অধ্যায়-৩২ অতঃপর যীশু খ্রিস্ট
যীশু খ্রিস্ট। সারা বিশ্বজুড়ে কাগজে কলমে হলেও অন্তত ২২০ কোটি অনুসারী যার, পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম যে মানুষটির নিজের নামে নয়, বরং তার উপাধির নামে। যে মানুষটির জন্ম সাল থেকে গণনা শুরু হয় বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত ক্যালেন্ডারটির, অথচ তার নিজেরই জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৪ কি ৬ সালের দিকে।
তার সত্যিকারের নাম ছিল ইয়েশোয়া। নিজের মাতৃভাষা আরামায়িকে তার নামের উচ্চারণটা এমনই ছিল, অথচ অধিকাংশের ধারণা তার ভাষা ছিল হিব্রু। তার নামটিও এখন আর ওভাবে উচ্চারিত হয় না। ভাষাটি মৃত হয়ে যাওয়ায় যা হয়, তার নাম বিদেশি ভাষায় প্রবেশ করে একে একে পরিবর্তিত হতে হতে এখন তিনি জিসাস, কিংবা যীশু, কিংবা এ-কার ও-কারবিহীন আরবিতে ঈসা। অবশ্য হিব্রু তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন, ধারণা করা যায় রোমানদের ভাষাও তার দখলে ছিল।
তৃতীয় শতকে রোমের একজনের লেখা থেকে ধার্য করা হয় ২৫ ডিসেম্বর তার জন্ম-তারিখ, কিন্তু শীতকালের এ তারিখটিতে যে তার জন্ম হয়নি এটা মোটামুটি নিশ্চিত। বাইবেলে বর্ণিত মেষপালকেরা যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার রাত্রে মাঠে মেষে চড়াবে না, কিংবা কুরআনে বর্ণিত মারিয়ামের প্রসববেদনার সময় উপরে থাকা খেজুর গাছের পাকা খেজুর ঝরে পড়া- এগুলো কখনোই শীতকালের ইঙ্গিত দেয় না, বরং মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের ইঙ্গিতই দেয়। যথাযথ তারিখের অভাবে দরকার ছিল কোনো রূপক তারিখ বেছে নেয়া। সেই হিসেবে ২৫ ডিসেম্বর ধার্য করার পেছনেও ছিল কিছু সম্ভাব্য কারণ, মোটামুটি কারণগুলোর মাঝে একটির জের ধরেই ক্রিসমাসের বাংলা হয়েছে বড়দিন।
ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে যেখানে নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিলের প্রবল প্রাচুর্য, যীশুর ক্ষেত্রে তেমন বলা যায় না। তবে তাই বলে তিনি কোনো কল্পিত চরিত্র নন ইতিহাসে, অনেকে সেটা মানতে না চাইলেও সত্যি সত্যি যীশু সম্পর্কে ঐতিহাসিক দলিল এমন সব কথাই বলে যেগুলো জানায় অনেক অজানা কিছুই। কিন্তু সেই উপসংহারে আসতে হলে সমসাময়িক দলিলগুলো সম্পর্কে দরকার বিস্তারিত ধারণা। যীশুর জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, শিক্ষা, বিবাহ (?) এবং সবশেষে প্রস্থান- সবগুলো বিষয় নিয়েই এত অবাক করা উপসংহারে আসা যায় যে যথেষ্ট নথির অভাব থাকা সত্ত্বেও তার কথিত জীবনী ইতিহাসের কষ্টিপাথরেও কম নাটকীয় নয়! তিনি ছোটবেলায় কী করতেন? কীভাবে ধর্মপ্রচার শুরু করলেন? তার কিশোর আর যুবক বয়স নিয়ে কিছু জানা যায় না কেন? তিনি কি আসলেই তিব্বত, ভারত আর মিসরে গিয়েছিলেন? যীশুকে নিয়ে ইহুদীরাই বা তখন কী ভাবত? ইহুদীদের নিজের লেখনিতেই বা কী রয়েছে যীশু সম্পর্কে? শুধু যীশুই নন, তার মা অর্থাৎ কুমারী মেরি বা মারিয়ামের জীবনটাও কম অবাক করা নয়। তারপর ধরুন বহুল আলোচিত গস্পেল অফ বারনাবাস, কিংবা যীশুর রেখে যাওয়া ‘রেলিকগুলো (relic) এগুলো নিয়েও লেখার আছে অনেক কিছুই।
এই ‘ইহুদী জাতির ইতিহাস’ বইটির প্রথম সংস্করণ জনপ্রিয়তা পাওয়ার ফলে এর দ্বিতীয় ও শেষ খণ্ডও লিখে শেষ করে ফেলি, যেখানে খ্রিস্টাব্দ ( Post-Christ) ইতিহাস লেখা হয়েছে, যেখানে যীশু খ্রিস্ট থেকে শুরু করে পরের দু’হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। এর মাঝে স্থান পেয়েছে- যেখানে ইহুদী ধর্মের আধিপত্য শেষ হয় আর যখন থেকে ইসলাম ধর্ম সাড়া ফেলে, সেই মাঝের ৬০০ বছরের মধ্যপ্রাচ্যের শূন্য সময়কালও। ব্যাপারটা নিয়ে বাংলা ভাষায় রেকর্ড আসলেই প্রায় শূন্য বলা চলে, কিন্তু এই ছয়শো বছরের ইতিহাস খুবই চমকপ্রদ। এ সময়টাই রাস্তা তৈরি করে দেয় অনেক কিছুর।
এবং, তার পরে হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনী নিয়ে একটি লেখনি লেখার ইচ্ছে আছে, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যে বিষয়গুলো আর আট-দশটি জীবনীতে উঠে আসে না, সেই চমকপ্রদ আর অসাধারণ অনালোচিত দিকগুলো, সেই এতিম বালক থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যের কর্ণধার হয়ে ওঠার মানবিক আর রোমাঞ্চকর অভিযানটি দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে, যার শুরুর দিককার হালকা একটি অংশ এ বইতে পেয়ে যেতে পারেন।
তবে তার আগে সংক্ষেপে দুটো বিষয় আলোচনা করা জরুরি।
ইহুদীদের বর্তমান অবস্থানে আসার ইতিহাস কী?
ইহুদী ধর্মের বিশ্বাস কী? তারা কী পালন করে? তারা মুসলিমদের কী ভাবে? খ্রিস্টানদের নিয়ে কী ভাবে? হযরত মুহাম্মাদ (সা) আর ঈসা (আ)-কে নিয়েই বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
চলুন এ দুটো অধ্যায় এবার কভার করে ফেলা যাক।