অধ্যায় ৩ – সিডিকে ওভারনাইট
১
টার্নস্টিলসের বাইরে বেরিয়ে সে হাতঘড়িতে দেখল সাড়ে আটটা বাজে। অদ্ভুত তো। ঘুরে দেখল ট্রেন শিডিউলের ওপরে রাখা ঘড়িতে আটটা পঁয়তাল্লিশ দেখাচ্ছে। তাকায়ুকি নামিয়া ভ্রূ কুঁচকে ভাবল, হতচ্ছাড়া ঘড়িটা আবার নষ্ট হয়েছে।
কলেজে ওঠার সময় বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে ঘড়িটা পেয়েছিল। আজকাল এতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, খুব ধীরে চলে। বিশ বছর চলার পর এর থেকে কী-ই বা প্রত্যাশা করা যায়? হয়তো কোয়ার্টজ ক্রিস্টালের ঘড়ি কিনে ফেলা উচিত এখন। ওসব এককালে গাড়ির চেয়েও বেশি দামি ছিল। যুদ্ধের কারণে দামে ভাটা পড়েছে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। রাস্তার দুপাশে দোকানের সারি। রাতেরবেলা এগুলো খোলা দেখতে অদ্ভুত লাগে তার। জানালা দিয়ে যেটুকু দেখা যায় তাতে তাকায়ুকি বুঝল এসবই বেশ উন্নতমানের ব্যাবসা। স্পষ্টতই নতুন বাসিন্দাদের আগমন স্টেশনের আশেপাশের জায়গার চাহিদা খুব বাড়িয়ে দিয়েছে।
মানে এই মরা শহরের চাহিদা বাড়িয়েছে? তাকায়ুকির বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তার শহর আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, সেটা ভাবতে ভালোই লাগল। নিজের পারিবারিক দোকানটাও স্টেশনের পাশে হলে খারাপ হতো না।
দোকানের রাস্তা থেকে একটা মোড় ঘুরে পাশের রাস্তায় চলে এলো সে। কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেল নতুন দালানের সারি। যতবারই সে এখানে আসে, ততবারই জায়গাটা দেখতে অন্যরকম লাগে তার। কিছু নতুন বাসা এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এখান থেকে অনেকেই প্রত্যহ টোকিওতে যাতায়াত করে। এক্সপ্রেস ট্রেনে গেলেও দুই ঘণ্টা লেগে যায়। প্রত্যহ এটা করার কথা তাকায়ুকি ভাবতেও পারে না। সে শহরে স্ত্রী-পুত্রের সাথে বাস করে। তাদের অ্যাপার্টমেন্ট খুব বড়ো নয় কিন্তু দুটো বেডরুম, একটা লিভিং রুম, একটা ডাইনিং রুম আর একটা কিচেন যথেষ্ট।
অন্যভাবে দেখলে, এই দূরবর্তী যাতায়াত যতই অযৌক্তিক হোক না কেন, তাতে করে যদি জীবনের সমস্যাগুলো দূর হয়, তাতে ক্ষতি কী। জীবনে সবকিছুই তো পরিকল্পনামাফিক হয় না। যদি তার জীবনের সমস্যাও দূরবর্তী যাতায়াতের মাধ্যমে সমাধান করা যেত তাহলে সেও হয়তো তাই করত।
কন্সট্রাকশন কাজের শেষ প্রান্তে রাস্তাটা একটা ‘T’ আকৃতি ধারণ করে। তাকায়ুকি ডানে মোড় নিয়ে ঢালের রাস্তা বেয়ে হাঁটতে শুরু করে। এখান থেকে সে চাইলে চোখ বন্ধ করেও বাসায় চলে যেতে পারবে। তার শরীর যেন গন্তব্যস্থল সহজাতভাবেই জানে। হাইস্কুলের পর থেকে কত লক্ষ বার এই পথে যাতায়াত করেছে সে, তার হিসেব নেই।
সামনে, ডানে একটা ছোটো বিল্ডিং দেখতে পেল সে। রাস্তার আলোতে সাইনটা দেখা যায় কিন্তু এত দূর থেকে শব্দগুলো মলিন হয়ে দুর্ভেদ্য রহস্যে পরিণত হয়েছে। শাটারটা তোলা।
আর কাছে আসতেই সাইনের লেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল—নামিয়া জেনারেল স্টোর।
বাসা আর পাশের গ্যারেজের মাঝের তিন ফিট প্রশস্ত গলি আছে। তাকায়ুকি সেদিক দিয়ে হেঁটে পেছনের দরজার কাছে চলে এলো। এলিমেন্টারি স্কুলে থাকতে এখানে তার বাইকটা রাখত।
পেছনের দরজা দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকা যায়। দরজাটার পাশেই একটা মিল্ক ক্রেট। দশ বছর ধরে কোনো দুধ ডেলিভারি দেওয়া হয়নি এখানে। তাকায়ুকির মা মারা যাবার পর কিছু দিন তাকায়ুকি দুধ ডেলিভারি দিতো। এরপর বন্ধ করে দিয়েছে। ক্রেটটা কেউ আর ফেরত চায়নি।
মিল্ক বিনের পাশে একটা বোতাম আছে। সেটা চাপলে ভেতরে শব্দ হয়। হতো আর কী, এখন আর কাজ করে না সেটা।
তাকায়ুকি নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ফেলল। জুতার র্যাকে একজোড়া পরিচিত স্লিপার আর একজোড়া চামড়ার জুতা। এদের মালিক একজনই।
‘হ্যালো! কেউ আছেন?’ তাকায়ুকি গম্ভীর গলায় ডাকল। কিন্তু উত্তর এলো না। জুতো খুলে রান্নাঘরে ঢুকল সে। এরপরই তাতামি রুম। সামনে স্টোর।
তাতামি রুমে ইউজি ছোটো একটা টেবিলের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। তার পরনে একটা সোয়েটার আর লম্বা আন্ডারওয়্যার। সে ধীরে ধীরে তাকায়ুকির চেহারার দিকে তাকালো। কেবল তার চেহারার দিকে। চোখে বড়ো চশমা।
‘ওহ, তুমি এসেছো।’
‘ওহ? এটুকুই বলবে? দরজা এভাবে খুলে রাখতে হয় না। কতবার বলব? লক করে রাখবে।’
‘চিন্তা কোরো না, কেউ এলেই আমি বুঝে যাবো।’
‘এখন তো বুঝতে পারলে না। আমি এসেছি শুনতেই পাওনি।’
‘শুনেছি, কিন্তু আমি চিন্তা করতে ব্যস্ত ছিলাম। একারণে তোমার কথার উত্তর দেইনি।’
‘আবার বাহানা।’ তাকায়ুকি হাতের কাগজের ব্যাগটা টি টেবিলে রেখে মেঝেতে আসন পেতে বসল। ‘কিমুরায়া থেকে কিছু রেড বিন পাস্তা এনেছি, বাবা। তোমার পছন্দের খাবার।’
‘বাহ,’ ইউজি খুশি হয়ে উঠল। ‘এসবের কী দরকার ছিল।’
‘ব্যাপার না।’
ইউজির উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হলো। কাগজের ব্যাগটা নিয়ে বেদির মুখোমুখি দাঁড়ালো সে। পেস্ট্রিগুলো স্ট্যান্ডে রেখে দুবার বেল বাজিয়ে আবার বসে পড়ল। ইউজি হয়তো ক্ষুদ্রাকায়, তবে আশি বছর বয়সের তুলনায় ভারসাম্য চমৎকার।
‘রাতের খাবার খেয়েছো?’ তাকায়ুকি জিজ্ঞাসা করল।
‘এক বোল সোবা নুডল খেয়েছি। ভাবছিলাম রাতে এখানেই থাকব।’
‘ফুমিকোকে বলে আসতে পারলেই হলো।’
‘সেও তোমাকে নিয়ে আমার মতই চিন্তিত। তোমার শরীর কেমন?’
‘ভালো। এতদূর কেবল আমার খোঁজ নিতে আসতে হবে না তোমাকে। ‘দুঘণ্টা বরবাদ করে এখানে আসার পর এই কথাটা দারুণ শোনালো।’
‘আমি কেবল বলছি এখানে চিন্তার কিছু নেই। যাই হোক, আমি এই মাত্র গোসল করে বের হয়েছি। টাবটা এখনও ভরা। ঠান্ডা হয়নি। চাইলে তুমিও গোসল করে নিতে পারো।’
ইউজি টেবিলের ওপরে ছড়ানো স্টেশনারি নিয়ে ব্যস্ত। পাশেই নামিয়া জেনারেল স্টোরকে, লেখা একটা খাম।
‘এটা আজ রাতে এসেছে?’
‘না, কাল এসেছিল। খেয়াল করিনি।’
‘আজ সকালে এর উত্তর দেওয়ার কথা না?’
নামিয়া জেনারেল স্টোরকে উদ্দেশ্য করে লেখা সব চিঠির উত্তর পরদিনই মিল্ক ক্রেটে পেয়ে যাবে—এটা ইউজির ব্যক্তিগত রীতি। একারণেই প্রতিদিন সে সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে যায়।
‘এবার দেওয়া হয়নি। সে জানে খুব দেরি করে পোস্ট করেছে। চিঠিতেই লেখা আছে। আমাকে সময় নিতে বলেছে। উত্তর পরদিন দিলেও সমস্যা নেই।’
‘তাই নাকি?’
তাকায়ুকি কখনও এসবের মানে বুঝে উঠতে পারেনি। অন্য মানুষের সমস্যার সমাধান দিয়ে একটা জেনারেল স্টোরের মালিকের কী লাভ হতে পারে? হ্যাঁ এর পেছনের গল্পটা সে জানে। সেটা কোনো রহস্য না। কিছু ম্যাগাজিন তো তাদের সংখ্যায় ইউজিকে তুলেও ধরেছে। এরপর থেকে চিঠির সংখ্যা বেড়ে যায়। গুরুতর চিঠিও ছিল, ঠাট্টার চিঠিও ছিল। কিছু কিছু তো সোজাসাপটা হয়রানি করেছে। এক রাতে ইউজি ত্রিশটা চিঠি পায়। সবগুলোর হাতের লেখা একইরকম আর মূল বিষয়গুলোও ফালতু। কিন্তু ইউজি সবগুলোর জবাব দিয়েছিল।
তাকায়ুকি থামাতে চেয়েছিল তাকে। ‘কী করছো? এরা তোমার সাথে মজা করছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট কোরো না তো।’
কিন্তু বয়স্ক লোকটা এসব থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। এমনকি সে তার ছেলেকে করুণা করে বলেছিল, ‘তুমি কিছু বুঝো না, তাই না?’
