অধ্যায়-৬ : অতঃপর যীশু খ্রিস্ট

অধ্যায় ৬ : অতঃপর যীশু খ্রিস্ট

ইহুদীরা বিশ্বাস না করলেও খ্রিস্টধর্ম আর ইসলাম মতে, হারুন বংশের ইমরান পরিবারে জন্ম নেন পুণ্যবতী কন্যা মারিয়াম (আ)।

কুরআনে উল্লেখ আছে, “নিশ্চয় আল্লাহ আদম, নূহ ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের পরিবারকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের ওপর মনোনীত করেছেন। তারা একে অপরের বংশধর… যখন ইমরান-পত্নী নিবেদন করল, হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার গর্ভে যা রয়েছে, তা আমি মুক্ত করে আপনার উদ্দেশে উৎসর্গ করলাম, সুতরাং আপনি আমা হতে তা গ্রহণ করুন, নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। অতঃপর যখন সে তাকে প্রসব করল, বলে উঠল, হে আমার প্রতিপালক! আমি কন্যা প্রসব করেছি এবং আল্লাহ ভাল করেই জানেন যা সে প্রসব করেছে; বস্তুত পুত্র কন্যার মতো নয় এবং আমি তার নাম রাখলাম মারিয়াম এবং আমি তাকে ও তার বংশধরকে বিতাড়িত শয়তান হতে তোমার আশ্রয়ে ছেড়ে দিলাম। তখন তার প্রতিপালক তাকে সন্তুষ্টি সহকারে গ্রহণ করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালন পালন করলেন এবং জাকারিয়াকে তার তত্ত্বাবধায়ক করলেন। যখনই জাকারিয়া মারিয়ামের কক্ষে প্রবেশ করত, তার কাছে খাদ্য সামগ্রী দেখতে পেত; জিজ্ঞেস করত- হে মারিয়াম! এসব কোত্থেকে তোমার কাছে আসে? মারিয়াম বলত, ওসব আল্লাহর নিকট হতে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছে অপরিমেয় খাবার দান করেন।” (কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:৩৪-৩৭)

মারিয়াম বিনতে ইমরান (বাইবেলে ইমরান হলেন ‘আম্রাম’) ধর্মীয় ইতিহাসে বিনা পিতায় ঈসা (আ)-কে জন্মদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন, একই সাথে তিনি ইসলামে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন। তার মায়ের নাম হান্না। নাসরত গ্রামের এই ইমরান পরিবার থেকেই জন্ম নেন ঈসা (আ)।

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেন, হান্নার কোনো সন্তান হতো না। একদিন তিনি দেখেন, একটি পাখি তার ছানাকে আদর করছে, এ দৃশ্য দেখে তার সন্তান লাভের খুব ইচ্ছে হলো। তিনি মানত করলেন, তার যদি সন্তান হয় তাহলে তিনি তাকে বাইতুল মুকাদ্দাসের সেবক বানাবেন। এই মানতের পরপরই তার ঋতুস্রাব শুরু হয়। স্রাব শেষ হবার পর পবিত্র হয়ে তিনি তার স্বামীর সাথে মিলিত হন। গর্ভে আসেন মারিয়াম (আ)। জন্মের পর দেখা গেল, তিনি কন্যা সন্তান প্রসব করেছেন। কন্যাকে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে দিতে পারবেন?

বাইতুল মুকাদ্দাসে মারিয়ামের অভিভাবকত্বের জন্য হয়ে যাওয়া কলম- নিক্ষেপ লটারিতে তিনবার নাম এলো জাকারিয়া (আ)-এর, সম্পর্কে তিনি মারিয়ামের খালু। তার জন্য জাকারিয়া (আ) সুন্দর কক্ষ নির্ধারণ করে দিলেন। মসজিদের দায়িত্ব পালনের সময় মারিয়াম (আ) তা পালন করতেন। আর বাকি সময় তার কক্ষে থাকতেন। যখনই জাকারিয়া (আ) তার কক্ষে যেতেন, দেখতে পেতেন তার জন্য অজানা উৎস থেকে আসা খাবার সাজানো আছে। অর্থাৎ, ফেরেশতারা তার জন্য খাবার নিয়ে আসেন।

এরকমই একদিন, ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) এসে মারিয়াম (আ)-কে সুসংবাদ দিলেন তার গর্ভে আসতে চলা শিশুর, তার নাম রাখতে হবে ঈসা।

কুরআন বলছে- “আর স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলল, হে মারিয়াম, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন ও পবিত্র করেছেন এবং নির্বাচিত করেছেন তোমাকে বিশ্বজগতের নারীদের ওপর। হে মারিয়াম, তোমার প্রতিপালকের প্রতি অনুগত হও। আর সিজদা করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো। যখন ফেরেশতারা বলল, হে মারিয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে তাঁর একটি বাণীর সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মারিয়ামের পুত্র ঈসা মাসিহ, সে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত ও সান্নিধ্য প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর সে মানুষের সাথে কথা বলবে দোলনায় ও পরিণত বয়সে এবং সে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত। মারিয়াম বলল, হে আমার রব, কীভাবে আমার সন্তান হবে? কোনো মানুষ তো আমাকে স্পর্শ করেনি! আল্লাহ বললেন, এভাবেই, আল্লাহ যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন শুধু বলেন, হও। ফলে তা হয়ে যায়। আর তিনি তাকে কিতাব, হিকমাত, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দেবেন। আর তিনি তাকে বনী ইসরাইলের নিকট রসূল হিসেবে প্রেরণ করবেন। সে বলবে, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে নিদর্শনসহ তোমাদের নিকট এসেছি, আমি তোমাদের জন্য মাটি দিয়ে পাখির মতো একটা কায়া গঠন করব, অতঃপর তাতে ফুঁৎকার দেব, ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখি হয়ে যাবে এবং আল্লাহর হুকুমে আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীদের আরোগ্য করব ও আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবিত করব এবং আমি তোমাদেরকে বলে দেব, তোমাদের গৃহে তোমরা যা আহার করো এবং সঞ্চয় করে রাখ; নিশ্চয়ই এ কাজে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা মুমিন হও।” (কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:৪২-৪৯)

মারিয়াম (আ) নিঃসন্দেহে খুবই বিব্রত ছিলেন এই অবিবাহিত গর্ভধারণে। কুরআন থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়, “অতঃপর ছেলে তার গর্ভে আসল। তখন সে তা নিয়ে দূরবর্তী জায়গায় চলে গেল। সন্তান প্রসবের বেদনা তাকে এক খেজুর বৃক্ষতলের দিকে তাড়িত করল। সে বলে উঠল, হায়! এর আগেই যদি আমি মরে যেতাম আর মানুষের স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে যেতাম!” (সুরা মারিয়াম, ১৯:২২-২৩)

খ্রিস্টধর্ম অনুযায়ী মেরির প্রসববেদনা না হলেও, ইসলাম অনুযায়ী তার প্রচণ্ড প্রসব বেদনা হচ্ছিল- “ফেরেশতা তার নিম্ন পার্শ্ব থেকে আহ্বান করে তাকে বলল, তুমি দুঃখ করোনা, তোমার পাদদেশে তোমার প্রতিপালক এক ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন। আর তুমি খেজুর গাছের কান্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, তাহলে তা তোমার ওপর তাজা-পাকা খেজুর ফেলবে। অতঃপর তুমি খাও, পান কর এবং চোখ জুড়াও। আর যদি তুমি কোনো লোককে দেখতে পাও, তাহলে বলে দিও, আমি পরম করুণাময়ের জন্য চুপ থাকার মানত করেছি। অতএব আজ আমি কোনো মানুষের সাথে কিছুতেই কথা বলব না।” (সুরা মারিয়াম, ১৯:২৪-২৬)

ইহুদীরা ছিল কথা শোনানোর ওস্তাদ। মারিয়াম (আ) নিজেও জানতেন, তাকে ভয়ংকর কথা শোনা লাগবে। তাকে ব্যভিচারিণী আখ্যা পেতেই হবে। নাহলে বিয়ে না করে তার বাচ্চা এলো কোথা থেকে?

“অতঃপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলো; তারা বলল, হে মারিয়াম! তুমিতো এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছ! হে হারুনের বোন (যেহেতু হারুন (আ)-এর বোনের নামও ছিল মিরিয়াম)! তোমার পিতা তো খারাপ লোক ছিল না! আর তোমার মাও ছিল না ব্যভিচারিণী! তখন মারিয়াম তার ছেলের দিকে ইশারা করল। তারা বলল, আমরা কোলের বাচ্চার সঙ্গে কীভাবে কথা বলব? শিশুটি বলল, আমি তো আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন আর আমাকে নামায ও যাকাতের হুকুম দিয়েছেন, যতদিন আমি জীবিত থাকি। আর আমাকে মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে অহঙ্কারী, অবাধ্য করেননি। শান্তি আমার ওপর, যেদিন আমি জন্মেছি এবং যেদিন আমি মারা যাব আর যেদিন আমাকে জীবিত অবস্থায় উঠানো হবে। এই হচ্ছে মারিয়াম পুত্র ঈসা। এটাই সঠিক বক্তব্য, যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করছে।” (সুরা মারিয়াম, ১৯:২৭-৩৪)

ঈসা (আ) বা যীশুর নাম তার মাতৃভাষায় ইয়েশোয়া, আরবিতে উচ্চারণ করা হয় ঈসা। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম দ্বিধাহীনভাবে যীশুকে প্রতিশ্রুত মাসিয়াহ বা মাসিহ বা অভিষিক্ত ত্রাণকর্তা হিসেবে ঘোষণা করে। নাসরত গ্রামের অধিবাসী হওয়ায় তার অনুসারীদের একটা সময় থেকে নাসারা ডাকা হতো। খ্রিস্টধর্মের বিস্তারিত ইতিহাস আর যীশু খ্রিস্টের অজানা তথ্যাবলি নিয়ে ইনশাল্লাহ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বইয়ে আলোচনা করা হবে। তবে ইহুদীদের দৃষ্টিকোণ বোঝাতে যতটুকু জরুরি, ততটুকু এ অধ্যায়ে লেখা হচ্ছে।

ঈসা (আ)-এর জন্মের জন্য ইহুদীদের মাঝে কেউ কেউ ইউসুফ নাজ্জার বা জোসেফ নামে একজনকে অপবাদ দেয়, যিনি সম্পর্কে মারিয়ামের এক খালাত ভাই ছিলেন, একই সাথে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসেও কাজ করতেন। কথিত আছে, তিনি প্রথম তাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আবিষ্কার করেন। ইহুদীরা জাকারিয়া (আ)- কেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়নি (কেউ কেউ বলেন, এ কারণেই জাকারিয়াকে হত্যা করা হয়।)। তাফসির থেকে জানা যায়, মারিয়াম জন্মদানের জন্য দূরের যে জায়গায় চলে যান, তার নাম ছিল বাইতে লাহম বা বেথেলহেম। তবে এ ঘটনা ইহুদী উৎসে পাওয়া যায় না। এবং মারিয়ামের সাথে করে নিয়ে আসা শিশুপুত্রের মুখে কথা শোনার পর তাদের অভিব্যক্তি নিয়েও কিছু জানা যায় না।

বিশেষজ্ঞগণ ‘ম্যাসাকার অফ দ্য ইনোসেন্টস’ (গসপেল অফ ম্যাথিউ, ২:১৬- ১৮) নামের ঘটনাকে কিংবদন্তি হিসেবে নিলেও, বর্ণিত আছে, রাজা হেরোদ দ্য গ্রেটের কাছে তিন জ্ঞানীলোক বেথেলহেমের তারকার উদয় থেকে এসে হাজির হন উপহার সামগ্রী নিয়ে। বলেন, তারা ইহুদীদের রাজাকে খুঁজছেন, তার সদ্য জন্ম হয়েছে। রাজা হেরোদ এ কথা শুনে রেগে যান প্রচণ্ড। তিনি দুবছর বা তার কম বয়সী সকল বেথেলহেমবাসী পুত্রসন্তানকে হত্যার নির্দেশ দেন, যেন কেউ বড় হয়ে তার রাজত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন। এতে ভয় পেয়ে মারিয়াম ঈসা (আ)-কে নিয়ে মিসরে পালিয়ে যান।

একজন গালিলি ইহুদী হিসেবে ঈসা (আ) স্বাভাবিকভাবেই বড় হন। তার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব চার সালের দিকে হলেও, তার নবুয়ত জীবন শুরু হয় ত্রিশ বছর বয়সে, অর্থাৎ প্রায় ২৭ সালের দিকে। তিন বছর তিনি নবুয়তি কার্যক্রম চালান। তিনি অসংখ্য চমকপ্রদ মুজেজা বা অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করেন, যেমন আল্লাহর আদেশে মৃতকে জীবিত করা, কুষ্ঠ রোগীকে সারানো, অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়া, সাগরের পানির ওপর দিয়ে হেঁটে আসা, অল্প খাবারকে অজস্র পরিমাণে পরিণত করা, ইত্যাদি। তার বারো সাহাবীর পাশাপাশি অসংখ্য অনুসারী যোগাড় হয়ে যায়। লোকে তাকে মাসিহ বা মেসায়া ডাকতে শুরু করে।

অবশ্য যীশু খ্রিস্টকে তখনও আলাদা করে পাত্তা দেবার কারণ ছিল না ইহুদীদের, কারণ তিনিই একমাত্র নন যে মাসিহ বলে দাবি করেছিলেন ওই সময়। ইহুদীদের দুর্দিনে অনেক লোকই এমন দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। তাদেরকে ভণ্ড হিসেবে উপাধি দিত ইহুদীরা। যেমন, খ্রিস্টপূর্ব চার সালে এক রাখাল তার মাথায় মুকুট চড়িয়ে দাবি করে বসে, সে ‘ইহুদীদের রাজা’। নির্মমভাবে তাকে ও তার অনুসারীদের হত্যা করে রেখে যায় রোমানরা। আরেক ভদ্রলোক, যাকে আমরা চিনি ‘সামারিটান’ বলে, তাকে প্রিফেক্ট খোদ পন্টিয়াস পাইলেটই ক্রুশবিদ্ধ করেন। যদিও তার কোনো অনুসারীই ছিল না; তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় জানাবার উদ্দেশ্য ছিল কোনো রকমের স্বর্গীয় বা নেতাগোত্রের দাবিদাওয়া নিয়ে আসা কাউকে বরদাশত করাই যাবে না, পাছে সে ভবিষ্যতে ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এরকম করে ডাকাতসর্দার খ্যাত হেজেকিয়া, পেরেয়া থেকে আগত সাইমন, গালিলি থেকে আসা জুডাস, জুডাসের নাতি মেনাহেম, গিওরা থেকে আগত আরেক সাইমন, কোচবার ছেলে অন্য আরেক সাইমন- সবাই নিজেদেরকে প্রতিশ্রুত মসিহ বা ত্রাতা হিসেবে আখ্যা দেন আর ঠাঁই করে নেন পরপারে, ধন্যবাদান্তে রোমান বাহিনী আর ইহুদী ধর্মগুরুরা।

তাই এত ভণ্ড মেসায়া বা মসিহের ভীড়ে রোমান কর্তৃপক্ষ আর সমসাময়িক ইহুদী গুরুরা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি, নাসরত গ্রাম থেকে আসা এক ত্রিশ বছরের কাঠমিস্ত্রী যুবক আবির্ভূত হবেন মেসায়া হিসেবে। তার গুটি কয়েক অনুসারীকে দমন করার জন্য সেই মেসায়াকে ক্রুশে চড়িয়ে দেয়াটাই তাই তারা ভেবেছিলেন সহজতম সমাধান।

কিন্তু যীশুর ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে দাঁড়ায় এ কারণে যে, তিনি নাকি বাইতুল মুকাদ্দাস ভেঙে নতুন করে গড়ার কথা বলেন। আর তাছাড়া নিজের মেসায়া দাবি তো আছেই। খ্রিস্টধর্ম অনুযায়ী, তাকে ঈশ্বরপুত্র বলা হয়। কিন্তু হিব্রু অলংকারে পিতা বা আব্বা অনেকটাই আরবি শব্দ ‘রাব্ব’ এর মতো ছিল। আক্ষরিক অর্থে নিলে ইহুদীদের কাছে এটি প্রচণ্ড ধর্মবিরোধী একটি কথা। কিন্তু এমন না যে ইহুদীরা কখনও হিব্রুতে কাউকে আল্লাহর সন্তান বলেনি, এমনকি তাদের বর্তমান কিতাবেই ধার্মিক ব্যক্তিদের সকলকে, আর সকল নবী রাসুল এমনকি ফেরেশতাকে আল্লাহর সন্তান বলা হয়েছে, অবশ্য এসব কিতাবকে ইসলাম ধর্মে বিকৃত বলেই বিশ্বাস করা হয়। সত্যি বলতে, ইহুদী ধর্ম বইগুলোতে পাতায় পাতায় আপনি ‘বেনে এলোহিম’ (প্রা7 ২২) বা ‘বেনে এলিম’ শব্দের খোঁজ পাবেন, যার অর্থ ঈশ্বরের সন্তান; ধার্মিকতা বোঝাতে এটি ব্যবহার করা হতো।

সমস্যা হয়ে গেল তখনই, যখন কথাটাকে আক্ষরিকভাবে নেয়া হলো, যেমনটা এখন নেয়া হয়। ইহুদীরা এটি মানতে পারেনি। কিন্তু এসবের চেয়েও উর্ধ্বে যে কারণ নিহিত ছিল, তা হলো, রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ইহুদীরা চাইতো না এমন কোনো কিছু ঘটুক, যা তাদের জেরুজালেমে থিতু হয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে নড়বড়ে করে দেয়। আসলেই, তাদের আর কী চাই! মাথার ওপর রোমান সাম্রাজ্যের মতো পরাক্রমশালী অভিভাবক আছে, নবনির্মিত বাইতুল মুকাদ্দাস বা সেকেন্ড টেম্পল আছে (আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট নেই যদিও, তা ইতিহাস থেকে বিলীন হয়ে গিয়েছে বহু আগেই), আছে ইহুদী ইমাম বা র‍্যাবাইদের স্থানীয় ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি। কেন তারা চাইবে যে নতুন কোনো আন্দোলন বা কিছু এসে তাদের আরামে ব্যাঘাত ঘটাক? বলাই বাহুল্য, পর্দার আড়ালের ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যাওয়া ধর্মগুরুদের মাঝে তখন দুর্নীতি ঢুকেছিল ভালোভাবেই। ঐতিহাসিক অনেক নথিই পাওয়া যায়, যেখানে তৎকালীন ধর্মগুরুদের দুর্নীতির বিস্তারিত উল্লেখ আছে। তাদের নীতি বা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে, এমন কাউকে তারা কোনোভাবেই বরদাশত করতেন না। তাই প্রতিটি আন্দোলনই ছিল তাদের জন্য ভয়ের। সাদুকি আর ফারিসিরা দফায় দফায় এসে জ্বালাতন করে গিয়েছে যীশু খ্রিস্টকে। যীশুর কাছ থেকে নিজেদের দুর্নীতির ফিরিস্তি শুনে তারা আর বরদাশত করতে পারলো না। রাজা হেরোদকে বলে কয়ে প্রিফেক্ট পন্টিয়াস পাইলেটকে দিয়ে তারা আয়োজন করলো তাদের দৃষ্টিতে নব্য মেসায়াকে ক্রুশে দেয়ার।

ইসলাম ধর্মমতে যীশুকে ইহুদীরা ক্রুশে চড়াতে পারেনি, খ্রিস্টধর্মমতে যীশু ক্রুশে চড়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং তিন দিন পরে পুনরায় ফিরে আসেন, যাকে ইস্টার সানডে বলে পালন করা হয়। দুই ধর্মই বিশ্বাস করে, যীশু আবার ফিরে আসবেন কেয়ামতের আগে।

.

ইহুদীরা যীশু খ্রিস্টকে নিয়ে কী ধারণা পোষণ করে?

শুরুতেই বলা জরুরি, খ্রিস্টধর্মের যীশুর ব্যাপারে ইহুদীরা কড়াভাবে ‘ব্লাসফেমাস’ অনুভূতি পোষণ করে থাকে। কারণ, স্রষ্টার শরিক আর স্রষ্টার আক্ষরিক পুত্র-এমন ধারণা ইহুদী ধর্মেও ইসলামের মতো পরিত্যাগ করে।

ইহুদী ধর্মে একজন মেসায়ার বৈশিষ্ট্য হিসেবে সুনির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করা রয়েছে, এ ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পূরণ না হলে তাকে মেসায়া বলা হবে না। মেসায়া পুরো ইসরাইলকে তাওরাতের পথে ফিরিয়ে আনবেন, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করাবেন, জেরুজালেমের আদি ও আসল বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করবেন (থার্ড টেম্পল), ইসরাইলের নির্বাসিত সকল ইহুদীকে একত্রিত করবেন।

যীশুকে মেসায়া না মানার পেছনে যে প্রধান কারণগুলো দেন ইহুদী ধর্মগুরুগণ-

১) যীশু মেসায়া সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ করেননি

২) মেসায়ার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি তার মাঝে দেখা যায়নি

কী কী ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি বলে জানান ইহুদী গুরুরা?

১) এজেকিয়েল ৩৭:২৬-২৮ অনুযায়ী, মেসায়া থার্ড টেম্পল তৈরি করবেন।

২) ইশাইয়া ৪৩:৫-৬ অনুযায়ী, সকল ইহুদীকে পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন মেসায়া।

৩) ইশাইয়া ২:৪ অনুযায়ী, মেসায়া এক শান্তির যুগের সূচনা করবেন। কোনো জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে তলোয়ার তুলবে না। যুদ্ধ কী জিনিস, তা লোকে ভুলে যাবে।

৪) জাকারিয়া ১৪:৯ অনুযায়ী, ইসরাইলের স্রষ্টার ছায়াতলে মেসায়া সারা পৃথিবীকে এক করবেন।

এর মধ্যে একটিও যদি পূর্ণ না হয়, তাহলে সেই ব্যক্তিকে ইহুদীরা মেসায়া ডাকবে না। বলা বাহুল্য, কেউই এ যাবৎ এগুলো পূরণ করেননি, তাই কাউকেই ইহুদীরা মেসায়া খেতাব দেয়নি, যীশুকেও না।

অবশ্য মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈসা (আ) ফিরে এসে এগুলো পূরণ করবেন।

কোন কোন ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য মেলেনি যীশুর?

মেসায়া হবেন মূসা (আ)-এর পর সবচেয়ে বড় নবী। নবীদের যুগ ব্যবিলনে থাকতেই শেষ হয়ে গিয়েছে বলে ইহুদীদের ধারণা। তাই এরপরের কোনো নবীকেই তারা মানেনি।

ইশাইয়া ১১:১-৯, ইয়ারমিয়া ২৩:৫-৬, ৩০:৭-১০, ৩৩:১৪-১৬, হিজকীল ৩৪:১১-৩১, ৩৭:২১-২৮, হোসিয়া ৩:৪-৫ অনুযায়ী, মেসায়াকে হতে হবে পিতার দিক থেকে রাজা দাউদ (আ)-এর বংশধর, তিনি ইসরাইল শাসন করবেন। কিন্তু যীশু পিতাহীনভাবে জন্মালে পিতার দিক থেকে দাউদের বংশধর হওয়ার সুযোগ আর থাকে না। ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী, মেসায়ার সাধারণ পিতা- মাতা থাকবে, তার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা থাকবে না।

মেসায়া অবশ্যই তাওরাত মেনে চলবেন, সাব্বাথ মানবেন। কিন্তু গসপেল অফ জন ৯:১৪ বলছে, ঈসা (আ) শনিবার অর্থাৎ সাব্বাথ দিবসে কারও চোখ ভালো করে দিয়েছিলেন, যা সাব্বাথের লংঘন। সুতরাং তিনি তাওরাত মানতেন না।

মধ্যযুগের ইহুদী দার্শনিক মাইমনিদিজ (মোজেস বেন মাইমন) বলেন, “যীশু ভবিষ্যদ্বাণী পূরণে সক্ষম তো হন-ইনি, তার ওপর আবার মারাও যান, সুতরাং তিনি নিঃসন্দেহে তাওরাতের সেই মেসায়া নন। আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছিলেন ইহুদীদের পরীক্ষা করতে, তারা ভণ্ড মেসায়ার কথা শুনে বিভ্রান্ত হয় কি না দেখতে।” (হিলকোস মেলাখিম ১১:৪-৫)

যীশু অবশ্য সর্বতভাবেই একজন ঐতিহাসিক চরিত্র, তার অস্তিত্বের প্রমাণও ইতিহাসে মেলে। খ্রিস্টান নথিপত্রের বাইরেও ইহুদী উৎসে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, ইহুদী মৌখিক ধারা তথা মিশনাহতে আমরা যীশুর দেখা পাই, যাকে একজন জাদুকর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি ইহুদীদের তাফসিরগ্রন্থ তালমুদেও যীশুর উল্লেখ আছে। অবশ্যই তাকে সুনজরে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।

যীশুর জীবনী নিয়ে একটি ইহুদী গ্রন্থ রচিত হয়েছিল যার নাম “সেফের তলেদোৎ ইয়েশু”, অর্থাৎ “ইয়েশু’র (যীশুর) জীবনীগ্রন্থ”। সেখানে তারা যে কাহিনী তুলে ধরে, তা অনেকটা এরকম- জুদাহ বংশের এক লোক ছিল, যার নাম জোসেফ প্যান্ডেরা, তার নিকটে এক বিধবা বাস করতেন, তার কন্যার নাম মিরিয়াম। এই কুমারী মেয়ের সাথে বাগদান হয়েছিল ইউহানা নামের এক লোকের, যিনি তাওরাতের শিক্ষাপ্রাপ্ত, আল্লাহভীরু, দাউদবংশীয়। এক সাব্বাথ দিবসে জোসেফ মিরিয়ামের দিকে কুদৃষ্টি ফেলল, সে মিরিয়ামের দরজায় কড়া নাড়ল, ভান করল যেন সে তার স্বামী ইউহানা। মিরিয়াম জোসেফের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ইউহানা ফিরে এসে জানতে পারলেন কী হয়েছে। কিন্তু প্যান্ডেরাকে শাস্তি দেয়ার উপায় নেই, কারণ কোনো সাক্ষী নেই। দুঃখে ইউহানা ব্যবিলন চলে গেলেন। ওদিকে, যথাসময়ে যীশুকে জন্ম দিলেন মিরিয়াম। বড় হলে তাকে ইহুদী রীতিতে শিক্ষা দিলেন। একদিন যীশু বড়দের সামনে অসম্মানসূচকভাবে মাথায় টুপি না দিয়েই হাঁটছিল। তখন লোকে বুঝতে পারলো সে ভালো লোকের সন্তান নয়। মিরিয়াম স্বীকার করলেন, যীশু প্যান্ডেরার সন্তান। যীশু অপমানিত হয়ে গালিলির পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে চলে গেলেন। পরে তিনি জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাসে গিয়ে স্রষ্টার ইসমে আজম শিখে নিলেন, যা ব্যবহার করে কেউ যা ইচ্ছা তা করতে পারে। অনেক লোককে জড়ো করে তিনি নিজেকে মেসায়া দাবি করলেন। বললেন, তার বিষয়েই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ছিল তাওরাতে। আল্লাহর নাম ব্যবহার করে তিনি এক খোঁড়া লোককে সুস্থ করে দিলেন। লোকে তাকে মেসায়া হিসেবে আরাধনা করতে লাগলো। সানহেদিন সিদ্ধান্ত নিল, এই লোককে গ্রেফতার করা জরুরি। তারা শীষ্যের ছদ্মবেশে জেরুজালেমে আসার আমন্ত্রণ জানাতে লোক পাঠালো যীশুর কাছে। যীশুকে রানীর সামনে হাজির করা হলো, তাকে জাদুবিদ্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। কিন্তু যীশু এক লাশকে জীবন্ত করে তুললে তাকে ছেড়ে দেয়া হলো। তার নামে আবারও অভিযোগ এলো, কিন্তু এবার তিনি অনুসারীদের বললেন, লড়াই না করতে। তাকে ধরে নিক। ইসমে আজম ব্যবহার করে তিনি কাদামাটি দিয়ে পাখি বানিয়ে উড়িয়ে দিলেন। ইহুদী মনীষীরা তখন এহুদা বা জুডাস ইস্ক্যারিয়ট নামের এক লোককে ইসমে আজম শিক্ষা করালেন। তারপর দুজনের মধ্যে যুদ্ধ হলো। দুজনেই ইসমে আজম ভুলে গেলেন। যীশুকে গ্রেফতার করা হলো, তাকে পেটানো হলো। তাকে টাইবেরিয়াসে নিয়ে গিয়ে এক সিনাগগের পিলারের সাথে বাঁধা হলো। পান করতে দেয়া হলো ভিনেগার। তার মাথায় কাঁটার মুকুট পরানো হলো। মনীষী আর যীশুর অনুসারীদের মাঝে এ সময় ঝগড়া বিবাদ শুরু হলো, এই সুযোগে যীশু ও তার অনুসারীরা পালিয়ে গেলেন। ঈদুল ফিসাখের আগের দিন যীশু সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়ে স্রষ্টার ইসমে আজম উদ্ধার করবেন। তিনি গাধার পিঠে চড়ে জেরুজালেম প্রবেশ করলেন। কিন্তু জুডাস ইস্ক্যারিয়ট মনীষীদের বলে দিলেন, যীশু বাইতুল মুকাদ্দাস যাচ্ছেন। তাকে এক গাছের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু ইসমে আজম ব্যবহার করে যীশু গাছ ভেঙে ফেললেন। শেষমেশ এক স্তূপ বাধাকপির ওপর তাকে দাঁড়া করিয়ে ফাঁসি দেয়া হলো। এরপর তাকে দাফন করা হলো। রবিবার দিন তার অনুসারীরা গিয়ে রানীকে বলল, যীশু নাকি আর কবরে নেই, তিনি নাকি স্বর্গে আরোহণ করেছেন। আসলে এক মালী তাকে কবর থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। পরে সেই মালী নিজেই স্বীকার করে এসে, সে লাশ সরিয়েছে। সেই লাশকে মনীষীরা পরে ঘোড়ার লেজের সাথে বেঁধে রানীর কাছে নিয়ে গেলেন। অবশেষে রানী বুঝতে পারলেন, আসলে এই লোক ভণ্ড নবী ছিল। তিনি তিরস্কার করলেন অনুসারীদের, আর প্রশংসা করলেন ইহুদী মনীষীদের।

আরেক ইহুদী বিবরণে, প্যান্ডেরা আসলে এক রোমান সেনা ছিল, যিনি মেরিকে ধর্ষণ করেন তার মাসিক চলাকালীন সময়ে। নারীদের চুল ঠিক করে দেয়ার পেশায় নিয়োজিত মিরিয়ামকে রোমান সেনা পানটেরা ধর্ষণ করে বলে তালমুদে উল্লেখ আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *