অধ্যায়-২ : সেকেন্ড টেম্পলের যুগে

অধ্যায় ২ : সেকেন্ড টেম্পলের যুগে

আলেকজান্ডারের জেনারেল টলেমি জুদাহ প্রদেশ দখল করলেন ভালোয় ভালোয়। কিন্তু তার প্রাক্তন মিত্র সেলুকাস ব্যাপারটা ভালোভাবে নিলেন না। সেলুকাস ছিলেন আলেকজান্ডারেরই আরেক জেনারেল, তিনি তখন শাসন করছেন সিরিয়া এলাকা। পরবর্তী শতক কেটে গেল তাদের বংশধরদের দ্বৈরথেই।

অবশেষে এলো সেলুকাসদের রাজত্ব, যাকে আমরা সেলুসিদ সাম্রাজ্য বলি, তারা তরবারির সাহায্যে ফয়সালায় পৌঁছে গেল। সিরিয়ার সেলুসিদ রাজা তৃতীয় অ্যান্টিয়কাস (খ্রিস্টপূর্ব ২২৩-১৮৭) মিসরের টলেমি বংশের পঞ্চম রাজাকে একদম তুলেমুলে শেষ করে দিলেন। খ্রিস্টের জন্মের তখনও প্রায় দুশো বছর বাকি।

শুরুতে অ্যান্টিয়কাস ইহুদীদের ব্যাপারে খুবই সদয় আচরণ করলেন। ইহুদীরা তো খুব খুশি। তিনি ইহুদীদের কর কমিয়ে দিলেন, এমনকি সেকেন্ড টেম্পলে বড় রকমের দান খয়রাত করলেন। কিন্তু দেখতে না দেখতেই তার এ মনোভাব বদলে গেল। তবে ততদিনে তার রাজত্বেরও বিদায় ঘণ্টা বাজছে।

আজকের তুরস্কের এক প্রাচীন শহর ছিল এফিসাস। এফিসাসের ম্যাগনেশিয়াতে খ্রিস্টপূর্ব ১৯০ সালে রোমানদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সেলুসিদ রাজা অ্যান্টিয়কাস। এতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন তিনি। জোরপূর্বক তাকে শান্তি চুক্তিতে রাজি হতে হয়। ফলে তিনি এশিয়া মাইনর এলাকা রোমানদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। এই এলাকা ছিল তার সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনবান এলাকা, ফলে তার টাকাপয়সায় টান পড়ে।

অ্যান্টিয়কাসকে তখন খুঁজতে হয় বিকল্প রাস্তা। তিনি ধনসম্পদে ভরপুর উপাসনালয়গুলো লুট করায় মনোযোগ দিলেন। এক বছর পর এরকম এক উপাসনালয় লুণ্ঠনের সময় তিনি পরপারে পাড়ি জমান। সিংহাসনে আরোহণ করেন তার পুত্র চতুর্থ সেলুকাস (খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭-১৭৫)। তিনিও একই রাস্তায় হাঁটেন। তার চ্যান্সেলর হেলিওডোরাসকে পাঠান জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাস তথা সেকেন্ড টেম্পল লুট করতে, কিংবা ইহুদীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করতে। এই টাকা দিয়ে তিনি রোমানদেরকে কর দেবেন। কিন্তু হেলিওডোরাসের কী হলো কে জানে, তিনি জেরুজালেম থেকে টাকা পয়সা না নিয়েই ফিরে গেলেন রাজার কাছে, তাকে খুন করে দখল করে নিলেন সিংহাসন। অবশ্য পরে সেলুকাসের ভাই শীঘ্রই রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন, নাম ধারণ করেন রাজা চতুর্থ অ্যান্টিয়কাস। তখন খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫ সাল।

এ সময় জুদাহ অঞ্চলের ইহুদী সমাজ দুই হোমড়াচোমড়া দলে বিভক্ত ছিল, আর এ জুদাহুতেই ছিল জেরুজালেম শহর। এই দুই ইহুদী পরিবারের একটি ছিল তোবায়া (Train) পরিবার, যাকে ইংরেজিতে টোবায়াড বলে, আর অন্যটা অনিয়াড পরিবার। অনিয়াড পরিবারের অনিয়াস তখন বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রধান ইমাম। কিন্তু অনিয়াসের ভাই জেসনের ইচ্ছা এ পদটা পাবার। তাই তিনি সেই রাজা চতুর্থ অ্যান্টিয়কাসকে ঘুষ দিলেন যেন তাকে প্রধান ইমাম করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

তাই হলো, জেসন হলেন প্রধান ইমাম। কিন্তু তিনি ইহুদী ধর্মকে হেলেনাইজ করতে চেষ্টা করলেন, অর্থাৎ এর মাঝে গ্রিক সংস্কৃতি ঢুকাতে চাইলেন। যেমন, তিনি গ্রিক খেলাধুলা শুরু করলেন জুদাহ প্রদেশে। রক্ষণশীল ইহুদী সমাজে এমন নগ্নগাত্র খেলাধুলো দেখে ক্ষেপে গেল মানুষ। খুব দ্রুতই পদ হারালন জেসন। এবার অনিয়াড পরিবার থেকে ক্ষমতা চলে গেল টোবায়াড় পরিবারে। প্রধান ইমাম হলেন এ পরিবারের মেনেলাউস।

