অধ্যায়-২৯ ব্যবিলনের অগ্নিপরীক্ষায় নবী দানিয়েল (আ)

অধ্যায়-২৯ ব্যবিলনের অগ্নিপরীক্ষায় নবী দানিয়েল (আ)

নির্বাসনকালের আরেকজন বিখ্যাত নবী ছিলেন হযরত দানিয়েল (আ); অবশ্য ইহুদী ধর্মে যে ৪৯ জন পুরুষ নবীর তালিকা আছে, তাতে দানিয়েলের (আ) নাম নেই। তার নামের অর্থ ‘আল্লাহ আমার বিচারক’। উচ্চবংশীয় এই তরুণ জেরুজালেম থেকে নেবুকাদনেজারের আক্রমণে বন্দী হয়ে আশ্রয় পান ব্যবিলনে। পারস্যের রাজা সাইরাস ব্যাবিলন দখল করে নেয়ার আগ পর্যন্ত দানিয়েল (আ) নেবুকাদনেজার ও তার পরবর্তী রাজাদের অনুগত ছিলেন, যদিও মনে-প্রাণে তিনি আল্লাহর উপাসনাই করতেন। ছয়টি শহরে দানিয়েলের কবর নামে স্থাপনা আছে, তবে দক্ষিণ ইরানের সুসাতে থাকা স্থাপনাটি সবচেয়ে বিখ্যাত। তাঁর কিতাব বলছে, ঠিক যেভাবে আল্লাহ দানিয়েল (আ) ও তার সঙ্গীদের বাঁচিয়েছেন, সেভাবেই ইসরাইলকে বাঁচাবেন তৎকালীন অত্যাচার থেকে।

বন্দী সুদর্শন বালকদেরকে ব্যবিলনের প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে শিক্ষিত করে তোলার জন্য। এর মাঝে একজন ছিলেন দানিয়েল (আ)। তবে দানিয়েল ও তাঁর তিন সঙ্গী রাজকীয় খাবার ও মদ স্পর্শ করতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের ওপর নজর রাখা লোকেরা ভয় পেয়ে যায়, কারণ তারা যে হারে না খেয়ে থাকছেন মারা নাকি যান। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১০ দিন পরেও তারা কেবল পানি আর সবজি খেয়ে সতেজ ছিলেন। পরে তাদেরকে রাজকীয় খাবার থেকে বিরত থাকবার অনুমতি দেয়া হয়। (বুক অফ দানিয়েল)

তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হলে বাদশাহ নেবুকাদনেজার আবিষ্কার করলেন দানিয়েল ও তাঁর বন্ধুরা তার রাজ্যের বিদ্বানদের থেকেও জ্ঞানী, দশগুণ ভালো। তাই তিনি তাদেরকে তার রাজসভায় রেখে দেন, যেখানে রাজা সাইরাসের আগমন পর্যন্ত দানিয়েল কাজ করেন।

পরের বছর বাদশাহ নেবুকাদনেজার এক স্বপ্ন দেখলেন। তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠতেই বুঝতে পারলেন তার স্বপ্নের গভীর অর্থ আছে। কী সেই অর্থ?

তিনি তার জ্ঞানী সভাসদদের বললেন তিনি কী স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বলতে, এবং যা দেখেছেন তার অর্থই বা কী। কেউই উত্তর দিতে পারলেন না দেখে দানিয়েলসহ সকলকেই তিনি মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তখন আল্লাহর কাছ থেকে দানিয়েল (আ) ঐশীবাণী পান, যাতে তিনি সেই স্বপ্ন ও এর ব্যাখ্যা জেনে যান। বাইবেল (দানিয়েল ২) বলছে, দানিয়েল ঠিক এভাবে বাদশাহর সাথে কথা বলেন-

বাদশাহ যে নিগূঢ় কথা জিজ্ঞাসা করেছেন, তা বিদ্বান বা গণক বা মন্ত্রবেত্তা বা জ্যোতির্বেত্তারা বাদশাহকে জানাতে পারে না; কিন্তু আল্লাহ আছেন, তিনি নিগূঢ় বিষয় প্রকাশ করেন, আর ভবিষ্যতে যা যা ঘটবে, তা তিনি বাদশাহ বখতে- নাসারকে জানিয়েছেন। আপনার স্বপ্ন এবং বিছানার উপরে আপনার মনের দর্শন এই। হে বাদশাহ, বিছানায় আপনার মনে এই চিন্তা উৎপন্ন হয়েছিল যে, এর পরে কী হবে; আর যিনি নিগূঢ় বিষয় প্রকাশ করেন, তিনি আপনাকে ভবিষ্যতের ঘটনা জানিয়েছেন। কিন্তু আমার নিজের সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, অন্য কোনো জীবিত লোকের চেয়ে আমার বেশি জ্ঞান আছে বলে যে আমার কাছে এই নিগূঢ় বিষয় প্রকাশিত হলো তা নয়, কিন্তু অভিপ্রায় এই, যেন বাদশাহকে এর তাৎপর্য জানানো যায়, আর আপনি যেন আপনার মনের চিন্তা বুঝতে পারেন।

হে বাদশাহ, আপনি দৃষ্টিপাত করেছিলেন, আর দেখলেন, একটি প্রকাণ্ড মূর্তি। সেই মূর্তিটি বিশাল এবং ভীষণ উজ্জ্বল; তা আপনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল; আর তার দৃশ্য ভয়ঙ্কর। সেই মূর্তির বৃত্তান্ত এই; তার মাথাটি সোনার, তার বুক ও বাহু রূপার; তার উদর ও ঊরুদেশ ব্রোঞ্জের; তার জঙ্ঘা লোহার এবং তার পা কিছু লোহার ও কিছু মাটির ছিল। আপনি দৃষ্টিপাত করতে থাকলেন, শেষে মানুষের হাতে কাটা হয়নি এমন একটি পাথর সেই মূর্তির লোহা ও মাটির দুই পায়ে আঘাত করে সেগুলো চুরমার করে ফেললো। তখন সেই লোহা, মাটি, ব্রোঞ্জ, রূপা ও সোনা একসঙ্গে চুরমার হয়ে গ্রীষ্মকালীন খামারের তুষের মতো হলো, আর বায়ু সেসব উড়িয়ে নিয়ে গেল, তাদের জন্য আর কোথাও স্থান পাওয়া গেল না। আর যে পাথরখানি ঐ মূর্তিকে আঘাত করেছিল, তা বৃদ্ধি পেয়ে মহাপর্বত হয়ে উঠলো এবং সমস্ত দুনিয়া পূর্ণ করলো।

এটাই ছিল সেই স্বপ্ন। এখন আমরা বাদশাহ সাক্ষাতে এর তাৎপর্য প্রকাশ করবো। হে বাদশাহ, আপনি বাদশাহদের বাদশাহ, বেহেশতের মালিক আল্লাহ আপনাকে রাজ্য, ক্ষমতা, পরাক্রম ও মহিমা দিয়েছেন। আর যেকোনো স্থানে মানুষ বাস করে, সেই স্থানে তিনি মাঠের পশু ও আসমানের পাখিদেরকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছেন এবং তাদের সকলের উপরে আপনাকে কর্তৃত্ব দিয়েছেন; আপনিই সেই সোনার মাথা। আপনার পেছনে আপনার চেয়ে ক্ষুদ্র আরেকটি রাজ্য উঠবে; তারপর ব্রোঞ্জের তৃতীয় একটি রাজ্য উঠবে, তা সমস্ত দুনিয়ার উপরে কর্তৃত্ব করবে। আর চতুর্থ রাজ্য লোহার মতো দৃঢ় হবে; কারণ লোহা যেমন সমস্ত কিছু ভেঙে চুরমার করে, তেমনই সেই রাজ্য অন্য সমস্ত রাজ্যকে ভেঙে চুরমার করবে। আর আপনি দেখেছেন, দুই পা ও পায়ের আঙ্গুল সকল কিছু কুমারের মাটির ও কিছু লোহার, এতে বিভক্ত রাজ্য বুঝায়; কিন্তু সেই রাজ্যে লোহার দৃঢ়তা থাকবে, কেননা আপনি কাদায় মিশানো লোহা দেখেছেন। আর পায়ের আঙুলগুলো যেমন কিছু লোহার ও কিছু মাটির ছিল, তেমনি রাজ্যের একাংশ দৃঢ় ও একাংশ ভঙুর হবে। আর আপনি যেমন দেখেছেন, লোহা কাদায় মিশানো হয়েছে, তেমনি সেই লোকেরা মানুষের বীর্যে পরস্পর মিশ্রিত হবে; কিন্তু যেমন লোহা মাটির সঙ্গে মিশে যায় না, তেমনি তারা পরস্পর মিশ্রিত থাকবে না। আর সেই বাদশাহের সময়ে বেহেশতের আল্লাহ একটি রাজ্য স্থাপন করবেন, তা কখনও বিনষ্ট হবে না এবং সেই রাজত্ব অন্য জাতির হাতে তুলে দেওয়া হবে না; তা ঐ সমস্ত রাজ্যগুলোকে চুরমার করে বিনষ্ট করে নিজে চিরস্থায়ী হবে। কারণ আপনি তো দেখেছেন, পর্বত থেকে একখানি পাথর যা মানুষের হাতে কাটা হয়নি এবং ঐ লোহা, ব্রোঞ্জ, মাটি, রূপা ও সোনাকে চুরমার করলো; মহান আল্লাহ বাদশাহকে ভবিষ্যতের ঘটনা জানিয়েছেন; স্বপ্নটি নিশ্চিত ও তার তাৎপর্য সত্য। (দানিয়েল ২:২৭-৪৫)

বোল্ড করা অংশটি দিয়ে মুসলিম বিশারদগণ যথাক্রমে খ্রিস্টান ও মুসলিম জাতির আগমনের কথা উল্লেখ করেন।

এ ঘটনার পর দানিয়েল ও তার সঙ্গীদের পদোন্নতি হলো। কিন্তু আবারও পরীক্ষায় পড়লেন দানিয়েল ও তার সঙ্গীরা। বাদশাহ নেবুকাদনেজার ৬০ হাত লম্বা এক সোনার মূর্তি স্থাপন করলেন নিজের। এরপর সকলকে এর সামনে দাঁড়া করিয়ে আদেশ করলেন, মূর্তিকে সিজদা করতে। না করলে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।

কিন্তু সভায় উপস্থিত তিনজন ইহুদী এ কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালো। বাদশাহ ক্রোধান্বিত হয়ে আগুনের উত্তাপ আরও সাত গুণ বাড়াতে বললেন। সে তিনজন বললেন, “আমরা যাঁর সেবা করি, আমাদের সেই আল্লাহ আমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ আছেন, আর, হে বাদশাহ, তিনি আপনার হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করবেন; আর যদি না-ও হয়, তবু হে বাদশাহ আপনি জানবেন, আমরা আপনার দেবতাদের সেবা করবো না এবং আপনার স্থাপিত সোনার মূর্তিকে সেজদা করবো না।” (দানিয়েল ৩)

তাদেরকে আগুনে ফেলবার পর বাদশাহ অবাক হয়ে বললেন মন্ত্রীদেরকে, “আমরা কি তিনজন পুরুষকে বেঁধে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করিনি?” তাঁরা জবাবে বাদশাহকে বললেন, “হ্যাঁ, মহারাজ।”

তখন বাদশাহ বললেন, “দেখ, আমি চার ব্যক্তিকে দেখতে পাচ্ছি; ওরা মুক্ত হয়ে আগুনের মধ্যে চলাচল করছে, ওদের কোনো হানি হয়নি; আর চতুর্থ ব্যক্তির অবয়ব দেবপুত্রের মত।”

বাদশাহ তাদের বেরিয়ে আসতে বললেন। দেখা গেলো তিনজন ইহুদীই একদম অক্ষত আছেন। একটি চুলও পোড়েনি। চতুর্থজন ছিলেন ফেরেশতা।

বাদশাহ ঘোষণা করলেন, “সকল দেশের লোক, জাতি ও ভাষাবিদদের মধ্যে যে কেউ ইহুদীদের আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো ভ্রান্তির কথা বলবে, সে খণ্ড-বিখণ্ড হবে এবং তার বাড়ি ধ্বংসস্তুপ করা যাবে; কেননা এই রকম উদ্ধার করতে সমর্থ আর কোনো দেবতা নেই।”

এরপর বাদশাহ আবারও একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তার মতে স্বপ্নটি ছিল, এক বেহেশতি প্রহরীর নির্দেশে তিনি একটি বিশাল গাছ কেটে ফেললেন।

দানিয়েল (আ)-কে তলব করা হলো। তিনি জানালেন, এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা হলো, নেবুকাদনেজারই হলেন সেই গাছ। তিনি সাত বছরের জন্য পাগল হয়ে যাবেন, পশুর মতো জীবন কাটাবেন।

পরে নেবুকাদনেজারের নাতি বেলশাজার যখন রাজা হন, তখনও দানিয়েল (আ) ছিলেন তার রাজসভায়। কিন্তু বেলশাজার ইহুদীদের পবিত্র পাত্র দিয়ে পান করেন আর দেব-দেবীর উপাসনা করেন। বাইবেল বলছে, “ঠিক তখনই মানুষের একটি হাত এসে রাজপ্রাসাদের দেওয়ালের প্রলেপের উপরে প্রদীপ-আসনের সম্মুখে লিখতে লাগল; এবং যে হাতটি লিখছিল, সেটি বাদশাহ দেখতে পেলেন। তখন বাদশাহর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তাঁর ভাবনা তাঁকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিল; তাঁর কোমরের গ্রন্থি শিথিল হয়ে পড়লো এবং তাঁর হাঁটু কাঁপতে লাগল।” (দানিয়েল ৫)

দানিয়েল (আ) সে লেখার অর্থ বোঝালেন, বেলশাজারের রাজত্ব মিডিয়ান পারসিকদেরকে দেয়া হবে। দানিয়েল পদোন্নতি পেলেন এ ঘটনার পর। কিন্তু সে রাত্রেই বেলশাজারকে হত্যা করা হয় এবং মিডিয়ান পারস্যের ড্যারিয়াস (দারিয়ুস ) দখল করেন ব্যাবিলন।

ড্যারিয়াস দানিয়েল (আ)-কে আরও পদোন্নতি দেন। দানিয়েলের (আ) প্রতি ঈর্ষান্বিত সভাসদরা ধোঁকা দিয়ে তাঁকে দিয়েই এ আদেশ দেয়ান যে, আগামী ত্ৰিশ দিন কোনো ঈশ্বরের প্রতিই প্রার্থনা করা যাবে না। যে এ আইন ভাঙবে তাকেই সিংহের মুখে ফেলা হবে। কিন্তু দিনে তিনবার বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে প্রার্থনা করেন দানিয়েল (আ)। এটা মানুষ জেনে যাওয়াতে ব্যথিত মনে হলেও রাজা ড্যারিয়াস বাধ্য হন প্রিয় দানিয়েলকে (আ) সিংহের মুখে ফেলতে। যে খাদে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো সেখানে ছিল অনেকগুলো সিংহ। ভোরবেলা রাজা দৌড়ে এলেন, জানতে চাইলেন- আল্লাহ কি দানিয়েলকে রক্ষা করেছেন?

দানিয়েল উত্তর দিলেন, “হে বাদশাহ চিরজীবী হোন। আমার আল্লাহ তাঁর ফেরেশতা পাঠিয়ে সিংহদের মুখ বন্ধ করেছেন, তারা আমার ক্ষতি করেনি; কেননা তাঁর সাক্ষাতে আমার নির্দোষিতা পরিলক্ষিত হলো; এবং হে বাদশাহ, আপনার সাক্ষাতেও আমি কোনো অপরাধ করিনি।” (দানিয়েল ৬:২১-২২ )

বাদশাহ ভীষণ খুশি হলেন এবং তাকে উদ্ধারের পর দানিয়েলকে দোষারোপকারীদেরকে সিংহের খাদে ফেলে দিলেন। সিংহগুলো তাদের শেষ করে দিলো।

ইহুদী লোককথা বলে, আহাসেরুস নামের এক পারসিকের মন্ত্রী হামানের হাতে নিহত হন দানিয়েল (আ)। দানিয়েল (আ)-কে নিয়ে বাইবেলের অন্য ঘটনাগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে তাঁকে নিয়ে ইসলামে ছবি অঙ্কন সংক্রান্ত একটি অদ্ভুত কাহিনী আছে। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় এখন নেই। তবে লেখাটি মাওলানা মহিউদ্দিন অনূদিত ‘নবুয়াতের প্রমাণপঞ্জি’ গ্রন্থের ২০ পৃষ্ঠাতে উল্লেখিত আছে। রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসও সেই কাহিনীতে আছেন।

তার পুরো নাম ছিল, ফ্লাভিয়াস হেরাক্লিয়াস অগাস্টাস (Flavius Heraclius Augustus)। গ্রিক ভাষায় prápros Hpakhetos। তাঁর জন্ম ৫৭৫ সালে, তুরস্কে। ৬০৮ সালে তাঁর ক্ষমতার বিস্তার শুরু হয়। ৬১০ সালে রোমান সম্রাট পদে আসীন হয়ে ৬৪১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান।

এবার আসুন মূল কাহিনীতে আসা যাক।

হিশাম ইবনুল আস (রা) বলেন, আবু বকর (রা) আমাকে এক ব্যক্তির সাথে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে পাঠালেন তাঁকে দাওয়াত দিতে। আমরা যখন গেলাম, তখন সেখানে তাঁর গভর্নর জাবালা গাসসানি ছিলেন।

সম্রাট দূত পাঠিয়ে বললেন, “আমার দূতকে যা বলার বলুন।”

আমরা না করলাম।

তারপর দূত আমাদেরকে জাবালার কাছে নিয়ে গেল। দেখলাম, তিনি কালো পোশাক পরে আছেন। বললাম, “কালো পোশাক কেন পরিধান করে আছেন?” তিনি বললেন, “আমি কসম খেয়েছি, সিরিয়া থেকে তোমাদের না তাড়ানো পর্যন্ত কালো পোশাক পরিধান করে থাকবো।”

“এটা হবে না, বরং আমরা আপনাদের দেশ পেয়ে যাব। আমাদের রাসুল (সা) সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।”

“আপনারা সেই জাতি না, যারা এ দেশ জয় করবে। ভবিষ্যৎবাণী হলো, সেই জাতি সম্পর্কে যারা রোজা রাখে আর সন্ধ্যার সময় ইফতার করে।”

তারপর জাবালা আমাদেরকে রোজার কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম আমাদের রোজার কথা। সাথে সাথে তাঁর মুখ কাল হয়ে গেল।

জাবালা আমাদেরকে দূতের সাথে হেরাক্লিয়াসের কাছে পাঠালেন। আমরা সেখানে পৌঁছালে দেখলাম সম্রাট আমাদের নিরীক্ষণ করছেন। আমরা সম্রাটের জানালার নিচে থামলাম। আমরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করলাম। জানালা কেঁপে উঠলো।

আমরা ভেতরে গেলাম। দেখলাম লাল পোশাক পরে সম্রাট বসে আছেন। জানালাগুলোও লাল। আমরা কাছে এলে সম্রাট হেসে হেসে বললেন, “কী ক্ষতি ছিল আমাকে তোমাদের নিয়ম মতো সালাম দিলে?”

“আমরা বিশ্বাসীরা একে অপরকে যা বলি সেটা আপনাকে বলা বৈধ মনে করি না।”

“কী বল তোমরা?”

“বলি- আসসালামু আলাইকুম।”

“তোমাদের বাদশাহকে কী বল?”

“একই।”

“বাদশাহ কীভাবে জবাব দেন?”

“একই কথা দিয়ে।”

“তোমাদের প্রধান বিশ্বাস বাণী কী?”

“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার।”

এতে জানালা দুলে উঠলো। সম্রাট দেখে বললেন, “তোমরা বাসায় যখন এটা বলো তখনও কি জানালা দুলে ওঠে?”

“নাহ! আল্লাহর কসম, আমরা এ জায়গা ছাড়া কোথাও দেখিনি।”

সম্রাট আমাদের অনেক অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন, আমরা জবাব দিলাম। একপর্যায়ে বললেন, “ওঠো। তোমাদের জন্য একটি ঘর সাজানো আছে। সব ব্যবস্থা করা আছে।”

আমরা তিনদিন থাকলাম সেখানে। প্রতি রাতে হেরাক্লিয়াস আমাদের ডেকে পাঠাতেন আর অবাক ব্যাপার, সেই একই প্রশ্নগুলো বারবার করতেন। আমরা একই জবাব দিতাম।

তারপর সম্রাট একটি সিন্দুক আনালেন যা ছিল মণি-মুক্তায় ভরা। অনেকগুলো চেম্বার বা খুপরি সেটাতে, তালা মারা সবই। সম্রাট একটি চেম্বার খুললেন। সেখান থেকে একটি রেশমি কাপড় বের করলেন, কাপড় সরাতেই দেখলাম, একটি ছবি- মানুষের চেহারা। লালচে, শ্মশ্রুহীন, লম্বা গ্রীবা, প্রশস্ত চোখ, তাঁর চুল এত সুন্দর ছিল! সম্রাট বললেন, “চেনো এঁকে?”

“না।”

“ইনি আদম (আ)।”

সম্রাট ২য় তালা খুললেন। আবারও রেশমি কাপড়। এবারের ছবিতে চেহারা শুভ্র, লালচে চোখ, বড় মাথা।

“চেনো এঁকে?”

“না।”

“ইনি নুহ (আ)।”

তৃতীয় চেম্বার খুললেন। এবার রেশমি কাপড় সরাতেই যে ছবি দেখলাম, সেখানে শুভ্র ত্বক, সুডৌল দেহ, উজ্জ্বল কপাল, কারুকার্যময় গাল, সাদা দাঁড়ি, যেন তিনি জীবিত, হাস্যরত।

“চেনো?”

“না।”

“ইনি ইব্রাহিম (আ)।”

এরপর আরও একটি তালা খুললেন, ছবি বের করতেই চিনে ফেললাম, ইনি আমাদের নবী। আমাদের কান্না চলে এলো। আমরা সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলাম। সম্রাট বললেন, “আল্লাহর কসম, সত্যি করে বলো, ইনি তোমাদের নবী?”

“হ্যাঁ, ইনিই। কিন্তু, ইনি আর আমাদের মাঝে নেই।”

সম্রাট কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এরপর বললেন, “এটা ছিল সিন্দুকের সর্বশেষ চেম্বার। এর আগে আরও অনেক চেম্বার ছিল। তোমরা কী বল সেটা দেখার জন্য তড়িঘড়ি করে এটা আগে দেখিয়েছি।”

এরপর তিনি আগের তালাটি খুললেন, এতে আগের মতো আরেকটি ছবি ছিল। এবারের ছবিটি যুবক বয়সের কারও। তাঁর চেহারায় সাধুতার চিহ্ন স্পষ্ট। সুশ্রী চেহারা। কুচকুচে কালো দাঁড়ি। অনেক চুল। সম্রাট বললেন,

“এঁকে চেনো?”

“না।”

“ইনি ঈসা (আ)।”

তিনি আরও কিছু তালা খুলে দেখালেন, একটাতে দেখা গেল ট্যান হওয়া চামড়ার, বেশ কোঁকড়া চুলের আর অন্তর্ভেদী দৃষ্টির এক লোক। জানলাম ইনি মূসা (আ)।

তাঁর পাশের ছবিতে প্রশস্ত কপাল, আর হালকা ট্যারা চোখের একজন। জানলাম ইনি হারুন (আ)।

এরপর একজন গড় উচ্চতার, সোজা চুলের মানুষ, তিনি ছিলেন লুত (আ)। তাঁর পাশে, প্রায় মূসার মতোই দেখতে তবে লালচে ত্বক, উঁচু নাক, চাপা গালের একজন সুদর্শন লোক। তিনি নাকি ইসহাক (আ)।

এরপরের ছবিতে দেখলাম প্রায় হুবহু দেখতে ইসহাকের মতো একজন, কেবল ঠোঁটের উপর একটা তিল। ইনি ইয়াকুব (আ)।

তাঁর পাশে হাস্যোজ্জ্বল, লালচে, সুদর্শন একজন ছিলেন, তিনি ইসমাইল (আ)। দেখতে যেন আদর্শ পুরুষ।

এর পরেরজন দেখতে আদমের মতোই, কিন্তু এত সুন্দর যেন সূর্য জ্বলজ্বল করছে। জানলাম, ইনিই ইউসুফ (আ)।

এর পরের ছবিতে দেখা গেল, সরু পা, ছোট চোখ, কিন্তু বড় পেট। লালচে ত্বক। গড় উচ্চতা। তিনি ছিলেন দাউদ (আ)।

তারপর একজন লম্বা অশ্বারোহীর ছবি দেখলাম। হেরাক্লিয়াস বললেন, ইনি সুলাইমান (আ)।

সবশেষে আমরা হিরাক্লিয়াসকে জিজ্ঞেস করলাম, “নবীদের এসব ছবি আপনি কোথায় পেলেন?”

তখন তিনি উত্তর দিলেন, “আদম (আ) আল্লাহর দরবারে আবেদন করেন যে, তাঁর বংশধরদের মধ্যে যারা যারা নবী হবেন তাদের আকার-আকৃতি তাঁকে দেখানো হোক। সেই মতে আল্লাহ তাদের প্রতিকৃতি আদমের কাছে পাঠিয়ে দেন। এগুলো আদম (আ) এর পরিত্যক্ত মূল্যবান বস্তুসামগ্রীর সাথে ছিল পশ্চিমের এক জায়গায়। বাদশাহ জুলকারনাইন এগুলো সেখান থেকে নিয়ে আসেন এবং হযরত দানিয়াল (আ)-এর কাছে সমর্পণ করেন। দানিয়াল পরে এগুলো কাপড়ে আঁকিয়ে নেন। এখন যে ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছ, এগুলো সব হুবহু দানিয়ালের আঁকা ছবি।”

হিরাক্লিয়াস বললেন, “আমার বাসনা, এ দেশ আমি ত্যাগ করি এবং তোমাদের একজন গোলাম হয়ে থাকি। যখন মৃত্যুবরণ করি, তখন যেন আমার সাথে সৎ ব্যবহার করা হয় আর আমার দেহ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।”

[নবুয়াতের প্রমাণপঞ্জি, মাওলানা মহিউদ্দিন অনূদিত, পৃষ্ঠা ২০]

এ ঘটনায় জুলকারনাইনের পরিচয় ইঙ্গিত করে আলেকজান্ডারকে নয়, বরং রাজা সাইরাসকে, কারণ সাইরাসই ছিলেন নবী দানিয়েল (আ) এর সন্নিকটে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এতক্ষণ যে ব্যবিলনের কথা বলা হলো, তা বর্তমানের ইরাকে পড়েছে।

এ পর্যন্ত মোটামুটি প্রধান হিব্রু নবীদের কাহিনী বর্ণনা করা হয়ে গিয়েছে। এর পরে যা যা ঘটেছে তা অনেকটাই ঐতিহাসিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *