অধ্যায় ৩ : মারাঠা আক্রমণ

অধ্যায় ৩ – মারাঠা আক্রমণ

১৭৪১ সালের শেষের দিকে আলীবর্দী সমস্ত শত্রুদের দমন করেন, আর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যা জুড়ে। কিন্তু ভাগ্য এই বৃদ্ধ মানুষটিকে ক্ষণিকের অবসরও লিখে রাখেনি। মির্জা বাকারকে অপসারণের পর রাজধানীতে ফেরার আগেই, উড়িষ্যা আর দাক্ষিণাত্যের প্রান্ত থেকে ভয়াবহ হতাশাজনক শত্রু হিসেবে তার সামনে এসে উপস্থিত হয় মারাঠা আক্রমণগুলো, যা তাকে তার শাসনামলের বিরাট সময় জুড়ে বিশ্রামহীন রেখেছিল।

মারাঠা আক্রমণের সূচনা

বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সূত্রপাত দেখা দেয় সেসময়ে মারাঠা সাম্রাজ্যবাদের জয়যাত্রার সঙ্গেই। এসময়ে মারাঠাদের দেখা যায় মুমূর্ষু মুঘল সাম্রাজ্যের উপর প্রতিশোধ নিতে, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিপরীতে; আর সেটাই মারাঠাদের ভারতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া করে তোলে। মুঘল ধ্বংসস্তূপের উপরে মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিচক্ষণতা শুরু হয় প্রথম পেশওয়া বালাজি বিশ্বনাথের সময় থেকে, যেটা খুব সম্ভবত তার সাহসী ও কল্পনাপ্রবণ উত্তরসূরী প্রথম বাজি রাওয়ের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল, যখন তিনি তার মনিব সাহুকে বলেন :  আমাদের শুকিয়ে যাওয়া গাছের (মুঘল শাসন) কাণ্ডে আঘাত করতে দিন; শাখাগুলো নিজে থেকেই ঝরে যাবে। এভাবেই কৃষ্ণ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত মারাঠা পতাকা উড়বে । মারাঠাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত সেনাপতি ত্ৰিম্বাক রাও ধাবাড়ি ও সেনা সাহিব সুবাহ রঘুজি ভোঁসলেসহ আরও কিছু শত্রুভাবাপন্ন সেনাপতিদের দমনের পর, বাজি রাও ১৭৪০ সালের ২৮ এপ্রিল তার মৃত্যুর আগেই গুজরাট, মালওয়া ও বুন্দেলখণ্ডে মারাঠা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন আর মূল দাক্ষিণাত্য পুরোপুরি মারাঠাদের কাছে সমর্পিত হয়।

বাস্তবিকভাবে রঘুজি ভোঁসলে ছিলেন নাগপুরের স্বাধীন গোত্র সর্দার, যিনি সাতারায় কর্তৃত্ব ফলানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে লালন করেছিলেন তার মনিব সাহুর প্রভাবে আনার মাধ্যমে, যিনি রঘুজির প্রতি সদয় মনোভাব পোষণ করতেন। কিন্তু সেটা বানচাল হয়ে যায় বাজি রাওয়ের অসাধারণ মেধা আর সক্ষমতার কাছে। রঘুজি সে-কারণে সেখান থেকে বেরিয়ে তার নিজের সম্প্রসারণ ও লুটপাটের জন্য পথ খুঁজছিলেন তার এলাকার উত্তর-পূর্ব দিকে, সুবাহ বাংলায়। প্রকৃতির দানে প্রভূত ঐশ্বর্যের বাংলা তখনও মারাঠাদের চৌখ দেওয়া শুরু করেনি। সেসময়কার বাংলার রাজনৈতিক দুর্দশা চমৎকার এক সুযোগ করে দেয় তার উচ্চাশা পরিপূর্ণ করার। চরম শত্রু আলীবর্দীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে, দাক্ষিণাত্যে আশ্রয় নেওয়া নবাব সারফারাজের আত্মীয় আর অনুসারীরা, রঘুজিকে বাংলা আক্রমণের আহ্বান করে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দেন। কিছু মুসলিম লেখকের বর্ণনা থেকে মনে হয়, আসাফ জাহ নিজাম-উল-মুল্‌কও রঘুজিকে প্ররোচিত করেছিলেন বাংলার দিকে এগিয়ে আসতে। এভাবে নিজাম-উল-মুল্ক বেরারে অবস্থান করা মারাঠাদের দৃষ্টি অন্যদিকে— তার এলাকার দক্ষিণে ও উত্তর-পূর্ব দিকে ঘুরিয়ে দেন, আর একই সময়ে দক্ষিণে আলীবর্দীকে তার প্রভাববলয় বিস্তার থেকে প্রতিহত করেন।

সমসাময়িক সাহিত্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

সেসময়ে লেখা ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে মারাঠা আক্রমণের সূত্রপাত নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তার লেখনি অনুযায়ী, এগুলো ছিল একধরনের হিন্দুধর্মযুদ্ধ মুসলিম (আলীবর্দী ও তার বাহিনী) অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে, যারা পুরীর কাছে ভুবনেশ্বরের মন্দিরে তাণ্ডব চালিয়েছিল আর এভাবে হিন্দুধর্মের শান্তি নষ্ট করেছিল। সমসাময়িক আরেক বাঙালি লেখক গঙ্গারাম তার মহারাষ্ট্রপুরাণে মারাঠাদের ক্ষোভের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন দেশের দুর্দশা ও অনাচারের আর এর বিহিত করতে তারা সম্মত হয় স্বর্গীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। কিন্তু এই বক্তব্যগুলোর ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। ভারতচন্দ্র ছিলেন নদীয়ার নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্রাহ্মণ জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের ব্রাহ্মণ সভাকবি, জমিদার আলীবর্দীর কাছে বন্দীও হয়েছিলেন নজরানা হিসেবে চাওয়া ১২ লক্ষ রুপি দিতে ব্যর্থ হওয়ায়। তাই তার বক্তব্য সংকীর্ণ ধরনের দেশপ্রেমে অন্ধ বলে সন্দেহ করা যেতেই পারে। গঙ্গারাম একই পথে হাঁটেননি। তার বর্ণনা ছিল জনসাধারণের (গ্রামের কৃষিজীবী, বৈষ্ণব, ব্রাহ্মণ, সাধারণ নরনারী) দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আর তিনি পরিষ্কারভাবে তাদের প্রথমদিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা—যে তারা মারাঠাদের আগমনে স্বস্তি প্রকাশ করেছিল, পরবর্তী হতাশা ও বিরক্তি আর শেষপর্যন্ত বাংলার বিপন্ন মুসলিম সরকারের দিকেই তাদের মনোভাবের দিক পরিবর্তনের উল্লেখ করেছেন। উপরে উল্লেখ করা হিন্দু অনুভূতি সম্পর্কে সেসময়কার মুসলিম ঐতিহাসিকদের সম্ভবত কোনো ধারণাই ছিল না; তারা চক্রান্তের সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত পুরো দায় চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় ভারতের অন্য মুসলিমদের উপরে (যেমন – সারফারাজ খানের অনুসারীদের; অসন্তুষ্ট কর্মকর্তাদের, বা নিজাম-উল-মুল্‌ল্কের)। হয়তো তারা আংশিকভাবে ঠিক, আর এটাও স্বাভাবিক যে বাংলার মুসলিম লেখকরা হিন্দু প্রজাদের ভেতর অন্তঃপ্রবহমান অসন্তোষ সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলেন।

প্রথম মারাঠা আক্রমণ ১৭৪২

রঘুজি ভোঁসলে তার প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর রামকে দায়িত্ব দেন বাংলা আক্রমণ করে চৌথ আদায় করার। ভাস্কর আরও ২৩ জন সেনাপতি, ২০ হাজার অশ্বারোহী   নিয়ে উড়িষ্যা পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে আসেন, সেখানকার সহকারী প্রশাসক শেখ মাসুম খানকে উৎখাত করেন আর তার পেশকার দুর্লভরামকে বন্দী করেন। এরপর তিনি পাচেতের (বর্তমান রানীগঞ্জ ও আশেপাশের জেলা) দিকে যাত্রা করেন।

উড়িষ্যা থেকে ফেরার পথে আলীবর্দীর কাছে খবর আসে যে মারাঠারা মেদিনীপুরের কাছে জয়গড় পর্যন্ত চলে এসেছে, আর সংবাদপ্রেরক ছিলেন সেই এলাকার রাজস্ব-সংগ্রাহক। তিনি প্রথমে এটাকে তেমন পাত্তা দেননি, তিনি ধীরেসুস্থে মুর্শিদাবাদে ফেরার ব্যবস্থা নেন, এই বিশ্বাসে যে চেনা-জানা রাজমহলের পাহাড়ি রাস্তা ছাড়া বাইরের আক্রমণকারীরা বাংলায় ঢুকতে পারবে না। কিন্তু শীঘ্রই তার এই ভ্রম কেটে যায়, যখন তিনি শাক্রা ও মুবারাক মঞ্জিলে পৌঁছান তার কাছে খবর আসে যে মারাঠারা পাচেত পেরিয়ে গিয়েছে আর বর্ধমানে আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে। তিনি এই খবর আর অগ্রাহ্য করতে পারলেন না।

বর্ধমানে খণ্ডযুদ্ধ

একদিন ও একরাত অবিশ্রান্তভাবে জোরকদমে চলার পর আলীবর্দী ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল বর্ধমানে পৌঁছান আর শহরের বাইরে রানীদীঘি নামের এক জলাশয়ের পাশে শিবির স্থাপন করেন। তার সঙ্গে তিন থেকে চার হাজার অশ্বারোহী, চার থেকে পাঁচ হাজার মাস্কেটিয়ার (বন্দুকবাজ) ছিল, কারণ উড়িষ্যা উদ্ধারের পর বেশিরভাগ সৈন্যই সাওলাত জংয়ের তত্ত্বাবধানে মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিল। তাকে সম্পূর্ণ হতবাক করে দিয়ে মারাঠারা গভীর রাতে তার শিবির ঘিরে ফেলে, তার সৈন্যদলের মালপত্র, কিছু ঘোড়া, হাতি আর উট লুট করে আর খাবার সরবরাহের পথ আটকে দেয়। পরিকল্পিত লড়াই এড়াতে, মারাঠারা দিনের বেলা খণ্ডযুদ্ধের আশ্রয় নিত আর সন্ধ্যায় বর্ধমান ফিরে যেত। ভাস্কর তার ফিরে যাওয়ার বিনিময়ে ১০ লক্ষ রুপি দাবি করলে আলীবর্দী তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মারাঠাদের মোট চব্বিশজন সেনাপতির ১৪ জন ভাস্করের সঙ্গে আলীবর্দীর বাহিনীর পিছে লেগে থাকেন, আর বাকিরা অন্য এলাকায় গিয়ে তাণ্ডব চালাতে থাকে।

বর্ধমানে নবাবের বাহিনীর করুণ দশা

শুধু তাই নয়, রিয়াজের লেখক বলেছেন,  শস্যের গোলায় আগুন লাগিয়ে দেয় আর মাঠে উর্বরতার কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট রাখেনি, আর যখন বর্ধমানের গোলা ও গুদামঘর নিঃশেষ হয়ে যায়, আমদানি করা খাদ্যশস্য সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়, ক্ষুধায় মৃত্যু এড়াতে উদ্ভিদ-শিকড় খেতে শুরু করে, আর গবাদি পশুরা গাছের পাতা। এমনকি একটা সময়ে এগুলোও দুর্লভ হয়ে পড়ে। সকালের নাস্তা আর রাতের খাবারের জন্য চোখ দিয়ে গোলাকার সূর্য আর চাঁদ গেলা ছাড়া আর কিছু‍ই করার ছিল না । আমরা একইরকম পরিস্থিতির বর্ণনা পাই ওয়াফা 13 সালিমুল্লাহর লেখায়। গঙ্গারামও লিখেছেন :  বর্গীদের ভয়ে কেউ ঘর থেকে বেরোত না আর কোথাও কোনো খাবার সুলভ ছিল না। সেনাবাহিনীর সব সৈন্যরা, তা উঁচুপদের হোক বা নিচু, বাধ্য হয়ে সেদ্ধ লতাপাতা ও শিকড় খেত। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে পড়েছিল; অন্যদের কথা আর কী বলার, নবাব নিজেও এসব খেতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

আলীবর্দী বর্ধমান থেকে বেরিয়ে এলেন; পথে বিপত্তি

প্রায় এক সপ্তাহ এভাবে কেটে যাওয়ার পর, যখন আলীবর্দী চিন্তা করে দেখলেন তার শিবিরে অনেকটা শত্রুর দয়ার উপর নির্ভর করে অবস্থান করা একদমই অনুচিত কোনোরকম খাবারের সংস্থান ছাড়া। তিনি একরাতে দ্রুত অল্পকিছু নির্বাচিত সৈন্য নিয়ে মারাঠা অশ্বারোহীদের অবরোধের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন, আর পরিকল্পিত লড়াইয়ে নামলেন, মারাঠারা যেটা এতদিন এড়িয়ে আসছিল। সেনাবাহিনীকে চলমান রাখতে, তিনি অন্য অনুসারীদের আর যোদ্ধা নয় এমন লোকেদের শিবিরেই থাকার আদেশ দেন টানাগাড়ি, তাঁবু আর অন্যান্য রসদের সঙ্গে। কিন্তু এমনটা হয়নি। ১৭৪২ সালের মে মাসের এক সকালে তিনি নির্বাচিত সৈন্যসহ শিবির ছেড়ে বেরোতেই, পিছে রয়ে যাওয়া লোকেরা অপ্রস্তুত অবস্থায় মারাঠা আক্রমণের শিকার হয়, এরপর তারাও কাছাকাছি থেকে নবাবের বাহিনীকে অনুসরণ করতে থাকে; ফলে আগের মতোই তারা ধীরগতির হয়ে পড়ে।

বাংলার বাহিনীকে এমন পরিবেষ্টিত অবস্থায় পেয়ে মারাঠারা চারদিক দিয়ে আক্রমণ চালায়, আর ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় বর্ধমান শহর থেকে ১২ মাইল দূরে। সন্ধ্যার সময় নবাব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন তার আফগান সেনাপতিরাও উদাসীন হয়ে পড়েছে আর পেছনে পড়ে রয়েছে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার বদলে। প্রকৃতপক্ষে আফগানরা তার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল নানা কারণে। মারাঠারা কেবল তার তাঁবু আর তিন-চারটা পালকি ছাড়া সমস্ত রসদ, তাঁবু, আর মালপত্র ধ্বংস করে ফেলে। দুর্দশার ষোলোকলা পূর্ণ করতে তাকে ধানক্ষেতে রাত কাটাতে হয়, যা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে কাদা-জলে ডুবে ছিল। এভাবেই দুর্দশার ভেতর দিয়ে সারারাত থাকতে হয় তাকে।

আলীবর্দীর শাস্তি প্রস্তাব

মাথার উপর ছাদ নেই, পেটে দানা-পানি নেই, চারিদিকে শত্রু — আলীবর্দী নিজেকে খুবই বিপন্ন পরিবেশে আবিষ্কার করলেন; কিন্তু তার সহজাত ধৈর্য দিয়ে, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে-কোনো উপায়ে এই অবস্থা থেকে মুক্তির। সম্ভবত তার জিনিসপত্র পুনরায় জোগাড় করার জন্য সময়ক্ষেপণের উদ্দেশ্যে পরদিন সকালেই শান্তি আলোচনার প্রস্তাব রাখেন, মারাঠাদের কাছে দাক্ষিণাত্যের স্থানীয় মীর খাইরুল্লাহ খান নামের এক দূতের মাধ্যমে, যিনি তখন বর্ধমানের রাজার বাহিনীতে বকশি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রাজা নিজে তাকে বিশ্বস্ত মনে করতেন, তার উপরে ভরসা করেই ভাস্করের কাছে বাংলার নবাবের সঙ্গে সমঝোতার চিঠি পাঠানো হয়।

ভাস্করের অতিরিক্ত দাবি

ভাস্কর ঔদ্ধত্য নিয়ে জবাব দেন যে তিনি প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি আছেন আর নবাবও তার রাজধানীতে বিনা ক্লেশে প্রবেশ করতে পারবেন, যদি তিনি তাকে এক কোটি রুপি দেন ও তার সমস্ত হাতি সমর্পণ করেন।

আলীবর্দীর মারাঠাদের সঙ্গে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত

আলীবর্দীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানকিরাম তাকে মারাঠাদের দাবি পূরণের জন্য উপদেশ দেন ঐ সময়ে তার সেনাবাহিনীর শোচনীয় অবস্থা দেখে। কিন্তু আলীবর্দী সিদ্ধান্ত নেন আরেকবার আক্রমণ করার, আর জবাব দেন যে তিনি শত্রুদের যথেচ্ছ দাবি মেনে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার থেকে ১০ লক্ষ রুপি তার নিজের মানুষদের ভেতর বিলি করবেন। করম আলী জানিয়েছেন যে, আলীবর্দী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে হতবিহ্বল না হয়ে প্রথমে তিনি মারাঠাদের দাবি মেনে নিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু জলদিই তিনি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন যখন তারা তার নাতি সিরাজ-উদ-দৌলাকে টাকার বিপরীতে জিম্মি হিসেবে তাদের সঙ্গে রাখতে চায়, আর তাই আল্লাহর কাছে ঐশী সাহায্য চেয়ে তিনি তার সেনাপতিদের উদ্দেশে বলেন :  আমি কেন ঐ অর্থ তোমাদের পুরস্কার হিসেবে না দিয়ে মারাঠাদের দিয়ে দেব?  এরপর তিনি অসন্তুষ্ট আফগানদের মন জয় করা জরুরি ভাবলেন, যারা তার সেনাবাহিনীর মূল চালিকাশক্তি ও প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছিল।

মুস্তাফা খানের তাঁবুতে আলীবর্দী ও আফগানদের আনুগত্য ফিরে পাওয়া

এই চিন্তায় আলীবর্দী সেই রাতেই কোনো নিরাপত্তাপ্রহরী ছাড়া কেবল শিশু সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে মুস্তাফা খানের তাঁবুতে গিয়ে বললেন,  অতীতে যেসব ঘটনা ঘটেছে সে-কারণে কি আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন? আমি এখন আপনার নিকট প্রস্তুত হয়ে উপস্থিত হয়েছি, সঙ্গে আছে মাত্র সিরাজ-উদ-দৌলা। সে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। আমাদের সঙ্গে আর কেউ নেই। এক আঘাতে এখনই আমাদের শেষ করে ফেলুন এবং সকল অনিশ্চয়তা থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। আর বহুদিনের বন্ধুত্বের কোনো স্মৃতির কথা যদি মনে জাগরিত হয় ও অতীত উপকারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কোনো স্থান আপনার হৃদয়ে থেকে থাকে এবং আমার অপরাধসমূহ যা অতীতে পরিণত হয়েছে তা যদি ক্ষমা করতে পারেন; তবে এই চরম সংকটের মুহূর্তে আমার পাশে এসে দাঁড়ান এবং নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলুন এবং প্রতিজ্ঞা করুন যে, আমাকে পরিত্যাগ করে যাবেন না। আমার মনে শান্তি আনতে এটিই একমাত্র উপায় এবং মারাঠাদের নিয়ে কী করা যায় তা আমার পক্ষে চিন্তা করার উপায়। কারণ আমার কাছে আত্মসমর্পণের আগে যা কিছু করা সম্ভব তা করতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এটা মুস্তাফা খান ও তার সহযোদ্ধা শামশির খান, উমর খান, সর্দার খান, রহম খান ও অন্যদের উপর আশানুরূপ প্রভাব বিস্তার করে আর তারা সকলেই নবাবের পক্ষে নতুন উদ্যমে লড়াইয়ে নামতে সম্মত হন।

কাটোয়ার পথে আলীবর্দীর লড়াই

এভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে আলীবর্দী পরদিন সকালে কাটোয়ার দিকে যাত্রা করেন, বর্ধমানের ৩৫ মাইল উত্তর-পূর্বে, সঙ্গে খুবই কমসংখ্যক সৈন্য (দুই থেকে তিন হাজার অশ্বারোহী, পাঁচ থেকে ছয় হাজার পদাতিক ও কিছু হাতি) নিয়ে। নিকুলসরাইয়ে পৌঁছে তার সৈন্যরা তাদের পুরো পথ অনুসরণ করা মারাঠাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল। সন্ধ্যার দিকে এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধ শুরু হয় আর পুরো রাত ধরে তা চলতে থাকে, একপর্যায়ে উমর খানের ছেলে, আলীবর্দীর সাহসী সেনাপতি মুসাহিব মুহাম্মাদ খান মারা যান। মারাঠারা আলীবর্দীর শিবিরে প্রথমবার আক্রমণ করে হাতিয়ে নেওয়া একটি কামান একটি গাছের উপরে স্থাপন করে তার সেনাবহরের দিকে ছুড়তে শুরু করে। ভোরবেলায় আলীবর্দীর বাহিনীর সঙ্গে আসা মানিকচাঁদ (বর্ধমানের রাজার দিওয়ান) ভয়ে বর্ধমানে পালিয়ে যান। মারাঠারা দ্রুত আলীবর্দীর বাহিনীর কেন্দ্রে ঢুকে মীর হাবিবকে বন্দী করে, যিনি এরপর থেকে তাদের বন্ধুতে পরিণত হন, আর তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। কিন্তু এমন বিপর্যয়কর সময়ে আলীবর্দীর গোলন্দাজ বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক হায়দার আলী খান, মীর জাফর খান, মুস্তাফা খান, শামশির খান, উমর খান, সর্দার খান ও রহম খানের মতো কিছু সেনাপতির বীরত্বে তার বাহিনী বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। তারা সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুদের পাল্টা আক্রমণ করেন আর শত্রুপক্ষের অনেককেই হত্যা করেন, যেটা মারাঠাদের ভীত করে আর তারা নবাবের বাহিনীকে ঘিরে যে বৃত্ত তৈরি করেছিল তা ভেঙে দেওয়া আর কেবল একটা অংশেই আঘাত করতে থাকে। এর ফলে বাংলা বাহিনী বিরাম পায় দৃঢ়ভাবে আবার একক দল হিসেবে সারিবদ্ধ হওয়ার, আর কাটোয়ার দিকে যাত্রা শুরু করার। তবে মারাঠাদের সঙ্গে পুরো পথ ধরেই লড়াই চলমান ছিল।

আলীবর্দীর বাহিনীর দুর্ভোগ

বর্ধমান থেকে কাটোয়ার পথে আলীবর্দীর বাহিনীর দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। আলীবর্দীর সঙ্গে এসময়ে উপস্থিত থাকা ইউসুফ আলী সমস্যায় জর্জরিত যাত্রার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তার লেখনিতে। তিনি লিখেছেন নবাবের সৈন্যরা পথে যখনই থামত, অনুসরণ করা মারাঠারাও থেমে যেত, নবাবের সৈন্যদের সুইভেল বন্দুকের ব্যাপ্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে, আর একইসঙ্গে অনুসন্ধান দল পাঠাত নবাব-বাহিনীর চলার পথের আশেপাশের দশ-বারো মাইলের বৃত্তে যত গ্রাম রয়েছে সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ আর লুট করার জন্য। প্রতি রাতে নবাবের বাহিনীর সেনাপতি থেকে সাধারণ সৈন্য খোলা আকাশের নিচে, গালিচাহীন বা চাদরহীন মাটিতে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। খাদ্যদ্রব্য কমে আসছিল, যাদের পদাধিকার ছিল বা হাতে কিছু অর্থ ছিল, তারা বড়জোর একবেলার খাবার সংগ্রহ করতে পারত, আর সাধারণ মানুষের ভরসা ছিল গাছপালা আর শিকড়, এমনকি ঘাসও বাদ যেত না। যাত্রার প্রথম দিন ইউসুফ আলী নিজেও একসের খিচুড়ির তিনভাগ জোগাড় করতে পেরেছিলেন, যা তিনি অন্য সাতজনের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিলেন; পরদিন তারা সাত খণ্ড শাকর-পারা খেয়ে দিন পার করেছিলেন; আর তৃতীয় দিন আধাকেজি পচা-গলা মাংস পেয়েছিলেন। এভাবে তিনদিন প্ৰায় অভুক্ত থেকে বাংলাবাহিনী মারাঠাদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে চতুর্থ দিন কাটোয়ায় পৌছায়। কিন্তু মারাঠা বাহিনীর হালকা অশ্বারোহী দল তার আগেই কাটোয়ায় পৌঁছে সেখানকার খামার, গোলাঘর ও গুদাম পুড়িয়ে দেয়, আর নিজেরা নেওয়ার পর যেটুকু শস্য তারা বহন করতে পারেনি সেগুলোও পুড়িয়ে দেয়। ক্ষুধায় কাতর আলীবর্দীর সৈন্যরা আধপোড়া শস্য দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করতে শুরু করে। মুর্শিদাবাদ থেকে এর পরপরই ত্রাণ চলে আসে। আলীবর্দীর অনুরোধের জবাবে, হাজী আহমাদ ও শাহামাত জং রসদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় মালামাল সাওলাত জংয়ের তত্ত্বাবধানে পাঠান।

মারাঠা বাহিনীর ছোট দল নিয়ে মীর হাবিবের মুর্শিদাবাদে তাণ্ডব

নবাবের দলে এভাবে নতুন শক্তি সঞ্চয় আর বর্ষার আগমনে, ভাস্কর বীরভূম হয়ে তার নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু সদ্য মারাঠা দলে যোগ দেওয়া মীর হাবিব এর বিরোধিতা করেন, তিনি তাকে বলেন জগৎ শেঠ ও অন্য বণিকদের সম্পদ এখন অরক্ষিত মুর্শিদাবাদে, সেখানে মারাঠারা সহজেই লুটপাট করতে পারবে, যদি আলীবর্দীর অনুপস্থিতিতে সেখানে হামলা করা যায়। ভাস্কর এই প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে যান, আর মীর হাবিব কাটোয়া থেকে মুর্শিদাবাদের পথে বেরিয়ে পড়েন মাত্র কয়েক হাজার ঘোড়সওয়ার মারাঠা নিয়ে ১৭৪২ সালের ৬ মে ভোরে, তিনি মুর্শিদাবাদের উল্টোদিকের দহপাড়ায় এসে সেখানকার বাজার জ্বালিয়ে দেন, যা গঞ্জ মুহাম্মাদ খান নামে পরিচিত ছিল। হাজী আহমাদ, শাহামাত জং ও ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা থেকে আসা হোসেন কুলি চেষ্টা করেন তাকে ভাগীরথী নদীর ওপারে আটকে রাখার। কিন্তু তিনি সবাইকে পরাস্ত করে হাজীগঞ্জ দিয়ে ভাগীরথী পেরিয়ে মুর্শিদাবাদে ঢুকে পড়েন। তিনি তার বাড়িতে গিয়ে ভাই মীর শরীফকে তার সঙ্গে নেন, কিন্তু স্ত্রী-সন্তানকে নেওয়ার সময় হাজী আহমাদ, আতাউল্লাহ খান ও আলীবর্দীও এক সেনাপতি আলী জাওয়াদ খানের বাধার মুখে পড়েন। তিনি এরপর দ্রুত জগৎ শেঠ ফতেহচাঁদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নগদ তিন লক্ষ রুপি ও প্রচুর পরিমাণে অন্যান্য সম্পদ লুট করেন। শহরের অন্যান্য এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে সারফারাজ খানের জামাতা মুরাদ আলী খান, দুর্লভ রাম ও  বাজুতারাহ (পাচোত্রা) সাইর  কর-তত্ত্বাবধায়ক মীর শুজাউদ্দিনকে বন্দী করে মারাঠা বাহিনী ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে ট্রিটকোনায় শিবির স্থাপন করে পরদিন আবারও মুর্শিদাবাদে তাণ্ডব চালানোর উদ্দেশ্যে।

মুর্শিদাবাদ শহরে আতঙ্ক

মুর্শিদাবাদ শহরের অধিবাসীরা দুর্ভাগ্যের রাত কাটায় গভীর হতাশায়। সুদের কারবারি ও অন্যান্যরা পরিবার নিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ভগবানগোলা মালদার মতো এলাকায় পালিয়ে যায়। মারাঠারা  তাদের ঘোড়া ও গবাদি পশুদের তুঁতগাছ খাওয়ায়, ফলে রেশম উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় । মে মাসের ৬ তারিখে ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজরা তাদের কুঠি ছেড়ে চলে যায় আর কাটোয়ায় নবাবের বিজয়ের আগে পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি।

কাটোয়া থেকে আলীবর্দীর মুর্শিদাবাদ যাত্রা ও মারাঠাদের পিছু হটা

মারাঠাদের গতিবিধির খবর পেয়ে আলীবর্দী কাটোয়া থেকে একটানে দ্রুত চলে, দিন-রাত সমান তালে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, ৭ মে ভোরবেলায় মুর্শিদাবাদ শহরে পৌঁছান। মীর হাবিব ও তার দল কাটোয়ার দিকে যেতে থাকে, আর পথে যত গ্রাম পড়ে সব লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করে।

পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকায় মীর হাবিবের মারাঠা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা

বাংলার অতিবৃষ্টি এড়াতে কাটোয়া থেকেই মারাঠারা তাদের ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা যখন বীরভূমের সীমান্তে, মীর হাবিব তখন তাদের পথরোধ করেন। তাদের কাপুরুষের মতো ঘরে ফেরার নিন্দা করেন আর বাংলায় প্রচুর লুটপাটের সুযোগের কথা বলে প্রলুব্ধ করে তাদের কাটোয়ায় ফিরিয়ে আনেন। তারা কাটোয়া, দাঁইহাট ও বোসিংবেরাকে তাদের অধীনে নিয়ে আসে আর মীর হাবিব পশ্চিমবাংলার অন্য এলাকায় মারাঠা-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি জমিদারদের সঙ্গে সমঝোতা করতে থাকেন আর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের ও অন্যান্য লোকেদের থেকে কর ও ভাড়া আদায় করতে থাকেন তার প্রতিনিধির মাধ্যমে।

মারাঠাদের হুগলি দুর্গ জয়

মীর হাবিব এরপর প্রাচুর্যময় শহর হুগলি দখলের সিদ্ধান্ত নেন, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি তার কৈশোর সেখানে কাটিয়েছিলেন আর সেখানের নাগরিকদের মধ্যে অনেকেই তার আত্মীয় ও বন্ধু ছিলেন। তিনি কয়েকজনের সঙ্গে মিলে হুগলি দুর্গ দখলের ষড়যন্ত্র শুরু করেন, যার মধ্যে দুজন ধনাঢ্য বণিক মীর আবুল হাসান ও মীর আবুল কাশিম ছিলেন হুগলির প্রশাসক ও আলীবর্দীর সত্তাই মুহাম্মাদ ইয়ার খানের ঘনিষ্ঠ। নবাবের ফৌজদার মুহাম্মাদ রাজা খান লাম্পট্যের কারণে দুঃখজনকভাবে দুর্গের নিরাপত্তায় অবহেলা করতেন, রাত কাটাতেন মদ আর নর্তকীদের সান্নিধ্যে। এটা ষড়যন্ত্রকারীদের সুযোগ করে দেয়। নির্ধারিত এক রাতে মীর হাবিব সিস রাওয়ের নেতৃত্বে দুহাজার মারাঠা দুর্গের দরজায় চলে আসেন, যখন মুহাম্মাদ রাজা খান  হৈচৈপূর্ণ পানভোজনের উৎসবে আর সুন্দরী নারীদের নৃত্যকলায় পুরো ডুবে ছিলেন । তার বিশ্বস্ত মীর আবুল হাসান তখন তাকে গিয়ে জানান যে  মীর হাবিব একা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন আর দুর্গ-তোরণে দাঁড়িয়ে আছেন । মদের প্রভাবে মুহাম্মাদ রাজা দরজা খুলে দিতে বলেন ও মীর হাবিবকে প্রবেশের অনুমতি দেন। মারাঠারা তখন দ্রুত দুর্গে ঢুকে দখল নিয়ে নেয় আর নবাবের কর্মকর্তাদের শেকল-বন্দী করেন। হুগলির অনেক অধিবাসীই রাতের আঁধারে চিনসুরা ও তার আশেপাশের এলাকায় পালিয়ে যায়, আর কেউ কেউ সরাসরি ওলন্দাজ আর ফরাসিদের শরণ নেয়।

হুগলির প্রশাসক সিস রাও

পরদিন সকালে সিস রাও হুগলির মারাঠা-প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। দয়ালু ও নম্র হওয়ার কারণে তিনি কিছু নাগরিকের সাধুবাদ পান, যাদের তিনি শান্তি ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তিনি কাজী ও মুস্তাজিবদের নিয়োগ দেন ও মীর আবুল হাসানকে ফৌজদার নিযুক্ত করেন আর জমিদারদের রাজস্ব আদায় করা শুরু করতে বলেন। এভাবে কাটোয়া বাংলায় মারাঠাদের প্রধানকেন্দ্র হয়ে ওঠে আর মীর হাবিব তাদের প্রধান উপদেষ্টা হন। পশ্চিমবাংলার কিছু জমিদার তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে মীর হাবিবকে বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়ার বিনিময়ে তাদের এলাকা মারাঠা তাণ্ডবের হাত থেকে রক্ষা করেন।

হুগলি নদী পেরিয়েও মারাঠাদের উদ্যোগ

মারাঠাদের গতিবিধি কলকাতার ইংরেজদের জন্য চরম উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে ওঠে। কলকাতার কাউন্সিল নিজেদের  এই সমস্যার (মারাঠা আক্রমণের জন্য তৈরি) সময়ে পণ্য পরিবহনের সময় উভয়পক্ষকেই সেগুলোকে পথ দেখাতে। কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের কাছে ১৭৪২ সালের ৩১ জুলাই লেখা হয়েছে :  মারাঠাদের আগমনী বার্তা শুনে ফোর্ট উইলিয়ামে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শক্তিশালী একটি দল (ক্যাপ্টেন হলকোম্বের অধীনে) কাশিমবাজারে পাঠানো হয় ও দুর্গ পরিকল্পনার জন্য পাটনার ফরিয়েস্টি নামের এক প্রকৌশলীকে খুঁজতে পাঠানো হয়। অধীনস্থ কুঠিগুলোকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে বলা হয়, কাশিমবাজারে কিছু ঘাঁটিও তৈরি করা হয় । মারাঠা বাহিনী হুগলি নদী পেরিয়ে আসার চেষ্টাও চালায়, আর তাদের একটি দল টানা দুর্গ পর্যন্তও উঠে আসে। কিন্তু তারা এরপর আর এগোতে পারেনি কলকাতার কাউন্সিলের সময়োচিত ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে। সুলুকসহ (সুলুক= এক মাস্তুলের ইউরোপীয় বড় নৌকো; বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ, পর্ব ৪-এ প্রকাশিত মহারাষ্ট্রপুরাণের টীকায় বলা হয়েছে,  সুলুফ- সুলুক—একপ্রকার বাণিজ্য-দ্রব্যবাহী দূরগামী বৃহৎ নৌকা। ১৯শ শতাব্দীর প্রথম ভাগেও এই সুলুক নৌকা কলিকাতা, হুগলী, হিজলী, প্রভৃতি বন্দর হইতে মাদ্রাজ, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত করিত ।— অনুবাদক) কোম্পানির জাহাজ টাইগ্রিস  পেরিন স গার্ডেনের রক্ষক হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন মারাঠারা হুগলি নদী পেরোতে না পারে ।

মীর হাবিব সুন্দরবন হয়ে ঢাকা আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আলীবর্দী সেটাকে বানচাল করে দেন দ্রুত হোসেন কুলি খানকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করতে ঢাকায় ফেরত পাঠিয়ে।  ইংরেজরাও সেখানে তাদের কুঠি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কলকাতার কাউন্সিল কোর্ট অফ ডিরেক্টরসে ১৭৪৩ সালের ৮ জানুয়ারি লিখে পাঠায় :  ঢাকায় প্রায়ই মারাঠাদের আগমনের শঙ্কা রয়েছে, তাদের যা রসদ প্রয়োজন সরবরাহ করা হয়েছে কিন্তু তাদের জনবল পাঠানো সম্ভব হয়নি ।

মারাঠা তাণ্ডব ও পশ্চিমবাংলা ও উড়িষ্যায় অধিকার

১৭৪২ সালের বর্ষা মৌসুমে সক্রিয় লড়াইয়ের অবসান হলে মারাঠা বাহিনী চমৎকার সুযোগ পেয়ে যায় বর্ধমান, মেদিনীপুর আর উড়িষ্যার বালেশ্বর পর্যন্ত তাদের লুটপাট অব্যাহত রাখার। গঙ্গারাম বর্ধমান, নদীয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নাম উল্লেখ করেছেন, যেসব এলাকায় মারাঠা বাহিনী ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিল। তার মতে, মারাঠা বাহিনী প্রথমে লুট করে পুড়িয়ে দেওয়া চন্দ্রকোণা, মেদিনীপুর, দিগনগর, খিরপাই, নিমগাছি, সেদা, সিমলিয়া, চান্দিপুর, শ্যামপুর, আনাইলা, বর্ধমান শহর ও তার আশেপাশের গ্রাম আর এরপর অগ্রসর হয় কাঠারা, সরাই, দামদভাই, জাদুপুর, ভাতচালা, মির্জাপুর, চন্দ্র, পলাশী, বৈঁচি, বেদ, সমুদ্রগাড়া, জাননগর, নদীয়া, কাদাই, বৈঠান, চাদাইলা, সিঙ্গি, ভাস্কা, গোধানাস, মাস্তাইলা, গতপাড়া, জুগুদিয়া, পাতালি, আতাইহাট, পাতাইহাট, দাঁইহাট, বেরা বোসিং (বোসিবেরা) ও ভিকিহাটে। এরপর কাগ্রাম ও মৌগ্রামে ওলন্দাজ কুঠি লুট করার পর তারা কান্তি পৌঁছায়। কান্ডি থেকে তারা বীরভূমে ফিরে আসার সময় জেলার বেশিরভাগ এলাকায় লুটপাট চালায় আর কিছু সময়ের জন্য আমদাহারা ও মহেশপুরে বিশ্রাম নেয়। এরপর মারাঠা বাহিনী বনবিষ্ণুপুরে যায়, কিন্তু সেখানকার স্থানীয় বাহিনীর গোলাবারুদের প্রবল প্রতিরোধ আর বিরূপ ভাগ্যের কারণে তারা সেখানে কোনো তাণ্ডবলীলা চালাতে পারেনি পরদিন তারা বাবলার প্রবাহ পেরিয়ে মঙ্গনপাড়া, সাতুই, ও কামনগরে পৌঁছায় আর সেখান থেকে তারা দ্রুত মাহাটা, কড়িগাছা, কাঠালিয়া ও আন্ধারমানিকে ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটি হয়ে আর দহপাড়ায় পৌঁছায় গোয়ালজান, বুধনিপাড়া ও নিশিপাড়া হয়ে। দু-তিন মাসে উড়িষ্যা, মেদিনীপুর, বর্ধমান, রাজশাহী জমিদারির একটা অংশ, বীরভূম ও রাজমহল–এককথায় পুরো পশ্চিমবাংলা আর উড়িষ্যার কিছু অংশ মারাঠা অধিকারে চলে যায়; কেবল মুর্শিদাবাদ শহর আর উত্তর ও পূর্ব বাংলায় আলীবর্দীর কর্তৃত্ব বজায় থাকে।

মারাঠা তাণ্ডবে জর্জরিত এলাকার মানুষের দুর্দশা

তাণ্ডব চালানো এলাকাগুলোর মানুষের অবস্থা ভয়াবহ ও শোচনীয় ছিল মারাঠাদের খেয়ালি হিংস্রতার কারণে। গঙ্গারাম বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন মানুষের দুর্দশার  বইসহ ব্রাহ্মণ আর পণ্ডিতেরা,  সোনার বেনিয়ারা (স্বর্ণকার) দাঁড়িপাল্লা নিয়ে,  গন্ধ-বণিকেরা (মুদি, কবিরাজ ও সুগন্ধি-কারবারি) ও  কাঁসারিরা (ঘণ্টা – ধাতুর কারিগর) দোকান বন্ধ করে, কামার ও কুমারেরা তাদের সরঞ্জাম নিয়ে, জেলেরা দড়ি আর জাল নিয়ে, আর  শঙ্খ-বণিকেরা (শাঁখার ব্যবসায়ী) তাদের জিনিস নিয়ে পালিয়ে যায়। কায়স্থ আর বৈদ্যরাও একই পথ অনুসরণ করে। ভদ্র মহিলারা, যারা কখনোই মানুষের সামনে হাঁটাচলা করত না, তারাও মাথায় পোটলা নিয়ে বেরিয়ে আসে। ক্ষেত্রিরা (ক্ষত্রিয়) ও রাজপুতেরা তরবারি ফেলে পালিয়ে যায় আর কৈবর্ত ও কৃষিজীবীরাও লাঙল আর ধানবীজ গরুর পিঠে ফেলে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। শেখ, সৈয়দ, মুঘল ও পাঠানরা তাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়; আর গর্ভবতী নারীরা, যারা বেশিদূর হাঁটতে পারেনি, পথেই বাচ্চা প্রসব করে গরীবেরা তাদের একমাত্র পোশাক নিয়ে, বৃদ্ধরা হাঁটার লাঠি নিয়ে আর ছানি ও ধনুকেরাও তাদের ছাগল নিয়ে পথে বেরিয়ে আসে… হঠাৎ বর্গিরা পালিয়ে যেতে থাকা মানুষগুলোকে একটা মাঠে ঘিরে ফেলে আর সবকিছু বাদ দিয়ে কেবল তাদের সঙ্গে থাকা সোনা আর রুপা লুট করে। তারা কিছু মানুষের হাত বা নাক বা কান কেটে দেওয়া আবার কিছু মানুষকে হত্যাও করে। এমনকি তারা সুন্দরী মহিলাদের ধর্ষণ করে, গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা বারবার মানুষের থেকে অর্থ দাবি করতে থাকে, যারা তাদের অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি তাদের কিছু মানুষের নাক দিয়ে পানি প্রবেশ করানো হয়, বাকিদের দীঘির পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়, কিছু মানুষ সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় । বর্ধমানের রাজার সভা-পণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, সালিমুল্লাহ ও গোলাম হোসেন সালিম- তিন সমসাময়িক লেখক গঙ্গারামের বর্ণনারই প্রতিধ্বনি করেছেন তাদের লেখায়। গোলাম হোসেন সালিম লিখেছেন :  দস্যু মারাঠারা বহু লোকের হাত, কান, নাক কেটে তাদের মুখে মাটির ঝোলা বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়। তাদের অস্থায়ী শাসনে বহুসংখ্যক লোক নিহত ও দগ্ধ হল। এভাবে অনেক পরিবার উজাড় হল, তাদের মান-সম্মানও হারিয়ে গেল ।

হলওয়েলও মারাঠা আক্রমণের একই ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন :  তারা একটি দলকে বাখ্শ্ বন্দরে প্রেরণ করে, যেখানে তারা আক্রমণ, দখল ও লুট করে; সব জায়গায় কুকর্ম করে বেড়াতে থাকে অভিশাপযোগ্য নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যা প্রতিশোধ নেওয়ার বা অমানবিকতার চূড়ান্ত, সবধরনের সম্পদ লুকিয়ে রাখার সন্দেহে অধিবাসীদের কান, নাক, হাত কেটে ফেলা, মাঝেমধ্যে তাদের বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে যেত একই সন্দেহে মহিলাদের স্তন কেটে ফেলার ভেতর দিয়েও, লিঙ্গ বা বয়স কোনোটাই তাদের বর্বরতার থেকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল ।

বহু মানুষের পূর্ব ও উত্তর বাংলায় পলায়ন

পশ্চিমবাংলার কিছু মানুষ তাদের সম্মান ও সম্পদ বাঁচাতে পূর্ব ও উত্তর বাংলায় (ঢাকা, মালদা ও রামপুর-বোয়ালিয়া) পালিয়ে যায়, ও পরে সেখানেই স্থায়ী হয়। এমনকি শাহামাত জং গঙ্গা পেরিয়ে গোদাগাড়ি (বর্তমানে রাজশাহীতে) চলে আসেন নিজের ও নবাবের পরিবার ও দুই পরিবারের কিছু আসবাবপত্র ও মালামাল নিয়ে। সেখানে স্বল্প সময় কাটানোর পর, যেটাকে পরে ভাগনগর বলা হত, মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন পরিবারের কিছু প্রিয় নারীদের ও আলীবর্দীর মালামাল সঙ্গে করে। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কিছুদিনের জন্য নদীয়া ত্যাগ করেন ও ১২ মাইল দূরে ইছামতী নদীর তীরে অবস্থান করেন ও বর্ধমানের রাজা তিলকচন্দ্র রায়ার মা বর্ধমান থেকে মূলাজোড় পালিয়ে যান, যেটা তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের থেকে ইজারা নিয়েছিলেন। অনেকে কলকাতা গিয়ে ইংরেজদের আশ্রয় নেয়, যারা নবাবের অনুমতিতে তাদের এলাকার চারদিকে পরিখা খনন করেছিল। এই পরিখা পরে  মারাঠা ডিচ  নামে পরিচিত হয়।

বর্ষাকালে আলীবর্দীর প্রস্তুতি

বর্ষাকালে আলীবর্দী, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মারাঠাদের বিরুদ্ধে সবধরনের সক্রিয় সামরিক কর্মকাণ্ড স্থগিত রাখেন তার ক্লান্ত বাহিনী নিয়ে। ২ তিনি মুর্শিদাবাদ শহরের কাছে আমানিগঞ্জ ও তারকপুরে শিবির স্থাপন করেন, আর মনোযোগ দেন তার সামরিক শক্তি বাড়ানোর দিকে যেন বর্ষার পর মারাঠাদের বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। তার গোলন্দাজ বাহিনীকে নতুন করে সাজানো হয়, কিছু যুদ্ধ-হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার হাতির সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার, ঢাকা, মালদা আর রাজমহল থেকে রণতরী নিয়ে জাহাজবহর তৈরি করা হয়, আর দশ লক্ষ রুপি দেওয়া হয় সৈন্যদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তিনি দিল্লিতে সম্রাটের কাছে ও পাটনা ও পূর্ণিয়ায় তার সহকারীদেরও মারাঠাদের বিরুদ্ধে সাহায্যের আবেদন জানান।

নবাবের মারাঠা অভিযানে পাটনা থেকে জৈনুদ্দিন ও পূর্ণিয়া থেকে সাইফ খানের আগমন

জৈনুদ্দিন যখন তার চাচার চিঠি পান তখন তার অবস্থাও সুবিধার ছিল না, কারণ তার সৈন্যরা ভোজপুরের জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযানশেষে মাত্রই ফিরে এসেছিল আর তাদের পাওনাও পুরো মেটানো হয়নি। কিন্তু হিদায়াত আলী খান তার অনুপস্থিতিতে সৈন্যদের সমস্ত বকেয়া পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন আর পাটনার সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেন, তখন জৈনুদ্দিন লেখক গোলাম হোসেনের চাচা মাহদি নিসার খান ও মায়ের চাচা আবদুল আলী খানকে নিয়ে ৫০০০ অশ্বারোহী ও ছয় থেকে সাত হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। সাইফ খানও পূর্ণিয়া থেকে পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে যোগ দেন।

মুর্শিদাবাদে পা রেখেই বর্ষা শেষ হওয়ার আগে জৈনুদ্দিন মারাঠাদের উপর আক্রমণের জন্য উতলা হয়ে ওঠেন, আর নবাবের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তার মতামত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এরপর নবাব তার দুই ভাতিজা, আত্মীয় আবদুল আলী খান ও কার্যকর আর সুসংহত বাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদ উপকণ্ঠ ত্যাগ করেন, তখনও মাটি কর্দমাক্ত আর কিছু ভূমি পানির তলে ছিল। এই সময়ে ভাস্কর দাঁইহাটে (কাটোয়ার পাঁচ মাইল দূরে) দুর্গোৎসব পালন করছিলেন, পশ্চিমবাংলার কিছু জমিদারদের থেকে চাঁদা নিয়ে। নবাব পূজার তৃতীয় দিন ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৭৪২ সালে আকস্মিক হামলা চালান। মারাঠারা তখন কাটোয়ার দিকে পালিয়ে যায় তাদের তল্পিতল্পার অনেকখানি ফেলে।

ভাগীরথীর পূর্বতীরে কাটোয়ার কাছে নবাব

কয়েকদিনের যাত্রার পর নবাব কাটোয়ার কাছে, ভাগীরথীর পূর্বতীরে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে উপস্থিত হন। সেখান থেকে একটি ছোট নদী—অজয় পশ্চিমদিক থেকে এসে ভাগীরথীতে মিশেছে। মারাঠা বাহিনীর মূল অংশ অজয়ের দিকে মুখ করে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে শিবির স্থাপন করেছিল ও গোলাবারুদসহ একটি ছোট এক মাস্তুলের জাহাজ প্রস্তুত ছিল ভাগীরথীতে, কাটোয়ার দিকে। তারা সবাই সতর্ক ছিল, ফলে নবাব তাদের শক্ত অবস্থান থেকে নড়াতে পারেননি যদিও তিনি ভাগীরথীর উল্টোদিক থেকে আটদিন ধরে গোলা নিক্ষেপ করে যান। কিন্তু মারাঠা বাহিনীর পশ্চিম অংশ তেমন সুরক্ষিত ছিল না, আর তাই নবাব গোপনে ভাগীরথী আর অজয় পেরিয়ে সেই অংশে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন।

নৌকার সেতুতে নবাবের বাহিনীর ভাগীরথী ও অজয় পার হওয়া

কাটোয়ার কয়েক মাইল উপরে ভাগীরথীর দুই তীরেই মারাঠা-অধিকার ছিল না। এর ফলে নবাব উদ্ধরণপুরে ভাগীরথীর উপরে নৌকা দিয়ে একটি অস্থায়ী সেতু তৈরি করতে সক্ষম হন, আর তার বাহিনী নিয়ে অজয়ের উত্তরতীরে চলে যান। এরপর ভাগীরথীতে একসঙ্গে একটা-দুটো করে নৌকাগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, যা অজয় নদের মুখে মারাঠা শিবিরের এক মাইল উপরে গিয়ে পৌঁছায়। নবাব এগুলোকে ব্যবহার করেন অজয়ের উপর সেতু বানিয়ে সকাল হওয়ার আগেই এই প্রবাহ মারাঠাদের অগোচরে নীরবে পার হওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু নবাবের বাহিনী যখন পার হচ্ছিল তখন মাঝের একটি বা দুটি নৌকা সরে গিয়ে প্রায় ১৫০০ সৈন্যের মৃত্যুর কারণ হয়। সেতু জলদিই মেরামত করা হয়, আর পূর্ব আকাশে ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই বাংলার ৩০০০ সৈন্য অজয়ের দক্ষিণ তীরে পৌঁছে যায়। জলদি এগিয়ে গিয়ে তারা আকস্মিকভাবে মারাঠা সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মারাঠারা তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে পালিয়ে যায় প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা যাচাই বা প্রতিহত না করেই। বাংলার সৈন্যরা তাদের প্রবলভাবে তাড়া করে অনেককেই হত্যা করে। সকালবেলায় নবাব হাতি, কামান, আর সৈন্য পাঠান অজয়ের অন্য পাড় দিয়ে, আর জলদিই নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। তিনি মারাঠাদের তাড়া করেন কাটোয়া থেকে চার মাইল দূর পর্যন্ত  আর তাদের ফেলে যাওয়া শিবিরে ফিরে আসেন, তার সেনাবাহিনীকে ক্ষণিক বিশ্রাম দিতে।

পাচেত, বাঁকুরা, মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা হয়ে মারাঠাদের পিছু হটা

ভাস্কর পাচেতে পালিয়ে যান আর বর্ধমান, হুগলি, হিজলি ও অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে থাকা তার দলের অন্যরাও পালাতে থাকে। কলকাতার কাউন্সিল, কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে ১৭৪২ সালের ৩০ অক্টোবরে পাঠানো চিঠিতে জানায় (অনুচ্ছেদ ৬) :  নবাব তার রাজধানীর কাছে পাটনা ও অন্য এলাকা থেকে আসা সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুটুয়ার (কাটোয়া) দিকে এগিয়ে যান, মারাট্টোরা (মারাঠা ) পেছাতে থাকে যুদ্ধের আগে পর্যন্ত, নবাব বিজয়ী হন আর তাদের পুঞ্চাত (পাচেত) পর্যন্ত বিতাড়িত করেন কিন্তু কোনওপক্ষেরই তেমন ক্ষতি হয়নি। এরপর তারা রামগুরে (রামগড়) চলে যায়, হুগলি ও টানায় থাকা তাদের দল এলাকা ত্যাগ করেছিল।  বাংলার বাহিনী মারাঠাদের আর বেশিদূর ধাওয়া করতে পারেনি পাচেতের ঘন অরণ্যের কারণে। ১২ মীর হাবিবের নির্দেশনামতো ভাস্কর পাচেত ছেড়ে দিক পরিবর্তন করে বিষ্ণুপুরে (বাঁকুড়া জেলায়) চলে যান, আর সেখান থেকে চন্দ্রকোণার দিকে এগোতে থাকলে মেদিনীপুরে পৌঁছান, যেখানে তিনি নারায়ণগড়ে শিবির স্থাপন করেন আর  রাধানগর ও অন্যান্য শহর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেন ।

মারাঠাদের চিল্কা হ্রদের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া

ভাস্কর একটি দল উড়িষ্যায়ও পাঠিয়েছিলেন, যেখানে আলীবর্দীর সহকারী প্রশাসক শেখ মাসুম সাহসিকতার সঙ্গে তাদের মোকাবেলা করেন কিন্তু জয়পুরে পরাজিত ও নিহত হন। এভাবে উড়িষ্যা মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার উপক্রম হয়। কিন্তু আলীবর্দীর ত্বরিত ব্যবস্থা তা প্রতিহত করে। শেখ মাসুমের করুণ পরিণতি শুনে তিনি পাচেত ছেড়ে বর্ধমান হয়ে মেদিনীপুর আসেন। ভাস্কর এরপর বালেশ্বরে চলে যান কিন্তু জলদিই ফিরে আসেন ও মেদিনীপুর থেকে চার মাইল দূরের এক জায়গায় নবাবের মুখোমুখি হন, যাতে তিনি পরাজিত হন ও প্রচুর সৈন্য হারান। এটা মারাঠাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে, আর তারা পালিয়ে যেতে থাকে আর নবাবের বাহিনী তাদের তাড়া করে চিল্কা হ্রদের অন্যপারে পাঠিয়ে দেয় ১৭৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে।

আলীবর্দী কটকেই দুমাস অবস্থান করেন, উড়িষ্যায় তার কর্তৃত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি মুস্তাফা খানের চাচা আবুল নবী খানকে সহকারী প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন আর তার পেশকার হিসেবে জানকিরামের ছেলে দুর্লভরামকে নিযুক্ত করেন, আর মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন ১৭৪৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে। ১৬২ ফিরে এসে তিনি তার সৈন্যদের ভেতর ৩০ লক্ষ টাকা বিতরণ করেন পুরস্কার হিসেবে, দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তার পাশে থাকার জন্য। মারাঠাদের বিরুদ্ধে আলীবর্দীর বিজয়ের খবর দিল্লি দরবারে পৌঁছালে সম্রাট তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠির সঙ্গে হুসাম-উল-মুলক (রাজ্যের তরবারি) উপাধি দেন ও একটি ছোরা, মূল্যবান রত্ন- পাথরের নেকলেস, সম্মানের পোশাক পাঠান। এহতেশাম-উদ-দৌলা, মাহাম- উদ-দৌলা, এহতেরাম-উদ-দৌলা ও একরাম-উদ-দৌলা উপাধিগুলো দেওয়া হয় যথাক্রমে শাহামাত জং, সাওলাত জং, হাইবাত জং ও আতাউল্লাহ খানকে মুস্তাফা খান তিন হাজারি মসনবদারিতে উন্নীত হন।

পাটনায় সাফদার জং

প্রথম মারাঠা-আক্রমণ পরিণতি পায় ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরে ভাস্করের ভয়াবহ পরাজয় আর দাক্ষিণাত্যে কলঙ্কময় প্রস্থানের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এর ভেতরেই বিহারে বন্ধুর পোশাকে আবির্ভাব হয় এক শত্রুর, অপ্রত্যাশিত এলাকা থেকে। নবাব আলীবর্দীর মারাঠাদের বিরুদ্ধে সাহায্যের আবেদনে, সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ আওধের সুবাহদার সাফদার জংকে আদেশ দেন বিহার রক্ষা করার, আর প্রয়োজনে বাংলায়ও যাওয়ার। সাফদার জং ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে ফায়জাবাদ থেকে বের হন ১০ হাজার হিন্দুস্তানি সৈনিক, সাত হাজার কিষিলবাশ অশ্বারোহী নিয়ে, যারা নাদির শাহের বাহিনী ছাড়ার পর তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল প্রচুর গোলাবারুদ ও সুসজ্জিত শিবির সঙ্গে করে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি ৪০ হাজার সৈন্য আর বাংলার সুবাহদারির ফরমান নিয়ে এগিয়ে আসছেন। বাংলায় থাকা ইংরেজরা এই গুজব বিশ্বাস করেছিল আর তাদের কলকাতার কাউন্সিল, কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের উদ্দেশ্যে ১৭৪৩ সালের ৮ জানুয়ারি লেখে :  পাটনা থেকে আমরা জেনেছি যে আওধের সুবাহ ( সুবাহদার) ৪০ হাজার ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে আসছেন, শোনা গেছে তার কাছে ফারমান্দ (ফরমান) রয়েছে বাংলার সুবাহদারির । সাফদার জংয়ের বিনীত অনুরোধে আল্লাহাবাদের প্রশাসক আমিন খান তাকে চুনার দুর্গ ব্যবহারের অনুমতি দেন। দুর্গে তার নিজের লোকেদের অধীনে সৈন্য সমাবেশ করার পর তিনি তার পরিবার নিয়ে আড়ম্বর ও আভিজাত্য নিয়ে পাটনার দিকে যাত্রা করেন।

তার এগিয়ে আসা পাটনার অধিবাসীদের মাঝে আতঙ্কের সঞ্চার করে, তারা এর আগেই নাদির শাহের দিল্লি অভিযানের সময় কিষিলবাশ সৈন্যদের অত্যাচারী আচরণের কথা শুনেছে। পাটনার প্রশাসক জৈনুদ্দিন তখন বাংলায় আর তার সহকারী সৈয়দ হিদায়াত আলী খান আশঙ্কায় উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কিন্তু দিল্লির দরবার থেকে আসা প্রতিনিধি মুরিদ খানের মধ্যস্থতায় হিদায়াত আলী খান পাটনার দক্ষিণ-পশ্চিমে ঐতিহাসিক মানের পর্যন্ত এগিয়ে সাফদার জংয়ের জন্য প্রতীক্ষা করেন, যিনি তাকে ভদ্রজনোচিত শিষ্টাচারের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান। ১৭৪৩ সালের ৮ জানুয়ারি কলকাতার কাউন্সিল, কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে লেখে :  … রাজার দুয়ান (দিওয়ান?) পাটনার নায়েবের সঙ্গে তার শিবিরের প্রধান ও কাউন্সিল (পাটনার ইংরেজ কুঠির) নৌকা সরবরাহ করতে বাধ্য হয় তার বাহিনীকে জোনকাহ (?) নদী পার করতে, তার লোকেরা নির্মম আচরণ করে, কোনো আদেশ মানছিল না, বলা হয় তিনি পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলেন মকসুদাবাদের (মুর্শিদাবাদ) নবাবের পাটনার পরিচারকদের বাড়ি লুট করার। কাউন্সিল প্রধান দপ্তরির (পিওন) সংখ্যা বাড়িয়েছিলেন অপদস্থ হওয়া থেকে রক্ষা পেতে।

সাফদার জং পাটনা শহরে হিদায়াত আলী খানের সঙ্গে প্রবেশ করেন ১৭৪২ সালের ৭ ডিসেম্বর আর কিছু দূর ভ্রমণের পর, পাঁচ মাইল পশ্চিমে বাঁকিপুরে শিবির স্থাপন করেন। সেখানে থেকে তিনি বিহারের শাসকের মতোই আচরণ করতে থাকেন। হিদায়াত আলী খানকে পাটনা দুর্গ তার বাহিনীর জন্য খালি করতে বলেন জৈনুদ্দিনের সবকিছু সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে, আর তার পারসিক সেনাদের নিয়োজিত করেন দুর্গের প্রহরায়, আর এভাবে দুর্গে ঢোকা ও বের হওয়ায় বাধা তৈরি করেন। কিন্তু গোলাম হোসেন তার বাবা হিদায়াত আলী খানের নির্দেশনামতো গভীর রাতে জৈনুদ্দিন আহমাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ ও আসবাবপত্র পাশের এক স্থানে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হন, যা পরে হিদায়াত আলী খান তার বাড়ির কাছে আরও সুরক্ষিত জায়গায় স্থানান্তর করেন। পরদিন সাফদার জং জমকালোভাবে শহরে ফিরে আসেন ও দুর্গ তার লোকেদের অধীনস্থ করেন। এরপর পাটনা শহরের বাইরে তার নানা তথা সাদাত খান বুরহান-উল-মুলকের বাবার সমাধি ঘুরে তিনি বাঁকিপুর শিবিরে ফিরে যান। নবাবের সরকারের উঁচুপদে আসীন কর্মকর্তা, মনসবদার, জমিদার, জায়গিরদার এককথায় শহরের সব অভিজাতেরা তাকে অনুসরণ করেন ও নজর উপহার দিয়ে যান। কিন্তু সাফদার জং তাদের শীতল অভ্যর্থনা করেন। তিনি জৈনুদ্দিনের তিন- চারটি হাতি ও সমসংখ্যক কামান দখল করেন হিদায়াত আলী খানের বিরোধিতা সত্ত্বেও। পাটনার ইংরেজ কুঠিও কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, আর ১৭৪৩-এর ৮ জানুয়ারিতে কলকাতার কাউন্সিল কোর্ট অফ ডিরেক্টরসকে চিঠিতে জানায় :  সাফদার জং পাটনায় আসার পর থেকে বাংলার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা (পাটনার কুঠিয়াল) একরকম বন্দীই হয়ে আছে পাটনার কুঠিতে, কোনো পণ্য পাঠাতে পারছে না… ।

এভাবে পাটনায় সাফদার জংয়ের ব্যবহার ছিল বন্ধুত্বের থেকে বেশ দূরে। তিনি নিজেকে  অপ্রিয় অতিথি  করে ফেলেছিলেন, যার প্রস্থানই তার মনোরঞ্জনের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল পাটনার অধিবাসীদের। তার গতিবিধির খবরে আলীবর্দী উড়িষ্যা ছেড়ে মুর্শিদাবাদের দিকে চলে আসতে থাকেন ও তাকে সতর্ক করেন বাংলায় প্রবেশের ব্যাপারে। তিনি সম্রাট মুহাম্মাদ শাহকেও চিঠি লিখে অনুরোধ করেন সাফদার জংকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিতে, কারণ তার মতো লোকের থেকে তিনি সাহায্য আশা করেন না। মুহাম্মাদ শাহ এরপরই সাফদার জংকে চিঠি পাওয়া মাত্র তার দেশে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেন। উড়িষ্যা থেকে আলীবর্দীর ফিরে আসা ও বিহারে আলীবর্দীকে সহায়তা করতে বালাজি রাওয়ের আগমনের সংবাদে সাফদার জং পাটনা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৭৪৩ সালের ১৫ জানুয়ারি মানেরে গঙ্গা পার হন নৌকা দিয়ে সেতু বানিয়ে, আর তার এলাকায় ফিরে যান। এভাবে ১৭৪২-৪৩ সালের আওধের বিপদ কেটে যায় বাংলার উপর থেকে। তবে এটা সাফদার জংয়ের উত্তরসূরী সুজাউদ্দৌলার জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে রয়ে যায় বিহারে প্রভাববলয় তৈরির অভিলাষের। প্রকৃতপক্ষে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে সুজাউদ্দৌলার ভূমিকার কারণ ছিল তার উচ্চাশা ও ব্যক্তিগত আগ্রহ, বাংলার পরাজিত নবাব মীর কাশিমের প্রতি কোনো ধরনের আবেগ থেকে নয়।

দ্বিতীয় মারাঠা আক্রমণ, ১৭৪৩

বাংলার জন্য আরও বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করেছিল। উড়িষ্যা থেকে আলীবর্দী ফেরা মাত্রই রঘুজি ভোঁসলে, ভাস্করের মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা থেকে চৌথ আদায়ের উদ্দেশ্যে এই প্রদেশে ১৭৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রবেশ করে প্রচুর সৈন্য নিয়ে। এর প্রতিশ্রুতি অবশ্য সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ, সাহুকে দিয়েছিলেন; আর সাহু এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন রঘুজিকে। দুর্দান্ত অদূরদর্শী দিল্লি সম্রাট দুর্ভাগ্য-কবলিত বাংলা প্রদেশকে মারাঠা তাণ্ডব থেকে রক্ষার জন্য বাইরের সাহায্য নেন। নিজের রঘুজির বিরোধিতা করার শক্তি না থাকায় তিনি রঘুজির চরম শত্রু পেশওয়া বালাজি রাওকে এই প্রদেশে এসে সহায়তা করার জন্য বলেন। এই সাহায্যের বিনিময়ে সম্রাট তাকে মালওয়ার সরকার ও পাটনার বকেয়া চৌথের একটি অংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

বিহারের ভেতর দিয়ে বালাজির যাত্রা

দক্ষিণ দিক দিয়ে বালাজি রাও বিহারে প্রবেশ করেন প্রায় ৫০ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে। এটা পুরো প্রদেশে ভয়াবহ ভীতির সৃষ্টি করে। তার চলার পথ জুড়ে তিনি হুমকি দিয়ে অধিবাসীদের থেকে অর্থ আদায় করেন আর বিভিন্নভাবে অপদস্থ করেন। গোলাম হোসেন লিখেছেন যে যারা তাকে নগদ অর্থ বা দামি উপহার দিয়েছিল তারা তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে পেরেছিল আর যারা নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছে তাদের বিরোধিতা করে, তাদের হত্যা করা হয় আর ঘরবাড়ি লুট করা হয়। গয়া জেলার দাউদনগরের প্রতিষ্ঠাতা দাউদ খান কুরেশির নাতি আহমাদ খান কুরেশি গাউসপুরের দুর্গ রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা কেবল তার উপর বালাজির সৈন্যদের শাস্তিই টেনে এনেছিল, তারা দুর্গ দখল করে ও তার প্রাণের বিনিময়ে ৫০ হাজার রুপি দিতে বাধ্য করে। দাউদনগর লুট ও ধ্বংস করে দেয়। পাটনার অধিবাসীরা সতর্ক হতে শুরু করে ও চিন্তিত হয়ে পড়ে তাদের জীবন, সম্মান ও সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে। কেউ কেউ তাদের পরিবারকে গঙ্গার উত্তরপাড়ে হাজীপুরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের সৌভাগ্য যে বালাজি পাটনায় যাননি। তিনি টিকারি, গয়া, মনপুর, বিহার, মুঙ্গের হয়ে ভাগলপুরে যান, তার বাহিনী সেসব এলাকার লোকেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার করে। ভাগলপুরের অনেকেই গঙ্গা পেরিয়ে উল্টোদিকে আশ্রয় নেয়। গিরিয়ার যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সারফারাজের সাহসী সেনাপতি গাউস খানের বিধবা স্ত্রী তার বড় পরিবার নিয়ে পালাতে অক্ষম ছিলেন, সাহসিকতার সঙ্গে তার ঘর ও সম্মান রক্ষায় রক্তের শেষবিন্দু পর্যন্ত প্রতিরোধ করার দৃঢ়তা নিয়ে লড়াই করেন। তার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বালাজি তার সম্পদ ও মালামাল স্পর্শ করেননি, আর তার দেহরক্ষীদের একটি দলকে বাড়ি পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন মারাঠাদের পুরোদল এলাকা ত্যাগ করা পর্যন্ত।

বাংলার সমভূমিতে বালাজির অগ্রযাত্রা

আলীবর্দীর বিরোধী কিছু লোক বালাজিকে জানায় যে নবাব তেলিয়াগড়ি গিরিপথে তার বিশ্বস্ত সেনাপতির অধীনে একটি দল আর তিনটি কামান রেখে দিয়েছেন তার অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে, আর সেকারণেই তার পাচেত সড়ক হয়ে বাংলার সমতলে প্রবেশ করা উচিত। তিনি তাদের উপদেশ শোনেননি, বরং পাশের কোলগং (কাহালগাঁও) পাহাড়ের ছোটরাজাদের ডেকে পাঠান আর তাদের ভালো রকমের পুরস্কারের আশ্বাস দেন রাজমহলের পাহাড় হয়ে বাংলায় পৌঁছানোর পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। তাকে সাহায্য করার জন্য রাজি হলেও তারা তাকে পথ দেখাতে সক্ষম হননি, কারণ তারা বাংলা ও বিহারকে আলাদা করা পাহাড় সারিকে ভালোমতো চিনতেন না। অবশেষে সীতারাম রায়, কোলগং পাহাড়ের এক পুরনো রাজপুত অধিবাসী এগিয়ে আসে তার বাহিনীকে  গোপন পথ ধরে বাংলায় নিয়ে যেতে, এক লক্ষ রুপির বিনিময়ে। তিনি পুরো মারাঠা বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান, হলওয়েলের মতে,  প্রথমে দক্ষিণদিকে, তারপর এক বা দুই বিন্দু দক্ষিণে, যতক্ষণ-না কাঙ্ক্ষিত গিরিপথ খুঁজে পান, যা ছিল কোলগং পাহাড় সারির একদম কেন্দ্রে। এই গিরিপথ পাওয়া গেল, যা ছিল তার সংকেত তার বাকি অভিযানের; তিনি তাদের সহজেই চলাচলযোগ্য আর সুবিধা সম্বলিত এই পথ ধরে নিয়ে গেলেন, যতক্ষণ-না এর প্রান্ত কোলগং আর তেলিয়াগড়ির মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে মিশেছে; সেখান থেকে তিনি দক্ষিণে গেলেন যা তেলিয়াগড়ির পাহাড়ের গিরিপথে চলে গিয়েছে; এই গিরিপথও তিনি একইরকম সহজভাবে পেরিয়ে গেলেন; সেখান থেকে দুদিন তেলিয়াগড়ি ও রাজমহল পাহাড়ের মাঝের সমতল ভূমিতে চলার পর তিনি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গেলেন; রাতে তিনি জেনারেলকে (বালাজি) বললেন, তাকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। সকালে তিনি আবারও খানিক দক্ষিণে যান, আর সেদিনই সন্ধ্যায় তারা রাজমহল পাহাড়ের আরেকটি গিরিপথে ঢুকে পড়েন, আর তার গোটা বাহিনী পা রাখে (যদি আমরা এই শব্দটি ব্যবহার করতে পারি), মানুষ বা ঘোড়া কোনোটিই হতাহত না করে, রাজমহলের পশ্চিমের ছোট শহর বেনিয়া গাং-য়ে ১৩ মার্চ, ১৭৪৩ তারিখে। তাদের সেখানে যেতে ছয়দিন লেগেছিল ভাগলপুর থেকে, আর সেই বৃদ্ধলোক তার পুরস্কার নিয়েই ফিরে গিয়েছিল। এরপর বীরভূমের সমভূমি পেরিয়ে আর মুর্শিদাবাদের প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে পেশওয়া মানকারার কাছে শিবির ফেলেন, যা মুর্শিদাবাদ শহরের থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে আর রঘুজি তার শিবির স্থাপন করেছিলেন কাটোয়ায়।

১৭৪৩ সালের ৩১ মার্চে পলাশীতে আলীবর্দী ও বালাজির সম্মিলন

এভাবে দুই মারাঠা বাহিনী বাংলার সমভূমিতে পৌঁছেছিল। পশ্চিমবাংলার সব জায়গায় বিপদের শঙ্কা ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে, আর নবাব আশঙ্কা করছিলেন যে তিনি যেন দুই বাহিনীর মাঝখানে না পড়ে যান। তিনি রঘুজির বিপক্ষে পেশওয়ার সাহায্য নেওয়ার চিন্তা করলেন আর আমানিগঞ্জে তার শিবির থেকে যাত্রা শুরু করলেন তার সঙ্গে দেখা করার। আলীবর্দীর সেনাপতিরা, মুস্তাফা খান, শামশির খান, উমর খান, হায়দার আলী খান, মীর জাফর খান, ফাখরুল্লাহ বেগ খান, রহম খান ও অন্যরা নিজ নিজ পতাকাসহ তাকে সঙ্গ দেন, যেন পেশওয়া বাংলার সেনাবাহিনীর শক্তিমত্তা দেখে মুগ্ধ হন। কয়েকদিনের আলোচনার পর, বাংলার নবাব ও পেশওয়া ১৭৪৩ সালের ৩১ মার্চ পলাশীতে দেখা করেন। নবাব সাহুকে বাংলার জন্য চৌথ দিতে সম্মত হন, ২২ লক্ষ রুপি পেশওয়াকে দেন, পেশওয়াও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রঘুজির সঙ্গে  ঝামেলার নিষ্পত্তির  যেন তিনি আর ভবিষ্যতে বাংলা আক্রমণ না করেন। পেশওয়া কিছু মূল্যবান রত্ন আর হাতিও পেয়েছিলেন উপহার হিসেবে। পেশওয়ার চাপে নবাবকে পুরো অর্থ একসঙ্গে পরিশোধ করতে হয়েছিল, নবাব তাকে তাদের দুজনেরই সাধারণ শত্রু রঘুজির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্য রাজি করানোর আগেই।

রঘুজিকে বাংলা থেকে বিতাড়ন

বাংলা আর পুনাবাহিনীর মিলিত যুদ্ধযাত্রার খবরে রঘুজি তার কাটোয়া ও বর্ধমান শিবির গুটিয়ে বীরভূমে পালিয়ে যান। কিন্তু নবাব ও পেশওয়া পরদিন ভাগীরথী পেরিয়ে তাকে প্রবল ধাওয়া করতে থাকেন। দুই-তিন দিন ধাওয়ার পর পেশওয়া বুঝতে পারেন যে নবাব বা বাংলা বাহিনী রঘুজিকে ধরতে পারবে না তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে তার হালকা মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তাকে অনুসরণ করবেন। নবাব এতে রাজি হন, এরপর পেশওয়া দ্রুত পরদিনই রঘুজির দলের কাছে পৌঁছে যান আর যুদ্ধে পরাজিত করেন, তার সৈন্যদলে প্রচুর হতাহত হয় ও মালপত্রের প্রচুর ক্ষতি হয়, আর তাকে বাধ্য করেন বাংলা ছেড়ে যেতে। মেদিনীপুরে সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করা ভাস্করও নিজের দেশে ফিরে যান উড়িষ্যা হয়ে।` পেশওয়াও সন্তুষ্ট হয়ে পুনায় চলে যান। এভাবে ১৭৪৩ সালের মে মাসের শেষদিকে মারাঠাদের দুই বাহিনী বাংলা ত্যাগ করে।

আলীবর্দীর মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তন

আলীবর্দী মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন, যেখানে কিছুদিনের মধ্যেই তার মা ৯০ বছর বয়সে মারা যান। তার ভাতিজা জৈনুদ্দিন পাটনায় ফিরে যান আর প্রতিরক্ষা প্রাচীর তৈরি করেন শহরের চারদিক দিয়ে অধিবাসীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও। একই সময়ে আলীবর্দীর ঢাকার কর্মকর্তাদের ভেতর ষড়যন্ত্র আর সমস্যা দানা বাঁধতে থাকে। ঢাকায় হোসেন কুলি খানের দিওয়ান বিশিষ্ট রাজস্বাধ্যক্ষ গোকুলচাঁদ তার মনিবের বিরুদ্ধে শাহামাত জংয়ের সামনে অভিযোগ আনেন অর্থ অপব্যবহারের। এর ফলে হুসাইন কুলি তার দফতর হারান, যা ঢাকার ফৌজদার ইয়াসিন খানের উপর বর্তায় আর ইয়াসিন খানের জায়গায় ফৌজদার হন মীর কালান্দার। হুসাইন কুলি সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদ পৌঁছে তার পদ ফিরে পান আলীবর্দীর বড়মেয়ে ও শাহামাত জংয়ের স্ত্রী ঘষেটি বেগমের প্রভাব খাটিয়ে। ইয়াসিন খান এতে অপমানিত বোধ করেন ও নিরিবিলি অবসর জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তিনি তার বন্ধু রাজমহল ও ভাগলপুরের ফৌজদার আতাউল্লাহ খানের অনুরোধে তার সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। হোসেন কুলি ঢাকায় ফিরে আসেন ও ঘষেটি বেগমের অনুগ্রহ নিশ্চিত থাকায় তিনি আরও অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে ওঠেন। তিনি গোকুলচাঁদকে বরখাস্ত করে সেখানে রাজবল্লভকে বসান। তিনি এরপরই মুর্শিদাবাদে চলে আসেন তার পৃষ্ঠপোষিকার সান্নিধ্যে থাকার জন্য আর তার ভাতিজা হুসাইনউদ্দিন খানকে তার সহকারী হিসেবে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন।

ভাস্করের নেতৃত্বে তৃতীয় মারাঠা আক্রমণ, মার্চ ১৭৪৪

নয় মাস পর আবারও মারাঠা-দুর্বৃত্তের আনাগোনা শুরু হয়। ১৭৪৪ সালের মার্চের শুরুতে, রঘুজি দুই সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত ও আলীভাই কারাওয়ালকে 20 হাজার ঘোড়সওয়ারের  নেতৃত্ব দিয়ে উড়িষ্যা ও মেদিনীপুর হয়ে বাংলা আক্রমণ করতে পাঠান। এবারে রঘুজির সামনে পেশওয়ার মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিল না, কারণ ১৭৪৩ সালের ৩১ অগাস্ট সাহু দুই মারাঠাপ্রধানকে সমঝোতায় নিয়ে আসেন, তাদের প্রভাব বলয়ের ব্যাপারে। মালওয়া, আগ্রা, আজমির, আল্লাহাবাদ সুবাহ ও বিহারের (দাউদনগরসহ) টিকারি ও ভোজপুর দুই জমিদারি বার্ষিক ১২ লক্ষ রুপি রাজস্বের বিনিময়ে পেশওয়ার অধীনে চলে যায়, আর বিহারের বাকি অংশ, সুবাহ আওধ ও বাংলা (উড়িষ্যাসহ) রঘুজির অধীনে থাকে।

আলীবর্দীর গভীর সংকট

রাজমহল যাওয়ার পথে আলীবর্দী ভাস্করের অগ্রযাত্রার সংবাদ পান, আর দুদিনের মধ্যে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। মারাঠাদের এমন প্রত্যাবর্তন তাকে চরমভাবে বিস্মিত করে। তার বেশিরভাগ সৈন্য তখন ক্লান্ত, বাংলার প্রচুর সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছে, প্রদেশ ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত, আর ১৭৪৩ সালে পেশওয়াকে ভর্তুকি দেওয়ার কারণে এবং বিশাল সেনাবহরের ভরণপোষণ ও যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যয় মেটাতে সরকারি কোষাগারও প্রায় দেউলিয়া হবার জোগাড়। এর সঙ্গে যোগ হয় নবাবের নিজের শারীরিক অসুস্থতা, যা তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বিভিন্ন দিক চিন্তা করে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন তরবারির খেলায় নয়, কৌশলে মারাঠাদের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেওয়ার।

আলীবর্দীর কৌশলে ভাস্করকে হত্যার পরিকল্পনা

এই বিষয় মাথায় রেখে আলীবর্দী বেশ ক বার শলাপরামর্শ করেন তার সাহসী ও কুশলী সেনাপতি মুস্তাফা খানের সঙ্গে। মুস্তাফা খান ভাস্কর ও তার অনুসারীদের ফাঁদে ফেলে হত্যাযজ্ঞ সম্পাদনের ব্যাপারে তার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, বিহারের সুবাহদারির প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। আলীবর্দী এতে রাজি হন, মুস্তাফা খান গোপনে ফন্দি আঁটতে থাকলেন। তিনি ভাস্করের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন ও তাকে জানান যে তার মনিব শান্তি ও সমঝোতা চান আর তিনি নিজে এটা করতে আগ্রহী। এটা শুনে ভাস্কর তার সামরিক প্রস্তুতি কমিয়ে ফেলেন আর মুস্তাফা খানের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ব্যাপারটাকে সহজ করতে আলীবর্দী তার দিওয়ান জানকিরাম ও মুস্তাফা খানকে কাটোয়ার ৩২ মাইল দক্ষিণ- পশ্চিমে দিগনগরে পাঠিয়ে দেন, আর নিজে মানকারায় চলে আসেন। মুস্তাফা খান ও জানকিরাম ভাস্করের মন জয় করেন তাদের বাগ্মিতা আর পবিত্র প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে, আর তাকে চৌথের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ব্যাপারে তার ও আলীবর্দীর সাক্ষাতের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়ে বলেন। তারপরও কিছু সন্দেহের কারণে ভাস্কর প্রথমে নিজে না-গিয়ে আলীবর্দীর শিবিরে প্রথমে আলীভাই কারাওয়ালকে ২৫ জন অশ্বারোহী দিয়ে মুস্তাফা খানের সঙ্গে পাঠান নবাবকে সম্মান জানানোর ছলে, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। আলীবর্দী, জানকিরাম ও মুস্তাফা খান তাদের সুমিষ্ট, শিল্পিত আর হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য দিয়ে তারও হৃদয় জিতে নেন, আর তার মনেও এই প্রত্যয়ের জন্ম দেন যে এই সাক্ষাতের চাহিদা ও ব্যবহারিক প্রয়োজন রয়েছে। তারপর তাকে মুস্তাফা খান ও জানকিরামের সঙ্গে ভাস্করের কাছে প্রেরণ করা হয়। তারা সবাই ভাস্করকে এমনভাবে উৎসাহ দেন যে তার মন থেকে সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে যায়। যখন মীর হাবিব, ভাস্করকে সতর্ক করেন নবাবের প্রতিনিধিদের কথায়, তখন মুস্তাফা খান ও জানকিরাম দুজনেই তাদের নিজ নিজ ধর্মের পবিত্র বস্তুর নামে শপথ করেন জানকিরাম গঙ্গার পবিত্র জল ও তুলসি পাতা ছুঁয়ে আর মুস্তাফা খান হাতে পবিত্র কুরআন নিয়ে। যখন এই আলাপ-আলোচনা চলছে, তখন আলীবর্দী ভাস্করকে সম্মান দেখাতে বাংলায় উৎপন্ন ও বাইরে থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ফল ও অন্য খাবার পাঠান। ভাস্কর আলীবর্দীর সঙ্গে মানকারায় সালের ৩১ মার্চ দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন।

আলীবর্দীর সতর্কতা

আলীবর্দী ভালোমতোই জানতেন যে তার নিখুঁত পরিকল্পনায় চরম গোপনীয়তা বজায় রাখা প্রয়োজন। তাই তিনি পুরো পরিকল্পনা গোপন রেখেছিলেন, কেবল জানকিরাম, মুস্তাফা খান ও মির্জা বেগ ছাড়া আর কেউই এই ব্যাপারে অবগত ছিল না, বরং তিনি চাইছিলেন সবাইকে এটা বিশ্বাস করাতে যে তিনি সত্যিই শান্তির জন্য উদ্‌গ্রীব। সাক্ষাতের দিন এগিয়ে আসতেই জাঁকালো তাঁবু স্থাপন করা হয় মানকারায়, আর কাপড় দিয়ে সংলগ্ন একটি মাঠ উঁচু করে ঘিরে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট দিন সকালে (৩১ মার্চ) আলীবর্দী তার ভাতিজা সাওলাত জং, আতাউল্লাহ খান ও মীর কাযিম খানকে নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করেন, পিছনে কিছু দূরে তার বাহিনীর একটি ছোট দল রেখে। মীর জাফর খানকে তাঁবুর প্রবেশপথে কিছু সৈন্যসহ দাঁড় করানো হয়; হায়দার আলী খানকে মারাঠাদের আগমনের পথে অপেক্ষা করতে বলা হয়; আর মির্জা দাওয়ার কুলিকে তার থেকে খানিক দূরে কামানসহ অবস্থান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বাছাই করা কিছু সৈন্যকে তাঁবুর দুপাশে আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়। এই ব্যবস্থাগুলো নেওয়ার পর আলীবর্দী তার অভিপ্রায়ের কথা সাওলাত জং, আতাউল্লাহ খান, মীর জাফর খান ও ফাখরুল্লাহ বেগ খানের কাছে খুলে বলেন আর তাদের তাঁবুর ভেতরে পুরো সশস্ত্র হয়ে দুই সারিতে দাঁড়াতে বলেন। কৌতূহলের কারণে প্রচুর মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে সেখানে এসে ভিড় করতে শুরু করে।

মানকারায় ভাস্করের সঙ্গে আলীবর্দীর সাক্ষাৎ

ভাস্কর ৩১ মার্চে মানকারায় আসেন তার ২২ জন সেনাপতি সঙ্গে করে ও আলীভাই কারাওয়াল ১৫ থেকে ২০ হাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে নবাবের তাঁবু থেকে চার মাইল দূরে অবস্থান করেন। মুস্তাফা খান ও জানকিরাম তাকে প্রবেশপথে স্বাগত জানিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করান, কিন্তু জলদিই সেখান থেকে চলে যান জরুরি কাজের বাহানায়। ভাস্কর এরপর নবাবের সামনে যান, তখন তাঁবু খাটানোর লোকেরা তার (নবাবের) সংকেত পেল  প্যাভিলিয়নের পর্দা ফেলে দেওয়ার, সেগুলো তাঁবুর দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধার ও বন্ধু-শত্রু সকলের আসা- যাওয়া বন্ধ করার ।

ভাস্কর ও তার সঙ্গীদের হত্যা

মির্জা হাকিম বেগ ভাস্করকে নবাবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি পরপর তিনবার তার পরিচয় জেনে নিশ্চিত হন, তারপর লুকিয়ে-থাকা সৈন্যদের ভাস্কর ও তার সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দেন। মীর কাযিম খান, বার খোরদার বেগ ও অন্যরা ভাস্কর ও তার সেনাপতিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মীর কাযিম খান ভাস্করকে তরবারির এক কোপে হত্যা করেন, আর তার সেনাপতিদেরও সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করা হয়।

গণহত্যা ও মারাঠাদের বাংলা থেকে বিতাড়ন

মুস্তাফা খান ও উমর খান হিংস্রভাবে নেতৃত্ববিহীন মারাঠা সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন আর তাদের অগণিত সৈন্যদের হত্যা করেন। আলীবর্দী নিজে হাতিতে চড়ে শত্রুদের কাটোয়া পর্যন্ত তাড়া করেন। রঘুজি গায়কোয়াড়, যিনি মুস্তাফা খান ও জানকিরামের শপথের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর শিবিরের দিকে পালিয়ে দশ হাজার সৈন্য ও চটজলদি করে যতটুকু মালপত্র নেওয়া সম্ভব নিয়ে নেন। বর্ধমান, দিগনগর ও মেদিনীপুর ও রাজমহলের মধ্যবর্তী দিকের ভ্রাম্যমাণ অন্য মারাঠা দলগুলোও পালিয়ে যায়। এভাবে  পুরো মারাট্টো (মারাঠা) বাহিনী প্রদেশ ছেড়ে পালায়।

আলীবর্দীর মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন

রাজধানীতে ফিরে আলীবর্দী তার সৈন্যদের দশ লক্ষ টাকা বিতরণ করেন তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। এছাড়াও, তার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি সম্রাট মুস্তাফা খানকে বাবুর জং (রণক্ষেত্রের বাঘ) এবং মীর জাফর খান, ফাখরুল্লাহ বেগ খান, হায়দার আলী খান ও অন্যদের, যারা বীরত্বের শত্রুদের বিরুদ্ধে সঙ্গে লড়াই করেছিল তাদের বাহাদুর উপাধি দেন। তারা আগের থেকে উঁচুপদেও আসীন হন। আলীবর্দী নিজে সুজা-উল-মুল্ক (রাজ্যের বীর) উপাধি গ্রহণ করেন ও বিশেষ সম্মানের খিলাত লাভ করেন। তিনি এবারে তার বাহিনীর সৈন্য কমিয়ে ফেলেন মারাঠাদের হাত থেকে নিস্তার ও আপাত নিরাপত্তা পেয়ে। শাহামাত জং নিজেকে বিলাস-ব্যসনে ডুবিয়ে দিলেন আর প্রচুর অর্থ ব্যয় করে দিল্লি থেকে নর্তকীর দল আনিয়েছিলেন 1 কিন্তু হাজী আহমাদ অসন্তুষ্ট হয়ে পাটনায় তার ছেলে জৈনুদ্দিনের কাছে চলে যান। তার অসন্তোষের কারণ ছিল হুগলির ফৌজদারের পদ, যেটা নিয়ে তিনি লালায়িত ছিলেন; আলীবর্দী সেটা সৈয়দ আহমাদকে দিয়েছিলেন উড়িষ্যা থেকে ফিরে আসার পর। হুগলিতে শুল্ক নিয়ে আলিমানদের (জার্মান) সঙ্গে সৈয়দ আহমাদের বচসা হয়েছিল। এক কর্মকর্তা সুবহান সিং দমনমূলক নীতি গ্রহণ করলে উত্তেজিত জার্মানরা রাতে হুগলি দুর্গ আক্রমণ করে বসে, কিন্তু প্রহরীরা তাদের প্রবলভাবে প্রতিরোধ করে পাল্টা-আক্রমণ করলে সকালবেলায় তারা নৌকায় করে পালিয়ে যায়। সৈয়দ আহমাদ এরপর জার্মান কুঠি দখল করতে শক্তিশালী বাহিনী পাঠান হুসাইন রাজা খান ও সুবহান সিংয়ের অধীনে। কিন্তু অভিজ্ঞতাহীন আর ভুল নিরাপত্তার আশ্বাসে তারা হুগলির কাছে অমিচাদের বাগানে বিশ্রাম নিতে থামে, আর সেখানেই গভীর রাতে জার্মানরা তাদের আক্রমণ করে বসে। শিবিরে দ্বিধা ছড়িয়ে পড়ে আর সবাই পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে আলীবর্দী মীর জাফর খানকে পাঠান হুগলির আলিমানদের শিক্ষা দিতে। মীর জাফর খান কুঠি দখল করেন, আর আলিমানরা তা জলদিই খালি করে দেয়। কিছু মানুষ বিশ্বাস করে যে মীর জাফর খান ১০ হাজার রুপি উৎকোচ নিয়ে তাদের কুঠি ছেড়ে পালাতে দিয়েছিলেন।

চতুর্থ মারাঠা আক্রমণ, ১৭৪৫

ভাস্কর ও তার অনুগামীদের করুণ মৃত্যু প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় বাংলায় আরেকবার আক্রমণের সুযোগ খুঁজতে থাকা রঘুজির মনে।

মুস্তাফা খানের বিদ্রোহে মারাঠাদের সুযোগ

একবছরের মধ্যেই সেই সুযোগ চলে আসে, যখন আলীবর্দীর শীর্ষ আফগান- সেনপাতি মুস্তাফা খান তার পৃষ্ঠপোষকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন ও রঘুজিকে বাংলা আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ১৪ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আর ১৭৪৫ সালের মার্চে উড়িষ্যায় প্রবেশ করেন।

মারাঠাদের কাছে বন্দী দুর্লভরাম

মুস্তাফা খানের বিদ্রোহের পর তার ভাতিজা আবদুল রসুল খান রাজা জানকিরামের ছেলে, উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া দুর্লভরামের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যোগ দেন। নতুন প্রশাসক ছিলেন দুর্বল চিত্তের ও পুরোহিত-চালিত, বাড়াবাড়ি রকমের কুসংস্কারাচ্ছন্ন। মারাঠাদের আকস্মিক আগমনে হতবিহ্বল হয়ে, তিনি প্রথমে নিজেকে বড়বর্তী দুর্গে প্রায় একপক্ষকাল আটকে রাখেন, এরপর বোকার মতো রঘুজির শিবিরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান আর তিনি ও তার সাথীরা সেখানে বন্দী হন।

১৭৪৬ সালে তার মুক্তি

তাকে এরপর নাগপুরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ১৭৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিসাজি বিকাজিকে বলেন পেশওয়াকে বলে যেন তার মুক্তির ব্যবস্থা করেন। ১৭৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বাবা জানকিরাম তার জন্য মুক্তিপণ হিসেবে তিন লক্ষ রুপি পাঠান রঘুজির কাছে।

বড়বতী দুর্গের পতন

একমাস বড়বতী দুর্গ সাহসিকতার সঙ্গে রক্ষা করেছিলেন দুর্লভরামের প্রতিনিধি সামানার সৈয়দ – মীর আবদুল আজিজ। কিন্তু রসদের অভাবে তিনি আত্মসমর্পণ করেন, তবে শর্ত দিয়ে যে তাকে ও তার অনুসারীদের কোনো লোককে আর তাদের সম্মান ও সম্পদকে মারাঠারা স্পর্শ করতে পারবে না ও কাউকে তাদের বাহিনীতে যোগদানের জন্য বাধ্য করা যাবে না।

রঘুজিকে সাময়িকভাবে তুষ্ট করার আলীবর্দীর উদ্যোগ

আলীবর্দী আফগানদের অনুসরণ করে পাটনায় গেলে শাহামাত জং তার সঙ্গে যোগাযোগ করে রঘুজির আগমনের খবর দেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদ ফিরে যান। আফগানরা তখনও প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করছে, আর মুর্শিদাবাদ শহর প্রতিরক্ষার দিক থেকে অরক্ষিত ছিল, তাই তিনি চিন্তা করলেন এটা যে-কোনোভাবে সামলানোর বা অন্য কেউ লম্বা সময়ের জন্য রঘুজির বিরোধিতা করুক, আর এ- কারণে তিনি মুনিম আলী খানকে রঘুজির কাছে পাঠান শান্তির মিথ্যা প্রস্তাবনাসহ। রঘুজি পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন আর তিনকোটি রুপির দাবি জানান। আলীবর্দী আড়াই মাস ধরে আলোচনা চালিয়ে যান সময়ক্ষেপণের জন্য আর ২০ জুন, ১৭৪৫-এ আরা থেকে ১৮ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে জগদীশপুরের কাছে মুস্তাফা খানের হত্যা তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে।

মুস্তাফা খানের মৃত্যুর পর আলীবর্দীর কঠোর মনোভাব

মুস্তাফা খানের মৃত্যু আলীবর্দীকে ব্যাপক অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল, আর রঘুজির প্রতি কঠোর মনোভাব দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। এবার তিনি রঘুজিকে লিখলেন :  একটি চুক্তি সামনে আনা হয়েছে অর্থের সাহায্যে, যার প্রভাব হয় ক্লীবত্বের, নয়তো খানিকটা আশার। প্রথমেই বলে রাখি যে আল্লাহর আশীর্বাদে, আমার যোদ্ধারা যে-কোনো সময়ের থেকে অনেক বেশি লোলুপ হয়ে আছে আপনার সঙ্গে আরেকটি সংঘর্ষের জন্য এবং শিকারীরা শিকারের উপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার থেকেও বেশি উদ্গ্রীব হয়ে আছে। আর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের ব্যাপারে, আপনাকে বলতেই হবে যে তারা আপনার মতো দুর্ভাগা সেনাপতির সঙ্গে কোনোরকম সন্ধির থেকে কোনোরকম ফয়দা আশা করছে না। তাই বিষয় এমন দাঁড়াচ্ছে যে সমঝোতা আপনি আশা করছেন–তা সম্ভব নয়, কেবল যুদ্ধই সম্ভব… ।

বর্ধমান ও বীরভূমে রঘুজি

কিন্তু এই হুমকি রঘুজির এগিয়ে আসা বন্ধ করতে পারেনি। ১৭৪৫ সালের জুন মাসে তিনি বর্ধমান জেলায় পা রাখেন, যা  বিভিন্ন আড়ংয়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে আর ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় । ২০ জুলাই তিনি বীরভূমে প্রবেশ করেন আর সেখান থেকেই কটক, মেদিনীপুর আর হিজলিতে সৈন্যদল পাঠান।

রঘুজির বিহার যাত্রা

এই সময়ে চেইনপুরের কাছের মাগরোর ও সাসারামের পাহাড়ি এলাকায় মুস্তাফা খানের মৃত্যুর পর বিদ্বেষ নিয়ে দিনাতিপাত করা মুস্তাফা খানের ছেলে মুর্তাজা খান, বুলান্দ খান ও অন্যকিছু ক্ষুব্ধ আফগানরা তাদের উদ্ধারের করুণ আবেদন করেন রঘুজির কাছে। তাদের সঙ্গে মৈত্রী তার দল ভারী করবে এই বিবেচনায় রঘুজি বর্ষার শেষে বিহারের দিকে যাত্রা শুরু করেন। উত্তর বীরভূমের জঙ্গল আর খড়গপুরের পাহাড় (মুঙ্গেরের দক্ষিণে) পেরিয়ে তিনি ফতোয়ায় পৌঁছান, সেখানে লুট করে আগুন ধরিয়ে, টিকারি জমিদারির শেখপুরা ও অন্য গ্রামগুলোয় তাণ্ডব চালিয়ে সোন নদী পার হন।

আফগানদের সঙ্গে মৈত্রী

আফগানদের উদ্ধার করে তিনি আবারও নদী পার হন আরওয়াল এলাকা দিয়ে আর পাটনার দিকে এগিয়ে যান। আফগান মৈত্রীর কারণে তার দলের সৈন্যসংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত হয়।

মারাঠাদের অনুসরণ করতে আলীবর্দীর বিহার যাত্রা

আলীবর্দী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে বিহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ১৭৪৫ সালের অক্টোবর মাসে, বাছাই করা ১২ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে মারাঠাদের তার প্রদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে। তার যাত্রার খবর পেয়ে মারাঠারা পাটনা ছেড়ে দক্ষিণে সরে আসে। বাঁকিপুরে কিছুদিনের জন্য শিবির স্থাপন করে নবাব তার ভাতিজা জৈনুদ্দিনের পরিবারের কিছু সমস্যার সমাধান করেন। এরপর তিনি শত্রুদের আক্রমণ করতে তার সম্পূর্ণ তরতাজা বাহিনী আর শক্তিশালী গোলন্দাজ বহর নিয়ে নওবতপুর হয়ে (মিঠাপুর থেকে ১৩ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, পাটনা জংশন রেলওয়ে স্টেশনের জায়গা) বেরিয়ে যান। কিন্তু মারাঠা বাহিনী সম্মুখ সমর এড়িয়ে নিজেদের কামানের গোলার আওতার বাইরে রেখে তার আগে আগে চলতে থাকে, যতক্ষণ-না তার বাহিনী মাহিব আলীপুরের (সোন নদীর পূর্বতীরে, নওবতপুরের ১৯ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে) কাছে রানীদীঘি পর্যন্ত পৌঁছায়, সেখানে রঘুজি তার শিবির স্থাপন করেন। সেখানে বাংলা-বাহিনীর অগ্রগামী সেনাদল রঘুজির উপর অতর্কিতে হামলা চালায় মীর জাফর খান ও শামশির খানের অধীনে। মারাঠা বাহিনীর অন্য অংশ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় তাদের সর্দারকে রক্ষা করার, যারা শেষপর্যন্ত পালিয়ে যায় শামশির খানের অবহেলায়, বা সম্ভবত তার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। এরমধ্যেই আলীবর্দী সেখানে তার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন মারাঠাদের শাস্তি দিতে। কিন্তু রঘুজি সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে যান মাটি আঁকড়ে ধরে, যদিও তিনি হঠাৎ করেই ভাগ্যক্রমে মুখে আঘাত পান, আর মহিমাজি বাবা ও শঙ্করজি বাবা নামে তার দুই সেনাপতি যথাক্রমে ১৪ ও ২০ নভেম্বর মারা যান।

রঘুজির নবাব-বেগমের প্রস্তাবনা খারিজ

মীর জাফর খান ও শামশির খানকে বিশ্বাসঘাতক সন্দেহ করে আলীবর্দী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কিন্তু তার বেগম, যিনি প্রায়ই তাকে কার্যকর উপদেশ দিতেন, এবারও সামনে এগিয়ে আসেন তার চিন্তিত স্বামীর সমস্যা নিরসনে। তিনি নিজ উদ্যোগে তকি আলী খান ও মুজাফ্ফার আলী খানকে শান্তির দূত হিসেবে রঘুজির কাছে পাঠান মীর হাবিবের পরামর্শমতো রঘুজি নবাবের বেগমের কোনো প্রস্তাব মানতে রাজি হননি, আর মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা হন, নবাব সেই শহরে পৌঁছনোর আগেই লুট করার জন্য।

রঘুজি ও আলীবর্দী দুজনেরই মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা; পথে ভাগলপুরে যুদ্ধ

নবাব-বাহিনী সোন নদী পার হয় প্রচুর সমস্যার ভেতর দিয়ে, রসদের প্রচণ্ড অভাব তাদের ভুগিয়েছিল। জৈনুদ্দিনের দুই বিশিষ্ট কর্মকর্তা জাসওয়ান্ত নাগোর ও মীর গোলাম আশরাফ তাদের সঙ্গে যোগ দেন, পথে মারাঠাদের হাতে ধরা পড়ে অনেক ঝামেলা পোহানোর পর। আলীবর্দী বাংলার দিকে ফিরতি পথ ধরেন মানের ও পাটনা হয়ে। পথে রঘুজি পাঁচ থেকে ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে উল্টো ঘুরে আলীবর্দীকে আক্রমণ করেন, ভাগলপুরের কাছে চম্পানগরের এক জলপ্রবাহের কাছে। আলীবর্দী মাত্র ৬০০ সৈন্য নিয়ে পাল্টা-আক্রমণ করে তাদের তাড়িয়ে দেন। এবারে দক্ষতার সঙ্গে তার সঙ্গে লড়াই করেন দোস্ত মুহাম্মাদ খান নামের এক কর্মকর্তা।

মারাঠারা আবারও বাংলায়

আশঙ্কা ছিল যে মূল সড়ক ধরে চললে আলীবর্দীর বাহিনীর সঙ্গে মুর্শিদাবাদে পৌঁছানোর আগেই আরও একটি সংঘর্ষ হবে। রঘুজি ভাগলপুর থেকে সাঁওতাল পরগণা ও বীরভূমের পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মুর্শিদাবাদের কাছে ১৭৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২১ তারিখে এসে উপস্থিত হন ও লুটপাট করেন  মাকসুদাবাদের (মুর্শিদাবাদ) উল্টোদিকের শহরগুলো ও আশেপাশের অনেকগুলো গ্রাম , যেমন ঝাপিদহ ও মীর জাফরের বাগান। মারাঠারা তিন থেকে চারদিন মুর্শিদাবাদের দক্ষিণ ও পশ্চিমের দিকের শহরতলীতে ঘুরে বেড়ায়।

কাটোয়ার কাছে আকস্মিক সংঘর্ষ ও রঘুজির পরাজয়; নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন এবং মীর হাবিব ও অন্যদের বাংলায় রেখে যাওয়া

মূল সড়ক ধরে আলীবর্দী মুর্শিদাবাদ এসে পৌঁছান ২২ ডিসেম্বর। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই রঘুজির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন আর এটা শুনে রঘুজি কাটোয়ার দিকে সরে যান। কাটোয়ার কাছে রানীদিঘীর কাছে আলীবর্দী তাকে ধরে ফেলেন। ঐ সময়েই সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়, যাতে রঘুজি পরাজিত হন ও প্রচুর সৈন্য ও রসদ হারান, আর বাধ্য হন নাগপুরে সরে যেতে। তিনি বাংলায় মীর হাবিবের নেতৃত্বে গোলাম মুর্তাজা খান ও বুলান্দ খানসহ দুই থেকে তিন হাজার অশ্বারোহী ও ছয় থেকে সাত হাজার আফগান সৈন্য রেখে যান, তার অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে। ১৭৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি মারাঠা বাহিনী কাশিমবাজারের ছয় মাইল পশ্চিমে এসে হাজির হয়। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা কলকাতার কাউন্সিলকে ১৭৪৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লেখে যে মারাঠারা  তাদের দিকে তখনও এগিয়ে আসছিল, ফলে গাদি (কাপড়ের) নিরাপত্তার সঙ্গে পাঠানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু মার্চের শুরুতে আতাউল্লাহ খান  বিশাল বাহিনী  নিয়ে মারাঠাদের তাড়াতে এলে, তারা  দ্বীপ (কাশিমবাজার) ত্যাগ করে ।

নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় মারাঠাদের ভ্রাম্যমাণ দল

মারাঠাদের ভ্রাম্যমাণ দল, এরপরও আলাদা হয়ে বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, কটক ও বালেশ্বরে অবস্থান করছিল। কলকাতার কাউন্সিল তাদের ১৭৪৬ সালের ৩০ নভেম্বরের চিঠিতে জানিয়েছে : মারাট্টোদের একটি দল মেদিনীপুরে পুরো সময়জুড়ে রয়েছে মীর হাবিবের নেতৃত্বে, দলের কিছু লোক রয়েছে ইঙ্গিলিতে (হিজলি) ও ডিন স টাউনে (ডায়মন্ড হারবারের কাছে), আর জায়গাগুলোয় পুরো তাদের কর্তৃত্ব ছিল। প্রকৃতপক্ষে পুরো উড়িষ্যার উপর মীর হাবিবের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। কিন্তু আলীবর্দী তড়িঘড়ি করে তার শত্রুদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতে যাননি। বিহারে দুটো কঠিন অভিযানের পর, তিনি মুর্শিদাবাদে কিছু সময় থেকে লণ্ডভণ্ড হওয়া ভূমিতে শান্তি ও প্রাণচাঞ্চল্য, শক্তি ফিরিয়ে আনা আর সৈন্যদের সন্তুষ্টি অর্জনকে প্রয়োজনীয় মনে করলেন। দোস্ত মুহাম্মাদ খান ও মীর কাযিম খান এবারে বিশেষ সুবিধা পেলেন। এই অবকাশে আলীবর্দী জাঁকালোভাবে তার নাতি সিরাজ-উদ-দৌলার বিয়ের অনুষ্ঠান উদযাপন করলেন।

রঘুজির আর্থিক সমস্যার কারণে মীর হাবিবকে উড়িষ্যায় সাহায্যে বিঘ্ন

এই সময়ে আলীবর্দীর শাস্তিমূলক অভিযানের আশঙ্কায় থাকা মীর হাবিব রঘুজির সাহায্য চাইলেন ও তাকে ভর্তুকি হিসেবে ১১ লক্ষ রুপি দিতে চাইলেন। রঘুজি এভাবে আকর্ষিত হয়ে তার ছেলে জানোজির অধীনে কারান্ডে, ভাগ, গায়কোয়াড়সহ আরও কিছু মারাঠা সর্দারদেরসহ বাংলায় সৈন্য পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৭৪৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনি তার বাহিনীও তৈরি করে ফেলেছিলেন এই অভিযানের জন্য, কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা তাকে বাধা দেয় তাদের পাঠাতে

আলীবর্দীর উড়িষ্যা পুনর্দখলের প্রস্তুতি

আলীবর্দী উড়িষ্যা পুনরায় দখলের জন্য আর দেরি করতে চাইলেন না এবারে। তিনি জলদিই তার বাহিনীর বকশি হিসেবে নিয়োজিত মীর জাফর খানকে উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে মীর জাফর খানকে হিজলি ও মেদিনীপুরের ফৌজদারের পদও দেওয়া হয়। তিনি তার মামাত ভাই মীর ইসমাইলকে অস্থায়ীভাবে বকশি পদে বসিয়ে, সুবহান সিংকে তার সহকারী ফৌজদার হিসেবে হিজলিতে পাঠিয়ে, আট হাজার অশ্বারোহী আর ১২ হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে ১৭৪৬ সালের নভেম্বর মাসে মারাঠাদের বিতাড়নের জন্য মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন।

মেদিনীপুরের পাশে মীর জাফরের কাছে সৈয়দ নূরের পরাজয়

মেদিনীপুরে মীর জাফরের আগমনের খবরে মারাঠা ও আফগানদের সমন্বয়ে গঠিত দলটি বালেশ্বরে চলে যায়। কিন্তু তিনি আরেকটু এগিয়ে মীর হাবিবের এক সেনাপতি, সৈয়দ নূরকে মেদিনীপুরের কাছে পরাজিত করেন ১৭৪৬ সালের ১২ ডিসেম্বরের দিকে। বালেশ্বরে কোম্পানির কুঠিপ্রধান কেলসাল কলকাতার কাউন্সিলের কাছে পাঠানো ১৬ ডিসেম্বরের চিঠিতে উল্লেখ করেন যে সৈয়দ নূরকে  তার দুজন প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে হত্যা করা হয় আর মারাঠোরা (মারাঠা) সেই এলাকা থেকে কটকের দিকে পালিয়ে যায় মীর হাবিবের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আশায়, যিনি তার যাত্রাপথে ছিলেন কোনাক্কা (কণিকা) থেকে, যেখানকার রোদজাহ (রাজা) ও তার পরিবারকে তিনি (মীর হাবিব) বন্দী করে রেখেছিলেন। বালাসোরের (বালেশ্বর) ফৌসদার (ফৌজদার) তার জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও পালানোর জন্য প্রস্তত হয়ে ছিলেন, মীর জ্যাফিয়ের (মীর জাফর) ও তার ১৫ হাজার সৈন্যদের আগমন যথাশীঘ্র আশা করা হচ্ছে । তিনি আবার ১৭৪৭ সালের ২৫ জানুয়ারিতে লিখেছেন যে, মীর হাবিব শিবির স্থাপন করেছেন  শহর (বালেশ্বর) থেকে দুই মাইল দূরে আট হাজার ঘোড়ার আরোহী আর পায়েচলা ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি নদীর তীর (বড় বালাং) ধরে গোলন্দাজ বাহিনী আর নৌকায় কামান স্থাপন করছেন নবাবের বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ।

পঞ্চম মারাঠা আক্রমণ; জানোজির যুদ্ধযাত্রা, ১৭৪৭

রঘুজির ছেলে জানোজি এই সময়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে কটকে এসে উপস্থিত হন আর উত্তর দিক থেকে মীর হাবিবকে সাহায্য করার সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যান। এটা মীর জাফর খানের মনে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করে, যদিও তার সঙ্গে ২০ হাজার সৈন্য ছিল। তিনি জলদি মেদিনীপুর থেকে বর্ধমানে পালিয়ে যান, আর তাকে ধাওয়া করে জানোজির বাহিনীর অগ্রগামী দল ও কিছু হাতি ও রসদ হাতিয়েও নেয় তার থেকে। আলীবর্দী কঠোরভাবে তিরস্কার করেন মীর জাফর খানের এমন লজ্জাজনক পালানোর আর বর্ধমানে তার দলকে শক্তিশালী করতে শক্তিশালী বাহিনী পাঠান আতাউল্লাহ খান সাবেত জং ও ফাখরুল্লাহ বেগ খানের অধীনে। তারা জানোজি আর মীর হাবিবের অধীনের মারাঠাদের যৌথবাহিনীর সঙ্গে অনিশ্চিত এক সংঘর্ষে জড়িয়ে যান।

মীর জাফর ও আতাউল্লাহর বিশ্বাসঘাতকতা

মীর জাফর ও আতাউল্লাহ খানের মনে জলদিই এক অশুভ অভিপ্রায় জেগে ওঠে, আর তারা ষড়যন্ত্র শুরু করেন আলীবর্দীকে হত্যা করে বাংলা ও বিহারের সরকার দখলের। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই নবাবের কাছে এই গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায় ও তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়। আতাউল্লাহ খানকে বরখাস্ত করা হয়, মীর জাফর খানকে দেওয়া দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, নুরুল্লাহ বেগ খানকে নবাবের বাহিনীর বকশির দায়িত্ব দেওয়া হয় আর সুবহান সিংকে দেওয়া হয় হিজলির ফৌজদারি।

বর্ধমানের কাছে জানোজির পরাজয় ও মেদিনীপুরে পিছু হটা

মুস্তাফা খান, শামশির খান, সর্দার খান ও অন্য অভিজ্ঞ আফগান সেনাপতিদের দলত্যাগের পর আলীবর্দী যাদের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলেন তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা তাকে আতঙ্কিত করতে পারেনি, যদিও তিনি তখন ৭১ বছর বয়সের বৃদ্ধ। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তার সৈন্যদের নেতৃত্ব দেন বর্ধমান পর্যন্ত আর মারাঠারা পরাজিত হয় প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লড়াইয়ে। মারাঠারা চেষ্টা করেছিল নবাবের অনুপস্থিতিতে হুট করে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হয়ে সেখানে তাণ্ডব চালিয়ে তার মনোযোগ ভিন্নমুখী করে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার। কিন্তু নবাবের বাহিনী ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ধাওয়া করায়, তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি আর বাধ্য হয় মেদিনীপুরে পালিয়ে যেতে। আলীবর্দী এরপর বর্ষার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই রাজধানীতে ফিরে আসেন। ১৭৪৭ সালের পুরো বছর জুড়েই উড়িষ্যা, মেদিনীপুর পর্যন্ত মারাঠা কর্তৃত্বে থাকে।

আলীবর্দীর বিহার যাত্রা, ১৭৪৮

১৭৪৮ সালের শুরুতে বিহারে আফগান বিদ্রোহ তুঙ্গে উঠলে তার ভাই হাজী আহমাদ ও জৈনুদ্দিনের মৃত্যুতে বিদ্রোহীরা পাটনার সাময়িক দখল নিলে, আলীবর্দী ভয়াবহ জটিল সমস্যায় পড়ে যান আর আরেকবার বিহারে যেতে বাধ্য হন। একই সময়ে জানোজির অধীনে মারাঠাদের মূল বাহিনী মেদিনীপুর থেকে বর্ধমানের লোকালয়ের কাছে চলে আসে, আর সেখানে  সারা দেশ থেকে তাদের অনেকগুলো পিছিয়ে পড়া দল এসে জড়ো হয়েছিল । তাদের অনেকেই সুন্দরবন হয়ে ঢাকায় আসার চেষ্টা করেছিল, কেউ কলকাতার কাছে টানা দুর্গ পর্যন্ত এসেছিল, আর বড় একটা দল মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেছিল আর কাশিমবাজারে ইংরেজ- পতাকাবাহী একটি নৌবহর ও তার মালামাল লুট করেছিল।

অমিচাঁদের মধ্যস্থতায় ইংরেজদের লুট হওয়া মাল উদ্ধারের চেষ্টা

ইংরেজ কোম্পানি মারাঠাদের মাধ্যমে  লুট হওয়া মালামালের পুরোটুকু বা আংশিক উদ্ধার  করার চেষ্টা চালায় অমিচাঁদের মধ্যস্থতায়। অমিচাঁদ বোওয়ান সিংকে (?) জানোজির কাছে পাঠান, যিনি উত্তর দেন :  বোওয়ান সিং আমার কাছে এসেছে ও কোম্পানির নৌকায় লুটের খবর জানিয়েছে; আগে থেকে জানা থাকলে আমি অবশ্যই সৈন্যদের মধ্যে কঠোর তদন্ত করতাম। কিন্তু নৌকা লুটের পর সেখান থেকে আনা বন্দীরা কোম্পানির নাম একবারও উল্লেখ করেনি, নয়তো আমি সব জিনিস আনা সেখানেই বন্ধ করে দিতাম। এখন সেগুলো বহু জায়গায়, বহু মানুষের ভেতর বণ্টন করা হয়ে গিয়েছে, যাই হোক, আপনার কথামতো আমি কী উদ্যোগ নিয়েছি সেটা বোওয়ান সিং আপনাকে ব্যাখ্যা করবে। আমি এখন পাটনায় আমার শত্রুদের ধ্বংস করতে যাচ্ছি আর কিছু অন্য কাজও রয়েছে, যেগুলোর জন্য বিলম্ব হতে পারে, তারপরও আমি ভাগলপুর ফিরে, আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব আপনাদের মালামাল ফিরিয়ে দিতে। তখন কলকাতার কাউন্সিল মারাঠাদের মাধ্যমে হওয়া কোম্পানির ক্ষতির প্রতিকার পেতে পুনা কোর্টে আবেদন করে। অনুরোধ মেনে বোম্বের কাউন্সিলের সভাপতি ওয়েক সাহু রাজার কাছে বার্তাবাহক পাঠান এই আবেদন জানিয়ে যে বাংলার কোম্পানির উল্লিখিত লোকসানের বিপরীতে যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, কিন্তু বার্তাবাহক ফিরে আসে  সাহু রাজার থেকে কোনো লিখিত জবাব ছাড়াই , আর  তার ছোটখাটো অজুহাত  ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সমস্ত আশায় পানি ঢেলে দেয়।

মারাঠা বাহিনীর আলীবর্দীর বাহিনীকে ধাওয়া, ভাগলপুরের কাছে নিষ্পত্তিহীন লড়াই

আলীবর্দীকে নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে আফগান বিদ্রোহীদের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে মারাঠারা সিদ্ধান্ত নেয় সাময়িকভাবে পশ্চিমবাংলা লুণ্ঠনে বিরতির আর বাংলা- বাহিনীকে ধাওয়া করে বিহারে যাওয়ার। তাই মীর হাবিব পাঁচ হাজার অশ্বারোহী আর সাত হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে সাঁওতাল পরগণার পাহাড়- জঙ্গল পেরিয়ে, ভাগলপুরের কাছাকাছি চম্পানগরের প্রবাহের কাছে এসে নবাবের বাহিনীর পিছনের দিকে আকস্মিক আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু এই দল শিবিরের অনুসারীদের সামান্য ক্ষতি করতে পেরেছিল, বাংলার সৈন্যরা তাড়িয়ে দেওয়ার আগে।

পাটনার কাছে আফগানদের সঙ্গে মারাঠা বাহিনীর যোগদান

এর পরপরই জানোজি ও মীর হাবিবের অধীনে মারাঠাদের দুইটি দল পাটনা শহরের থেকে সামান্য পূর্বদিকে আফগান বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। জানোজি ও মীর হাবিব, শামশির খান ও তার বন্ধুদের দামি পোশাক ও অন্যান্য উপহার দেন। মীর হাবিবের সঙ্গে মির্জা মুহাম্মাদ সালেহ, মোহন সিং আর অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মীর হাবিবের জন্য শামশির খানের আয়োজিত ভোজনোৎসবে যান। বিনোদনের পর মীর হাবিবকে বৈকালিক বিশ্রামের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। শামশির খান তার লোকদের আদেশ দেন তাকে পরিপূর্ণ বিশ্রামের সকল সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার, কিন্তু তিনি বের হতে চাইলে তাকে আটকে রাখার। তিনি ৩০ বা ৪০ লক্ষ রুপি দাবি করেন মারাঠাদের সাহায্য করার জন্য যে সেনাবাহিনী গঠন করা হয়েছে, সেটার খরচ হিসেবে।

শামশির খানের অর্থ দাবির কৌশল মীর হাবিবকে ব্যথিত করে

মির্জা সালেহ, মীর হাবিবকে এই সমস্যা থেকে বের করার চেষ্টা করেন। তিনি তার কিছু ঘোড়সওয়ারকে কিছুদূর গিয়ে আবার ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ফেরত আসতে বলেন, আর চিৎকার করে বলতে বলেন যে তাদের নবাবের বাহিনী তাড়া করেছে। এটা গণ্ডগোল ও দ্বিধার তৈরি করে, আর এর সুযোগ নিয়ে মীর হাবিব তার নিজের শিবিরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পথে দুই আফগান সেনাপতি তাকে বাধা দেন ও তাদের দাবি পেশ করেন। মীর হাবিব তর্ক জুড়ে দেন যে শত্রুরা এত কাছে চলে এসেছে, অর্থের ব্যাপারে কথাবার্তা পরেও হতে পারে। কিন্তু আফগান সেনাপতিরা তার কাছ থেকে যতক্ষণ-না দুই লক্ষ রুপির প্রতিশ্রুতি পান, তাকে আটকে রাখেন আর এর জন্য এক ব্যাংকারকেও তার জন্য জামানত রাখতে হয়। আফগান সেনাপতিদের এই ধরনের আচরণ মীর হাবিবের অনুভূতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দেয়। তাই যখন নবাব ও মারাঠা-আফগান যৌথবাহিনীর মধ্যে লড়াই হয়, মারাঠা বাহিনী উদাসীনতার সঙ্গে কেবল নবাবের সৈন্যদের পেছনের অংশে আঘাত করে, আর  নিজেদের যুদ্ধের মাল লুটতেই নিয়োজিত রাখে, মিত্রদের সহায়তা করার বদলে ।

রানীসরাইয়ে মারাঠা-আফগান বাহিনীর বিপর্যয়কর পরাজয়; জানোজির নাগপুর ফিরে যাওয়া

আলীবর্দী ১৭৪৮ সালের ১৮ এপ্রিল মারাঠা-আফগান যৌথবাহিনীকে ভয়াবহভাবে পরাজিত করলেন বাড় থেকে আট মাইল পশ্চিমে রানীসরাইয়ে। মীর হাবিব ও জানোজি দ্রুত মুর্শিদাবাদের দিকে চলে গেলেন আলীবর্দীর অনুপস্থিতিতে সেখানে লুট করতে। কিন্তু পথে জানোজি তার মায়ের মৃত্যুর খবর পেলে তিনি নাগপুরে ফিরে যান তবে মীর হাবিবের সঙ্গে বেশিরভাগ সৈন্য রেখে যান মেদিনীপুরে।

মেদিনীপুরে মীর হাবিবের সঙ্গে সাবাজির দল মিলে শক্তিবৃদ্ধি; উড়িষ্যায় মারাঠা কর্তৃত্ব

রঘুজি ভোঁসলে তার ছোটছেলে সাবাজি ভোঁসলেকে অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে পাঠিয়ে দেন মীর হাবিবের দলকে ভারী করতে। মেদিনীপুরকে প্রধান কেন্দ্র করে, মীর হাবিব উড়িষ্যার বিভিন্ন অংশে লুটতরাজ করতে থাকেন। এভাবে বাংলা ও বিহার মারাঠাদের তাণ্ডব থেকে রেহাই পেলেও উড়িষ্যা তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে যায়।

উড়িষ্যা পুনরুদ্ধারে আলীবর্দীর যুদ্ধযাত্রা

১৭৪৮ সালের নভেম্বরে আলীবর্দী পাটনা থেকে মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছান, বিহারে সিরাজ-উদ-দৌলাকে সহকারী প্রশাসক আর তার সহকারী হিসেবে রাজা জানকিরামকে নিয়োগ করে। অল্প কিছুদিন বিশ্রামের পর তিনি রাজধানী ছেড়ে আবার বেরিয়ে পড়েন ১৭৪৯ সালের মার্চের মাঝামাঝি, আর কাটোয়ায় গিয়ে সৈন্যদের একত্রিত করেন উড়িষ্যা পুনরুদ্ধারের জন্য। এর কয়েক মাস আগে তিনি দক্ষিণ থেকে মারাঠাদের আগমন রুখতে হায়দার আলী খানের নেতৃত্বে আট হাজার সৈন্যের হালকা অশ্বারোহী বাহিনী পাঠান বর্ধমানে। উড়িষ্যা যাওয়ার পথে বর্ধমানে এসে আলীবর্দী, হায়দার আলী খানকে তার দলসহ মেদিনীপুর পর্যন্ত যেতে বললে তারা বেঁকে বসে, আর স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় তাদের বকেয়া পরিশোধ না করা হলে তারা কোথাও যেতে ইচ্ছুক নয়। আলীবর্দী মির্জা হাকিম বেগ ও ইউসুফ আলী খানের বাবা গোলাম হোসেনকে বিদ্রোহীদের কাছে পাঠান আর নিজেও ব্যক্তিগতভাবে তাদের সামনে যান; কিন্তু তারা গোলমাল বন্ধ করেনি। প্রচণ্ড ক্রোধে আলীবর্দী পুরো বাহিনীকেই ভেঙে দেন আর হতোদ্যম না হয়ে মেদিনীপুরের দিকে রওনা দেন পাঁচ বা ছয় হাজার ঘোড়সওয়ারি নিয়ে, কোনো কামান ছাড়াই। এটা শুনে মীর হাবিব তার নিজের শিবির জ্বালিয়ে দিয়ে অনুসারীদের সঙ্গে দক্ষিণে সরে যান। নবাব মেদিনীপুর শহরে না ঢুকে কোসাই (কাঁসাই) নদী পার হয়ে নদীর তীরেই শিবির স্থাপন করেন।

মেদিনীপুরের কাছে মারাঠাদের পরাজয়

মেদিনীপুরের জঙ্গলে মারাঠা বাহিনী বিরতি দেয়, আর সেখানে দোস্ত মুহাম্মাদ খান, মীর কাযিম খান ও নবাবের অন্য সেনাপতিদের কাছে তারা পরাজিত হয়। ১৭৪৯ সালের ৫ মে কটকের ইংরেজ কুঠির প্রধান হেনরি কেলসাল কলকাতার কাউন্সিলকে জানান মারাঠারা কটকের কুঠির দৃষ্টিসীমায় শিবির স্থাপন করেছিল আর নবাবের সৈন্যরা সেখান থেকে তিন কোস (ক্রোশ/ছয় মাইল) দূরে ছিল । আবার তিনদিন পর ৮ মে তিনি লিখেছেন :  নিল্লা পণ্ডিতের নেতৃত্বে শক্তিশালী মারাট্টোদের (মারাঠা) একটি বাহিনী কুঠির কাছেই শিবির স্থাপন করেছিল, আর তারা সেখানে লুটপাট বন্ধ করে সব জমা করেছিল, কারণ তাদের ঘোড়া শহরে ঢুকতে না ঢুকতেই নবাব সেখানে গিয়ে হাজির হন আর সঙ্গে সঙ্গে একটি সৈন্যদলকে নদী পার করে তাদের পিছু ধাওয়া করেন আর অল্প সময়েই কাছাকাছি চলে যান।

কটক অভিমুখে আলীবর্দী

নবাব তাদের বালেশ্বর পর্যন্ত তাড়া করার পর জানতে পারেন মীর হাবিব, সাবাজি ও তাদের সৈন্যরা কটকের জঙ্গলে পালিয়ে গেছেন। তিনি কটকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন, বৈতরণী নদীর ভদ্রক ও জাজপুরে দুইটি প্রবাহ পার হয়ে কটকের ৩৬ মাইল উত্তরে বারা নামের এক জায়গায় বিশ্রাম নেন। আলীবর্দী তার সেনাদল ভেঙে দিলে সৈয়দ নূর, সারান্দাজ খান ও ধর্মদাস হাজারি মারাঠাদলে যোগ দিয়েছিলেন আর মারাঠারা তাদের বড়বর্তী দুর্গের দায়িত্ব দিয়েছিল। তারা নবাবের কটকে আসার খবরে তার সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করে আনুগত্য প্রকাশ করতে চান। কিন্তু নবাব এতে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে মারাঠাদের তাড়া করতে থাকেন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, প্রতিকূলতা আর অনিশ্চয়তায়। যখন লম্বা ও ক্লান্তিকর যাত্রার পরও শত্রুপক্ষের কোনো হদিস পাওয়া গেল না, তিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন, আর একটা দলকে রেখে আসেন জঙ্গলে। দুই হাজার সৈন্য নিয়ে বারা থেকে যাত্রা করে বড়বর্তী দুর্গে আকস্মিক হামলা চালান। ১৮ ঘণ্টার ক্লান্তিকর যাত্রার পর, মাত্র ৩০০ জনে পরিণত হওয়া তার অবসন্ন বাহিনী নিয়ে তিনি বড়বর্তী দুর্গের সামনে এসে উপস্থিত হন ১৭৪৯ সালের ১৭ মে তারিখে।

আলীবর্দীর উড়িষ্যা পুনর্দখল

বড়বর্তী দুর্গে থাকা সেনাদল আলীবর্দীর বাহিনীকে বাধা দেওয়ার বদলে পরদিন তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়ে যায়। ১৮ মে সকালে যখন দুর্গের কর্মকর্তারা নবাবের সঙ্গে দেখা করেন, তখন সৈয়দ নূর ও ধর্মদাসকে বন্দী করেন আর সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা সারান্দাজ খানকে হত্যা করা হয়। এই কর্মকর্তাদের করুণ পরিণতিতে পুরো সেনাদল দুর্গ প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়, আর দরজা বন্ধ করে দেয়। নবাব দুর্গ অবরোধ করেন। ১৫ দিনের প্রতিরোধের পর দুর্গের সৈন্যরা নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে উড়িষ্যা মারাঠাদের থেকে পুনরুদ্ধার করা হয়।

কটকের ইংরেজ কুঠিয়ালরা নবাবের গতিবিধি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। হেনরি কেলসাল ১৯ মে, ১৭৪৯ সালে কলকাতার কাউন্সিলের কাছে লেখা চিঠিতে জানান :  নবাব কটকের তিন লীগের মধ্যে তাঁবু ফেলেছিলেন, আর তিনি অপেক্ষা করছিলেন তার জেমিন্দারদের (জমিদার) মাধ্যমে মীরাবিবের (মীর হাবিব) ও অ্যাঙ্গোশ্রেফের (?) খবরের জন্য; আর দুদিন পর তিনি আবারও লিখেছেন :  কিছু মানুষ যাদের তিনি নবাবের বাহিনীকে অনুসরণ করতে পাঠিয়েছিলেন, তারা ফিরে আসে নবাবের কটক শহরে প্রবেশ করার খবর নিয়ে। মীর হাবিব ও মারাট্টোরা (মারাঠা) তার ধাওয়ায় পালিয়ে যায়।

বর্ষাকাল এড়িয়ে যাওয়ার জন্য, আলীবর্দী একজনকে উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করে দ্রুত রাজধানীতে ফেরার পরিকল্পনায় ছিলেন। মীর জাফর খান ও দুর্লভরাম এই পদ নিতে সোজা অস্বীকার করলেন সাত থেকে আট হাজার মারাঠাদের আক্রমণের ভয়ে, যারা নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল আশেপাশের জঙ্গলে, আর আলীবর্দী চলে গেলেই ফিরে আসবে। শেষপর্যন্ত অশ্বারোহী বাহিনীর এক কর্মকর্তা শাহ আবদুস সুবহান খানকে এই দায়িত্ব দিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদের পথ ধরলেন।

কটক আবারও মারাঠা নিয়ন্ত্রণে

কিন্তু কটকের দখল আবারও মারাঠারা নিয়ে নেয়। আলীবর্দীর কটক ত্যাগের ছয়- সাতদিন পর তারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে আর বীরত্বের সঙ্গে তাদের প্রতিহত করা প্রতিপক্ষ আবদুস সুবহান খানকে আহত করে। আলীবর্দী এই দুর্যোগের খবর পান ১৭৪৯ সালের ৬ এপ্রিল তারিখে, যখন তিনি বালেশ্বরে। কিন্তু তিনি সেখানে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না মূলত দুটি কারণে— তার সৈন্যরা অবসন্ন হয়ে পড়েছিল আর বর্ষাকাল চলে আসছিল। তাই তিনি বিভিন্ন সমস্যা আর কষ্টকে অতিক্রম করে জুলাই মাসের শুরুতে মুর্শিদাবাদ পৌঁছান। দূরবর্তী অভিযানগুলোর ধকলে ৭৩টি বসন্ত দেখা এই মানুষটি ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়েন মুর্শিদাবাদে ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, যা তাকে ১৭৪৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভুগিয়েছিল।

মারাঠা বাহিনী তখন উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রান্তে তাদের লুটতরাজ জারি রেখেছিল, এমনকি কটকের ইংরেজ কুঠিও এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত ছিল না। মীর হাবিব ও মোহন সিং বালেশ্বরে যান ১৫ অক্টোবর, আর দুদিন পর আফগানরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এবং সেনাদলের পেছনের দিক রক্ষার বাহিনী গঠন করেছিল আর  সব মিলিয়ে সৈন্যসংখ্যা হয়েছিল ৪০ হাজারের মতো। ডিসেম্বর মাসের দিকে মারাঠাদের একটি দল কলকাতার কাছাকাছি কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় ঝামেলা সৃষ্টি করছিল। ১৯ ডিসেম্বর, ক্যাপ্টেন জর্জ মিনচিন ডিন স টাউন (ডায়মন্ড হারবারের কাছে) থেকে কলকাতার কাউন্সিলের কাছে লিখেছিলেন যে  তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মাহরাট্টাদের (মারাঠা) সংকটে ফেলা উচিত, যখন তিনি দেখলেন সুলুফ (এক মাস্তুলের ইউরোপীয় বড় নৌকো) তাদের মাহরাট্টাদের গুলি থেকে নিরাপত্তায় যথেষ্ট, তিনি চাইছিলেন তারা যেন উপকূলে চলে আসে, আর তিনি ভেবেছিলেন এভাবে তাদের পুরো নির্মূল করতে না পারলেও চরম সমস্যায় ফেলতে পারবেন। ক্যাপ্টেন তাদের দিকে ১৩টি গোলা ও ১৭টি শেল ছুড়লে, তারা আলোচনায় বসতে আগ্রহী হয়।

১৭৪৯ সালের ডিসেম্বরে আলীবর্দী মেদিনীপুরে

এমন পরিস্থিতিতে আলীবর্দী উদাসীন ও নিষ্ক্রিয়ভাবে রাজধানীতে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি কাটোয়ার দিকে রওনা হলেন, আর সেখানে সব সৈন্য জড়ো করার পর বর্ধমান হয়ে মেদিনীপুর গেলেন ১৭৪৯ সালের ডিসেম্বরে। তার এগিয়ে আসার খবরে মারাঠারা আলাদা হয়ে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু আলীবর্দী পুরো মৌসুম মেদিনীপুরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন, যেন মারাঠাদের বাংলায় ঢোকার পথ চিরতরে বন্ধ করতে পারেন। শহরের বাইরে কাঁসাই নদীর তীরে তিনি তাঁবু ফেললেন, মেদিনীপুরের ফৌজদার আলী কুলি খানকে সিরাজ-উদ-দৌলার বাহিনীর অধিনায়ক করলেন, আর বালেশ্বরে সিরাজ- উদ-দৌলার অধীনে একটি দল পাঠালেন মারাঠাদের সেখান থেকে তাড়াতে। দোস্ত মুহাম্মাদ খান ও মীর কাযিম খানের নেতৃত্বে এই দলের সম্মুখবাহিনী মারাঠাদের বিরুদ্ধে দাপটের সঙ্গে এগিয়ে গেলে মারাঠা বাহিনী পালিয়ে যায়। আলীবর্দী তার প্রিয় নাতির থেকে বেশিদিন বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে নিজেই নারায়ণগড়ে তাকে দেখতে যান। তারপর তারা জলদি ফিরে আসেন মেদিনীপুরের শিবিরে। নবাব তখন তার সেনাবাহিনী থেকে কিছু বিশ্বাসভঙ্গকারীকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে তা সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, আর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বাতিল করতে হয়।

ত্বরিতগতিতে মারাঠাদের রাজমহল ও মুর্শিদাবাদে হানা

যখন নবাব মেদিনীপুরের শিবিরে,  কয়েক হাজার মারাট্টোদের (মারাঠা) একটি দল তাকে এড়িয়ে গিয়ে (মার্চের শুরুতে, ১৭৫০) রাজমহল পর্যন্ত তাণ্ডব চালায়,   আর সেখান থেকে তারা মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করে। ১২ হাজার অশ্বারোহীকে নেতৃত্ব দিয়ে মীর হাবিব মুর্শিদাবাদ শহরের চার মাইলের ভেতরে চলে আসেন আর মীর জাফরের বাহিনীর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ হয়, যেটায়  তারা (মীর জাফরের বাহিনী) পরাজিত হয়ে পিছিয়ে শহরের কাছে চলে যায়… দুই বাহিনী পরস্পরের কাছাকাছি তাঁবু ফেলে, আর মারাট্টোরা (মারাঠা) প্রতিদিন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তাদের চারপাশে ধ্বংসযজ্ঞ চালাত । এটা শুনে নবাব মেদিনীপুর ছেড়ে বর্ধমানের দিকে চলে আসেন, আর মারাঠারা মুর্শিদাবাদের পশ্চিমদিকের বনাঞ্চলে পালিয়ে যায়।

মারাঠাদের পিছে আলীবর্দী

বর্ধমানে এক জঙ্গলমহালের জমিদার আলীবর্দীকে প্রস্তাব দেন পাহাড়ি পথ ধরে তাকে পথ দেখিয়ে মারাঠাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার। আলীবর্দী তার দেখানো পথে এগোতে থাকেন, কিন্তু তৃতীয় দিনে জমিদার আত্মহত্যা করেন জঙ্গলের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলায়। তাই নানা অসুবিধা ও সমস্যার কথা বিবেচনা করে আলীবর্দী বর্ধমানে ফিরে বর্ধমানের রাজার দিওয়ান মানিকচাঁদের বাগানে কিছুদিন অবস্থান করেন।

আলীবর্দীর মেদিনীপুরে অবস্থান

কিছুদিনের মধ্যেই আলীবর্দী জানতে পারেন পালিয়ে যাওয়া মারাঠা বাহিনী আবার মেদিনীপুরে ফিরে এসেছে আর তাই তিনি আবার সেখানে গেলেন। কিন্তু মারাঠারা আবার পালিয়ে যায় তিনি সেখানে যাওয়ার আগেই। তিনি কিছুদিন সেখানেই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন, কারণ কেউই সেখানকার ফৌজদারের পদ নিতে চাইছিল না।

১৭৫০ সালের জুনে সিরাজ-উদ-দৌলার বিহার দখলের চেষ্টা আর দ্রুত পাটনা শহরে যাওয়া

কিন্তু এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ তার পরিকল্পনা পরিবর্তনে বাধ্য করে। নবাবের থেকে বরখাস্ত হওয়া অসন্তুষ্ট সেনাপতি মাহদি নিসার খান, আলীবর্দীর প্রাণপ্রিয় আর যার নামে নবাব সব উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন, সেই সিরাজ-উদ-দৌলাকে উস্কে দেন— নবাবের প্রতিনিধি জানকিরামকে হটিয়ে বিহারের স্বাধীন নবাব হওয়ার। এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে খামখেয়ালি যুবক মুর্শিদাবাদ প্রাসাদে যাওয়ার ছল করে মেদিনীপুর ছেড়ে বেরিয়ে যান। তিনি রাজধানীর দিকে যাত্রা করে তার বেগম লুৎফুন্নিসাকে নিয়ে জাফর খানের বাগানে মাহদি নিসার খানের সঙ্গে দেখা করেন, আর পাটনা শহর আক্রমণ করে বসেন। জানকিরাম নিজেকে আবিষ্কার করেন উভসংকটময় পরিস্থিতিতে। তিনি শহর অরক্ষিত রেখে চলে যেতে যেমন পারছেন না, আবার এটাও আশঙ্কা করছেন যে সিরাজ-উদ- দৌলার গায়ে কোনো আঘাত লাগলে তার নানার অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হবে। তার বাহিনী আক্রমণকারীদের প্রথমে প্রতিহত করলেও একসময় পিছিয়ে আসতে হয় পাটনা শহরের হাজীগঞ্জ মহল্লার এক সংঘর্ষে। তারপরও আক্রমণকারীদের শহর দখল করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছিল তারা, আর এই বিদ্রোহের নেতা মাহদি নিসার খান, মির্জা মাদারি বেগ দক্ষিণী ও আমানত খান লড়াইয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এটা সিরাজ-উদ-দৌলার সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় আর সিরাজ-উদ- দৌলা নিজে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। তার শ্বশুর মুহাম্মাদ ইরাজ খানের ভাই মুস্তাফা কুলি খানের ঘরে তিনি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেন।

আলীবর্দীর বিহার যাত্রা ও সিরাজ-উদ-দৌলাকে সঙ্গে করে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসা

মুর্শিদাবাদ থেকে পাটনায় সিরাজ-উদ-দৌলার যুদ্ধযাত্রার খবরে আলীবর্দী দ্রুত মেদিনীপুর ত্যাগ করেন। তিনি বিহারের দিকে দ্রুত যাত্রা করেন, মাঝে মাত্র একদিন মুর্শিদাবাদে বিরতি দিয়ে। বাড়ের কাছে গিয়াসপুরে পৌঁছে তিনি পুরো ঘটনা শোনেন। তিনি জলদি পাটনার দিকে ধাবিত হন এবং জানকিরাম ও সিরাজ-উদ-দৌলার মধ্যের ঝামেলা মিটিয়ে দেন। জানকিরাম যোগ্যতার সঙ্গে বিহারের প্রশাসন সামলান ১৭৫২ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।

আলীবর্দীর অসুস্থতা

পাটনায় থাকতেই আলীবর্দী প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হন। কিন্তু তার পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব ছিল না, কারণ মারাঠা বাহিনী মেদিনীপুরে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল, আর ঐ এলাকা কিছু অক্ষম কর্মকর্তার দায়িত্বে রেখে আসা হয়েছিল। তিনি সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে নৌপথে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন ও পথেই কিছু নামি চিকিৎসক তার চিকিৎসা করেন, আর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন ১৭৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু তার বিশ্রামের সময়টুকুও ছিল না, কারণ বৃদ্ধবয়সে তার অসুস্থতার খবর মেদিনীপুরের সৈন্যদের মনে হতাশা আর উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছিল এবং তার কর্মকর্তা মীর জাফর খান ও দুর্লভরামের কাপুরুষতা ও কৌশলহীনতা মারাঠাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল সেখানে আক্রমণ চালাতে।

আরোগ্য ও মেদিনীপুরে যুদ্ধযাত্রা

তাই শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও আলীবর্দী মেদিনীপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন ১৭৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে, মীর হাবিবকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাকে বাধ্য করেন পাশের জঙ্গলে পালিয়ে যেতে। নবাবের বাহিনীর ক্রমাগত ধাওয়ায় তিনি উড়িষ্যায় চলে যান। এরপর নবাব কাটোয়ায় ফিরে আসেন আর মারাঠাদের পুরোপুরি বিতাড়ন করার কর্মসূচি পরের বছরের জন্য তুলে রাখেন।

দুই পক্ষেরই শান্তিস্থাপনের ব্যাকুলতা

সময় কখনও এমন সব ব্যাপার সমাধান করে দেয় যা মানুষ শত চেষ্টা করেও পারে না। আট বছরেরও বেশি সময় ধরে একের পর এক অভিযান আর লুটপাট মারাঠাদের জন্য কোনো দীর্ঘস্থায়ী সুফল বয়ে আনেনি। এর জন্য তারা বাংলার নবাবের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ নিষ্পত্তির মাধ্যমে কিছু অর্জনের চিন্তা করতে থাকে। নবাবও তাদের লুটতরাজে বাধা দিতে পারছিলেন না সবসময় নজরদারি করার পরও, আর জীবন ও অর্থ দুটোই সমানে খরচ হচ্ছিল। নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ জীবনের ৭৫ তম বসন্তে এসে আলীবর্দীর আর কোনো আগ্রহ ছিল না মারাঠাদের সঙ্গে লড়াই দীর্ঘায়িত করার। তার প্রদেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক বিধ্বস্ত হয়েছিল আর সেখানকার অধিবাসীরা আকুলভাবে আকাঙ্ক্ষায় ছিল শান্তি ও নিরাপত্তার। এভাবে দুই পক্ষই ১৭৫১ সালের দিকে শান্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

চুক্তির জন্য আলোচনা

মারাঠাদের পক্ষে মির্জা সালেহর প্রতিনিধিত্বে আর নবাবের পক্ষে মীর জাফর চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করেন। মির্জা সালেহকে কাটোয়ায় নবাবের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন মীর জাফর। তারপর তারা মুর্শিদাবাদের দিকে যান ও চুক্তির শর্তগুলো ঠিক করেন। এটা শেষে গিয়ে স্বাক্ষরিত হয় নাগপুর দরবারের সম্মতিতে ১৭৫১ সালের মে বা জুন মাসে।

১৭৫১ সালের চুক্তির শর্তগুলো

চুক্তির শর্তগুলো ছিল

১. মীর হাবিব এখন থেকে আলীবর্দীর অধীনে কর্মকর্তা বলে পরিগণিত হবেন ও তাকে নবাবের পক্ষ থেকে উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসক করতে হবে। সহকারী প্রশাসক হিসেবে তিনি সেখানকার অতিরিক্ত রাজস্ব দিয়ে রঘুজির সৈন্যদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করবেন।

২. ১৮ আশ্বিন ১১৫৯ বঙ্গাব্দ (অক্টোবর ১৭৫১) থেকে ১২ লক্ষ রুপি প্রতি বছর দুইটি কিস্তিতে মারাঠাদের দিতে হবে চৌথ হিসেবে  এই শর্তে যে মারাঠারা এই রাজ্যে আর কখনও পদার্পণ করবে না।

৩. জলেশ্বরের কাছে সুবর্ণরেখা নদী (গোলাম হোসেন ভুল করেছেন এটাকে সোনামাকিয়া বলে) সুবাহ বাংলার সীমানা হিসেবে চিহ্নিত হয়, আর মারাঠারা এই প্রবাহ পেরিয়ে আর আসবে না বলে সম্মত হয়।

মীর হাবিবের পরিণতি

মীর হাবিবের ভাগ্যে নতুন দপ্তরের সুখ বেশিদিন লেখা ছিল না, যেটা তিনি অর্জন করেছিলেন কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, রক্তপাত আর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে। তার সৌভাগ্যই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকেই তার হুট করে পাওয়া ক্ষমতার জন্য ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন, আর  তার কড়া আদেশ প্রদান আর রাজসিক মেজাজে  খেপে গিয়েছিলেন। তাই চুক্তির প্রায় একবছর পর জানোজি উড়িষ্যায় তার বাবার প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে সুরক্ষার জন্য রয়ে যাওয়া মারাঠা পদাতিক বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে এলে, মীর হাবিবের শত্রুরা তার মন বিষিয়ে তোলে। জানোজি মীর হাবিবকে তার ৪০-৫০ জন অনুসারীসহ উড়িষ্যার রাজস্বের হিসেব তার তাঁবুতে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর ১৭৫২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে জানোজির নির্দেশে তাকে কয়েকজন অনুসারীসহ হত্যা করা হয়। গোলাম হোসেন মনে করেন মীর হাবিবের পতন ছিল মারাঠাদের অসংখ্য হামলায় অগণিত পরিবার ধ্বংসের বিপরীতে বিধাতার প্রতিদান, যেগুলোর পিছে তিনি অনেকাংশেই দায়ী ছিলেন। রিয়াজ অবশ্য মীর হাবিবের মৃত্যুর ভিন্ন বর্ণনা দেয়। সেখানে বলা হয়েছে আলীবর্দী নিজে চতুরতার সঙ্গে এটা করিয়েছিলেন। তিনি মীর হাবিবকে একটি চিঠি পাঠান, যাতে লেখা ছিল :  আপনার পাঠানো চিঠি পেয়েছি; আপনি মারাঠাদের সমূলে উচ্ছেদের যে পরিকল্পনা করেছেন সেটায় আমার সম্মতি রয়েছে। এটা অত্যন্ত সুপরামর্শ; আপনি ওদিক থেকে আর আমি এদিক থেকে সতর্কতার সঙ্গে অপেক্ষা করব। যে- কোনোভাবে তাদের এদিকে আনার চেষ্টা করবেন, তখন আমরা যা নির্ধারণ করেছিলাম সেটা বান্তবায়ন করা যাবে । এই চিঠিটি তিনি বার্তাবাহককে দিয়ে এমন পথে যেতে বলেন যেন সে মারাঠাদের হাতে সহজেই ধরা পড়ে। তার এই চাল সফল হয়, আর জানোজি সন্দেহের বশে তাকে হত্যা করেন। হতে পারে মীর হাবিবের পতনের পিছে আলীবর্দীর হাত ছিল। তাকে হত্যার পর নাগপুর দরবারের কর্মকর্তা মির্জা সালেহকে (মুসালিহ-উদ-দিন) উড়িষ্যার উপ-প্রশাসক পদে বসানো হয় আলীবর্দী ও মারাঠা উভয়পক্ষের যৌথ সম্মতিতে।

মারাঠা আক্রমণের প্রভাব

অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে মারাঠা আক্রমণ বাংলার ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বিপর্যয়কর ঘটনা ছিল। তাদের প্রভাব কমবেশি অনুভূত হয়েছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। এটা ভাবা ভুল হবে যে বর্গিদের তাণ্ডব কেবল গুরুত্বপূর্ণ আর বড় শহরগুলোতে পরিচালিত হয়েছিল, আর তারা বর্ষায় থেমে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে আমরা সে-সময়কার বিভিন্ন লেখা, কলকাতা কাউন্সিল থেকে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসে যাওয়া চিঠি থেকে জানতে পারি যে পশ্চিমবাংলার অভ্যন্তরের গ্রামগুলোও তাদের লুট ও ধ্বংসের থেকে রেহাই পায়নি। গ্রামে বসবাসরত দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের কুঁড়েঘর ও বাসস্থান রাজধানীর জগৎ শেঠের সুদের কারবারের আস্তানা বা নাওয়াজিশ মুহাম্মাদের প্রাসাদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জগৎ শেঠের বাড়ি কেবল একবার লুট হয়েছিল, কিন্তু গরীব গ্রামবাসীদের কুঁড়েঘর বছরের পর বছর পুড়েছে আর তাদের সর্বস্বও লুট হয়েছে একইসঙ্গে। মারাঠারা কেবল সামরিক অভিযানের সময় মূল যুদ্ধের জন্য আর বর্ষাকালে বিশ্রাম নিত। কিন্তু এসময়ে তাদের লুটপাট অন্য সময়ের চেয়ে আরো জোরেসোরে চলত।

ক) অর্থনৈতিক

মারাঠা তাণ্ডব মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল বাংলার বাণিজ্য, শিল্প, মুদ্রাব্যবস্থা আর কৃষিতে। প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে এই প্রদেশের অর্থনৈতিক অসংগতিতে ভুগতে থাকার পেছনে মারাঠাদের অতর্কিত আক্রমণগুলোই প্রধানতম ভূমিকা রেখেছিল।

খ) সামাজিক

সমাজে মারাঠা আক্রমণের প্রভাব দুভাবে অনুভূত হয়েছিল—১) প্রদেশের জনসংখ্যার সংমিশ্রণে আর ২) মানুষের নৈতিক মর্যাদায়। আমরা ইতোমধ্যেই বলেছি কীভাবে পশ্চিম থেকে মানুষের বড় একটি অংশ পূর্ব ও উত্তর বাংলায় দেশান্তরিত হয়েছিল, বা কলকাতার ব্রিটিশ বসতিতে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিল, যেখানে তারা তুলনামূলক ভালো নিরাপত্তা আশা করেছিল, কিন্তু তারা অন্য কোনো বৈদেশিক বসতিতে যায়নি। এভাবে প্রদেশের পশ্চিম অংশের জনশূন্যতা পূর্ব আর উত্তরাংশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয় আর কলকাতায় জনসমাগম বাড়িয়ে দিতে থাকে। এছাড়াও কিছু মারাঠা পরিবার পাকাপাকিভাবে বাংলায় কিছু নির্দিষ্ট স্থানে বসতিস্থাপন করে। হলওয়েল ১৭৪৩ সালের একটি সতীর ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে কাশিমবাজারের একটি মারাঠা পরিবারের উল্লেখ করেছিলেন। মারাঠা পরিবারের পূর্বপুরুষেরা এখনকার সাঁওতাল পরগণা জেলার (বিহার) দেওঘরের করুন গ্রাম থেকে বাংলায় এসেছিল ভাস্করের অনুসারীদের সঙ্গে, এরপর আর নিজেদের এলাকায় ফিরে যায়নি। আরও কিছু মারাঠা পরিবার একই সময়ে বাংলায় বসতি গড়েছিল। খুব সম্ভবত তারা বাণিজ্যিক আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য বাংলায় স্থায়ীভাবে থিতু হয়েছিল, আর একইসঙ্গে তাদের বাংলার নবাবের দপ্তরে রাজস্ব আদায়ের চাকরির লোভও ছিল। দ্বিতীয় ব্যাপারটির ক্ষেত্রে গঙ্গারামের লেখনি থেকে জানা যায় যে বাংলায় আক্রমণের সময় তারা সপ্তদশ শতকের নারীকে শ্রদ্ধা করার আদর্শ ভুলে গিয়েছিল, আর সেটার নির্বিচার লঙ্ঘন হয়েছিল প্রদেশের অভ্যন্তরে লুণ্ঠিত বা পালিয়ে যাওয়া পরিবারের মহিলাদের উপর।

গ) রাজনৈতিক

বর্গিদের হামলা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। প্রথমত, তারা বিহারের আফগান বিদ্রোহকে উৎসাহিত ও তরান্বিত করেছিল। আলীবর্দীর আফগান সেনাপতিরা তাদের সেরাটুকু নিংড়ে দিয়েছিল তার শাসনামলের শুরুর বছরগুলোতে; কিন্তু মারাঠাদের বারবার আক্রমণে যখন তার গদি টালমাটাল হয়ে পড়ে, তারা তার কাছে কিছু অভিযোগের প্রতিকার চায়; আর শেষপর্যন্ত প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে বসে আর মারাঠা আক্রমণকারীদের সঙ্গে মিলে লড়াই করে। তারা স্বপ্রণোদিত ছিল আর মীর হাবিব ও তার সঙ্গের মারাঠাদের সহায়তা পেয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, এটা উড়িষ্যায় মারাঠাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে দিয়েছিল। ১৭৫১ সালের চুক্তি অবশ্যই মারাঠাদের হাতে উড়িষ্যা ছেড়ে দেয়নি; এটা কেবল তাদের দক্ষিণ অংশের রাজস্ব তোলার অধিকার দিয়েছিল। তাত্তিকভাবে উড়িষ্যা বাংলা সরকারের অধীনেই রয়ে যায়। কিন্তু বাংলায় ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা বিশৃঙ্খলার সুযোগে মারাঠারা সেখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ও বেরার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। আমরা বেশকিছু সূত্র থেকে জানতে পারি উড়িষ্যায় মারাঠারা তাদের কেবল নিজেদের গণ্ডিতেই আবদ্ধ রাখেনি, মাঝেমধ্যে তারা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তেও সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তারা বাংলার জন্য ক্ষতিকর বলেই প্রমাণিত হয়েছিল ১৮০৩ সালে উড়িষ্যা বৃটিশদের পদানত হওয়ার আগে পর্যন্ত

তৃতীয়ত, বাংলার বিধ্বস্ত এলাকার থেকে পালিয়ে আসা অধিবাসীদের কলকাতায় ইংরেজদের কুঠির বসতি এলাকার ভেতরে তাৎক্ষণিক আশ্রয়ের প্রস্তাব এই মানুষগুলোর ভেতরে ইংলিশ কোম্পানির প্রতি সহানুভূতি ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে। ইংরেজরা মারাঠাদের আক্রমণ থেকে শহর রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে একটি সেনাদল গঠন করা ছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা তুলতে সক্ষম হয়েছিল কলকাতার স্থানীয়, আর্মেনীয়, পর্তুগিজ অধিবাসীদের থেকে।

এটা থেকে বোঝা যায় যে ইংরেজদের প্রতি খানিকটা আস্থা রেখেছিল জনসাধারণ। তাই যখন কয়েক বছর পর, মীর জাফর ও বাংলার কিছু প্রভাবশালী জমিদার মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন সিরাজ-উদ-দৌলাকে মসনদ থেকে হটানোর পরিকল্পনায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবাবের বিপক্ষে ইংরেজদের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন, তাদের কার্যকরী আইনের শাসন আর তাদের সাহায্য চাওয়া মানুষদের অটল সুরক্ষা দেওয়ার কারণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *