অধ্যায়-৩৪ এক নজরে ইহুদী বিশ্বাসের ইতিবৃত্ত
ইহুদী ধর্মবিশ্বাস পুরোটাই গড়ে উঠেছে তাওরাত (তোরাহ) ধর্মগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে। যদি আপনি বাইবেল খুলে দেখেন তাহলে সেখানে ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম যে পাঁচটি বই পাবেন, সেগুলো হলো জেনেসিস (বেরেইসিত), এক্সোডাস (শেমত), লেভিটিকাস (ভায়িক্রা), নাম্বার্স (বামিদবার) এবং ডিউটেরোনমি (দেভারিম)। এ পাঁচটি বইকে একত্রে বলা হয় ‘Five Books of Moses’ অর্থাৎ মূসা (আ) এর পাঁচ পুস্তক। এরপর বিভিন্ন নবীদের সহিফা মিলিয়ে সংকলিত হয় ‘হিব্রু বাইবেল’। একে তানাখও ডাকা হয় হিব্রুতে, কখনও বা ‘মিঞা’।
তাওরাত পুরোপুরি বুঝতে প্রয়োজন ‘তালমুদ’, যা মূলত ইহুদী আইন বিষয়ক সংকলন গ্রন্থ, আর এতে নানা ধর্মীয় ব্যাখ্যাও রয়েছে। তালমুদ বলতে আসলে ‘ব্যাবিলনীয় তালমুদ’-কেই (Babylonian Talmud) বোঝায়। আবার জেরুজালেম তালমুদও রয়েছে। তালমুদের দুটো অংশ, এক হলো মিশনাহ, যা ইহুদী ধর্মপণ্ডিত অর্থাৎ র্যাবাইদের মৌখিক তোরার লিখিত সংস্করণ, যা মোটামুটি ২০০ সালের দিকে লেখা হয়। আর অন্যটি হলো গেমারা, যা র্যাবাইদের করা মিশনাহর ব্যাখ্যা বা তাফসির, এটি প্রায় ৫০০ সালের দিকে লেখা হয়। মৌখিক তাওরাত ছাড়া লিখিত তাওরাত বোঝা যাবে না- এটাই ইহুদী পণ্ডিতদের মতামত। তাওরাতে মোট ৬১৩ খানা আদেশ আছে। এদেরকে ‘মিজভাই’ (mitzvahs) ডাকা হয়, যার অর্থ ‘আদেশ’। ‘বার মিজভাহ’ বলতে বোঝায় সেই অনুষ্ঠান, যা পালিত হয় যখন কোনো ইহুদী বালক প্রাপ্তবয়স্ক হয়, যা ইহুদী আইনে ১৩ বছর বয়স (মেয়েদের ক্ষেত্রে ১২ বছর)।
ইহুদীদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাখ্যাকারক র্যাবাইদের একজন ছিলেন ‘রাশি’; তার এ নামটা মূলত আদ্যক্ষরের সমষ্টি। (RASHI, RSbbi SHlomo Itzhaki)
ধর্মপ্রাণ ইহুদীদের নিয়ম করে দৈনিক তাওরাতের অংশবিশেষ পড়বার নিয়ম, এ অংশকে ‘পারশাহ’ বলে। কেবল তাওরাতই নয়, সাথে রাশির ব্যাখ্যাও পড়তে হয়।
বর্তমানে ইসরাইল একটি রাষ্ট্র হলেও পূর্বে ইসরাইল বলতে একটি জাতিকেই বোঝাতো, সত্যি বলতে, ইহুদী, হিব্রু ও ইসরাইলী- এ তিনটি শব্দ সমার্থকই ছিল।
ইহুদীরা এক ঈশ্বরেই বিশ্বাস করে। তিনি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা। তাঁর কোনো সন্তান নেই, তিনি অমুখাপেক্ষী। তাঁর অনেকগুলো নাম আছে। কিন্তু ইহুদীরা সাধারণত তাঁর নাম উচ্চারণ করে না, বরং ‘হাশেম’ (হা-শেম, The Name) বলেই ঈশ্বরকে বুঝিয়ে থাকে, কারণ তাদের মতে, ঈশ্বরের নাম মুখে আনা প্রচণ্ড পবিত্রতার কাজ, এবং যখন তখন তা ব্যবহার করতে নেই।