‘কী বুঝব?’ রাগে গা জ্বলে গেলেও ওপরে ওপরে শান্ত ভাব ধরে রেখে বলেছিল তাকায়ুকি।
‘ঠাট্টা, হয়রানি, এসবে আমার কিছু আসে যায় না। প্রতিটা চিঠিই সাহায্যের আর্তনাদ নিয়ে আসে আমার কাছে। এরা আমাদের মতোই। অন্তরে ক্ষত নিয়ে ঘুরে। রক্তাক্ত হৃদয়। প্রমাণ হিসেবে দেখতে পারো: সবাই দেখে আমি উত্তর দেই কিনা। এখানে এসে মিল্ক ক্রেটে উঁকি দেয়। ভাবে আমি তাদেরকে কী উত্তর দেবো। ভাবো। এমনকি এই ত্রিশটা চিঠি লিখতেও কত সময় লেগেছে। উত্তরের আশা না থাকলে এমনটা কেউ করত না। তাই আমি উত্তর দিচ্ছি। এবং দিয়ে যাবো। যে মন থেকে আমার কাছে সাহায্যের আবেদন করছে তাকে আমি কখনই ফিরিয়ে দেবো না।’
আর ইউজি আসলেই সেই ত্রিশটা চিঠির উত্তর দিয়েছিল। সারারাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গিয়েছিল উত্তর লিখতে লিখতে। মিল্ক বিনে রেখে দেয় সেগুলো। সকাল আটটায় স্টোর খোলার আগেই সব উত্তরগুলো নিয়ে যায় কেউ। সেই ঠাট্টা এখানেই শেষ হয়। কিছুদিন পর একটা কাগজ আসে, কেবল একটা বাক্য লেখা: ‘আমি দুঃখিত। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’ এই প্রেরকের হাতের লেখা এবং ত্রিশটা চিঠির প্রেরকের হাতের লেখা এক। ইউজি সেই নোট দেখে কতটা গর্বিত হয়েছিল তা তাকায়ুকির এখনও মনে আছে।
তাকায়ুকি ভেবেছিল তার বাবার বাঁচার উদ্দেশ্য এটাই। তাকায়ুকির মা হৃদরোগের সমস্যায় মারা যাবার পর থেকে ইউজি তার উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। তার সব সন্তানই বাড়ি ছেড়ে যার যার জীবিকা নির্বাহের পথে চলে গিয়েছিল। এই একাকীত্ব তখন সত্তর বছর বয়সি বৃদ্ধ লোকটার প্রাণশক্তি ক্ষয় করে ফেলে।
ইউরিকো নামে এক বড়ো বোন আছে তাকায়ুকির। তাকায়ুকির চেয়ে দুই বছরের বড়ো সে। সে যেহেতু তার স্বামীর বাসায় থাকে তাই সেও ইউজিকে তেমন সাহায্যের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। সব তখন তাকায়ুকির কাঁধে পড়ে। কিন্তু তার নিজের ছোট্ট পরিবার ছিল, যারা একটা কোম্পানি হাউজে থাকত। সেখানে ইউজির থাকার মতো জায়গা ছিল না।
ইউজিকে তখন তার সন্তানদের অবস্থা মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু প্রাণশক্তি হারিয়েও, স্টোর বন্ধ করে দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখায়নি ইউজি
এরপর একদিন, তাকায়ুকি ইউরিকোর ফোন পায়।
‘আমি অবাক হয়ে গেছি। সে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। হয়তো মা মারা যাবার আগে যেমন ছিল তার চেয়েও বেশি প্রাণবন্ত। আমার খুব স্বস্তি লাগছে। তুমি গিয়ে তার সাথে দেখা করে এসো। অবাক হয়ে যাবে।’
তার বোন অনেক লম্বা সময় ধরে তাদের বাবাকে দেখেনি। এভাবে ইউজিকে দেখে সে খুব খুশি হয়।
‘জানো বাবার অবস্থা এখন খুব ভালো।’
তাকায়ুকি বলল সে জানত না।
অবশেষে ইউরিকো বলল যে তাদের বাবা জীবনের দিকনির্দেশকের দায়িত্ব পালন করছে।
তাকায়ুকি এর মানে বুঝল না। জীবনের দিকনির্দেশক মানে আবার কী? এর পরের ছুটির দিনই সে বাড়ি আসে। বাসার দৃশ্য সত্যিই অবিশ্বাস্য। নামিয়া জেনারেল স্টোরের সামনে ভিড়। বেশিরভাগই ছোটো বাচ্চা, তবে প্রাপ্তবয়স্কও আছে। স্টোরের ভেতরের একটা দেওয়ালের দিকে উঁকি দিয়ে দেখছিল তারা। দেওয়ালে অনেকগুলো কাগজের চিরকুট টাঙানো। ভিড়ের লোকজন কাগজগুলো পড়ছিল আর হাসছিল।
তাকায়ুকি এগিয়ে এসে দেখল হরেক রকমের কাগজ টাঙানো। খাতার ছেঁড়া পৃষ্ঠা, মেমো প্যাডের নোট ইত্যাদি। কোনো চিঠির বিষয়বস্তুই তেমন গুরুতর না :
পড়াশোনা না করে বা নকল না করে কীভাবে ভালো নম্বর পেতে পারি? কোনো বাচ্চার হাতের লেখা নিশ্চয়ই। এর সাথে উত্তরটাও টাঙানো হয়েছে। সেটা ইউজির হাতের লেখা।
শিক্ষককে বলো তোমাকেই যেন তোমার পরীক্ষা নিতে বলে। এতে করে প্রশ্ন যেহেতু তুমি করবে তাই উত্তরটাও তোমার জানা থাকবে।
মানে কী? এটা তো উপদেশ না। এ তো চোখা মন্তব্য।
বাকি চিঠিগুলো দেখল সে। সবই অর্থহীন।
আমি চাই স্যান্টা আমাদের বাসায় আসুক। কিন্তু আমাদের বাসায় কোনো চিমনি নেই। এখন কী করব?
আমাদের পৃথিবী যখন ‘প্ল্যানেট অব দি অ্যাপেসে’ পরিণত হবে, তখন আমি জাপানিজ কোথা থেকে শিখব?
ইউজি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। আর উত্তরগুলো খুব জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। নিচে একটা পরামর্শের বাক্স বসিয়ে লিখে দিয়েছে:
সমস্যার পরামর্শ:
আমাকে যে-কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করো, যে-কোনো কিছু
-নামিয়া জেনারেল স্টোর
.
‘আহা, জীবনকে কোনো না কোনোভাবে তো উপভোগ করতে হবে। প্রতিবেশী বাচ্চাদের সাথে মজার ছলে জিনিসটা আবিষ্কার করেছি। কিন্তু মানুষ এটা এখন খুব উপভোগ করছে। অংশ নিচ্ছে। অনেকে খুব দূর থেকেও এসব পড়তে আসে। আজকাল বাচ্চাগুলো বেশ গুরুতর সমস্যা নিয়ে আসছে। আর সেসবের উত্তর দিতে খুব বেগ পেতে হয়।’
ইউজি হাসে। শুষ্ক সেই হাসিতে যেন প্রাণের আমেজ। ইউরিকো ভুল বলেনি; স্ত্রী বিয়োগের পরের শোকাহত ইউজি আর এখনকার তাদের বাবার মাঝে অনেক তফাৎ।
এই পরামর্শের খেলাটা তার মাঝে প্রাণের সঞ্চার করে। কিন্তু ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো খুব কঠিন এবং গুরুতর হয়ে পড়ে। একারণে পরামর্শের বাক্সটা লোকদৃষ্টি থেকে সরিয়ে মেইল স্লট আর মিল্ক ক্রেটের ব্যবস্থা করে ইউজি।
ইউজি সামনের টেবিলে খাতা-কলম নিয়ে বসে বসে ভাবছে। ভ্রূ কুঁচকে আছে তার।
‘খুব কঠিন নাকি এই চিঠিটা?’ তাকায়ুকি লক্ষ করে বলল। ইউজি মাথা নাড়লো। ‘এক মেয়ের চিঠি। সবচেয়ে কঠিন ধরনের চিঠি এটা।’
যার মানে, প্রেম সংক্রান্ত।
ইউজির পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়, বিয়ের আগে পর্যন্ত বর-কনে কেউ কারও ব্যাপারে কিছু জানতও না। সেই প্রজন্মের কারও কাছে প্রেম বিষয়ক পরামর্শ চাওয়ার মতো বিপথগামী ভুল আর হয় না। তাকায়ুকি ভাবল
‘যা ইচ্ছা লিখে দাও। কী আসে যায়।’
‘কী বললে? আমি এমন করি নাকি?’ ইউজি বিরক্ত হলো।
তাকায়ুকি উঠে পড়ল। ‘বয়ার আছে না? আমি খুঁজে নিচ্ছি।’
ইউজি কোনো উত্তর দিলো না। কিন্তু তাকায়ুকি ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। অনেক আগের টু-ডোর মডেল ফ্রিজ, যেটা আগে ইউরিকোর শ্বশুরবাড়িতে ছিল। দুবছর আগে নতুন মডেল কিনে নিয়েছে তারা। এর আগে তাকায়ুকি কলেজে থাকতে ১৯৬০-তে কেনা একটা ওয়ান-ডোর ফ্রিজ ব্যবহার করত ইউজি।
ভেতরে দুটো ঠান্ডা বিয়ার পেল তাকায়ুকি। ইউজি ঠান্ডা বিয়ার পছন্দ করে। তার ফ্রিজে সবসময় ঠান্ডা বিয়ার থাকেই। মিষ্টি খুব একটা পছন্দ না তার। সম্প্রতিই কিমুরায়ার মিষ্টি রুটিতে রুচি এসেছে।
তাকায়ুকি একটা বোতল নিয়ে ক্যাপ খুলল। কাপবোর্ড থেকে দুটো গ্লাস নিয়ে টেবিলে চলে এলো।
‘তুমিও খাবে, তাই না?
‘এখন না।’
‘সব কিছু ঠিক আছে তো?
‘চিঠির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ার খাই না। তোমাকে আগেও বলেছি।’ তাকায়ুকি মাথা নেড়ে গ্লাসে বিয়ার ঢেলে নিলো।
ইউজি গভীর চিন্তামগ্ন একটা অভিব্যক্তি নিয়ে তাকায়ুকির দিকে তাকালো, ‘বাবার স্ত্রী-সন্তান আছে।’
‘কী?’ তাকায়ুকি বলল, ‘মানে?’
ইউজি খাম তুলে ধরল। ‘যে মহিলা লিখেছে। বাবার স্ত্রী আছে।’
তাকায়ুকি কিছু বুঝল না।
‘তো? আমার বাবারও স্ত্রী-পুত্র আছে। স্ত্রী হয়তো এখন নেই কিন্তু সন্তান তো আছে। এই যে আমি আছি।’
ইউজি ভ্রু কুঁচকালো। বিরক্ত হচ্ছে সে।
‘আমার কথা বলেনি। বুঝতে পারছ না। মহিলাটার বাবা না—বাচ্চাটার বাবা।’
‘কার বাচ্চা?’
‘মেয়েটার গর্ভের বাচ্চা।’
‘কী?’ তাকায়ুকির বুঝতে আর এক সেকেন্ড লাগল, ‘ওহ! আচ্ছা। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। আর যে ছেলে এই বাচ্চার বাবা তার ইতোমধ্যে স্ত্রী আর সন্তান আছে।’
‘সেটাই এতক্ষণ ধরে বলছি তোমাকে।’
‘সোজাসুজি বললেই তো পারতে। বাবা বলতে তো যে কেউ নিজের বাবার কথাই ভাববে।’
‘একেই বলে বাছবিচার না করে সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়া।’
‘হয়তো।’
‘তোমার কী মনে হয়?’
‘কোন ব্যাপারে?’
‘ছেলেটার স্ত্রী-সন্তান আছে। আর এই মেয়েটার গর্ভে এখন তার সন্তান। মেয়েটার এখন কী করা উচিত?’
তাকায়ুকি অবশেষে সমস্যাটা ধরতে পারল। বিয়ারে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আজকালকার মেয়েগুলোর কোনো বুদ্ধি-শুদ্ধি নেই। গর্দভ কোথাকার। বিবাহিত পুরুষের সাথে এভাবে মেলামেশা করা ভালো নাকি।’
ইউজি নাক মুখ কুঁচকে টেবিলে একটা ঘুসি কষালো। ‘আমি নৈতিক বক্তৃতা শুনতে চাইনি। পরামর্শ শুনতে চাচ্ছি। তার এখন কী করা উচিত?’
‘সহজ ব্যাপার। অ্যাবোরশন করা উচিত। এছাড়া আর কী বলার আছে তাকে?’
‘তোমাকে জিজ্ঞাসা করাই ঠিক হয়নি।
‘মানে কী?’
ইউজি রেগে উঠল। ‘অ্যাবোরশন করা উচিত। এছাড়া আর কী বলার আছে তাকে?—আমার ধারণা সে কী ইতোমধ্যেই এটা ভাবেনি? তার সমস্যা এই পরামর্শে সমাধান করা যাবে না। বুঝতে পারছ না সেটা?’
তাকায়ুকি চুপ করে রইল। এখন বুঝতে পারছে।
‘শোনো,’ ইউজি বলল, ‘সে এটা জানে, যে এখন অ্যাবোরশনই করা উচিত। সে জানে ছেলেটা দায়িত্ব নেবে না এবং বাচ্চাটা জন্ম দিয়ে মেয়েটা তাকে একা একা মানুষ করতে পারবে না। কিন্তু তারপরেও সে নিজের বাচ্চাকে জন্ম দেওয়ার তাড়না থেকে পালাতে পারছে না। অ্যাবোরশনের চিন্তাও করতে পারছে না। বুঝলে?’
‘মনে হয় না বুঝেছি। তুমি বুঝেছো, বাবা?’
‘চিঠিটা পড়েছি বলে বুঝেছি। হয়তো এটাই তার শেষ সুযোগ।’
‘শেষ সুযোগ কেন?
‘মেয়েটার এর আগে একবার বিয়ে হয়েছে। তখন বাচ্চা নিতে সমস্যা হচ্ছিল। ডাক্তার বলেছিল তার যা শারীরিক অবস্থা তাতে একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়া খুব কঠিন হবে। এমনকি বাচ্চা নেবার আশাও ছেড়ে দিতে বলেছিল। এ কারণেই তার বিয়ে টিকেনি।
‘সে কী বন্ধ্যা?’
‘মূল কথা, এই বাচ্চাটাই তার শেষ সুযোগ। এই পর্যায়ে আশা করি হয়তো তুমিও এটা বুঝে গেছ যে অ্যাবোরশন কেন এই সমস্যার সমাধান নয়।
তাকায়ুকি গ্লাসের বিয়ার শেষ করে বোতলের দিকে হাত বাড়ালো।
‘আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমার মনে হয় না মেয়েটার আরও ভেবে দেখা উচিত? বাচ্চাটার জন্য খারাপ লাগছে। বড়ো হওয়াটা কঠিন হবে তার জন্য।’
‘মেয়েটা বলেছে সে ওসবের জন্য প্রস্তুত।’
‘এখন বলছে,’ তাকায়ুকি গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে তার বাবার দিকে তাকালো। ‘কিন্তু তেমনটা হলে সে পরামর্শ চাইতো না। এটা বলার মানে সে মনে মনে প্রস্তুত হয়েই গেছে। তোমার বলায় এখন আর কিছু আসে যায় না।’
‘হয়তো।’
‘হয়তো?’
‘মানুষের চিঠির উত্তর দিতে দিতে একটা জিনিস শিখেছি। বেশিরভাগ সময়ে মানুষ নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই জানে। পরামর্শ চায় যেন অন্যের কাছ থেকে শুনতে পারে যে তার সিদ্ধান্ত সঠিক। একারণেই আমার চিঠি পাবার পর অনেকেই আবারও উত্তর দেয়। হয়তো তাদের মনে অন্য কোনো সমাধান ইতোমধ্যেই ছিল।’
‘কী জ্বালা। কীভাবে যে এত বছর ধরে এটা করছো।’
‘আমি মানুষকে সাহায্য করছি। তাতেই কষ্ট লাঘব হয়।’
‘তুমি অদ্ভুত, বুঝলে? যাই হোক। সুতরাং এই চিঠি নিয়ে তোমার এত মাথা না ঘামালেও চলবে, তাই; না? মেয়েটা তো বাচ্চাটা নিতেই চাচ্ছে। তাহলে তাকে আশা করি বাচ্চাটা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেবে বলে উত্তর দিয়ে দিচ্ছো না কেন?’
ইউজি মাথা নাড়ল। ‘তুমি আসলেই বুঝো না। চিঠিটার মানে মেয়েটা জানে যে সে এই বাচ্চাটা চায়। কিন্তু আমরা যা জানি আর যা অনুভব করি তার মাঝে বিস্তর পার্থক্য আছে। হয়তো সে বাচ্চাটা নেবার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করছে, আর সে জানে যে তার সামনে আসলে কোনো পথ নেই, বাচ্চাটা সে রাখতে পারবে না। তার এই দ্বন্দ্বটা মেটাবার উদ্দেশ্যেই এই চিঠি লেখা। এমন হয়ে থাকলে আশা করি বাচ্চাটা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেবে বলে তার আত্মদ্বন্দ্ব আরও বাড়াতে পারি না আমি।’
তাকায়ুকির এখন মাথাব্যথা করছে।
‘তোমার জায়গায় আমি হলে বলতাম নিজেই ভেবে বের করো।’
‘তোমার কাছে তো আর কেউ পরামর্শ চাচ্ছে না। আমাকে মেয়েটার মাথার ভেতরে ঢুকতে হবে। চাবিটা নিশ্চয়ই এই চিঠির কোথাও আছে।’
বেচারা, তাকায়ুকি ভাবল। বৃদ্ধ লোকটার জন্য খারাপও লাগছে, কিন্তু তাকায়ুকি জানে কঠিন সমস্যাগুলোই ইউজি বেশি পছন্দ করে। এসবের মাঝে তাকায়ুকি যা বলতে এসেছে তা বলাটা আরও মুশকিল হয়ে গেল। আজ কেবল নিজের বৃদ্ধ বাবার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যেই আসেনি সে।
‘বাবা, একটু সময় হবে? কিছু কথা ছিল।’
‘আমি ব্যস্ত।’
‘বেশিক্ষণ লাগবে না। আর তুমি তো ব্যস্তও না। কেবল আটকে আছো। কথা শুনতে শুনতে হয়তো ভালো কোনো সমাধান আসবে তোমার মাথায়।’
ইউজি তার পুত্রের দিকে তাকালো, ‘আচ্ছা বলো।’
তাকায়ুকি সোজা হয়ে বসল। ‘ইউরিকো স্টোরের কথা বলল। সে বলল এর অবস্থা খুব খারাপ।’
‘এইসব হাবিজাবি তোমাকেও বলেছে?’
‘সে চিন্তিত। তোমার মেয়ে, তোমার জন্য চিন্তা তো করবেই।’
কয়েক বছর আগে ইউরিকো একজন ট্যাক্স অ্যাডভাইজারের জন্য কাজ করত। তার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে সে স্টোরের ট্যাক্স রিটার্নগুলো দেখাশোনা করেছে। কিন্তু এ বছরের ফর্মটা পূরণ করার সময় তার ভাইকে ফোন করে সবটা জানাতেই হয়েছে।
‘খুব খারাপ অবস্থা। আমরা বিপদসীমা অতিক্রম করে ফেলেছি। এখন আর লুপহোল খুঁজে লাভ নেই।
তাকায়ুকি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করল আসলে এতটাই খারাপ কিনা তখন ইউরিকো বলেছে, ‘বাবা যদি নিজেকে ফাইলও করে দেয় তাহলেও তারা ওয়েলফেয়ার সাইন করাবে তাকে দিয়ে।’
তাকায়ুকি তার বাবার দিকে তাকালো।
‘বাবা, তোমার মনে হয় না এখন স্টোরটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত? আশেপাশের লোকজন এখন স্টেশন থেকেই জিনিসপত্র কিনে নেয়। আগে যখন স্টেশন ছিল না তখন এখানে ভালো ব্যাবসা হতো। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। চলো এটা বন্ধ করে দেই।’
ইউজিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘বন্ধ করে কী করব?’
‘আমাদের বাসায় চলে আসবে।’
তাকায়ুকি পাশের দেওয়ালের দিকে তাকালো। সেখানে ফাটল ধরেছে। ‘ব্যাবসা বন্ধ করে দিলে আর এখানে থেকে কী করবে। এটা খুব দূরবর্তী এলাকা। আমাদের সাথে এসে পড়ো। ফুমিকো রাজি হয়ে গেছে।’
‘মানে তোমার ওই খুপরি বাসায় যাবো?’
‘আমরা নতুন বাসা কেনার কথা ভাবছি—’
ইউজির চশমার পেছনের চোখ দুটো গোলগোল হয়ে গেল, ‘নতুন বাসা? তুমি?’
‘এতে অবাক হবার কী আছে? চল্লিশ বছর হয়ে গেছে আমার। এখন এসব নিয়ে ভাবা শুরু করতে হবে। একারণেই তোমার ব্যাপারটা উঠেছে।’
ইউজি হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিলো, ‘আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।’
‘কেন?’
‘কারণ আমি একা একাই বাঁচতে পারি। তোমার ওপর নির্ভর করতে হবে না আমাকে।’
‘এখন এটা বলছো কিন্তু এক সময় না এক সময়ে বাস্তবতা চোখ মেলে দেখতে তো হবে। তোমার তেমন আয়-রোজগার নেই। চলবে কীভাবে তুমি?’
‘যা আছে ওতেই চলবে। ধন্যবাদ।’
‘কীভাবে চলবে—’
‘যথেষ্ট হয়েছে।’ ইউজি জোরে বলে উঠল। ‘আশা করি তুমি কাল সকালে চলে যাচ্ছো। বকবক বন্ধ করে গোসল করো। ঘুমাতে যাও। আমি ব্যস্ত। কাজ করছি।’
‘ব্যস্ত? তুমি খালি চিঠিই লিখছো তাই না?’
ইউজি চিঠির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার আর কিছু বলার নেই।
তাকায়ুকি উঠে দাঁড়ালো, ‘আমি গোসল করতে গেলাম।’
কোনো উত্তর নেই।
নামিয়া হাউজের পুরোনো স্টেইনলেস টাবটা খুব ছোটো। তাকায়ুকিকে গুটিসুটি মেরে সেখানে বসতে হলো। জানালার বাইরে একটা পাইন গাছ দেখতে পাচ্ছে সে। এটা ছোটোবেলার পরিচিত একটা দৃশ্য।
ইউজি আসলে স্টোরটাকে নয় বরং চিঠির পরামর্শ দেওয়াকে ছাড়তে চায় না। স্টোর বন্ধ করে অন্য জায়গায় চলে গেলে চিঠিগুলো আর পাবে না সে। মানুষ এই ব্যাপারটা উপভোগ করছিল। নিশ্চয়ই এতে কোনো আনন্দ রয়েছে, যার কারণে এত মানুষ তার কাছে উপদেশ চাচ্ছে।
নিজের বাবার জীবনের একমাত্র তৃপ্তিকে সে কীভাবে কেড়ে নিতে পারে?
ভোর ছ’টায় ঘুম থেকে উঠল তাকায়ুকি। কাপড় পরতে পরতে বাইরে কিছু শব্দ শুনতে পেল। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল কেউ মিল্ক ক্রেট থেকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কালো লম্বা চুলের সাদা পোশাক পরা একটা মেয়ে। চেহারা দেখা গেল না।
তাকায়ুকি নিচে নেমে এলো। ইউজি জেগে আছে। রান্নাঘরে পানি ফোটাচ্ছে।
‘শুভ সকাল।’
‘ওহ, তাড়াতাড়ি উঠে গেছ।’ ঘড়ি দেখল ইউজি, ‘নাস্তা করবে?’
‘না। যেতে হবে। চিঠির কী হলো?’
‘হয়ে গেছে। অর্ধেক রাত পার করতে হয়েছে এর পেছনে।’
‘কী বললে?’
‘বলতে পারব না।
‘কেন?’
‘গোপনীয়তা বলে একটা ব্যাপার আছে।’
তাকায়ুকি অবাক হলো, তার বাবা এই শব্দও জানে? ‘যাই হোক, একটা মেয়ে মিল্ক ক্রেটের কাছে এসেছিল।’
‘কী? তুমি দেখছিলে তাকে?’
‘ওপরতলার জানালা দিয়ে দেখা যায়।’
‘সে তোমাকে দেখেনি তো?’
‘মনে হয় না।’
‘তোমার তাই ধারণা?’
‘হ্যাঁ। কয়েক সেকেন্ডেরই ব্যাপার।’
ইউজি একটু হতাশ হলো যেন। ‘এভাবে তাকানো যাবে না। এটাও একটা নিয়ম। তারা তোমাকে দেখে ফেললে আর কখনও পরামর্শের জন্য আসবে না।’
‘আমি তাকে ইচ্ছা করে দেখিনি। ঠিক আছে? ভুলে দেখে ফেলেছি।’
‘এত বছর পর এ-ই করতেই ফিরে এসেছিলে,’ ইউজি বিড়বিড় করতে করতে স্যুপ বানাতে লাগল।
‘বললাম তো, দুঃখিত।’ তাকায়ুকি বাথরুমে চলে গেল।
দাঁত ব্রাশ করে ও মুখে পানি দিয়ে তৈরি হয়ে বের হলো সে। ইউজি তামাগোয়াকি, এক ধরনের জাপানিজ ওমলেট, বানাচ্ছে। এত বছর একা থাকার পরে সে এখন এতে দক্ষ হয়ে গেছে।
‘তো,’ তাকায়ুকি তার বাবার পিঠের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে।’
ইউজি কিছু বলল না।
‘আচ্ছা, আমি যাচ্ছি তাহলে।’
তাকায়ুকি পেছনের দরজা দিয়ে বের হলো। যাবার পথে দাঁড়িয়ে মিল্ক ক্রেটের ভেতরটা দেখে নিলো।
কিছু নেই।
তার বাবা কী লিখেছে? জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে।
২
তাকায়ুকি ইয়াসুকুনি স্ট্রিটের একটা বিল্ডিংয়ের পাঁচতলায় শিনজুকুতে কাজ করে। তার কাজ ছিল অফিসের সরঞ্জাম বিক্রি করা এবং ইজারা দেওয়া। তার বেশিরভাগ কাস্টমারই ছোটো বা মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী। কোম্পানির তরুণ প্রেসিডেন্টের বিশ্বাস ছিল তারা ‘মাইক্রো যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে’, যা আসলে মাইক্রোকম্পিউটারের সংক্ষেপণ। সে বলত কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিটি অফিসেই কমপক্ষে একটি কম্পিউটারের প্রয়োজন পড়বে। তাকায়ুকি হিউম্যানিটিজ পড়েছিল এবং সে বুঝে উঠতে পারছিল না যে কম্পিউটার তার কোন কাজে আসবে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কম্পিউটারের ব্যবহার একসময় সীমাহীন হয়ে উঠবে।
‘তোমাদেরকে শিখে নিতে হবে,’ এটা যেন প্রেসিডেন্টের বুলি ছিল।
যখন ইউরিকো তাকে অফিসে ফোন করে তখন তাকায়ুকি অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু মাইক্রোকম্পিউটার পড়ছিল। একটা শব্দও বুঝতে পারছিল না সে, তাই বইটা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে যাচ্ছিল।
‘দুঃখিত, কাজের সময় বিরক্ত করলাম।’
‘ও কিছু না। কী হয়েছে? বাবার কথা বলতে ফোন করেছো?’ তার ধারণা তার বোন সাধারণত এই বিষয়ে কথা বলতেই ফোন করে।
এবং ধারণাটা সত্যি।
‘হ্যাঁ, কাল আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম স্টোর বন্ধ। এ ব্যাপারে কিছু বলেছিল তোমাকে?’
‘না তো। কী হয়েছে?’
‘তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে উত্তর দিলো, প্রতিদিন দোকান খোলা রাখা যায় নাকি।’
‘ঠিকই তো বলেছে।’
‘শুধু তাই না। আসার সময়ে প্রতিবেশীদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা বলল শাটারটা সারা সপ্তাহেই বন্ধ ছিল।’
তাকায়ুকির চোখ সরু হয়ে এলো। ‘অদ্ভুত তো।’
‘তাই না? তাকে ভালো দেখাচ্ছিল না। শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে।’
‘সে অসুস্থ হলে আমাদেরকে জানাতো।’
‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু—বুঝতে পারছি না।’
তাকায়ুকির টনক নড়ল। পরামর্শ দেওয়াই ইউজির জীবনের মুখ্য কাজ। কিন্তু সেটা চালিয়ে যাবার জন্য দোকানের ব্যাবসাটাও চালিয়ে যেতে হবে।
দোকানটা বন্ধ করার জন্য দুবছর ধরে সে ইউজিকে রাজি করাবার চেষ্টা করে চলেছে। তখন তার বাবা মোটেও অসুস্থ ছিল না। একদিনের জন্যেও দোকান বন্ধ করত না সে।
‘আচ্ছা, আজ অফিস শেষে আমি তার সাথে দেখা করে আসব।’
‘আমার মনে হয় তুমি জিজ্ঞাসা করলে অন্য উত্তর দেবে।’
তাকায়ুকি নিশ্চিত ছিল না কিন্তু তার বোনকে বলল, ‘দেখা যাক।’
অফিস শেষে বেরিয়ে পড়ল তাকায়ুকি। রাস্তায় স্ত্রীকে ফোন করে যখন সব কিছু জানালো তখন সেও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল।
বছরের শুরুতে ইউজির সাথে দেখা হয়েছিল তার। তখন ফুমিকো আর তাদের ছেলেকে নিয়ে এসেছিল। এরপর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে এমন কী হলো?
আসতে আসতে রাত ন’টা বেজে গেল। নামিয়া জেনারেল স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকায়ুকি। রাতের বেলা শাটার বন্ধ থাকা অদ্ভুত ব্যাপার না, কিন্তু দোকানটা দেখলে কেমন যেন শূন্যতা অনুভূত হয়।
পেছনের দরজার নব ঘোরাতে গিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। অদ্ভুত তো। বাড়তি চাবিটা বের করল। লম্বা সময় ধরে এটা ব্যবহার করতে হয়নি।
রান্নাঘরের বাতি বন্ধ। তাকায়ুকি ভেতরে ঢুকে সোজা তাতামি রুমে চলে গেল। সেখানে ইউজি মেঝেতে একটা ঢালাই বিছানায় শুয়ে আছে।
ইউজি শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকালো, ‘তুমি এখানে কী করছ?’
‘কী করছি? ইউরিকো খুব চিন্তা করছিল তোমার জন্য। সে বলল দোকানটা নাকি এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ।’
‘ইউরিকো, মেয়েটা নিজের চরকায় তেল দিতে পারে না।’
‘কী হয়েছে। তুমি অসুস্থ?’
‘তেমন কিছু না।’ যার মানে গুরুতর কিছু হয়েছে।
‘কী হয়েছে?’
‘বললাম তো কিছু না। আমার কোনো ব্যথা নেই। বুঝলে?’
‘আচ্ছা, তাহলে দোকান বন্ধ করেছো কেন?’
ইউজি কিছু বলল না। তাকায়ুকি জানে এটা তার বাবার একগুঁয়েমির ইঙ্গিত কিন্তু ইউজির চেহারার অভিব্যক্তি দেখে সে বুঝে গেল কী হয়েছে। সে যন্ত্রণায় আছে।
‘বাবা, কী—’
‘তাকায়ুকি, তোমার বাসায় এখনও একটা বাড়তি ঘর আছে?’
‘কী আছে?’
‘টোকিওতে, তোমার বাসায়।’
তাকায়ুকি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। গত বছর মিটিকাতে একটা বাসা নিয়েছে তারা। পুরোনো প্রপার্টি, কিন্তু কাজ করিয়ে নতুন বানিয়ে নিয়েছে। ইউজি দেখতে গিয়েছিল।
‘তুমি হয়তো এতদিনে সেই ঘর অন্য কাজে ব্যবহার করছো।’
তাকায়ুকি জানে তার বাবা কী বলতে চাইছে। এই হঠাৎ পরিবর্তনে সে হতবাক হয়ে গেল।
‘না, এখনও খালি আছে। দোতলার তাতামি রুমটা তোমার জন্যেই রাখা হয়েছে। তোমাকে দেখিয়েছিলাম না? বেশ বড়ো নয় কিন্তু আলো-বাতাস আছে।’
ইউজি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘ফুমিকোর মতো কী? সে রাজি হবে? তোমরা অবশেষে নিজেদের একটা বাসা পেয়েছো। এই বুড়ো লোক গিয়ে সেখানে
‘এসব ভাবতে হবে না। বাসা কেনার সময়েই আমরা তোমার জন্য প্ল্যান করে রেখেছিলাম।’
‘—তাই?’
‘তুমি আমাদের সাথে আসছো তাহলে? আমরা প্রস্তুত আছি।’
ইউজি রাজি হলো।
বুকে একটা চাপ অনুভূত হলো তাকায়ুকির। এই দিনটা অবশেষে এলো। তবুও অনুভূতিগুলো চেহারায় ফুটে উঠতে দিলো না সে।
‘আমার জানতে ইচ্ছা করছে, কী হয়েছে আসলে? গতবার বলেছিলে তুমি কখনই দোকান বন্ধ রাখবে না। তুমি সত্যিই কেমন বোধ করছ বলো তো?’
‘এত ভাবতে হবে না। আমি ঠিক আছি। চিন্তা কোরো না।’ ইউজি চুপ থেকে বলল, হয়তো এখনই মোক্ষম সময়।’
তাকায়ুকি মাথা ওপর-নিচে দোলালো। কিছু বলল না।
এক সপ্তাহ পর, ইউজি স্টোর ছেড়ে চলে গেল। একটা ট্রাক ভাড়া করে কেবল তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিলো। কম প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ফেলে গেল। বিল্ডিংটাকে কী করা যায় তা বুঝতে পারল না। খুব সহজে বিক্রি হবে না। আপাতত যেভাবে আছে তেমনই থাক।
মিটিকা যাবার পথে ট্রাকের রেডিয়োতে ‘এলি মাই লাভ’ বাজছিল। মার্চে অ্যালবামটা রিলিজ হবার পর থেকে এই গান বেশ সুখ্যাতি অর্জন করে ফেলেছে।
ফুমিকো আর তার ছেলে তাদেরকে আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানায়। কিন্তু তাকায়ুকি জানে তারা কেমন অনুভব করছে। ফুমিকো নিশ্চয়ই ভান করছে, তাদের ছেলেও। ফুমিকো সামনাসামনি কিছু বলে না। সে খুব বুদ্ধিমতী। এ কারণেই তাকায়ুকি তাকে বিয়ে করেছিল।
ইউজি এখানের নতুন জীবনযাত্রা উপভোগ করতে শুরু করে। নিজের ঘরে বই পড়ে বা টিভি দেখে বা হাঁটাচলা করে সময় কাটতে লাগল তার। সবচেয়ে বড়ো কথা প্রতিদিন নিজের নাতিকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হয় সে।
কিন্তু সেটা টিকল না বেশিদিন।
কদিন পরেই ইউজি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এক রাতে তার প্রচণ্ড ব্যথা ওঠে এবং অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হয়। ইউজি ডাক্তারকে বলে তার পেটে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে। এই প্রথমবার বাবার মুখে এমন কথা শুনে তাকায়ুকি ধাক্কা খায় একটা।
এরপর ডায়াগনোসিসে ইউজির লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে।
‘শেষ পর্যায়ের ক্যান্সার,’ ডাক্তার ভাবলেশহীন কণ্ঠে জানায় তাদের। তাকায়ুকি জিজ্ঞাসা করে এর মানে কি চেষ্টা করেও ইউজিকে বাঁচানো যাবে না? ডাক্তার বলে এমনটা ভাবাই সহজ। কোনো ধরনের চিকিৎসাই আর কাজে দেবে না।
বলা বাহুল্য, এই কথোপকথনে ইউজি উপস্থিত ছিল না। অ্যানেস্থেশিয়ার কারণে তার তখনও জ্ঞান ফেরেনি।
তারা ঠিক করে যে ডাক্তার আসল রোগটার নাম ইউজিকে বলবে না। বরং অন্য কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিস্থিতির কথা বলবে।
খবরটা শুনে ইউরিকো কান্নায় ভেঙে পড়ে। ‘তাকে আগেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল আমার।’ নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল সে। তাকায়ুকি ভেঙে পড়ে। সে ভেবেছিল তার বাবাকে স্বাভাবিকের চেয়ে কম প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে কিন্তু সে যে আসলে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করছিল—এটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল।
এরপর থেকেই অসুস্থতার সাথে যুদ্ধ শুরু হয় ইউজির। সৌভাগ্যবশত, তাকে আর তীব্র যন্ত্রণা পোহাতে হয়নি। ধীরে ধীরে সে আরও শুকিয়ে যেতে থাকে। হাসপাতালের বিছানায় তাকে আর আসল ইউজির মতো দেখাচ্ছিল না।
একমাস পর, তাকায়ুকি অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় হাসপাতালে গিয়ে দেখল ইউজি বিছানায় বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। এই ঘরে দুজন রোগী থাকা যায়। কিন্তু অন্য বিছানাটা এখন খালি।
‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভালো আছো।’
ইউজি তার ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘কোনো কোনো দিন খুব খারাপ অবস্থা যায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে ভালোও থাকি।
‘দেখো আমি কী এনেছি।’ তাকায়ুকি রেড বিন পেস্ট্রির প্যাকেটটা টেবিলে রাখল।
‘একটা উপকার চাই তোমার কাছ থেকে।
‘কেমন উপকার?’
ইউজি অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। কথাটা বলা তার পক্ষে কঠিন। অবশেষে যখন বলল, তখন তাকায়ুকি খুব অবাক হলো।
‘আমি স্টোরে ফিরে যেতে চাই।’
‘কেন? এই অবস্থায় দোকান খোলার কথা চিন্তাও করা যাবে না।’
ইউজি মাথা নাড়ল। ‘খুলে লাভও নেই। শেলফে কোনো মালপত্র নেই। আমি কেবল বাসায় ফিরতে চাচ্ছি।’
‘কেন?’
ইউজি কোনো উত্তর খুঁজে পেল না।
‘অযৌক্তিক কথা বোলো না, বাবা। তোমার পক্ষে একা থাকা সম্ভব না। তোমার যত্ন নেবার জন্য কাউকে না কাউকে প্রয়োজন। আশা করি সেটা কেন সম্ভব না তা তুমি বুঝতে পারো।’
ইউজি আবার মাথা নাড়ল। ‘আমার কাউকে লাগবে না। আমি একা থাকতে পারব।’
‘মোটেও না। আমি আমার অসুস্থ বাবাকে একা ছাড়ব না।’
ইউজি খুব করুণ চোখে তাকালো তার দিকে, ‘কেবল এক রাতের জন্য।’
‘এক রাত?’
‘কেবল এক রাত। আমি কেবল আর একটা রাত থাকতে চাই ঐ বাসায়। একা।’
‘কী হয়েছে তোমার?’
‘বলে কী লাভ। তুমি বুঝবে না, আসলে কেউই বুঝবে না। আমাকে পাগল ভাববে।’
‘না বললে বুঝব কীভাবে।’
‘তুমি বিশ্বাস করবে না।’
‘কী বিশ্বাস করব না?’
ইউজি এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বরং বলল, ‘আমি জানি ডাক্তাররা কী বলছে। চাইলে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন তাকে। চিকিৎসায় কোনো কাজ হচ্ছে না। সে এটাই বলেছে, তাই না?’
এবার তাকায়ুকির চুপ থাকার পালা। ইউজি যা বলছে তা সত্যি। ডাক্তাররা এটাই বলেছে। হয়তো যে-কোনো দিনই মৃত্যুবরণ করতে পারে সে।
‘আমাকে সাহায্য করো তাকায়ুকি। আমি এটাই চাই,’ নিজের ছেলের সামনে দুহাত জোড় করে আবদার করল ইউজি।
তাকায়ুকি চেহারা শক্ত করে ফেলল। ‘এমন কোরো না।’
‘আমার খুব বেশি সময় নেই। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না, কিছু করতে বোলো না। কেবল আমি যা চাই তা দয়া করে আমাকে করতে দাও।’
বুড়ো বাবার এমন করুণ আবদার সোজা তাকায়ুকির অন্তরে আঘাত করল। সে জানে না এর ফলাফল কী হবে, কিন্তু সে তার বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাকায়ুকি, ‘কবে যাবে?’
‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আজ রাতে গেলে কেমন হয়?’
‘আজই? এত তাড়া কীসের?’
‘সময় খুব কম যে।’
‘কিন্তু সবাইকে জানাতে হবে তো।’
‘তার দরকার হবে না। ইউরিকো বা অন্য কাউকে এসব কিছু বোলো না। হাসপাতালে বলবে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছো কিছু সময়ের জন্য। এখান থেকে সোজা স্টোরে চলে যাবো।’
‘বাবা তুমি কেন এসব করতে চাচ্ছো আমাকে দয়া করে বলো।’
ইউজি চোখ সরিয়ে নিলো। ‘আর কিছু বললে তুমি তোমার মত বদলে দিবে।’
‘দেবো না। আমি তোমাকে দোকানে নিয়ে যাবো। দয়া করে বলো।’
‘তুমি সত্যিই আমার কথা বিশ্বাস করবে?’
‘কথা দিচ্ছি।’
‘আচ্ছা, শোনো তাহলে।’
৩
প্যাসেঞ্জার সিটে বসে ইউজি খুব কম কথাই বলতে পারল। তবে ঘুমায়নি।
হাসপাতাল থেকে দোকানের এলাকায় আসতে তিন ঘণ্টা লেগে গেল। ইউজি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে।
তাকায়ুকি এসব কেবল ফুমিকোকে জানিয়েছে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ট্রেনে আসতে পারত না, তাই গাড়ি নিয়ে এসেছে। আজ রাতে হয়তো সে আর বাসায় ফিরবে না।
সামনেই নামিয়া জেনারেল স্টোর দেখা গেল। দোকানের সামনে সিভিকটা পার্ক করল তাকায়ুকি, গত বছরেই কিনেছে গাড়িটা। এখন প্রায় এগারোটা বাজে।
‘আচ্ছা, আমরা এসে গেছি।’
তাকায়ুকি চাবি বের করে সিট থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু ইউজি নড়ল না।
‘না, তুমি বাড়ি যাও।’
‘কিন্তু–’
‘কত বার বলব? আমি একা থাকতে পারব। আমার কাউকে লাগবে না।’
তাকায়ুকি মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
‘আমি দুঃখিত,’ ইউজি বলল, ‘তুমি এ পর্যন্ত আমাকে দিয়ে গেছ সেটাই অনেক।’
‘এই, ঠিক আছে।’ তাকায়ুকি নাক ঘষলো। ‘আমি সকালে আসছি তাহলে। আশেপাশেই থাকব।’
‘রাতে গাড়িতে ঘুমাবার পরিকল্পনা করছো, তাই না? ঠান্ডা লেগে যাবে। তাকায়ুকি শব্দ করে হেসে উঠল।
‘এসব তোমাকে বলতে হবে না। নিজেই তো অসুস্থ। আমার অবস্থান থেকে ভেবে দেখো। মুমূর্ষু বাবাকে একা একটা পরিত্যক্ত বাসায় রেখে নিজের বাসায় গিয়ে আরামে ঘুমাতে পারতে? আর এতদূর আসা-যাওয়া করার চেয়ে গাড়িতে রাত কাটানোটাই ভালো।’
‘দুঃখিত, তোমাকে বাইরে থাকতে হচ্ছে।’
‘আমার কিছু হবে না। ভেতরের বাতি ঠিক আছে।’ ইউজি দরজা খুলে একটা পা পেভমেন্টে রাখল। এটা খুব করুণ একটা দৃশ্য।
‘ওহ,’ হুট করে যেন মনে হলো ইউজির, ‘সবচেয়ে দরকারি জিনিসটাই ভুলে গিয়েছিলাম।’ সে একটা খাম দিলো তাকায়ুকিকে।
‘কী এটা?’
‘ভেবেছিলাম একে আমার উইল হিসেবে রেখে যাবো। কিন্তু তোমাকে তো সব জানিয়েই দিয়েছি। চাইলে এখনই এটা পড়ে নিতে পারো। সেটাই ভালো হবে। আমি ভেতরে গেলে পড়া শুরু করবে। আমাকে কথা দাও এই চিঠিতে যাই লেখা থাকুক না কেন, আমাদের মাঝে যা যা কথা হয়েছে তুমি সেগুলো করবে। তুমি যদি তা না করো, তবে আমি এখন যা করতে যাচ্ছি তার কোনো মূল্যই থাকবে না।’
তাকায়ুকি খামটা দেখল। খামে কিছু লেখা নেই। তবে ভেতরে একটা কাগজ আছে।
‘সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।’ হাসপাতাল থেকে তাকে দেওয়া লাঠিটা ব্যবহার না করেই ইউজি গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।
তাকায়ুকি অজান্তেই তাকে পেছন থেকে ডেকে উঠল। ইউজি একবারের জন্যও পেছনে না তাকিয়ে বাড়ির পাশের গলিতে অদৃশ্য হয়ে যায়।
কিছুক্ষণের জন্য তাকায়ুকি নির্বাক হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর খামটা হাত তুলে নেয়। ভেতরে নিশ্চিতভাবেই একটা চিঠি আছে।
.
প্রিয় তাকায়ুকি,
যখন তুমি এই চিঠিটা পড়বে তখন হয়তো আমি বেঁচে নেই। এটা ভাবতে খারাপ লাগে কিন্তু এটাই জীবন। আর এখন যেহেতু আমি বেঁচে নেই তাই দুঃখ অনুভব করার হৃদয়ও আমার নেই।
আমি একটা সাহায্য চাচ্ছি। এটাই এই চিঠির মূল উদ্দেশ্য। আমার হয়ে তোমাকে একটা কাজ করতেই হবে।
একটা ঘোষণা দিতে হবে। আমার তেত্রিশতম মেমোরিয়াল সার্ভিসে নিম্নোক্ত বাণী প্রচার করতে হবে তোমাকে।
[আমার মৃত্যুর তারিখে], মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নামিয়া জেনারেল স্টোরের পরামর্শ বাক্স কেবল এক রাতের জন্য খোলা থাকবে। আমরা চাই যারা কখনও এই স্টোর থেকে উপদেশ পেয়েছেন, তারা যেন সেই সময়ে তাদের অশোধিত মতামত আমাদেরকে জানান। পরামর্শটা আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? কাজে দিয়েছে কি দেয়নি? দয়া করে আপনাদের চিঠিগুলো আগের মতো মেইল স্লটে রেখে যাবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকব।’
আমি জানি, তোমার কাছে এসব ছাইপাশ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে এর তাৎপর্য অনেক। দয়া করে আমার জন্য এই কাজটা করে দাও।
-বাবা
.
তাকায়ুকি চিঠিটা দুবার পড়ে শুষ্ক হাসি হাসল।
অন্য সময় হলে এই চিঠিকে উইল হিসেবে পেলে তাকায়ুকি একে পাত্তাই দিতো না। ভাবত তার বাবার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে একটা দায়িত্ববোধ জাগলেও দ্রুত এটা ভুলেও যেত সে। আর একবার ভুলে গেলে ত্রিশ বছর পর সেটা মনে করার কোনো উপায়ই নেই।
কিন্তু তার বাবার অদ্ভুত ব্যাখ্যা শোনার পর এটা উপেক্ষা করার প্রশ্নই আসে না। তার বাবা নিজের সবচেয়ে অন্তর্নিহিত ভয়টা তাকে বলে দিয়েছে।
প্রথমে ইউজি একটা পত্রিকার ক্লিপিং পড়তে দিয়েছিল তাকায়ুকিকে।
তিন মাস আগের আর্টিকেল এটা। পাশের শহরের এক মহিলার মারা যাবার খবর। আর্টিকেলে লেখা, অনেকেই একটা গাড়ি কোস্টাল রোড থেকে হার্বারে ছিটকে পড়তে দেখেছে। পুলিশ আর ফায়ার ডিপার্টেমেন্ট এসে ড্রাইভার সিটে বসে মেয়েটাকে মৃত অবস্থায় পায়।
কিন্তু তার এক বছর বয়সি শিশুটা ধ্বংসযজ্ঞের পাশেই ভেসেছিল। বাচ্চাটাকে হয়তো সংঘর্ষের আগেই গাড়ি থেকে দূরে ছুঁড়ে ফেলা হয়। সৌভাগ্যজনকভাবে, বাচ্চাটার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি।
ড্রাইভারের নাম মিদোরি কাওয়াবে। বয়স বাইশ। অবিবাহিত। গাড়িটা তার এক বন্ধুর থেকে ধার করা। যাকে মিস কাওয়াবে বলেছিল এই গাড়ি করে বাচ্চাটাকে ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে।
মেয়েটার প্রতিবেশীদের মতে, মিস কাওয়াবের কোনো চাকরি ছিল না এবং দিন পার করতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। অনেক ভাড়া জমে গিয়েছিল আর তাকে বাড়ি ছাড়তে বলা হয়। ঘটনাস্থলে স্কিড মার্কের অনুপস্থিতি থাকায় পুলিশ সন্দেহ করছে এটা একটা হত্যাকাণ্ড। তাই একটা তদন্ত চালু করা হয়। আর্টিকেল এখানেই শেষ।
‘এর মানে কী?’ তাকায়ুকি জিজ্ঞাসা করেছিল।
ইউজিকে অপ্রস্তুত দেখায়। ‘এটা সেই মেয়ে। যার বিবাহিত এক পুরুষের সাথে সম্পর্ক ছিল। আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিল। আমি নিশ্চিত এটা সে-ই। বাচ্চাটার বয়স মিলে যায় আর ঘটনাটা পাশের শহরেরই।’
‘হতেই পারে না। কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে না?’
‘মনে হয় না।’ ইউজি মাথা নাড়ায়। ‘যারা চিঠি লিখে তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করে। ঐ মেয়ের নাম ছিলো গ্রিন রিভার। আর এই মেয়ের নাম মিদোরি কাওয়াবে। মিদোরি, জাপানিজ শব্দের অর্থ সবুজ। আর তার শেষ নামে নদী আছে। কাকতালীয়ভাবে এতটা মিলে যেতে পারে না।’
তাকায়ুকি কী বলবে বুঝতে পারল না।
কিন্তু এখানেই শেষ না।
‘যে আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিল, এটা সেই মেয়েই কিনা, তাতে কিছু আসে যায় না। মূল কথা হলো আমি তাকে সঠিক পরামর্শ দিয়েছি—একবার না, বারবার দিয়েছি। আমার পরামর্শগুলো কী ভালো ছিল না? আমি আমার মনপ্রাণ উৎসর্গ করে চিঠিগুলোর উত্তর দিতাম। একবারও কি সেগুলো কাজে দেয়নি? আমি কি কাউকে সাহায্য করতে পারিনি? আমি উত্তর জানি না। আমার পরামর্শের কারণে কিছু মানুষ বিপদেও পড়ছে। যখন এটা বুঝতে পারি তখন আমার মন নষ্ট হয়ে যায়। পরিণতির কথা না ভেবে চিঠিগুলোর দিকে তাকাতেও পারছিলাম না। একারণে স্টোর বন্ধ করে দেই।’
তো একারণে বন্ধ করেছিল। তাকায়ুকি অবশেষে বুঝতে পারল। এতদিন তার বাবার মন পরিবর্তনের কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছিল সে।
‘তোমাদের বাসায় উঠেও এসব মন থেকে সরাতে পারিনি। রাতে এই ভেবে ঘুম আসত না যে আমার উপদেশের কারণে কারও জীবন নষ্ট হয়েছে।’
‘এসব ভেবো না। তুমি যাই পরামর্শ দাও না কেন, শেষ সিদ্ধান্ত তাদের হাতেই থাকে। সেই সিদ্ধান্ত যদি কয়েকজনের জন্য মারাত্মকও হয়, তাতে তোমার কোনো দোষ নেই।’
কিন্তু ইউজি এটা মানতে পারেনি। দিনের পর দিন হাসপাতালে গভীর চিন্তায় দিন কাটিয়েছে। এরপর এক রাতে খুব অদ্ভূত স্বপ্ন দেখে। বিষয়বস্তু ছিল সেই জিনিসটাই: নামিয়া জেনারেল স্টোর।
‘মাঝরাতে কেউ স্লটে চিঠি ফেলছে। আমি কোথা থেকে দেখতে পাচ্ছি তা জানি না। হয়তো খুব সামনে থেকে। যাই হোক, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এটা ভবিষ্যৎ, এখন থেকে বহু বছর পরের ঘটনা। কীভাবে জানি তা জিজ্ঞাসা কোরো না, কিন্তু আমি নিশ্চিত।
প্রতি রাতে একই স্বপ্ন দেখতে লাগল। তখন সে বুঝতে পারে, এগুলো নিছক স্বপ্ন নয়, পূর্বাশংকা।
‘যারা স্লটে চিঠি দিচ্ছিল তারা কোনো না কোনো সময়ে আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিল। তারা আমাকে বলতে চাইছিল যে তাদের জীবন বদলে গেছে। আমি গিয়ে সেসব চিঠি সংগ্রহ করতে চাই।’
‘কিন্তু কীভাবে? সেগুলো কি ইতোমধ্যে আদৌ লেখা হয়েছে?’
‘আমি দোকানে গেলে সেগুলো পেতে পারব। আমি জানি এসব শুনতে অদ্ভুত লাগছে কিন্তু আমি জানি আমি পারব। একারণেই আমাকে যে করেই হোক সেখানে যেতে হবে।’
ইউজির কণ্ঠ খুব দৃঢ়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে কোনো বিভ্রমে আছে।
তাকায়ুকি এমন গল্প বিশ্বাস করার মতো মানুষ না। কিন্তু সে তার বাবাকে কথা দিয়েছে। আর সেটা তাকে মানতেই হবে
৪
অন্ধকার থাকতেই তাকায়ুকির ঘুম ভাঙল। সিভিকের ভেতরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সে। ভোর পাঁচটা বাজতে আর কয়েক মিনিটই বাকি।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল সে। একটা ছোটো পার্কের পাশে গাড়িটা পার্ক করেছিল। পার্কের পাবলিক বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। ছোটোবেলা এই পার্কে খেলতে আসত সে। এখন কত সংকীর্ণ দেখাচ্ছে কিন্তু ছোটোবেলা মনে হতো এত বিশাল জায়গায় সে চাইলে বেসবলও খেলতে পারবে।
গাড়িতে বসে স্টোর পর্যন্ত আসতে আসতে চারপাশ বেশ আলোকিত হয়ে উঠল। সাইনের শব্দগুলো এখন পড়া যাচ্ছে। পেছনের দরজার সামনে চলে এলো সে। চাবিটা আছে কিন্তু তাও কড়া নাড়ল।
কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতার পর দরজার ওপাশে শব্দ শুনতে পেল সে।
দরজা খুলল ইউজি। তার চেহারায় অপার স্নিগ্ধতা।
‘আমি ভেবেছি তুমি এ তক্ষণে তৈরি হয়ে যাবে।’ তাকায়ুকির কণ্ঠ ভারী।
‘এসো, ভেতরে এসো।’
তাকায়ুকি ভেতরে ঢুকল। ভেতরের পরিবেশটা যেন বদলে গেছে। যেন বাইরের জগতের সাথে এই পরিবেশের কোনো সংযোগ নেই।
জুতো খুলে ভেতরে ঢুকল তাকায়ুকি। ভেতরটা খুব পরিষ্কার।
‘বাহ, খুব পরিচ্ছন্ন তো। যদিও—’ বাক্যের বাকি অংশটুকু ছিল ‘আলো-বাতাস নেই।’ কিন্তু তাকায়ুকি টেবিলের ওপর সারি সারি খাম দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সবগুলো নামিয়া জেনারেল স্টোরকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
‘এগুলো কাল রাতে এসেছে?’
ইউজি মাথা নেড়ে চেয়ারে বসে পড়ল। ‘যেমনটা আমি ভেবেছিলাম। এখানে আসতেই মেইল স্লট থেকে একের পর এক চিঠি আসতে থাকে। যেন আমি বাসায় আসার অপেক্ষা করছিল এরা।’
তাকায়ুকি মাথা নাড়ল, ‘তুমি ভেতরে চলে যাবার পর আমি বাইরে নজর রেখেছি। কিন্তু কাউকে বাসার কাছে আসতে দেখিনি।’
‘কিন্তু তারপরেও এত চিঠি! ভবিষ্যতের চিঠি।’
তাকায়ুকি একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ল। ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না—’
‘আমার কথা শুনেও বিশ্বাস হয়নি?’
‘না মানে, হ্যাঁ হয়েছে।’
ইউজি হেসে উঠল, ‘কিন্তু তাও মনের গহীনে সংশয় ছিল। এখন কী বলবে আমি এসব চিঠি নিজে নিজেই লিখেছি?’
‘না না। সেটা বলব না। আমি জানি এত সময় ছিল না তোমার।
‘এত খাম বানাতেই তো ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, স্টেশনারিও নেই দোকানে।’
‘আমি বিশ্বাস করছি। আমি স্টোরে এমন কিছু কখনও দেখিনি।’
তাকায়ুকির অস্বস্তি লাগল। এমন অলৌকিক কিছু রূপকথার বাইরেও হয়? একবার মনে হলো এসব কোনো অদ্ভুত ম্যাজিক ট্রিক। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী এক বৃদ্ধের সাথে এমন মজা করে কার কীইবা লাভ?
এগুলো ভবিষ্যতের চিঠি-এটা ভাবাই হয়তো সবচেয়ে ভালো সমাধান। ইউজি যা বলছে তা সত্যি হয়ে থাকলে এটা তো আসলেই অলৌকিক কিছু। তাকায়ুকি মনে মনে উত্তেজিত হলেও তা বাইরে প্রকাশ করল না।
‘তো, পড়া শুরু করা যাক?’
‘হ্যাঁ,’ ইউজি একটা খাম তুলে নিলো। ‘দেখো।
তাকায়ুকি একটা চিঠি খুলল। এটা হাতে লেখা চিঠি না। টাইপ করা।
‘এ কী!’
ইউজি মাথা নাড়ল। ‘প্রায় অর্ধেক চিঠিই প্রিন্ট করা। ভবিষ্যতের মানুষের সবার হয়তো ব্যক্তিগত প্রিন্টিং মেশিন আছে।’
তাকায়ুকি একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে পড়তে শুরু করল।
নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,
আপনি সত্যিই আবার দোকান খুলছেন? পোস্টে বলা হয়েছিল এক রাতের জন্যই খোলা থাকবে। উপলক্ষ্য কী? আমার মনে সন্দেহ ছিল এটা কোনো কৌশল কিনা, কিন্তু তাও আমি লিখছি। দেখা যাক কী হয়।
হয়তো চল্লিশ বছর আগে আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম: পড়াশোনা বা নকল না করে কীভাবে পরীক্ষায় ভালো গ্রেড পাবো?
আমি জানি খুব বোকার মতো প্রশ্ন কিন্তু আপনি চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন: তোমার শিক্ষককে বলো যেন তোমাকে নিজের পরীক্ষা নিজেকেই নিতে দেয়। তাতে করে সব প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই আগে থেকে জানবে।
প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আপনি মজা করছেন।
আপনার উত্তরটা আমার মাথায় সবসময় ছিল। মিডেল স্কুল এবং হাইস্কুলেও, যখনই আমি কোনো পরীক্ষা দিতাম, তখন এই পরামর্শটা মনে হতো আমার। আমার বোকা প্রশ্নের উত্তর আপনি এত যত্ন নিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা আমি কখনও ভুলতে পারিনি।
কিন্তু নিজে বাচ্চাদেরকে পড়ানোর সময়ে আপনার উত্তরের আসল মাহাত্ম্য বুঝতে পারি—হ্যাঁ, আমি এখন একজন শিক্ষক।
প্রথম দিন থেকেই খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। বাচ্চাগুলো আমার কথাও শুনতো না, আমার সাথে সহজও হয়ে আসত না। নিজেদের মাঝেও খাপ খেত না তারা। পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। কোনোকিছুই কাজে দিচ্ছিল না।
আমি সবকিছুই চেষ্টা করেছিলাম। খেলাধুলা বা বিতর্ক। কিছুই ফল দেয়নি। এরপর একদিন একটা বাচ্চা বলল, ‘আমি এসব চাই না, আমাকে কেবল বলুন আমি ভালো গ্রেড পাবো কীভাবে?’
প্রশ্নটা শুনে আমার পুরোনো এক পরামর্শের কথা মনে পড়ে গেল। আর একটা বুদ্ধি এলো মাথায়।
হয়তো বুঝে গেছেন এরপর আমি কী করেছি। আমি তাদেরকে বললাম ‘বন্ধু কুইজ’ নামে একটা অন্যরকম পরীক্ষা নেব তাদের। যে-কোনো একটা ক্লাসমেটের সাথে দল তৈরি করে তার বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। তার জন্মদিন কবে, ঠিকানা, কত জন ভাই-বোন, বাবা-মায়ের চাকরি, শখ, প্রতিভা—এসব জিজ্ঞাসা করা হবে। এরপর সেই ক্লাসমেটের সঠিক উত্তরের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হবে প্রত্যেককে।
প্রথমে তারা খুব বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু এক দুই রাউন্ডের পরই সহজ হয়ে আসে। গ্রেড ভালো পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ক্লাসমেটের ব্যাপারে সব জানা। আমার ছাত্রছাত্রীরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করে, এত ভালোভাবে যে তারা অন্যরকম একটা ব্যাচে পরিণত হয়।
আমার মতো নবাগত শিক্ষকের জন্য তখন এটা সাফল্যের বিষয়। এরপর থেকে আমি আত্মবিশ্বাস পাই। এমনকি এটাই শিক্ষকতাকে আজীবনের পেশা হিসেবে বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে আমাকে।
এ সবই আপনার পরামর্শের ফল, মিস্টার নামিয়া। এত বছর ধরে আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর উপায় খুঁজছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। অবশেষে সেই সুযোগটা পেয়ে আমি খুব খুশি।
নিবেদিত
এ+ আকিরা
বি. দ্র. আমার ধারণা এই চিঠি আপনার হয়ে আপনার কোনো পরিবারের সদস্য পাবে। এটা আপনার বেদিতে রেখে দিলে আমি কৃতজ্ঞ হবো।
.
তাকায়ুকি চিঠিটা শেষ করতেই ইউজি বলে উঠল, ‘তো?’
‘চমৎকার,’ এটুকুই বলতে পারল সে। ‘আমার এই প্রশ্নটা মনে আছে।’
‘আমারও অবাক লাগছে। প্রেরক খুবই কৃতজ্ঞ। আমি কেবল তার মজার প্রশ্নের উত্তর গুরুত্ব সহকারে দিয়েছিলাম।’
‘কিন্তু সে সেটা কখনও ভুলেনি।’
‘তেমনই মনে হয়। আর কেবল এটুকুই না। সে ওই পরামর্শের সাথে নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করে সঠিক জায়গায় ব্যবহার করতে পেরেছে। সে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে কিন্তু এসবের পেছনে মূল অবদান তারই পরিশ্রমের।’
‘আমার মনে হয় তুমি তার সামান্য সমস্যার ভালো সমাধান গুরুত্বের সাথে দিয়েছো বলে সে খুব খুশি হয়েছিল, একারণেই মনে রেখেছে।’
‘আমার দেওয়া সমাধান খুব অসাধারণ কিছু না।’ ইউজি বাকি সব চিঠিগুলোর দিকে তাকালো, ‘আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি বলে এরা আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আমি খুশি হয়েছি, কিন্তু যখন পড়লাম তখন বুঝতে পেরেছি যে সেসব পরামর্শ তখনই কাজে লেগেছে যখন তারা এটা কাজে লাগিয়েছে, সেটার পেছনে পরিশ্রম দিয়েছে। আমি যা-ই বলি না কেন, তারা নিজেরা উদ্যোগ না নিলে সমস্যা কখনই সমাধান হতো না।’
তাকায়ুকি একমত হলো।
‘এগুলো দেখতে ভালো লাগে, তাই না? তুমি কীভাবে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছো এগুলো তারই প্রমাণ।’
‘এভাবে ভাবা যায়,’ ইউজি গাল চুলকে একটা খাম তুলে নিলো। ‘এটা পড়ো।’
‘এটাই কেন?’
‘পড়লে বুঝবে।’
তাকায়ুকি খামটা থেকে চিঠি বের করল। এটা হাতে লেখা একটা চিঠি।
.
নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,
আমি শুনেছি আজ দোকানটা একরাতের জন্য খোলা হবে, তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে পারলাম না।
আমি আসলে লোকমুখে কিছু গল্প শুনে আপনার কথা জানতে পারি। আমার পরিচিত একজন আপনার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিল। সেটা কে ছিল তা বলার আগে আপনাকে আমার কথা বলি।
আমি ছোটোবেলায় অনাথাশ্রমে বড়ো হয়েছি। সেখানে কবে এসেছিলাম তা আমার মনে নেই। আমার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলো অনাথাশ্রমেরই। আমি ভেবেছিলাম মানুষ এভাবেই বড়ো হয়।
কিন্তু স্কুলে গিয়ে আমার এই ধারণা ভাঙল। আমার বাবা-মা, ঘরবাড়ি নেই কেন?
একদিন অনাথাশ্রমের এক স্টাফ আমাকে জানালো আমি কীভাবে এখানে এসেছি। আমি একমাত্র তাকেই ভরসা করতাম। সে বলল আমার বয়স যখন এক বছর তখন আমার মা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়। আমার বাবা ছিল না। স্টাফ আমাকে বলেছিল আমি বড়ো হলে আমাকে বাকিটা জানাবে।
আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। বাবা থাকবে না কেন? কিছু সময় পার হলো কিন্তু আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।
তখন মিডেল স্কুলে আমাদেরকে একটা রিসার্চ করতে দেওয়া হয়। সবাইকে যার যার জন্মের সময়ে হওয়া ইভেন্টগুলো নিয়ে গবেষণা করতে হবে। আমি এজন্য লাইব্রেরিতে কিছু পত্রিকা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছিলাম। তখন একটা আর্টিকেল পাই।
সেখানে একটা গাড়ি দুর্ঘটনার খবর ছিল। মিদোরি কাওয়াবে নামে এক মহিলার গাড়ি হার্বারে ছিটকে পড়ে। তার সাথে তার এক বছরের কন্যা সন্তান ছিল। আর রাস্তায় কোনো স্কিড মার্ক না পাওয়ার কারণে পুলিশের আশংকা ছিল এটা আসলে হত্যাকাণ্ড বা আত্মহত্যা।
আমি আমার মায়ের নাম আর মারা যাবার আগে সে কোথায় থাকত তা জানতাম। এই মহিলা আমার জন্মদাত্রী।
আমি হতবাক হই। আমার মা দুর্ঘটনায় পড়েনি, বরং আত্মহত্যা করেছে। আর আমাকেও মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এটা আমার জন্য খুব বড়ো ধাক্কা ছিল।
লাইব্রেরি থেকে বের হলাম ঠিকই কিন্তু অনাথাশ্রমে গেলাম না। দয়া করে জিজ্ঞাসা করবেন না কোথায় গিয়েছিলাম। আমার নিজেরই মনে নেই। আমার কেবল মনে হচ্ছিল আমার নিজেরও মরে যাওয়া উচিত ছিল। আমার নিজের মা-ই যেখানে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে, সেখানে আমার আর বাঁচার কোনো কারণ থাকে না। তার কি আমাকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসার কথা না? আমার জীবনটাই অর্থহীন। বেঁচে থাকা উচিত না আমার।
তিনদিন পরে আমাকে কাস্টডিতে নেওয়া হয়। একটা এমিউজমেন্ট পার্কের এক স্টোরের ছাদের কোনায় খুঁজে পেয়েছিল তারা আমাকে। সেখানে কেন ছিলাম আমি জানতাম না। কেবল এটুকু জানতাম, যে উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিলে মরতে সুবিধা হবে।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। কবজিতে কাটা দাগ ছিল। আমার ব্যাগের ভেতরে একটা রক্তে ভেজা রেজর ব্লেড পায় তারা।
এরপর কিছু সময় আমি কারও সাথে কথা বলিনি। কারও চোখের দিকেও তাকাতাম না। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিলাম।
একদিন অনাথাশ্রমে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আমার সাথে দেখা করতে আসে। সে আমার বয়েসি। তার ভাই শারীরিকভাবে অক্ষম। তাদের দুজনের অত্যাচারী বাবা-মায়ের কাছ থেকে তারা পালিয়ে অনাথাশ্রমে এসেছে। মেয়েটা খুব ভালো গান করে। আর আমার গান খুব পছন্দ। আমরা ভালো বন্ধু হয়ে যাই।
তার সাথে আমি সব কথা বলতে পারতাম। দুজনে মিলে কথা বলছিলাম তখন সে বলল কিছু জরুরি কথা আছে তার। আমার কেন যেন মনে হলো অনাথাশ্রমের স্টাফটা তাকে পাঠিয়েছে। জানে আমি ওকে ছাড়া আর কারও সাথে কথা বলব না।
তাকে বললাম আমি সবই জানি। আর কিছু বলতে হবে না আমাকে। কিন্তু সে জোর করল। আর বলল আমি কেবল এক অংশ জানি, পুরো সত্যিটা জানি না। যেমন মারা যাবার সময় আমার মায়ের ওজন কত ছিল? আমি তাকে বললাম এসব আমি কীভাবে জানব? সে বলল সাতষট্টি পাউন্ড। আমি তাকে বলতেই যাচ্ছিলাম যে সে এটা কী করে জানে, কিন্তু আমি বললাম, ‘মাত্র এটুকুই?’
সে বলে যেতে লাগল।
মিদোরির লাশটা যখন পাওয়া গেল, তখন দেখা গেল সে খুব শুকনো। পুলিশ তার অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালালো। সেখানে কোনো খাবার ছিল না। কেবল কিছু পাউডার মিল্ক আর ফ্রিজে বাচ্চার খাবারের একটা জার।
মিদোরি চাকরি পাচ্ছিল না আর তার সমস্ত জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়। বাড়ি ভাড়া জমতে জমতে পর্বত সমান হয়ে গেলে তাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়। এমন একটা অসহায় মুহূর্তে নিজের বাচ্চাসহ আত্মহত্যা করার চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
কিন্তু বাচ্চাটা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল কী করে?
‘আসলে,’ আমার বন্ধু বলেছে, ‘অলৌকিক কিছু হয়নি।’ আর কিছু বলার আগে আমাকে একটা চিঠি দিলো।
চিঠিটা নাকি আমার মায়ের অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গেছে। আমার নাভিরজ্জুর সাথে ছিল এটা। এতদিন স্টাফটা এটা সযত্নে রেখে দিয়েছিল। তারা ঠিক করেছে এখনই এটা আমাকে দেখানোর উপযুক্ত সময়।
খামে ‘মিস গ্রিন রিভার’ লেখা।
ইতস্তত করে খামটা খুললাম। হাতে লেখা একটা চিঠি আছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এটা আমার মায়ের লেখা চিঠি। কিন্তু পড়তে পড়তে বুঝলাম এটা মায়ের লেখা চিঠি নয়। বরং তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি। প্রেরক আমার মাকে মিস গ্রিন রিভার বলে সম্বোধন করছিল।
চিঠিটা তাকে পরামর্শ দিয়ে লেখা। আমার মা কোনো এক অজানা কারণে এই প্রেরককে ভরসা করত। চিঠি পড়ে আমি বুঝলাম তার গর্ভের সন্তানের বাবা এক বিবাহিত লোক যার সন্তানও আছে। মা তার অনাগত সন্তান রাখবে কিনা তা নিয়ে খুব চিন্তিত।
আমার জন্মের কলঙ্ক পড়তে আমার ভালো লাগছিল না। এমন অনৈতিক কারণে জন্ম হয়েছে আমার?
বন্ধুর সামনেই চিৎকার করে মাকে ভৎর্সনা করতে লাগলাম।
‘কেন আমাকে জন্ম দিলে? কেন আমাকে খুন করতে চাইলে?’
কিন্তু আমার বন্ধু বলল আমি ভুল বুঝছি। চিঠির পুরোটা পড়া উচিত আমার। চিঠির প্রেরক বলেছিল এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো অনাগত সন্তানটা শান্তিতে থাকতে পারবে কিনা। ‘বাবা-মা দুজন বেঁচে থাকলেও অনেক বাচ্চারা শাস্তিতে বাঁচতে পারে না। আর আপনি যদি নিজের বাচ্চার ভালোর জন্য সব ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে তৈরি না থাকেন, তবে আমি বলব আপনার বাচ্চাটা নেওয়া উচিত না। লোকটা যদি আপনার কাছে ফিরেও আসে, তবুও আমার পরামর্শ এটাই হবে।
‘তোমার মা তোমাকে জন্ম দিয়েছে।’
আমার বন্ধু বলল, ‘কারণ সে তোমার জন্য সমস্ত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল। সে যে এই চিঠিটা রেখে দিয়েছে এটাই তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। একারণে সে তোমাকে মেরে ফেলার কথা চিন্তাও করতে পারেনি।’
তার মানে সেটা কোনো খুন বা আত্মহত্যা নয়, দুর্ঘটনাই। মিদোরি কাওয়াবে সঠিক পরিমাণে খাবার পাচ্ছিল না। তার মানে সে নিশ্চয়ই গাড়ি চালাবার সময়ে অ্যানেমিক শক পেয়ে গাড়ির ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। সে গাড়িটা বাচ্চাকে ডাক্তার দেখাতে নেবার জন্য ধার করেছিল। গাড়ি পানিতে আছড়ে পড়ায় মিদোরি জ্ঞান হারায়। যখন জ্ঞান ফিরে তখন সে জানালা খুলে সন্তানকে গাড়ি থেকে বের করে দেয় যেন কেউ তাকে দেখে বাঁচায়।
গাড়িতে তার লাশের সিটবেল্টও খোলা ছিল না। অ্যানেমিয়ায় হয়তো সে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
বাচ্চাটার ওজন তখন বাইশ পাউন্ড ছিল। মিদোরি তাকে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার দিচ্ছিল।
পুরোটা পড়ার পরে আমার বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কি এখনও মরে যেতে চাই?
বুঝতে পারছিলাম না আমি কী ভাবব। আমার মায়ের সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। রাগ এক জিনিস, কিন্তু সেটাকে কৃতজ্ঞতায় রূপান্তর করতে গিয়ে আমি আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।
আমি আমার বন্ধুকে বললাম আমার কিছু যায় আসে না। গাড়ি দুর্ঘটনাটা তার নিজের দোষ। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলে এমনটা হতো না। আমাকে বাঁচানোটা মা হিসেবে তার দায়িত্ব। কিন্তু নিজেকে এভাবে মরতে দিয়ে বোকার মতো কাজ করেছে সে।
সে আমাকে চড় মারল।
কাঁদতে কাঁদতে বলল জীবনটাকে এভাবে না দেখতে। আমি কি ইতোমধ্যে অনাথাশ্রমের আগুন লাগার কথা ভুলে গেছি?
বুঝতে পারলাম না কী বলব। সে ক্রিসমাসের সময়ে অনাথাশ্রমে যে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেটার কথা বলছে। আমিও তখন বাকি সবার মতই ভয় পেয়েছিলাম।
আমার বন্ধুর ছোটো ভাইটা বাকিদের চেয়ে পেছনে পরে গিয়েছিল। মারা পড়তো প্রায়। পারফরমেন্স করতে আসা এক মিউজিশিয়ানের জন্য বেঁচে যায় সে। লোকটা খুব কোমল স্বভাবের। সবাই যখন বাঁচার জন্য ছুটছে তখন সে আমার বন্ধুর কথা শুনে আবার ভেতরে ঢুকে যায়। আমার বন্ধুর ভাইকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু লোকটার পুরো শরীরে থার্ড ডিগ্রি বার্ন হয়েছিল। সে হাসপাতালে মারা যায়।
আমার বন্ধু বলেছে তারা এই লোকের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। এটাই তার আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। সে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল জীবন খুব মূল্যবান।
আমি তখন বুঝতে পারলাম স্টাফ ওকে কেন আমার কাছে পাঠিয়েছে। সে ছাড়া কেউ আমাকে এভাবে বুঝাতে পারত না। তারা ঠিক ধরেছে। সে আমাকে মানিয়ে ফেলে। আমিও কান্না করতে শুরু করি। অবশেষে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।
সেদিনের পর থেকে আমি কখনও মরে যাবার চিন্তা করিনি। আমি এখন জানি, জীবন কত মূল্যবান।
কিন্তু এই চিঠির প্রেরক কে, তা না ভেবে পারলাম না। সাইন করা ছিল ‘নামিয়া জেনারেল স্টোর।’ কে এটা? জেনারেল স্টোর কী?
সম্প্রতিই ইন্টারনেটে আমি আপনার কথা জানতে পারি—আপনি চিঠির উত্তরে পরামর্শ দেন। একটা ব্লগে আপনার কথা পড়েছি। তারা আপনার স্মৃতিরোমন্থন করছিল। সেই সূত্রে আপনার পোস্ট পাওয়া।
মিস্টার নামিয়া, আমি আপনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। আমার মাকে পরামর্শ দিয়েছেন বলে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি অবশেষে বলতে পারছি, আমি খুশি যে আমি জন্মগ্রহণ করেছি।
—গ্রিন রিভারের কন্যা
.
বি: দ্র: আমার বন্ধু খুব নামকরা গায়িকা হয়ে গেছে। সে মিউজিকাল জিনিয়াস আর জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। আমি তার ম্যানেজার। সে নিজে ও কারও আত্মত্যাগের প্রতিদান দিয়ে চলেছে।
৫
তাকায়ুকি চিঠিটা ভাঁজ করে রাখল।
‘চমৎকার। তোমার পরামর্শ চিহ্ন ফেলে যাচ্ছে।’
কিন্তু ইউজি মাথা নাড়ল। ‘যা বলেছি, এসবের পেছনে মূল অবদান তাদের নিজস্ব উদ্যোগের। আমার পরামর্শ কারও জীবন বরবাদও করতে পারত, যদি-না তারা ঠিক পদক্ষেপ নিত।
তাকায়ুকি তার বাবার চেহারায় তৃপ্তি দেখতে পেল।
‘এই চিঠিগুলোই আসল উপহার। এগুলো টাঙিয়ে রাখা উচিত।’
‘না, এগুলো তুমি রেখে দাও।’
‘কী?’
‘সবগুলো আমার হয়ে তুমি সামলে রাখো।’
‘কেন?’
‘পুত্র আমার, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না। আমি এসব হাতে পেলে তছনছ করে ফেলব। এগুলো ভবিষ্যতের চিঠি।
তার বাবা ঠিক বলছে।
‘কতদিন রাখব?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইউজি। ‘যতদিন আমি মারা না যাই।’
‘আচ্ছা। আমি সেগুলো তোমার কফিনে রেখে দেবো? পুড়ে শেষ হয়ে যাবে তাহলে।’
‘চমৎকার বুদ্ধি। এটাই করবে।’
তাকায়ুকির এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, সামনে রাখা চিঠির সারিগুলো ভবিষ্যতের চিঠি।
‘বাবা, ইন্টারনেট জিনিসটা কী?’
‘ওহ সেটা। ওটা ভেবে আমিও বিরক্ত হচ্ছি। বেশিরভাগ চিঠিতে এটাই লেখা। আপনার পোস্ট ইন্টারনেটে দেখেছি, আবার সেল ফোন নামেও কিছু জিনিস আছে।’
‘সেটা আবার কী?’
‘জানি না বাপু। মনে হয় ভবিষ্যতের পত্রিকা।’ ইউজি চোখ সরু করে তাকায়ুকির দিকে তাকাল, ‘যে চিঠিটা তোমাকে গাড়িতে দিয়েছি সেটা পড়েছো ভালোমতো? মনে হচ্ছে প্রচার ঠিকভাবেই করবে।’
‘ইন্টারনেটে নাকি সেল ফোনে দেবো?’
‘সেরকম কিছুতেই দেবে মনে হয়।’
তাকায়ুকি অস্বস্তিতে পড়ল, ‘আমি এসবের ভেজালে পড়তে চাই না। খুব বিভ্রান্ত লাগে।’
‘চিন্তার কিছু নেই। আস্তে আস্তে বুঝে যাবে। চলো এখন যাই।’
তখনই কাণ্ডটা ঘটল। স্টোর থেকে একটা মৃদু শব্দ এলো। যেন একটা কাগজ পড়ছে। চোখাচোখি করল ইউজি আর তাকায়ুকি।
‘মনে হয় আরেকটা এসেছে,’ ইউজি বলল।
‘আরেকটা চিঠি?’
‘হ্যাঁ, দেখে এসো।’
‘আচ্ছা।’ তাকায়ুকি সেদিকে চলে গেল। এখানে স্টেশনারির বাক্সগুলো তাক করে রাখা। কিছুই ঠিক করা হয়নি এখনও। শাটারের সাথে লাগানো একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সের ভেতরে একটা কাগজ পেল তাকায়ুকি। সেটা নিয়ে তাতামি রুমে চলে এলো। ‘এটাই হবে।’
ইউজি চিঠিটা খুলে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
‘কী হয়েছে?’ তাকায়ুকি প্রশ্ন করল।
ইউজি চিঠিটা এগিয়ে দিলো তার ছেলের দিকে। তাকায়ুকি দেখল এতে কিছু লেখা নেই। ‘একি! মানে কী এর?’
‘আমি জানি না।’
‘কেউ ঠাট্টা করল নাকি?
‘হয়তো তবে আমার মনে হয় না।’
‘তাহলে কী এটা?’
ইউজি চিঠিটা টেবিলে রাখল, ‘হয়তো কেউ তার সমস্যার সমাধান এখনও পায়নি। হয়তো এখনও রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই বলার কিছু পাচ্ছে না।
‘তাহলে কাগজ কেন পাঠালো?’
ইউজি তাকায়ুকির দিকে তাকালো, ‘তুমি একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করবে?’
‘কেন?’
‘উত্তর দেবো।’
‘কীসের? এখানে কিছু লেখাই নেই।’
‘ভেবে বের করতে হবে।’
‘এখন?’
‘তুমি চলে যাও।’
ইউজির কণ্ঠের দৃঢ়তা অনুভব করল তাকায়ুকি, ‘ঠিক আছে। জলদি করো। ‘হুম,’ ইউজি ইতোমধ্যেই ভাবনায় ডুবে গেছে।
তাকায়ুকি গাড়িতে ফিরে এলো। বাইরে এখনও ভোরের আলো ছড়ায়নি। অদ্ভুত তো! কিন্তু সে তো বাসার ভেতরে অনেকক্ষণ ছিল।
সিভিকে বসে আড়মোড়া ভাঙল সে। হয়তো বাসার ভেতরে সময় অন্যরকমভাবে প্রবাহিত হয়। এই আবিষ্কার তার বোন বা স্ত্রীকে জানানো যাবে না। তারা বিশ্বাস করবে না।
গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে করতে তন্দ্রামতো এসে গেল তার। একটা শব্দে জেগে উঠে দেখল গলি দিয়ে ইউজি বেরিয়ে আসছে। লাঠি ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। তাকায়ুকি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে প্যাসেঞ্জার দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেল।
‘শেষ?‘
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায় সেটা?’
‘আর কোথায়, মিল্ক ক্রেটে।’
‘সেখানে রাখাটাই যথেষ্ট?’
‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সেটাই যথেষ্ট।’
তাকায়ুকি ভাবল তার বাবা খুব অন্যরকম। যেন মানুষ না সে।
গাড়িতে দুজনে উঠে বসলে তাকায়ুকি তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘শূন্য চিঠির জবাব কীভাবে দিলে?’
ইউজি মাথা নাড়ল, ‘তুমি জানো সেটা তোমাকে বলতে পারব না।’
তাকায়ুকি কিছু বলল না। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করতেই ইউজি বলল, ‘এক সেকেন্ড।’
তাড়াতাড়ি ব্রেক কষল তাকায়ুকি।
ইউজি স্টোরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যুগের পর যুগ ধরে এই স্টোরে কাটিয়েছে সে। এটা কেবল একটা ব্যাবসাই নয়। একে বিদায় জানানো সহজ না।
‘আচ্ছা,’ খুব ধীরে ধীরে বলল ইউজি, ‘চলো।’
‘সব হয়ে গেছে?’
‘আমার যা যা করা দরকার তা করে ফেলেছি।’
ইউজি সিটে গা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল।
সিভিক চালু করল তাকায়ুকি।
৬
সাইনের শব্দগুলোতে এত ময়লা জমে গেছে! তাও সে শাটারের ছবি তুলে নিলো। নানা কোণ থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করল। সে ক্যামেরা ভালো চালাতে পারে না। কে জানে ভালো হবে নাকি খারাপ। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। কাউকে তো আর ছবি দেখাচ্ছে না।
প্রাচীন বিল্ডিংটা রাস্তার অপর পাশ থেকে দেখল তাকায়ুকি। এক বছর আগের কথা ভাবছে সে। যে রাতে সে ইউজির সাথে স্টোরে এসেছিল।
একে বাস্তব বলে মনে হয় না। যেন একটা স্বপ্ন। আসলেই কি সেই চিঠিগুলো ভবিষ্যৎ থেকে এসেছিল? সে রাতের কথা আর কখনও আলোচনা করেনি তারা।
কিন্তু তার বাবার কফিনে রাখা চিঠিগুলো খুব বাস্তবই ছিল। ইউরিকো সেগুলোর কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। সে উত্তর দেয়নি।
ইউজি খুব অদ্ভুতভাবে মারা যায়। ডাক্তার বলেছিল সে যে-কোনো সময়েই মারা যেতে পারে। কিন্তু তার জীবনীশক্তি যেন বেড়েই চলে। দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু কখনও ভাঙে না, এমন। সে খেত কম। বেশিরভাগ সময়ে ঘুমাতো। কিন্তু আরও এক বছর বেঁচে থাকে। তার শরীরের ভেতরে সময় যেন থেমে গিয়েছিল।
কারও কণ্ঠ শুনে সম্বিৎ আসে তাকায়ুকির।
‘উম, এই যে।’
ঘুরে দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে খেলাধুলোর পোশাক। পাশে বাইক। আর কাঁধে জিমের ব্যাগ।
‘হ্যালো। আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘আপনি মিস্টার নামিয়াকে চিনেন?’
‘আমি তার পুত্র। এটা তার দোকান ছিল।’
মেয়েটার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল, ‘ওহ আচ্ছা।’
‘আপনি স্টোরে আসতেন?’
‘হ্যাঁ, তবে কাস্টমার হিসেবে না।’ মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন সে লজ্জিত।
তাকায়ুকি বুঝে গেল, ‘আপনি তাহলে পরামর্শের জন্য আসতেন।’
‘হ্যাঁ। সেটার খুব বড়ো প্রভাব পড়েছে আমার জীবনে।’
‘শুনে খুশি হলাম। কতদিন আগের কথা সেটা?’
‘খুব সম্ভবত গত নভেম্বর।’
‘গত নভেম্বর?’
‘দোকানটা কী আর কখনও খুলবে না?’ মেয়েটা শাটারের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘আমার বাবা মারা যাবার পর–‘
মেয়েটা খুব চমকে গেল। ‘মারা গেছে? কবে?’
‘গত মাসে।’
‘ওহ—আমি দুঃখিত।’
‘ধন্যবাদ,’ তাকায়ুকি জিম ব্যাগটার দিকে তাকালো। ‘আপনি ক্রীড়াবিদ?’
‘আমি একজন ফেন্সার।’
‘বাহ!’ তাকায়ুকি এটা আশা করেনি।
‘অনেকেই ফেন্সারদেরকে কখনও সামনাসামনি দেখেনি।’ মেয়েটা হেসে বাইকে উঠে গেল। ‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। বিদায়।’
‘আচ্ছা। আবারও ধন্যবাদ।’
তাকায়ুকি মেয়েটাকে বাইকে করে চলে যেতে দেখল। একজন ফেন্সার। এদের হুটহাটই দেখা যায়। চার বছর পরপর অলিম্পিকে দেখা মেলে এদের। তাও কেবল হাইলাইটসে। কিন্তু এ বছর জাপান মস্কোকে বয়কট করেছে। তাই সেটুকুও দেখা যায়নি।
মেয়েটা বলল সে গত নভেম্বরে চিঠি দিয়েছে। হয়তো এটা তার মনের ভুল কারণ ততদিনে ইউজি হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে ছিল।
তাকায়ুকি ছোটো গলিটা দিয়ে হেঁটে পেছনে চলে এলো। মিল্ক ক্রেটটা খুলল। কিছু নেই। ইউজি গত বছর যে অদ্ভুত চিঠিটা লিখেছিল সেটা এখন কোথায়? সত্যিই কি ভবিষ্যতে পাড়ি জমাতে পেরেছে?
৭
সেপ্টেম্বর ২০১২।
শুঙ্গো নামিয়া হতবাক হয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। তার এটা করা উচিত না। কোনো ঝামেলা হয়ে গেলে বিপদে পড়বে সে। এটা তার পারিবারিক ল্যাপটপ। যদি পুলিশ ট্র্যাক করে ফেলে তাহলে তাকে এক সেকেন্ডে ধরে ফেলবে। সাইবার ক্রাইমের শাস্তি খুব গুরুতর হয়।
কিন্তু তার মনে হয় না তাকায়ুকি তাকে কোনো বেআইনি কাজ করতে বলেছে। শেষ সময় পর্যন্তও সে জরাগ্রস্থ হয়নি। শুঙ্গোকে যখন কাজটা করতে বলছিল, তখনও তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়।
তাকায়ুকি শুঙ্গোর দাদা। গত বছরের শেষের দিকে সে মৃত্যুবরণ করে। পাকস্থলির ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। তাকায়ুকির বাবাও ক্যান্সারে মারা যান। হয়তো ক্যান্সার রোগটা তাদের বংশগত।
তাকায়ুকিকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগে সে শুঙ্গোকে নিজের ঘরে ডেকে একটা ছোটো কাজ করতে বলে যায়। আর বলে এই কথা কেবল তাদের দুজনের মাঝেই থাকবে।
‘কী কাজ?’ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল শুঙ্গো।
‘তুমি কম্পিউটার ভালো চালাতে পারো, তাই না?’
‘তা বলতে পারেন,’ সে মিডেল স্কুলের ম্যাথ ক্লাবে ছিল। তারা সবসময় কম্পিউটার ব্যবহার করত।
তাকায়ুকি একটা কাগজ বের করল, ‘আগামী সেপ্টেম্বরে, তুমি এখানে যা যা লেখা আছে, তা ইন্টারনেটে পোস্ট করবে।’
শুঙ্গো কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ল। অদ্ভুত তো।
‘এটা কী?’
তাকায়ুকি মাথা নাড়ল। ‘এটা যাই হোক। একে যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করবে। তুমি তা পারবে, তাই না?’
‘হয়তো।’
‘সত্যি বলতে এটা আমার নিজেরই করার কথা ছিল। আমি তেমনই কথা দিয়েছিলাম।’
‘কাকে?’
‘আমার বাবা। তোমার প্রপিতামহকে।’
‘আমার দাদার বাবা—’
‘কিন্তু শোনো। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। কতদিন বাঁচব তা জানি না। একারণে তোমার সাহায্য প্রয়োজন।’
‘আচ্ছা।’
তাকায়ুকিকে প্রসন্ন দেখাল।
এর কিছুদিন পরই, তাকায়ুকি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। শুঙ্গো যখন সুয়া অনুষ্ঠানে বসেছিল, তখনও যেন সে শুনতে পাচ্ছিল, কফিন থেকে তার দাদা বলছে, ‘আমি তোমার ওপর নির্ভর করে আছি, দাদুভাই।’
এরপর থেকে এই প্রতিজ্ঞাটা শুঙ্গোর মনে গেঁথে যায়। কীভাবে কী করবে তা বুঝে ওঠার আগেই সেপ্টেম্বর চলে আসে।
শুঙ্গো কাগজটা ডেস্কে তার সামনে রাখল।
.
‘সেপ্টেম্বর ১৩ তারিখে, মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নামিয়া জেনারেল স্টোরের পরামর্শ বাক্স কেবল এক রাতের জন্য খোলা থাকবে। আমরা চাই যারা কখনও এই স্টোর থেকে উপদেশ পেয়েছেন, তারা যেন সেই সময়ে তাদের অশোধিত মতামত আমাদেরকে জানান। পরামর্শটা আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? কাজে দিয়েছে কি দেয়নি? দয়া করে আপনাদের চিঠিগুলো আগের মতো মেইল স্লটে রেখে যাবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকব।’
.
তাকায়ুকি কাগজটার সাথে আরও কিছু দিয়েছিল তাকে। নামিয়া জেনারেল স্টোর, তার প্রপিতামহের দোকানের একটা ছবি। শুঙ্গো সেটা কখনও দেখেনি কিন্তু জানে বিল্ডিংটা এখনও সেখানেই আছে।
তাকায়ুকি কেবল বলেছিল তার পরিবার একটা জেনারেল স্টোর চালাত। ব্যস এটুকুই জানে শুঙ্গো।
‘উপদেশ’ বলতে কী বুঝিয়েছে, আবার ‘পুনরায় চালু’ বলতেই বা কী বোঝানো হয়েছে? এখন পেছানো যাবে না আর। একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে ফেললে সেটাকে আনডু বোতাম চেপেও বন্ধ করা যাবে না।
শুঙ্গো কম্পিউটার বন্ধ করে দিলো। স্ক্রিনটা বন্ধ করতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়ল তার।
হাতঘড়িটা। ডেস্কের এক কোনায় রাখা। উত্তরাধিকার সূত্রে এটা তাকায়ুকির কাছ থেকে পেয়েছে সে। তাকায়ুকি কলেজে ভর্তি হবার সময় তার বাবা এটা তাকে দিয়েছিল। এখন এটা এত পুরোনো আর নষ্ট হয়ে গেছে যে প্রতিদিনই পাঁচ মিনিট করে হারিয়ে ফেলে।
শুঙ্গো মনিটরের দিকে তাকালো। তার আর তার দাদার চেহারা একইরকম। দুজনের চেহারা যেন একে অপরকে প্রতিফলিত করছে।
একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শুঙ্গো। এখন সেটা পালন করার সময় হয়েছে। কম্পিউটারটা চালু করল সে।