অধ্যায়-৫ মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত
সোনালি গম্বুজের চমৎকার মসজিদটি চোখে পড়লেই অনেকে মনে করেন, মসজিদুল আকসা বুঝি ওটাই। কিংবা, কেউ কেউ মসজিদুল আকসা বলতেই বোঝেন বাইতুল মুকাদ্দাসকে। সোনালী গম্বুজের মসজিদ আর মসজিদুল আকসা যে এক নয়, কিংবা বাইতুল মুকাদ্দাস বলতে আসলে কী বোঝায়, ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম সকলের কাছে কেন পবিত্র এ বাইতুল মুকাদ্দাস- এগুলো নিয়েই এ অধ্যায়, যা ইতি টানবে অনেক ভুল ধারণার।
ইসরায়েল তেলআবিব থেকে সরিয়ে ইতিহাস-বিজড়িত জেরুজালেম নগরীকে রাজধানী ঘোষণা করে ২০১৮ সালে। আব্রাহামিক সেমেটিক তিন ধর্মেরই সহস্রাধিক বছরের ধর্মীয় ইতিহাস এ নগরীকে ঘিরে রয়েছে। জেরুজালেমকে হিব্রুতে বলা হয় ‘ইয়ারুশালেইম’ বা ‘শান্তির শহর’। মধ্যপ্রাচ্যের জুদিয়া (এহুদিয়া) পাহাড়ি এলাকার মালভূমিতে ভূমধ্যসাগর আর মৃত সাগরের মাঝে এ শহরের অবস্থান। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়েরই দাবী- জেরুজালেম তাদের রাজধানী
জেরুজালেম নগরীর দীর্ঘ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ নগরী অন্তত দুবার ধ্বংস হয়, ২৩ বার অধিকৃত হয়, ৫২ বার আক্রমণ করা হয় আর উদ্ধার করা হয় ৪৪ বার! মজার ব্যাপার এ নামটাকে কেনান দেশীরা ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছিল। কুনিফর্ম হরফে লেখা লিপিতে দেখা যায়, তারা এ নগরীকে ‘উরুসালিমা’ বা শালিম এর শহর বলে, কারণ শালিম তাদের এক দেবতার নাম। এটা খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ সালের কথা। কিন্তু হিব্রুতে একই নামের অর্থ শান্তির শহর। তবে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের দিকে আসলে ইসরায়েলিরা এখানে শহর গড়ে তুলতে কাজ শুরু করে। আরবিতে এ শহরকে কুদস বলা হয়। দ্বিতীয় শতকে রোমানরা এ শহরের নাম দিয়েছিল Aelia Capitolina (ইলিয়া কাপিতোলিনা)। কখনো ‘ইলিয়া’ নামেও পরিচিত ছিল। সেই থেকে আরবিতেও নামটি হয়ে যায় ‘ইলিয়া’ (!)।
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে জুদাহ রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল জেরুজালেম। তবে তখনকার জেরুজালেম আজকের চেয়ে ছোট ছিল, পুরোনো জেরুজালেমকে আজ ‘ওল্ড সিটি’ বলা হয়। ১৫৩৮ সালে সুলতান সুলেমান পুরোনো শহরের চারপাশে দেয়াল তুলে দেন। সেই দেয়াল দেখেই আমরা আজ পার্থক্য বুঝতে পারি। ওল্ড সিটি ঐতিহ্যগতভাবে চার অংশে বিভক্ত- আর্মেনীয়, ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম অংশ। ১৯৮১ সালে ওল্ড সিটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ২০১৫ সালের হিসেবে জেরুজালেম শহরে বসবাস ৮ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী, শহরটির মোট জনসংখ্যার ৬২% ছিল ইহুদী, ৩৫% মুসলিম এবং ২% খ্রিস্টান।
বাইবেল অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে কিং ডেভিড বা হযরত দাউদ (আ) জেবুসাইটদের কাছ থেকে জয় করে নেন জেরুজালেম নগরী, এবং এরপর একে তার ইসরায়েল রাজ্যের রাজধানী বানান। তার পুত্র কিং সলোমন বা হযরত সুলাইমান (আ) সেখানের টেম্পল মাউন্ট এলাকায় ফার্স্ট টেম্পল বা প্রথম উপাসনালয়ের নির্মাণকাজ শেষ করেন। আর এখানেই আমাদের কাহিনী শুরু।
