অধ্যায় ৪ – আফগান বিদ্রোহ
বহির্শক্তির আগ্রাসন যে-কোনো দেশের জন্যই উদ্বেগজনক আর অভ্যন্তরীণ সমস্যায় যুঝতে থাকা দেশে সুযোগসন্ধানীরা সেটা কাজে লাগানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায়। মারাঠা আক্রমণ সুবাহ বাংলার জন্য ভয়াবহ দুর্যোগ তো ছিলই, যা জটিলভাবে জড়িয়ে ছিল বাংলার নবাবের সেনাবাহিনীর বড় অংশ গড়ে ক্ষমতাবান উপাদান হয়ে ওঠা— আফগান সেনাপতি ও সৈন্যদের বিদ্রোহের সঙ্গে।
উত্তর ভারতে আফগানদের নতুন আগমন
আগেকার স্থায়ী আফগানরা, যাদের বলা হয় ইন্দো-আফগান, তারা বসতিস্থাপন করেছিল আল্লাহাবাদ, দ্বারভাঙা, উড়িষ্যা ও সিলেটে, আর সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল নতুন করে উত্তর ভারতে আসা আফগানদের অভিবাসনের কারণে, যা সেই সময়ে বৃহত্তর মধ্য ও পশ্চিম এশীয়দের অনুপ্রবেশ ছিল। আফগান ভাগ্যান্বেষীরা সামরিক কাজ পেয়ে যেতেন বহু জায়গায়, প্রহরার কাজে বা ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে, আবার কেউ কেউ নিজেরাই শহর গড়ে নিজেদের প্রভাববলয় তৈরি করত— যেমন রোহিলাখণ্ড আর ফাররুখাবাদ। এই শান্তিপূর্ণ আফগান অনুপ্রবেশ প্রশস্ত পথ তৈরি করে দিয়েছিল উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আফগান আক্রমণের পথের ১৭৪৮ সালের থেকে; ঠিক এর আগে দীর্ঘ পারস্য প্রভাব ও অনুপ্রবেশের মতোই যা পারসিক আক্রমণের পথ তৈরি করেছিল ১৭৩৮-৩৯ সালে।
ভাস্করের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মুস্তাফা খান ও অন্য আফগানদের আলীবর্দীর গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকা
চমৎকার লড়াকু যোদ্ধার গুণাবলি ও সামরিক সংস্থার জন্য মেধাবী, আফগানেরা নিজেদের গোত্রের সুযোগ-সুবিধা থেকে একচুলও ছাড় দিতেন না, আর একই সঙ্গে তারা নিজেদের আবিষ্কার করেছিল মুঘল সম্রাটের থেকে বা তার শাখা- প্রশাখার থেকে যুদ্ধের কৌশলে শ্রেয়তর হিসেবে। তারা ছিল সাহসী, একগুঁয়ে আর প্রতিহিংসাপরায়ণ। আলীবর্দী বিহারের আফগানদের থেকে মূল্যবান পরিষেবা গ্রহণ করেছিলেন সেখানে নায়েব নাজিম হিসেবে কর্মরত থাকার সময়ে, আর বাংলার সুবাহদার হিসেবে তার সরকারের প্রথম চার বছরে। সবচেয়ে বিখ্যাত আফগান সেনাপতি মুস্তাফা খান তাকে সহায়তা করেছিলেন প্রথম মারাঠা আক্রমণ থেকে শুরু করে ভাস্করের হত্যা পর্যন্ত। তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বিশ্বস্ত মন্ত্রণাদাতা। কিন্তু এরপরই তিনি তার ভয়াবহ শত্রুতে পরিণত হন।
স্বাধীন ক্ষমতার জন্য মুস্তাফা খানের উচ্চাশা
এটা মানব-চরিত্রের এক দুর্বলতা যে কিছু বছরের পরিষেবা প্রদানের পর নিজেকে সে সেই অবস্থানে অপরিহার্য ভাবে; উচ্চাভিলাষ আর লালসা এরপর পথ দেখাতে থাকে, যা যদিও উজ্জ্বল আর লোভনীয় মনে হয়, কিন্তু লম্বা সময়ের জন্য সেটা তার ধ্বংস ডেকে আনে। অতি উচ্চাশার মানুষ হিসেবে মুস্তাফা খান এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। আগের তিন-চার বছরে সাফল্যকে অভ্যাসে পরিণত করা তাকে গর্বিত ও উদ্ধত করেছিল, আর স্বাধীনভাবে ক্ষমতাভোগের স্বপ্ন বা আলীবর্দীরও উপরে নিজেকে দেখছিলেন তিনি।
মুস্তাফা খানের সন্দেহ ও বিচ্ছেদ
মুস্তাফা খানের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য আলীবর্দী নিজেও দায়ী। প্রচণ্ড প্রয়োজনের মুহূর্তে ভাস্করকে হত্যার পুরস্কার হিসেবে তিনি তাকে পার্টনার সহকারী প্রশাসকের দায়িত্ব দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মুস্তাফা খান এই কাজ সমাধা করলেও আলীবর্দী তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন, আর তাকে মিষ্টি কথায় শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। এটা আফগান সেনাপতিকে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষিপ্ত করে তোলে আর তার পরিণতিতে দুজনের ভেতরকার সম্পর্কে প্রকাশ্যেই চিড় ধরতে দেখা যায়। মুস্তাফা খান যথেষ্ট চালাক ছিলেন চটজলদি নবাবের অশুভ অভিপ্রায় বোঝার জন্য, আর তার পক্ষ থেকে কিছু ক্ষতির আশঙ্কায় ১৭৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময় থেকে মুস্তাফা খান দরবারে যাতায়াত ছেড়ে দেন। একদিন সেখানে ব্যক্তিগতভাবে যাওয়ার আগে, তিনি তার দুজন সেনাপতি উদাল শাহ ও হাকিম শাহকে পাঠান। নবাবের কাছে এরা দুভাই যাওয়ার খানিক পরেই একজন খোজা সেখানে দৌড়ে এসে খবর দেয় যে নবাবের বেগম ভয়াবহ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছেন। নবাব দরবার ছেড়ে যাওয়ার আগে মুস্তাফা খানের প্রতিনিধিদের অপেক্ষা করতে বলেন তিনি ফেরত না আসা পর্যন্ত। কিন্তু তারা এটাকে তাদের গ্রেফতার করার জন্য নবাবের চাল হিসেবে ভেবে নিলেন আর দরবার ত্যাগ করলেন তার ফেরত আসার আগেই। তারা বের হয়েই দেখতে পেলেন মুস্তাফা খানকে, যিনি নবাবের দরবারের দিকে যাচ্ছিলেন, আর তারা তাদের সন্দেহ ব্যক্ত করেন তার কাছে। মুস্তাফা খান আগে থেকেই এ ধরনের সন্দেহ করছিলেন, তাই তাদের কথা বিশ্বাস করে নিজের বাড়িতে ফিরে যান। এটা নবাবের কানে গেলে তিনি মুস্তাফার সন্দেহ দূর করার জন্য নাওয়াজিশ মুহাম্মাদকে তার কাছে পাঠান, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও মুস্তাফা খানকে তিনি বোঝাতে ব্যর্থ হন।
নবাবের বিরুদ্ধে মুস্তাফা খানের প্রকাশ্য বিদ্রোহ
মুস্তাফা খান এই ঘটনার পরেই নবাবের চাকরিতে ইস্তফা দেন, আর নয় হাজার আফগান ঘোড়সওয়ার ছাড়াও শক্তিশালী পদাতিক সৈন্যের বিশাল বহরের দায়িত্ব নিয়ে, বিহারের সহকারী প্রশাসকের পদের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। তিনি তার সৈন্যদের বকেয়া ১৭ লক্ষ টাকার দাবিও তোলেন, যা নবাব কোনো বাছ-বিচার না করেই হিসেব মিটিয়ে ফেলেন। নবাব তার দিক থেকে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তার প্রাসাদ, আত্মীয়দের ঘর-বাড়ি সুরক্ষিত করার জন্য সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খান, সৈয়দ আহমাদ খান, মীর জাফর খান, হায়দার আলী খান, ফখরুল্লাহ বেগ খান, নুরুল্লাহ বেগ খান, আফগান সেনাপতি উমর খান ও তার ছেলেদের আর ফতেহ রাওসহ অন্য হিন্দু সেনাপতিদের অধীনে। মুস্তাফা খানের পক্ষে সম্ভব হয়নি উমর খান, রহম খান, শামশির খান ও সর্দার খানকে তার দলে ভেড়াতে, কারণ আলীবর্দী চতুরতার সঙ্গে তাদের বিভিন্ন উপহার ও সুবিধা দিয়ে তার পক্ষে রেখে দিয়েছিলেন।
জৈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে মুস্তাফা খানের পাটনা অভিযাত্রা
মুর্শিদাবাদে হতাশ হয়ে মুস্তাফা খান ১৭৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির কাছাকাছি সময়ে পাটনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন, সঙ্গে আট বা নয় হাজার অশ্বারোহী নিয়ে; উদ্দেশ্য— জৈনুদ্দিনের থেকে সেখানকার সরকার ছিনিয়ে নেওয়া। রাজমহলে এসে তিনি কিছু হাতি, বন্দুক আর গোলাবারুদ ছিনিয়ে সরাসরি নবাবের শত্রু হিসেবে নিজেকে প্রকাশিত করেন। মুস্তাফা খানের পাঠানো চিঠি পেয়ে তার ভাতিজা, উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসক তার দলে যোগ দিয়ে দল ভারী করেন।
মুস্তাফা খানের মুঙ্গের দুর্গ দখল ও পাটনার দিকে অগ্রসর হওয়া
মুঙ্গের পৌঁছেই মুস্তাফা খান সেখানকার দুর্গ দখল করেন, যার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। আবদুল রসুল দুর্গ দখলের সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু মুস্তাফা খান ঝড়োগতিতে দুর্গের দায়িত্বে নবাবের নিয়োজিত কর্মকর্তা হুসাইন বেগ খানকে তার তিন ছেলেসহ বন্দী করেন, আর বেশকিছু কামান আর গোলাবারুদের দখল নেন। সেখানে তিনদিন অবস্থানের পর তিনি ১৫ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে (সম্ভবত আবদুল রসুলের বাহিনী যোগ দেওয়ায় এই সংখ্যায় উপনীত হয়েছিল) পাটনার দিকে যাত্রা করেন।
মুস্তাফার বিদ্রোহ, আলীবর্দীর কাছে চরম ধৃষ্টতা আর জৈনুদ্দিনের জন্য তার দুশ্চিন্তা
এভাবে মুস্তাফার বিদ্রোহ আলীবর্দীর কাছে চরম ধৃষ্টতামূলক মনে হয়। সে-সময়ে তিরহুতের মহল ভানওয়ারায় থাকা তার ভাতিজা জৈনুদ্দিনের জন্য দুশ্চিন্তা শুরু হয়। আলীবর্দী এর মধ্যেই তাকে গঙ্গার উত্তর দিক দিয়ে মুস্তাফা খানের পথ এড়িয়ে মুর্শিদাবাদে ফেরত আসার জন্য চিঠি লিখে পাঠান। জৈনুদ্দিনের কর্মকর্তাদের অনেকেই তার চাচার পরামর্শ মেনে নেওয়ার উপদেশ দেন, কারণ তারা ১৫ হাজার ঘোড়সওয়ার, ১৫০ হাতি আর ৫০ কামান সঙ্গে করে আনা মুস্তাফা খানের মতো সাহসী সেনাপতির সঙ্গে লড়াইয়ে সবকিছু ধ্বংসের আশঙ্কা করছিলেন।
জৈনুদ্দিনের আফগানদের প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত
কিন্তু জৈনুদ্দিন তাদের কোনো কথাই কানে নেননি, আর তার অবস্থান ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে পাটনার দিকে দ্রুত রওনা হয়ে যান। তিনি তার প্রাসাদে ঢোকার বদলে জাফর খানের বাগানে অবস্থান নেন আর পাটনা শহরের প্রতিরক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি তার পুরনো সব সৈন্যদের এক করেন আর নতুন সৈন্য সংগ্রহেরও চেষ্টা করেন। কিছু স্থানীয় অভিজাত— আহমাদ খান কুরেশি, শেখ জাহানইয়ার, শেখ হামিদ উদ্দিন, শেখ আমরুল্লাহ, করম খান, গোলাম জিলানী, খাদেম হুসাইন খান, জাসওয়ান্ত নাগোর, রাজা কিরাতচাঁদ, রাজা রামনারায়ণ ও অন্য হিন্দু অধিনায়কদের নির্দেশ দেওয়া হয় নতুন চাঁদা তোলার। প্রদেশের কিছু জমিদার, টিকারির সুন্দর সিং, নারহাট ও সামাইয়ের নামদার খান, সেরেস ও কোটম্বাহর বিষণ সিং, সাসারাম ও চৈনপুরের পালোয়ান সিং ও তার ভাই সাবুথার সিং ও আরওয়ালের ভারত সিং তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন তার কাছে। এভাবেই জৈনুদ্দিন অল্প সময়ের মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ হাজার সৈন্য জোগাড় করেন তার শিবির ভূমির দিক থেকে সুরক্ষিত ছিল মাস্কেটিয়ারদের (বন্দুকবাজ) জন্য তৈরি টাওয়ার দিয়ে। এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত ছিল পরদার মাধ্যমে আর পাটনা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমের জলা থেকে শহর রক্ষার বাঁধের লাগোয়া ছিল। নিরাপত্তার জন্য এর সঙ্গেই গভীর খাদ খনন করা হয়েছিল, আর মাটিগুলো দিয়ে দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছিল পানির পরে। বেষ্টনে কামান বসানো হয়েছিল, আর দেয়ালের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সেনাপতিকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছিল।
জৈনুদ্দিনের প্রস্তুতি
জৈনুদ্দিনের সৈন্যদের বিভিন্ন দলে ভাগ করা হয়েছিল, প্রত্যেকটির দায়িত্বে ছিলেন বিশ্বস্ত অধিনায়ক; প্রথম দলের নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম হোসেনের চাচা আবদুল আলী খান, দ্বিতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন আহমাদ খান কুরেশি (দাউদনগরের প্রতিষ্ঠাতা দাউদ খান কুরেশির নাতি), তৃতীয় দলটি কিরাতচাঁদের অধীনে, চতুর্থটি রাজা রামনারায়ণ, পঞ্চমটি খাদেম হোসেন খান ও ষষ্ঠ দলটি নাসির আলী খানের অধীনে ছিল।
জৈনুদ্দিনের পক্ষ থেকে মুস্তাফা খানের অভিপ্রায় ব্যাহত করার উদ্যোগ
এই সাবধানতা অবলম্বনের পরও জৈনুদ্দিন মুস্তাফা খানের কাছে বার্তাবাহী এক দল পাঠান যাতে হাজী আলম কাশ্মিরি, পাটনার সাইফ খানের মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মৌলভী তেগ আলী খান, আর আগা আজিমাই ছিলেন। তাদের জন্য পাঠানো হয়েছিল মুস্তাফা খানের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবনের জন্য। মুস্তাফা খানের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথেই জৈনুদ্দিন আবারও তাদের বার্তা পাঠিয়ে তাকে বলতে বলেন যে : যদি নবাবের চাকরি ছেড়ে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে থাকেন ও আমাদের ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন আর প্রদেশ ত্যাগ করেন, আমি আমাদের আগেকার বন্ধুত্বের খাতিরে আপনাকে অনুরোধ করব আমার গৃহে এসে অন্তত দুতিন-দিন অবস্থান করার, যেন আমি আপনার সঙ্গ পাই আর আপনাকে টানাগাড়ি, তাঁবু ও যাত্রার অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। যদি নবাবের প্রতি আপনার অসন্তোষ কমাতে কারো হস্তক্ষেপ প্রয়োজন মনে করেন, আর আপনার মন যদি বলে আমি সে-অসন্তোষের কারণ দূর করতে কোনো সহায়তা করতে পারি, আর আপনাদের দুজনের মানসিক দূরত্ব দূর করে আপনাদের সম্পর্ক আবারও উষ্ণ করতে পারি, তবে আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত রয়েছি। আর যদি অন্যদিকে আপনার কাছে সম্রাটের সনদ থাকে এই প্রদেশের সরকারের জন্য, তাহলে দয়া করে আমাদের দেখাবেন যেন আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আপনাকে প্রদেশের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারি।
মুস্তাফার কঠোর জবাব
মুস্তাফা খান বেশ কঠিন আর ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দিয়েছিলেন কারণ আলীবর্দীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব নবায়ন বা নীরবে বাংলা ত্যাগ করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু বিহার নিয়ে জৈনুদ্দিনের সঙ্গে লড়ার ইচ্ছে ছিল; আর সম্রাটের থেকে আসা দিল্লির সনদের ক্ষেত্রে বলতে হয়, তার কাছেও একই সনদ ছিল, যেমন সনদ আলীবর্দী ব্যবহার করেছিলেন সারফারাজের বিরুদ্ধে, আর তা হল উচ্চতর শক্তির সনদ।
পাটনা শহরের কাছে মুস্তাফার আগমন ও জৈনুদ্দিনের বাহিনীর উপর হামলা
১৭৪৫ সালের ১৪ মার্চ ভোরবেলায়, মুস্তাফা খান জৈনুদ্দিনের শিবিরের এক মাইলের ভেতরে এসে অবস্থান নেন, আর পাটনা শহরের দক্ষিণের এক আমবাগানে অপেক্ষা করতে থাকেন। তার বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে, একভাগ বুলান্দ খান রুহেলার নেতৃত্বে জৈনুদ্দিনের প্রতিরক্ষার পেছনের দিকে আক্রমণ করতে পাঠান, আর অন্যদল নিয়ে নিজে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামনের দিকে আক্রমণ করেন, যা রাজা সুন্দর সিং, কিরাতচাঁদ ও অন্য হিন্দু সেনাপতিদের নেতৃত্বে ছিল। দুটো দলই প্রবল বিক্রমে জৈনুদ্দিনের শিবিরের উপর আক্রমণ করে। জুলফিকার খান মেওয়াটি, রাজা কিরাতচাঁদ ও তার পিসীর ছেলে লালা উরি লাল, তার চাচার ছোটছেলে বালমুকুন্দের মতো কিছু সেনাপতি, আর জৈনুদ্দিনের সহকারী দীপচাঁদ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পরে আহত হয়ে পালিয়ে যান।
জৈনুদ্দিনের বাহিনীর বিপর্যয় ও সাহসিকতা
জৈনুদ্দিনের প্রচুর সৈন্য পালিয়ে গেলে তার সঙ্গে কেবল দুইশোর মতো ঘোড়সওয়ার আর ১৫০ পদাতিক রয়ে যায়। মুস্তাফা খান এরপর জৈনুদ্দিনের কাছাকাছি পৌঁছে যান, কিন্তু জৈনুদ্দিন অবিচলভাবে হাতির পিঠে বসে তির ছুড়ে উদাল শাহ, হাকিম শাহসহ আরও কিছু আফগান সেনাদের হত্যা করেন।
মুস্তাফার মাহুতের মৃত্যু, মুস্তাফার বাহিনীর তাৎক্ষণিক সংশয় ও পলায়ন
মুস্তাফা খানের মাহুত হঠাৎ করেই মাস্কেটের গুলির আঘাতে মারা যায়, আর তাই তিনি লাফ দিয়ে হাতি থেকে নেমে যান এই আশঙ্কায় যে, মাহুতহীন হাতি নিয়ন্ত্ৰণ হারিয়ে তার সৈন্যদেরই বিশৃঙ্খল করে দিতে পারে। কিন্তু তার বেশকিছু সৈন্য মনে করে বসে যে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে পালিয়ে গিয়েছেন।
মুস্তাফার সাতদিনব্যাপী লড়াই, দুঃসাহসী জৈনুদ্দিন
দুই বাহিনী মুখোমুখি এক সপ্তাহ ধরে লড়াই চালিয়ে যায়। ১৭৪৫ সালের ২১ মার্চ, মুস্তাফা খান আবারও জৈনুদ্দিনের প্রতিরক্ষায় আঘাত হানেন। তার বাহিনীর এক অংশ মুহাম্মাদ জাহানইয়ার খান ও আহমাদ খান কুরেশির দিকে ও নিজে শত্রুপক্ষের ডানদিকে আক্রমণ করেন। তিনি জৈনুদ্দিনের হাতির কাছাকাছি চলে গেলেও জাসওয়ান্ত নাগোর তাকে বাধা দেন। জৈনুদ্দিন নিজেও সাহসের সঙ্গে লড়াই করে যান।
মুস্তাফা খানের চোখ হারানো; পিছু হটা
একটি গুলি হঠাৎ করেই মুস্তাফা খানের ডান চোখে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। সন্ধ্যার দিকে তার ছেলে মুর্তজা খান ও তার সৈন্যরা তাকে হাতির পিঠে করে মিঠাপুরের (এখনকার পাটনা রেলওয়ে স্টেশন) দিকে পালিয়ে যান। সেখানে মুস্তাফা খানের জ্ঞান ফিরে এলে তিনি এই বিপর্যয়ের জন্য অনুশোচনা করেন।
জৈনুদ্দিনের সঙ্গে আলীবর্দীর যোগদান ও মুস্তাফাকে বিহার থেকে বিতাড়ন
পরদিন জৈনুদ্দিন পরাজিত আফগানদের তাড়া করে নিয়ে যায় নওবতপুর (পাটনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১৩ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে) আর মুহিব আলীপুর (সনের পূর্বতীরে, নওবতপুরের ১৯ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে) পর্যন্ত, আর সোন নদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে পাঠিয়ে দেন। মুহিব আলীপুরে গিয়ে জৈনুদ্দিন জানতে পারেন যে আলীবর্দী ও পাটনার কাছাকাছি চলে এসেছেন। নবাব তার সঙ্গে যোগ দেন ও তাদের বিহারের সীমানা ছাড়িয়ে গাজীপুরের উল্টোদিকের যামানিয়া পর্যন্ত তাড়া করেন। চুনারের দুর্গের কাছের এক গ্রামে মুস্তাফা আশ্রয় নেন, যা আওধের নবাব সাফদার জংয়ের অধীনে ছিল। ইউসুফ আলী লিখেছেন যে আলীবর্দী তখন সাফদার জংয়ের অধীনে থাকা বেনারস আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, ১৭৪৩ সালে পাটনায় সাফদার জংয়ের অভব্য আচরণের কারণে। কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়িত করা হয়নি, কারণ সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ সাফদার জংয়ের সঙ্গে আলী মুহাম্মাদ রুহেলাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বানকারাহ পর্যন্ত তাড়া করেছিলেন। আলীবর্দী নিজেকে সাফদার জংয়ের সীমানার কিছু এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট রাখেন। তিনি জৈনুদ্দিনের সঙ্গে এপ্রিলে পাটনায় আসেন, কিন্তু জলদিই তাকে বাংলায় ফেরত আসতে হয়, কারণ মুস্তাফা খানের আমন্ত্রণে তখন রঘুজি ভোঁসলে বাংলায় আক্রমণ চালিয়েছেন।
মুস্তাফা খানের অদম্য উচ্চাশা
বিহার থেকে বিতাড়িত হয়েও মুস্তাফা খান তার উচ্চাশা হারিয়ে যেতে দেননি। অদম্য উৎসাহ আর বীরত্বের কারণে তিনি নাছোড়বান্দা ছিলেন, যদিও তাকে পিছু হটতে হয়েছিল আর অর্থনৈতিক সমস্যায়ও পড়তে হয়েছিল, তারপরও তিনি আরেকবার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন
শাহাবাদের জমিদারদের সঙ্গে মৈত্রী
সময় নষ্ট না করে, তিনি তার বন্দুক ও কামান সারাইয়ের দিকে নজর দেন আর নতুন সৈন্য নিয়োগ করতে থাকেন বিভিন্ন স্থান থেকে। বৃষ্টি শুরুর আগে তিনমাসে তিনি ১৮ হাজার ঘোড়সওয়ার আর ১৫ হাজার পদাতিক সৈন্যের একটি বড় দল দাঁড় করিয়ে ফেলেন, আর বিহারের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তিনি প্রথমে শাহাবাদ জেলায় প্রবেশ করেন, যেখানে জগদীশপুরের (আরা শহর থেকে ১৮ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে) উদয়ন্ত সিং উজ্জয়নীর মতো জৈনুদ্দিনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আরও জমিদারেরা ছিলেন।
পাটনা থেকে মুস্তাফার বিরুদ্ধে জৈনুদ্দিনের যুদ্ধযাত্রা ও ১৭৪৫ সালের ২০ জুনের লড়াই
এই খবর পেয়ে মুস্তাফা খানকে ঠেকাতে জৈনুদ্দিন ১৭৪৫ সালের ২ জুন পাটনা থেকে ১৩ থেকে ১৪ হাজার সৈন্যকে নেতৃত্ব দিয়ে পাটনা থেকে যাত্রা শুরু করেন যার মধ্যে শাহ দ্বীন মুহাম্মাদ, রহম খান রুহেলার মতো সেনাপতিসহ আরো সৈন্য ছিল। কোইলওয়ারে সোন নদী পেরিয়ে তিনি প্রথমে আরা শহরে, এরপর আরা থেকে পাঁচ মাইল দক্ষিণে কারহানিতে যান। আফগানরা আগেই কারহানি গ্রামের দুই মাইল দূরে পৌঁছে শত্রুপক্ষের অপেক্ষা করছিল, আর সেখানেই তীব্র লড়াই হয় ১৭৪৫ সালের ২০ জুলাই। হাতির পিঠে সওয়ার কিরাতচাঁদ পাঁচহাজার অশ্বারোহী আর কয়েক হাজার পদাতিক সৈন্যের দায়িত্ব নিয়ে জৈনুদ্দিনের বাহিনীর ডানদিকের অংশের নেতৃত্বে ছিলেন; আর আহমাদ খান কুরেশি ও জাসওয়ান্ত নাগোর তাদের সৈন্যসহ এই অংশের শক্তি বৃদ্ধি করেছিলেন। জৈনুদ্দিনের শক্তিশালী গোলাবারুদের বহর মুস্তাফার মনে বিন্দুমাত্র ভয়ের কারণ হয়নি। প্রচণ্ড ধাওয়ার পর, তিনি জৈনুদ্দিনের বাহিনীর সম্মুখভাগকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন, দাউদ খান ও তার আরও বেশকিছু তরুণ সৈন্য মারা যায়, খাদেম হোসেন খান আহত হন, তার কামান মুস্তাফা খান দখলে নেন। জৈনুদ্দিনের পুরো বাহিনী ভয়ংকর আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, কিন্তু আবদুল আলী খান আবারও সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাকে জলদিই সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন মাহদি নিসার খান, নকি আলী খান, শাহ জাহানইয়ার, রাজা সুন্দর সিং, রহম খান রুহেলা, করম খান ও রাজা রামনারায়ণ, আর জৈনুদ্দিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকা মুস্তাফা খানকে থামাতে এগিয়ে যান। হঠাৎ করেই একটি গুলি (মাস্কেট বল) এসে মুস্তাফা খানের বুকে আঘাত করে আর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।
মুস্তাফা খানের মৃত্যু, তার ছেলে ও অনুসারীদের মাগরোরে পলায়ন
তিনি জলদিই জ্ঞান ফিরে পান ও জৈনুদ্দিনের দিকে এগোতে থাকেন, কিন্তু জৈনুদ্দিনের ছোড়া দুটি তির তার জীবনের ইতি ঘটায়। জৈনুদ্দিনের নির্দেশে তার গার্হস্থ্য বিষয়ক তত্ত্বাবধায়ক হাশিম আলী খান, মুস্তাফা খানের হাতিতে উঠে তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেন, মাথা আলাদা করে ফেলেন আর বর্শার ফলায় লাগিয়ে তা উঁচু করে সৈন্যদের দেখাতে থাকেন। তার মরদেহ দু-টুকরো করে পাটনায় নিয়ে যাওয়া হয়, যার এক অংশ পশ্চিম দরওয়াজা আর অন্যটি পূরব দরওয়াজায় (শহরের পশ্চিম ও পূর্ব দিকের দুটো দরজা) জৈনুদ্দিনের নির্দেশে শের শাহের মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফনের আগে পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়। রাজা কিরাতচাঁদ আফগানদের শিবির পর্যন্ত ধাওয়া করে বহু মূল্যবান সম্পদের সঙ্গে তাদের তাঁবু আর ঘোড়াও দখল করেন। তারা সবাই মুস্তাফা খানের ছেলে মুর্তজা খানের নেতৃত্বে মাগরোর গ্রামে (কর্মনাশা নদীর তীরে, চেইনপুরের ১৪ মাইল পশ্চিমে) পালিয়ে যায়।
আফগান মারাঠা মৈত্রী ও দ্বিতীয় আফগান বিদ্রোহ
এভাবে প্রথম আফগান বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করা হয় আর বিজয়গর্বে জৈনুদ্দিন জাঁকজমকের সঙ্গে পাটনায় ফিরে আসেন। কিন্তু বাংলার নবাবের জন্য নতুন সমস্যার শুরু হয়। মাগরোর গ্রামে আশ্রয় নেওয়া আফগানেরা রঘুজি ভোঁসলের কাছে গিয়ে সাহায্যের আবেদন করে, আর মারাঠাপ্রধান ১৭৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিহার আক্রমণ করেন। এই সময়ে বাংলায় মারাঠারা নিশ্চিতভাবে আফগান বিদ্রোহীদের সহায়তা পেয়েছিল।
আলীবর্দীর আন্তরিকতাহীন আফগান সেনাপতি, তাদের পদচ্যুতি ও দ্বারভাঙায় গমন
১৭৪৫ সালের নভেম্বরে সোন নদীর তীরে মারাঠাদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় শামসির খান ও সর্দার খানের মতো প্রধান সেনাপতিদের থেকে আলীবর্দী কোনো সহায়তা পাননি। পরে তারা আলীবর্দীর বিরুদ্ধে রঘুজির সঙ্গে বাংলার মসনদ ভাগাভাগির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আলীবর্দী ১৭৪৬ সালের জুন মাসে তাদের পদচ্যুত করেন আর তারা তাদের ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে তাদের ঘরে অর্থাৎ উত্তর বিহারের দ্বারভাঙায় ফিরে যান।
জৈনুদ্দিনের বাংলার সিংহাসন দখলের অভিলাষ
কিন্তু এতে করেও আলীবর্দীর আফগান-সমস্যা শেষ হল না। তাদের থেকে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছিল তার জন্য, আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে তারই ভাতিজা জৈনুদ্দিনের পথ প্রশস্ত হচ্ছিল এতে। আগের প্রাপ্তিতে— যেমন আলীবর্দীকে ১৭৪২ সালে ভাস্করের বিরুদ্ধে সহযোগিতা আর ১৭৪৫ সালের মার্চ ও জুনে মুস্তাফা খানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জয়ে অহংকারে ফুলে ওঠা জৈনুদ্দিন এবারে উচ্চাশা পোষণ করলেন তার বৃদ্ধ চাচাকে সরিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসার আর তার দুই ভাইকে তার নিয়ন্ত্রণে আনার, যাদের ক্ষমতা ও সম্পদ তিনি নিজে দেখে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে সিরাজ-উদ-দৌলার বিয়ের সময়ে। ইউসুফ আলী পাটনায় জৈনুদ্দিনের সেনাবাহিনীর বকশি মাহদি নিসার খানের থেকে শুনেছিলেন যে, জৈনুদ্দিন তার চাচার সঙ্গেও এমন কিছু করতে যাচ্ছেন, যেমনটা তার চাচা করেছিলেন তার মনিব সারফারাজ খানের সঙ্গে।
আফগান সৈন্যদের নিয়োগের ইচ্ছা
তার এই উচ্চাভিলাষী ইচ্ছে পূরণের জন্য জৈনুদ্দিন দ্বারভাঙার অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের তার বাহিনীতে নিতে চাইলেন। এর জন্য তিনি আলীবর্দীর কাছে একটি চিঠি পাঠান মীর আবদুল মালির (যিনি আওধের সাদাত খানের পরিচারক ছিলেন, পরে পাটনায় জৈনুদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন) মাধ্যমে, আর বলেন যে দ্বারভাঙায় অলসভাবে বসে থাকা আফগান সৈন্যরা তার সরকারের জন্য ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করছে, আর তাদের যেহেতু প্রদেশ থেকে তাড়িয়েও দেওয়া সম্ভব নয়, তাই তিন হাজার সৈন্যসহ কিছু কর্মকর্তাকে তার বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হল, যদি তাদের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সরাসরি মুর্শিদাবাদের কোষাগার থেকে দেওয়া হয়। আলীবর্দী খুব সহজেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান, শুধুমাত্র তার ভাতিজাকে তিনি পছন্দ করতেন বলে।
দ্বারভাঙার আফগানদের হাজীপুরে জৈনুদ্দিনের সাক্ষাতের আমন্ত্রণ
পাটনায় তার প্রতিনিধি ফিরে এলে, জৈনুদ্দিন আগা আজিমাই (যিনি ১৭৪৮ সাল পর্যন্ত পূর্ণিয়ার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাইফ খানের সেনাবাহিনীর বকশি ছিলেন কিছুকাল), তকি কুলি খান ও মুহাম্মাদ আসকার খানকে দ্বারভাঙার আফগানদের কাছে প্রেরণ করেন তার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। ১৭৪৭ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শামশির খান, তার বোনের ছেলে মুরাদ শের, সর্দার খান ও বকশি বাহেলিয়ার নেতৃত্বে আফগানদের বেশ বড় একটি দল দ্বারভাঙা ছেড়ে পার্টনার উল্টোদিকে গঙ্গার উত্তরে হাজীপুরে এসে উপস্থিত হয়। তাদের পুরোপুরি বিনাশ করার জন্য জৈনুদ্দিনের ষড়যন্ত্র সন্দেহ করে আফগানরা সবাই একসঙ্গে গঙ্গা পার হয়নি, হাজীপুরে ১৫ দিন অপেক্ষা করার পর তার সঙ্গে সমঝোতা করে। তাদের কাজে লাগানোর জন্য উদ্গ্রীব জৈনুদ্দিন নিজেই দ্রুতগামী পাল-তোলা নৌকায় হাজীপুরে যান, সঙ্গে কাছের দু-তিনজন পরিচারক আর ছোটছেলে মির্জা মাহদিকে সঙ্গে নিয়ে। তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর আফগান সর্দারেরা নদী পার হয়ে আসেন, আর জাফর খানের বাগিচায় শিবির স্থাপন করে ১৭৪৮ সালের জানুয়ারির শুরুতে।
চিহিল সাতুনে আফগানদের সঙ্গে জৈনুদ্দিনের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের আয়োজন উভয়পক্ষের সম্মতিতে ১৩ জানুয়ারি পাটনায় চিহিল সাতুন বা দরবারকক্ষে জৈনুদ্দিনের সঙ্গে আফগান সর্দারদের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের দিন নির্ধারিত হয়। আফগানদের মনে বিশ্বাস তৈরি করতে জৈনুদ্দিন এক আত্মঘাতী আদেশ দেন যে তার কোনো সৈন্য এ সময়ে দরবারকক্ষে উপস্থিত থাকবে না। মাহদি নিসার খান, খাদিম হোসেন খান, আহমাদ খান কুরেশি তখন পাটনার বাইরে ছিলেন সেরেস ও কটোম্বাহর জমিদারের বিরুদ্ধে এক অভিযানে; আর যে-সৈন্যরা পাটনায় ছিল, মনিবের আদেশে চিহিল সাতুনে তাদের কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
নিরাপত্তাহীন করা জৈনুদ্দিনের ভুল সিদ্ধান্ত, আফগান সহায়তার আশা
কেবলমাত্র কিছু সভাসদ আর কেরানি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন মুহাম্মাদ আসকার খান, মীর মুর্তজা, গুপ্তচরদের প্রধান মুরালিধর, অস্ত্রের তত্ত্বাবধায়ক রামযানি, গোলাবারুদের হিসাবনিয়ন্ত্রক সীতারাম, পাটনার অভিজাত মীর আবদুল্লাহ, ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি—শাহ বান্দাগি ও অন্যরা, আর দু-তিনজন অভিজাত যারা জৈনুদ্দিনকে সম্মান জানাতে এসেছিলেন। এভাবে, তার অভিলাষ পূরণের অদম্য ইচ্ছায় জৈনুদ্দিন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করতেই ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার আফগান সহায়তা প্রাপ্তির আশা ভূ-পতিত হল, আর জলদিই তিনি শিকার হলেন আফগান ষড়যন্ত্রের।
আফগানপ্রধানদের জৈনুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এগিয়ে আসা
নির্ধারিত দিনে, আহমাদ পনি, মুরাদ শের ও ঠাকুর বাহেলিয়া পাঁচশো আফগান নিয়ে চিহিল সাতুনে প্রবেশ করেন পার্টনার প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, তখন শামশির খান শহরের কেন্দ্রে কোতোয়ালের চবুতরায় তিন বা চার হাজার আফগান নিয়ে পূর্ব দরজা ও প্রাসাদের দিকে ধাবমান প্রধান সড়ক দখল করেন। শামশির খানের আগমনের বার্তা পেয়ে মুরাদ শের তার অনুসারীদের দরবার থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন যেন শামশির খানের অনুসারীদের দরবারে স্থান করে দেওয়া যায়। জৈনুদ্দিনের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আবদুর রশিদ খান নামের এক আফগান তাকে ছুরি বসিয়ে দেয়, কিন্তু অতিরিক্ত স্নায়ুচাপে কাঁপতে থাকা হাতের আঘাত তার কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি।
মুরাদ শের তাকে দ্বিখণ্ডিত করেন
এরপর মুরাদ শের এগিয়ে এসে তার ধারালো তরবারির কোপে জৈনুদ্দিনকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন। তার শরীর বিভিন্ন টুকরো করে একখণ্ড জমিতে পুঁতে রাখা হয়, যা এখন পাটনা শহরের বেগমপুর মহল্লার মাকবারা-ই-হাইবাত জং নামে পরিচিত। জৈনুদ্দিনের শেষ পরিণতি করুণ হলেও তিনি তার কর্মফল ভোগ করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন রোশান খান তেরাহিকে কেবলমাত্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সন্দেহে তিনি হত্যা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে রোশান খান তেরাহির নির্মম গুপ্তহত্যা ছিল আফগান অসন্তোষের একটি মূল কারণ, যার ফলে ১৭৪৮-এর বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিধাবোধের বিস্তার
জৈনুদ্দিনকে হত্যার পর সবার মধ্যে দ্বিধা ছড়িয়ে পড়ে, আর তার অনেক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত পরিচারক আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মারা যান বা আহত হন। অনেকেই তাদের অস্ত্র আর সাজসজ্জা ছাড়াই পালিয়ে যান। আগে থেকেই করে রাখা পরিকল্পনামতো শামশির খান ও সর্দার খান জৈনুদ্দিনের প্রাসাদে ঢোকেন। জেনানা এলাকার প্রহরীরা পালিয়ে যায়, কিন্তু জৈনুদ্দিনের বিধবা আমিনা বেগম উপস্থিত-বুদ্ধি খাটিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় হারেম তাৎক্ষণিক তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়।
জৈনুদ্দিনের পরিবারের প্রতি অপমানজনক আচরণ
এরপর পালা এল জৈনুদ্দিনের বাবা হাজী আহমাদের, যিনি নিজের ছেলে ও ভাইয়ের উচ্চাশার আগুনে বরাবর হাওয়া দিয়ে এসেছেন। যখন আফগানরা প্রাসাদে ঢুকছিল, তখন হাজী আহমাদ দেয়ালের এক ফাটল দিয়ে পালিয়ে পাশের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। দুপুর দুটো পর্যন্ত তার হাতে সময় ছিল পালিয়ে বাংলায় এসে ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দেওয়ার, কিন্তু ৯০ বছর বয়সেও অতিরিক্ত সম্পদ আর নারীর লোভে তিনি রয়ে যান, যতক্ষণ-না আফগানরা তাকে ধরে ফেলে আর সন্ধ্যায় শামশির খানের কাছে নিয়ে যায়। আফগানরা তাকে ১৭ দিন ধরে অত্যাচার করে তার সমস্ত লুকোনো সম্পদের খোঁজ নেয়। তারা ৭০ লক্ষ রুপি, অগুণতি রত্ন আর সোনার পিণ্ড খুঁজে পায় প্রাসাদের মহানবী (স.)-এর পদচিহ্ন-সম্বলিত এক পাথরের নিচে। জৈনুদ্দিনের ঘর থেকে নাকি পাওয়া গিয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ রুপি, মতান্তরে কয়েক হাজার রুপি।
হাজী আহমাদের মৃত্যু
অত্যাচারের ধকলে হাজী আহমাদ ১৭৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মারা যান, আর এভাবে পৃথিবীর কাছে উদাহরণ রেখে যান সুখের সঙ্গে নষ্টামির অসংগতির । তার শব দাফন করা হয় জাফর খানের বাগিচার কাছে গঙ্গার তীরে সাবালপুর গ্রামের কাছে। জৈনুদ্দিন ও হাজী আহমাদের মালিকানাধীন সব ইমারতে প্রহরা বসানো হয়, কার্যত তাদের পরিবারের সবাই আফগানদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ে।
আফগান বিদ্রোহে পাটনার অধিবাসীদের তিনমাসব্যাপী দুর্দশা
পাটনার আফগান বিদ্রোহ পুরো তিনমাস সেখানকার সাধারণ অধিবাসীদের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। শহর হয়ে যায় অবাধ লুটের জায়গা, আর সেখানকার অধিবাসীদের দিন-রাত কাটতে থাকে ভয় আর চরম যন্ত্রণায়। পাটনার অধিবাসী গোলাম হোসেন লিখেছেন যে বকশি বাহেলিয়া ও শামশির খানের অনুসারীরা কোনো শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী ছিল না, কোনো বাধা মানছিল না, দুর্ভাগা শহরের প্রতিটি মহল্লায় তারা ছড়িয়ে পড়েছিল, এমন দিন ছিল না যেদিন কোনো ঘরবাড়িতে সহিংসতার আতঙ্ক আর কলুষতা ছড়ায়নি। বহু পরিবারের সম্ভ্রমহানি হয়েছে তাদের কারণে, আর খুব কম ভাগ্যবান পরিবারই আছে যারা এই দুর্বৃত্ত জাতের হাত থেকে পালাতে পেরেছিল। ১১ সালিমুল্লাহও ২ একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন : তারা (আফগান) শহরের ধনীদের বাড়িগুলো ঘিরে ফেলেছিল, আর লুট করেছিল। শহর আর তার চারপাশ তাদের তাণ্ডবের শিকার হয়েছিল; অনেকেই প্রাণ, সম্পদ আর পরিবারের সম্মান হারিয়েছিলেন; আর কেয়ামতের দিনের সব আলামত দেখা যাচ্ছিল । ওয়াফাও লিখেছেন যে আফগানরা সব জায়গায় তাণ্ডব চালিয়েছিল, (শহরের) প্রতিটি রাস্তায় ও বাজারে, আর নেওয়ার মতো যা পাচ্ছিল সবই লুট করছিল (অর্থ ও শস্য ইত্যাদি)। মুরাদ শের ও ঠাকুর বাহেলিয়া একমাস ধরে নাগরিকদের সম্পদ কেড়ে নিতেই ব্যস্ত ছিলেন, আর তারা সুদের ব্যবসায়ীদের (ব্যাংকার) থেকেও অর্থ লুটে নিয়েছিলেন তাদের বাড়ির সামনে প্রহরা বসিয়ে। আহমাদ পনি প্রচুর বণিকদের বিপণি ধ্বংস করেন; এমনকি ভবঘুরে আর ভিক্ষুকদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি, তাদেরও যা কিছু আছে দিয়ে দিতে বলা হয়। অনেকেই শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, আর যারা রয়ে যায়— তারা সম্মান আর সম্পদ, দুটোই হারিয়ে ফেলে ।
জাফর খানের বাগিচায় শামশির খানের শক্তিশালী শিবির স্থাপন
শামশির খান, মুরাদ শেরও অন্যদের মতোই পাটনা শহরের দায়িত্ব অনুসারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে জাফর খানের বাগিচায় শিবির স্থাপন করেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন আলীবর্দী তাকে শাস্তি দিতে বিহারে আসবেন, তাই তাকে প্রতিহত করতে তিনি নিজেকে ব্যস্ত করে তোলেন সেনাসংখ্যা বাড়ানোর দিকে। প্রকৃতপক্ষে পুরো উত্তর ভারত তখন আফগান দিয়ে ভরা। যতজনকে সম্ভব নিয়োগ করে শামশির খান তাদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে সম্পদ বিতরণ করেন ও সুযোগ-সুবিধা দেন। প্রতিদিন পাটনার অধিবাসীরা অন্তত পাঁচ থেকে ছয়বার ভয়ে কেঁপে উঠত, তাদের দামামার শব্দে, আর খোঁজ নিলেই দেখা যেত কোনো-না-কোনো আফগান অধিনায়ক মহড়া করে শহরের মধ্য দিয়ে শামশির খানের বাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছে।
এভাবে শামশির খান ও মুরাদ শের প্রায় ৪০ হাজার ঘোড়সওয়ার আর প্রায় সমসংখ্যক পদাতিক সৈন্য জোগাড় করে ফেলেন। আর সঙ্গে ছিল শক্তিশালী কামান, যেগুলো পাটনা দখলের সময়েই তাদের হাতে এসেছিল, মীর হাবিব আর জানোজির অধীনে থাকা মারাঠারাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
মারাঠা ও আফগানদের সম্মিলিত জোট
এই খবরে আলীবর্দী বিহারের আমানিগঞ্জের শিবির ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, শামশির খান ও মুরাদ শের জৈনুদ্দিনের বিধবা আমিনা বেগম, তার ছোটমেয়ে ও ছোটছেলে মির্জা মাহদিকে পাটনার প্রাসাদ থেকে বের করে রাস্তা দিয়ে পর্দা ও ছাউনিবিহীন গরুর গাড়িতে করে তাদের শিবিরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে সবার সামনে দিয়ে, আর আফগান খলনায়কদের এজন্য জনসাধারণেরা অভিশাপ দিতে থাকে।
আলীবর্দীর বিহার পুনরুদ্ধারের সংকল্প
১৭৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মির্জা হাকিম বেগ আলীবর্দীকে তার ভাতিজার বিশ্বাসঘাতকতায় হৃদয়বিদারক মৃত্যু আর ভাইয়ের অসম্মানজনক মৃত্যুর খবর জানান, সঙ্গে তার মেয়ের অপমানের খবরও দেন। এই খবরগুলো নবাবকে তীব্ৰ শোক আর হতাশায় উত্তেজিত করে ফেলে। কিন্তু জলদিই তিনি সাহসী হয়ে ওঠেন, আর পাটনার দিকে যুদ্ধযাত্রা করে পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নেন; আফগানদের কাছে বন্দী বেঁচে থাকা আত্মীয়দের ফিরিয়ে আনার আশায় ও দুই নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর বদলা নেওয়ার জন্য। তিনি তার বন্ধু ও সৈন্যদের নিয়ে এক সভা ডেকে পাটনায় যা হয়েছে তার বিবরণ দিয়ে তার শত্রুদের সঙ্গে লড়ার অদম্য স্পৃহা ব্যক্ত করেন, আর প্রয়োজনে বীরের মতো মরতেও চান এই অসম্মানের সঙ্গে মাথা নিচু করে থাকার চেয়ে। তিনি তাদের সুযোগ দেন বাড়ি ফিরে যাওয়ার, নয়তো তাকে এই বিপজ্জনক অভিযানে সঙ্গ দেওয়ার। সবাই কুরআন ছুঁয়ে শপথ নেয় আমৃত্যু তার পাশে থেকে লড়াই করার। তিনিও তাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন তাদের সমস্ত বকেয়া কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। জলদিই তার মেয়ে ঘষেটি বেগম ও তার স্বামী নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খানের থেকে আর্থিক সহায়তা আসে, আর জগৎ শেঠ মাহতাবচাঁদ থেকেও ধার করা হয় ( ৬০ লক্ষ রুপি) ও অন্য ব্যাংকারদের থেকেও ধার নেওয়া হয়। সৈন্যরা একবারেই অনেকখানি বকেয়া পেয়ে যায়। নবাব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তার সেনাবাহিনীর রসদের। মুর্শিদাবাদ শহরের রক্ষণাবেক্ষণের ভার ভাগাভাগি করে দেওয়া হয় নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খান আর আতাউল্লাহ খানের অধীনে, পাঁচ থেকে ছ হাজার সৈন্যসহ।
নবাবের মুর্শিদাবাদ ত্যাগ
এই সতর্কতামূলক উদ্যোগগুলো নিশ্চিত করার পর, আলীবর্দী পাটনার উদ্দেশ্যে তার আমানিগঞ্জের শিবির ত্যাগ করেন ১৭৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি, থেকে ১৬ হাজার অশ্বারোহী আর ২০ হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে। তিনি যখন ১৪ মার্চ মুর্শিদাবাদের ২৫ মাইল উত্তরে কোমরাহ পৌঁছান, তার সৈন্যরা আর অর্থ না পেলে একচুলও না-নড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নবাব সৈন্যদের জলদিই সন্তুষ্ট করেন, আর তারাও সাক্রিগলি দিয়ে বেরিয়ে ১৭ মার্চ ভাগলপুরে পৌঁছায়, আর মুঙ্গেরের দিকে যাত্রা শুরু করে।
মুঙ্গেরে যাত্রাবিরতি
পূর্ণিয়ার প্রশাসক সাইফ খান দেড় হাজার সৈন্য পাঠান শেখ দ্বীন মুহাম্মাদের অধীনে, যারা নবাবের দলের সঙ্গে সুলতানগঞ্জের কাছে মিলিত হয়। তিনি পেশওয়া বালাজি রাওয়ের কাছেও সাহায্যের আবেদন জানান বাংলার চৌথ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, আর বালাজিও জবাব দিয়েছিলেন যে, কিছুদিনের মধ্যেই পাটনা থেকে যাত্রা শুরু করবেন। নবাব মুঙ্গেরেই কিছুদিন বিরতি নেন তার আহত সৈন্যদের বিশ্রাম দিতে, আর সেখানেই টিকারির রাজা সুন্দর সিং এসে যোগ দেন দেড় হাজার অশ্বারোহী আর কিছু পদাতিক সৈন্য নিয়ে, আর সামাই ও নারহাটের জমিদার কামগার খানও এসময়ে যোগ দেন। প্রতিশোধ নিতে বের হওয়া বাংলার সেনাদল মুঙ্গের থেকে খুব দ্রুত পাটনা থেকে ৩৪ মাইল পূর্বে গঙ্গার তীরে বাড় এলাকায় পৌঁছে যায়। শামশির খান তার দিওয়ান আহমাদ খান কুরেশিকে পাটনার দায়িত্ব দিয়ে আসেন।
বাড়ের কাছে আগমন
নবাব গঙ্গার ডানদিকের তীর ধরে এগোতে থাকেন। বাড় শহরের ঠিক পশ্চিমে, গঙ্গা নিজেকে নানাভাগে ভাগ করে অনেকগুলো দিয়ারা বা দ্বীপের (চর) সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে উত্তরের ধারা গঙ্গার মূলধারা, আর প্রায় দুই মাইল দক্ষিণে পুরনো গঙ্গার খাত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। বাড় শহরের কাছে কিছু মাইল পশ্চিমে আরেকটি অগভীর প্রবাহ ছিল। আফগানরা সেখানে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল কামান বসিয়ে, শত্রুদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে। আলীবর্দী সামনে থেকে আক্রমণের ঝুঁকি নেওয়াটা সঠিক বলে মনে করেননি, তিনি আরও দু-মাইল দক্ষিণে গিয়ে স্থানীয় এক জমিদারির ভেতর দিয়ে আফগানদের কাছে অপরিচিত আরেকটি জায়গা দিয়ে একই প্রবাহ পেরিয়ে শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে গিয়ে পৌঁছান। এই পরিস্থিতিতে আফগানরা কামান ফেলে দ্রুত সেই জায়গা ত্যাগ করে, আর পশ্চিমদিকে আলীবর্দীর অবস্থানের ঠিক উল্টোদিকে গিয়ে অবস্থান নেয়। প্রহরায় আলীবর্দী পুরোরাত নির্ঘুম কাটান, হঠাৎ আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিটি সতর্কতা গ্রহণ করেন। ভোরে তিনি প্রার্থনা করেন দিনের বেলার যুদ্ধের সাফল্য কামনায়, আর কপালে ইমাম হুসাইনের কবরের এক টুকরো পবিত্র মাটি ঘষে নেন।
রানীসরাইয়ের যুদ্ধ
১৭৪৮ সালের ১৬ এপ্রিলের সকালে, আলীবর্দী বাড় থেকে আট মাইল পশ্চিমে রানীচক বা রানীসরাইয়ে চলে যান, আর সেখানকার সমতলে তার সৈন্যদের দাঁড় করান। বাহাদুর আলী খান নবাবের সমস্ত কামানের সামনে ছিলেন; তারপর হালকা বন্দুকের দায়িত্বে ছিলেন হায়দার আলী খান, রহম খান, মীর কাযিম খান ও দোস্ত মুহাম্মাদ খান; আর তারপর ছিল অগ্রগামী ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক বাহিনী–সৈয়দ আহমাদ খান, আল্লাহ ইয়ার খান, মির্জা ইরাজ খান, রাজা সুন্দর সিং ও কামগার খানের মাইয়ির অধীনে। নবাব নিজে পুরো বাহিনীর মধ্যভাগে এসে দাঁড়ান, উমর খান ও তার চার সন্তান আসালত খান, দিলের খান, আহমাদ খান ও মুহাম্মাদ খানকে সঙ্গে নিয়ে। আফগানদের মূল বাহিনী বাংলার বাহিনীর বিপরীতে লম্বা এক সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল, যা রানীসরাই থেকে প্রায় তিন মাইল লম্বা হয়েছিল পূর্বদিকে, আর তাদের মিত্র মারাঠারা তাদের বাহিনীর সঙ্গে একটি কোণ তৈরি করেছিল নবাবের বাহিনীর বামদিক বরাবর। আফগান বাহিনীর বামদিক ছিল হায়াত খানের অধীনে, সঙ্গে ছিল বড় কামান, যা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গঙ্গার দিকে প্রবাহিত এক চিকন খাত দিয়ে বাংলার বাহিনীর ডানদিকে আঘাত করার জন্য।
সর্দার খানের মৃত্যু
যুদ্ধ শুরু হয় কামানের অবিরাম গোলাবর্ষণের ভেতর দিয়ে। কামানের একটি গোলা দ্রুত সর্দার খানের মাথা উড়িয়ে দেয়, যিনি শামশির খানের থেকেও সাহসী ছিলেন আর প্রায় অর্ধেক আফগান সৈন্যের নেতৃত্বে ছিলেন। এটা তার সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেয় আর তারা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। হায়দার আলী খান মাস্কেটিয়ারদের (বন্দুকবাজদের) নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, একের পর এক বন্দুকের গুলি ছুড়তে থাকেন তাদের সারির দিকে লক্ষ্য করে, ধোঁয়ার মেঘের জন্য দিনের বেলাতেই আঁধার নেমে আসে। এভাবে আফগানরা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লে, আলীবর্দী শাহ জাহানইয়ার ও ফখরুল্লাহ বেগ খানকে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেও তারা তাদের জায়গা থেকে একচুলও নড়েননি। এমন সময় মারাঠারা তাদের মিত্রদের সহায়তা করতে আর অন্যদিকে নজর ফেরাতে পেছন থেকে আলীবর্দীর সৈন্যদলের লটবহরের দিকে আক্রমণ করে বসে, এমনকি কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। নানার পাশে থাকা সিরাজ-উদ-দৌলা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আর তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানাকে অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত না করে নবাব তার সেনাবাহিনীর সামনের সারিকে সরাসরি আফগানদের আক্রমণের নির্দেশ দেন, আর নিজেও সেই দলের পিছে এগোতে থাকেন। হাতির পিঠে সওয়ার তার কিছু সেনাপতি প্রবল বিক্রমে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লড়াই কাছাকাছি চলে এলে, প্রত্যেক সৈন্যই বিরোধী প্রতিপক্ষের সৈন্যের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। মাস্কেট-বলের আঘাতে আহত মুরাদ হাতির পিঠের হাওদাতেই লুটিয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে নবাবের দুই সেনাপতি— মীর কাযিম খান ও দোস্ত মুহাম্মাদ খান লাফ দিয়ে হাতিতে উঠে পড়েন।
মুরাদ শের খান ও শামশির খানের মৃত্যু
আহত অবস্থাতেও মুরাদ শের খান তার বাঁকানো ভারী তলোয়ার (সেবার) দিয়ে মীর কাযিম খানের কয়েকটি আঙুল কেটে ফেলেন, কিন্তু এসব ঘটনার মধ্যেই দোস্ত মুহাম্মাদ খান তার মাথা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলেন। একই সময়ে শামশির খানও আহত হয়ে হাতির উপর থেকে পড়ে গেলে নবাবের সেনাপতি দিলির খানের এক অনুসারী তারও মাথা আলাদা করে ফেলে। নেতাদের মৃত্যুতে হতবিহ্বল আফগানরা আর পুরো যুদ্ধে প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকা মারাঠা মিত্রবাহিনী যুদ্ধের ময়দানেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এরপর নবাব নিজে বিরোধীদলের শিবির দখল করেন। ফতোয়ার পাঁচ মাইল পূর্বে গঙ্গার তীরে বৈকণ্ঠপুরে কিছুদিন থাকার পর তিনি বিজয়ীর মতো পাটনায় প্রবেশ করেন আর তার মেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়দের জীবিত দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। পাটনার অভিজাত ও সাধারণ অধিবাসীরা আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে আফগান দুর্বৃত্তদের থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, যা তাদের মাথার উপর ডেমোক্লিসের তরবারির মতো ঝুলছিল টানা তিনমাস।
শামশির খানের পরিবারের প্রতি আলীবর্দীর মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার
আলীবর্দী একদল বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়ে দেন দ্বারভাঙায় আফগানদের মূল্যবান সম্পদ ও মালামাল বাজেয়াপ্ত করার জন্য। শামশির খানের পরিবারের নারীরা সুরক্ষিত ছিলেন বেত্তিয়ার রাজার কাছে, যিনি নবাবকে অনুরোধ করেছিলেন যেন তাদের ইচ্ছেমতো অন্য কোথাও চলে যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু তার অনুরোধ অগ্রাহ্য করা হয়। বরং আফগান সর্দারের পরিবারের নারীদের আনতে নবাব একদল বিশ্বস্ত লোক পাঠান, নবাব নিজে গঙ্গা পেরিয়ে বেত্তিয়ায় আসেন শিকারের অজুহাত দেখিয়ে; কিন্তু তিনি আসলে তার লোকেদের কাছে শামশির খানের বিধবা ও মেয়েকে হস্তান্তর করতে উদ্যোগী এই রাজাকে আতঙ্কিত করতেই সেখানে গিয়েছিলেন। নবাব শামশির খানের পরিবারের নারীদের প্রতি সদয় আচরণ করেন, তাদের তার নিজের জেনানায় আশ্রয় দেন ও তাদের সবধরনের সুযোগ- সুবিধার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি আত্মীয়দের অনুমতি নিয়ে শামশির খানের মেয়ের বিয়েও দেন শাহ মুহাম্মাদ ইসহাক নামের এক অভিজাত আফগানের সঙ্গে আর নবদম্পতি ও শামশির খানের বিধবা স্ত্রীকে অনুমতি দেওয়া হয় দ্বারভাঙায় ফিরে যাওয়ার, যেখানে তিনি তাদের ভরণপোষণের জন্য কিছু গ্রামও দান করেন। পরাজিত শত্রু পরিবারের নারীদের প্রতি আলীবর্দীর এই ভদ্রজনোচিত আচরণ ঠিক তার নিজের মেয়ে ও আত্মীয়দের প্রতি পাটনায় বিদ্রোহী আফগানদের বর্বর আচরণের উল্টো ছিল।
আলীবর্দীর বিহারে অবস্থান ও বিহারের প্রশাসন পুনর্গঠন
আলীবর্দী পরবর্তী ছয় মাস পাটনায় থেকে যান বিহারের প্রশাসন নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য। নাতি সিরাজ-উদ-দৌলাকে কেবল নামেই সেখানকার সহকারী প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়, মূল প্রশাসনিক কাজ ন্যস্ত করা হয় রাজা জানকিরামের উপর, যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সিরাজ-উদ-দৌলার সহকারী হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সৈয়দ আহমাদ খান আর সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে নবাব ১৭৪৮ সালের ৬ নভেম্বর পাটনা ত্যাগ করেন।
১৭৪৮ সালের নভেম্বরে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন
ভগবানগোলায় নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ, হোসেন কুলি খান ও মুর্শিদাবাদের অভিজাতেরা তাকে স্বাগত জানান, আর ১৭৪৮ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি বিজয়ীর মতো মুর্শিদাবাদে পা রাখেন। তিনি আফগানদের বিরুদ্ধে তার জয় ও অলৌকিকভাবে বিহার পুনরুদ্ধারের পুরো কৃতিত্ব আল্লাহর কৃপায় বলে উল্লেখ করেন, আর আবারও নামাজ আদায় করেন, যেমনটা রানীসরাইয়ের যুদ্ধের আগের রাতেও করেছিলেন।
ক্ষমতার জন্য আফগানদের হুঙ্কার
১৭৪৮ সালে বিহারের আফগান বিদ্রোহ আলীবর্দীর জন্য ভিন্ন ধরনের এক দুর্যোগ ছিল। এটা কেবল তার জন্য ব্যক্তিগত মানুষ হারানো, অর্থ ব্যয় আর তার পরিবারের জন্য চরম অবমাননাকরই ছিল না, এটা তার শাসন আর কর্তৃত্বকেও রীতিমতো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। এই বিদ্রোহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকার আফগান দুঃসাহসীদের সমর্থন ও সহযোগিতায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় আফগানিস্তানের শাসক আহমাদ শাহ আবদালির অবদানে, যিনি কাবুল, কান্দাহার, লাহোরের পর দিল্লির দিকে এগিয়ে এসেছিলেন এবং আলী মুহাম্মাদ রুহেলা নামের আরেক আফগান সর্দারের থেকে, যিনি সারহিন্দ থেকে সাহারানপুর হয়ে বারেলি পর্যন্ত এসে নিজেকে রোহিলাখণ্ডের অধিকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন (ফেব্রুয়ারি, ১৭৪৮)। প্রকৃতপক্ষে এই সময়টাকে বলা হয় আফগানদের পুনর্জাগরণের সময়, উত্তর-পশ্চিমের সানুদেশ (টেবিল-ল্যান্ড) আর ভারতীয় সমতল ভূমি — দু-জায়গাতেই; আর তারা স্পষ্টতই ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল ১৫২৬ ও ১৫৫৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে হিন্দুস্তানের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেওয়া মুঘলদের সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে। মহান মুঘলদের পুরো শাসনামলে তারা অস্থির ও অসংযত ছিল, ভিনদেশি সাম্রাজ্যের পাশে কাঁটা হয়ে ছিল। আওরঙ্গজিবের নীতি কাবুল থেকে লাহারের আফগান ও পাঠানদের আরও অসন্তুষ্ট করে তোলে, মুঘল বাহিনীর বিপর্যয়কর ফলের পর। আফগানরা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষয়ে-যাওয়া গাছের মূল কাঠুরে। তারা হিন্দুকুশের অন্যপারের মুসলিমদের ভারতে অনধিকার প্রবেশকারী ভাবত। তারা একটি জাতীয়তাবাদী ভাবধারা তৈরি করে নিজেদের শক্তিশালী বিরোধীপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা ভিনদেশি ক্ষমতা হোক বা দুঃসাহসী ভাগ্যান্বেষী, যেমনটা আলীবর্দী ছিলেন।
শ্রেষ্ঠত্বের জন্য আফগানদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অষ্টাদশ শতকের বাকি সময়টা ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। এটা মুঘলদের সাম্রাজ্যের বিভাজন ত্বরান্বিত করে, পরোক্ষভাবে শিখদের উত্থানে সহায়তা করে, কিন্তু ১৭৬১ সালের জানুয়ারিতে পানিপথের যুদ্ধে কঠিনভাবে উত্তরের দিকে আসতে চাওয়া মারাঠাদের বিরোধিতা করে, আর বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সবসময় তটস্থ করে রাখে এবং তাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নীতিকে ও জামান শাহের (১৭৯৩-১৮০০) সময়কাল পর্যন্ত নেটিভ স্টেটগুলোর সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। ১৭৫৭ সালের সংকটময় সময়ে, কলকাতার কাউন্সিল জানায় : … ঈশ্বরের কৃপায় ও আশীর্বাদে, আবদালি ফিরে যাচ্ছেন টানা সফর করে তার নিজের দেশে । দুররানিদের ভয় ভারতে অবস্থানরত বৃটিশদের এর পরের কিছু বছরও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। লর্ড ওয়লেসলি দাবি করেন যে তিনিই এই ভয় দূর করেছেন পারস্যে দুটো দূত পাঠিয়ে, প্রথমটি মাহদি আলী খানের কাছে ও দ্বিতীয়টা ক্যাপ্টেন ম্যালকমের কাছে।