অধ্যায় ২৮ : ইহুদী এসকাটোলজি
কটমটে একটি নাম দিয়ে দিলাম অধ্যায়ের। ইতিহাস তো শেষ, বর্তমানও বলে ফেললাম। এবার তাই ভবিষ্যতের পালা। কিন্তু ভবিষ্যৎ তো বলা যায় না!
কিন্তু তারপরও যুগে যুগে নানা ধর্মে ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে এসেছে, আসছে দিনগুলোতে কী হবে না হবে, তা নিয়ে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আলাপ হয়েছে দুনিয়া ধ্বংসের সময় এগিয়ে এলে কী হবে, সে বিষয়ে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এ নিয়ে এক আলাদা ধর্মবিদ্যাই আছে! গ্রিক থেকে ইংরেজিতে এসে সেই বিদ্যার নাম হয়েছে এসকাটোলজি (Eschatology), যার মানে ‘অন্তিম সময়ের বিদ্যা’। গ্রিক শব্দ ‘এসকাটোস’ মানে ‘অন্তিম’। ১৮৪৪ সালে এ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। এ অধ্যায়ে আমরা মূলত জানার চেষ্টা করব সেমিটিক এসকাটোলজি নিয়ে, অর্থাৎ শেষ সময় নিয়ে এ ধর্মগুলো কী বলে থাকে, বিশেষ করে ইহুদী ধর্ম, যেহেতু তারাই আমাদের বইয়ের বিষয়বস্তু।
ইহুদী ধর্মে শেষ সময়কে বলা হয় ‘আহারিত হা-ইয়ামিম’, তাদের পবিত্র তানাখ গ্রন্থে বারবার এসেছে এ শব্দটি। অন্তিম সময় বা এন্ড অফ টাইমস নিয়ে ইহুদীদের যত ভবিষ্যদ্বাণী, তার মূল উৎস হলো তানাখ বা হিব্রু বাইবেল। নির্বাসনের আগের নবীদের কিতাবে তারা এগুলোর খোঁজ করে, বিশেষ করে ইশাইয়া (আ), ইয়ারমিয়া (আ), হিজকীল (আ) এবং মূসা (আ)।
ইহুদীদের হিজকীলের কিতাব থেকে ভবিষ্যদ্বাণী হলো, ইহুদীদের নির্বাসন শেষে তারা যখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে, তখন অনুষ্ঠিত হবে ইয়াজুজ মাজুজের যুদ্ধ। [ইয়াজুজ মাজুজ ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মে কীভাবে উল্লেখিত, তা বিস্তারিত জানতে পড়ুন আমার ‘অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে’ বইটি।] মধ্যযুগীয় র্যাবাই এবং তাওরাত বিশারদ দাউদ কিমহির মতে, এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে জেরুজালেমে, বা জেরুজালেমকে ঘিরে। তবে হাসিদী ইহুদীরা মনে করতো, ইহুদীদের দুঃখ মোচন হবার আগ পর্যন্ত এ যুদ্ধ হবে না।
ইহুদী ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী, আল্লাহ দাউদ (আ)-এর বংশধারাকে আবার সিংহাসনে বসাবেন, রাজত্ব দেবেন। আবার দাঁড়াবে বাইতুল মুকাদ্দাস বা থার্ড টেম্পল অফ সলোমন। দাউদের বংশধারা থেকে আগত মাসীহ বা মেসায়া (খ্রিস্ট) ইহুদীদেরকে নেতৃত্ব দেবেন এবং এক মসীহ যুগের (মেসায়ানিক এজ) সূচনা করবেন। সেই যুগ হবে শান্তি ও সমৃদ্ধির। সারা পৃথিবীর সকল মানুষ ইহুদীদের ঈশ্বরকে এক ঈশ্বর বলে মেনে নেবে। অতঃপর কিয়ামত হবে এবং আল্লাহ সকল মৃতকে জীবিত করবেন, শুরু হবে নতুন জীবন।
