অধ্যায়-৩ : হেলেনিজম শেষে

অধ্যায় ৩ : হেলেনিজম শেষে

সেলুসিদদের রাজা সপ্তম অ্যান্টিয়কাস মারা যাবার পর হিরক্যানাসের আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কারণ, সেলুসিদরা এ সময় দুর্বল হয়ে যায়। তাই তাদেরকে আর কর দিতে হতো না। এরপর হিরক্যানাস যখন নিজের নামে মুদ্রা চালু করলেন, তখন অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলো।

হিরক্যানাস জুদাহ জুড়ে নানা ধরনের নির্মাণকাজ শুরু করেন। অ্যান্টিয়কাস যে দেয়ালগুলো ভেঙে ফেলেছিলেন, সেগুলো তিনি পুনর্নির্মাণ করেন। বাইতুল মুকাদ্দাসের উত্তর দিকে একটি দুর্গও নির্মাণ করেন, নাম দেন ‘বারিস’। এছাড়া নিজের নামেও দুর্গ বানান তিনি।

তার চেয়েও বড় কথা, রোমান রিপাবলিক আর অন্যান্য জেন্টাইল (অ-ইহুদী) ক্ষমতাগুলোর সাথে তিনি সখ্যতা বাড়াতে লাগলেন। রোমান সিনেটেই দুটো বিল পাশ হয়, যাতে ইহুদী সাম্রাজ্যের সাথে মিত্রতার কথা বলা হয়। এমনকি রোমানরা হাসমোনীয় সাম্রাজ্যকে স্বাধীন থাকতে দেয়। রোমানদের সমর্থনকে পুঁজি করে চমৎকারভাবে শাসন করতে থাকেন হিরক্যানাস।

শুধু রোমানদের সাথেই নয়, মিসরের টলেমি সাম্রাজ্যের সাথেও তার সুসম্পর্ক। সম্ভবত মিসরে বসবাস করতে থাকা ইহুদীদের টলেমির দরবারে ভালো যোগাযোগ থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছিল। রোমকে সন্তুষ্ট করতে গ্রিক শহর অ্যাথেন্স আর পার্গামনও হিরক্যানাসকে সম্মান জানালো।

বেথেলহেমে খনন করে হিরক্যানাসের তেষট্টিটি মুদ্রা পাওয়া গেছে, যার এক পাশে লেখা “প্রধান ইমাম ইউহানা” আর অন্য পাশে লেখা “ইহুদী জামাত”। এ থেকে আন্দাজ করা যায়, তখনকার সময়ে ইহুদীদের মনোরঞ্জন করে চলা শাসক হিরক্যানাসের জন্য দরকারি ছিল।

জীবনের শেষ কাজ হিসেবে তিনি ধর্ম আর শাসনকাজ আলাদা করে যান। তিনি মারা যাওয়ার পর তার বিধবা স্ত্রী শাসনকার্য হাতে নেন। আর তার ছেলে জুডাস অ্যারিস্টোবুলাসকে দেয়া হয় প্রধান ইমামের দায়িত্ব। অবশ্য, ছেলে জুডাসের এ ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি। তিনি নিজের মাকে গ্রেফতার করে জেলখানায় পুরলেন, তাকে খাবার দাবারও দিতেন না।

জুডাসের কথায় একটু পর আসছি। তার আগে জুডাসের বাবা হিরক্যানাসের সাথে সাদুকি আর ফারিসিদের দ্বন্দ্বের বিষয়টা জেনে নেয়া যাক।

ইহুদীদের তৎকালীন সমাজে সবাই তাওরাতে বিশ্বাস করত বটে, তারপরেও মতবিভেদের অভাব ছিল না। অসংখ্য ভাগ উপবিভাগ দেখা যেত। প্রথম শতকের ইতিহাসবিদ জোসেফাসের মতে, এর মাঝে তিনটি প্রধান দলের কথা উল্লেখ করার মতো। এরা হলো সাদুকি, ফারিসি আর এসিন।

সাকিরা ছিলেন আর্থ-সামাজিক দিক থেকে একদম উঁচু স্তরের লোক। সম্ভবত রাজা দাউদ (আ)-এর ইমাম সাদুক-এর নাম থেকে এসেছে সাদুকি নামটি। হিব্রুতে এর অর্থ ‘সৎ’, আরবিতে ‘সাদিক’ নামের কাছাকাছি; যদিও ইংরেজিতে ‘স্যাজুসি’ ডাকা হয়। সাদুকিরা তাওরাতের সমস্ত আইন মানতে রাজি, তবে কেবলই আক্ষরিকভাবে। তারা পরকাল আর আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করত না, এমনকি ফেরেশতাদের অস্তিত্বেও না। মৃত্যুর পরপর আত্মার বিনাশ হয়, এটাই তাদের বিশ্বাস। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে, ভাগ্য আগে থেকে নির্ধারিত থাকে না। দুনিয়ার ভালো-খারাপ কর্মকাণ্ডের কোনো প্ৰতিফল নেই।

দ্বিতীয় দলটি হলো ফারিসি। এটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে, কিংবা হিব্রু ‘পারুশ’ থেকে, যার অর্থ ‘আলাদা’। কিছু স্কলার বলেন, তারা নিজেদেরকে আলাদা রাখতেন পবিত্রতার জন্য। এটি ছিল একটি সামাজিক আন্দোলন, একটি চিন্তাধারা। তারা বিশ্বাস করতেন, তাওরাতের আইনের ব্যাখ্যা হওয়া উচিৎ মূসা (আ)-এর সময়ের হিসেব ধরে। পাশাপাশি তারা পরকাল ও আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতেন। কেউ বলেন, ইতিহাসবিদ জোসেফাস একজন ফারিসি ছিলেন; আবার কেউ বলেন, তিনি ফারিসিদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তৎকালীন সময়ে প্রায় ৬,০০০ ফারিসি ছিলেন। সেইন্ট পল ছিলেন একজন ফারিসি। ফারিসিরা আইন ব্যাখ্যায় ওস্তাদ ছিলেন, তারা ভাগ্যে খুবই বিশ্বাস করতেন।

আর তৃতীয় দলটি ছিল এসি। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী। এদের অনেকেই জগৎ সংসার বিমুখী হয়ে জুদাহ রাজ্যের মরুভূমিতে সন্ন্যাসব্রতে ব্যস্ত থাকতেন। তাদের একটি দল বিয়ে করতেন না। সবাই একসাথে থাকতেন, একসাথে খেতেন। তারা ইসরাইলের রাজনীতিতে কোনো অবদানই রাখতেন না। তাই এদের সাথে কারও সখ্যতা বা শত্রুতা, কিছুই নেই। ধারণা করা হয়, ডেড সি স্ক্রল নামের যে লেখাগুলো এখন পাওয়া যায়, সেটি এসিনদেরই লেখা।

ইহুদীদের কেন্দ্রীয় বিচার আদালত ছিল সানহেদিন, অর্থাৎ ‘কাউন্সিল’। তেইশ বা একাত্তর জন র‍্যাবাইয়ের সম্মিলনে এ আদালত গঠিত। ফারিসি আর সাদুকি, দুই দলই সানহেদ্রিনের সদস্য ছিলেন। পরবর্তী যুগগুলোতে ইহুদীরা যখন নির্যাতিত জীবন কাটায়, তখন সানহেদ্রিন নাম লুকিয়ে একে ‘বাইত হা-মিদ্রাস’ বা ‘শিক্ষাঘর’ বলে ডাকা হতো।

একটু আগে উল্লেখ করা ডেড সি স্কুলের বিষয়ে আসা যাক। জুদাহ রাজ্যের মরুভূমির বুকে কুমরান গুহা থেকে উদ্ধার করা হয় প্রাচীন ইহুদীদের এসব হিব্রু পাণ্ডুলিপি। এ গুহাগুলো মৃত সাগর বা ডেড সির উত্তর তীরে। তাই উদ্ধারকৃত পাণ্ডুলিপিগুলোকে ‘ডেড সি স্ক্রল’ বলা হয়; আবার ‘কুমরান কেভ স্ক্রল’ নামেও ডাকা হয়। খ্রিস্টপূর্ব শেষ তিনটি শতক আর প্রথম খ্রিস্টীয় শতক জুড়ে এ স্ক্রলগুলো লেখা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হারিয়ে যাওয়া স্ক্রলগুলোর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত এই ডেড সি স্ক্রল। বাইবেলের বাইরের অনেক কিছুই আমরা এ স্ক্রলগুলো থেকে জানতে পারি। প্রায় সবগুলো স্ক্রলই ইসরাইল জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এখন, যদিও জর্ডান আর ফিলিস্তিনও এ স্ক্রলগুলোর মালিকানার দাবিদার।

ডেড সি এলাকা থেকে কয়েক হাজার স্ক্রল উদ্ধার করা হয়েছে। তবে খুব কম স্ক্রলই ঠিকভাবে পড়ার মতো অবস্থায় আছে। এর মাঝে কুমরান গুহারগুলোই উল্লেখযোগ্য। এগারোটি গুহা থেকে মোট ৯৮১টি স্কুল পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত প্রথম আবিষ্কারের কৃতিত্ব কয়েকজন রাখালের।

১৯৪৭ সালের দিকে মুহাম্মেদ, জুমা আর খলিল মূসা নামের কয়েকজন বেদুইন রাখাল কুমরানের গুহায় একটি কলসে সাতটি স্কুল আবিষ্কার করে, যখন তাদের একজন ভুল করে গুহার ভেতরে পড়ে যায়। মুহাম্মেদ গুহা থেকে বেরিয়ে এল হাতে কয়েকটি স্ক্রল নিয়ে। সেগুলো শিবিরে নিয়ে গিয়ে পরিবারকে দেখায় সে। কী করবে ভেবে না পেয়ে তারা সে স্ক্রলগুলো টানিয়ে রাখলো তাঁবুর খুঁটির সাথে। মাঝে মধ্যে লোক এলে খুলে খুলে দেখায়। একটা পর্যায়ে একটি স্কুল ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে যায়। তখন স্কুলগুলোকে বেথেলহেমের এক ডিলারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেই ডিলার এগুলোকে মূল্যহীন বলে ফিরিয়ে দিল। তবে বেদুইনরা হাল ছাড়লো না, একজনের কাছে তিনটি স্কুল প্রায় সোয়া তিনশো ডলার মূল্যে বিক্রি করতে পারলো। পরের বছর সাতটি স্ক্রল নজরে পড়ে আমেরিকান স্কুলস অফ অরিয়েন্টাল রিসার্চের বিশেষজ্ঞ জন ট্রেভরের। তার উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে এ স্কুলগুলো উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়। এ স্কুলগুলোতে পাওয়া যায় নানা অজানা তথ্য। তবে আজও সমস্ত স্কুলের মানে বের করা যায়নি।

একটু আগে মাকে গ্রেফতার করা জুডাস অ্যারিস্টোবুলাসের কথা বলছিলাম। ইতিহাসের পাতায় তাকেই হাসমোনীয় সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১০৪ সালে তিনি ক্ষমতা হাতে নেন, আর তার মৃত্যু হয় ঠিক এক বছর পরেই। তখন এ ক্ষমতা চলে যায় তার ভাই জোনাথান আলেকজান্ডারের হাতে। তবে তার নাম বদলে রাখা হয় আলেকজান্ডার ইয়ান্নাই।

রাজা আলেকজান্ডার তার মৃত ভাইয়ের বিধবাকে বিয়ে করেন। সামরিক অভিযান থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ মিলিয়ে তার পুরো শাসনকাল ছিল রক্তপাতময়। তবে বাইবেলের বাইরে আলেকজান্ডারের রাজত্বকেই সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে বড় ইহুদী রাজ্য হিসেবে ইতিহাসে দেখা হয়। ফিলিস্তিনের ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদীর আশেপাশের অঞ্চল পর্যন্ত আলেকজান্ডারের রাজত্ব ছিল 1 দ্বিমতের কারণে তিনি অনেক মানুষকে হত্যা করেন।

আলেকজান্ডারের রাজত্বের সময় ফারিসিরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তাদের দাবি, তিনি হেলেনিস্টিক প্রভাব ফেলছেন রাজ্যে। ফারিসিরা তাই আলেকজান্ডারকে অগ্রাহ্য করে নিজেরাই মুদ্রা বানাতে শুরু করেন। কিন্তু এই বিদ্রোহ টেকেনি, মাঝ দিয়ে অনেকে প্রাণ হারালেন।

আলেকজান্ডার মারা যাবার পর তার স্ত্রী (যিনি আগের রাজারও স্ত্রী ছিলেন) ক্ষমতা হাতে তুলে নেন। রানী সালোমি আলেক্সান্দ্রা ক্ষমতায় আরোহণ করে সব নিয়ম বদলে দিলেন। হেলেনিজমের ছিটেফোঁটা থাকলেও তা বাতিল করলেন। সব রায় দিলেন ফারিসিদের পক্ষে, যেন তারা তার হাতে থাকেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৭৬ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি স্বাধীন ইসরাইলের শেষ রানী, এবং শেষ শাসক। সত্যি বলতে, ইসরাইলের ইতিহাসে কেবল দুজন নারী শাসক ছিলেন। এক এই আলেক্সান্দ্রা, অন্যজন রাজা আহাব আর রানী জেজেবেলের কন্যা আতালিয়া।

রানী আলেক্সান্দ্রার মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেন। তাদের দুজনের নামই পূর্ববর্তী রাজাদের নামে-দ্বিতীয় হিরক্যানাস ও দ্বিতীয় অ্যারিস্টোবুলাস। দক্ষিণ ইসরাইলের ইদুমিয়া থেকে অ্যান্টিপার্টার নামের এক গোত্রপতি এলেন দ্বিতীয় হিরক্যানাসের আমন্ত্রণে। হিরক্যানাস তাকে বললেন, তিনি যেন তার মিত্র জর্ডানের নাবাতীয়দের নিয়ে হিরক্যানাসের সমর্থনে জেরুজালেম আক্রমণ করেন। কিন্তু তারা চিন্তাও করেননি, অন্য দিক থেকে কেউ এসে তাদের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়ে যাবে।

তখন সদ্য সিরিয়া জয় করেছেন রোমান নেতা পম্পে। তার অভিযানেই নির্ধারিত হবে হাসমোনীয়দের ভবিষ্যৎ। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে পম্পে দ্য গ্রেটকে অনুরোধ করা হলো হাসমোনীয় রাজ্যের উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা একটু দেখে দিতে। তিনি ভালো মতোই দেখে দিলেন! হাসমোনীয় সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেল।

দুই ভাই-ই সিরিয়ার দামেস্কে গিয়ে পম্পেকে বলেন, বিষয়টা সমাধান করে দিতে। পম্পে বললেন, তিনি স্বয়ং জুদাহ রাজ্যে এসে সমাধান করবেন। অ্যারিস্টোবুলাস পম্পের সমাধানের অপেক্ষায় না থেকে দামেস্ক ত্যাগ করে আলেকজান্দ্রিয়াম দুর্গে নিজেকে আটকে রাখলেন। এতে পম্পের রাগ উঠে গেল। তিনি তার বাহিনী নিয়ে জুদাহ গেলেন, তার বাহিনী দেখেই অ্যারিস্টোবুলাস আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু যখন জেরুজালেম অধিকার করে নিতে গেল তার বাহিনী, তখন অ্যারিস্টোরুলাসের সমর্থকরা রোমানদের ঢুকতে দিল না। আবারও রেগে গিয়ে পম্পে অ্যারিস্টোবুলাসকে গ্রেফতার করলেন, এবং জেরুজালেম অবরোধ করলেন।

জোসেফাস বলেন, পম্পে দেখতে পেলেন জেরুজালেমের দেয়ালগুলো এত শক্তিশালী যে এগুলো ভেদ করে আক্রমণ করা বৃথা। তার ওপর শহরে যদি ঢুকেও যান তিনি, লোকজন টেম্পল অফ সলোমনে আশ্রয় নিতে পারবে। সেই টেম্পলের দেয়াল আরও শক্তিশালী।

তবে দ্বিতীয় হিরক্যানাসের সমর্থকেরা সম্ভবত শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকের একটি দেয়াল খুলে দিল। সেখান দিয়ে রোমানরা ভেতরে প্রবেশ করলো। এর ফলে পম্পে প্রাসাদ আর জেরুজালেমের ওপরের দিকের দখল পেয়ে গেলেন, কিন্তু অ্যারিস্টোরুলাসের সমর্থকেরা শহরের পুব দিক অর্থাৎ বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা নিজেদের দখলে রেখেছে। পম্পে তাদেরকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিলেন, কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করল।

পম্পে রেগে গিয়ে পুরো বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন বাইতুল মুকাদ্দাস। কিন্তু সেখানকার প্রতিরক্ষা খুবই ভালো। নানা ফন্দি ফিকিরে তিন মাস কেটে যাবার পর পম্পের বাহিনী বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করতে পারলো। ভেতরের ১২,০০০ ইহুদীকে গণহত্যা করা হলো। এ সময় মাত্র কয়েকজন রোমান সেনা মৃত্যুবরণ করে।

আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট রাখার জায়গাকে বলা হয় হোলি অফ দ্য হোলি’জ, সেখানে কেবল প্রধান ইমামের প্রবেশের অনুমতি থাকে। স্বয়ং পম্পে সেখানে প্রবেশ করে বিনষ্ট করেন সবকিছু। তবে তিনি সেখান থেকে কিছু সরাননি, কোনো ধনসম্পদ বা একটি মুদ্রাও নয়। বরং পরদিনই তিনি আদেশ করেন পুরো বাইতুল মুকাদ্দাস ধুয়ে মুছে ঠিক করতে, আবার ইহুদী রীতি চালু করতে। অ্যারিস্টোবুলাসকে ধরে নিয়ে গেলেন পম্পে, রোমে প্রবেশ করলেন বিজয়ীর বেশে।

তবে যাওয়ার আগে পম্পে দ্বিতীয় হিরক্যানাসকে প্রধান ইমাম পদে বসিয়ে যান। কিন্তু তার শাসক উপাধি কেড়ে নেয়া হয়। অনেকদিন পর, ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম তাকে জুদাহ ও গালিলির শাসক হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। কাগজে কলমে জুদাহ স্বাধীন রইলো, কিন্তু সিরিয়ার রোমান শাসকদের কাছে কর দিতে হতো। পুরো রাজ্যকে পাঁচটি জেলায় ভাগ করা হলো। প্রত্যেক জেলার স্থানীয় শাসকগোষ্ঠী থাকবে, যাদের বেশিরভাগ সাদুকি। যেমন একটু আগে অ্যান্টিপার্টারের নাম বলা হলো, তিনি ক্ষমতা পেলেন ইদুমিয়ার, সেই সাথে তিনি কর সংগ্রাহকের দায়িত্বও পেলেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালে পম্পে মারা যাবার পর, দ্বিতীয় হিরক্যানাস আর অ্যান্টিপাটার মিসরের বিরুদ্ধে সৈন্য দিয়ে সমর্থন দিলেন জুলিয়াস সিজারকে। এর পুরস্কার হিসেবেই আসলে হিরক্যানাসকে শাসক উপাধি ফিরিয়ে দেয়া হয়, আর তার মন্ত্রী হন অ্যান্টিপাটার। জুলিয়াস সিজার জুদাহ বা ইহুদী রাজ্যের বাইরে ইহুদীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। ইহুদীদেরকে উপাসনায় কেউ বাধা দেবে না। তারা বিনা বাধায় জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাসে উপহার পাঠাতে পারবে। তাদেরকে জোরপূর্বক সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হবে না। নিজেদের বিচার আচার ইহুদী সানহেদ্রিন নিজেরাই করবে। রোমানদের সাহায্য চাইলেই কেবল চূড়ান্ত বিচারে সাহায্য করা হবে।

অ্যান্টিপার্টারের পুত্র ফাসেল হলেন জেরুজালেমের গভর্নর। তার আরেক পুত্র হেরোদ হলেন গালিলির গভর্নর। গালিলিতে একটি বিদ্রোহ হয়েছিল এ সময়, হেরোদ সেটি তুলেমূলে নির্মূল করেন। তার নির্দয়তার কারণে সানহেদ্রিন তাকে জুদাহ থেকে বহিষ্কার করে।

ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের মতো সিনেটরদের হাতে নিহত হলেন জুলিয়াস সিজার। তখন খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সাল, অর্থাৎ ইহুদীদের এ নতুন সুযোগ সুবিধার মাত্র তিন কি চার বছর হলো। তবে সিজারের গুপ্তহত্যার পর ক্যাসিয়াস হেরোদকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যেমনটি সিজার বেঁচে থাকার সময়ও সিরিয়ার গভর্নর দিয়েছিলেন।

জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মার্ক অ্যান্টনি আর অক্টাভিয়ান এগিয়ে আসেন, তাদের হাতে পরাজিত হয়ে ক্যাসিয়াস আত্মহত্যা করেন। মার্ক অ্যান্টনি ও অক্টাভিয়ান ফাসেল আর হেরোদকে শাসক হিসেবে রাখেন, যদিও হেরোদের ব্যাপারটা মেনে নিতে চায়নি ইহুদীরা। তাতে অ্যান্টনি ও অক্টাভিয়ানের কিছু যায় আসেনি। রোমানদের অধীনস্ত রাজা হিসেবে ফাসেল ও হেরোদ জুদাহ শাসন করতে থাকেন।

কিন্তু কিছু সময় পরেই, খ্রিস্টপূর্ব ৪০ সালে পারস্যের পার্থিয়ানরা আক্রমণ করে রোমানদের অধিকৃত এশিয়া মাইনর অঞ্চল, আর সেই সাথে সিরিয়া ও জুদাহ। ভাইপো অ্যান্টিগোনাসের হাতে সিংহাসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হন রাজা দ্বিতীয় হিরক্যানাস: পার্থিয়ানদেরকে ডেকে এনেছিলেন এই অ্যান্টিগোনাসই।

হেরোদ এ চাল বুঝে যান, তিনি পার্থিয়ানদের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে তাদের শিবিরে যেতে মানা করেন ফাসেলকে। কিন্তু তবুও সেখানে যান ফাসেল, সাথে ছিলেন হিরক্যানাস। হিরক্যানাসের জীবিত দেহ ক্ষতবিক্ষত করে পার্থিয়ানরা। এমন ভাগ্য যেন বরণ করতে না হয়, সেজন্য নিজের মাথার মগজ নিজেই খুলি ফাটিয়ে বের করে আত্মহত্যা করেন ফাসেল। মারা যাবার আগে তিনি নিশ্চিত করেন যে, ছোট ভাই হেরোদ (airpin হিব্রু হোর্দোস’) জেরুজালেম থেকে পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেছেন।

কিন্তু পালিয়ে যাওয়া হেরোদ হয়তো তখনও জানতেন না, তার দম ফুরায়নি। তিনি আরও অনেক বছর টিকে থাকেন। এই সেই ‘হেরোদ দ্য গ্রেট’, যার সময় জন্ম নেন যীশু খ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *