অধ্যায়-৩৫ হাতিবাহিনীর ইতিবৃত্ত ও কিছু অজানা দিক

অধ্যায়-৩৫ হাতিবাহিনীর ইতিবৃত্ত ও কিছু অজানা দিক

দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের হলকার চোটে কাছে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। আগুনটা আসলে লাগানো হয়েছে বিশাল পরিখা জুড়ে। আর সেখান থেকে ভেসে আসছে মানুষের অন্তিম হাহাকার! একজন নয়, দুজন নয়, দু’হাজার মানুষের মর্মান্তিক চিৎকার! আগুনে পুড়ে মারা যাবার আগে তাদের শেষ চিৎকার কাছে দাঁড়ানো মানুষের রক্ত হিম করে দেবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কিছু করার নেই। একদিকে অত্যাচারী রাজা, আর ওদিকে দু’হাজার নিরীহ মানুষ ছাই হয়ে যাচ্ছে।

ভাবছেন, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে নিয়ে লেখা জীবনীর মাঝে কী না কী লেখা হচ্ছে? মোটেও না, এ ঘটনাটা যেদিন ঘটেছিল তার সাথে শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) এর মক্কা নগরীতে জন্ম পর্যন্ত ঘটনা যে কী ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটি অবিশ্বাস্য! এই বইয়ের পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে নবী (সা) এর জীবনী, এক নতুন আর ভিন্ন আঙ্গিকে। এবং এজন্য রেফারেন্স হিসেবে যেখানে হযরত মুহাম্মাদ (সা) সংক্রান্ত ঘটনা আসবে, সেখানেই মূলত ব্যবহার করা হবে ইবনে হিশাম রচিত প্রামাণ্য জীবনী। এটিই সর্বপ্রথম লেখা জীবনীগুলোর একটি হবার কারণে এতে কোনো সন্দেহ নেই মিথ্যে ঘটনা ঢুকবার। এর সাথেও থাকবে একদম ইসলামের প্রথম যুগের কিংবা তারও আগের কিছু রেফারেন্স, যেগুলো উপমহাদেশীয় গ্রন্থগুলোতে তুলনামূলক কম উদ্ধৃত হয়। এ কারণে অনেকেই এ ঘটনাগুলোর সাথে পুরোই অপরিচিত। আর ইবনে কাসিরের তাফসির তো আছেই। যদি আপনি এ অধ্যায়গুলোতে উল্লেখিত সবগুলো ঘটনা আগে থেকেই জেনে থাকেন, তবে আপনার ইতিহাস বিষয়ক জ্ঞান সত্যিই ঈর্ষণীয়!

মূল ঘটনাপ্রবাহে প্রবেশের আগে পাঠকদের জন্য পরামর্শ- এ লেখায় বেশ কিছু নতুন নাম আসবে, কিছু অঞ্চলের যুদ্ধ নিয়ে কথা হবে, ঘটনার গুরুত্ব আস্বাদন করতে হলে আপনাকে কষ্ট করে নাম আর সম্পর্কগুলো মনে রাখতে হবে। লেখা সংক্ষেপ করবার জন্য বেশ কিছু ব্যাপার সহজে উপস্থাপন করা হবে, যেটা হয়তো সত্যিকারে এত সহজ ছিল না। এখন তবে চলুন, আমরা চলে যাই ১,৫০০ বছর আগের এক উত্তপ্ত আরবে!

শেবা ( Sheba )।

এ নামটা অনেকেরই পরিচিত নিশ্চয়ই, যে বইটি পড়ছেন এখানেই শেবা বা সাবাকে নিয়ে ইতোমধ্যে একটি অধ্যায়ই লেখা হয়ে গিয়েছে। সুলাইমান (আ) বা সলোমনের স্ত্রী ‘কুইন অফ শেবা’; ইসলামি নানা কাহিনীতে যার নাম এসেছে সাবার রানী বিলকিস হিসেবে, কুরআনে অবশ্য তার নাম উল্লেখ নেই। ইয়েমেনে অবস্থিত এ রাজ্যের ইতিহাস অনেকেই ঠিক মতো জানেন না।

প্রাচীন ইয়েমেনের হিমিয়ার রাজ্যকে (Himyarite Kingdom) গ্রিক- রোমানরা বলত Homerite Kingdom; খ্রিস্টের জন্মেরও ১১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ রাজ্য, অর্থাৎ আজ থেকে একুশ শতক আগের কাহিনী। খ্রিস্টপূর্ব ২৫ সালে এ রাজ্যের অধিকারে আসে শেবা অঞ্চলটি। সেই থেকেই বলা হয় Kingdom of Sheba.

সবারই জানা রয়েছে যে, মোটামুটি ৫৭০ সালে নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) জন্মগ্রহণ করেন। কথাটা আবারও বললাম এ কারণেই যে, এতে আন্দাজ করতে সুবিধে তাঁর জন্মের ঠিক কত বছর আগের কথা লেখা হচ্ছে।

নিদেনপক্ষে ৫২৫ সাল পর্যন্ত আরবে প্রবল প্রতাপশালী ছিল হিমিয়ার রাজত্ব। প্রধানত তারা খ্রিস্টান হলেও হিমিয়ার অনেক রাজা ছিল, যারা কি না ইহুদী। সেটা ছিল ষষ্ঠ শতকের কথা। তবে সেসব ইহুদী হিমিয়ার রাজা খ্রিস্টানদের প্রতি খুবই বিরূপ ছিল। বিরূপতা যে কত বেশি ছিল সেটা একটি ঘটনাতেই বোঝা যায়। রাজা ইয়াকাফের রাজত্বে নাজরান (আরব) থেকে আসা এক খ্রিস্টান মিশনারিকে ইহুদীরা খুন করে কেবল প্রকাশ্যে একটি উপাসনালয়ে ক্রুশ টানাবার জন্য!

আরবে তখন বাইজান্টিন প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। আরবের মক্কা মদিনা নাজরানের উপরের দিকে ছিল বাইজান্টিন সাম্রাজ্য, নিচে ইয়েমেনের হিমিয়ার রাজ্য, বামে মিসর আর ডানে পারস্য। মাঝখানে যেন কাবাব মে হাড্ডি হয়ে আরব। মানচিত্রটা এক ঝলক বুঝে নিন:

যাকে দিয়ে ঘটনার শুরু তার নাম আবু কারিবা, হিমিয়ারের রাজা আবু কারিবা আসাদ কিংবা আবু কারাব। সাল ৩৯০, বাইজান্টিন (খ্রিস্টান) সাম্রাজ্যের রাজধানী তখন ছিল কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাবুল, তুরস্ক); আর তাদের সাথে শত্রুতা ছিল হিমিয়ারদের। উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল আরবের দখল নিয়ে মসলা ব্যবসায় লাভ পাওয়া। তাছাড়া আরব দখল করলে ভারতে ব্যবসার রুট সুগম হয়। তিনি ‘তুব্বা’ উপাধিতেও পরিচিত ছিলেন। তুব্বা অর্থ ‘সূর্যকে যে ছায়ার মতো অনুসরণ করে’। নামটা থেকে সূর্যপূজারীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই ধারণা করাই যায়, তিনি পৌত্তলিক ছিলেন, যেমনটা ছিল তার হিমিয়ার অঞ্চলের অধিবাসীরা। ৩৯০ থেকে ৪২০ সাল পর্যন্ত তার রাজত্ব ছিল।

তিনি উত্তর আরবে আক্রমণ করলেন আরবকে বাইজান্টিন প্রভাব থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। খ্রিস্টান বাইজান্টিনরা তাই চাইতো পুরো পৌত্তলিক আরবকে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলতে। ইতোমধ্যে আবিসিনিয়াতে খ্রিস্টান ধর্ম তারা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। আবিসিনিয়া ছিল ইয়েমেনেরও পরে, মিসরের দক্ষিণে, এখন এর নাম ইথিওপিয়া। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনী নিয়ে রচিত এই অংশে ইথিওপিয়া ফিরে আসবে বারংবার, তাই এ ব্যাপারটা মনে রাখতে হবে। বাইজান্টিনরা হিমিয়ারের উত্তরাঞ্চলকেও চেষ্টা করতে লাগল পৌত্তলিক থেকে খ্রিস্টান করবার।

সেই সময়ে হিমিয়ারের রাজা কারিবা আসাদ সিদ্ধান্ত নিলেন শত্রু বাইজান্টিনদের এ কাজ করতে দেবেন না। কারিবার সেনাবাহিনী ইয়াসরিবে পৌঁছাল। মক্কার কাছের এক নগরী এই ইয়াসরিব। দুটোই উত্তর আরবে।

এখানে তিনি তেমন কোনো প্রতিরোধ পেলেন না। তাই তিনি কোনো বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা না করে নিজের ছেলেকে ইয়াসরিবের গভর্নর করে চলে গেলেন। কিন্তু, বেশিদূর যাওয়া লাগল না। তার কাছে খবর এসে পৌঁছাল, ইয়াসরিবের অধিবাসীরা তার ছেলেকে খুন করে ফেলেছে।

ছেলে হারাবার প্রবল শোক নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন ইয়াসরিবে। তার মনে তখন জিঘাংসার আগুন জ্বলছে। তিনি রক্তে ভাসিয়ে দেবেন ইয়াসরিবকে।

ইয়াসরিবের সব খেজুর গাছ কেটে ফেললেন তিনি। এ গাছগুলোই ছিল ইয়াসরিববাসীদের আয়ের প্রধান উৎস। নগরী অবরোধ করা হলো। নিজ নগরী রক্ষার জন্য ইয়াসরিবের পৌত্তলিকদের সাথেই স্থানীয় ইহুদী বাসিন্দারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলো। এ যুদ্ধের মাঝেই কারিবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

তখন ইয়াসরিবের দুই ইহুদী বিজ্ঞ লোক এ খবর শুনে রাজা কারিবাকে দেখতে গেলেন। তারা ছিলেন কাআব আর আসাদ। তারা কারিবাকে ওষুধ দিলেন আর কারিবা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তখন তারা দুজন অনুনয় করল, যেন ইয়াসরিব আক্রমণ না করে ফিরে যান রাজা কারিবা। কারিবা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি আক্রমণ তো বন্ধ করলেনই, সাথে নিজে ইহুদী ধর্মও গ্রহণ করে ফেললেন। তার কথাতে পুরো সেনাবাহিনীও নিজেদের পৌত্তলিক ধর্ম বাদ দিয়ে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করলো। অবশ্য, ইহুদী ধর্ম ঠিক ধর্মান্তরিত হয়ে গ্রহণ করবার মতো নয়, বরং পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তথাপি তারা ইহুদী মতাদর্শ গ্রহণ করে। এরপর ইয়াসরিব ত্যাগ করলেন রাজা কারিবা।

ইতোমধ্যে হয়তো পাঠক বুঝে গিয়েছেন, এই ইয়াসরিবই হলো বর্তমান মদিনা নগরী। ভবিষ্যতে এর নামকরণ করা হয় ‘মদিনা’। আগে ইয়াসরিব ছিল। তবে সেই কাহিনী আসবে পরে।

নিজের রাজ্যে ফিরে আসলেন রাজা কারিবা। এসেই তিনি সবাইকে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে বললেন। অনেকে প্রতিবাদ করলেও অনেকে আবার গ্রহণ করে ইহুদী ধর্ম। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, সকলেই ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তবে প্রথম মতবাদটিই বেশি প্রচলিত। ইহুদী আর পৌত্তলিকরা এর পর থেকে পাশাপাশি থাকতে লাগল সারা আরবেই। এমনকি, হিমিয়ার রাজ্যেও। কেউ কেউ অবশ্য কারিবার ইহুদী ধর্ম গ্রহণকে উপকথা বলে মন্তব্য করে থাকেন, তবে এটা স্বীকার করে নেন যে, পরবর্তী রাজারা ইহুদী ছিলেন।

আবু কারিবা তার ভাতিজা হারিস ইবনে আমুকে লোহিত সাগরের তীরে ভাইসরয় হিসেবে নিয়োগ দেন এবং মক্কা ও ইয়াসরিবকে নিয়ন্ত্রণ করেন।

তবে ইহুদী ধর্ম গ্রহণের পর খুব বেশি দিন টেকেনি কারিবার রাজত্বকাল। অনেকে মনে করেন, নিজের সৈন্যরা তাকে হত্যা করে। তিনি তিন ছেলে রেখে যান; হাসান, আমু আর জোরাহ। অথচ সিংহাসন দখল করে বসে এক পৌত্তলিক! নাম ছিল তার যু-শানাতির। তিনি ছিলেন খুবই অত্যাচারী।

তবে এরপর কালক্রমে আবার ইহুদী রাজা আসেন। এখানে শত বছরের ইতিহাস আছে। সেই বিষয়ে বিস্তারিত যাওয়া হচ্ছে না।

হিমিয়ার রাজ্যের শেষ ইহুদী রাজা হন যু-নুওয়াস (alsigi)। এ নামটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কুরআনে তার কথা না বলা হলেও তার রেফারেন্স করা হয়েছে। পুরো নাম, ইউসুফ ইবনে শারহাবিল যু-নুওয়াস। একইসাথে তিনি ছিলেন শেবার রাজা। গ্রিক ভাষায় তাকে Dounaas (Aouvaag) ডাকা হয়।

বলা হয়, সুদর্শন যু-নুওয়াসকে আগের রাজা ব্যক্তিগত কক্ষে নিয়ে যৌন সম্ভোগ করতে গেলে যু- নুওয়াস নিজের জুতোয় লুকোনো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেন রাজাকে। এরপর তিনি নিজে রাজা হন। কোথাও কোথাও তাকে ইহুদী মাতার পুত্র বলা হলেও। অনেকের মতে, তিনি পরবর্তীতে পৌত্তলিক থেকে ইহুদী হন রাজনৈতিক স্বার্থে। এটা ৫১৭ থেকে ৫২২ সালের কথা। ইবনে হিশামের গ্রন্থে যু-নুওয়াসের বিস্তারিত ঘটনা পাওয়া যায়।

রাজা হয়েই তিনি ঘোষণা করেন, তার রাজ্যের খ্রিস্টানদের শাস্তি দেয়া হবে, কারণ অন্য রাজ্যে খ্রিস্টানরা ইহুদীদের নিপীড়ন করে। তিনি তাদের ইহুদী ধর্মে আসতে বলেন। কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করে। ক্রোধে যু-নুওয়াস তাদের আক্রমণ করেন নাজরানে। ছয় মাস তাদের অবরোধ করে রাখা হয়। ইহুদী তিশরি মাসের পনেরো তারিখ শহরটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৩০০ লোক আত্মসমর্পণ করে এই প্রতিশ্রুতি পাবার পর যে, তাদের শাস্তি দেয়া হবে না। বলা বাহুল্য, এ কথা রাখা হয়নি। যু-নুওয়াস তাদের সকলের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। ভয়ংকর মৃত্যুদণ্ড। পরিখায় আগুন লাগিয়ে চার্চের কাছেই সেখানে তাদের জীবিত পুড়িয়ে মারেন, যারা সমর্পণ করেনি তাদেরও। নাজরানের (সৌদি আরবে) প্রায় ২,০০০ বিশ্বাসী খ্রিস্টান এভাবে মারা যায়। কোনো মতে আবার সেটা ৩০০০! কুরআনে এ ঘটনাকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে।

“অভিশপ্ত হয়েছে পরিখাওয়ালারা যারা অগ্নিসংযোগকারী; যখন তারা পরিখার কিনারায় বসেছিল। এবং তারা বিশ্বাসীদের সাথে যা করেছিল, তা নিরীক্ষণ করছিল। তারা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল শুধু এ কারণে যে, তারা প্রশংসিত পরাক্রান্ত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের ক্ষমতার মালিক…” [কুরআন, ৮৫:৪-৯]

আগেই বলা হয়েছে, ইথিওপিয়া তখন বাইজান্টিন (রোমান) প্রভাবে ছিল, অর্থাৎ খ্রিস্টান।

যু-নাওয়াস তখন সেই আবিসিনিয়া/ইথিওপিয়া আক্রমণ করেন। নাজরানও (আরবের দক্ষিণে, মক্কা মদিনা থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে) আক্রমণ করেন।

এরপর তিনি উত্তর আরব (মক্কা মদিনা) আক্রমণের চিন্তা করেন। খ্রিস্টানদের নির্যাতন করার আহ্বান জানিয়ে তিনি প্রতিবেশী রাজাদের কাছেও পত্র দেন, যেমন পারস্য আর বর্তমান ‘ইরাক’। ইরাকের ‘লাখমিদ’ রাজা আল মুন্ধির ইবনে আল নুমান ৫১৯ সালের জানুয়ারিতে এই চিঠি পান। তিনি তখন আবার চেষ্টা করছিলেন রোমান/বাইজান্টিন (খ্রিস্টান) রাজ্যের সাথে শান্তিচুক্তি করার। সেই সময় সেই পত্র পেয়ে তিনি অবাক হন। চিঠি তিনি রোমান দূতকে দেখান আর সেই দূত শিউরে ওঠেন।

এ খ্রিস্টান নিধনের সংবাদ সারা রোমান আর পারস্যে ছড়িয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত রোমান সম্রাট জাস্টিন দ্য ফার্স্টের কাছেও নাজরান থেকে আর্তি গেল খ্রিস্টান নিধনের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। ইথিওপিয়ার আঝুম রাজ্যের রাজা কালেব (নামটা মনে রাখা জরুরি) তখন রোমান সম্রাট জাস্টিনের সহায়তায় সেনা যোগাড় করলেন এবং ইয়েমেনে পৌঁছালেন। সেখানে তিনি যু-নুওয়াসকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। তবে যু-নুওয়াস আত্মহত্যা করেন নাকি নিহত হন, এটা নিশ্চিত নয়। আরবেরা বলে, তিনি আত্মহত্যা করেন, তিনি নাকি ঘোড়া নিয়ে লোহিত সাগরে ছুটে যান ও ইচ্ছা করে ডুবে যান লজ্জায়। বিখ্যাত ইয়েমেনি কবি ইমরুল কায়েস তার কবিতায় দুজন মহান ইয়েমেনি ব্যক্তির মৃত্যুতে শোক করেন। তাদের একজন ছিলেন ‘শেষ’ হিমিয়ার রাজা যু-নুওয়াস।

এটা সম্ভবত ৫২৫ সালের কথা। যুদ্ধে জিতবার পর কালেব দেশে ফিরে যান। তার সেনাবাহিনীর একজন দক্ষ কমান্ডার ছিলেন আল-আশরাম। মূলত, কালেব দুটো বাহিনী পাঠিয়েছিলেন, প্রথমটি ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়টি পাঠানো হয়। এই দ্বিতীয় বাহিনীর কমান্ডারই আল আশরাম। তার অধীনে ছিল এক লাখ সৈন্য আর শত শত যুদ্ধের হাতি। যু-নাওয়াসের মৃত্যুর পর কালেব ফিরে গেলে এ এলাকার দখল নিয়ে নিতে চায় আল-আশরাম। কিন্তু কালেব সেটা মানেননি। কালের দেশ থেকে জেনারেল আরিয়াতকে প্রেরণ করেন, যেন আরিয়াতকে ইয়েমেনের গভর্নর বানানো হয়। কিন্তু আল-আশরাম এটা মানবেন না। ফলে রাজা কালেব রেগে যান। এ দ্বন্দ্ব অনেক দিন চলে।

শেষ পর্যন্ত আরিয়াত আর আল-আশরাম এর দ্বন্দ্বযুদ্ধ (ডুয়েল) অনুষ্ঠিত হয়। সেটাতে আল-আশরামের মুখে আঘাত লাগে। মুখ কেটে যায়। কিন্তু ওদিকে আরিয়াত মারা যায়। আর জয়ী হন আল-আশরাম। তবে এরপর থেকে তার উপাধি হয় ‘আশরাম’ (Scarface) বা ‘যার মুখে কাঁটা দাগ’। এটা সম্ভবত ৫৪৩ সালের ঘটনা। এর আগপর্যন্ত তিনি তার নিজের আসল নামেই পরিচিত ছিলেন।

তার আসল নাম ছিলো আব্ৰাহা।

রাজা কালেব এরপর দুবার বাহিনী পাঠান আব্রাহাকে দমন করতে, কিন্তু সেই দুবারই পরাজিত হন। শেষ পর্যন্ত কালেব তার অধীনে ইয়েমেনের শাসক বা রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেন আব্রাহাকে।

এতক্ষণ যা বলা হলো, সংক্ষেপে আরো একবার ঝালিয়ে নেয়া যাক। উত্তরের বাইজান্টিন সাম্রাজ্য ছিল খ্রিস্টান। দক্ষিণের ইথিওপিয়াও খ্রিস্টান। আর আরবে বেশ ভাল সংখ্যক খ্রিস্টান ছিল। এদের শত্রু হয়ে দাঁড়ায় ইয়েমেনের শেবা বা ইহুদী হিমিয়ার রাজ্য। ইহুদী যু-নুওয়াসকে খ্রিস্টান-হত্যার জন্য বাইজান্টিন সম্রাট জাস্টিন দ্য ফার্স্ট শায়েস্তা করতে পাঠান ইথিওপিয়ার রাজা কালেবকে। কালেবের কমান্ডার ছিলেন আব্রাহা। কিন্তু কালেব চলে গেলে আব্রাহা রাজত্ব চাইলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি ইয়েমেনের রাজা হলেন।

রাজা হয়েই খ্রিস্টান আব্রাহা শুরু করেন ইহুদী আর পৌত্তলিক দমন। তিনি তার রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন সানাতে। অসম্ভব উগ্র খ্রিস্টান ছিলেন এই আব্রাহা। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেন। সেটা হলো, রাজ্যের সেচপ্রণালী উন্নত করেন আর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করেন। সাবিয়ান রাজধানী মা’রিবে তিনি বিশাল সেচ বাধ ঠিক করে দেন। এ সাফল্যে সারা রাজ্যে বিশাল ভোজ উদযাপিত হয়। তিনি সানাতে বিশাল এক চার্চ বা ক্যাথেড্রাল নির্মাণ করেন, নাম এক্লেসিয়া (গ্রিক ভাষায়), আরবিতে আল-কুলাইস। (বোঝাই যাচ্ছে, এ আরবি নামটা গ্রিক থেকে এসেছে।)

এ পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাস রেখে, আরবের একটু ভেতরে প্রবেশ করা যাক এখন। আরবের নিজস্ব ইতিহাসটুকু এবার জানব আমরা। এখানে বলে রাখা ভালো, আরবে শিক্ষিতের হার কম থাকলেও মুখস্থ মেধায় তাঁরা ছিলেন অনন্য। তাদের মৌখিক ইতিহাসও তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবার, খুব কম সময়ের মাঝে অনেকটা ইতিহাস বলা হয়ে যাবে বিধায় একটু ধীরে ধীরে পড়লে ভালো বোধগম্য হবে।

আরবের দুই প্রধান নগরী ছিল ইয়াসরিব (মদিনা) ও মক্কা। আনুমানিক ৪৯৭ সালের দিকে ইয়াসরিবের নাজ্জার গোত্রের হাশিম আর সালমার পরিবারে জন্ম নিল এক শিশু। তার নাম রাখা হয় শায়বা। তার বাবা হাশিম কিন্তু আসলে ইয়াসরিবের নয়, বরং মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের হাশিম গোত্রের। একদম শিশু থাকতেই বাবা মারা গেলেন শায়বার। মায়ের কাছেই বড় হলেন আট বছর বয়স পর্যন্ত। তখন তার চাচা (বাবা হাশিমের ভাই) মক্কা থেকে এসে সালমাকে বুঝালেন, বালক শায়বাকে মক্কায় নিয়ে যাওয়া ভাল হবে। ওখানে অনেক ভাল সুযোগ সুবিধা। সালমা বিমুগ্ধ হলেন মক্কার কথা শুনে। তিনি প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হন।

মক্কায় প্রথম আসতেই লোকে ভাবল, এই ছোট ছেলে বুঝি তার নতুন দাস। কিন্তু পরে চাচা সবাইকে বুঝিয়ে বললেন সব। চাচা ছিলেন হাশিম গোত্রের প্রধান। তিনি যখন মারা গেলেন, তখন তার উত্তরাধিকারী হলেন শায়বা, সেই ইয়াসরিবের শায়বা।

প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত মক্কায়। এর কারণ মক্কার কাবা ঘর, যা ‘আল্লাহর ঘর’ নামে পরিচিত। তারা এসে আল্লাহর পবিত্র ঘর তাওয়াফ করত, যদিও সেই সময় সেটা ছিল ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তিতে ঠাসা। তারপরও এককালে সেটা ছিল একত্ববাদের প্রতীক। এ অঞ্চলের মানুষেরই পূর্বপুরুষ নবী হযরত ইসমাইল (আ) আর তাঁর বাবা হযরত ইব্রাহিম (আ) মিলে এ ঘর বানান। সবাই এখানে এসে তাওয়াফ করত আর আল্লাহকে স্মরণ করত।

তবে শায়বার সময় সবাই আল্লাহকে মানলেও, তাঁকে একক উপাস্য মানত না। তারা আরও দেব-দেবী বানিয়ে নেয়, আর তাদের উপাসনা করা শুরু করে, যেন সেসব দেব-দেবী আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে। তখন আল্লাহ তাদের উপর দয়া বর্ষণ করবেন। অর্থাৎ দেব-দেবীদের উপাসনা করার কারণ ছিল, তারা ছিল ‘মিডিয়াম’ বা ‘মাধ্যম’, আল্লাহর সাথে যোগাযোগের ‘মিডিয়াম’। প্রধান দেব- দেবীদের মধ্যে ছিল আল-লাত, আল-মানাত, আল-উজ্জাহ ইত্যাদি। এই তিনজনের নামের সাথেই জড়িত কুখ্যাত স্যাটানিক ভার্স, তবে সে অন্য কাহিনী। লাত, উজ্জাহ, মানাত, হুবাল – ইত্যাদি দেব-দেবীর ভিড়ে ‘আল্লাহ’ ছিলেন আরবদের কাছে প্রধান দেবতা, আর বাকিরা যেন তাঁর অধীনস্থ! এবার পাঠকদের দুই আর দুইয়ে চার মিলাবার পালা। অজানা ইতিহাস থেকে জানা ঘটনায় প্রবেশ করা যাক।

প্রতি বছর হজ্ব মৌসুম ছিল মক্কার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন অনেক পর্যটক আসত। তারা দেব-দেবীর পূজা না করলেও কেবল আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতেই আসে। তবে এই ফাঁকে ধর্মের পাশাপাশি পণ্যের দাম বাড়িয়ে ব্যবসাটা ভালই করে নিত ব্যবসায়ী মক্কাবাসীরা। তবে ধর্মের সাথে ব্যবসা মিলানোকে কোনোমতেই পছন্দ করতেন না শায়বা। তিনি এর বিরোধিতা করতেন। আর অন্যান্য গোত্রের নেতাদের তুলনায় শায়বাকে সবাই বেশি মান্য করত সবাই। এককথায়, শায়বা ছিলেন মক্কার নেতা।

তাকে সবাই নাম ধরে ডাকত না, ডাকত ‘আব্দুল মুত্তালিব’ বলে, অর্থাৎ মুত্তালিবের দাস। কারণ তাঁর সেই চাচার নাম ছিল মুত্তালিব। সেই যে ছোটবেলায় তাকে সকলে মুত্তালিবের দাস ভেবেছিল, সেই খেতাব আর যায়নি, তার আসল নাম ‘শায়বা’ হারিয়েই যায়।

দূর দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ মক্কার এক উপাসনালয় ভ্রমণ করতে যায়। এটা শুনে উগ্র খ্রিস্টান ইয়েমেনের রাজা আব্রাহা রেগে যান। কারণ তিনি একটি ক্যাথেড্রাল বানিয়েছেন (এক্লেসিয়া), অথচ এখানে তেমন মানুষ আসে না। তিনি এক লোককে দায়িত্ব দিলেন, এ ক্যাথেড্রালের কথা প্রচার করে বেড়াতে, যেন মানুষ এখানে আসে। কিন্তু প্রচারকাজ চালানোর সময় সেই লোককে কেউ তীর চালিয়ে মেরে ফেলে। এ খবর পেয়ে আব্রাহা ক্রোধে অন্ধ হয়ে যান। তার সব রাগ গিয়ে পড়ে মক্কার সেই কাবার উপর। তিনি বললেন, কাবা ধ্বংস করে দেবেন। কথিত আছে, কুরাইশদের এক লোক এটা শুনে রেগে যায় আর সেই ক্যাথেড্রাল নোংরা করে দিয়ে আসে রাতের আঁধারে।

৫৭০ সাল, আব্রাহা তখন ৪০,০০০ সৈন্য একত্র করে মক্কার দিকে রওনা দেন। তার বাহিনীর অগ্রে ছিল এক সাদা হাতি। বলা হয়, মোট ৮টি হাতি ছিল বাহিনীতে। হাতি দিয়ে কাবা গুড়িয়ে দেবার ইচ্ছা ছিল তার।

আব্রাহাকে বাধা দিতে পথিমধ্যে অনেক আরব গোত্র আক্রমণ করে। কিন্তু সবাই পরাজিত হয়। বর্ণিত আছে, মক্কার পরিসীমায় পৌঁছালে, আব্রাহার সাদা হাতি বসে পড়ে। সেটাকে জোর করেও আর আগানো যাচ্ছিল না। কথিত আছে, হাতিটির নাম ছিল মাহমুদ। আর আব্রাহার সবচেয়ে প্রিয় হাতি ছিল এটি।

আব্রাহা একটি দল পাঠালেন, যারা মক্কাবাসীদের উট কেড়ে নিয়ে আসল। এর মধ্যে আব্দুল মুত্তালিবের ২০০ উট ছিল।

কুরাইশ বংশের সবাই একত্রিত হলো আব্রাহাকে বাধা দেবার জন্য। আব্রাহা তখন এক হিমিয়ার দূত পাঠালেন কুরাইশদের কাছে এই বলে যে, “আমি কেবল কাবা ধ্বংস করতে এসেছি, মানুষদের না। তবে কেউ বাধা দিলে সে মরবে।”

শায়বা তথা আব্দুল মুত্তালিব মক্কাবাসীদের বললেন সবাই যেন মক্কা ত্যাগ করে পাহাড়ে চলে যায়, ওখানেই থাকে। আব্রাহা আব্দুল মুত্তালিবের সাথে মিটিং আহবান করলেন। আব্দুল মুত্তালিব তাই আব্রাহার কাছে গেলেন। আব্রাহা সিংহাসন থেকে উঠে তাকে উষ্ণ সম্ভাষণ করলেন, পাশে বসালেন।

আব্দুল মুত্তালিব আলোচনা শুরু হতেই বললেন, “আমার উট ফেরত দিন।” আব্রাহা অবাক হয়ে গেলেন, বললেন, “আমি তো ভাবলাম আপনি অনুনয় বিনয় করবেন, আমি যেন আক্রমণ না করে ফিরে যাই ইয়েমেনে। আমি আপনাদের উপাসনালয় ধ্বংস করে দিতে এসেছি। আপনাদের বাপ-দাদাদের উপাসনালয়! আপনাদের মানসম্মান, প্রতিপত্তি সব মিশে যাবে! আর এসব বিষয়ে কথা না বলে আপনি বলছেন, আপনার উট ফেরত দিতে?”

আব্দুল মুত্তালিব তখন একটা কথা বলেন, “আমি আমার উটের মালিক। আমি তাই আমার উট চাইতে আসলাম। আর এই ঘরের মালিক আল্লাহ নিজেই এর রক্ষাকর্তা। আমি নিশ্চিত তিনি তাঁর ঘর রক্ষা করবেন।”

আব্রাহা অবাক হয়ে যান এরকম উত্তর শুনে। তিনি কুরাইশদের উটগুলো দিয়ে দেন। মিটিং শেষে চলে গেলেন আব্দুল মুত্তালিব।

পরদিন সকালবেলা, আব্রাহা তাঁর বাহিনী নিয়ে ঢুকতে যাবেন মক্কায়। মক্কাবাসীরা আগেই পাহাড়ে চলে গেছে। রয়ে গেছেন কেবল আব্দুল মুত্তালিব নিজে আর কয়েকজন নেতা; তারা কাবার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আব্রাহা একজনকে পাঠালেন তাদের বলতে যেন তারা সরে যায় ঐ ঘর (কাবা) থেকে।

দূত আসলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, তাদের নেতা কে? সবাই আঙুল দিয়ে দেখালেন আব্দুল মুত্তালিবকে। তখন তিনি আবারো বললেন, “এই ঘরের মালিক নিজেই এর রক্ষাকর্তা। বাইরের আক্রমণ থেকে আর তাঁর ঘরের দাসদের নিগৃহীত হতে দেবেন না।”

তিনি তখন কাবা ঘরের দরজা ধরলেন আর চিৎকার করে উঠলেন, আল্লাহ যেন তাঁর নামের এ ঘর রক্ষা করেন। এরপর আব্দুল মুত্তালিব আর নেতারাও পাহাড়ে চলে গেলেন। আব্রাহা অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন মক্কার কাবার দিকে।

তখন হঠাৎ আকাশে দেখা গেল, বিশাল একঝাঁক সবুজ পাখি আসছে। ছোট ছোট পাখি। তারা সবাই পাথর বহন করে আনছে ঠোঁট আর পায়ে করে। এবং সেনাবাহিনীর উপরে আসতেই সেই পাথরগুলো সেই অনেক উঁচু থেকে ফেলে দিচ্ছে। অনেক উঁচু থেকে পড়া খুব ক্ষুদ্র পাথরের আঘাতও হয়ে উঠল বিশাল। ইথিওপিয়ান বাহিনীর বেশিরভাগ সৈন্য পালিয়ে যায়, যারা পাথরের আঘাতে নিহত না হলো। তবে আব্রাহা গুরুতর আহত হন এবং ইয়েমেনে পালিয়ে যাবার পথে মারা যান।

মক্কাবাসীরা পরে পাহাড় থেকে ফিরে আসল, আর সেনাবাহিনীর অবশেষ পড়ে থাকতে দেখল। কাবার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি আব্রাহা ও তাঁর বাহিনী।

এ ঘটনা এত বেশি অবাক করা ছিল তাদের জন্য যে, তখন থেকে সাল গণনার একটা আদর্শ হয়ে দাঁড়ায় সেই বছরটা; সেই বছরটি Year of the Elephant নামে পরিচিত হয়। তাছাড়া হাতি আরবদের কাছে দুর্লভ প্রাণী ছিল, অনেকে দেখেইনি আগে। তখনকার আরবে, কেউ যদি কোনো আগের ঘটনা বর্ণনা করত, তাহলে এভাবে শুরু করত যে, ঘটনাটা ঘটেছিল সেই হাতিবর্ষের এত বছর আগে/পরে। এ ঘটনা নিয়ে পরে কুরআনে সুরাও অবতীর্ণ হয়- সুরা ফীল, ফীল অর্থ ‘হাতি’।

আরবি না জানা অনেকে মনে করে, পাখির নাম ‘আবাবিল’। কিন্তু না, ‘তইরান আবাবিল’ শব্দের অর্থ পাখির ঝাঁক। তইর মানে ‘পাখি’। আবাবিল মানে ‘ঝাঁক’। এটা কোনো পাখির নাম না।

আয়িশা (রা) বলেন, “ আব্রাহার বাহিনীর দুজন সেনাকে আমি মক্কাতে ভিক্ষা করতে দেখেছি। তারা দুজনেই চলাচলে অক্ষম আর অন্ধ ছিল। তারা বসে বসে ভিক্ষা করত।” আবু বকর (রা) এর কন্যা আসমা (রা) বলেন, “ঐ সেনা দুজনের একজন ছিল হাতির চালক। তার নাম ছিল আনীসা।”

দক্ষিণ আরবের এক কুয়ার কাছে পাথরে এই লেখাটা আব্রাহা খোদাই করেন, তবে এটি মক্কার ঘটনার আগেও হতে পারে, কারণ এতে মক্কার কথা লেখা নেই-

Walter W. Muller ইতিহাসে আব্রাহার ঘটনা লিখতে গিয়ে বলেন, “আব্রাহা দক্ষিণ আরবের অনেক এলাকা দখলে নিয়ে নেন, তবে উত্তর আরব নয়। তার রাজত্বের শেষ দিকে আব্রাহা আরেকটা অভিযান চালান, উত্তর আরবে। আর এই ঘটনাটা খুবই ভালভাবে আরবদের স্মৃতিতে রয়ে গেছে, বিশেষ করে আব্রাহার হাতিবাহিনী দেখে মনে হয়। তবে আশানুরূপভাবে আব্রাহা মক্কার দখল নিতে ব্যর্থ হন আর তার অভিযান বরবাদ হয়।” এর বেশি কিছু তিনি লেখেননি। কীভাবে আব্রাহা মারা যান বা কেন এত শক্তিশালী বাহিনী একটি ব্যবসায়ী জাতিকে হারিয়ে দিতে পারেনি, সেই বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করা হয় সেই লেখায়।

ইসলামের আবির্ভাবের আগের এক কবিতা থেকে একটা অংশ উদ্ধৃত করা যায়, কবি নুফাইল বিন হাবিব। তিনি এই পাখির ঘটনার সময় মুহাসাবে ছিলেন। এটি মক্কা আর মিনার মাঝের এক জায়গা। তিনি এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। তার কাছে পলায়নরত ইথিওপিয়ান সৈন্যরা সিরিয়ার রাস্তা জানতে চাচ্ছিল, এই নুফায়েলই ইথিওপীয় বাহিনীর বন্দী হিসেবে পথ দেখিয়ে এনেছিলেন। ইবনে কাসিরের তাফসীরেও এর উল্লেখ আছে। কবিতার অংশটা এরকম:

“ অভিবাদন নাও রুদাইনা! কী সুন্দর এক সকাল আজ।
হে প্রিয়তমা রুদাইনা!
তুমি যদি দেখতে, আমি যা দেখেছি এই মূসাহাবে!
তাহলে তুমি কখনও আমার আর তোমার মধ্যে যা হয়েছিল সেটা ভেবে
ব্যথিত হতে না…
আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম যখন সেই পাখিগুলো দেখলাম।
আর, আশঙ্কা করছিলাম যদি ঐ পাথরগুলো না আমাদের উপরেও পড়ে!
আর ওরা (সৈন্যরা) আমার কাছে পালিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করছিল
রাস্তার কথা!
এমনভাবে বলছিল যেন আমি ওদের কাছে ঋণী। আমায় যেন বলতেই
হবে…”

Year of the Elephant হাতিবর্ষ আরেকটি কারণে বিখ্যাত। কারণ এ বছরই মক্কার নেতা কুরাইশ বংশের হাশিম গোত্রের শায়বা বা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঔরসে আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)।

তবে ঠিক এই জন্ম নিয়ে উপমহাদেশীয় কথন আর বইপত্রে এমন অনেক ঘটনার অনেক সময় উল্লেখ থাকে যা পরবর্তী সংযোজন। প্রাথমিক প্রামাণ্য জীবনীগুলোতে এর কোনোই উল্লেখ নেই। নাটকীয় করতে গিয়ে অযাচিত সংযোজন বরং ঘটনার সৌন্দর্যকেই বিনষ্ট করে। অথচ প্রামাণ্য গ্রন্থ আর তৎকালীন আরবের নথিগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করলে এমন অত্যাশ্চর্য আর গভীর বিস্তারিত ঘটনা পাওয়া যায় যা এদেশের অধিকাংশ মানুষেরই অজানা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *