অধ্যায়-৪ – মৌলিক কণা প্রাথমিক অবয়ব
এ অধ্যায়ে আমরা একটু অন্য প্রসঙ্গে যাব। কিছু সংখ্যক মৌলিক কণা ও তাদের বৈশিষ্ট্যের দিকে প্রাথমিক নজর দিবো। এসব কণাদের সম্পর্কে জানলে পরবর্তী অধ্যায়সমূহের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা উপকৃত হব। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানব যখন চতুর্দশ অধ্যায়ে প্রোটন কণার স্থায়িত্বের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের বিবেচনা করব। প্রথমেই আলো ও তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের অনুষঙ্গী কণাদের বিবেচনা করা যাক। এরা হচ্ছে ‘ফোটন’ কণা। ফোটন নামক এই কণাদের বিকিরণের একটি বিকল্প ধরন আছে। শতাব্দীর শুরুর দিকে বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এবং পরবর্তীকালে অন্য অনেকে এই বিকিরণকে অনুধাবন করেছিলেন। এই বিকিরণ শক্তির স্বতন্ত্র খণ্ড খণ্ড রূপে সৃষ্ট। আর এই খণ্ড খণ্ড রূপকে পরবর্তীকালে বলা হয় ‘ফোটন’। এ বিষয়টি কোয়ান্টাম তত্ত্বের ফলাফলগুলোর মধ্যে একটি। ফোটনসমূহ বিশেষ গুণসম্পন্ন কণা এবং এদেরকে এভাবেই বিবেচনা করতে হয়। সাধারণ আলো বিলিয়ন-বিলিয়ন ফোটনের সমন্বয়ে সৃষ্ট। এসব কণা সবাই একত্রে গমন করে। যদি আমরা তরঙ্গের শক্তিকে যথাযথভাবে পরিমাপ করি তাহলে দেখব যে, এটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের গুণিতক যা একটি একক ফোটনের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ফোটন কণার শক্তি সচরাচর একেবারেই কম। তাই অধিক প্রায়োগিক উদ্দেশ্যে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের শক্তির যে কোনও মান থাকতে পারে। কিন্তু পরমাণু বা পারমাণবিক কেন্দ্রীণ (নিউক্লিয়াস)-এর সঙ্গে আলো কিংবা তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের মিথস্ক্রিয়ায় এককালীন একটি ফোটন জায়গা নেয়। এসব মিথস্ক্রিয়া বিবেচনার সময় ফোটনের প্রতিকৃতি বিবেচনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। কণা হিসেবে বিবেচিত ফোটনের ভর শূন্য (০)। এর বৈদ্যুতিক আধানও শূন্য (০)। কিন্তু এদের শক্তি আছে এই অর্থে যে, এরা তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের কম্পাঙ্কের সংসৃষ্ট। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুযায়ী ভারী কণা ছাড়া শূন্য ভরের সকল কণা আলোর বেগে চলে।
মৌলিক কণা কী দিয়ে গঠিত? এই প্রশ্নটি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে সয়ং একটি মৌলিক সমস্যা। এই বিষয়টিতে এখানে আমাদের নিজেদেরকে নিযুক্ত করার প্রয়োজন নেই। আমি কেবল কিছু সংখ্যক প্রসঙ্গোচিত কণার উল্লেখ করব। আমাদের উদ্দেশ্যের জন্য এদেরকে মৌলিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইলেকট্রন। ইংরেজ পদার্থবিদ জোসেফ জন থমসন (১৮৫৬-১৯৪০) ১৮৯৭ সালে এই ইলেকট্রন কণা আবিষ্কার করেছিলেন। ইলেকট্রন ঋণাত্মক আধান বিশিষ্ট। ইলেকট্রনের ভর প্রায় (৯.১১×১০)^-২৮
গ্রাম। নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড (১৮৭১-১৯৩৭) ১৯২০ সালের দিকে প্রোটন কণা আবিষ্কার করেছিলেন। প্রোটনের বৈদ্যুতিক আধান ইলেকট্রনের বৈদ্যুতিক আধান (এক একক ঋণাত্মক আধান)-এর সমান, কিন্তু বিপরীত ধর্মী। অর্থাৎ প্রোটনের বৈদ্যুতিক আধানের এক একক ধনাত্মক আধান রয়েছে। প্রোটনের ভর ইলেকট্রনের ভরের ১৮৩৬ গুণ। পরবর্তীকালে ১৯৩২ সালের কাছাকাছি ইংরেজ পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক (১৮৯১-১৯৭৪) নিউট্রন কণা আবিষ্কার করেছিলেন। নিউট্রনের ভর ইলেকট্রনের ভরের ১৮৩৮ গুণ বেশি। একটি পরমাণুর কেন্দ্রীণ (নিউক্লিয়াস) গণিত হয় কতগুলো নিউট্রন ও প্রোটন মিলিত হয়ে। আর পরমাণুর কেন্দ্রীণের চারপাশের কক্ষপথে কতগুলো ইলেকট্রন ঘুরতে থাকে। একটি কেন্দ্রীণের আয়তন ১০^-১৩ সেন্টিমিটার। আর পরমাণুর আয়তন ১০^-৮ সেন্টিমিটার। পরমাণুর প্রোটন ও ইলেকট্রনদের আধান পরস্পর বিপরীতধর্মী তাই এরা পরস্পরকে আকর্ষণ করে। কেন্দ্রীণের চারপাশের ইলেকট্রন সংখ্যা ও কেন্দ্রীণের প্রোটন সংখ্যা সমান হওয়ায় পরমাণুর নিট আধান নেই অর্থাৎ এটি নিরপেক্ষ হয়। সুতরাং, সকল সাধারণ বস্তুই ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনদের সমন্বয়ে গঠিত। এখানে উল্লেখ্য যে, একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রীণ হচ্ছে একটি প্রোটন। ১৯২০ এর শেষের দিকে ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী পি.এ.এম. দিরাকের কাজ অনুসরণপূর্বক জানা গিয়েছিল যে, প্রত্যেক কণারই তার সমভর বিশিষ্ট বিপরীত বা প্রতি কণার অস্তিত্ব রয়েছে। এসব প্রতি কণার আধান মূল কণার বিপরীতধর্মী হয়। কণা-প্রতিকণাদের অন্যান্য গুণাবলিও পরস্পর বিপরীতধর্মী হয় যেগুলো আমাদের জানা প্রয়োজন। যখন একটি কণা তার বিপরতীয় কণার সংস্পর্শে আসে তখন এরা পরস্পরকে ভেঙে দেয়। ফলে বিকিরণের বিস্ফোরণ তৈরি হয়। এই বিকিরণ শক্তি (E) বহন করে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সুপ্রসিদ্ধ সূত্র E=mc^2 থেকে E কে পাওয়া যায়। এখানে m হচ্ছে ওই কণা দুটির যৌথ ভর এবং c হচ্ছে আলোর বেগ। ইলেকট্রনের বিপরীত কণা হচ্ছে পজিট্রন। ১৯৩২ সালে আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী সি.ডি. অ্যান্ডার্সন এই পজিট্রন কণা আবিষ্কার করেছিলেন। প্রোটন ও নিউট্রনের বিপরীত কণাসমূহ যথাক্রমে এন্টি-প্রোটন ও এন্টি-নিউট্রন। ফোটন কণাও মৌলিক কণা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং এটি তার নিজের প্রতিকণাও। অধিকাংশ মৌলিক কণাই স্পিন (ঘূর্ণন) নামক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। এই বৈশিষ্ট্যের প্রতিকৃতি তৈরি করতে কণাকে ছোট্ট একটি গোলক হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে যেটি একটি অক্ষের চতুর্দিকে ঘুরছে। এই দৃশ্যটি অতি আক্ষরিকভাবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। কণায় কৌণিক ভরবেগ প্রাপ্ত হয়ে স্পিনের সৃষ্টি হয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে কৌণিক ভরবেগ একটি স্বতন্ত্র সংখ্যায় পৌঁছে যাকে একটি মৌলিক একক তথা প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক দ্বারা পরিমাপ করা হয়। প্ল্যাঙ্কের এই ধ্রুবককে ħ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একে ‘h-Slash’ বলে উচ্চারণ করা হয়। ħএর মান প্ল্যাঙ্কে মূল ধ্রুবক ħ কে 2π দ্বারা ভাগকৃত মানের সমান। এই এককের ভিত্তিতে কৌণিক ভরবে বা স্পিন পূর্ণ সাংখ্যিক বা অর্ধ-বিজোড় পূর্ণ সাংখ্যিক হয় অর্থাৎ
প্রভৃতি মানের হয়। আমরা দৈনন্দিন জীবনে এই স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করি না কারণ এই একক h এর মান অতীব নগণ্য। উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশুর খেলনা লাটিম যখন ঘুরে তখন এতে সম্ভাব্য পরিমাণে প্রায় ১০^৩০ħ ইউনিট কৌণিক ভরবেগ বিদ্যমান থাকে। এরকম অবস্থা থেকে প্রাপ্ত কৌণিক ভরবেগকে ‘অরবিটাল কৌণিক ভরবেগ বলা হয়। কোয়ান্টাম বিদ্যা অনুসারে এগুলো কেবল পূর্ণমান প্রাপ্ত হয়। কিন্তু কণাদের বেলায় একটি ঘূর্ণনশীল গোলকের প্রতিকৃতি বিবেচনা করাটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রনের স্পিন (১/২)ħ যা পূর্ণমান নয়। সুতরাং এ ধরনের স্পিন কিছুটা অদ্ভুত বা বিশেষ ধরনের সহজাত স্পিন। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে মৌলিক কণাসমূহের এই ধরনের স্পিন সহজে প্রতিকৃত হতে পারে না। প্রোটন ও নিউট্রনের উভয়ের স্পিন (১/২)ħ। ফোটনের স্পিন ১ħ। যদিও ফোটনের স্পিন পূর্ণ সংখ্যায় রয়েছে তবু এ স্পিন অরবিটাল কৌণিক ভরবেগের থেকে প্রকাশমান হিসেবে গণ্য নয়।
এখন আমরা ভ্রমাত্মক নিউট্রিনো কণায় আসি যার অর্থ ‘ক্ষুদ্র নিরপেক্ষ’ কণা। ফোটনের মতই এটি শূন্যভর বিশিষ্ট (এখনও পর্যন্ত এমনটিই অনুমান করা হয়)। এই নিউট্রিনোর বৈদ্যুতিক আধান নেই। এই কণার স্পিন ফোটনের স্পিনের সমান এর স্পিন (১/২)ħ। সাধারণ বস্তুর সঙ্গে এর মিথষ্ক্রিয়তা অতি নগণ্য। এটি নয়। এটি কোনও প্রকার বিরতি ছাড়াই লেড্-এর কয়েক আলোক বর্ষের মধ্য দিয়ে গমন করতে পারে। ১৯৩১ সালে অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী উল্ফগ্যাঙ্গ পাউলি (১৯০০- ১৯৫৮) নিউট্রিনোর অস্তিত্বের প্রস্তাব করেছিলেন। অবশেষে এফ. রেইনস এবং সি. কোওয়ান ১৯৫৬ সালে নিউট্রিনোকে পরীক্ষামূলকভাবে শনাক্ত করেছিলেন। এদিকে দেখা যায় যে, একটি মুক্ত নিউট্রন (অর্থাৎ এটি আর কেন্দ্রীণের মধ্যে অবস্থিত নয়) অস্থায়ী। কারণ একটি মুক্ত নিউট্রন অল্প কয়েক মিনিটে ভেঙে গিয়ে একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন এবং একটি এন্টি-নিউট্রিনোতে পরিণত হয়। এই এন্টি-নিউট্রিনো হচ্ছে নিউট্রিনোর বিপরীত কণা যেটি ঠিক দর্পণের নিউট্রিনোর * অবয়ব যা ৪.১ নম্বর চিত্রে দেখানো হল। নিউট্রনের এই ভাঙ্গনকে বলা হয় বিটা ভাঙ্গন। এই বিটা ভাঙ্গন ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি নতুন ধরনের মিথস্ক্রিয়ার প্রথম পরিচিত উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি। এটি দুর্বল মিথস্ক্রিয়া হিসেবে পরিচিত। আমরা পরবর্তীকালে এ বিষয়ে আবার ফিরে আসব। এবার নিউট্রিনো প্রকৃতপক্ষে একাধিক রকমের রয়েছে। ইলেকট্রন তার সঙ্গে এক ধরনের নিউট্রিনো যুক্ত করেছে যাকে বলা হয় ইলেকট্রন নিউট্রিনো। প্রকৃতিতে মিউয়ন নামের এক ধরনের কণা আছে। ইলেকট্রনের মতই এ কণার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু এটি ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় ২০৭ গুণ বেশি ভারী। মিউয়ন কণা ঋণাত্মক আধান বিশিষ্ট কিন্তু এর বিপরীত কলা (পজিট্রনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ) ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট। এই মিউয়ন তার সঙ্গে নিউট্রিনো যুক্ত করে তার নাম হয় মিউয়ন নিউট্রিনো। ইলেকট্রনের বিটা ভাঙ্গনে যে এন্টি-নিউট্রিনো তৈরি হয় তা ইলেকট্রন এন্টি-নিউট্রিনা। ইলেকট্রন, মিউয়ন, নিউট্রন এবং এদের প্রত্যেকের বিপরীত কণাসহ এরা সবাই লেপ্টন গোত্রীয়। এই বৈশিষ্ট্যের একটি গুরুত্ব রয়েছে আর তা হচ্ছে এদের প্রত্যেকের লেপ্টন সংখ্যা এভাবে যুক্ত করা সম্ভব যা কোনও প্রক্রিয়ার পূর্বের মোট লেপ্টন এবং প্রক্রিয়ার পরের মোট লেপ্টন সংখ্যা একই হয়। সম্প্রতি ‘τ -লেপ্টন’ নামে নতুন এক ধরনের লেপ্টন আবিষ্কৃত হয়েছে। ‘τ’ হচ্ছে গ্রিক বর্ণ একে ইংরেজিতে উচ্চারণ করা হয় ‘টাউ’। ধারণা করা হয় τ লেপ্টন তার সঙ্গে নিউট্রিনোদেরও সংযুক্ত করে যাদের আমরা বল ‘τ-নিউট্রিনোস।
চিত্র-৪.১ : নিউট্রিনোর স্পিন বামহাতি স্কুর মত (a) যেখানে এন্টি-নিউট্রিনো হচ্ছে নিউট্রিনোর দর্পণ-অবয়ব (b)।
মৌলিক কণাদের ভর গ্রামে দেওয়া হয় না যেহেতু ১ গ্রাম ভর মৌলিক কণার জন্য বেশি ভর। গ্রামের পরিবর্তে শক্তির ওপর ভিত্তি করে এদের ভর উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ কণাদের ভর আইনস্টাইনের E = mc^2 সূত্রানুসারে সম্পূর্ণরূপে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই শক্তি ইলেকট্রন ভোল্ট দ্বারা প্রকাশ করা হয় যার লিখিত রূপ cv। এক ইলেকট্রন ভোল্ট সমান ১.৬০২×(১০)^-১২ আর্গস।
১ গ্রাম ভর প্রতি সেকেন্ডে ১ সেন্টিমিটার বেগে চললে যে গতিশক্তি হয় তাকে ধরা হয় অর্ধ আর্গ। সুতরাং ইলেকট্রন ভোল্ট হচ্ছে শক্তির সাধারণ মান অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ। একটি ইলেকট্রনের ভর হচ্ছে ০.৫১ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট (Mev)। প্রোটন ও নিউট্রনের ভর যথাক্রমে ৯৩৮.৩ Mev এবং ৯৩৯.৬ Mev।