প্রথমে বুঝে নেয়া যাক টেম্পল মাউন্ট (Temple Mount) কী। হিব্রুতে একে ডাকা হয় ‘হার হা-বাইত’ নামে। ‘হার’ মানে পাহাড় বা মাউন্ট। ‘বাইত’ মানে গৃহ বা ঘর। তাই এর অর্থ ‘ঈশ্বরের ঘরের পাহাড়’। জেরুজালেমের ওল্ড সিটির এ টিলার ‘টেম্পল মাউন্ট’ কমপ্লেক্সটি মুসলিমদের কাছে ‘আল হারাম আশশারিফ’ বা ‘হারাম শরিফ’ নামে পরিচিত। মক্কার মসজিদুল হারামকেও একই নামে ডাকা হয়। আবার আল হারাম আল কুদস আল শারিফ নামেও পরিচিত এ জায়গা। উমাইয়া শাসনের যুগ থেকেই এখানে রয়েছে তিনটি ঐতিহাসিক স্থাপনা- কিবলি মসজিদ (যাকে মসজিদুল আকসা মনে করা হয়), চার মিনার, ডোম অফ দ্য রক এবং ডোম অফ দ্য চেইন। ১১টি গেট দিয়ে এখানে ঢোকা যায়, যার মাঝে ১০টি মুসলিমদের জন্য, আর একটি অমুসলিমদের জন্য। প্রত্যেক দ্বারের কাছে রয়েছে ইসরায়েলি পুলিশের গার্ড পোস্ট। তবে, স্থায়ীভাবে বন্ধ করা আরও ৬টি গেট বিবেচনা করলে মোট গেট ১৭টি।
খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে কিং সলোমন বা সুলাইমান (আ) নির্মাণ করেন ফার্স্ট টেম্পল বা প্রথম উপাসনালয়, যা বাইতুল মুকাদ্দাস নামে চিরচেনা। এটি ইহুদীদের প্রার্থনার কিবলা এবং মুসলিমদেরও প্রথম কিবলা ছিল বহু বছর। এদিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করত মদিনায় হিজরতের ১৭ তম মাস পর্যন্ত। পবিত্র কুরআনের আয়াত অনুযায়ী, এই প্রথম উপাসনালয় নির্মাণের আগেই দাঁড়ানো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সুলাইমান (আ)। ইহুদী কিতাবগুলোতে এ উপাসনালয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয় ফার্স্ট টেম্পল।
এহুদিয়া প্রদেশের পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবেলের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে নির্মিত হয় সেকেন্ড টেম্পল, বা দ্বিতীয় উপাসনালয়, সেই আগের উপাসনালয়ের জায়গাতেই। যে ব্যবিলনীয়রা ৭০ বছর আগে প্রথম উপাসনালয় ধ্বংস করে দিয়েছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার, এই জেরুবাবেল নামের অর্থই হলো “বাবেলের বীজ’। বাবেল মানে ব্যাবিলন। দুঃখের ব্যাপার, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ধ্বংস করে দেয় এটিও।
ইহুদী ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, এ জায়গাতেই নির্মিত হবে থার্ড টেম্পল বা তৃতীয় উপাসনালয়। কিন্তু আদি সেই উপাসনালয়ের চিহ্ন এখন আর নেই বিধায় কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোকে বাইতুল মুকাদ্দাস বলে সম্বোধন করা হয় না। ভাবছেন, ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ কথাটা কোথা থেকে এসেছিল? আরবিতে এর প্রচলনের অনেক আগেই হিব্রুতে সেই পবিত্র উপাসনালয় বা হোলি টেম্পলকে ‘বেইত হা-মিকদাস’ ডাকা হতো। ‘মিকদাস’ মানে পবিত্র, মুকাদ্দাস বা আল-মাক্বদিস বলতে আরবিতে যা বোঝায়, আর বেইত হলো ‘ঘর’, আরবিতে যা বাইত।
এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র ঘর’ এখন না থাকলেও অনুমান করা যায় যে এটি এই টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরীফ এলাকাতেই ছিল। ঘরটি না থাকলেও ঘরের পবিত্রতা এখনো আছে এবং ছিল। তাই এ জায়গাটিকেই বাইতুল মুকাদ্দাস বলা হয়, এবং কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোকে নয়। এ মৌলিক ধারণাটিই অনেকে বুঝতে ভুল করে, এবং মসজিদুল আকসাকে এককভাবে বাইতুল মুকাদ্দাস ভেবে প্রচার করা হয় অনেক ওয়েবসাইট ও বইতেও। ইহুদীরা এ জায়গার দিকে ফিরেই প্রার্থনা করে দিনে তিন বেলা, ঠিক যেখানে আগের দুবার বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং যে জায়গায় তৃতীয়বারের মতো সেটি নির্মিত হবে বলে তারা বিশ্বাস করে।
হয়তো আপনার মনে হতে পারে, এ জায়গা তো ইহুদীদের জন্য অনেক পবিত্র, তবে তাদের জন্য গেট কম কেন টেম্পল মাউন্টে ঢুকবার? সত্যি বলতে, ইহুদীরা একে এতই পবিত্র জ্ঞান করে যে, অনেক ইহুদী টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরিফ এলাকাতে পা ফেলে না পবিত্রতা রক্ষার্থে। কারণ, এখানেই ইহুদীদের কাছে পবিত্রতম জায়গা Holy of Holies আছে, যেখানে আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট বা তাবুতে সাকিনা (শরীয়ত সিন্দুক) ছিল। একইসাথে ছিল হযরত মূসা (আ) এর উপর বেহেশত থেকে নাজিল করা তাওরাতের দশ আদেশের ফলকগুলো। ধারণা করা হয়, ডোম অফ দ্য রকের ঠিক নিচেই এ জায়গা। যদি টেম্পল মাউন্টে হাঁটতে গিয়ে এ পবিত্র জায়গার ওপর দিয়ে পা মাড়িয়ে যায়, সেই আশংকায় বহু ইহুদী এদিকে আসে না।
বাইতুল মুকাদ্দাসের কথা তো গেল, এবার আসা যাক মসজিদুল আকসার ব্যাপারে। এ নামটি এসেছে কুরআনের সুরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াত (১৭:১) থেকে, “পরম পবিত্র মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখাতে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম (মক্কা) থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারিপাশে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি।”
আকসা অর্থ ‘দূরের মসজিদ’। ৬০০ সালের পরের যে রাতের কথা এখানে বলা হয়েছে, ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, সে সময় বাইতুল মুকাদ্দাস বা সেই উপাসনালয় ধ্বংসপ্রাপ্তই ছিল। তবে তার মানে এই নয় যে, সেই এলাকা একদম শূন্য ছিল। বরং, প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা ছিল সেই পবিত্র এলাকা। এবং সেখানে অনেকগুলো দ্বারও ছিল, ছিল পূর্ববর্তী নবীদের ব্যবহার করা জায়গার স্মৃতিচিহ্ন। উক্ত আয়াতেই উল্লেখ আছে ‘যার চারিপাশে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি’ অর্থাৎ একটি ‘এলাকা’র কথাই বলা আছে। আর আশীর্বাদপুষ্ট পবিত্র এলাকা বলতে টেম্পল মাউন্ট এলাকাই আছে সেখানে। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে দাউদ (আ)-এর মিহরাবের কথা আছে। হাদিস ও কুরআনে একে মসজিদ বলা হয়েছে, কারণ সেটি সিজদার স্থান ছিল। মসজিদ বলতে কোনো ছাদওয়ালা ইমারতকে বোঝানো হয় না সবসময়। যেমন- হাদিস অনুযায়ী, “তোমার জন্য সমগ্র পৃথিবীই মসজিদ।” (সুনান ইবনে মাজাহ)। তাছাড়া তখন মক্কার মসজিদুল হারামের ওপরেও কোনো ছাদ ছিল না।
ইসলামে নবী (সা) এর মক্কা থেকে জেরুজালেমের রাত্রিভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয়; বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকায় তিনি নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে উমার (রা) নিজে খলিফা থাকাকালে জেরুজালেম যান, যার বর্ণনা আমরা প্রসিদ্ধ আল- বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে এভাবে পাই,
“…খলিফা উমার (রা) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করলেন এবং শর্ত করলেন যে, তিন দিনের মধ্যে সকল রোমান নাগরিক বায়তুল মুকাদ্দাস ছেড়ে চলে যাবে। এরপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করলেন সেই দরজা দিয়ে, মিরাজের রাতে রাসুল (সা) যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময়ে তিনি তালবিয়া পাঠ করেছিলেন, ভেতরে গিয়ে দাউদ (আ)-এর মিহরাবের পার্শ্বে তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায আদায় করলেন। পরের দিন ফজরের নামায মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে জামাতের সাথে আদায় করলেন- এরপর তিনি ‘সাখরা’ বা বিশেষ পাথরের নিকট এলেন। কা’ব আল আহবার (রা) থেকে তিনি ঐ স্থান সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলেন। কা’ব (রা) এই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন যেন তিনি মসজিদটি ওই পাথরের পেছনে তৈরি করেন। হযরত উমার (রা) বললেন, ইহুদী ধর্ম তো শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর বায়তুল মুকাদ্দাসের সম্মুখে মসজিদ নির্মাণ করলেন। এখন সেটি উমারী মসজিদ নামে পরিচিত…।”
এখানে কতগুলো বিষয় খেয়াল করবার মতো, যেমন- রোমান নাগরিকরা বাইতুল মুকাদ্দাস কম্পাউন্ডে থাকত। টেম্পল মাউন্টের পবিত্র এলাকাটাই আসলে বাইতুল মুকাদ্দাস হিসেবে ডাকা হচ্ছে, যা প্রাচীরাবৃত। সাখরা নামের এক পাথরের কথা বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে দাউদ (আ) এর মিহরাবের কথা। এ সবগুলো জিনিস ১৪০০ বছর পর এখনো বিদ্যমান।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্টোরি অব আর্ট এন্ড আর্কিটেকচার বিভাগ থেকে নেয়া নিচের ছবিতে পাঠক দেখতে পাবেন টেম্পল মাউন্টের চিহ্নিত জায়গাগুলো- যখন নামাজের সময় হলো, তখন সোফ্রোনিয়াস তাকে চার্চে আহ্বান করলেন, কিন্তু উমার (রা) “না” বললেন। তিনি জানালেন, এখন যদি তিনি এই চার্চে নামাজ আদায় করেন, তাহলে পরে মুসলিমরা এই চার্চ ভেঙে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। এতে খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্র স্থান হারাবে। উমার (রা) এখানে কোনো জবরদস্তি করানো থেকে বিরত করলেন এ কারণে যে, এটাই সেই জায়গা, যেখানে খ্রিস্টানরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে যীশুখ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন, আর এখানের গুহাতেই তাঁর দেহ রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই চার্চ এখনো আছে, নাম হলো Church of the Holy Sepulchre ।
হযরত উমার (রা) চার্চের বাইরে বেরিয়ে নামাজ পড়লেন। পরে সেখানে আরেকটি মসজিদ বানানো হয়, নাম দেয়া হয় ‘মসজিদে উমার’। তবে উল্লেখ্য, কয়েক শতক পর (১০০৯ সালে) ফাতিমীয় খলিফা আল হাকিম উমার (রা) এর কথা সম্পূর্ণ অমান্য করে এই চার্চ ধ্বংস করে দেন। পরবর্তীতে তার পুত্র খলিফা আজ জাহির চার্চটি আবার নির্মাণ করার অনুমতি দেন। ১০৪৮ সালে সেটি বানানো শেষ হয়।
ইহুদীদের জন্যও জেরুজালেম খুব পবিত্র জায়গা। খ্রিস্টান অধিকার থেকে মুক্ত করে উমার (রা) এ স্থানে ইহুদীদের পুনর্বাসনের জায়গা করে দেন। ৭০টি ইহুদী পরিবার এখানে চলে আসে।
টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্সের ভেতরে, প্রাচীরের ভেতর পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস নামের এলাকাতেই উমার (রা) ছোট্ট এক নামাজ ঘর নির্মাণ করেন। উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান (৬৪৬-৭০৫) এ মসজিদটি পুনর্নির্মাণ ও প্রসারিত করা শুরু করেন। তার পুত্র খলিফা আল ওয়ালিদ (৬৬৮-৭১৫) নির্মাণকাজ শেষ করেন। এটিকেই ভাবা হয় মসজিদুল আকসা, কিন্তু আসলে না। এটিকে মসজিদ আল কিবলি বলা হয়। মিরাজের রাত্রে পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাসের ভেতরে যেখানে নবী (সা) নামাজ আদায় করেন বলে বর্ণিত আছে। মসজিদে উমার কিন্তু ভিন্ন আরেকটি মসজিদ। সত্যি বলতে, মসজিদে কিবলিকে আকসা মসজিদ বলাটা বেশ প্রচলিত ভুল, চিংড়িকে মাছ বলার মতোই। তাই একে গ্রহণ করে নেয়া হয়। তবে পুরো টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্সকে আল-আকসা বলা হয়, বা “আল-আকসা কমপ্লেক্স/কম্পাউন্ড”।
৭৪৬ সালের ভূমিকম্পে কিবলি মসজিদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ৭৫৪ সালে আব্বসীয় খলিফা আল মনসুর (৭১৪-৭৭৫) সেটি আবার নির্মাণ করেন। ৭৮০ সালে এটি আবার সংস্কার করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১০৩৩ সালে মসজিদটি আরেক ভূমিকম্পে আবার ধ্বংস হয়ে যায়। দু’বছর পর ফাতিমি সপ্তম খলিফা আলী আজ জাহির (১০০৫-১০৩৬) আবারও সেই জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি যে সীমানা অনুযায়ী মসজিদটি বানিয়েছিলেন, আজকের কিবলি মসজিদ ঠিক ততটুকু জায়গার উপরেই দাঁড়িয়ে। এমনকি, আজকের সেই মসজিদের কিবলা দেয়ালের মোজাইকও তার আমলের।
বিভিন্ন খলিফা নানা সময়ে এ মসজিদে অনেক কিছুই সংযোজন করেন, যেমন- মিম্বর, মিনার ইত্যাদি। তবে ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম জয় করে নেবার পর এ মসজিদকে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করে। আর বাইতুল মুকাদ্দাসেরই অপর যে মসজিদটি রয়েছে, অর্থাৎ যেটিকে আমরা সোনালি গম্বুজের জন্য চিনে থাকি, সেটিকে চার্চ হিসেবে ব্যবহার করে তখন তারা। তারা সেটাকে ডাকত Templum Domini বা Temple of God বা ঈশ্বরের উপাসনালয় নামে। মসজিদুল আকসাকে তারা ডাকত Temple of Solomon নামে, যদিও এর সাথে সুলাইমান (আ) এর কোনোই সম্পর্ক ছিল না। সেখানে তারা ঘোড়ার আস্তাবল স্থাপন করে। জেরুজালেমের গুল্ড সিটি ইসরায়েলের অধিকারে থাকলেও এ জায়গার মসজিদ জর্দানি- ফিলিস্তিনি ইসলামি সংঘ ‘ওয়াকফ’ এর অধীনে।
১১১৯ সালে মসজিদটি নাইট টেমপ্লারদের হেডকোয়ার্টার হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তারা এ ইমারতের সাথে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটো অংশ যোগ করে। বর্তমানে পশ্চিম দিকের সেই অংশ নারীদের নামাজের জায়গা এবং পূর্ব দিকের অংশটি ইসলামি জাদুঘর হিসেবে চালু আছে। ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহউদ্দিন জেরুজালেম জয় করবার পর পুরোই চেহারা বদলে ফেলেন এ মসজিদের। তিনি এর সংস্কার করেন এবং সুলতান নুর আল দীনের মিম্বর সেখানে যোগ করেন।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময় টেম্পল মাউন্ট এলাকায় বিভিন্ন নতুন জিনিস যোগ করা হলেও কিবলি মসজিদকে অপরিবর্তিত রাখা হয়। নতুন যোগ করা জিনিসের মাঝে ছিল কাশিম পাশার ঝর্ণা (১৫২৭) এবং নবীর গম্বুজ বা জিব্রাইলের গম্বুজ (১৫৩৮)। মসজিদটি শীর্ণ অবস্থায় চলে গেলে জেরুজালেমের গভর্নর সুলাইমান পাশা আল আদিল একে সংস্কার করেন ১৮১৬ সালে।
বিংশ শতকে ১৯২২ সালে প্রথম সংস্কার করা হয় মসজিদটির। এরপর আরো সংস্কার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়েই। ১৯৫১ সালের ২০ জুলাই জর্ডানের রাজা প্রথম আব্দুল্লাহকে এ মসজিদে জুম্মার নামাজে গুলি করে হত্যা করা হয়, খুনি ছিল একজন মুসলিম, নাম তার মুস্তাফা আশু (২১)। ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট ডেনিস মাইকেল রোহান নামের এক খ্রিস্টান মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার বিশ্বাস ছিল এটি ধ্বংস করলে যীশু খ্রিস্ট দ্রুত আবার পৃথিবীতে আগমন করবেন। আশির দশকে বেন শোশান ও এহুদা এতসিওন নামের দুই ইহুদী পরিকল্পনা করে বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকার মসজিদ দুটো উড়িয়ে দেবার। এতে করে ইসরায়েলের থার্ড টেম্পল নির্মাণের কাজ ত্বরান্বিত হবে!
১৯৬৯ সালে মসজিদুল আকসার উপর নতুন গম্বুজ নির্মিত হয়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে অ্যালুমিনিয়ামের বদলে সীসা দিয়ে গম্বুজকে পুনর্নির্মাণ করা হয় খলিফা আজ জাহিরের মূল নকশা ফিরিয়ে আনতে।
আল আকসা কম্পাউন্ডে একসাথে প্রায় ৫,০০০ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে। কিবলি মসজিদের গম্বুজ কিন্তু সোনালি নয়, বরং কালচে ধূসর। এর ভেতরের দিকে চতুর্দশ শতকের
ইসলামি পেইন্টিং ছিল যা ১৯৬৯ সালের আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু পরে trateggio পদ্ধতি অবলম্বন করে সম্পূর্ণ পেইন্টিং আবার ফিরিয়ে আনা হয়। মসজিদের ওজু করবার ঝর্ণাটি ‘আল-কাস’ (পেয়ালা) নামে পরিচিত।
এবার আসা যাক সোনালি গম্বুজের ডোম অফ দ্য রকের কথায়। আরবিতে একে বলে ‘কুব্বাতুস সাখরাহ’। ‘কুব্বাহ’ হলো ‘গম্বুজ’ আর ‘সাখরাহ’ হলো ‘পাথর’। হিব্রুতে ‘কিপ্পা হা-সেলা’ (nas yon)। এটি নির্মাণ করেন উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ৬৯১ সালে। তিনি এটা ঠিক সেই জায়গায় নির্মাণ করেন যেখানে ইহুদীদের সেকেন্ড টেম্পল বা দ্বিতীয় বাইতুল মুকাদ্দাস রোমানরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। রোমানরা সেখানে জুপিটারের মন্দির বানিয়েছিল, সেটির জায়গায় আব্দুল মালিক বানান এই ডোম অফ দ্য রক বা কুব্বাতুস সাখরাহ। গম্বুজটি ১০১৫ সালে ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু ১০২২-২৩ সালে পুনর্নির্মিত হয়। ইসলামি স্থাপত্যবিদ্যার প্রাচীনতম নিদর্শনের একটি এই আটকোণা ইমারত।
প্রশ্ন জাগতে পারে, এখানে যে পাথরের কথা বলা হচ্ছে, কী সেই পাথর? সত্যি বলতে, এ পাথর হচ্ছে এই পুরো টেম্পল মাউন্টের অন্তর্গত সবচেয়ে পবিত্র জিনিস। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এ পাথরের ওপর ভর রেখে হযরত মুহাম্মাদ (সা) উর্ধ্বারোহণ করেন মিরাজের রাত্রিতে। নিশ্চিত সূত্রে বর্ণিত না হলেও কথিত আছে, ফেরেশতা ইসরাফিল (আ) এ জায়গা থেকেই কিয়ামতের জন্য শিঙায় ফুঁৎকার দেবেন।
আর, ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী, এর নাম ভিত্তিপ্রস্তর, বা ফাউন্ডেশন স্টোন। হিব্রুতে ডাকা হয় এভেন হা-স্তিয়া। এটিই হোলি অফ দ্য হোলিজ এর অবস্থান বলে বিশ্বাস করা হয়। এমনকি একে মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুও বলা হয়েছে ইহুদী কাব্বালা সাহিত্যের জোহারে। এর নিচে আছে আত্মাকুয়া বা ওয়েল অফ সোওলস নামের এক গুহা, যাকে ঘিরে আছে নানা কাহিনী- তবে সেই কথা হবে হয়তো অন্য কোনো বইতে।
নীলচে পাথরটি মাটি থেকে দেড় মিটার ওপরে অবস্থিত। ফাউন্ডেশন স্টোনের দিকেই ইহুদীরা প্রার্থনা করে। এটিই আদি কিবলা।
১১৮৭ সালে সালাহউদ্দিন জেরুজালেম জয় করার পর ডোম অফ দ্য রকের ওপরের ক্রুশ নামিয়ে ফেলেন। সুলতান সুলেমান তার রাজত্বকালে (১৫২০- ১৫৬৬) এ স্থাপত্যের বাইরে টাইলস লাগিয়ে দেন পুরোটা জুড়ে। আর ভেতরে লাগানো আছে মোজাইক ও মার্বেল, যাতে লিখিত কুরআনের আয়াত। সুলতান সুলেমানের নির্দেশে টাইলজুড়ে সুরা ইয়াসিন লিখিত হয়। তার ওপরে লেখা হয় সুরা ইসরা বা সুরা বনী ইসরাইল, কারণ সেখানে নবী (সা) এর এই বাইতুল মুকাদ্দাসে আসবার কথা লিখিত আছে।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সময় ডোম অফ দ্য রকের মাথায় ইসরাইলের পতাকা ওড়ানো হয়। কিন্তু শীঘ্রই ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে দায়ানের নির্দেশে সেটি নামিয়ে ফেলা হয় এবং এর দায়িত্ব দেয়া হয় মুসলিম সংগঠন ওয়াকফের হাতে। এখনো ওয়াকফের হাতেই এর অধিকার রয়েছে।