ইহুদীদের এ কোন্দল যখন চলছে, তখন রাজা অ্যান্টিয়কাস তার বাহিনী নিয়ে মিসরের রাজা ষষ্ঠ টলেমিকে আক্রমণ করে পরাজিত করলেন। নিজ রাজ্যে ফেরার সময় তিনি জেরুজালেম হয়ে ফিরলেন, সেই সাথে খালি করে তুলে নিলেন সেকেন্ড টেম্পলের যাবতীয় কোষাগার। তার কাছে মনে হলো, এ তো চমৎকার উপায় টাকাপয়সা পাবার। মিসর আক্রমণ করবেন, আর জেরুজালেমে লুট করবেন।

তিনি যখন আবারও মিসরে চড়াও হতে গেলেন, তখন দেখা গেল সেখানে রোমানরা হাজির। রোমান বাহিনী তাকে হটিয়ে দিল। জেরুজালেমে গুজব ছড়িয়ে পড়লো, রাজা অ্যান্টিয়কাস মারা গেছেন। এ খবর জেসনের কানে যেতেই তিনি টোবায়াড পরিবারের মেনেলাউসকে প্রধান ইমাম পদ থেকে সরাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিধি বাম, অ্যান্টিয়কাস মরেননি। তিনি জেসনের এই গ্রিক হেলেনিস্টিক বিপ্লবের খবর পাওয়া মাত্রই দমন করলেন তাকে আর তার দলকে। তবে জেসনকে দমন করতে গিয়ে তিনি জেরুজালেমের বারোটা বাজিয়ে দিলেন।

অ্যান্টিয়কাস জেরুজালেম জয় করে নিয়ে অনেক লোককে দাস হিসেবে নিয়ে গেলেন। তিনি খৎনা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। সাব্বাথ পালন করা যাবে না আর। তাওরাত তিলাওয়াত করা যাবে না। অ্যান্টিয়কাস আদেশ জারি করলেন, বাইতুল মুকাদ্দাস আজ থেকে আর ইহুদীদের ঈশ্বরের প্রতি উপাসনার জন্য নয়, এখন থেকে এখানে গ্রিক দেবতা জিউসের উপাসনা করা হবে। কুরবানগাহে শুকর জবাই করা হবে। ইহুদী অ-ইহুদী সবাই এখানে উপাসনা করতে পারবেন। ভেতরে জিউসের মূর্তি স্থাপন করা হলো।

জেসনের হেলেনিজম নিয়ে আসলে রাজার সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল তার আন্দোলন নিয়ে। কোনো রাজাই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন পছন্দ করেন না। শেষমেশ জেরুজালেমে সেই গ্রিক হেলেনিজমই চালু করে দিলেন রাজা অ্যান্টিয়কাস।

কিন্তু অ্যান্টিয়কাস বোঝেননি ইহুদীরা কতটা ধর্মপ্রাণ, তারা জান দিতে রাজি কিন্তু ঐতিহ্য বর্জন করতে রাজি না। ইমাম মাত্তাথিয়াস আর তার পাঁচ পুত্রের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত হলো। মাত্তাথিয়াস মারা গেলেও তার ছেলে জুডাস চালিয়ে গেলেন এ আন্দোলন।

সেসময় ইহুদীদের একটি রাজনৈতিক দলের নাম ছিল হাসিদী (২7) দল। হিব্রু হাসিদ শব্দের অর্থ ‘ধার্মিক’, যুগে যুগে সকল ধার্মিকদেরকেই এ নামে ডাকা হয়েছে। কিন্তু এই সেকেন্ড টেম্পলের যুগে রাজনৈতিক দলটিকে আলাদাভাবে স্মরণ করা হয় হাসিদী নামে। মাত্তাথিয়াসের সশস্ত্র আন্দোলন আর রক্তপাতের বিরোধিতা করেছিলেন হাসিদীরা। প্রতিবাদস্বরূপ জেরুজালেম ছেড়ে দিয়ে জুদাহর মরুভূমিতে চলে যান তারা। তাদের এ আচরণ ভালোভাবে নেয়নি শাসক সেলুসিদরা। সেলুসিদরা তাদের আক্রমণ করতে এলো, কিন্তু সাব্বাথ দিবস শনিবারে হাতে অস্ত্র তুলে নেবেন না হাসিদীরা। তাতে সেলুসিদদের কিছুই যায় আসেনি, তারা কচুকাটা করলো নিরস্ত্র হাসিদীদের।

ঠাণ্ডা মাথার এই খুন দেখে অন্যান্য ইহুদীরাও যোগ দিল এ আন্দোলনে। একের পর এক সামরিক অভিযান রুখে দিতে লাগলো ইহুদীরা। একটা পর্যায়ে সেলুসিদরা ইহুদীদের প্রতি তাদের কঠোর নীতি বদলাতে বাধ্য হলো।