মুসলিমদের মাঝে সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসিত একটি প্রশ্ন হলো, ইহুদীদের মাসিহ কি দাজ্জাল? ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, মাসিহ আদ-দাজ্জাল বা ভণ্ড মাসিহের আগমন ঘটবে শেষ যুগে, যাকে হত্যা করবেন ঈসা (আ), যিনি খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী প্রকৃত মাসিহ বা খ্রিস্ট। হিব্রু মাসিয়াহ (p) শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘যার গায়ে মেখে দেয়া হয়েছে’, অর্থাৎ রাজ-অভিষেকের সময় অভিষিক্তের শরীরে তেল মাখিয়ে দেয়া হতো, তাই এর ভাবার্থ হলো ‘ত্রাণকর্তার পদে যিনি অভিষিক্ত’, আরবিতে আল-মাসিহ (+ে wall)। ইহুদী ধর্মে আসলে চারজন মাসিহের উল্লেখ আছে। এরা হলেন- ‘দাউদের বংশের মাসিহ, ‘ইউসুফের বংশের মাসিহ’, ইলিয়াস (আ)- যাকে ইহুদী মতে জীবিত আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল, এবং সর্বশেষ আসবেন একজন ইমাম, যাকে কেবল ‘সৎ ইমাম’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর একজন আসবে ভণ্ড মাসিহ, যাকে হত্যা করবেন দাউদের বংশের মাসিহ। কে কোন সময় আসবেন, তা নিয়ে আছে বিতর্ক। সাধারণ বিশ্বাস হলো, প্রথমে ইউসুফের বংশের মাসিহ আসবেন, তিনি ইসরাইলের সন্তানদের একত্রিত করবেন, তাদের নিয়ে যাবেন জেরুজালেমে। জেরুজালেম বিজয়ের পর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস বানাবেন, এবং নিজের রাজত্ব শুরু করবেন। তখন ইয়াজুজ মাজুজ কিংবা দাজ্জালের আগমন হবে। কোনটা আগে হবে, তা বলা যায় না।
ইহুদী ধর্মে এই দাজ্জাল বা খ্রিস্টবিরোধী চরিত্রের নাম আরমিলাস। আরমিলাস এসে পুরো পৃথিবী জয় করে নেবে খুব কম সময়ে, এরপর জেরুজালেমে তার রাজধানী করবে এবং সেখান থেকে রাজত্ব করবে এবং নিজেকে খোদা দাবিও করবে। এবং এটি সম্পন্ন করতে গিয়ে আরমিলাস হত্যা করবে ইউসুফের বংশের মাসিহকেই, তার দেহ কবর না দেয়া অবস্থায় পড়ে থাকবে জেরুজালেমে। তখন ফেরেশতারা তার মৃতদেহ আড়াল করে রাখবেন, যতক্ষণ না দাউদের বংশের মাসিহের আগমন না ঘটে। তিনি আসার পর ইউসুফের বংশধারার মাসিহকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। ইলিয়াসও (আ) আসবেন দাউদের বংশের মাসিহের সাথে। এই মাসিহ নামার সময় ফেরেশতা পরিবেষ্টিত হয়ে নামবেন এবং তিনি আরমিলাসকে হত্যা করবেন কেবল তার শ্যেন দৃষ্টি বা নিঃশ্বাসের আঘাতেই। এই দাউদের বংশের মাসিহ হলেন আসল মাসিহ, যাকে ইহুদীরা আরামায়িকে ‘মালকা মেশিহা’ বা হিব্রুতে ‘মেলেখ মাশিয়াহ’ (রাজা মাসিহ) বলে থাকে।
ইসলামের নানা ভবিষ্যদ্বাণীর সাথেই ইহুদীদের কিছু ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়, চরিত্রগুলোর গড়মিল আছে যদিও। যেমন, ইয়াজুজ মাজুজের আগমনের কথা রয়েছে ইসলামেও। “আর যে জনপদকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, তার অধিবাসীদের ফিরে না আসা অবধারিত। যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ ও মাজুজকে বন্ধন মুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে।” (কুরআন, সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৯৫-৯৬)
আবু দাউদ শরিফের একটি হাদিসে এসেছে, মুয়ায ইবনে জাবাল (রা)-কে রাসুল (সা) বলছেন, “জেরুজালেমের রাজ্য বিকাশমান হবে যখন ইয়াসরিবের অবস্থা করুণ, ইয়াসরিবের অবস্থা করুণ হবে যখন মালহামা (শেষ যুদ্ধ) আসবে, আর মালহামার সাথে আসবে কনস্ট্যান্টিনোপল জয়, আর তার সাথে আসবে দাজ্জালের আগমন। রাসুল (সা) নিজের উরু বা কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, তুমি (মুয়ায) আমার সামনে বসে আছ তা যেমন সত্য, আমার এ কথাগুলোও তেমন সত্য।” (আবু দাউদ ৪২৯৪, ৩৯/৪ বা ৩৮/৪২৮১)
