অধ্যায় ২ – সুবাহদার হিসেবে আলীবর্দীর উত্থান ও তার শক্তি সুসংহতকরণ
সুজাউদ্দিনের মৃত্যু ও সারফারাজের সিংহাসন লাভ
১৩ মার্চ, ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দিনের মৃত্যু হয় আর তার সন্তান সারফারাজ, আলা- উদ-দৌলা হায়দার জং শান্তিপূর্ণভাবেই বাংলার মসনদে আসীন হন। নতুন সুবাহদার প্রধান দিওয়ান হাজী আহমাদ, খালসা দিওয়ান রায়রায়ান আলমচাঁদসহ অন্য পুরনো কর্মকর্তাদের বহাল রাখেন। কিন্তু তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সরকারের হাল ধরতে অক্ষম ছিলেন।
সারফারাজের প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নৈতিক চরিত্রহীনতা
প্রশাসনিক প্রতিভাহীন সারফারাজ রাজ্যের সমস্যাগুলোর দিকেও ঠিকমতো নজর দিতে পারেননি। পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন করতে যেনবা তিনি অতিরিক্ত ব্যভিচারে ডুবে গেলেন ধর্ম ও তার নানারকমের রীতিনীতির বাড়াবাড়ির ছদ্মবেশে। আর এভাবেই তিনি হয় অলস ইমামদের সঙ্গে নয়তো তার হারেমের ১৫০০ নারীর সঙ্গে অলস সময় কাটাতে থাকেন। হারেমের প্রতি অতিরিক্ত নেশা সারফারাজের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছিল, আর সে-কারণে তার ভেতরে বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, পৌরুষ গড়ে ওঠেনি, যা দিয়ে একজন শাসক তার দেশকে পরিচালনা করেন। তার এই ক্ষতিকর আমোদপ্রমোদ ও দুর্বলতা প্রভাব ফেলেছিল তার প্রশাসনে, আর উত্তেজিত করে তুলেছিল তার বাবার সময়কার বিশ্বস্ত ও যোগ্য কর্মকর্তাদের উচ্চাভিলাষী হতে, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে হলেও। আদপে, তার সরকার উচ্চাভিলাষী বিচ্ছিন্ন শক্তি ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয় এক বছর এক মাসের মাথায়।
সারফারাজের বিরুদ্ধে আলীবর্দী, হাজী আহমাদ, আলমচাঁদ ও ফতেহচাঁদের ষড়যন্ত্র
দিল্লি সাম্রাজ্যের ভাগ্যের উত্থান-পতন বাংলার উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আলীবর্দী আর তার ভাই ধূর্ত হাজী আহমাদ, উপলব্ধি করলেন যে নিজেদের উপরে ওঠার এটাই সুযোগ, কারণ তাদের দাবি নাদির শাহের আক্রমণে অসহায় হয়ে পড়া অথর্ব দিল্লি সম্রাটের পক্ষে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না। রায়রায়ান আলমচাঁদ ও মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ব্যাংকার ফতেহচাঁদ জগৎ শেঠ, দুজনেই সুজাউদ্দিনের প্রতি নিবেদিত হলেও ছেলেকে কোনোরকম সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকেন, যদিও সারফারাজ তাদের প্রতি কোনো বিরূপ মনোভাব দেখাননি। সারফারাজের শাসনের শুরু থেকেই তারা হাজী আহমাদের পরিকল্পনায় যুক্ত হন আলীবর্দীকে পাটনা থেকে সারফারাজের সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে ডেকে এনে, সারফারাজকে সরিয়ে তাকে বাংলার মসনদে বসানোর। এই তিন ব্যক্তি প্রথমে সারফারাজকে দিল্লির সম্রাটের কাছে হেয় করার চেষ্টা করেন। নাদির শাহের দিল্লি লুটের সময় তারা সরল মনের বাংলার নবাবকে পারস্যের আক্রমণকারীর নামে মুদ্রা ও খুতবা দিতে পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তারা দিল্লিতে সুজাউদ্দিনের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ও বাংলার রাজস্ব মুরিদ খানের মাধ্যমে দিল্লিতে পাঠান, যাকে মুর্শিদাবাদে নাদির শাহের আক্রমণেরও আগে দিল্লি থেকে পাঠিয়েছিলেন সম্রাট মুহাম্মাদ শাহের উজির কামরুদ্দিন খান। তারা দিল্লির কর্মকর্তাদের সারফারাজের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে ও তাদের দলে টানতে সমর্থ হন। সারফারাজের শক্তি হ্রাসে তারা অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাত দেখিয়ে তার সৈন্য প্রায় অর্ধেক করে ফেলেন, ফলে কেবল তিন থেকে চার হাজার অশ্বারোহী থাকে সারফারাজের সৈন্যদলে। কর্মচ্যুত সৈন্যদের হাজী আহমাদ আলীবর্দীর দলে অন্তর্ভুক্ত করে পাটনায় পাঠিয়ে দেন। তিনি তার ভাইয়ের কাছে তার ও তার ছেলের সঞ্চিত অর্থও পাঠিয়ে দেন এই বাহিনীর ভরণপোষণের জন্য, যার পরিমাণ ছিল প্রায় চার লক্ষ রুপি।
সারফারাজের কিছু উপদেষ্টার কারণে হাজী আহমাদের সঙ্গে তার বিরোধ
সারফারাজের উপদেষ্টাদের মধ্যে হাজী লুৎফ আলী, মীর মুর্তাজা, মর্দান আলী খান (সুজাউদ্দিনের বকশি) ও অন্যরা হাজী আহমাদের দলের সঙ্গে নবাবের বিরোধ গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ ছিলেন। নবাব তাদের উপর আস্থা রেখেছিলেন সরকার গঠনের পরপরই আর তারা এর সুযোগ নিয়েছিলেন হাজী আহমাদের বিরুদ্ধে পুরনো বিদ্বেষ পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত। হাজী আহমাদের বিরুদ্ধে তারা ক্রমাগত নবাবের কান ভারি করতে থাকেন। নবাব তাই হাজী আহমাদকে দিওয়ানের পদ থেকে সরিয়ে মীর মুর্তাজাকে দায়িত্ব দেন। তিনি হাজী আহমাদের জামাতা আতাউল্লাহ খানকে রাজমহলের ফৌজদারি থেকে সরিয়ে সেখানে মীর মুর্তাজার জামাতা হুসাইন মুহাম্মাদ খানকে স্থলাভিষিক্ত করেন। এছাড়াও যখন হাজী আহমাদের দুই ছেলে – রংপুর থেকে সৈয়দ আহমাদ ও পাটনা থেকে জৈনুদ্দিন আহমাদ মুর্শিদাবাদ এসে নবাবের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলে নবাব তা উপেক্ষা করেন। অন্যদিকে হাজী আহমাদের বিরুদ্ধে সহিংস পরিকল্পনাকারী মানুচার খান ও অন্যদের পরামর্শে, নবাব এই দুইজনকে বন্দী করেন। নবাবের জন্য হাজী আহমাদের প্রতি এই কঠোর নীতি বজায় রাখাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হত, তবে তার পক্ষে এটা করা সম্ভব ছিল না। যেহেতু তিনি দূষিত মানুষদের সংস্পর্শে ছিলেন, তার ভেতরে সেই মানসিক শক্তি ছিল না, আর মাত্রাতিরিক্ত স্নায়ুচাপে হাজী আহমাদের কাছে সব ফাঁস করে দিয়েছিলেন, এই আশায় যে পুরনো কর্মকর্তারা তার উপর পুনরায় আস্থা রাখবেন। এটা ছিল কৌশলগতভাবে থেকে তার দিক থেকে সবচেয়ে বড় ভুল। হাজী আহমাদ পরিস্থিতির গভীরতা আঁচ করতে পেরে কালক্ষেপণ না করে পাটনায় তার ভাইকে পুরো ঘটনার বিবরণ পাঠিয়ে দেন। প্রকৃতপক্ষে, সারফারাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি প্রায়ই এভাবে রং চড়িয়ে ও বিকৃতভাবে বিভিন্ন সংবাদ প্রেরণ করতেন মুর্শিদাবাদ থেকে। এভাবে হাজী আহমাদ বন্ধুত্বের পোশাকে মেতে ওঠেন তার পৃষ্ঠপোষকের বিরুদ্ধে নষ্টামির ঘৃণ্য খেলায়। আলীবর্দীর গুণকীর্তন গাওয়া ওয়াফা ভ্রান্তভাবে বলেছেন যে হাজী আহমাদ সারফারাজের সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন একাধিকবার সারফারাজ কর্তৃক অপমানিত হওয়ার পরও।
পাটনায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে আলীবর্দীর চেষ্টা
আলীবর্দী বুঝতে পেরেছিলেন যে সারফারাজের সঙ্গে তার সংঘর্ষ অনিবার্য, আর তাই পাটনায় তার অবস্থান সুদৃঢ় করতে দিল্লি দরবার থেকে তার অনুমোদন প্রয়োজন। এই চিন্তা থেকে তিনি কেন্দ্রীয় দরবারে সারফারাজের উকিল যুগল কিশোরকে চিঠি লিখে নিশ্চিত করেন যে তিনিই বিহারের সরকারে বহাল রয়েছেন কি না, মোটামুটি নিশ্চিত ও দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়ার পর তিনি মুর্শিদাবাদের সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেন। কিন্তু আলীবর্দী আর যুগল কিশোরের মধ্যে বনিবনা হয়নি আর যুগল কিশোর সারফারাজকে চিঠিও দিয়েছিলেন এই ব্যাপারে। আলীবর্দীর বিশ্বাসঘাতকতার খবর পেয়ে, সারফারাজ আলীবর্দী ও হাজী আহমাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হন।
সারফারাজ নিশ্চিত হলেন বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে
এরপর সারফারাজ হাজী আহমাদকে অপমানিত করার চেষ্টা করেন হাজী আহমাদের নাতনি ও আতাউল্লাহ খানের মেয়ের সঙ্গে জৈনুদ্দিনের ছেলে মির্জা মুহাম্মাদের (সিরাজ-উদ-দৌলা) বিয়ের সম্পর্ক ভেঙে, তরুণী বধূকে তার নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এছাড়াও তিনি বিহারের রাজস্ব নিয়ে খুঁটিনাটি সব তথ্য নিতে থাকেন আর সুজাউদ্দিনের সময় থেকে আলীবর্দীর সঙ্গে থাকা সৈন্যদের ডেকে পাঠান। যেসব সৈন্য দ্বিধাগ্রস্ত ছিল ফেরত আসার ব্যাপারে, তাদের সুজাউদ্দিনের সুবাহদারির শাসনের শুরু থেকে পেয়ে আসা সমস্ত অনুদান ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হল। এই সমস্ত ঘটনার পুরো বর্ণনা হাজী আহমাদ পাঠিয়েছিলেন তার ভাইয়ের কাছে আর তার ছেলে সৈয়দ আহমাদ খানও এর সত্যতা নিশ্চিত করেছিলেন।
আলীবর্দীর বাংলার মসনদের প্রতি দৃষ্টি
ইউসুফ আলী লিখছেন যে তাকে আলীবর্দী ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন যে তার নিজের কোনো ইচ্ছেই ছিল না সারফারাজের বিরোধিতা করার, কিন্তু তিনি পরিচালিত হয়েছিলেন তার ভাই হাজী আহমাদ আর ভাতিজা সৈয়দ আহমাদের প্ররোচনায়। তবে এটা আংশিক বর্ণনা আর আলীবর্দীর পরবর্তী কার্যক্রমের সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণও নয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে হাজী আহমাদের প্ররোচনা যথেষ্ট প্রভাব রেখেছিল তার ভাইয়ের উপর; তবে এটা ভেবে নেওয়া ভুল হবে যে আলীবর্দী তার ভাইয়ের হাতের পুতুল ছিলেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আলীবর্দীর উচ্চাশা এই প্রক্রিয়ার একটি বড় ব্যাপার ছিল। তিনি অবশ্যই বাংলার সুবাহদারির প্রতি লালায়িত হয়েছিলেন আর তার জন্য তিনি নানা ধরনের পরিকল্পনা করেছিলেন যথেষ্ট দক্ষতা আর সতর্কতার সঙ্গে।
বাংলায় যাত্রার আগে আলীবর্দীর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা
সম্রাটের দরবারে আলীবর্দীর এক বন্ধু ছিলেন ইসহাক খান, যার উপাধি ছিল মুতামান-উদ-দৌলা। সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ তার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন, ফলে সুনজরে ছিলেন। আলীবর্দী তাকে ব্যক্তিগত চিঠিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সনদের অনুমোদনের জন্য লেখেন, যার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় কোষাগারে এক কোটি রুপির উপহারের পাশাপাশি বার্ষিক এক কোটি রুপির রাজস্ব আর সারফারাজের কাছ থেকে যতটা সম্পদ কেড়ে নিতে পারেন, তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আরেকটি চিঠিতে তিনি অনুরোধ করেন বাংলার মসনদের অধিকারের লড়াইয়ের জন্য সম্রাটের অনুমোদনের। অভীষ্টের দিকে প্রথম সুযোগ কাজে লাগাতে আর নিজেকে প্রস্তুত রাখতে, তিনি প্রথমে তার দলকে ভোজপুরের অসন্তুষ্ট ও কুখ্যাত জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করার চাতুরীর আশ্রয় নেন। ১৭৪০ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি, তিনি বাংলার সরকার গঠনের জন্য সারফারাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমোদন পেলেন দিল্লি থেকে। এরপর তিনি সময় পেলেন বাংলার দিকে যাত্রা করার, বিখ্যাত ও বিশ্বাসী জ্যোতিষীর নির্ধারিত সময়ে, আর গোপনে মুর্শিদাবাদে তার বন্ধু জগৎ শেঠ ফতেহচাঁদকে সংবাদ পাঠালেন তার বাংলার সরকারের পতন ঘটানোর অভিসন্ধি জানিয়ে।
আলীবর্দীর পাটনা ত্যাগ
১৭৪০ সালের মার্চের শেষদিকে আলীবর্দী ভোজপুরে যাওয়ার অজুহাতে পাটনা ত্যাগ করেন আর প্রথমে ওয়ারিস খানের দিঘীর কাছে তাঁবু ফেলেন। তিনি পাটনায় জৈনুদ্দিনকে তার প্রতিনিধি হিসেবে রেখে যান আর ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের বাবা সৈয়দ হিদায়াত আলী খানকে সেরেস ও কোটম্বাহের পরগণাগুলো (গয়া জেলায়) দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। হিদায়াত আলী পাটনা ছেড়ে যাওয়ার দুইদিন পর আলীবর্দী মুর্শিদাবাদ যাওয়ার লক্ষ্যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন জৈনুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখতে, আর পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। তার সৈন্যদের বিশ্বস্ততা পরীক্ষা করতে তিনি সমস্ত প্রধান হিন্দু ও মুসলিম সেনাপতিদের তলব করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুস্তাফা খান, শামশির খান, উমর খান, রাহম খান, সারান্দাজ খান, শেখ মাসুম, শেখ জাহাঙ্গীর খান, জুলফিকার খান, ছেদন হাজারি, বায়ার সিং ও অন্যরা। তিনি তাদের সামনে দুজন ধার্মিক ব্যক্তিকে আনেন, একজন মুসলিম যার হাতে কুরআন আর অন্যজন ব্রাহ্মণ, যার ডান হাতে গঙ্গাজল আর অন্য হাতে পবিত্র তুলসির ডাল। এগুলো নিয়ে, তিনি ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে মুসলমানদের কুরআন ছুঁয়ে শপথ নিতে বলেন যে তারা তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, আর হিন্দুদেরও একই শপথ নিতে বলেন গঙ্গাজল আর তুলসি ছুঁয়ে। তার মুসলমান ও হিন্দু সেনাপতিরা শপথ নেন। তারপর আলীবর্দী সারফারাজের বিরুদ্ধে তার পরিকল্পনার কথা সবাইকে বলেন, এর ফলে কয়েকজন চমকে উঠলেও তাদের সিদ্ধান্ত বদল করেন, কারণ তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। গভীর রাতের শুরুতেই এই সভা ভঙ্গ হয়।
রাজমহলের পাহাড় ডিঙিয়ে আসা
পরের দিন ভোরবেলায় আলীবর্দী পাটনা শহরের পূর্বদিকে জাফর খানের বাগানে চলে আসেন, আর সাত থেকে আট হাজার ঘোড়সওয়ার, প্রচুর পদাতিক সৈন্য আর ভারী কামান নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে যুদ্ধযাত্রা আরম্ভ করেন। দ্রুত তারা বাংলার সীমান্তের কাছে কোলগং/কোলগঞ্জ (বর্তমানে কাহালগাঁও, যেখানে লেখকের জীবদ্দশায় ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে লুপ লাইন ছিল, এখন ইস্টার্ন রেলওয়ের ব্রড গেজ লুপ লাইন রয়েছে) এসে পৌঁছায়, যেখানে প্রকৃতিই বাংলাকে বাইরের দখলদার থেকে রক্ষার প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছে। একদিকে ছিল রাজমহলের দুর্ভেদ্য পাহাড়সারি, যা দক্ষিণে ৮০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে সাঁওতাল পরগণা ও বীরভূমে গিয়ে শেষ হয়েছে আর অন্যদিকে, প্রমত্তা গঙ্গা দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেছে সাক্রিগলি গ্রামের (সাহেবগঞ্জ স্টেশন থেকে ছয় মাইল পূর্বদিকে, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া রেলওয়ে লুপ লাইনে) নিচ থেকে, আর এর পশ্চিম ধার ধরে বাংলার দিকে সড়ক চলে গিয়েছে। কোলগঞ্জ/কোলগং থেকে শাহাবাদ ও তেলিয়াগড়ি হয়ে দুটো পথ রয়েছে গিরিপথ ধরে, যেগুলোর একটির থেকে অন্যটির দূরত্ব সাড়ে তিন মাইল, আর এই পথগুলোকে বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করা হত। পাহাড় আর গঙ্গা পর্যন্ত গিরিপথ আগলে ছিল তেলিয়াগড়ি দুর্গ, যার ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যায় সাহেবগঞ্জ থেকে সাত মাইল পশ্চিমে। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এটা সেসময়ে বাংলার গ্যালিপলি হয়ে উঠেছিল। সৈন্যদের একটি গ্যারিসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল দুর্গে আর নবাবের থেকে অনুমতি ছাড়া কেউই এই দুর্গ অতিক্রম করতে পারত না। এ কারণেই বাংলার দিকে যুদ্ধযাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না।
এই যাত্রার খবরে সারফারাজের অজ্ঞতা
কিন্তু আলীবর্দী তার উদ্দেশ্য থেকে সরে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। তিনি তার সহজাত চতুরতায় এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায়ও বের করেন। পাশের উপত্যকায় বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে তিনি অপেক্ষা করেন আর তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মুস্তাফা খানকে ১০০ অশ্বারোহী নিয়ে সারফারাজের অনুমতিপত্রসহ পাঠিয়ে দেন দুর্গে প্রবেশের জন্য। অনুমতিপত্রও আলীবর্দীর ছিল না, তিনি (আলীবর্দী) অন্য আরেকজনের অনুমতিপত্র কোনোভাবে জোগাড় করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুস্তাফা খান দুর্গে অন্তত ২০০ বন্দুকবাজ (মাস্কেটিয়ার) সেনাকে তার দলে ভেড়াবেন আর দামামা বাজিয়ে আলীবর্দীর বাকি সৈন্যদের এগিয়ে আসার জন্য সংকেত দেবেন। মুস্তাফা খান নিজের মতো করেই সবকিছু সামলে নিলেন, দুর্গে অবস্থানরত সৈন্যরাও বাধ্য হল আলীবর্দী বাকি সৈন্য নিয়ে দুর্গে এসে পৌঁছানোর আগেই আত্মসমর্পণ করতে। এরপর কোনো বাধা ছাড়াই আলীবর্দী আকবারনগর চাকলায় (রাজমহলে) প্রবেশ করেন। সারফারাজ তখনও আলীবর্দীর এই যাত্রা সম্পর্কে জানতেন না, কারণ তিনি হাজী আহমাদ ও তার জামাতা, রাজমহলের ফৌজদার আতাউল্লাহ খানের পরামর্শে চলছিলেন। আর তারা বাংলায় খবর আসা-যাওয়ার নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন আলীবর্দীর রাজমহলে আসা পর্যন্ত।
রাজমহল থেকে সারফারাজকে আলীবর্দীর চিঠি
জগৎ শেঠ ফতেহচাঁদকে আলীবর্দীর প্রতিনিধির মাধ্যমে পাঠানো চিঠি এবারে নবাবের কাছে উপস্থাপন করা হয় আলীবর্দীর পরামর্শে। চিঠির লেখা থেকে জগৎ শেঠ হিসেব করেছিলেন যে তার বন্ধু ততক্ষণে তেলিয়াগড়ি পেরিয়ে গেছেন আর মুর্শিদাবাদে চার থেকে পাঁচদিনের ভেতরে পৌঁছে যাবেন; আর সারফারাজের কাছে তার অভিসন্ধি প্রকাশ হয়ে গেলেও কোনোভাবেই তার অবস্থানের পরিবর্তন হবে না। তাই অস্বস্তির ও ভয়ের ভান করে তার কাছে পাঠানো আলীবর্দীর চিঠি ও নবাবকে সরাসরি উদ্দেশ্য করে লেখা আরেকটি চিঠি তিনি নিজহাতে সারফারাজের হাতে দেন। সারফারাজের প্রকাশ্য বিরোধিতার আগে তার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও ভাই হাজী আহমাদসহ পরিবারের অন্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি লেখেন : আমার ভাই, হাজী আহমাদের উপর প্রচুর চাপ প্রয়োগের পর, আমাদের পরিবারের সম্মান ও পবিত্রতার দিকে আক্রমণ করা হয়েছে। এই পরিবারকে আরও অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে, আপনার ভৃত্য, মনে কেবল আনুগত্য আর বিশ্বস্ততা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি ছাড়া এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। আপনার এই ভৃত্য আশা করে, আপনি হাজী আহমাদকে তার পরিবার ও আত্মীয়দের নিয়ে আমার কাছে আসার অনুমতি দিবেন।
সারফারাজের বিস্ময়
আলীবর্দীর এই চিঠি সারফারাজের জন্য বিস্ময়কর ছিল। হাজী আহমাদকে নিয়ে কী করবেন, তা তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি দ্রুত তাকে বন্দী করলেন। কিন্তু এতে সমস্যা সমাধা হল না। তিনি তার কর্তব্য নির্ধারণ করতে তার সেনাপতিদের ডেকে পাঠালেন তাদের মতামত জানতে। হাজী আহমাদকে সভার আগে ডেকে তিরস্কৃত করা হয়, কিন্তু তিনি অনুনয় করে বলেন যে তিনি আলীবর্দীর শিবিরে পৌঁছেই তাকে অনুরোধ করবেন জলদি পাটনা ফিরে যেতে। সারফারাজের সেনাপতিরা দু-ধরনের মতে বিভক্ত হয়ে পড়েন শুরুতে। সুজাউদ্দিন ও সারফারাজের প্রতি অনুগত, অভিজ্ঞ ও সাহসী মুহাম্মাদ গাউস খান বলেন যে হাজী আহমাদকে বন্দী রেখে তেমন কোনো লাভ নেই, কারণ এতে করে আলীবর্দীর অগ্রযাত্রা থামবে না, আর তার বাহিনীতে ভাই হাজী আহমাদের উপস্থিতি খুবই অল্প শক্তি যোগ করবে।
হাজী আহমাদকে ভাইয়ের কাছে যাওয়ার অনুমতি প্রদান
মুহাম্মাদ গাউসের মতে সায় দেন অনেকেই, তাদের মধ্যে আলমচাঁদ ও জগৎ শেঠ ফতেহচাঁদও ছিলেন, যারা বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ও পরোক্ষভাবে আলীবর্দী ও হাজী আহমাদের উদ্যোগে সহায়তা করে আসছিলেন। এরপর হাজী আহমাদকে পরিবার ও অনুসারী নিয়ে তার ভাইয়ের কাছে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
গাউস খানের মতামত কার্যত উপেক্ষাই করা হয়েছিল। সারফারাজ হাজী আহমাদকে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেন। হাজী আহমাদ যথেষ্ট চতুর ছিলেন, তার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাদের মনোভাব প্রকাশের ব্যাপারে। তিনি জানতেন কীভাবে শিকারী কুকুরসহ শিকারীর থেকে খরগোশ পালায়। তাই তিনি যাত্রার মধ্যেই নবাবকে বিভ্রান্ত করতে তার কাছে চিঠি পাঠান যে আলীবর্দী আগের মতোই বিশ্বস্ত আছেন, আর নবাবের উচিত হবে না তার ভৃত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা, বরং তার উচিত আলীবর্দীকে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দিয়ে তার অবস্থান বর্ণনা করার। তিনি খানিকটা ইঙ্গিতও দেন যে যদি নবাব তার অনুরোধ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে অন্যদের পরামর্শে আলীবর্দীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন, তাহলে আলীবর্দী হতাশ হয়ে নিজেকে রক্ষার জন্য যে-কোনো কিছু করে বসতে পারেন, যে-লজ্জা তাকে এই জীবনে ও পরজীবনেও তাড়িয়ে বেড়াবে।
আলীবর্দীর বিরুদ্ধে সারফারাজের যাত্রা
হাজী আহমাদের এই ভ্রান্ত নিশ্চয়তায় বিভ্রান্ত হননি সারফারাজ বা তার কর্মকর্তারা। তারা অনেক ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্তে আসলেন যে আলীবর্দীর এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য গুরুতর শাস্তি পাওনা হয়ে গিয়েছে। সারফারাজ তার আলসেমি ছেড়ে জেগে উঠলেন। হাজী আহমাদের প্রতি প্রবল শত্রুভাবাপন্ন মর্দান আলী খানের (সুজাউদ্দিনের সেনাবাহিনীর বকশি) প্ররোচনায়, তিনি নিজেই আলীবর্দীর মুখোমুখি হতে চারহাজার অশ্বারোহী আর অগুণতি পদাতিক সৈন্য নিয়ে রওনা হলেন ১৭৪০ সালের ৬ এপ্রিল, বুধবারে, আর মুর্শিদাবাদের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন যৌথভাবে তার ছেলে হাফিজুল্লাহ, যার উপাধি ছিল মির্জা আমানি আর ফৌজদার ইয়াসিন খানের উপরে। নবাবের বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সেনাপতিরা ছিলেন গাজনাফার হোসেন খান ও মুহাম্মাদ তকি খানের ছেলে (দুজনেই নবাবের জামাতা), মীর মুহাম্মাদ বাকির খান, মির্জা মুহাম্মাদ ইরাজ খান, মীর কামাল, মীর গাদাই, মীর হায়দার শাহ, মীর দিলির শাহ, বাজি (বিজয়?) সিং, রাজা গান্ধর্ব সিং, শামশির খান কুরেশি (সিলেটের ফৌজদার), সুজা কুলি খান (হুগলির ফৌজদার), মীর হাবিব, মর্দান আলী খান ও অন্যরা।
নবাবের বাহমানিয়া হয়ে কোমরায় আগমন
মুর্শিদাবাদের উত্তরে গিয়ে, যেটাকে এখন আমরা জিয়াগঞ্জ-জঙ্গীপুর সড়ক বলি, সারফারাজ সেখানের বাহমানিয়ায় গিয়ে পৌছলেন প্রথম দিনে, দ্বিতীয় দিনে সরাই দেওয়ানে (দেওয়ানসরাই), আর তৃতীয় দিনে কোমরায় গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন, তার সৈন্যদের শক্তি পরীক্ষা করতে। সেখানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন তার পুরনো কিন্তু হাজী আহমাদের দলে ভিড়ে-যাওয়া বিশ্বাসঘাতক কর্মকর্তারা গোলার বদলে ইট আর বন্দুকের ভেতর আবর্জনা রেখে দিয়েছে। গোলন্দাজ বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক (তোপখানার অধ্যক্ষ) ও হাজী আহমাদের আত্মীয় শাহরিয়ার খানকে বরখাস্ত করা হয় আর সেখানে পর্তুগিজ চিকিৎসক অ্যান্টনির ছেলে পাঞ্চোকে নিয়োগ করা হয়।
আলীবর্দী ও সারফারাজের কপট সমঝোতা
নবাব কোমরায় কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়েছিলেন তার দূতদের থেকে পরিস্থিতির খবরের জন্য। সুন্নাত নামের এক খোজা, আর হুগলির ফৌজদার সুজা কুলি খানকে তিনি দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন আলীবর্দীর অভিসন্ধি জানতে। আলীবর্দীর শিবির থেকে তারা প্রতারণার শিকার হয়ে আলীবর্দীর চর হাকিম মুহাম্মাদ আলী খানকে নিয়ে ফিরে আসেন, যিনি সারফারাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন আলীবর্দী এখনও তার বিশ্বস্ত ভৃত্যই রয়ে গেছেন, তিনি নবাবের পরিবারের কাছে ঋণ স্বীকার করেন আর তার অন্তরে তার সরকারের উন্নতি ছাড়া আর কোনো চিন্তার ঠাঁই নেই। তারা নবাবকে আরও জানান যে, আলীবর্দী নবাবের কাছে দুটো আরজিও পেশ করেছেন – প্রথমটি হল নবাব সুজাউদ্দিনের নির্দেশে যেসব সৈন্যদের নিয়োগ করা হয়েছিল তাদের বকেয়া পরিশোধের জন্য সাত লক্ষ রুপি আর দ্বিতীয়টি হাজী আহমাদ বা তার পরিবারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারকারী মর্দান আলী খান, মীর মুর্তাজা, হাজী লুৎফ আলী খান ও মুহাম্মাদ গাউস খানের পদচ্যুতি, নয়তো নবাব তাকে অনুমতি দিক নবাবের অনুগ্রহের জন্য তারা যেন খোলামাঠে তার সঙ্গে লড়াই করে। সারফারাজের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা পোক্ত করতে আলীবর্দী কুরআন ছুঁয়ে শপথ নেন, বা রিয়াজের লেখক যেমন বলেছেন, তিনি প্রয়োজনে পরদিন সকালে হাতজোড় করে তার ক্ষমা ভিক্ষা করবেন। নবাব আবারও ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত হলেন, প্রধান খানসামাকে পরদিন ভোজের আয়োজন করারও নির্দেশ দিলেন। কিন্তু মুহাম্মাদ গাউস খান, মীর শারফুদ্দিন, মর্দান আলী খানসহ নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত অন্য সেনাপতিরা তাকে আলীবর্দীর দ্বিচারিতা বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন, আর ধোঁয়াশার ভেতর দিয়েই সমঝোতা-পর্ব শেষ হয়।
সারফারাজের সেনাপতিরা সঠিক পরামর্শই দিয়েছিলেন। আলীবর্দী কখনোই মৈত্রিতায় নিষ্পত্তি চাননি, যদিও ইউসুফ আলী, গোলাম হোসেন ও মুহাম্মাদ ওয়াফার বর্ণনায় তা বলা হয়েছে। সমস্ত আলোচনাই ছিল বন্ধুত্বের আড়ালে প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন করে সারফারাজকে আক্রমণের জন্য নিজেকে উপযুক্তভাবে প্রস্তুত করার সময় নিতে। তিনি তাড়াহুড়ো না করে খুব হিসেব করে চলছিলেন এই বিপজ্জনক খেলায়। প্রকৃতপক্ষে তার লক্ষ্য বাংলার মসনদই ছিল।
সূতির কাছে আলীবর্দীর শিবিরের দিকে সারফারাজের এগিয়ে যাওয়া
আকবারনগর চাকলার (রাজমহল) সীমানা থেকে আরও এগিয়ে, আলীবর্দী তার শিবির স্থাপন করেন সূতির কাছে আওরাঙ্গাবাদ থেকে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে চরকা বালিয়াঘাটা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। এটা শুনে সারফারাজ কোমরা থেকে নদীর পূর্বতীরে গিরিয়ার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু গাউস খান আরও এগিয়ে গিয়ে নদী পেরিয়ে আলীবর্দীর শিবির থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে শিবির স্থাপন করেন। দুই পক্ষেরই সৈন্যরা একে অন্যকে প্ররোচিত করতে থাকে আক্রমণের জন্য। গাউস খান, মর্দান আলী খান ও তাদের বন্ধুরা গোপনে আলীবর্দীর কিছু সেনাপতির সঙ্গে আলোচনা চালাতে থাকেন, তাদের পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে দলে টানার চেষ্টায়। একইভাবে হাজী আহমাদ, জগৎ শেঠ ফতেহচাঁদসহ অন্যরা সারফারাজের সেনাদলের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ রোপণের চেষ্টা চালিয়ে আলীবর্দীর দলে টানার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন
দুই দলের সামরিক শক্তি
দুই দলেরই সৈন্যসংখ্যা প্রায় সমান ছিল প্রায় ৩০ হাজার (২০ হাজার পদাতিক ও ১০ হাজার ঘোড়সওয়ার)। কিন্তু আলীবর্দীর ঘোড়সওয়ার দলে ছিল তিন হাজার বীর আফগান আর বিহারে নিয়োজিত তার পদাতিক সেনারা সারফারাজ খানের সেনাদের (যারা বেশিরভাগই ছিল বাংলার অধিবাসী) থেকে শারীরিক দিক থেকে শক্তিশালী ছিল। সারফারাজের কাছে বিশটি কামান ছিল আর আলীবর্দীরও কাছাকাছি সংখ্যার কামান ছিল।
সারফারাজের বিরুদ্ধে আলীবর্দীর তিনটি দলের অগ্রসর হওয়া
আলীবর্দী সারফারাজকে তিনদিক দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, আর তাই তার সৈন্যদের তিনটি আলাদা ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। গাউস খান ও মীর শারফুদ্দিনের বিরুদ্ধে নন্দলাল নামের এক সাহসী সেনাপতিকে পাঠান। তিনি নিজের দলসহ অন্য দুটো দলকেও ভাগীরথী নদী পার করেন, যে দলগুলো তৈরি হয়েছিল মূলত আফগান ও বাহেলিয়া বন্দুকবাজদের (মাস্কেটিয়ার) নিয়ে। নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খানের অধীনে, শামশির খান, আবদুল আলী খানসহ একদল রাতের আঁধারে সারফারাজের সেনা-সমাবেশের পেছনদিকে অবস্থান নেয় (৯ এপ্রিল ১৭৪০)। আলীবর্দী রাত দুটোয় অন্যদের নিয়ে সারফারাজের শিবিরের দিকে যাত্রা শুরু করেন, পথে কিছু সময় রাজশাহীর জমিদার রাজা রমাকান্তের লোকেরা পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।
গিরিয়ার যুদ্ধ, ১০ এপ্রিল ১৭৪০
সারফারাজের শিবিরের সামনে এসে প্রথমে আলীবর্দী আক্রমণ শুরু করেন গুলি ছুড়ে, আর পূর্ব পরিকল্পনামতো পেছন দিক থেকে নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খানের সৈন্যরা আক্রমণ শুরু করে এবং নন্দলালও গাউস খানের সেনাদের সঙ্গে লড়তে শুরু করেন। ভোরবেলা নামাজ শেষ করেই সারফারাজ কোরআন হাতে নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেন ও তির ছোড়ার নির্দেশ দেন। এভাবেই ১০ এপ্রিল, ১৭৪০ সালের ভোরে গিরিয়ার কাছে ভয়ংকর লড়াই হয়েছিল।
নবাবের বাহিনীতে প্রচুর হতাহত
সারফারাজের মুখ্য সেনাপতিদের অনেকেই—বাকির আলী খান উপাধিধারী মীর মুহাম্মাদের ভাই মীর কামাল (সুজাউদ্দিনের ভাতিজা), মীর গদাই, মীর আহমাদ, মীর সিরাজুদ্দিন, হাজী লুৎফ আলী খান, কুরবান আলী খান আর সারফারাজের বকশি মির্জা ইরাজ খানের তরুণ অবিবাহিত সন্তান যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান। সৈয়দ হোসেন খান, শাহামাত আলী খান, নাসরাতুল্লাহ খানসহ অন্যান্য সেনাপতিরাও মারাত্মক আহত হন। রায়রায়ান আলমচাঁদও আহত হন ও মুর্শিদাবাদে পালিয়ে যান। আলীবর্দী বাংলার মসনদে বসার পরপরই তিনি মারা যান। এই ঘটনাগুলো সারফারাজের বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সেনাবাহিনীর অগ্রভাগের পরিচালক মর্দান আলী খান ও অন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেলে, নবাবের হাতির চারপাশ ঘিরে তার জর্জিয়া ও আবিসিনিয়া থেকে আসা দাসরাই কেবল ছিল।
সারফারাজের বীরের মতো লড়াই আর মৃত্যু
এই সংকটপূর্ণ সময়ে হাতির মাহুত তাকে বীরভূমের জমিদার বদি-উজ-জামানের কাছে নিতে চাইল। কিন্তু সারফারাজ মাহুতের পিঠ চাপড়ে উত্তর দিলেন, আমি এই কুকুরগুলো থেকে পালিয়ে যাব না। এভাবেই তিনি বীরের মতো লড়তে এগিয়ে গেলেন, রকেট, গোলা, তির আর মাস্কেট-বন্দুকের গোলাগুলির ভেতর। হঠাৎ করেই একটি মাস্কেট থেকে ছোড়া গুলি তার কপালে এসে বিদ্ধ হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই মিক দাম্বারে (হাওদায়) এলিয়ে পড়েন ও মৃত্যুবরণ করেন বীরের মতো, ছত্রিশ বছর বয়সে। এই দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গেই, মীর হাবিব, সিলেটের ফৌজদার শামশির খান কুরেশি, রাজা গান্ধর্বের সঙ্গে আরও যারা দূরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন, কাপুরুষের মতো দৌড়ে পালিয়ে গেলেন; আর মীর হায়দার শাহ ও খাজা বসন্ত মুর্শিদাবাদের দিকে চার চাকার ঘোড়ার গাড়িতে বা রথে চড়ে পালালেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নবাবের মৃতদেহ নিয়ে মুর্শিদাবাদে পালিয়ে আসে তার বিশ্বস্ত মাহুত আর রাতের অন্ধকারে গোপনে তাকে তারই নুক্তাখালির প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে সমাহিত করেন তার ছেলে হাফিজুল্লাহ খান ও মুর্শিদাবাদের ফৌজদার ইয়াসিন খান।
দুই সন্তানসহ গাউস খান ও মীর দিলিরের সাহসিকতা ও মৃত্যু
এদিকে, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে, গাউস খান আর মীর শারফুদ্দিন নন্দলালকে পরাজিত ও হত্যা করে ফেলেছে। সারফারাজের মৃত্যুর খবর তাদের কানে না- যাওয়ায়, গাউস খান একজন অশ্বারোহীকে নবাবের শিবিরের দিকে পাঠালেন জয়ের খবর দিয়ে আর পরামর্শ দিয়েছিলেন এবারে একসঙ্গে শত্রুর উপর হামলার। কিন্তু ঘোড়সওয়ার একাকী ফিরে আসে তাদের শাসকের মৃত্যুর খবর নিয়ে। এই খবর প্রচণ্ড বেদনাদায়ক ছিল তার বিশ্বস্ত সেনাপতিদের জন্য। কিন্তু তিনি অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন; অন্যান্য নীচু মানসিকতার পলায়নপর প্রবৃত্তির মানুষগুলোর মতো নয়, যারা নবাবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, নবাবের মৃতদেহের কী হল তার চিন্তা না করেই। তিনি একজন বীরযোদ্ধার মতোই যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তার শাসকের শত্রুর কাছে নতি স্বীকার না করে। তিনি মুহাম্মাদ কুত্ব ও মুহাম্মাদ পীর—তার দুই সন্তানকে লড়তে উৎসাহিত করেন, যারা তার মতোই বীর ও সাহসী ছিলেন নতুন করে লড়াই করতে। তাদের সঙ্গে অল্পকিছু মানুষ ছিল যারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই হাতে-গোনা কিছু সঙ্গী নিয়ে তিনি ভয়ংকরভাবে আলীবর্দীর বাহিনীর উপর আক্রমণ করেন ও একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করেন ছেদন হাজারির বন্দুকবাজদের দুটো মাস্কেটের গুলিতে বিদ্ধ হওয়ার আগে। বাবার মতোই তার দুই ছেলেও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই মারা যান। সারফারাজের আরেক বিশ্বস্ত ও সাহসী সেনাপতি মীর দিলির, তার শাসককে রক্ষা করতে তার সঙ্গে থাকা মাত্র ১৬ জন সৈন্য নিয়ে শত্রুর সঙ্গে তুমুল লড়াই করেন।
মীর শারফুদ্দিন ও পাঞ্চোর শেষ ব্যর্থ চেষ্টা ও পাঞ্চোর মৃত্যু
মীর শারফুদ্দিন অল্পকিছু ঘোড়সওয়ার নিয়ে আলীবর্দীর দিকে এগিয়ে গেলেন ও দুইটি তির তার দিকে ছুড়ে দিলেন, যার একটি আলীবর্দীর হাতে থাকা ধনুকে আর অন্যটি ডান কাঁধে সামান্য ক্ষত সৃষ্টি করে। তিনি তার ধনুকের ছিলায় আবারও তির বসাতেই যাচ্ছিলেন, তখনই তার পুরনো দুই বন্ধু শেখ জাহানইয়ার ও মুহাম্মাদ জুলফিকার, আলীবর্দীর দুই সেনাপতি তাকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিরর্থক বলে তাকে বিরত করার চেষ্টা করেন। তারা তাকে প্রতিজ্ঞা করেন তার সম্মান অক্ষুণ্ণ ও বজায় থাকবে যদি তিনি যুদ্ধ পরিত্যাগ করেন। এরপর তিনি বীরভূমের দিকে ফিরে যান তার সঙ্গীদের নিয়ে। সারফারাজের গোলন্দাজ বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক পর্তুগিজ পাঞ্চো বীরত্বের সঙ্গে তখনও লড়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনিও আলীবর্দীর আফগান সেনাপতিদের হাতে নিহত হন।
সারফারাজের রাজপুত অধিনায়ক বিজয় সিং ও তার ছেলে জালিম সিংয়ের নায়কোচিত লড়াই
সারফারাজের রাজপুত অধিনায়ক বিজয় সিং বীরত্বের সঙ্গে নায়কোচিত লড়াই করেন এই দুঃসময়েও। তিনি সারফারাজের বাহিনীর কোমরায় পেছনে ফেলে আসা অংশের দায়িত্বে ছিলেন; কিন্তু তার প্রভুর মৃত্যুর খবরে তিনি বিচলিত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে অল্পকিছু অশ্বারোহী অনুচর নিয়ে আলীবর্দীর বাহিনীর ভেতরে ঢুকে পড়েন আর আলীবর্দীর হাতিকে বর্শার আঘাতে জর্জরিত করে তাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আলীবর্দীর নির্দেশে তার তোপখানার দারোগা তাকে গুলি করে হত্যা করে। তার নয় বছরের অসম সাহসী ছেলে তলোয়ার হাতে নিয়ে তার বাবার মৃতদেহকে আগলে রাখে। তার এই সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে আলীবর্দী তার সেনাদের বিজয় সিংয়ের মৃতদেহ ধরতে বারণ করেন ও পরে রাজপুত রীতি– নীতি মেনেই তার শেষকৃত্য পালন করতে দেওয়া হয়। অবক্ষয়ের এই সময়টাতেও রাজপুতদের এমন নায়কোচিত ও বীরত্বে ভরসা রাখতে পারতেন মুসলিম শাসকেরা।
গিরিয়ার যুদ্ধের পরপরই হাজী আহমাদকে মুর্শিদাবাদে প্রেরণ
গিরিয়ার জয় আলীবর্দীর কর্মজীবনে এক সন্ধিক্ষণ বলা যায়। গিরিয়া থেকে ২২ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভাগীরথীর পূর্বতীরে- তখনকার বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের পথে তাকে বাধা দেওয়ার মতো আর কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। বাংলার মসনদে বসা তখন তার জন্য কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। তিনি তাড়াহুড়ো করে তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করার মানুষ ছিলেন না। তিনি জানতেন পেয়ালা মুখে ওঠার আগে ফস্কে যাওয়ার অনেক আশঙ্কাও থাকে, আর তাই তিনি সাবধানী হয়ে তার অভীষ্টে পৌঁছাতে চাইছিলেন। সারফারাজের মৃত্যুর সংবাদে মুর্শিদাবাদ শহরের মানুষেরা দ্বিধাগ্রস্ত ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তাই গিরিয়ায় যুদ্ধজয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলীবর্দী হাজী আহমাদকে মুর্শিদাবাদ শহরের মানুষদের শান্ত করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আর সারফারাজের সরকারের সমস্ত বিভাগ ও প্রাসাদের সমস্ত কক্ষ পাহারা দিতে রাজধানীতে পাঠিয়ে দেন। হাফিজুল্লাহ, ইয়াসিন খান ও সারফারাজের জামাতা গাজনফর হোসেনের হাজী আহমাদ ও তার সৈন্যদের থেকে মুর্শিদাবাদ শহর রক্ষার উদ্যোগ ভেস্তে যায় সারফারাজের সৈন্যদের আর যুদ্ধে উৎসাহ না-থাকায়। ফলে তারা পরিশেষে আত্মসমর্পণ করেন। হাজী আহমাদ দামামা বাজিয়ে তার ভাইয়ের বিজয় ঘোষণার সঙ্গে যোগ করেন সবার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা ও নিরাপত্তার। আর ইয়াসিন খানের সহায়তায় সারফারাজ খানের সমস্ত কর্মকর্তা, সম্পদ আর হারেমের উপর কর্তৃত্ব অর্জন করেন।
আলীবর্দীর মুর্শিদাবাদে পদার্পণ
আলীবর্দী গিরিয়া থেকে একবারে মুর্শিদাবাদে আসেননি। তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে খানিক দূরে গোবরা নদীর তীরে তিনদিন অপেক্ষা করেন, যতক্ষণ-না তার আফগান ও বাহেলিয়া সৈন্যরা পুরোপুরি শহরের দখল নিয়ে নেয়। শহরে ঢুকেই আলীবর্দী তার ছলনাময় চাতুর্যের সাহায্যে নবাবের প্রতি তার নীচ আচরণের জন্য কপট ক্ষমা প্রার্থনা আর তার স্বজনদের সমবেদনা জানাতে গেলেন। এভাবে তিনি সারফারাজের বোন নাফিসা বেগমের কাছে গেলেন কপট অনুশোচনা দেখিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য। কিন্তু তার বক্তব্যের উত্তরে কোনো শব্দই ভেসে আসেনি নাফিসা বেগমের ঘর থেকে।
সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে আলীবর্দীর মসনদে আরোহণ
এরপর তিনি চিহিল সাতুনের (মুর্শিদ কুলি জাফর খানের আদেশে তৈরি চল্লিশ স্তম্ভের সভাকক্ষ) দিকে এগিয়ে গেলেন, যেখানে তিনি সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মসনদে বসলেন। দামামা, নাগাড়া বাজল আর শহরের সামরিক কর্মকর্তা ও সভ্যরা নতুন নবাবকে নজর উপহার দিয়ে গেলেন, যদিও সেটা তার প্রতি কোনোরকম আন্তরিকতা থেকে নয়, এটা ছিল শক্তিবলে যেটা তিনি অর্জন করেছেন, তার জন্য। তাদের অন্তরের অন্তস্তলে তিনি তার পৃষ্ঠপোষকের সন্তানের বিরুদ্ধে যা করেছেন সেটার জন্য তার প্রতি বিরক্তি আর ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।
আলীবর্দীর সারফারাজের পক্ষের লোকেদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগ
কিন্তু আলীবর্দী তার সহজাত বিচক্ষণতায় অসন্তোষ দূর করার সর্বাত্মক চেষ্টা করলেন। খাজা আবদুল করিম আমাদের জানাচ্ছেন যে, কাছে ও দূরের সবার সঙ্গে দয়া ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, অর্থের বিনিময়ে ও বিচক্ষণ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
সারফারাজের পরিবারকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান
সারফারাজের পরিবারের সদস্যদের ব্যয় নির্বাহের জন্যও তিনি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা করেছিলেন। নাফিসা বেগমকে তার ব্যক্তিগত সম্পদ রাখতে দেওয়া তো হয়ই, এছাড়াও মুর্শিদ কুলি খানের খাস তালুকের একটি অংশ দেওয়া হয় যা থেকে বার্ষিক এক লাখ টাকা আসত। ১৭৪১ সালের এপ্রিল মাসে নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, যাকে তিনি মায়ের সম্মান দিতেন ও তার গৃহস্থালির কাজের তদারকির পুরো কাজে তার উপর ভরসা করতেন। সারফারাজের বিবাহিত স্ত্রীদেরও (হারেমের স্ত্রীলোকেরা ছাড়া) সন্তানসহ ঢাকায় পাঠানো হয়। পরিবারের সমস্ত সদস্যদের মাসিক ব্যয় নির্বাহের জন্য মাসিক বরাদ্দও দেওয়া হয়, আলাদা করে যত্ন নেওয়া হয় সারফারাজের অবৈধ সন্তান আকা বাবার, যে কিনা তার বাবার মৃত্যুর দিনেই জন্মেছিল আর পরে নাফিসা বেগমের পালকপুত্র হিসেবে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু হাজী আহমাদ ও তার অনুসারীরা কৃতঘ্নতা ও অভব্যতা দেখিয়েছিল সারফারাজের হারেমের ১৫০০ নারীর দখল নিয়ে।
কর্মকর্তাদের বদল
আলীবর্দী তার প্রশাসন শুরু করেছিলেন প্রচুর অর্থ দিয়ে, কারণ তিনি মৃত নবাবের জমানো ৬৮ লক্ষ মতান্তরে ৭০ লক্ষ রুপি নগদ ও বিভিন্ন রত্ন, স্বর্ণ আর রুপোর বার মিলিয়ে পাঁচ কোটি রুপির সম্পদ হাতে পেয়েছিলেন। তিনি হাজী লুৎফ আলী, মানুচার খান ও মীর মুর্তাজার সম্পদও দখল করেছিলেন। তার পছন্দমতো প্রশাসন ঢেলে সাজাতে গিয়ে তিনি প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করেন। তার ভাতিজা ও জামাতা নাওয়াজিশ মুহাম্মাদকে (ঘষেটি বেগমের স্বামী) ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, টিপ্পেরা (ত্রিপুরা) ও সিলেটের সহকারী প্রশাসক পদে নিয়োগ করেন, আর তার সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেন হোসেন কুলি খানকে। কিন্তু দুজনেই বেশিরভাগ সময়ে মুর্শিদাবাদে থাকতেন, ফলে এই অংশের প্রশাসন সরাসরি চলে যায় হোসেন কুলি খানের দিওয়ান রায় গোকুলচাঁদের হাতে, যিনি যোগ্যতার সঙ্গে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতেন। আলীবর্দীর সবচেয়ে ছোট ভাতিজা জৈনুদ্দিন যার সঙ্গে তিনি তার মেয়ে আমিনা বেগমের (সিরাজ-উদ- দৌলার মা) বিয়ে করিয়েছিলেন, তাকে বিহারের সহ-প্রশাসকের পদে নিয়োজিত করেন। ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের চাচা ও আলীবর্দীর চাচাত ভাই আবদুল আলী খানকে সরিয়ে জৈনুদ্দিনকে তিরহুতের প্রশাসনে বসানো হয় বিহার ও বেসোক (বিসওয়াক) পরগণার রাজস্ব আদায়ের কাজের পাশাপাশি। কাশিম আলী খান, আলীবর্দীর শ্যালকের স্থলাভিষিক্ত হন মীর মুহাম্মাদ জাফর খান, পুরনো সেনাবাহিনীর বকশি হিসেবে; পরে তাকে রংপুরের ফৌজদার করা হয়, যেখানে তিনি তার কৃতিত্ব দেখান ও সম্পদও তৈরি করেন। নতুন সেনাবাহিনীর বকশি হিসেবে নিয়োগ করা হয় নাসরুল্লাহ বেগ খানকে, যিনি প্রদেশের বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। নবাবের তোপখানার অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খানের সহকারী হোসেন কুলি খানের চাচাত ভাই মির্জা মাজার আলী ওরফে হায়দার আলী খান; আর ঢাকার নাওয়ারাহ বা প্রাদেশিক নৌবহরের নামমাত্র তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন নতুন নবাবের শিশু নাতি মির্জা মুহাম্মাদ বা সিরাজ-উদ-দৌলা। সিরাজ-উদ-দৌলার ভাই মির্জা কাজিম, যাকে নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খান দত্তক নিয়েছিলেন নিজের সন্তান হিসেবে ও নামকরণ করেছিলেন একরামুদ্দৌলা পাদশাহ কুলি খান, তাকেও নামমাত্র ঢাকার সেনাবাহিনীর অধিনায়ক করা হয়েছিল। আলীবর্দীর সিংহাসনে বসার পরপরই প্রদেশের আগের দিওয়ান আলমচাঁদের মৃত্যু হলে রায়রায়ান উপাধি দিয়ে খালসা-দিওয়ান হিসেবে নিয়োজিত করা হয় চিন রায়কে, যিনি তার বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন ও আলীবর্দীর প্রশংসাভাজন হয়েছিলেন। আলীবর্দীর গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজের তদারকি করা দিওয়ান জানকিরামকে বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে দিওয়ান পদ দেওয়া হয়। আলীবর্দীর পুরনো অনুসারী গোলাম হোসেনকে প্রাসাদ সরকার (হাজিব) পদে মীর মুর্তাজার স্থলে, ও হাজী আহমাদের জামাতা আতাউল্লাহ খানকে সুজাউদ্দিনের সময় থেকে করে আসা রাজমহলের ফৌজদারির সঙ্গে ভাগলপুরেরও ফৌজদার করা হয়। আলীবর্দীর সত্তাই আল্লাহ ইয়ার খান, তার শ্যালক মীর জাফর আলী খান, ফখরুল্লাহ বেগ খান, নুরুল্লাহ বেগ খান, মুস্তাফা খান, ও অন্যান্যদের মসনর ও অন্যান্য পদ বিতরণ করা হয়।
আলীবর্দী সম্রাটের অনুমোদন কিনলেন ঘুস ও প্রতারণায়
এভাবে মুর্শিদাবাদে নিজের অবস্থান পোক্ত করে আলীবর্দী সম্রাট মুহাম্মাদ শাহের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রয়োজন বোধ করলেন সুবাহ বাংলায় তার একাধিপত্য বজায় রাখতে। কিন্তু দুটো কারণে তিনি তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একদিকে মুহাম্মাদ শাহ বাংলায় বিদ্রোহের খবরে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন আর বলা হয় নাদির শাহের আক্রমণের ফলে পুরো সাম্রাজ্য প্রবলভাবে আলোড়িত ও টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে দিল্লিতে আলীবর্দীর বন্ধু ও প্রধান সমর্থক ইসহাক খান মুতামান-উদ-দৌলার মৃত্যু, ১৭৪০ সালের ১৮ এপ্রিলে। তারপরও আলীবর্দী প্রত্যেকটি সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সম্রাটের মীর আতিশ (তোপখানার প্রধান) সাদুদ্দিনের মাধ্যমে তিনি সম্রাটের সামনে বিভিন্ন অজুহাত প্রদান করেন ও মৃত নবাবের সম্পদের থেকে পাওয়া একটি অংশ দেবার অঙ্গীকার করেন তার বাংলার সুবাহদারির নিশ্চিত করার বিনিময়ে। এই লোভনীয় প্রস্তাব মুহাম্মাদ শাহের পক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না, আর তিনি এই টোপ গিললেন। তিনি মুরিদ খানকে বাংলায় গিয়ে প্রতিশ্রুত অর্থ ও সঙ্গে সারফারাজের মৃত্যুর পর থেকে বকেয়া হয়ে থাকা রাজস্ব দিল্লিতে নিয়ে আসার দায়িত্ব প্রদান করেন। ধরে নিতে পারি মুরিদ খানের মুর্শিদাবাদে পদধূলি দেওয়ার কারণে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল, আলীবর্দী রাজমহলে তার সঙ্গে দেখা করেন এবং চল্লিশ লক্ষ রুপি নগদ ও ৭০ লক্ষ রুপির বিভিন্ন রত্ন, গয়না, সোনা ও রুপার তৈজসপত্র, দামী পোশাক, আর সারফারাজের সংগ্রহ থেকে প্রচুর হাতি ও ঘোড়া প্রদান করেন।
এছাড়াও তিনি আলাদা করে সম্রাটের জন্য তার তরফ থেকে পেশকাশ হিসেবে ১৪ লক্ষ রুপি, সঙ্গে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বার্ষিক রাজস্বের উদ্বৃত্ত হিসেবে এক কোটি রুপি প্রদান করেন। তিনি উজির কামরুদ্দিন খানকে তিন লক্ষ, বকশি আসাফ জাহ নিজাম-উল-মুলককে এক লক্ষ ও সম্রাটের দরবারের অন্যান্য সভ্যদেরও অল্পকিছু অর্থ প্রেরণ করেন। এপ্রিল মাসের শেষে মুরিদ খান ফিরে গেলে তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন আর সম্রাটের থেকে তার সুবাহদারি নিশ্চিতকরণের চিঠি হাতে পান, সুজা-উল-মুলক ও হুসাম-উদ-দৌলা (রাজ্যের নির্ভীক বীর ও সম্রাটের তরবারি) উপাধিসহ। নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খান, জৈনুদ্দিন, সৈয়দ আহমাদ ও আতাউল্লাহ যথাক্রমে শাহামত জং, হাইবাত জং, সাওলাত জং ও সাবেত জং উপাধি লাভ করেন এই সময়েই।
১৭৪০ সালের বাংলায় বিদ্রোহের মূল্যায়ন
১৭৩৯-৪০ সালের বাংলার বিদ্রোহ কেবল প্রদেশের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় নয়, মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ, যা এসময়ে আরও ধ্বংসাত্মক সব বিদ্রোহের সম্মুখীন হচ্ছিল। এটা আমাদের দেখায় সেসময়ের রাজনৈতিক বাতাবরণ চরম কলুষিত হয়ে পড়েছিল অধস্তনদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, বিশ্বাসঘাতকতায় আর অকৃতজ্ঞতা আর কৃতঘ্নতায়। সারফারাজের প্রতি আলীবর্দীর আচরণ অর্থাৎ প্রাথমিক জীবনে যার কাছ থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছিলেন, তার সন্তানের প্রতি এমন আচরণ অত্যন্ত জঘন্য। এমনকি গোলাম হোসেন, যিনি আলীবর্দীর পক্ষে সবসময় কথা বলেছেন, তিনিও এটাকে পূর্ণ সমর্থন দিতে ইতস্তত করেছেন। এই পাপের উপযুক্ত শাস্তি নেমে এসেছিল তার নাতি সিরাজ-উদ-দৌলার উপরেও, সারফারাজকে সিংহাসনচ্যুত করা একই বাহিনী সিরাজ-উদ-দৌলাকে উৎখাত করেছিল। বলা যেতে পারে পলাশীর যুদ্ধ ছিল ইতিহাসের ন্যায়বিচার, গিরিয়ার যুদ্ধের প্রত্যুত্তরে। মুহাম্মাদ শাহেরও তার অবস্থানে থেকে এ কাজ শোভা পায় না। ঘুস গ্রহণ করে ক্ষমতা দখলের এই কাজে সম্মতি প্রদান করা দিল্লি দরবারের জন্য অবশ্যই অসম্মানের ব্যাপার ছিল। এভাবেই, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও তার আশেপাশের কর্মকর্তারা যখন অর্থের ঝনঝনানির কাছে বিক্রি করে দেন নিজেদের, নৈতিক অবক্ষয়ে ডুবে গিয়ে—তার করুণ পতন অবশ্যম্ভাবীই ছিল।
আলীবর্দীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা
গিরিয়ার যুদ্ধ আলীবর্দীকে বাংলা ও বিহারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসকে পরিণত করলেও, বাংলা সুবাহর উপাঙ্গ হয়ে থাকা উড়িষ্যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরেই ছিল। সারফারাজের আরেক সন্তান মুহাম্মাদ তকি খানের মৃত্যুর পর শ্বশুর সুজাউদ্দিনের দেওয়া সহ-প্রশাসকের পদ থেকে উড়িষ্যার প্রশাসক হন রুস্তম জং (মুর্শিদ কুলি)। তিনি প্রথমে আলীবর্দীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে চান।
রুস্তম জং সারফারাজের মৃত্যুর বদলা নিতে বেরোলেন
কিন্তু তিনি তার ইস্পাহানি জামাতা মির্জা বাকার আর তার নিজের সাহসী স্ত্রী দুর্দানাহ বেগমের কথায় প্ররোচিত হয়ে সারফারাজের হত্যার বদলা নিতে আলীবর্দীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। রুস্তম জং তখন তার পৃষ্ঠপোষকের অনুমতির তোয়াক্কা না-করেই আলীবর্দীকে বাধা দেওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তার সেনাপতি ও সৈন্যদের নিয়ে এক সমাবেশ আহ্বান করে উদ্দীপনামূলক বক্তব্যে অনুরোধ করেন তার শাসক সারফারাজের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণিত আলীবর্দীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে। তিনি বলেন : আমার উদ্দেশ্য যেমন মহৎ, আমার অবস্থা তেমনি সংকটপূর্ণ। এখন এই অন্যায় যুদ্ধ সম্পর্কে আপনাদের অভিমত জ্ঞাত হওয়া আমার পক্ষে একান্ত সংগত। আপনারা যদি আমার পাশে দাঁড়াতে চান তবে সবাই মিলে একসঙ্গে অগ্রসর হয়ে লড়তে পারি। আর আপনাদের যদি অন্য অভিপ্রায় থাকে তবে আল্লাহর দোহাই, আপনারা তা জানিয়ে দিন, এবং যথাসময়ে জানিয়ে দিন যাতে সেই অনুসারে আমি কার্যব্যবস্থা গ্রহণ ও নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে পারি। ১৪৯ এই বক্তব্য আশানুরূপ প্রভাব ফেলে সৈন্যদের ভেতর। প্রধান সেনাপতি আবিদ আলী খান উপস্থিত সকলের পক্ষ থেকে জানান যে, আলীবর্দীর বিপক্ষে লড়াইয়ে তাদের বিশ্বস্ততার প্রতি আস্থা রাখতে।
কটক থেকে যুদ্ধযাত্রা শুরু
এরপর স্ত্রী দুর্দানাহ বেগম ও ছেলে ইয়াহিয়া খানকে মহানদী ও কাটজুরি (কাঠাজোড়ি) দুই নদীর মধ্যবর্তী এলাকার বড়বতী দুর্গে ১ সমস্ত সম্পদ দিয়ে, রুস্তম জং তার দুই জামাই- মির্জা বাকার খান ও আলাউদ্দিন মুহাম্মাদ খানকে শক্তিশালী সেনাবহরের সম্মুখভাগে রেখে কটক শহর ছাড়লেন ১৭৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে। বালাসোর (বালেশ্বর) শহর ও বড় বালাং (বুড়া বালাং) নদী পেরিয়ে, নদীর তীরেই বালেশ্বর শহর থেকে চার মাইল উত্তরে ফুলওয়ারির সমতল এলাকায় শিবির স্থাপন করলেন। এলাকাটি ঘনবন, ছোট ছোট শাখানদী আর খাড়া তীরের কারণে সবদিক দিয়েই প্রাকৃতিকভাবে নিরাপদ ছিল। তার অবস্থান দুর্ভেদ্য করতে তার শিবিরের চারপাশে বৃত্তাকারে ৩০০ কামান বসিয়েছিলেন, আর প্রতিরোধী দেয়াল তুলেছিলেন দুর্বল জায়গাগুলোতে।
উড়িষ্যায় আলীবর্দীর যুদ্ধযাত্রা
এর মধ্যেই আলীবর্দী প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম নিয়ে উড়িষ্যা অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত ও মৃত নবাবের আত্মীয়দের থেকে সেখানকার সরকার দখলের লড়াইয়ের লক্ষ্যে। সম্ভবত, রুস্তম জংয়ের সঙ্গে তার বোঝাপড়ার বন্ধুত্বপূর্ণ নিষ্পত্তির সময়ে, তিনি তার সৈন্যদের রুস্তম জংয়ের সেনাদলের বকশি ও হাজী আহমাদের জামাই মুখলিস আলী খানের মাধ্যমে বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। রুস্তম জংয়ের এগিয়ে আসার খবর পেয়ে তিনিও ১৭৪১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলা সরকারের দায়িত্ব হাজী আহমাদ ও নাওয়াজিশ মুহাম্মাদের (শাহামাত জং) দায়িত্বে রেখে তার ভাতিজা সৈয়দ আহামাদকে (মাহাম-উদ- দৌলা সাওলাত জং) সঙ্গে করে দশ বা বারো হাজার অশ্বারোহীর বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ১৫৮ তিনি দ্রুতলয়ে পথ পাড়ি দিয়ে মিদনাপুরে (মেদিনীপুর) এসে সেখানকার স্থানীয় জমিদারদের দলে ভেড়ান বিভিন্ন উপহারের বিনিময়ে ও জালাসোরের (জলেশ্বর) দিকে রওনা হয়ে যান। কিন্তু জলেশ্বরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুবর্ণলেখা নদী রাজঘাট দিয়ে পেরোনো বেশ কষ্টসাধ্য প্রমাণিত হয়, কারণ এলাকা পুরোটাই ছিল জঙ্গলে ঢাকা আর সেটার প্রহরায় ছিল চাওয়ার ও খণ্ডিতদের (মিশ্র ক্ষেত্রী বর্ণের মানুষ দুটোই) পুরো বাহিনী, যাদের নিয়োজিত করেছিলেন ময়ূরভঞ্জের রাজা জগদীশ্বর ভঞ্জ। রাজা আলীবর্দীকে সাহায্য তো করলেনই না, বরং তাকে বাধা দিলেন। আলীবর্দী জলদিই এই বিরোধিতা সামলে নিলেন গোলাগুলির সাহায্যে, আর নদী পেরিয়ে শিবির স্থাপন করলেন ফুলওয়ারির সমভূমির তিন মাইল দূরে, রামচন্দ্রপুরে। রুস্তম জংয়ের শিবিরের এত কাছে এসেও আলীবর্দী সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আক্রমণ করতে পারেননি রসদের ঘাটতির কারণে, মেদিনীপুর ও আশেপাশের জমিদারেরা চাহিদামাফিক পুরো রসদ দিতে অপারগ হওয়ায়। তারা যেটুকু পাঠাতে পেরেছিলেন, সেগুলোও পথেই ধরা পড়ে যায় উড়িষ্যার জমিদারদের হাতে; যারা রুস্তম জংয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসার কারণে সেগুলো আর গন্তব্যে মসনদের দখলদারের হাতে পড়তে দেননি। আসলেই আলীবর্দীর শিবিরে সমস্যা এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে তামাকের ব্যবসায়ীকেও জিনিসপত্র বিকিকিনি করতে হত হাতির পিঠে চড়ে, যেন আলীবর্দীর সৈন্যরা চড়াও হয়ে লুট না করতে পারে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে আলীবর্দী রুস্তম জংয়ের সঙ্গে সন্ধি করাটাই যুক্তিযুক্ত ভাবছিলেন। তার সেনাপতি মুস্তাফা খান তাকে উদ্দীপনামূলক উপদেশ দিলেন বর্ষাকালে নতুন পরিখাগুলো এভাবেই ফেলে রাখতে আর বর্ষাশেষে উড়িষ্যাকে পদানত করার পুনচেষ্টা করতে।
ফুলওয়ারির লড়াই, ৩ মার্চ ১৭৪১
কিন্তু জলদিই সংঘর্ষ বেধে যায়। রুস্তম জংয়ের জামাই মির্জা বাকার তার তারুণ্যের ঝোঁকে প্ররোচিত হয়ে তার বাহিনীর বড়ার (মধ্যপ্রদেশের গ্রাম) সৈয়দদের নিয়ে গড়া একটা অংশ নিয়ে নৌকোয় চেপে বসেন, আর আলীবর্দীর উপর আক্রমণ চালান। আলীবর্দীও তা মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসেন আর এভাবেই ফুলওয়ারির সমভূমিতে ৩ মার্চ ১৭৪১ তারিখে রক্তাক্ত এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথম আক্রমণে আলীবর্দী অরক্ষিত অবস্থায় রাখা রুস্তম জংয়ের কামানগুলোর দখল নিয়ে নেন। এই ক্ষতির পরও রুস্তম জং, মির্জা বাকার ও বড়া সৈন্যরা এমন সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে যায় যে বাংলার সৈন্যরা লড়াইয়ের মাঠ ছেড়ে পালিয়ে যায়, তাদের শাসককে পরাজয় ও অপমানের মুখে ঠেলে দিয়ে এমনকি আলীবর্দী ও তার বেগমকে বহন করা হাতির পালকেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরও দুই মাইল দূর পর্যন্ত ধাওয়া করা হয়। আলীবর্দীর এমন দুরাবস্থায় বর্ধমানের রাজার পেশকার মানিকচাঁদ সাহায্যকারী বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন। তিনি গোপনে বুদ্ধিমান ও সময়ানুবর্তী মানুষের মতো রুস্তম জংকে উপহাস করেন, কারণ তিনি তার দলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে যোগ দিতে চাইলেও মির্জা বাকার বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহে তার বিরোধিতা করেন, আর তাই তিনি আলীবর্দীর হয়ে লড়েন।
রুস্তম জয়ের পরাজয় ও মাছালিপতুমে ফিরে যাওয়া
রুস্তম জংয়ের দলেও কিছু কুলাঙ্গার ছিলেন যেমন মুখলিস আলী খান, আবিদ আলী খান, মুকাররাব খান আর কিছু আফগান গোত্রপতি—জলদিই তাদের শাসকের বিরুদ্ধে গিয়ে শত্রুশিবিরে যোগ দেন। কিন্তু এই শত্রুতায় ভীত না হয়ে মির্জা বাকার আলীবর্দীর বাহিনীর বামদিকে আক্রমণ চালাতে শুরু করেন, যেটার দায়িত্বে ছিলেন অভিজ্ঞ সেনাপতি মীর মুহাম্মাদ জাফর খান ও কাশিম আলী খান। এই অতর্কিত আক্রমণে বাংলার সৈন্যদের ভেতরে আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু এর পরপরই মীর মুহাম্মাদ জাফর খান দুর্দান্ত বিরোধীপক্ষ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন আর আলীবর্দীর নির্জীব সেনাপতিদের— মুসাহিব খান, দিলির খান, আসালাত খান আফগান সেনাপতি উমর খানের সন্তানদের সহায়তা করেন। এটা আলীবর্দীর সৈন্যদের মাঝে নতুন উদ্দীপনা আর সাহসের সঞ্চার করে শত্রুদের উপর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে, আর পরিস্থিতি রুস্তম জংয়ের প্রতিকূলে যেতে থাকে। মুজতাবা আলী, মীর আলী আকবার আর তিনশো সৈয়দ সৈন্যসহ মীর আবদুল আজিজ–তার সাহসী ও বিশ্বস্ত সেনাপতিরা আলীবর্দীর বাহেলিয়া সৈন্যদের বন্দুকের নিশানায় পরিণত হন। মির্জা বাকার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পান, আর তার সৈন্যরা সাহস হারিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছেড়ে দেয়। এভাবে লড়াইয়ের ভাগ্য ঘুরে যায় রুস্তম জংয়ের বিপক্ষে। তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই রইল না। তিনি হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়লেন, আর পিছে চলল তার আহত জামাই–পালকিতে, বালেশ্বরের বন্দরে। সঙ্গে দু-তিন হাজার অনুসারী, যারা তখনও রুস্তম জংয়ের প্রতি আনুগত্য হারায়নি। সম্ভবত তিনি তার কিছু সেনাপতির সাম্প্রতিক বিশ্বাসঘাতকতার অভিজ্ঞতায় ব্যথিত হয়েছিলেন, তিনি বালেশ্বর শহর থেকেই তার অনুগতদের ফিরে যেতে বলেন আর তিনি দ্রুত সমুদ্রের তীরে ধাবিত হন। তিনি সেখানে একটি বাণিজ্যতরী খুঁজে পান যেটা তার মতোই সুরাটের অধিবাসী ও বন্ধু হাজী মহসিনের ছিল। হাজী মহসিন সেসময়ে সম্ভবত ব্যবসায়িক কাজেই সেখানে গিয়েছিলেন আর বন্ধুকে সাহায্য করতেই ফুলওয়ারির লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন, কিন্তু পরাজিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। তারই পরামর্শে রুস্তম জং জামাই ও অল্পকিছু বিশ্বস্ত ভৃত্য নিয়ে তার সঙ্গে জাহাজে চড়ে বসেন আর মাছালিপত্নমে পৌঁছান পরবর্তী ছয়দিনের ভেতরে।
খুর্দা এলাকার জমিদার তার কষ্টপীড়িত পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে এল
রুস্তম জং চলে যাওয়ার পর আলীবর্দী খাইরুল্লাহ বেগ, ফাখরুল্লাহ বেগ ও নুরুল্লাহ বেগকে পাঠান বড়বর্তী দুর্গে, ভাগ্য-বিড়ম্বিত অসহায় অবস্থায় থাকা রুস্তম জংয়ের বেগম ও ছেলে ইয়াহিয়া খানকে আটক করতে। কিন্তু খুর্দার (উড়িষ্যার একটি এলাকা) জমিদার দ্বিতীয় রামচন্দ্রের (ইসলামে দীক্ষা নেওয়ার পর নাম হয় হাফিজ কাদ্র) ও রুস্তম জংয়ের এক দায়িত্বশীল বন্ধুর সময়োচিত সাহায্য তাদের অপমান থেকে রক্ষা করে, যদিও তাদের সম্পদের খানিকটা আলীবর্দীর সেনাপতিদের হাতে গিয়ে পড়ে। রুস্তম জংয়ের পরাজয় ও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালানোর খবর পেয়েই, অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানো উন্নত গুণাবলির মহৎ স্বভাবের মানুষ দ্বিতীয় রামচন্দ্রদেব নিজের মতো করে বিশ্বস্ত সেনাপতি শাহ মুরাদের অধীনে প্রচুর ঘোড়ার গাড়ি আর কড়া নিরাপত্তা প্রহরা দিয়ে তার বন্ধুর পরিবার ও সম্পদ কটক শহরের বাইরে আনার ব্যবস্থা করেন। একদম শেষ মুহূর্তে শাহ মুরাদ রুস্তম জংয়ের পরিবার ও সম্পদের কিছু অংশ তার নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। তিনি এই পরিবারকে গাঞ্জাম জেলার ইঞ্চাপুরামে (ইছাপুরাম) যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে দেন। ইঞ্চাপুরামের প্রশাসক আনোয়ারুদ্দিন খান রুস্তম জংয়ের পুরনো পরিচিত ছিলেন, তাই তিনি বন্ধুর অসহায় পরিবারকে যথাবিহীত সম্মানের সঙ্গে আতিথেয়তা প্রদান করেন। রুস্তম জং নিরাপদে মাছালিপত্নমে পৌঁছানোর পরই কেবল তার ভাগ্যবিড়ম্বিত পরিবারের কথা চিন্তা করার সুযোগ পেলেন, আর তার নির্দেশে মির্জা বাকার ইঞ্চাপুরামে গিয়ে তাদের নিয়ে আসেন।
রুস্তম জং দাক্ষিণাত্যে
এভাবে ভাগ্যের ফেরে উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসককে তার এলাকা থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়, সর্বস্বান্ত অবস্থায় তার স্ত্রী ও জামাইকে নিয়ে আশ্রয় খুঁজতে হয় আসাফ জাহ নিজাম-উল-মুকের অধিকৃত এলাকায়।
আলীবর্দীর উড়িষ্যার প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ; তার ভাতিজা সাওলাত জংকে নিয়োগ দান
তিনি প্রায় এক মাস তার কর্মজীবনের শুরুর আলীবর্দী দ্রুত কটকের দিকে এগিয়ে যান, রুস্তম জংয়ের দুই লক্ষ রুপি নগদ আর সমপরিমাণ মূল্যের বিভিন্ন সামগ্রী হস্তগত করেন। উড়িষ্যায় অবস্থান করে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। দিকে এই এলাকার অভিজ্ঞতা (সুজাউদ্দিনের সহকারী প্রশাসক থাকা অবস্থায়), আর স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে আগেকার জানাশোনা তার জন্য বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে। তিনি তার ভাতিজা সৈয়দ আহমাদকে (সাওলাত জং) উড়িষ্যার সরকারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন ও অভিজ্ঞ রুহেলা সেনাপতি গুজার খানকেও সেখানে রেখে আসেন তিন হাজার অশ্বারোহী ও চার হাজার পদাতিক সৈনিকের দায়িত্ব দিয়ে।
এরপর তিনি সেখানকার প্রশাসনিক বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তিনি তার শ্যালক আর তার বাহিনীর বহুদিনের বকশি, কাশিম আলী খানকে রংপুরের ফৌজদার পদে নিযুক্ত করেন, উড়িষ্যায় সাওলাত জংয়ের বদলির পর হওয়া শূন্যস্থান পূরণ করতে।
সাওলাত জং নতুন এলাকা প্রশাসনে অক্ষম ছিলেন
আলীবর্দীর দিক থেকে সাওলাত জংকে উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া ছিল বেশ বড় একটি ভুল। নীতি, কৌশল ও বুদ্ধির অভাবের কারণে তিনি নতুন অধিকৃত এলাকা প্রশাসনে অক্ষম ছিলেন। তার হামবড়া ভাব, লাগামহীন লাম্পট্য আর অর্থের প্রতি অতিরিক্ত লালসা, যা তিনি ধনীদের থেকে প্রায় অত্যাচার করেই কেড়ে নিয়েছিলেন, জন্ম দেয় তার সরকারের প্রতি বিস্তৃত অসন্তোষের। এছাড়াও, যে ডালে তিনি বসেছিলেন সেই ডাল কাটার মতন, বাংলা থেকে আগত তার সৈন্যদের থেকেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, অসুস্থ পরামর্শে তাদের বেতন কমানোর নীতি গ্রহণ করে। এই ত্রুটিপূর্ণ পরিচালনা তাদের ভেতর অসন্তোষ সৃষ্টি করে বিতৃষ্ণ করে তোলে উড়িষ্যার সামরিক কাজে। একইসঙ্গে তিনি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন সালিম খান, দারবিশ খান, নিজামত খান, মীর আজিজুল্লাহসহ আরও কিছু ব্যক্তিকে সামরিক কাজে অন্তর্ভুক্ত করে, যারা এর আগে রুস্তম জং ও তার জামাতার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। নতুন অজনপ্রিয়তা ও অদক্ষতা তাদের উৎসাহিত করে উড়িষ্যার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত থেকে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে রাখা মির্জা বাকারকে প্রদেশের ভেতরে স্বাগত জানাতে।
মির্জা বাকারের প্রত্যাবর্তন
এভাবে নিজে থেকেই সুবর্ণ সুযোগ মির্জা বাকারের কাছে চলে আসে, যিনি একবারে সাওলাত জংয়ের সব শত্রুকে উস্কে দিয়েছিলেন তার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার লক্ষ্যে আর নিজে দাক্ষিণাত্য থেকে ভাড়া করা মারাঠা সৈন্য নিয়ে উড়িষ্যা উদ্ধার করতে রওনা হয়েছিলেন। এরই মধ্যে রুস্তম জংয়ের পরিবারের রক্ষাকারী শাহ মুরাদের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ শুরু করে দেয় আর কটক শহরে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। সাওলাত জং তাদের শান্ত করার দায়িত্ব গুজার খানকে দিলে তারা দিনের আলোয় তাকে হত্যা করে, আর উড়িষ্যার কুশাসনের জন্য বড় অংশে দায়ী হোসেন বেগ খানের পরিণতিও এক হয়। চরম বিভ্রান্তিকর অবস্থায়, সাওলাত জং তার তোপখানার তত্ত্বাবধায়ক কাশিম বেগ ও কটকের ফৌজদার শেখ হিদায়াতুল্লাহকে পাঠান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে, কিন্তু তাদের অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে বিক্ষোভকারীরা কাশিম বেগকে হত্যা করে, আর কিছু আঘাত নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন হিদায়াতুল্লাহ। সাওলাত জং আর তার পুরো পরিবার তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন, আর তার সম্পদও লুট হয়ে যায়। সময়মতো খবর পেয়ে ১৭৪১ সালের অগাস্ট মাসে মির্জা বাকার রাজকীয়ভাবে প্রবেশ করেন কটকে আর তার কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।
সাওলাত জং ও তার পরিবারকে কঠোরভাবে বন্দী করা হয়
সাওলাত জংকে কড়া প্রহরার ভেতর দিয়ে প্রাসাদেই বন্দী করে রাখা হয়, তার স্ত্রী-সন্তান ও অন্য আত্মীয়দের বড়বতী দুর্গে। করম আলী লিখেছেন যে সাওলাত জংকে মির্জা বাকার হত্যা করে ফেলতেন কিন্তু তার স্ত্রীর জন্য তিনি এই জঘন্য কাজ থেকে বিরত হন। বিজয়ী কটকবাহিনী মিদনাপুর (মেদিনীপুর) ও হিজলি পর্যন্ত এগিয়ে এসে সেগুলোও দখল করে।
আলীবর্দীর দুশ্চিন্তা
সাওলাত জংয়ের দুর্দশা মারাত্মক অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে আলীবর্দীর মনে। পরিবারসহ ভাতিজার কারাবন্দিত্ব সত্যিই তার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়কর ছিল। একই সঙ্গে উড়িষ্যায় মির্জা বাকারের দুঃসাহসী প্রত্যাবর্তন ও সরকার দখল, তার মর্যাদা ও কর্তৃত্বে বড় আঘাত ছিল। তার দুশ্চিন্তা আরও তীব্র হয়েছিল যখন তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে মির্জা বাকার উড়িষ্যার বিদ্রোহে আরও প্রভাব ফেলতে পারেন আসাফ জাহ নিজাম-উল-মুলুকের প্ররোচনায়। তিনি চুপচাপ বসে না থেকে, প্রধান কর্মকর্তা ও আত্মীয়দের নিয়ে পরামর্শ করলেন সাওলাত জং ও উড়িষ্যা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। হাজী আহমাদ ও তার স্ত্রী (সাওলাত জংয়ের বাবা-মা) আলীবর্দীকে তাদের সন্তানের নিরাপত্তার জন্য মির্জা বাকারকে উড়িষ্যার সরকার ছেড়ে দিতে বলেন মুক্তির মূল্য হিসেবে। কিন্তু তিনি এই অপমানজনক প্রস্তাব মেনে নিতে পারলেন না, তিনি সঠিকভাবেই যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে এটা তার মর্যাদার জন্য হানিকর ও এতে তার সরকারের ভিত দুর্বল হয়ে পড়বে।
আলীবর্দীর ক্ষমতা ও মর্যাদা বজায় রাখতে উড়িষ্যায় যুদ্ধযাত্রার সিদ্ধান্ত
মুস্তাফা খানও আলীবর্দীকে উৎসাহ দিলেন মির্জা বাকারকে সম্মুখযুদ্ধে শাস্তি দেওয়ার। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন উড়িষ্যায় যুদ্ধযাত্রা করে তার সম্মান রক্ষা ও কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের। এই উদ্যোগকে সফল করতে একটি কার্যকর সেনাবহর তৈরি আর পর্যাপ্ত রসদ জোগাড়ে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। মুস্তাফা খানের বহর পাঁচ হাজার, শামসির খান ও উমর খান প্রত্যেকের বহর তিন হাজার, সর্দার খান ও আতাউল্লাহ খান–প্রত্যেকের বহর দু হাজার, হায়দার খান, ফখরুল্লাহ বেগ খান ও মীর জাফর খান – প্রত্যেকের বহর এক হাজার, মীর শারফুদ্দিন ও শাহ মুহাম্মাদ মাসুম ও বাহাদুর আলী খান – প্রত্যেকের বহর পাঁচশো, আমানত খানের বহরে দেড় হাজার, মীর কাশিম খানের বহর দুশো ঘোড়সওয়ারির বাহিনীতে পরিণত হয়। ফতেহ রাও, ছেদন বাহেলিয়া, ও অন্যান্য হিন্দু দলপতিরা মিলে ৫০ হাজার বন্দুকবাজ (মাস্কেটিয়ার) সংগ্রহ করেন।
আলীবর্দীর উড়িষ্যায় যুদ্ধযাত্রা
বড় ভাতিজা শাহামাত জংকে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী আর ১০ হাজার পদাতিক সৈন্যের দায়িত্ব দিয়ে মুর্শিদাবাদে রেখে আলীবর্দী নিজে ২০ হাজার অশ্বারোহী আর শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত দল নিয়ে এক শুভক্ষণে যুদ্ধযাত্রা করলেন কটকের উদ্দেশে। দ্রুত লয়ে দল পরিচালনা করে মহানদীর উত্তর কূলে, কটকের উল্টোদিকে পৌছালেন, যখন মির্জা বাকার দক্ষিণ তীরে, রায়পুরে শিবির স্থাপন করেছিলেন। মির্জা বাকার তার তাঁবু ও লটবহর শিবিরের থেকে সাত-আট মাইল দূরে রেখে এসেছিলেন। সাওলাত জংকেও সেখানে চার চাকার ঘোড়ার গাড়িতে হাজী মোহাম্মাদ আমিনের অধীনে, রুস্তম জয়ের ভাই, দুই তুরানীয়, আর ৫০০ তেলিঙ্গার (দাক্ষিণাত্যের পদাতিক সৈন্য) রেখে আসা হয়, আর রক্ষকদের বলে আসা হয় আলীবর্দীর বাহিনী এলে বন্দীর সঙ্গে কী করতে হবে।
মির্জা বাকারের পরাজয় ও দাক্ষিণাত্যে পলায়ন
জোবরা ঘাট দিয়ে মহানদী পেরিয়ে এক শীতের ভোরে আলীবর্দী তার শত্রু- শিবিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আলীবর্দীর বিশাল বহর দেখে মির্জা বাকারের সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যারা এর কিছু সময় পরেই তাদের প্রভুকে হতাশায় ফেলে ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। চরম হতাশ হয়ে মির্জা বাকার আবারও তার মারাঠা সঙ্গীদের নিয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে গেলেন, চম্পাঘাটির সড়ক ধরে, ১৭৪১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে। তিনি তাকে ধাওয়া-করা আলীবর্দীর পাঠানো আফগান সৈন্যদের হতবুদ্ধি করতে পেরেছিলেন তার পুরনো বন্ধু খুর্দার প্রধান সেনাপতি শাহ মুরাদ খানের সহযোগিতায়।
সাওলাত জং ও তার পরিবারকে উদ্ধার
সাওলাত জংকে উদ্ধার করাটাই আলীবর্দীর সমস্ত মনোযোগ কাড়ল এরপর। তিনি তার উল্লেখযোগ্য সেনাপতিদের মীর জাফর খানের অধীনে জড়ো করলেন এই কাজের জন্য। যখন তারা তাদের গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে যাবে কানাইজুরি নদী (কাটজুরি?), মীর মুহাম্মাদ আমিন খান (আলীবর্দীর সৎভাই ও মীর জাফর খানের শ্যালক) দলছুট হয়ে আসালাত খান, দিলির খান ও অন্য সাত সৈন্য নিয়ে বিপজ্জনকভাবে সাওলাত জংয়ের ঘোড়ার গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। মির্জা বাকারের রক্ষীরা তখনই সাওলাত জংয়ের দিকে তাদের বর্শা নিক্ষেপ করে, দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা সাওলাত জংকে স্পর্শ না করে গাড়িতে অবস্থান করা এক তুরিনীয় রক্ষীকে নিহত আর অন্যজনকে আহত করে। আলীবর্দীর সেনাপতিরা গাড়ির পর্দা তুলে সাওলাত জংকে বের করে আনেন। সবাই যখন সাওলাত জংয়ের বিস্ময়কর উদ্ধারের আনন্দে বিভোর, তখন হাজী মুহাম্মাদ আমিন কোনোভাবে গাড়ি থেকে বেরিয়ে মীর মুহাম্মাদ আমিনের ঘোড়ায় চেপে তার অজ্ঞাতসারেই পালিয়ে যান। সাওলাত জংকে আলীবর্দীর সামনে নিয়ে যাওয়া হলে আলীবর্দী সীমাহীন খুশিতে মত্ত হয়ে ওঠেন, আর মাটিতে সিজদাহ করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে থাকেন। ভাতিজাকে দামি পোশাক উপহার দিয়ে উষ্ণভাবে গ্রহণ করার পর, তিনি শক্তিশালী প্রহরীদের জিম্মায় বেশকিছু ঘোড়ার গাড়ি পাঠান বড়বতীর দুর্গ থেকে সাওলাত জংয়ের পরিবারকে নিয়ে আসার জন্য। মির্জা বাকারের নিয়োগ করা কিছু সৈন্য বড়বতী দুর্গে বাধা দিতে চাইলেও বেশিরভাগ সৈন্যরা বিজয়ীর অনুগ্রহ প্রত্যাশায় অন্য সৈন্যদের বিরোধিতা করে। এভাবে সাওলাত জংয়ের পরিবারকে উদ্ধার করে আলীবর্দীর সামনে আনা হয়। এর কিছুদিন পরেই, আলীবর্দী সাওলাত জংকে উপযুক্ত সরঞ্জাম যেমন – হাতি, ঘোড়া, অস্ত্র, পোশাক ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তির মর্যাদার সঙ্গে যায়, এমন সবকিছু দিয়ে মুর্শিদাবাদে পাঠান। সঙ্গে তার সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশও পাঠিয়েছিলেন, নিজের কাছে কেবল পাঁচশো অশ্বারোহী আর বাছাই করা কিছু কর্মকর্তাদের রেখে দেন। তিনি মির্জা বাকারের মিত্রদের শাস্তি দেন ও তাদের চিহ্ন দেওয়া (সামরিক কাজে ব্যবহৃত) ঘোড়াগুলোকে জব্দ করেন।
উড়িষ্যায় নতুন প্রশাসনিক পুনর্গঠন
এভাবে কটক পুনরুদ্ধারের পর, আলীবর্দী সেখানে প্রায় তিন মাস অবস্থান করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন ও উড়িষ্যার প্রশাসনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনেন। এক সময়ে রুস্তম জংয়ের অধীনে নিয়োজিত থাকা মুখলিস আলী খানকে উড়িষ্যার সহকারী প্রশাসকের পদে নিয়োগ দিয়ে আলীবর্দী বাংলার দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভদ্রক এলাকায় পৌঁছেই তিনি মুস্তাফা খানের পরামর্শে মত পরিবর্তন করে মুখলিস আলী খানকে বরখাস্ত করেন আর সেই পদে পানিপথের স্থানীয় ও তার সাহসী সেনাপতি ও বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম শেখ মাসুমকে উড়িষ্যার প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। জানকিরামের ছেলে দুর্লভরামকে সহকারী প্রশাসকের পেশকার পদে নিয়োগ করা হয়।
ময়ূরভঞ্জের রাজা জগদীশ্বর ভঙ্গের শান্তি
বালেশ্বরে পৌছে আলীবর্দী ভাবলেন ময়ূরভঞ্জের রাজা জগদীশ্বর ভঞ্জকে শাস্তি দেওয়াটা জরুরি, কারণ তিনি সাম্প্রতিকতম যুদ্ধে মির্জা বাকারের পক্ষে ছিলেন, আর আলীবর্দীর কর্তৃত্বের কাছে নত হননি। হরিহরপুরের প্রাসাদে রাজা যখন প্রমোদ-বিলাসে মত্ত, তখন আলীবর্দী-বাহিনীর একাংশ তার এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে হাজার হাজার পুরুষ ও নারীদের বন্দী করে জলদিই পদানত করে। জগদীশ্বর পিছিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যান এবং সেখানেই অবস্থান করেন। এভাবে ময়ূরভঞ্জ এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে আলীবর্দী তার বেগম ও নাতি সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে বাংলার দিকে যাত্রা শুরু করেন।
বিহারে জৈনুদ্দিন
এরই মধ্যে জৈনুদ্দিন বিহারে তার সরকারের কর্তৃত্ব দৃঢ় করতে ব্যস্ত ছিলেন কিছু যোগ্য কর্মকর্তাদের সহায়তায়–এদের মধ্যে তার দিওয়ান রায় চিন্তামন দাস, যিনি তার চাচার অধীনে পাটনায় দিওয়ান ছিলেন, ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেনের বাবা হিদায়াত আলী খান, হিদায়াত আলীর ভাই মাহদি নিসার খান ও হিদায়াত আলীর ভাতিজা আবদুল আলী খান অন্যতম। টিকারির রাজা সুন্দর সিং এবং নরহাট ও সামাই এলাকার জমিদারেরা, নামদার খান, কামগার খান, রানমাস্ত খান ও সর্দার খান–যারা কিছুকাল আগে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছিলেন, আলীবর্দীর প্রতি তাদের আগেকার সাহায্যের প্রতিদান পেয়েছিলেন জৈনুদ্দিনের থেকে, ব্যক্তিগত সুবিধা ও বন্ধুত্ব পাওয়ার মাধ্যমে। নিজে নেতৃত্ব দিয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী আর গোলন্দাজদের নিয়ে তিনি শাহাবাদের দুই বিদ্রোহী জমিদার— ভারত সিং ও উদ্যন্ত সিং উজ্জয়নকে (আরার কাছের জগদীশপুরের কুনওয়ার সিংয়ের দাদা, বিহারের ১৮৫৭-৫৯ সালের বিদ্রোহের নেতা) দমন করেন। উগ্র তরুণ সহকারী প্রশাসকের তাদের প্রতি এতটাই তীব্র ক্রোধ ছিল যে শাহাবাদের তখনকার সক্ষম ফৌজদার, আফগান-কর্মকর্তা রোশান খান তেরাহিকেও বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করেন স্রেফ তাদের সঙ্গে আঁতাতের সন্দেহে। একই সময়ে, বিহারের অন্যপ্রান্তে হিদায়াত আলী খান পালামৌ আর সেরেস, কটোম্বা ও শেরঘাটির জমিদার রাজা সুন্দর সিং ও রাজা জয়কিষাণ সিংয়ের সাহায্যে, রামগড়ের (এখনকার হাজারিবাগ) শক্তিশালী হিন্দুরাজার অধীনে চলে আসেন।