সেলুসিদরা ইহুদী নিয়ম রীতি পুনপ্রতিষ্ঠা করলো, সেকেন্ড টেম্পল বা বাইতুল মুকাদ্দাস ইহুদীদের হাতে ছেড়ে দিল, সেখানে আর গ্রিক দেবতার উপাসনা হবে না। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলোর পথে ফিরে এলো সেকেন্ড টেম্পল, পুনরায় আল্লাহর প্রতি উৎসর্গ করা হলো। এ দিবসকে আজও পালন করে ইহুদীরা ‘হানুকা’ (naat) নামে, যার অর্থ কোনো কিছুকে উৎসর্গ করা। বড়দিনের আশপাশের সময়ে হানুকা পালন করা হয় এখন।

সেলুসিদদের সাথে আন্দোলনের পর জুডাস রোমান রিপাবলিকের সাথে চুক্তি করলেন। কিন্তু চার বছর পর তিনি এক যুদ্ধে মারা যান। জুডাস যেহেতু বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রধান ইমাম ছিলেন, তাই তার মৃত্যুর পর প্রধান ইমাম পদে অধিষ্ঠিত হলেন তারই ভাই জোনাথান। একই সাথে তিনি জুদাহ প্রদেশের গভর্নর হলেন। জোনাথানের মধ্যে প্রধান ইমাম হবার গুণাবলি ছিল না আসলে।

জোনাথানের পর প্রধান ইমাম হয়ে এলেন তার ভাই সাইমন, তিনি আবার বেশ যোগ্য ছিলেন বলা চলে। তিনি জুদাহ প্রদেশকে সেলুসিদ সাম্রাজ্যের হাত থেকে স্বাধীনতা এনে দেন। জেরুজালেম নগরীতে সেলুসিদদের যে ব্যারাক ছিল, সেটি তিনি উচ্ছেদ করেন খ্রিস্টপূর্ব ১৪২-১৪১ সালের দিকে। বহুকাল আগে রাজা সলোমনের সাথে এক ফারাও-কন্যার বিয়ের ফলে সেই ফারাও একটি দুর্গ উপহার দিয়েছিলেন, যা কালক্রমে গাজারা দুর্গ নামে পরিচিত হয়। সেই গাজারা দুর্গ সাইমন পুনরুদ্ধার করেন, সেলুসিদ রাজাকে বশ স্বীকার করান জুদাহ প্রদেশের ব্যাপারে।

এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সমাপ্তি হলো। এ আন্দোলনকে বলা হয় ম্যাকাবিয়ান আন্দোলন। সেলুসিদ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিল, তাদেরকে বলা হয় মাকাবি। হেলেনিজম বা হেলেনিস্টিক ইহুদীবাদ দূরীকরণের কাজ শুরু করার কৃতিত্ব দেয়া হয় তাদেরকে।

সাইমন আনুষ্ঠানিকভাবে ইহুদীদের শাসক পদে আসীন হলেন। ইহুদী স্কলারদের ধারণা, এ সময়টাতে দানিয়েলের কিতাব বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও এ কিতাবে কেবল ব্যবিলনীয় নির্বাসনের আলাপ আছে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫ সালে সাইমনকে হত্যা করা হয় এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে। তার ছেলে ইউহানা হুরকানোস (জন হিরক্যানাস দ্য ফার্স্ট)। প্রথম হিরক্যানাস (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪-১০৪) একই সাথে শাসক এবং প্রধান ইমাম ছিলেন। তার শাসনামলের প্রথম দিকে সেলুসিদরা আবার জেরুজালেম আক্রমণ করে, হিরক্যানাস তার কিছু অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, আর জোরপূর্বক সেলুসিদদের সাথে পার্থিয়ানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেন। পার্থিয়ান ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের।

পরে হিরক্যানাস ট্রান্সজর্ডান এলাকার একটা বড় অংশ জয় করে নেন। মাটির সাথে মিশিয়ে দেন সামারিয়া এলাকার গেরিজিম পর্বতের ওপর অবস্থিত সামারিয় মন্দির। তাদের সবাইকে তিনি জোরপূর্বক ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করান।

তার এক ছেলে গালিলি সাগরের এলাকাগুলো, আর অন্য ছেলে সাগরতীরের অন্যান্য শহর এবং উত্তর ট্রান্সজর্ডানের যাবতীয় হেলেনাইজড শহরগুলো জয় করে নেন।

রাজা সাইমন যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, ইতিহাসে তাকে আমরা হাসমোনিয়ান (xi) সাম্রাজ্য নামে চিনি। হাসমোনীয় সাম্রাজ্যের নাম এসেছে বিপ্লবী মাত্তাথিয়াসের দাদার নাম হাশমোনে (8২1২7) থেকে। এ সাম্রাজ্যই (খ্রিস্টপূর্ব ১৪০-৩৭) সর্বশেষ স্বাধীন ইহুদী রাজ্য।

সেলুসিদ আর টলেমি সাম্রাজ্যের হাত ধরে শুরু হয় গ্রিক হেলেনিজম। আর হিরক্যানাসের হাত ধরে ইহুদী সাম্রাজ্য থেকে তা পুরোপুরি দূর হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *