অধ্যায় ৫ – আলীবর্দী ও ইউরোপীয় বণিক
ইংরেজ, ফরাসি ও ডাচরা ছিল বাংলার মুখ্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ী, গৌণ দিনেমার, প্রুশীয় আর পর্তুগিজদের পাশাপাশি। আলীবর্দী ভালোমতোই জানতেন যে অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় এনে, তার রাজ্যের বণিকদের উপর নজরদারি করা প্রয়োজন। সেসময়ের কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জিন ল বলেছেন, তিনি নির্ভুলভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তার সরকারের স্বার্থ দরিদ্র বণিকদের পক্ষে আর তার কান পর্যন্ত কোনো অভিযোগ গেলে তার সুবিচার নিশ্চিত করা। কলকাতার কাউন্সিল ১৭৪৭ সালে উল্লেখ করেছে যে, দুই পক্ষের সম্মতিতে এই দরবারগুলোতে (নবাব ও সহকারী নবাবের দরবার) ন্যায়সম্মতভাবে বণিকদের হিসেব-নিকেশ মেটানোর অনুমতি দেওয়ার প্রথা ছিল। স্ক্র্যাফটন লিখেছেন, আলীবর্দী ইউরোপীয়দের মৌমাছির চাকের সঙ্গে তুলনা করতেন লাভের জন্য যার মধু নিংড়ানো যায় আবার তাদের চাকে যদি তুমি অসুবিধের সৃষ্টি করো তাহলে তারা তোমাকে হুল ফুটিয়ে মারবে । এভাবে যখন বাংলা চরমভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল মারাঠা আক্রমণে, তিনি ইংরেজ, ফরাসি ও ডাচদের থেকে আর্থিক সহায়তা আদায় করে নিয়েছিলেন, তার উদ্দেশ্য ছিল মৌমাছির চাককে বিরক্ত না করে মৌমাছির পালক হিসেবে কেবলমাত্র লাভটুকু বের করে নেওয়া।
মারাঠা আক্রমণের সময়ে আলীবর্দীর ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ ও ডাচদের থেকে অর্থ সংগ্রহ
মারাঠা আক্রমণের কারণে বাংলার অর্থ-সম্পদের নাশ হয় বহুলভাবে। তাই নবাব ইউরোপীয় বণিক কোম্পানিগুলোকে প্রদেশের সুরক্ষায় আর্থিক সহায়তা করতে বলেন, যেখানে তারা তার হাত শক্ত করার জন্য অংশ নেবে আর বাণিজ্যে লাভ বুঝে নেবে। ১৭৪৪ সালের জুলাইয়ে তিনি ইংরেজদের অভিযুক্ত করেন মারাঠাদের সহযোগিতার দায়ে, আর দেখান যে, ইংরেজ (যারা এখন) আগে ৪-৫টি জাহাজ নিয়ে পুরো বিশ্বে বাণিজ্য করছে, আর এখন তারা ৪০-৫০টি জাহাজ এনেছে, যেগুলো কোম্পানির নয়… । বাংলায় তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধা দেওয়া হয়, যতক্ষণ-না তারা তাকে ৩০ লক্ষ রুপি পরিশোধ করছে, যা দিয়ে তিনি সৈন্যদের দুমাসের বকেয়া বেতন দেবেন। তাদের কিছু গোমস্তাকে গ্রেফতার করা হয়, আর সামরিক প্রহরা বসানো হয় গুররাহ আড়ংয়ে। কোম্পানির এক গোমস্তা প্রিট কোটমাকে নির্যাতন করা হয়, যতক্ষণ-না তিনি এক লক্ষ ৩৫ হাজার রুপি দিতে সম্মত হন, এরপর আরেক নিপীড়কের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেটাকে বাড়িয়ে তিন লক্ষ রুপি করার জন্য; এক দাদনি ব্যবসায়ীর গোমস্তা নরসিংহ দাসের সঙ্গেও রূঢ় ব্যবহার করা হয়; ইংরেজদের আরেক গোমস্তা বেলি কোটমাহ কাশিমবাজারে পালিয়ে যান আর কাশিমবাজারের ব্যবসায়ী কেবলরামকে গ্রেফতার করা হয়।
নবাবকে খুশি করার ইংরেজ প্রচেষ্টা
এই পরিস্থিতিতে, কলকাতার কাউন্সিল কাশিমবাজারের কুঠিয়ালদের অনুমতি দেওয়া নবাবকে ভালো দফতর আর জগৎশেঠ ফতেহচাঁদ ও চিনরায়ের (?) মাধ্যমে ৪০ থেকে ৫০ হাজার রুপি দেওয়ার প্রস্তাব করার। কিন্তু ফতেহচাঁদ এই পরিমাণ অর্থ নবাবের মনঃপূত হবে না বলে রায় দেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে তিনি অনুমোদন করার মতো ক্ষমতাবান হলে, পাঁচ (লক্ষ) রুপি তিনি নবাবকে গ্রহণ করতে বলতেন, ফরাসি ও ডাচেরা ইতোমধ্যেই তাদের অংশ দিতে রাজি হয়েছে নবাবের ইংরেজদের সঙ্গে বোঝাপড়ার উপর বিবেচনা করে, আর সুজা দৌলতের (সুজাউদ্দিন) সময় এর থেকে বেশি অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে …। কলকাতার কাউন্সিল এরপর কাশিমবাজার কুঠির প্রধান ফর্স্টারকে নির্দেশ দেন নবাবকে এক লক্ষ টাকা প্রস্তাব করার, আর সেভাবেই যেন তাদের উকিলকে পাঠানো হয় দরবারে। কিন্তু নবাব জবাব দেন, ইংরেজরা এখন পর্যন্ত পুরো দেশজুড়ে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করছে (আর) বেশকিছু গোপন দাঙ্গার কারণ হয়েছে, এবং বেলি কোটমাহকে তার কাছে নিয়ে আসতে বলেন, তাদের ভয় দেখান যে তিনি সব কুঠি ঘিরে ফেলে রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেবেন, আর তাতেও যদি তারা তার দাবি মেনে না নেয়, (তখন তিনি) আড়ং থেকে তাদের সমস্ত অর্থ আর মালামাল বাজেয়াপ্ত করবেন।
ফর্স্টারের সঙ্গে নবাবের সাক্ষাৎ ও মীমাংসা