জর্ডানের রাজা হুসাইন ১৯৯৩ সালে তার একটি বাড়ি বিক্রি করে পাওয়া ৮.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে ৮০ কেজি সোনা কিনে তা দান
করে দেন এ ডোম অফ দ্য রকের জন্য। সেই সোনাই আজ জ্বলজ্বল করে ডোম অফ দ্য রকের গম্বুজে।
ইসরাইলি পুলিশ নিশ্চিত করে যেন টেম্পল মাউন্ট এলাকায় কোনো অমুসলিম প্রার্থনা করতে না পারে। এমনকি অমুসলিমরা সেখানে কোনো প্রার্থনার বই বা ধর্মীয় পোশাক পরেও যেতে পারে না।
মূল ধারার ইহুদী র্যাবাইরা ইহুদীদেরকে টেম্পল মাউন্টে যেতে নিরুৎসাহিত করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, টেম্পল মাউন্টের বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা ঘিরে রাখা প্রাচীরের নির্মাণকাজ হেরোদ দ্য গ্রেট শুরু করেন, যখন কি না সেকেন্ড টেম্পলের জন্য এলাকাটা প্রসারিত করা হচ্ছিল। সেই প্রাচীর বা দেয়ালের একটি অংশ হলো ওয়েইলিং ওয়াল (Wailing Wall) বা কোটেল (Kotel)। পুরো দেয়ালটি ওয়েস্টার্ন ওয়াল নামে পরিচিত। আরেক নাম ‘বুরাক দেয়াল’, কারণ ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, মিরাজের রাত্রে এ দেয়ালে নবী (সা) তাঁর বাহন বুরাক প্রাণীটিকে বেঁধেছিলেন।
কিং সলোমন বা সুলাইমান (আ) বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করলেও এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ) বা বাইবেলের জ্যাকব। ইয়াকুব (আ) বীরশেবা থেকে বেরিয়ে হারান মরুর দিকে যাচ্ছিলেন। এখানে তিনি সন্ধ্যার পর ঘুমালে স্বপ্ন দেখেন যে, পৃথিবী থেকে একটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সেখানে আল্লাহর ফেরেশতারা ওঠা-নামা করছে। স্বপ্নে আল্লাহ তাঁকে জানালেন, যেখানে হযরত ইয়াকুব (আ) শুয়ে আছেন, সেই ভূমি তিনি তাঁকে দেবেন, এবং তার বংশধরকে। তাঁর বংশধরেরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। স্বপ্ন দেখে তিনি জেগে উঠলেন। এই সিঁড়ির স্বপ্ন ‘জ্যাকবস ল্যাডার ড্রিম’ নামে পরিচিত যা আগেও বলা হয়েছে। এ স্বপ্নের মাধ্যমে তিনি পবিত্র ভূমির প্রতিশ্রুতি পান। ‘লুজ’ নামের সেই জায়গার নাম তিনি ‘বেথেল’ (বাইতুল্লাহ) বা ‘ঈশ্বরের ঘর’ রাখলেন।
ইবনে কাসিরের আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে আছে, তিনি ওয়াদা করলেন যে, ভবিষ্যতে তিনি যদি নিরাপদে পরিবারের কাছে ফেরত যেতে পারেন, তবে শুকরিয়া স্বরূপ ঠিক এ জায়গায় আল্লাহর জন্য একটি ইবাদতখানা নির্মাণ করবেন। পাথরের উপর বিশেষ তেল দিয়ে তিনি জায়গাটা চিহ্নিত করেও রাখলেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর কাহিনী শেষে বহু বছর পর তিনি শাখীম এলাকার ‘উরশালিম’ নামের এক গ্রামে পৌঁছান। সেখানে শাখীম ইবনে জামুরের এক টুকরো জমি তিনি ১০০ ভেড়ার বিনিময়ে কিনে নেন ও সেখানে তিনি একটি কোরবানগাহ নির্মাণ করেন। সেটির নাম তিনি রাখেন ‘এল ইলাহী ইসরাইল’ (ইসরাইলের মাবুদই আল্লাহ)। তাফসিরকারক ইবনে কাসির লেখেন, এ কোরবানগাহ নির্মাণের আদেশ আল্লাহ দিয়েছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ)-কে এটিই পরবর্তীতে বাইতুল মুকাদ্দাস হয় সুলাইমান (আ) এর হাত ধরে।
মসজিদুল আকসা কম্পাউন্ড বলে যে ‘স্থাপনা’ আজ দেখা যায়, নবী (সা) এর সময়ে এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আবার বাইতুল মুকাদ্দাস উপাসনালয় বলে যার বর্ণনা ইহুদী কিতাবে ছিল, তা-ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় প্রাচীরের ভেতরে তা ছিল না। কিন্তু এ জায়গাটিকে বোঝাতে হাদিসে মসজিদুল আকসা বলেই সম্বোধন করা হয়েছে। হাদিসে আছে,
“আবু যার গিফারী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন: মসজিদুল হারাম। বর্ণনাকারী বলেন, আমি আবার বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বলেন: তারপর মসজিদুল আকসা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বলেন: চল্লিশ বছরের।” (বুখারি শরিফ, ৪:৫৫:৫৮৫)
কুরআন অনুযায়ী, ইয়াকুব (আ) এর দাদা ইব্রাহিম (আ) মক্কায় মসজিদুল হারাম বা কাবাঘর নির্মাণ করেন পুত্র ইসমাইল (আ)-কে নিয়ে। অবশ্য কিছু অতি দুর্বল বা বাতিল হাদিসে আদম (আ) এর প্রথম কাবা নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।
এই পুরো লেখাকে সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাইতুল মুকাদ্দাস বা পবিত্র ঘর ছিল হযরত সুলাইমান (আ) এর নির্মিত, যা টেম্পল অব সলোমন নামে পরিচিত। সেটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় পরে দ্বিতীয় আরেকটি উপাসনালয় নির্মাণ করা হয় যাকে সেকেন্ড টেম্পল ডাকা হয়, ফলে আদি বাইতুল মুকাদ্দাস পরিচিত হয় ফার্স্ট টেম্পল নামে। এই উপাসনালয় আগে যে বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল সেটি বাইতুল মুকাদ্দাস হিসেবে মেনে নেয়া হয়। তাই টেম্পল মাউন্ট বা বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা প্রায় সমার্থক। তাই বাইতুল মুকাদ্দাস বলতে কোনো নির্দিষ্ট ইমারতকে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু এখন সেই বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে ছোট-বড় নানা স্থাপনা। এর মাঝে একটি হলো মুসলিমদের কিবলি মসজিদ, বাইতুল মুকাদ্দাসের যে জায়গায় পূর্বে নবী (সা) মিরাজের রাত্রে নামাজ পড়েছিলেন। আর আরেকটি স্থাপনা হলো কুব্বাতুস সাখরাহ বা সোনালি গম্বুজের ডোম অফ দ্য রক। এখানে রয়েছে সেই পাথর, যার উপর নবী (সা) ভর রেখে উর্ধ্বারোহণ করেন বলে বলা হয়, এবং একইসাথে যা কি না ইহুদী ধর্মের ফাউন্ডেশন স্টোন বা ভিত্তিপ্রস্তর ও তাদের কাছে মহাবিশ্বের পবিত্রতম স্থান। এই সবগুলো স্থাপনা একত্রে যে কম্পাউন্ডে অবস্থিত, সেটিই আসলে ‘মসজিদুল আকসা’ এলাকা। ইহুদী ও খ্রিস্টানরা একে চেনে পবিত্র টেম্পল মাউন্ট নামে; একে বাইতুল মুকাদ্দাসও বলা যায়। আসলে মূল কোনো স্থাপনাই অবশিষ্ট না থাকায় নাম নিয়ে এত বিভ্রান্তি আর দোটানা। বাইতুল মুকাদ্দাস মক্কা ও মদিনার পরে মুসলিমদের কাছে তৃতীয় তীর্থস্থান।
নিচে পুরো কম্পাউন্ডের একটি ভিউ দেখানো হলো, যেখানে বাইতুল মুকাদ্দাস আর কিবলি মসজিদ দেখা যাচ্ছে আলাদা করে-
পুরো কম্পাউন্ডটিকে বলা হয় আল-আকসা কম্পাউন্ড, বা টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্স। সত্যি বলতে, পবিত্র কুরআনে (১৭:১) মিরাজের রাত্রে নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর ইসরা তথা মক্কা থেকে জেরুজালেম ভ্রমণের যে ঘটনা উল্লেখিত আছে, সেখানেও মসজিদুল আকসা বলা হয়েছে, খোদ কুরআনেই! কিন্তু তখন তো কোনো ইমারতই সেখানে ছিল না; আমরা ইতিহাস থেকে ভালো করেই সেটা জানি। ইসলামে, পুরো জমিনই মসজিদ বলে বিবেচিত, আর ‘আকসা” অর্থ ‘দূর’। মসজিদুল আকসা মানে দূরের মসজিদ। এখানে নবী (সা) নামাজ আদায় করেন বলে সীরাতে জানা যায়।
এই ছবি থেকে চিনে নিন আল-আকসা। ইংরেজি মানচিত্রটিকে বাংলায় অনুবাদ করে দিলাম পাঠকদের সুবিধার্থে। ভালো করে দেখে নেয়া যাবে এখান থেকে।
বহুদিন ধরে মুসলিমদের মাঝে বাইতুল মুকাদ্দাস আর মসজিদুল আকসা চিহ্নিতকরণ নিয়ে চলে আসা সংশয়ের সচিত্র সমাধান করাই ছিল এ অধ্যায়ের উদ্দেশ্য। সেই সাথে এ সংক্রান্ত ইতিহাসও তুলে ধরা। ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের কাছে পবিত্র এ ভূমি তিন ধর্মের এক মিলনস্থল হিসেবে কাজ করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।