আরেকটি হাদিসে এসেছে, “আমার উম্মাতের একটি দল হকের ওপর বিজয়ী থেকে কিয়ামত পর্যন্ত লড়াই করতে থাকবে। অতঃপর ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ) অবতরণ করবেন। তাকে দেখে মুসলমানদের আমির বলবেন, “আসুন! আমাদেরকে নিয়ে নামাযের ইমামতি করুন।’ ঈসা (আ) বলবেন, ‘না; বরং তোমাদের আমির তোমাদের মধ্যে হতেই (হবে)।’ এই উম্মাতের সম্মানের কারণেই তিনি এ মন্তব্য করবেন।” (সহিহ মুসলিম)
এরকম হাদিসগুলো বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না সংক্ষেপে, তবে যে যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে অর্থাৎ মালহামা, তা অন্যান্য ধর্মে আর্মাগেডন (Armageddon) নামে পরিচিত। এটি আসলে কোনো মূল ইংরেজি শব্দ নয়, বরং হিব্রু থেকে এসেছে। মূল শব্দটি ছিল ‘হার মেগিদো’ অর্থাৎ মেগিদো পাহাড়। ইহুদী ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, মেগিদো টিলার কাছেই সর্বশেষ মহাযুদ্ধের বাহিনীগুলো জড়ো হবে। এজন্যই এর নাম আর্মাগেডন।
অনেক গোঁড়া ইহুদীর মাঝেই ভবিষ্যদ্বাণী ত্বরান্বিত করার একটি প্রবণতা থাকে, আর সেই সূত্রে বলতে হয় ‘পবিত্র গাভীর ইহুদী বৃত্তান্ত’। এ অদ্ভুত বিষয়ে অনেকের নানা জিজ্ঞাসা থাকে আমার কাছে। মসীহবাদী ইহুদীদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন অপেক্ষা প্রতীক্ষা যা নিয়ে, তার পেছনে আছে এক পবিত্র লাল গরু। কেন?
ব্যাপারটা খুলে বলা যাক। ইহুদীদের তাওরাত কিতাব বা অন্যান্য নবীদের কিতাব বলে বিশেষ এক নবী আসবেন। আর অন্তত একজন মাসিহ (Messiah) আসবেন। সেই নবী কে, সেটি এই বইয়ের আলোচ্য বিষয় নয়- এ নিয়ে লিখতে হলে অনেক বড় পরিসরে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু সেই মেসায়া (ক্রাইস্ট) কে, সেটা বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। নবী নিয়ে ইহুদীদের মাথাব্যথা নেই।
হযরত ঈসা (আ) যে সেই মেসায়া বা খ্রিস্ট, সেই বিষয়ে অন্য দুই সেমিটিক ধর্ম ইসলাম আর খ্রিস্ট ধর্মবিশ্বাসে কোনোই দ্বিমত নেই। বাগড়াটা ইহুদী ধর্মবিশ্বাসে। কারণ, ইহুদী বিশ্বাসে যীশু হলেন ভণ্ড মেসায়া, অনেক ভণ্ডের একজন। তাদের যুক্তি যে নেই, তা নয়, সেই যুক্তি হলো, কিং ডেভিড অর্থাৎ দাউদ (আ) এর বংশধর সেই মেসায়া এসে জেরুজালেম থেকে দুনিয়া শাসন করবেন, বাইতুল মুকাদ্দাস তথা টেম্পল অফ সলোমন হবে তার শাসনকেন্দ্র। তার কিছুই করে দেখাতে পারেননি যীশু খ্রিস্ট। তার ওপর, তিন ধর্মমতেই, স্বয়ং ইহুদীরাই যীশুকে রোমানদের দ্বারা ক্রুশে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের ব্যবস্থা করে। ইহুদীরা একজন মৃত ও ব্যর্থ কাউকে খ্রিস্ট মানতে নারাজ। সুতরাং, খ্রিস্টের আগমন এখনও বাকি। যিনি আসবেন, এসে ইসরাইলকে সেরা বানাবেন, টেম্পল অফ সলোমন নির্মাণ করবেন আবার, সেখান থেকে দুনিয়াজুড়ে কর্তৃত্ব করবেন, যা বললাম এতক্ষণ আরকি। যে সব ইহুদী তখন যীশুর বাণীতে সাড়া দেয়, তারা পরিচিত হয় যীশুর গ্রামের বাড়ি নাসরতের (নাজারেথ) নামে-নাসারা, নাজারিন (অন্য এক সূত্রে, সাহায্যকারী অর্থে নাসারা)। এই ইহুদী আর নাসারাদের খ্রিস্ট দ্বন্দ্বের মাঝেই হাজির হয় ইসলাম। ইসলামেও যীশুই খ্রিস্ট। কিন্তু ইহুদীদের নিজস্ব হিসাবানুসারে যীশু তো আসলেই অনেক কিছু পূরণ করেননি, অন্তত নবী হিজকীল (আ) আর ইশাইয়া (আ) মেসায়া সম্পর্কে যা যা ভবিষ্যৎবাণী করে রেখে গিয়েছিলেন, সেগুলোর মাঝে এক দাউদের বংশ ছাড়া বাকিগুলোর পূরণ হওয়াটা জরুরি তাদের মতে।
এখানেই ঘটনার শুরু।
ইহুদী ধর্ম যীশুর ব্যাপারে অবশ্যই আর কিছুই কখনও বলেনি, এক অবিবাহিতা নারীর অবৈধ সন্তান ও ভণ্ড মেসায়া দাবিদার- এটুকুই ইহুদী ধর্মে তার পরিচয়। অন্যদিকে, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম আরেকটি ব্যাপারে বেশ একমত, সেটি হলো, যীশুর দ্বিতীয় আগমন। তিনি আসবেন এবং শেষ যুদ্ধ করবেন ভণ্ড মেসায়ার বিরুদ্ধে, যাকে খ্রিস্টানরা বলে অ্যান্টিক্রাইস্ট, আর মুসলিমরা বলে মাসিহে দাজ্জাল (“ভণ্ড মসীহ”)। তিনি তারপর জেরুজালেম থেকে শান্তির রাজত্ব কায়েম করবেন, ইত্যাদি। এদিক থেকে তার খ্রিস্টত্বের শর্ত পূরণ হয়ে যায়। ইসলামে অবশ্য কোনো গ্রন্থে বা কোথাও এই শর্ত পূরণ নিয়ে কথা হয়নি, তবে ইহুদী খ্রিস্টান ধর্ম আবার এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক। প্রশ্ন হলো, সেই আগমনটা কবে? ইহুদীরা যদি যীশুকে ভণ্ড বলে, তাহলে অপরজন যাকে বাকি দুই ধর্ম ভণ্ড বলবে, তাকেই ইহুদীদের সত্য বলে মেনে নেবার কথা। এবং এটাই ইসলামি এসকাটোলজি বলে, ইহুদীরা সেই ভণ্ড মেসায়ার অনুসারী হবে দলে দলে। কথা হলো, এই সত্য মিথ্যা মেসায়ার আগমন বিষয়ে ইহুদী এসকাটোলজি কী বলে?
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় অর্ধসহস্র বছর আগে প্রথমবারের মতো বাইতুল মুকাদ্দাস বা টেম্পল অফ সলোমন ধ্বংস করে দেন ব্যবিলনের সম্রাট নেবুকাদনেজার, ইহুদী কিতাব তাই বলে। ইহুদীরা দাসবন্দী অবস্থা থেকে আবার ইসরাইলে ফিরে, বানায় সেকেন্ড টেম্পল। এই বাইতুল মুকাদ্দাস এবার ৭০ সালের দিকে আবার ভেঙে দিয়ে যায়, এবার ভাঙে রোমানরা। সুতরাং, মেসায়ার আগমন সত্য হতে হলে, তাকে টেম্পল অফ সলোমন থেকে রাজত্ব করতে হলে, ওই স্থানে থার্ড টেম্পল প্রয়োজন, যা অরিজিনাল বাইতুল মুকাদ্দাসের আর্কিটেকচারাল ডিজাইনে নির্মিত হবে। ডিজাইন সংরক্ষিত আছে ভালোভাবেই। সেটা সমস্যা না। কিন্তু থার্ড টেম্পল কিন্তু যেন তেন সময় বানানো যাবে না! থার্ড টেম্পল নির্মাণের সংকেত কী হবে জানেন?
ইহুদী ধর্মগ্রন্থ বলে থাকে, টেম্পলের পবিত্রতার জন্য প্রয়োজন এক লাল গরুর দেহভস্ম। এক নিখুঁত লাল গরুর। শত শত বছর আগে এই একই রকম গরুর খোঁজে হন্যে হয়ে গিয়েছিলো ইহুদীরা। থার্ড টেম্পলকে পবিত্র করে ব্যবহার উপযোগী করতে যা যা প্রয়োজন, তার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে দ্য টেম্পল ইনস্টিটিউট। সবই প্রস্তুত, কাজ শুরু হলে শেষও হয়ে যাবে। কিন্তু গরুর খোঁজ কই?
এ গরু হতে হবে— “লালের নিখুঁত উদাহরণ। যদি দুটো লোমও পাওয়া যায়, যেটা একটু হালকা লাল, তাহলেও সেই গরু বাদ, অন্য রঙ তো পরের কথা। খুরের রংও হতে হবে লাল। বয়স তিন থেকে চার বছর, এর কম হবে না। সূচ পরিমাণ কোনো ক্ষতও থাকতে পারবে না। কোনোদিন তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো হয়নি, এমনটি হতে হবে। উৎসর্গ বাইতুল মুকাদ্দাসে নয়, জেরুজালেমের জলপাই পাহাড়ে হবে।” (তাওরাতের গণনাপুস্তক)
১৯৯৭ সালে টেম্পল ইনস্টিটিউট এক লাল গাভীর সন্ধান পায়, কিন্তু সেই গাভীর ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে খুঁত পাওয়া যায়। একই ঘটনা ঘটে ২০০২ সালেও, সেবারের লাল গরুরও পরে খুঁত ধরা পড়ে। গরুকে আবার ইসরাইলি হতে হবে, এমন শর্তের কথাও শোনা যায়। ১৯৮৭ সালে টেম্পল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় থার্ড টেম্পল নির্মাণের উদ্দেশ্যে। গত দুহাজার বছরেও কোনো নিখুঁত লাল গরুর জন্ম হয়নি বলে তারা জানায়। ২০১৮ সালে এক লাল গরুর জন্মের সন্ধান তারা পায়, যা আগামী কয়েক বছর চোখে চোখে রাখা হবে বলে জানানো হয়, কোনো খুঁত ধরা পড়ে কি না, দেখার জন্য। হিব্রুতে এ গরুকে বলা হয় “পারাহ আদুমাহ” বা লাল গরু (Red Heifer)। তবে বিকল্প হিসেবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে নিখুঁত লাল গরু উৎপাদনের চেষ্টাও যে করা হচ্ছে না, তা নয়। এ সবই কেবল থার্ড টেম্পল নির্মাণের পথ খুলে দেবার প্রচেষ্টা, যেন আগমন করতে পারেন মেসায়া। সাদিয়া গাওনের মতো ইহুদী ব্যাখ্যাবিশারদ হিব্রু ‘আদুমাহ’ শব্দটিকে লাল নয় বরং হলদে অনুবাদ করেছেন। ইহুদী পণ্ডিতগণ অনেকেই ভেবেছেন, কেন এই গরু এত জরুরি। কিন্তু কোনো উত্তর না পেয়ে শেষমেশ এটিকে ঐশী আদেশ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন তারা, যার উত্তর স্রষ্টা ছাড়া কেউ জানে না।
বর্তমানে যে স্থানে সোনালি গম্বুজের ডোম অফ দ্য রকের অবস্থান, সেখানেই ফার্স্ট এবং সেকেন্ড টেম্পল অফ সলোমন তথা বাইতুল মুকাদ্দাসের অবস্থা ছিল অন্তত ৭০ সাল পর্যন্ত। এটি গুঁড়িয়ে থার্ড টেম্পল বানালেই মেসায়ার আগমনের ভবিষ্যৎবাণী পূর্ণ হবে, এমনটাই প্রত্যাশা সেই ইহুদীদের।
বহুকাল আগে যখন নিখুঁত গরুর খোঁজ করছিল মরুচারী ইহুদী জাতি এবং প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিল হযরত মূসা (আ)-কে, সে ঘটনাকে পবিত্র কুরআনেও (২:৬৭-৭১) উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে গরুর রঙ লাল নয়, হলুদ। এই ঘটনার কারণে পবিত্র কুরআনের দ্বিতীয় সুরার নামকরণ করা হয় “বাকারা” বা “গরু”।
২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিবিসির খবরে আসে, যেহেতু জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট এলাকায় ইহুদীদের প্রার্থনা করতে ঢোকা বলতে গেলে নিষিদ্ধই, সেহেতু অনেকেই মুসলিম সেজে সেখানে ঢুকে পড়ে; এজন্য তারা মুসলিমদের নামাজ পড়ার রীতিনীতিও শিখে নেয়। এদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের প্রত্যাশা এখানকার মসজিদ দ্রুত ভাঙা হবে, গড়ে তোলা হবে থার্ড টেম্পল, যেন ভবিষ্যৎবাণী ত্বরান্বিত হয়।
ভবিষ্যতের ব্যাপার ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। এখন কেবল দেখার পালা, বর্তমানের স্রোত গড়ায় কোনদিকে।