ইহুদীদের ছুটির দিন হলো শনিবার। এই দিনকে সাব্বাথ (new) বা বিশ্রামদিবস বলা হয়।
ইহুদী একটি জাতিগত পরিচয়, তাই যেকোনো ইহুদী মায়ের ছেলে বা মেয়েই ইহুদী। প্রথাগত ইহুদী হবার জন্য শরীরে ইহুদী রক্ত থাকা জরুরি। তাই বলা হতো ইহুদী ধর্মে কেউ ‘কনভার্ট’ হতে পারে না। তবে এটি এখন আর সত্য নয়। র্যাবাইনিকাল কোর্টে গিয়ে প্রয়োজনীয় ধাপগুলো সম্পন্ন করে এখন ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করা যায়! এজন্য শর্ত দেয়া থাকে- ‘মিজভাহ’ অনুসরণ, মিকভাহ (পবিত্র জল)-তে অবগাহন এবং খত্না।
বাইতুল মুকাদ্দাস বা সুলাইমান (আ) এর নির্মিত উপাসনালয় ইহুদীদের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে বছরে অন্তত তিনবার ইহুদীরা আগে আসত কুরবানি দেবার জন্য। কিন্তু ৭০ সালে সেই উপাসনালয় রোমানরা ধ্বংস করে দেয়। বর্তমানে যে কাঠামো আছে, তা ইহুদীদের সেই টেম্পল নয়, বরং সেটি এখন মুসলিম স্থাপনাই বলা চলে। ইহুদীরা অপেক্ষায় থাকে, কবে মসিহ আসবেন এবং থার্ড টেম্পল নির্মাণ করে জেরুজালেম থেকে পৃথিবী শাসন করবেন। চার্চের মতো করে ইহুদীদের স্থানীয় উপাসনাস্থান হলো সিনাগগ (synagogues )।
র্যাবাই বা রাব্বি অর্থ ‘শিক্ষক’, তারা তাওরাতের শিক্ষক।
ইহুদী ধর্ম পুরুষ থেকে পুরুষে বংশান্তরিত হয় না, বরং মহিলা থেকে মহিলাতে।
ইসলামকে কী দৃষ্টিতে দেখে ইহুদী ধর্ম?
হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর সময় খুব কম ইহুদীই ইসলামকে চিনতো। যারা চিনতো তারা আরববাসী ইহুদী। মুসলিমরা যখন ইরাক জয় করে নেন, তখন মূলধারার ইসরাইলীরা ইসলাম সম্পর্কে খতিয়ে দেখতে লাগলো। তারা মতামত দিল যে, ইসলাম অনুসরণকারীদেরকে একই পথের একত্ববাদী হিসেবে ধরে নিতে হবে।
মোজেস বেন মাইমন, যাকে মাইমোননিদিজ (Maimonides) ডাকা হয়, তিনি ছিলেন খুব বিখ্যাত একজন মধ্যযুগীয় ইহুদী জ্যোতির্বিদ এবং তাওরাতের স্কলার। তিনি ঘোষণা করেন:
“মুসলিমরা মূর্তিপূজক নয়, তারা পৌত্তলিকতা থেকে ঢের দূরে। তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করে। যদিও তারা আমাদের নিয়ে একটি মিথ্যে বিশ্বাস রাখে যে আমরা নাকি বলে থাকি আল্লাহর পুত্র (উজাইর) আছে, তারপরও আমাদের তাদের সম্পর্কে মিথ্যে ধারণা পোষণ করা উচিৎ নয়… যারা বলে তাদের পূর্বপুরুষেরা যেভাবে মূর্তি পূজা করত, সেভাবে তারা কাবার পূজা করে, তবে সে ভুল ধারণা করছে। যারা কাবার দিকে সিজদা করছে, তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি অনুরাগ রয়েছে।” (Maimonides, Responsa #448)
ইহুদীরা কি মুহাম্মাদ (সা)-কে নবী হিসেবে মনে করে?
এটার উত্তর দু’রকম। খুব কম ইহুদী মনে করে যে হযরত মুহাম্মাদ (সা) নবী, কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করাটা জরুরি নয় যতক্ষণ না আপনি তাওরাতের ওপরে আছেন। কিন্তু সাধারণ ইহুদী বিশ্বাসই হলো, মুহাম্মাদ (সা) ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী নবী ছিলেন না। তারা বলে, তালমুদ যদিও বলছে আল্লাহ জেন্টাইল (অইহুদী) জাতির প্রতিও নবী পাঠিয়েছেন [যেমন- আইয়ুব (আ)], তথাপি, জেন্টাইল নবী বালাম ইসরাইলের বিরুদ্ধে দোয়া করবার পর থেকে নাকি মূসা (আ) প্রার্থনা করেছিলেন যেন আল্লাহর রূহ (নবুয়াত) আর কোনো জেন্টাইলের ওপর না আসে। সেই হিসেবে মুহাম্মাদ (সা) নবী হতে পারেন না, কারণ তিনি জেন্টাইল (জেন্টাইল শব্দের আরবি উম্মী)। তবে দ্বাদশ শতকের ইয়েমেনী র্যাবাই নাতানেল আল ফাইয়ুমি বলেন, আল্লাহ যেমন মূসা (আ) আর বনী ইসরাইলের মাঝে চিরস্থায়ী ওয়াদা করেছিলেন, তেমনই মুহাম্মাদ (সা) আর মুসলিমদের সাথেও করে থাকতে পারেন। তাই, জেন্টাইলদের জন্য মুহাম্মাদ (সা) নবী হতেই পারেন, কিন্তু ইহুদীদের কাছে নন। তবে মূলধারার ইহুদীবাদ বলে, “মুহাম্মাদ (সা) মসিহ রাজার আগমনের পথ সুগম করবার জন্য আল্লাহর পরিকল্পনার অংশমাত্র।” (মাইমোনিদিজ) তাদের মতে ইসলাম হতে পারে নূহ (আ) এর ধর্মের একটি ধারাবাহিকতা।
ইহুদীরা কি ঈসা (আ)-কে নবী হিসেবে মনে করে?
খ্রিস্টানরা যীশু খ্রিস্টকে যেভাবে দেখেন, সেটা ইহুদীরা পুরোপুরিই প্রত্যাখ্যান করে। তবে কেউ কেউ বলেন, যীশু একজন মরণশীল মানুষ ছিলেন, যিনি নূহ (আ) এর প্রচারিত ধর্মকে আরও প্রচার করে যান।
“আল্লাহ না করুক, যীশু ও তার শীষ্যরা তাওরাতকে ধ্বংস করতে আসেননি, ইহুদীবাদকে ধ্বংস করতে আসেননি। এসেছিলেন জেন্টাইলদের জন্য নতুন একটি ধর্ম নিয়ে। এমন না যে তিনি নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন, তিনি বরং নূহ (আ) এর আদি সাত আদেশই প্রচার করতেন।” (Rabbi Jacob Emden, Seder Olam Rabbah Vezuta)
পরকাল নিয়ে ইহুদীদের বিশ্বাস কী?
ইহুদীরা বিশ্বাস করে মৃত্যু আল্লাহর পরিকল্পনার একটি অমোঘ অংশ। তাওরাত বলছে, “মাটি থেকে তোমার জন্য, মাটিতেই তুমি ফিরে যাবে।” “For you are dust and to dust shall you return.” (তাওরাত, জেনেসিস ৩:১৯ )
ইহুদী ধর্ম পরকালে বিশ্বাস করায়। “এ দুনিয়া কেবল আসন্ন পরকালের অপেক্ষাকক্ষ মাত্র। নিজেকে প্রস্তুত করো যেন পরকালে ভালোমতো প্রবেশ করতে পারো।” (Pirkei Avot 4:২1 )
‘গুণীজনেরা শিখিয়েছেন, ভবিষ্যতের পৃথিবী আমাদের জন্য নয়, সে পৃথিবীর আনন্দোৎসব উপভোগ করা সাজে না। বরং আসন্ন পরকালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সৎ মানুষ দুনিয়া ত্যাগ করলেই পৌঁছে যাবে সুউচ্চে।” (Tanhuma Vayikra 8)
“আল্লাহ কেন এদোন বেহেশত (জান্নাতুল আদন?) আর গেহিম (জাহান্নাম) তৈরি করেছেন?” (Pesikta de – Rav Kahana 30, 19b)
এ জগতের সকল সৎ মানুষের জন্য রয়েছে পরকালে লভ্যাংশ।” (Sanhedrin 105a)
“ইসরাইলি ও জেন্টাইলদের যারাই গুনাহ করে, তারাই যাবে গেহিমে (জাহান্নামে), সেখানে তারা ১২ মাস কাটাবে।”
“দুনিয়ার আগুন গেহিমের আগুনের হালকা স্বাদ মাত্র।” (Berakhot 57b) “তাওরাত যে অনুসরণ করে, ভালো কাজ করে, বিনয়ী থাকে এবং আল্লাহকে ভয় করে, সে-ই বেঁচে যাবে গেহিমের আগুন থেকে।” (Pesikta Rabbati 50:1)
ইহুদীদের রীতিনীতি কী?
তারা খত্না করে। তাদের লাশ পোড়ানো নিষেধ, এবং অন্যদের সাথে কবর দিতে হবে। কবর দেয়ার আগে লাশ পবিত্র করিয়ে নিতে হবে ধুয়ে মুছে।
ইহুদীদের তিনবেলা প্রার্থনা করতে হয়। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা। একে তেফিল্লা বলে। ইহুদী নারী ও পুরুষদের ওপর এটি ফরজ। ছেলেদের তিন বেলা, মেয়েদের অন্তত এক বেলা ( কেউ বলেন দু’বেলা)। সকাল দুপুর ও সন্ধ্যার প্রার্থনাগুলোকে বলা হয় যথাক্রমে শাহারিত, মিনহা (anae) ও মারিভ। এছাড়া বিশেষ দিনে, যেমন- শনিবারে মূসাফ (pic) প্রার্থনা এবং ঈদের দিনে নেইলা অতিরিক্তভাবে প্রার্থনা করতে হয়।
প্রার্থনা একা একা করা গেলেও, অন্তত দশে মিলে (মিনিয়ান) করাটা ভালো বলা হয়েছে। মাথায় টুপি পরতে হয় ছেলেদের, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বিবাহিত হলে মাথা ঢেকে রাখা জরুরি
ইহুদীরা লুনিসোলার (চন্দ্র সূর্য মিলিয়ে) পঞ্জিকা ব্যবহার করে। তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলোর মাঝে আছে পাসওভার (মিসর থেকে ইসরাইলের মুক্তি উদযাপন), রশ হাশানা (ইহুদী নববর্ষ), ইয়ম কিপুর (গুনাহমুক্তি দিবস), সুকোত (মরুভূমিতে ইসরাইল জাতির বেঁচে থাকা উদযাপন), হানুকা (সেকেন্ড টেম্পল নির্মাণের স্মৃতি উদযাপন) ইত্যাদি।
ইহুদীদের হালাল খাবারকে বলে হয় কোশার। মুসলিমদের জন্য কোশার মাংস খাওয়া হালাল, কিন্তু ইহুদীদের জন্য হালাল মাংস খাওয়া কোশার নয়।
ইহুদীদের নিয়ে তথ্যাদি তো অনেক হলো। তবে এখন, আগের একটি অধ্যায়ে যে মহানবীর (সা) জীবনীর ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরা নিয়ে কথা বলছিলাম, তারই গোড়ার দিকের কিছু লেখা তুলে ধরা যাক, এর কিছুটা অংশ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল, তবে বাকিটা হয়নি। এটা বিশেষভাবে এ বইতে তুলে ধরার কারণ হলো, এ অংশগুলোতে ইহুদী সংক্রান্ত কিছু উল্লেখ রয়েছে।