবাব বেশ যত্নের সঙ্গে তার প্রজাদের সুযোগ- সুবিধা আর উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন, বিশেষ করে কৃষকদের যেন তারা মনে করে তারা রয়েছে বাবার পায়ের কাছে বা মায়ের বাহুডোরে। এই লেখকদ্বয়ের অতিবচনের কারণ তারা বিভিন্নভাবেই আলীবর্দীর কাছে ঋণী ছিলেন। তবে ইতিহাসের একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে বলতেই হয় যে তিনি ছিলেন কুশলী ও শক্ত প্রকৃতির প্রশাসক, যিনি মনন ও শক্তিমত্তা একীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন তার প্রশাসনের প্রতিটি শাখায় আর শাসকদের স্বার্থ বজায় রেখেছিলেন।
আলীবর্দীর নীতি ও ১৭৫১ সালের পর নেওয়া ব্যবস্থা
আলীবর্দীর শাসনের প্রথম ১১ বছর ছিল ঝড় ও চাপের, যে-সময়টায় তিনি ব্যস্ত ছিলেন শত্রু প্রতিরোধে আর বাংলার বৈষয়িক স্বার্থের জন্য তেমন কিছুই তিনি করতে পারেননি। কিন্তু ১৭৫১ সালের মে বা জুন মাসে মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি হলে তিনি দীর্ঘকাল ধরে চলা যুদ্ধের তাণ্ডবের ফলে সৃষ্ট ক্ষত নিরসনে পুনর্গঠন উদ্যোগের গুরুত্ব বুঝতে দেরি করেননি। তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন ন্যায় বিচার ও উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে তার প্রজাদের মধ্যে স্থিরতা আনতে, আর এরপরে তা থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি । তিনি সমস্ত মনোযোগ মারাঠাদের কারণে বিরান হয়ে পড়া বা তাদের আগমনী সংবাদে খালি হয়ে যাওয়া শহর ও গ্রামগুলোকে পুনর্গঠন আর পুনরুদ্ধারে গিয়েছিলেন, আর কৃষিজীবীদের আবারও তাদের জমিতে চাষ শুরু করার উৎসাহ দেন। এভাবে, একজন জ্ঞানী ও উপকারী শাসক হিসেবে, গ্রামগুলোর উন্নয়ন নিশ্চিত করেন আর ভারতীয় উপমহাদেশের মতো এলাকায় উন্নয়নের মেরুদণ্ড হিসেবে স্বীকৃত কৃষির উন্নয়ন করেন, আর সেটা প্রশাসনিক পুনর্গঠনের প্রকল্পেও সবার উপরে স্থান পেয়েছিল।
নবাব সরকারের রাজস্ব আদায়ের ধরন মোটেও এলোমেলো ছিল না। সেসময়ের সাধারণ রাজস্ব অনুসারে নবাব তার প্রদেশের জমিদারদের উপর মালগুজারি (রাজস্ব মূল্যায়ন) করেছিলেন মধ্যমপন্থি শর্তে। এই জমিদারেরা তাদের এলাকার প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহের কারণেই রায়তদের (কৃষকদের থেকে ফসল-সংগ্রহকারী) অতি উচ্চহারে ভাড়া দিতেন না, কিন্তু, প্রয়োজন পড়লে তাদের সুবিধাজনক সময়ে ভাড়া দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন, এমনকি কখনও তারা নিজেদের কাছ থেকেই ধার করে সময়মতো তাদের মালগুজারি নবাব সরকারের কাছে জমা দিতেন। প্রতি জেলাতেই শ্রফ (যারা অর্থ ধার দিত বা ব্যাংকার) শ্রেণির লোকেরা ছিলেন যারা প্রয়োজনমতো জমিদারদের অর্থ ধার দিতে প্রস্তুত থাকতেন, এমনকি রায়তদেরও দিতেন জমি চাষের জন্য, নইলে হয়তো সেটা পতিতই থাকত । এভাবে কৃষি অর্থের জন্য কখনোই বাধাগ্রস্ত হয়নি, কেবল মারাঠা আর মগদের আক্রমণের সময় ছাড়া। এক্ষেত্রে এটা বলতেই হয় যে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা বাংলার কৃষিকেও প্রভাবান্বিত করেছিল, যেমনটা শিল্পের ক্ষেত্রেও হয়েছিল।
আলীবর্দীর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ
নবাব জোরজবরদস্তি করে জনসাধারণের থেকে কখনও অর্থ নেননি; কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের জরুরি সময়ে, প্রথম ১১ বছরে আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ ধারণার থেকেও কম হচ্ছিল, তখন তাকে প্রায়ই অনিয়মিত সহায়তা নিতে হত ইউরোপীয় বণিকদের থেকে, আর রাজশাহীর রাজা রামকান্ত, দিনাজপুরের রাজা রাম নাথ আর গঙ্গার পূর্বদিকে মারাঠা তাণ্ডব থেকে প্রায় মুক্ত থাকা এলাকা নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো প্রভাবশালী জমিদারেরাও এই অনিয়মিত সহযোগিতা করতেন। ১৭৫১ সালের পর, তিনি মুর্শিদ কুলি জাফর খান ও সুজাউদ্দিনের মতো আবওয়াব আরোপ করেছিলেন, যা ছিল জমিদারদের উপর সাধারণ মূল্যায়নের চেয়ে অতিরিক্ত আরোপিত কর। তার সময়ে আদায়কৃত আবওয়াবের মোট পরিমাণ ছিল ২২ লক্ষ ২৫ হাজার ৫৫৪ রুপি। শোর বলেছেন এই অতিরিক্ত অর্থ আদায় সাধারণ মানুষের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, কারণ সেসময়ে দেশের সম্পদ এই অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার মতো সক্ষম ছিল । কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে এই অর্থ গ্রহণযোগ্য ছিল বলেই মনে হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাহিদার তুলনায়, যা আলোচ্য সময়ে বাংলা ও বিহারের সক্ষমতার বাইরে ছিল। এছাড়াও আগেই বলা হয়েছে কৃষিকে উৎসাহ দেওয়া হলেও, এই খাতের অবস্থা বিভিন্ন কারণে সন্তোষজনক পরিস্থিতির ধারেকাছেও ছিল না। যে-কোনোভাবেই এর অন্তর্নিহিত মূলনীতি ক্ষতিকর ছিল, আর ভবিষ্যতে এর বৃদ্ধি দেশের স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। ১৭৮৯ সালের ১৮ জুন শোর নিজে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে, রায়ত ও জমিদার – সবার জন্যই এই আরোপ করার ধরন মৌলিকভাবেই ধ্বংসাত্মক ছিল; আর সরাসরি জমিদারদের জোরপূর্বক অর্থ আদায়ে বাধ্য করত ও সবাই জালিয়াতি, লুকোচুরি আর দিনশেষে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন ।
আলীবর্দীর অধীনে হিন্দু কর্মকর্তা
আলীবর্দীর সরকারের পেছনে সক্ষম হিন্দু কর্মকর্তাদের উদ্যোগী কর্মকাণ্ডেরও ভূমিকা ছিল। তাদের মধ্যে জানকিরাম, দুর্লভরাম, দর্পনারায়ণ, রামনারায়ণ, কিরাতচাঁদ, উমিদ রায়, বীরু দত্ত, রামরাম সিং ও গোকূলচাঁদ অন্যতম। ওম জনপ্রশাসনে আলীবর্দীর হিন্দু কর্মকর্তাদের প্রভাব সঠিকভাবেই ধরতে পেরেছিলেন, কিন্তু তিনি ভুল করেছিলেন এই ভেবে যে তারা নবাবের সামরিক বাহিনীর উপর প্রভাববলয় বিস্তার করতে পারেননি। গোলাম হোসেনের লেখনি থেকে জানতে পারি নবাব তাদের মধ্যে কয়েকজনকে সাতহাজারি মসনবের সম্মান দিয়েছিলেন আর প্রচুর হিন্দুকে তার সরকারের সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে আসীন করেছিলেন। ফতেহ রাও, ছেদন হাজারিসহ আরও কিছু হিন্দু সেনাপতি ৫০ হাজার বন্দুকবাজ (মাস্কেটিয়ার) নিয়ে আলীবর্দীকে উড়িষ্যা অভিযানে সহায়তা করেছিলেন; জাসওয়ান্ত নাগোর, কিরাতচাঁদ, রামনারায়ণ ও আরও কিছু হিন্দু অধিনায়ক তার পক্ষে মুস্তাফা খানের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।
হিন্দুদের সহায়তা– আলীবর্দীর কর্মজীবনে প্ৰধানতম শক্তি
আলীবর্দীর জীবনে সত্যিকার অর্থেই হিন্দুদের সহযোগিতা প্রধানতম বিষয় ছিল। আলমচাদ ও ফতেহচাঁদ জগৎ শেঠরা ছিলেন ১৭৩৯-৪০ সালের ষড়যন্ত্রে অন্যতম অংশগ্রহণকারী, যার ফলে তিনি বাংলা সরকার দখল করতে সক্ষম হন। মুর্শিদাবাদের অমিচাঁদ ও অন্য শেঠরা আর অন্য শীর্ষস্থানীয় হিন্দু ব্যবসায়ীদের মতো লোকেরা তার সঙ্গেই ছিলেন পুরোটা সময়। বাংলার হিন্দুদের সহানুভূতি ও সহযোগিতা আদায় করে নেওয়া আলীবর্দীর পক্ষ থেকে বেশ কার্যকর ও বুদ্ধিমত্তার নীতি ছিল, আর পরাজিত নবাব সারফারাজের অনুসারী, অসন্তুষ্ট আফগান সৈন্য আর মারাঠা আক্রমণকারীদের থেকে মসনদ রক্ষায় তাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে আসীন করেছিলেন।
হিন্দুদের ভেতরের অসন্তোষ
এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আলীবর্দীর সমঝোতার চেষ্টার পরও কিছু হিন্দু জমিদারদের ভেতর অসন্তোষ ছিল, যারা মনে করেছিল তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝা অনেক ভারী আর অন্যায্য ছিল। এই অসন্তোষ পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে তৎকালীন হিন্দু-লেখক ভারতচন্দ্রের কলমে, যিনি নদীয়ার জমিদার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। বিদেশি পর্যবেক্ষক, কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী কর্নেল স্কট ১৭৫৪ সালে তার বন্ধু নোবেলকে লিখেছেন : জেন্টু (ইউরোপীয়রা স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীদের বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করত) রাজারা ও অধিবাসীরা মুর (মুহাম্মাদি বা মুসলিম) শাসকদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল আর গোপনে তাদের জোয়াল কাঁধ থেকে ফেলে দেওয়ার সুযোগ আর পরিবর্তন কামনা করত। যতক্ষণ পর্যন্ত আলীবর্দী শক্তহাতে ক্ষমতার লাগাম ধরে ছিলেন, এই ধিকিধিকি জ্বলতে-থাকা অসন্তোষ তারা প্রকাশ করতে পারেননি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পদক্ষেপের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এই আগুনে হাওয়া দেওয়া তার দুর্বল উত্তরসূরী সিরাজ-উদ-দৌলার ভুল ও খেয়ালি মনোভাব, আর তা দ্রুত বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কেবল অসন্তুষ্ট জমিদাররাই নন, আলীবর্দীর কিছু কট্টর সমর্থকও ১৭৫৭ সালের মহা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তারই নাতির বিরুদ্ধে
নবাবির প্রতি তৎকালীন হিন্দু জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলার হিন্দু অভিজাতরা ও কর্মকর্তারা এরপর থেকে তাদের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি, আর নবাবির প্রতি তাদের মনোভাব আরও বিদ্বেষপূর্ণ হতে থাকে।