ব্যাপারটা যখন আবারো ফতেহচাঁদ আর চিনরায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছায়, তারা কোম্পানির উকিলদেরকে জানান, নবাব দুই বা তিন লাখে সন্তুষ্ট হবার নয়, (তিনি) তার সৈন্যদের বকেয়া পরিশোধে এতটাই বদ্ধপরিকর যে তিনি তার জীবনের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করবেন না; সামরিক কর্মকর্তারা তাকে প্ররোচিত করছেন তিনি যেন ইংরেজদের উপর ও আড়ংয়ে আক্রমণের আদেশ প্রদান করেন। তাই তারা কোম্পানিকে চটজলদি করে নবাবকে সন্তুষ্ট করার মতো পরিমাণের যে-কোনো প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেন। পরিস্থিতির ধনাত্মক-ঋণাত্মক দিক বিবেচনা করে, আর ক্রয় করা পণ্যের সাধারণ ক্ষতির আশঙ্কায়, কলকাতার কাউন্সিল সৈয়দ আহমাদ খানকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নবাবের সামনে গিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদানের। সৈয়দ আহমাদ খান প্রতিজ্ঞা করেন এই চার লক্ষ রুপির বিনিময়ে সমপরিমাণ অর্থের ব্যবসায়ের পরোয়ানা নিয়ে আসার। কিন্তু তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারেননি। তাই ফস্টার কলকাতার কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৭৪৪ সালের ২৮ অগাস্ট নবাবের সঙ্গে দেখা করেন। নবাব তাকে ধুমধামের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান, তাকে তিনি সারপাও (সারাপা, সম্পূর্ণ খিলাত বা সম্মানের পোশাক) প্রদান করেন ও কোম্পানি সেপ্টেম্বর মাসে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দেবে— এই মীমাংসায় আসেন। কাশিমবাজারের কুঠিয়ালরা নবাবের সেনাপতি ও কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত ৩০ হাজার ৫০০ রুপি দেবেন বলেও সিদ্ধান্ত হয়। পাটনার কুঠিয়ালরাও পাঁচ হাজার রুপি নবাবকে আর তার কর্মকর্তাদের তিন হাজার রুপি দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেয়, পাশাপাশি ৪,৫৩৭-৯-৬ পাইয়ে চুপরাহ শহরের কুঠির ভাড়ার চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়; আর ঢাকা কুঠিও পাঁচ হাজার রুপি দিতে সম্মত হয়। নবাবকে একটি চমৎকার ঘোড়াও উপহার দেওয়া হয় যার জন্য কোম্পানিকে গুণতে হয়েছিল আড়াই হাজার মাদ্রাজি রুপি। কোম্পানির বাণিজ্যের উপর তখন সমস্ত বিধি- নিষেধ তুলে দেওয়া হয় আর কোম্পানির সমস্ত গোমস্তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
১৭৪৮-এ নতুন সমস্যা
কিন্তু খুব দ্রুত চার বছর পেরিয়ে যায় আর নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১৭৪৮ সালে কমোডর গ্রিফিন, বা তার সঙ্গীরা আর্মেনীয় ও বাংলার মুঘল বণিকদের কিছু বাণিজ্যতরী আটক করে, আর তারা নবাবের কাছে বিচার দেন এর বিহিত করতে। নবাব কলকাতায় কোম্পানির প্রশাসক বেয়ারওয়েলের কাছে একটি পরোয়ানা পাঠান : হুগলির সৈয়দ (আরব), মুঘল, আর্মেনীয় ইত্যাদি বণিকেরা অভিযোগ জানিয়েছে যে তাদের জাহাজের সঙ্গে লক্ষ টাকার পণ্য ও সম্পদ দখল ও লুট করা হয়েছে, আর আমাকে বিদেশি সূত্রে জানানো হয়েছে হুগলিতে সেই জাহাজগুলো বেঁধে রাখা হয়েছে ফরাসিদের জাহাজ হিসেবে। মোকেল (মোকা) থেকে যাত্রা শুরু করা লক্ষ টাকার পণ্যবোঝাই এই জাহাজ অ্যান্টনির আর সেই এলাকার কোতোয়াল আমাকে বিভিন্ন তথ্য প্রেরণ করেছেন যে সেই জাহাজ আপনারা দখল করে লুট করেছেন। এই বণিকেরা সাম্রাজ্যের জন্য উপকারী, তাদের আমদানি ও রপ্তানি করা পণ্য সবার জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, আর তাদের অনুযোগ এতটাই তীব্র যে আমার কান আর সেগুলো শুনতে চাইছে না। যেহেতু আপনাদের দস্যুবৃত্তির অনুমতি দেওয়া হয়নি, তাই এই পত্রপাঠ আপনারা বণিকদের সমস্ত পণ্য ফিরিয়ে দেবেন এবং আমাকে জানাবেন, নইলে আপনারা নিশ্চিত থাকুন এই ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য উপযুক্ত শাস্তি আশা করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গেই কোর্ট অফ ডিরেক্টরস সুদৃঢ় নির্দেশ পাঠায় কলকাতার কাউন্সিলকে, যেন বাংলা সরকারের কোনো শর্তই না মানা হয়, আর বারওয়েলও নবাবের নির্দেশমতো কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি উত্তর দেন যে পণ্যগুলো দখল করেছে রাজার জাহাজ, যার উপরে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, আর ফরাসিরা, যারা ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করছিল, তারাও আর্মেনীয়দের কিছু পণ্য আটক করেছিল তাদের শত্রুদের পণ্য ভেবে।
ইংরেজ বণিকদের বিরুদ্ধে নবাবের দমনমূলক নীতি
এমন উত্তর নবাবের মনঃপূত হয়নি, তিনি ইংরেজ বণিকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের দমনমূলক নীতি গ্রহণ করতে শুরু করেন তাদের বিভিন্ন কুঠিগুলোয়। মালদার কোম্পানির বণিক ও গোমস্তারা অভিযোগ করে যে নবাবের কিছু কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন তাদের অত্যধিক অর্থের চাহিদানুযায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায়। ঢাকা ও জগদিয়ার কুঠিগুলো নিত্যনৈমিত্তিক পণ্যের অভাবে ভুগতে থাকে, যেমন নবাবের কর্মকর্তারা খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করেন। এই কর্মকর্তারা কেবলমাত্র ঢাকার সমস্ত বণিক ও পোদ্দারদের সঙ্গেই নয়, মুতচুল্লাকাস (লিখিত চুক্তি) করেছিলেন মুদি-দোকানিদের সঙ্গেও যেন তারা ইংরেজ কুঠিয়ালদের কোনো রসদ ও অন্যান্য সদাইপাতি সরবরাহ না করে। এটা ঢাকার কুঠিয়ালদের সৈন্য আর চাপরাসিদের ভেতর এক ধরনের বিদ্রোহ সৃষ্টি করে, কুঠিয়ালদের বাধ্য করে তারা নবাবের দরবারে সংবাদ পাঠাতে, যদি রসদ বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে তারা যেখানে যা পাবে, তাই কেড়ে নেবে, ক্ষুধার্ত হয়ে মরার চেয়ে লড়াই করে মরা ভালো, যার উপরে ভিত্তি করে অল্পকিছু ভাতা আনা হয়েছিল । কিন্তু এরপরও তাদের ধরপাকড় করা হচ্ছিল, ফলে দু-একদিনের মধ্যে রসদ সরবরাহ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল সৈন্যদের বিদ্রোহের কারণে, যারা ইতোমধ্যেই তাদের বকেয়া বেতন না-পাওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়ে ছিল।
আত্মীয়দের মাধ্যমে নবাবকে খুশি করার ইংরেজদের চেষ্টা ও বিরোধ মেটানোর প্রয়াস
১৭৪৮ সালের মে মাসের শুরুতে কলকাতার কাউন্সিল নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খান ও চ্যামেরাজকে (শ্যামরাজ?) অনুরোধ করেন নবাবকে চিঠি লিখে (নবাব তখন পাটনায়) পরিস্থিতি নিরসনের। তারা কাউন্সিলের অনুরোধ রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, কিন্তু এটাও বুঝলেন যে সদ্য ঘটে যাওয়া বিহারের আফগান বিদ্রোহের কারণে নবাবের মন তখন বিক্ষিপ্ত, তাই তার কাছে তাদের চিঠি খুব সামান্যই গুরুত্ব পাবে । কিন্তু ১৭৪৬ সালের মার্চে নিযুক্ত কাশিমবাজারের কুঠি প্রধান ওয়াডহ্যাম ব্রুক বিশ্বাস করেছিলেন যে বিহারের বিপর্যয়ের পর নবাব আর হিংসাত্মক পদক্ষেপ নেবেন না, তবে তাকে আরও সহজ শর্ত দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে অন্ততপক্ষে যতক্ষণ-না অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । তাই তিনি ১৭৪৯ সালের ২ জানুয়ারি কলকাতার কাউন্সিলকে বলেন যে, নবাবকে সন্তুষ্ট করার জন্য সেসময়ে সদ্য কলকাতায় ছাড় হওয়া চমৎকার আরব্য ঘোড়া উপহার দিতে, আর হাজী আহমাদ নিজের জন্য যে বার্ষিক তিন হাজার ৬০০ রুপি চেয়েছেন সেটা প্রত্যাশার আগেই তাকে দিয়ে দিতে ব্যবসায়ের মাধ্যম হিসেবে । এত অল্প আর সুবিধাজনক শর্তে নবাবকে হাতে রাখার এই পরিকল্পনা কলকাতার কাউন্সিল মঞ্জুর করে, আর তাদের সুবিধাজনক সুযোগে নবাবকে উপহার হিসেবে আরব্য ঘোড়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
নবাবকে ঠাণ্ডা করার ওয়াডহ্যাম ব্রুকের চেষ্টা
শেঠদের ও হুকুম বেগ (হাকিম বেগ), কারুলি বেগ, বিরাম দত্ত (বীরু দত্ত), গোলাম হুসাইনসহ আরো বেশকিছু নবাবের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ওয়াডহ্যাম ব্রুক নবাবের দৃষ্টিভঙ্গি জানার ও কোম্পানির এ-ধরনের দুর্দশার শেষ করার চেষ্টার পাশাপাশি নবাবকে সন্তুষ্ট করার নিশ্চিত উপায় খুঁজছিলেন। ১৭৪৯ সালের মার্চে কারুলি বেগ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিতে যান আর সেখানকার কর্মকর্তাদের জানান যে, নবাব আশা করছেন যে ইংরেজরা যেন আর্মেনীয়দের অতিসত্বর সন্তুষ্ট করে, আর তিনি আদেশ করেন দুইশো বক্সারিকে (বক্সার এলাকার ম্যাচলক বন্দুকবাজ) কুঠিতে নিয়োজিত করার । এছাড়াও তিনি স্বেচ্ছায় তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ইংরেজ ও আর্মেনীয়দের মধ্যস্থতা করতে সম্মত হন। তার পরামর্শমতো ১৭৪৯ সালের ২৪ এপ্রিল, ওয়াডহ্যাম ব্রুক কলকাতায় তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লেখেন, তারা যেন স্থানীয় আর্মেনীয়দের স্বাক্ষরসহ একটি অঙ্গীকারনামা নবাবের উদ্দেশ্যে পাঠান যে তারা ইংরেজদের মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া ক্ষতির ব্যাপারে এখন সন্তুষ্ট রয়েছে। তিনি আরও জানান যে কোম্পানির ব্যাপারে নবাবের দমনমূলক নীতি নিয়ে জনসাধারণ্যে প্রচলিত যে নবাব উভয়ের (কোম্পানি ও আর্মেনীয়দের) থেকেই কিছু অর্থ আদায়ের চেষ্টায় রয়েছেন, যা কিছুদিন আগেও বলা হচ্ছিল ৫০ হাজার রুপির আশেপাশের কোনো একটা সংখ্যা; আর তিনি কী চাইছেন সেটা তারা পরিষ্কারভাবে জানার আগেই তাদেরই একটা প্রস্তাব দিতে হবে। ওয়াডহ্যামের প্রস্তাবনামতো কলকাতার কাউন্সিল সেখানকার আর্মেনীয়দের একটি কাগজে স্বাক্ষরের জন্য বলে; ১ জুন, ১৭৪৯ তারিখে যখন তারা উপস্থিত হয় (সম্ভবত তাদের কাউন্সিলে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল), তখন তারা এ-ধরনের স্বাক্ষর করতে অনীহা প্রকাশ করে। এ সময়ে কাউন্সিলের বেশিরভাগ সদস্য রায় দেন যে যদি ইংরেজরা বাধ্য হয় নবাবকে অর্থ দিতে, আর আর্মেনীয়রা যদি সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ না করে নবাবকে, তাহলে তাদের দুমাস সময়ের মধ্যে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করা হবে। উইলিয়াম ক্যাম্পে নামের এক সদস্য এমন মতও দেন যে, এই দুমাস সময়ও কোম্পানির বাণিজ্যকে ব্যাহত করবে, সেটা যতদূর প্রতিরোধ করা সম্ভব… জাহাজ বোঝাই করার মতো পণ্য জোগাড় করলে; তারা (প্রকৃতপক্ষে) সঙ্গে সঙ্গে (নবাবকে) খুশি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু কাউন্সিল যথেষ্ট প্রজ্ঞা দেখিয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করতে পারে, তাড়াহুড়ো করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকে।
বালেশ্বরে নবাব ও কেলসালের সাক্ষাৎ
ওয়াডহ্যাম ব্রুককে কেবল সন্তুষ্টির দলিলে আর্মেনীয়দের স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতির কথা জানানো হয়েছিল, আর একই সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানানো হয় যে বালেশ্বরের কুঠিপ্রধান হেনরি কেলসালকে আদেশ করা হয়েছে বালেশ্বরে অবস্থানরত মারাঠাদের পিছু নেওয়া নবাবকে খুশি করার। ওয়াডহ্যাম ব্রুককে ও আদেশ দেওয়া হয় তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে ইংরেজ বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নবাব সরকারকে প্রস্তাব দিতে, প্রয়োজনে ১৫ থেকে ২০ হাজার রুপি খরচও করতে বলা হয়। তিনি ১৪ জুন এর জবাব দেন যে, তিনি শেঠদের সঙ্গে ও বিরাম দত্তের সঙ্গে আলাপ করেছেন, আর তারা জানিয়েছেন নবাবের মুর্শিদাবাদে ফিরে আসার আগে কিছুই করা সম্ভব হবে না। তিনি আরও মত দেন যে ১৫ থেকে ২০ হাজার রুপি যথেষ্ট হবে না (যদি নবাব নিজের জন্য কিছু না রেখে তাদের অনুগ্রহও করেন) কাশিমবাজার কুঠিতে থাকা সামরিক প্রহরীদের খুশি করতে, আর তাই কলকাতার কাউন্সিল নবাব মুর্শিদাবাদে ফেরত আসামাত্র খর্ব হওয়া বাণিজ্য-স্বাধীনতা পুনরায় ফিরে পেতে সর্বোচ্চ কতটা অর্থ লাগতে পারে তার ধারণা জানতে চান তার কাছে।
এরমধ্যে ৯ জুন কেলসাল কলকাতার কাউন্সিলের সভাপতির চিঠি নিয়ে বালেশ্বরে নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যেখানে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে… কোম্পানির কর্মকাণ্ড… আর্মেনীয় ও অন্যদের অন্যায্য অভিযোগের ও কাশিমবাজারের কুঠিতে সৈন্য নিয়োগের কারণে , এবং একই সঙ্গে তাকে অনুরোধ করা হয় আর কোনো উৎপীড়ন ছাড়াই কোম্পানিকে আগের মতো স্বাভাবিকভাবে যেন বাণিজ্য করার অনুমতি দিতে। তিনি বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে নবাবকে বোঝানোর চেষ্টা করেন বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া কতটা ক্ষতিকর হবে তার রাজস্ব ও কোম্পানির জন্য।
নবাবকে কেলসালের সহযোগিতা
নবাব তখন তাকে আশ্বস্ত করেন যে মুর্শিদাবাদ ফিরে তিনি ইংরেজদের এই সমস্যা দূরীভূত করার চেষ্টা করবেন, আর তার কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে করে যেন তার কামান ও গোলাবারুদ দ্রুত কলকাতায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেন, তিনি সেগুলো বৃষ্টির কারণে পথের বাজে অবস্থায় নিতে অপারগ। কেলসাল তাকে সেভাবেই সহযোগিতা করেন।
নবাবের মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন ও তাকে খুশি করার ইংরেজদের অব্যাহত প্রচেষ্টা
১৭৪৯ সালের জুলাই মাসের শুরুতে নবাব মুর্শিদাবাদে ফিরে এলে কলকাতার কাউন্সিলের সভাপতি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখে পাঠান : আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি, আমাদের বালেশ্বরের প্রধান কেলসাল; আপনি যে অনুগ্রহ চেয়েছিলেন তাতে সম্মত হয়ে আমাকে সম্মানিত করেছেন। পালানকুইন (পালংকী/পালকি), বাঁশ, অন্যান্য পণ্য যা নবাব চেয়েছিলেন তা ডিঙিনৌকায় এসে পৌঁছেছে, যা সঙ্গে সঙ্গেই আমি হুগলির ফৌজদারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, আর যা কিছু এখনও বালেশ্বরে রয়ে গেছে, তা আসামাত্রই তার কাছে পাঠানো হবে । ১৭৪৯ সালের ৭ অগাস্ট, কাশিমবাজার কুঠিপ্রধান নবাবের কাছে উকিল পাঠালে নবাব তাদের জিজ্ঞাসা করেন তারা রৌজদি-নামা (কলকাতার আর্মেনীয়দের স্বাক্ষরিত সেই চুক্তি) এনেছেন কি না। তারা জানায় চৌত (?) দেওয়ার ভয়ে আর্মেনীয়রা এধরনের কোনো কাগজে স্বাক্ষর করেনি। নবাব বলেন তিনি তাদের থেকে এক পয়সাও নেবেন না এই মর্মে নিজহাতে লেখা মুচলেকা (লিখিত বিধি-নিষেধ বা চুক্তি) দেবেন আর কেলসালের ভূয়সী প্রশংসা করেন। নবাবের এই অভিব্যক্তিতে কাশিমবাজার কুঠিপ্রধানের কাছে মনে হয় যে কেলসালই নবাবের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি তার সঙ্গে সন্তোষজনক নিষ্পত্তির জন্য। আর তাই ১০ অগাস্ট কলকাতার কাউন্সিলকে তিনি চিঠিতে জানান যেন কেলসালকে দ্রুত নবাবের কাছে পাঠানো হয়। কাউন্সিল দ্রুত এই উপদেশ গ্রহণ করে কেলসালকে নবাবের দরবারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কেলসালকে উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়, আর তিনি সুযোগ বুঝে নবাবের সামনে আবেদনও করেন, সম্ভাব্য সকল পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলোর যুক্তি সাজিয়ে প্রমাণ করেন যে প্রথমবার কোম্পানিকে বাণিজ্যে বাধা দেওয়ার পর কোম্পানির দুর্দশা আর আর্মেনীয়দের অভিযোগের ভিত্তি কতটা ভঙ্গুর আর এতে কোম্পানির কিছু করার নেই। কিন্তু এটা প্রত্যাশামতো ফল বয়ে আনেনি, আর আবেদনের প্রেক্ষিতে নবাব স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে আর্মেনীয়দের সন্তুষ্ট করতেই হবে।
কাশিমবাজারের কুঠিয়ালদের হুকুম বেগ (হাকিম বেগ) ও কারুলি বেগের দ্বারস্থ হতে হয়, যারা পুরো ব্যাপারটার নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, আর নবাবকে ১৫ থেকে ২০ হাজার রুপি দেওয়ার বিনিময়ে তাদের পক্ষে এই ব্যাপারটার রায় দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ভাড়াটে চরিত্রের এই দুজন নিজেদের জন্যও কিছু অর্থ বের করে নিতে চাইছিলেন, তাই তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন নবাব যা আশা করছেন এই পরিমাণ তার থেকে কম দেখিয়ে। এরপর কুঠিয়ালরা নবাবকে এক লক্ষ ও ২০ হাজার রুপি হুকুম বেগ (হাকিম বেগ) ও অন্য কর্মকর্তাদের দেওয়ার প্রস্তাব দিলে হুকুম বেগ (হাকিম বেগ) তাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি দসেহরা (দশমী) অতিক্রান্ত হলেই পরোয়ানা বের করার ব্যবস্থা নেবেন । কিন্তু নবাব অসুস্থতার জন্য তার ঘরে অবস্থান করায়, তিনি নবাবের দেখা পাননি। বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্যের দুর্দশার চিন্তায় দেরি না করে কাশিমবাজারের কুঠিয়ালরা উকিলদের আবারও পাঠান হুকুম বেগ (হাকিম বেগ) ও কারুলি বেগের কাছে, যে তাদের হাতে নবাবের লিখিত নির্দেশ আদৌ এসেছে কিনা; যার প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছিলেন। হাকিম বেগ ও কারুলি বেগ উত্তরে জানিয়েছিলেন যেহেতু আর্মেনীয়দের অভিযোগ নিয়ে বেশ হৈচৈ হচ্ছে মাকসুদাবাদে (মুর্শিদাবাদ), তাই নবাব সবাইকে দরবারে তার সামনে উপস্থিত হতে বলেছেন আর নিজে শুনতে চান যে, তারা নিজেরা বলবে ক্ষতির কারণে তাদের সন্তুষ্টির কথা… ।
আর্মেনীয়দের সন্তুষ্টি, নবাবের পিছু হটা ও ইংরেজদের বাণিজ্য-প্রবাহ পুনরুদ্ধার
আর্মেনীয়দের বারবার করা সন্তুষ্টির দাবি আসলে কী ছিল তা হাতের কাছে পাওয়া দলিলপত্র থেকে জানা যায় না। কিন্তু নবাব সুস্থ হয়ে উঠলেই ১৭৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে দরবার বসিয়েছিলেন, যেখানে আর্মেনীয় বণিকেরা উপস্থিত হয়ে ইংরেজদের করা ক্ষতির ব্যাপারে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন। তারা তাদের প্রয়োজনমতো বা কম-বেশি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। নবাব তখন ইংলিশ কোম্পানির উপর জারি করা বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার আদেশ দেন ও তার সৈন্যদের কুঠিগুলো থেকে সরিয়ে নিতে বলেন। দরবার শেষ হওয়ার পর হুকুম বেগ (হাকিম বেগ) ইংরেজদের বুঝিয়ে দেন যে এই আদেশ কার্যকর হওয়ার আগে তাদের নিরাপত্তার জন্য এক লক্ষ ২০ হাজার রুপি জমা দিতে হবে ।
শেঠদের কাছ থেকে অর্থ ধার করে কোম্পানির নবাবের দাবি পূরণ
ইংরেজরা আগে থেকেই আর্থিক সমস্যার ভেতরে ছিল, বিশেষত মুর্শিদাবাদের শেঠদের অনমনীয় মনোভাবের কারণে; যারা তাদের আর কোনো অর্থ ধার দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু প্রচুর অনুনয়ের পর তারা দেড় লক্ষ রুপি ধার দেন, যেখান থেকে নবাবের দাবি পূরণ করে তাকে সন্তুষ্ট করা হয়। ইংলিশ কোম্পানির প্রতি নবাব পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকেন তিন বছর পর্যন্ত আর তাদের পক্ষে পরোয়ানা জারি করেন ১৭৫২ সালের ৮ অক্টোবর।
দক্ষিণ ভারতে অ্যাংলো-ফরাসি বিরোধের সময় আলীবর্দীর নিবিড় পর্যবেক্ষণ
যখন তার প্রদেশে ইউরোপীয়রা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করছে, আলীবর্দী সেসময়ে সবসময় সতর্ক ছিলেন তাদের রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা প্রতিরোধে। দক্ষিণ ভারতে অ্যাংলো-ফরাসি বিরোধের সময়ে তিনি নিবিড়ভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন যেন তারা হুট করে বাংলার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত না হয়, যেমনটা তারা দাক্ষিণাত্যে করেছিল। জিন ল বলেছেন, তিনি একইসঙ্গে ক্রোধ ও বিস্ময়ে ইংরেজ ও ফরাসিদের করোমান্ডেলের উপকূল ও দাক্ষিণাত্যে অগ্রসর হওয়ার খবরের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য সম্পর্কে জানছিলেন তার চরদের মাধ্যমে… তিনি ভীত হচ্ছিলেন যে একইরকম পরিকল্পনা নিয়ে কোনো একসময়ে তার সরকারের দিকেও এগোবে তারা। এভাবেই, যখন তার কানে গেল যে ইংরেজরা কলকাতায় ও ফরাসিরা চান্দেরনাগোরে (চন্দননগর) দুর্গ তৈরি করছে, তিনি সেগুলো ধ্বংস করার স্পষ্ট নির্দেশ দেন; ঠিক মুর্শিদ কুলি জাফর খানের মতো যিনি ১৭১৮ সালে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় দুর্গ তৈরি করতে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই ইংরেজ ও ফরাসি উকিলদের বলতেন, আপনারা ব্যবসায়ী, আপনাদের দুর্গের প্রয়োজন কেন? আমার নিরাপত্তায় আপনাদের কোনো শত্রুকেই ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই ।
আলীবর্দীর কঠোর নিরপেক্ষ নীতি
মারাঠাদের হাতে ইতোমধ্যে বিধ্বস্ত প্রদেশকে আরও যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে রক্ষায়, দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধের সময় আলীবর্দী কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিলেন। তিনি ফরাসি কমান্ডার বুসির চিঠিকে তাই পাত্তাই দেননি, যেটায় ফরাসিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে তার সমর্থন চেয়েছিলেন। তিনি তার এই নিরপেক্ষতার নীতি বাংলায় অবস্থানরত ইউরোপীয়দের উপরেও প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন, আর ১৭৪৫ সালের জুলাই মাসে তিনি এক পরোয়ানা জারি করেন, ইংরেজ, ফরাসি ও ডাচেরা তার শাসনাধীন এলাকায় একে অন্যের বিরুদ্ধে কোনো হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারবে না। তিনি নির্দিষ্টভাবে পালমিরা পয়েন্টকে নির্ধারণ করেন নিরপেক্ষতা শুরুর স্থান হিসেবে।
বাংলায় সহিংস বিচ্ছিন্নতার অনুপস্থিতি
সম্ভবত, এই নীতির ফলেই বাংলায় ইউরোপীয়দের মাঝে কোনো সহিংসতার ঘটনার তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না আলীবর্দীর শাসনামলে, যদিও অন্যান্য এলাকায় তাদের সম্পর্ক শত্রুতাপূর্ণ ছিল আর এখানেও তারা জরুরি অবস্থার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে রেখেছিল, আর প্রকৃতপক্ষে একবার গঙ্গার তীরের নিরপেক্ষতা ভেঙেছিল। ডাচদের প্রতি ইউরোপে ফরাসিদের বৈরিতার কারণে ১৭৪৮ সালের এপ্রিল মাসে নেদারল্যান্ডের ডাচ সরকার চিনসুরায় তাদের সভাপতিকে আদেশ দেয়, তাদের বসতি ও চান্দেরনাগোরের (চন্দননগর) মধ্যে সকল ধরনের যোগাযোগ নিষিদ্ধ করার।
ফরাসিদের বিরুদ্ধে অ্যাংলো-ডাচ মৈত্রী
চিনসুরায় ফরাসি আক্রমণের আশঙ্কায় সেখানকার ডাচেরা ইংরেজদের সঙ্গে মৈত্রী করে। এভাবে এই দুই প্রতিপক্ষ কিছু সময়ের জন্য নিজেদের শত্রুতা ভুলে, দু- পক্ষেরই সাধারণ শত্রু- ফরাসিদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়। ১৭৪৮ সালের জুলাইয়ে চিনসুরার ডাচ-পরিচালক আওখেল কলকাতা ইংরেজ প্রশাসক উইলিয়াম বারওয়েলকে লেখেন যে, তিনি তার জাহাজগুলোকে বরানগরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, আর তিনি কলকাতাতেও পাঠাতে প্রস্তুত আছেন যদি ফরাসিরা আক্রমণ করে বসে, তবে এই নিশ্চয়তা ছিল যে তারা এগুলো তাদের কাজে ব্যবহার করবে না, তাদের সহায়তার জন্য পাঠানো জাহাজের কোনো নাবিক বা অন্য কাউকে আটক করবে না, কেবল তাদের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করবে। প্রায় একমাস পর একটি তিক্ত ঘটনা ঘটে যায়, যার ফলে অ্যাংলো-ডাচ মৈত্রী হুমকির মুখে পড়ে। নির্দেশ পেয়ে একটি ডাচ-নৌকা তিনজন অসুস্থ নাবিককে ফুলতায় অবস্থান করা আরেকটি জাহাজ থেকে আনতে গেলে কলকাতার কাছেই নোঙর করা এক ইংরেজ জাহাজের সশস্ত্র সৈন্যদের আক্রমণের শিকার হয়। তারা তিনজন নাবিককে নিয়ে যায় — যাদের মধ্যে একজন ছিলেন ডাচ নাগরিক জর্জ জানসেন; আর একজন মাঝি ও একজন চাপরাশিকে এতটাই আঘাত করে যে, চাপরাশি পড়ে গিয়ে পানিতে ডুবে যায় আর আঘাতে মাঝি সেখানেই মারা যায় । এরপর আওখেন্স ইংরেজদের কলকাতার কাউন্সিলকে লেখেন যে ইংলিশ কোম্পানিকে এই হাঙ্গামার কারণে গায়ে কালিমা লাগানোয় নেদারল্যান্ড কোম্পানিকে সন্তুষ্ট করতে হবে (যা তারা দাবি করেছিল উল্লেখ করা হল) অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে, যেন অন্যরা এটা থেকে ভীত হয়ে এধরনের কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখে ও তাদের নৌকা বা জাহাজের কোনো ক্ষতির চিন্তা না করে… । তিনি আরও দাবি করেন জর্জ জানসেন ও অন্য নাবিক, ১৭৪৮ সালের অগাস্টে কোস্ট ক্যাপালি থেকে ডাচ-জাহাজ ছেড়ে ইংলিশ কোম্পানির সামরিক বিভাগে যোগদান করা হোয়িডঙ্ককে তার কাছে হস্তান্তর করার। সভাপতি ও কলকাতার কাউন্সিল তার বেশিরভাগ দাবিই পূরণ করেন। এভাবে একটি বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করা হয়, যা দু-পক্ষকেই ফরাসিদের বিপক্ষে লাভবান করে। সে-বছরেরই শেষপর্যায়ে ফরাসিরা ডাচ-কোম্পানির গার্ডেন অফ শাম্পাডা জবরদখল করে, যার ফলে আওখেল চান্দেরনাগোরের (চন্দননগর) ফরাসিপ্রধান রেনোকে ১৭৪৯ সালের ১৩ জানুয়ারি তার সৈন্যদের এই কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে লেখেন যে তারা গঙ্গার নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেছেন। ফরাসিপ্রধান ১৫ জানুয়ারি এই চিঠির উত্তরে লেখেন :— আমাদের বলার অনুমতি দিন যে আপনাদের প্রতিবাদের ভিত দুর্বল। আপনারা, ভদ্রমহোদয়েরা প্রথম নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেছিলেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে, যা আমাদের বিস্মিত করে, এমনকি যুদ্ধের সময়েও আমাদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক কখনও বাধাগ্রস্ত হয়নি। আমরা যে-পদক্ষেপ নিয়েছি তা আপনাদের কর্মকাণ্ডের বিপরীতে ন্যায়সংগত আর আপনার বাগান আমাদের দুর্গের এতটাই কাছে যে আমাদের দুর্গে চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়াও, আমাদের এলাকা দিয়ে ঘেরা এই ছোট জায়গা— যার পরিমাণ এক একরও নয়, সেখানে থাকা ১৭৪৪ সালে নির্মিত সিশটারম্যানের খরচে তৈরি (যা দরজার কাছের লাতিন লিপি থেকে জানা যায়) অন্য ইমারতগুলোয় এর থেকে বেশি আগ্রহ থাকা উচিত আপনাদের। আওখেন্স বারওয়েলকে জানান ফ্রেঞ্চদের এই কর্মকাণ্ড, যার ফলে কলকাতার কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয়- তারা নবাবকে জানাবে যে তারা গঙ্গার নিরপেক্ষতা ভঙ্গকারী ফরাসিদের থেকে আক্রমণের আশঙ্কায় রয়েছে। যদিও ইউরোপে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে গেলে ডাচদের বাগান আবারো আগের অবস্থায় ফিরে যায় ১৭৪৯ সালের এপ্রিল মাসে।
এক্স-লা-শ্যাপেলের শাস্তি থেকে সাত বছরব্যাপী যুদ্ধ পর্যন্ত বাংলায় ইউরোপীয়দের মধ্যকার শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক
ইউরোপীয় তিন প্রতিষ্ঠান এরপর একে অন্যের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ায়নি ইউরোপে সাতবছর ব্যাপ্তিকালের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত, যা আবারও ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে। একটি নির্দিষ্ট কারণকে ঘিরে ১৭৫৫ সালে তারা একত্রিত হয়। সেই বছর ঢাকার সহকারী প্রশাসক কৃষ্ণদাসের নায়েব মীর আবু তালিব ডাচ-কুঠির থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের উপহার দাবি করেন আর তাদের একজন লিপিকারকে (রাইটার) আটকে রাখেন যতক্ষণ-না ঢাকার ডাচ কুঠি প্ৰধান তা দিতে সম্মত হন। ইংরেজ, ডাচ ও ফ্রেঞ্চরা ব্যাপারটাকে অতি অপমানজনক বিবেচনা করে বাংলার নবাবের কাছে যৌথ আপিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইউরোপীয়দের প্রতি আলীবর্দীর কর্তৃত্ব
আলীবর্দী সবসময় তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে চাইতেন। জিন ল লিখেছেন- তিনি ছিলেন নিজের কর্তৃত্বের ব্যাপারে অনুভূতিশীল । তিনি প্রচুর স্বাধীনতা উপভোগ করতেন যখন তার সঙ্গে ইউরোপীয়দের প্রসঙ্গ আসত। সম্রাটের কাছ থেকে পাওয়া সুবিধা বা ফরমানের কথা উঠলেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন। তিনি জানতেন কীভাবে উপযুক্ত সময়ে সঠিকভাবে বলতে হয় যে তিনিই রাজা, তিনিই আইন (উজির) । ইংরেজ আর ফরাসিরা প্রায়ই তাকে খুশি রাখার জন্য আরবীয় ঘোড়া আর পারসিক বিড়াল উপহার দিত। ১৭৪৮ সালে তিনি তার কর্তৃত্ব অবজ্ঞা করায় ওস্টএন্ডসে কোম্পানির কুঠিয়ালদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেন হুগলি নদীর আরেক পারে। ১৭৫১ সালে যখন দুই ইংরেজ অ্যাকটন ও মিলস জার্মান নিরাপত্তায় চান্দেরনাগোর (চন্দননগর) ও হুগলির মধ্যবর্তী এলাকায় আসেন যুদ্ধ-সাজে সজ্জিত জার্মান (প্রুশীয়) পতাকার রঙের তিনটি জাহাজে করে, তখনই তিনি কলকাতার কাউন্সিলের সভাপতি ডাওসনকে লেখেন আর বলেন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জার্মান যুদ্ধ-জাহাজগুলোকে তাড়িয়ে দিতে। ১৭৫১ সালের ১৯ অগাস্ট ডাওসন উত্তর দেন : আমি পাইলটদের (পোতাশ্রয় থেকে নদীতে জাহাজ চালনার জন্য প্রশিক্ষিত ও অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি) নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা কোনো অ্যালেমান (জার্মান/আলিমান) জাহাজের দায়িত্ব না গ্রহণ করে বা তাদের পথ না দেখায়, আমার কোনো সন্দেহ নেই যে ডাচ আর ফরাসিরাও একই কাজ করেছে। ঈশ্বর না করুন, তারা যদি এদিকে আসেও, আমি আশাবাদী যে আপনার ঋজুতার কারণে সেগুলো হয় ডুবে যাবে, নয়তো ভেঙে যাবে, আর নাহলে ধ্বংস হবে ।
কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব প্রদর্শন
নবাবের কর্মকর্তারাও প্রায়ই ইউরোপীয় বণিকদের উপর তাদের কর্তৃত্ব ফলাত। এভাবে ১৭৪৬ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে রাজমহলের ফৌজদার আতাউল্লাহ খানের প্রতিনিধি রেনোকে গ্রেফতার করেন সাক্রিগলি থেকে, তার মনিবের ইচ্ছেয়। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে প্রতিবছরই নবাবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপহার পাঠাতে হত। ১৭৪৮ সালের মে মাসে কলকাতা কাউন্সিলের সভাপতি হুগলির ফৌজদারকে সাধারণ বার্ষিক উপহার হিসেবে দুহাজার ৭৫০ রুপি মূল্যমানের উপহার পাঠিয়েছিলেন। ১৭৫৪ সালের শেষদিকে ঢাকার দিওয়ান রাজবল্লভ স্থানীয় ইউরোপীয় কুঠিয়াল—ইংরেজ ও ফরাসিদের থেকে এক হাজার ৩০০ রুপির উপহার চান, নইলে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করারও হুমকি দেন। কিন্তু এর পরের বছরেই রাজবল্লভ তার বাকেরগঞ্জের লোকেদের আদেশ পাঠান যেন সেখান দিয়ে অতিক্রম করা সব নৌকা আটক করা হয়, যার ফলে ঢাকার ইংরেজ কুঠিয়ালরা সিদ্ধান্ত নেন যে কোম্পানির নৌকা তানতালেয়া (তেঁতুলিয়া) দিয়ে অতিক্রম করবে। তারা দ্রুত একটি চিঠি পাঠায় কলকাতার কাউন্সিলের কাছে এর প্রতিরক্ষার জন্য। কাউন্সিল লেফটেন্যান্ট জন হার্ডিংয়ের নেতৃত্বে ২৫ জন বক্সারি প্রেরণ করে এই নৌকোগুলো যেন ঢাকার পথে কোথাও আটকে না যায় আর পুরো বহরের নেতৃত্ব জন হার্ডিংয়ের কাঁধে নেওয়ার আদেশ দিয়ে। চালভর্তি কোম্পানির অনেকগুলো নৌকো ঢাকায় আটকে ছিল, যার ফলে চালের অভাব আর মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল সেখানে।
ইউরোপীয়দের প্রতি আলীবর্দীর মনোভাব – কঠোর, কিন্তু কর্কশ নয়
ইউরোপীয়দের প্রতি আলীবর্দীর মনোভাব কঠোর হলেও, অপ্রয়োজনীয়ভাবে তা কর্কশ ছিল না। চিনসুরার ডাচ-কাউন্সিলের পরিচালক ১৭৫৬ সালের ২৬ জুন সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে তার আবেদনে জানিয়েছিলেন যে, তাদের অতীতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল আর মহান নবাব সুজা-উল-মুল্ক মহব্বত জংসহ (আলীবর্দী) এই ভূমির রাজারা তাদের পালনকর্তা ছিলেন, যারা সবসময় সুবিধা দিয়ে এসেছেন । সমসাময়িক এক ফরাসি লেখকও বলেছেন যে আলীবর্দী ইউরোপীয়দের পছন্দ করতেন আর তারা ভয় পেত যে তার (নবাবের) মৃত্যুর পর কী হতে যাচ্ছে—এই ভেবে। ১৭৫৫ সালের দিকে তিনি দিনেমারদের (ডেন) সেরামপুরে (শ্রীরামপুর) বসতিস্থাপনের অনুমতি দেন। তিনি প্রায়ই ইউরোপীয়দের থেকে অর্থ আদায় করতেন, তবে সেটা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ঝামেলার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে, ভিত্তিহীন অজুহাতে নয়, যা ১৭৫৬ সালে ফোর্ট সেন্ট জর্জের কাউন্সিল ভুলভাবে জানিয়েছে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে ইউরোপীয়দের তার প্রদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার বা তাদের বাণিজ্যকেও কোনোভাবে ব্যাহত করার ইচ্ছে তার ছিল না।
আলীবর্দীর মৃত্যুশয্যায় বলা কথা— সাজানো গল্প
ইউরোপীয়দের অধিকার খর্ব করার ব্যাপারে, উত্তরাধিকার সিরাজ-উদ-দৌলাকে জি জেড হলওয়েলের উল্লেখ করা আলীবর্দী মৃত্যুশয্যার বক্তব্য বানোয়াট বলেই মনে হয়। অনেক মহান গুণ থাকলেও হলওয়েল নিরপেক্ষ ইতিহাসের ভাষ্যকার ছিলেন না। তিনি গল্প তৈরি করতেন বা তিলকে তাল বানাতেন তার লেখনির মাধ্যমে। ক্লাইভ তার নিন্দা করেছেন কঠিন ভাষায় : – হলওয়েল একজন মহৎ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি, কিন্তু আমি তার সম্পর্কে যা জেনেছি ও দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, তিনি তার দক্ষতা ব্যবহার করে কোম্পানির জন্য ভালোকিছু করতে পারবেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ১৭৬০ সালের পর হলওয়েল তার স্থলাভিষিক্ত হলে কী ভয়ংকর পরিণতি দাঁড়াবে : …(তার) মেধা রয়েছে, তবে আমি মনে করি এই কাজের জন্য একটি হৃদয়ও প্রয়োজন, তাই তিনি সভাপতিত্ব করতে অক্ষম যেখানে সততা আর সামর্থ্য সমান গুরুত্ব বহন করে। এছাড়াও আরও সমসাময়িক প্রমাণ রয়েছে যে আলীবর্দীর মৃত্যুশয্যায় তার নাতিকে বলা কথাগুলোকে হলওয়েল নিজেই বানিয়ে বলেছেন। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির দ্বিতীয় ব্যক্তি ম্যাথিউ কুলেটের ২২ জানুয়ারি ১৭৫৭ সালের কলকাতার কাউন্সিলের কাছে লেখা চিঠি থেকে জানা যায় : …আলীবর্দী খানের মৃত্যুর আগে শেষ কথা অনুযায়ী***, আমি এটাকে কল্পিত গল্প হিসেবেই দেখছি । কোম্পানির ঢাকা কুঠির প্রধান রিচার্ড বেকার, তার ১৭৫৭ সালের ২৫ জানুয়ারিতে কলকাতার কাউন্সিলকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন : হলওয়েল আমাকে ক্ষমা করবেন যদি আমি বলি আপনার দেওয়া আলীবর্দী খানের বক্তব্য খাঁটি নয়, যতক্ষণ-না উৎকৃষ্ট প্রমাণ হাতে আসছে, যা এখনও আমি দেখিনি। এমন উপদেশ যদি সত্যিই দেওয়া হত, সেখানে খুব কম বা কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না, তাই এটা অসম্ভব যে হলওয়েল মাকসুদাবাদে নবাবের অসুস্থাবস্থায় মন্ত্রিসভার এই রহস্য বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন আর এমন গোপন কথা আর কেউই জানতে পারেননি কেবল তিনি ছাড়া। ওয়াটস, কাশিমবাজারের কুঠির প্রধান, ১৭৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে লেখেন :- -মৃত্যুর আগে নাতিকে বলে যাওয়া মহব্বত জং বা আলীবর্দী খানের শেষ কথা তিনি (হলওয়েল) যা আমি বিশ্বাস করি, কুঠির কেউই শুনেছে; তবে এদেশের কোনো মানুষের মুখেও আমি শুনিনি; এটা সম্ভবত চতুর্দশ লুই তার নাতিকে যা বলে গেছেন তারই নকল, আর কুলেট যা বলেছেন – কল্পিত গল্প ছাড়া কিছু নয় । একবার আফগান সেনাপতি মুস্তাফা খানের প্ররোচনায়, আলীবর্দীর ভাতিজা শাহামাত জং ও সাওলাত জং বাংলা থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর উপদেশ দিয়েছিলেন আলীবর্দীকে। মুস্তাফা খান তার দরবার থেকে চলে গেলে, আলীবর্দী তাদের যা বলেছিলেন— তা এখানে বলা প্রয়োজন : আমার প্রিয় সন্তানেরা! মুস্তাফা খান ভাগ্যের সন্ধানে চলা এক সৈনিক, সে সবসময়ে চিন্তা করে আমি যেন তাকে নিয়োজিত করি কাজে, আর তার হাতে ক্ষমতা গেলেই সে নিজের জন্য ও তার বন্ধুদের জন্য সুযোগ-সুবিধা চাইবে; কিন্তু (আমার) সাধারণ বুদ্ধিতেও আসে না, এমন কাজে তুমি কেন তার সঙ্গে জড়াবে? ইংরেজরা এমন কী ভুল করেছে যে আমি তাদের ক্ষতি চাইব? ঘাসে আচ্ছাদিত এই সমভূমির দিকে তাকাও; তুমি এতে আগুন ধরালে এতে আগুন বাড়তেই থাকবে; আর কে সেই মানুষ যে সাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া আগুন নিভিয়ে আবার ভূমিতে ফেরত আসবে? এই ধরনের প্রস্তাবে কান দেওয়ার আগে সতর্ক থাকবে। কারণ এগুলো ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনে না। হরচরণ দাস ১৭৮৪ সালে লিখেছেন, তার মৃত্যুর ঠিক আগে, আলীবর্দী সিরাজ-উদ-দৌলাকে বলেছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে ঝগড়ায় না জড়াতে।