অধ্যায়-৩০ নির্বাসন শেষে ইসরাইলে প্রত্যাবর্তন
কথিত আছে, জুদাহ রাজ্য থেকে ইহুদী বণিকেরা প্রাচীন খ্রিস্টপূর্ব ৫৬২ সালে ভারতবর্ষের কোচিতে এসেছিল। আর আরও ইহুদী আসে সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংস হয়ে যাবার পর ৭০ খ্রিস্টাব্দে। এদেরকে বলা হতো ‘কোচিন’ ইহুদী।
ব্যবিলনের নির্বাসন থেকে ফিরে আসবার পরের সময়টাকে বলা যায় ‘পোস্ট- এক্সাইল পিরিয়ড’, যা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সাল পর্যন্ত চলে। সেকেন্ড টেম্পল জুডাইজম নামেও একে ডাকা হয়। কারণ তখন দ্বিতীয়বারের মতো বাইতুল মুকাদ্দাস (টেম্পল অফ সলোমন) নির্মিত হয়েছিল। এ সময়কালে হিব্রু বাইবেলের প্রামাণ্য সংস্করণ তৈরি, ইহুদী উপাসনালয় তথা সিনাগগ প্রতিষ্ঠা, শেষ সময়ের ইহুদী ভবিষ্যৎবাণী সংকলন এবং যীশু খ্রিস্টের আগমন- এগুলো ঘটেছিল। এ সময়কালের প্রথমদিকে ছিল পারসিয়ান জুডাইজম।
জেরুজালেম থেকে ফিরে আসার পর পারস্যের অর্থায়নে দ্বিতীয় বাইতুল মুকাদ্দাস স্থাপনা নির্মাণে নেতৃত্ব দেন শেষ তিন হিব্রু নবী। তারা ছিলেন হাগাই (আ), জাকারিয়া (আ) এবং মালাকি (আ)। এই জাকারিয়া (আ) অবশ্য যীশু খ্রিস্টের কাহিনীর সাথে জড়িত জাকারিয়া (আ) নন, অন্য জাকারিয়া। তাদের তত্ত্বাবধানে বাইতুল মুকাদ্দাস দ্বিতীয়বার নির্মাণ শেষ হয় ৫১৫/১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ইতিহাস আমাদের জানায় সেকেন্ড টেম্পল রোমানরা ধ্বংস করে দেয় ৭০ সালে। উল্লেখ্য, সকল ইহুদী কিন্তু ফিরে আসেনি! বরং, একটি অংশ ফিরে এসেছিল। তারা ছিল নির্বাসিত প্রকৃত জুদাহ নাগরিকদের ইহুদী বংশধর, কিন্তু তারা আগে কোনোদিন জুদাহ দেখেনি। তবে তারা নিজেদেরকে প্রকৃত ‘ইসরাইল’ ও স্থানীয়দের (যারা রয়ে গিয়ে বংশ বিস্তার করেছে) থেকে উত্তম মনে করত। তারা সমাজের উচ্চপদগুলোতে আসীন হয়। ইমাম পদগুলোতেও ছিলেন তারা।
শেষ হিব্রু নবীর মৃত্যুর পর পারসিক শাসনের অধীনে ইহুদী জনগণের শাসনব্যবস্থা পরের পাঁচ বংশ ধরে রইলো ‘জুগোত’ নেতাদের হাতে। জুগোত (nita) অর্থ হিব্রুতে ‘জোড়া’। আশকেনাজি ইহুদীরা উচ্চারণ করেন ‘জুগোস’। (মধ্যযুগে পশ্চিম জার্মানি ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস শুরু করা ইহুদীরা আশকেনাজি ইহুদী) খ্রিস্টের জন্মের ১৭০ বছর আগে থেকে শুরু হয়ে ২০০ বছর ধরে চলে জুগোত ব্যবস্থা, এখানে দুজন করে জ্ঞানী মানুষ শাসন করতেন। তাদের একজনকে বলা হতো ‘নাসি’ অর্থ ‘প্রেসিডেন্ট’ অন্যজন আভবাইতদিন অর্থ প্রধান বিচারক। এ জুগোত শাসক দুজন ইহুদীদের ‘সুপ্রিম কোর্ট’ তথা সানহেড্রিনের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।
যা-ই হোক, পারসিক জুডাইজমের পর এলো হেলেনিস্টিক জুডাইজম (Hellenistic Judaism), অর্থাৎ গ্রিক প্রভাবিত ইহুদী ধর্ম, যা কি না ‘পুরো ইহুদী নয়, পুরো গ্রিকও নয়’। পার্সিয়ান সময়কাল শেষ হয়ে যায় যখন ভূমধ্যসাগরের কূল জুড়ে জয়লাভ করলেন মহাবীর আলেকজান্ডার, সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ কি ৩৩২ সালের কথা। তার মৃত্যুর পর অবশ্য তার সাম্রাজ্য আগের মতো থাকেনি। তখন জেরুজালেমসহ এহুদা প্রদেশ প্রাচীন মিসরভিত্তিক টলেমি শাসকবংশের অধীনে এসে পড়ে।
যেসকল ইহুদী ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকে বসবাস করত, তারা এই হেলেনিস্টিক (গ্রিক) ইহুদীবাদের গোড়াপত্তন করে। এদের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত ছিলো মিসরীয় দলটি। তাদের সাথে টলেমি রাজদরবারের বেশ খাতির ছিল। এই মিসরপ্রেমটা মোটেও জোর করে আসেনি, বরং ইচ্ছে করেই। এহুদা (পরবর্তীতে এহুদিয়া বা জুডিয়া) প্রদেশ আর আর সেই মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়াবাসী ইহুদী দলছুটদের জীবন হেলেনিজমের সংস্কৃতি ও ভাষা দ্বারা প্রবল রকমের প্রভাবিত হয়। গ্রিকরা যেমন ইহুদীদের সংস্কৃতিকে পছন্দ করত, তেমনই উল্টোটাও সত্য ছিল। এই হেলেনিস্টিক সময়কালটা টিকে ছিল মোটামুটি ১১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। গ্রিক ওল্ড টেস্টামেন্ট অর্থাৎ ‘সেপচুয়াজিন্ট’ (Septuagint) এই সময়কালেই সংকলন করা হয়। ফাইলো ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ইহুদী স্কলার যিনি আলেক্সান্দ্রিয়াতে বসবাস করতেন সে সময়। তিনি এই হেলেনিজমের বড় ভক্ত ছিলেন।
এখানে আরও দুটো শব্দ সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি। এক হলো ‘Pharisees’ যা প্রাচীন গ্রিক শব্দ (papucaios) থেকে এসেছে। এটি ছিল একটি সামাজিক মুভমেন্ট, একটি চিন্তাধারা। তারা বিশ্বাস করতেন, তাওরাতের আইনের ব্যাখ্যা হওয়া উচিৎ মূসা (আ) এর সময়ের খেল ধরে। এক বিখ্যাত ফারিসি, ঐতিহাসিক জোসেফাস বলেন, তৎকালীন সময়ে প্রায় ৬,০০০ ফারিসি ছিলেন। সেইন্ট পল ছিলেন একজন ফারিসি। অন্যদিকে, ফারিসিদের বিপরীতে ছিল ‘Sadducees’। সাদুকিরা ছিলেন বুর্জোয়া, সমাজের উপর শ্রেণীর ইহুদী। তারা বিশ্বাস করতেন আইনগুলো ব্যাখ্যার ভার আসলে ধর্মগুরুদের, তারাই সর্বৈব ক্ষমতার অধিকারী। এরা ছিলেন হেলেনিস্ট।
হেলেনিস্টিক জুডাইজমের পরপর এলো হাশমোনীয় সাম্রাজ্য (Hasmonean Dynasty)। সিরিয়ার সেলুসিদ (Seleucid) সাম্রাজ্য ছিল একটি তৎকালীন হেলেনিস্টিক বা গ্রিক রাজ্য। এর রাজধানী ছিল বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত ধ্বংসপ্রাপ্ত অ্যান্টিয়ক শহর। আলেক্সান্দ্রিয়ার হেলেনিস্টিক ইহুদী আর এহুদা বা ইসরাইলের মূল ধারার ইহুদীদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়া শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের শেষ দিকে এসে। তখন সেলুসিদ রাজা চতুর্থ অ্যান্টিওকাস কিছু ইহুদী রীতিনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে ক্ষেপে যায় মূল ধারার ইহুদীরা, তাদের একটি দল জুদাহ প্রদেশের শাসক হাশমোনীয় পরিবারের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু করে, তাদেরকে ম্যাকাবি বিদ্রোহী বলে। এই বিদ্রোহ ‘ম্যাকাবীয় স্বাধীনতা আন্দোলন’ (Maccabean Revolt) নামে পরিচিত। এ বিদ্রোহের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় একটি স্বাধীন রাজ্য, যার নাম হয় হাশমোনীয় সাম্রাজ্য। ১৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকে হাশমোনীয় সাম্রাজ্য। এ সময়ও একটু আগে বলা জুকোত শাসন চালু ছিল। জেরুজালেমের আলেক্সান্দ্রা ছিলেন একজন জনপ্রিয় হাশমোনীয় শাসিকা, তার দুই পুত্রের মাঝে গৃহযুদ্ধের কারণে মিলিয়ে যায় হাশমোনীয় সাম্রাজ্য। এ এলাকার জনগণ চাইতো না যে, কোনো রাজা তাদের ওপর রাজত্ব করুক, বরং ধর্মগুরুরাই করুক। তাই তারা রোমান কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানালো। এর ফলস্বরূপ রোমান জেনারেল পম্পেই দ্য গ্রেট জুদিয়া দখল করে নেন, শুরু হলো জেরুজালেমে রোমান শাসন।
পম্পেই যখন জুদিয়া অধিকার করে নেন তখন খ্রিস্টের জন্ম হতে আরও ৬৩ বছর বাকি। তখন শুরু হওয়া রোমান সাম্রাজ্য বিস্তার চলেছিল ১৫০ বছর ধরে, জুদিয়া তার একটি অংশ মাত্র। রোমের সিনেট থেকে হাশমোনীয় সাম্রাজ্য পতনের পর জুদিয়া অঞ্চলের জন্য ‘হেরোদ দ্য গ্রেট’-কে (Herod the Great) বাছাই করা হয় ‘ইহুদীদের রাজা’ (King of the Jews) হিসেবে।
হেরোদ দ্য ফার্স্টকে বলা হয় জুদিয়ার প্রথম ‘রোমান ক্লায়েন্ট কিং’। শাসনকালে তার পরিচিতি হয় চমৎকার সব স্থাপনা জুদিয়াজুড়ে নির্মাণ করার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে হেরোদ পরিচিত হন যীশু খ্রিস্টের জন্মের সময় জুদিয়ার রাজা হিসেবে। তিনি সেকেন্ড টেম্পল বা বাইতুল মুকাদ্দাস সংস্কার করেন এবং পবিত্র টেম্পল মাউন্ট এলাকা উত্তর দিকে আরও প্রশস্ত করেন। এছাড়াও তিনি বন্দর ও কিছু দুর্গ স্থাপন করেছিলেন। একদম শূন্য থেকে একটি বনেদি পরিবার (হেরোদীয় শাসন বা হেরোডিয়ান ডাইন্যাস্টি বলা হয় যাকে) স্থাপনের কৃতিত্ব ঐতিহাসিকগণ তাকে দেন বটে, কিন্তু তারপরও নানা কাজে তিনি ইতিহাসে সমালোচিত।