অধ্যায়-২৭ ইসরাইলের সেবায় হযরত উজাইর (আ)
উজাইর বা এজরা আসলে নবী ছিলেন কি ছিলেন না, এটা নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে তিনি ইহুদী জাতির জন্য ছিলেন প্রবাদপুরুষ। মোটামুটি ৪৮০ থেকে ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার চলাফেরা ছিল। কথিত আছে, তার কবর ইরাকের বসরার নিকট। আবার কেউ বলেন, উত্তর সিরিয়ার আলেপ্পোর নিকটে। তিনি ব্যবিলনে বসবাসরত নির্বাসিত এহুদা রাজ্যের ইহুদীদের দলকে জেরুজালেমে ফিরিয়ে নিয়ে যান। (এজরা, ৮:২-১৪) তিনি নিশ্চিত করেন যেন ইহুদীরা নিজেদের ধর্মের বাইরে কাউকে বিয়ে না করে। তার উদ্দেশ্য ছিল ইহুদী রক্ত বিশুদ্ধ রাখা, অন্য জাতির সাথে মিশ্রিত না হওয়া।
সেকেন্ড টেম্পল নির্মাণের সময়কালে নেহেমিয়া ছিলেন এহুদা রাজ্যের গভর্নর। পারস্যের রাজা তাকে যখন জেরুজালেমে পাঠান তখন তার কাজ ছিল জেরুজালেমের ভাঙা দেয়াল পুনর্নির্মাণ করা। তা শেষ হলে নেহেমিয়া উজাইর (আ)-কে দিয়ে তাওরাত পাঠ করান। উজাইর (আ) তাওরাতের আইন প্রতিষ্ঠা করেন জেরুজালেমে।
ইহুদীদের কোর্ট সানহেদ্রিন ২৩ জন কিংবা ৭১ জন প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত। এ সানহেদ্রিন প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেয়া হয় উজাইর (আ)-কেই।
ইবনে কাসিরের তাফসিরে বর্ণিত আছে, যখন আমালিকা সম্প্রদায় বনী ইসরাইলের উপর জয়ী হয়, তাদের আলেমদের হত্যা করে এবং লোকদের বন্দী করে ফেলে, তখন উজাইর (আ) খুব মর্মাহত হন। তিনি এমনভাবে কাঁদা শুরু করলেন যে তার চোখের অশ্রু বন্ধই হয় না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে একবার একটি মাঠের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন এক মহিলাকে দেখতে পেলেন একটি কবরের জেরুজালেম পুনর্নির্মাণ করছেন নেহেমিয়া
পাশে বসে কাঁদছে, আর বলছে, “হায়! এখন আমার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা কী করে হবে?”
এ দেখে উজাইর (আ) সেখানে দাঁড়িয়ে যান এবং জিজ্ঞেস করেন, “এ লোকের আগে তোমার খাওয়া পরার ব্যবস্থা কে করতেন?”
সে উত্তর দিল, “আল্লাহ।”
তখন তিনি তাকে বললেন, “তাহলে আল্লাহ তো এখনও জীবিত, তার তো মৃত্যু নেই।”
তখন মহিলা বলল, “হে উজাইর! আপনি বলুন তো, বনী ইসরাইলের আগে আলেমদেরকে বিদ্যা শেখাতেন কে?”
উজাইর (আ) বললেন, “আল্লাহ।”
তখন মহিলা বলল, “তাহলে আপনি কেন কেঁদে সময় কাটাচ্ছেন?”
উজাইর (আ) বুঝতে পারলেন যে, তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তাকে বললেন, “তুমি অমুক নদীতে গিয়ে গোসল করো, দু’রাকাত নামাজ আদায় করো। সেখানে তুমি একজন লোককে দেখতে পাবে। সে তোমাকে যা কিছু খেতে দেবে তা তুমি খেয়ে নেবে।”
কথামতো উজাইর (আ) সেখানে গেলেন। গোসল করে তিনি নামাজ আদায় করলেন। এক লোককে এরপর তিনি দেখতে পেলেন সেখানে, লোকটি তাকে বলেন, “মুখ খুলুন!”
তিনি মুখ খুলে দেন। তখন লোকটি পাথরের মতো কী একটা জিনিস তিনবার তার মুখে নিক্ষেপ করলেন। সাথে সাথে কিছু একটা হয়ে গেলো। উজাইর (আ) তাওরাতের সবচেয়ে বড় আলেম হয়ে গেলেন। তারপর তিনি বনী ইসরাইলের কাছে গিয়ে বললেন, “আমি তোমাদের কাছে তাওরাত নিয়ে এসেছি।”
তারা বলল, “উজাইর! আপনি তো মিথ্যাবাদী ছিলেন না আগে!”
তখন উজাইর (আ) হাতে কলম নিলেন, এবং পুরো তাওরাত লিখে ফেললেন।
লোকেরা যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে সাথে আলেমরাও ফিরে আসেন। তারা উজাইর (আ) এর ব্যাপারটা জানতে পারেন। তখন তারা পাহাড়ে ও গুহার মাঝে লুকানো তাওরাতের পুস্তিকাগুলো বের করে আনেন। ঐ পুস্তিকাগুলোর সাথে উজাইর (আ) এর লিখিত পুস্তিকাগুলো তারা মিলিয়ে দেখেন। দেখা যায়, তা পুরোপুরি মিলে গেছে।
এতে অনেকে উজাইর (আ) এর মাঝে ঐশ্বরিকতা খুঁজে পেলো।
ইবনে কাসির জানান, উজাইর (আ) সুলাইমান (আ) ও জাকারিয়া (আ) এর মাঝামাঝি কোনো একসময় বসবাস করতেন। কেউ কেউ তাকে নবী মনে করতেন, আবার এমনও আছে যে, কেউ কেউ বলেছেন আল্লাহ উজাইর (আ) কে নবী-তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি তাকদির বা ভাগ্যে বিশ্বাস করতে চাননি। আন্দালুসিয়ার ইবনে হাজম কিংবা আল-সামাওয়াল মনে করতেন, উজাইরের (আ) কোনো শীষ্য তাওরাত বিকৃত করে। তাকে আধুনিক ইহুদী ধর্মের জনকও বলা হয়, কারণ তিনি নির্বাসনের পর ফিরে এসে হারানো ইহুদী ধর্মকে নতুন রূপ দান করেন। তিনি একইসাথে অনেকগুলো ভাষা ভাল করে জানতেন।
ইবনে হাজমের লেখনি অনুযায়ী, ইয়েমেনের এক ইহুদী গোত্র মনে করত, উজাইর (আ) আসলে আল্লাহর পুত্র। কিছু কিছু ইয়েমেনি ইহুদী গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তারা উজাইর (আ)-কে মসীহ ভাবতেন। উজাইর (আ) এই ইয়েমেনী গোত্রকে জেরুজালেমে ফিরতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তারা আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তারা বিশ্বাস করে, এ অবাধ্যতার কারণে উজাইর (আ) তাদের অভিশাপ দেন, ফলে তারা এত দরিদ্র রয়ে যায়। এজন্য ইয়েমেনি সেই ইহুদী গোত্রে কারও নাম ‘উজাইর’ বা ‘এজরা’ রাখা নিষিদ্ধ।
কুরআন বলছে, “ইহুদীরা (একটি গোত্র) বলে উজাইর আল্লাহর পুত্র এবং খ্রিস্টানরা বলে মসীহ আল্লাহর পুত্র। এ হচ্ছে তাদের মুখের কথা। এরা পূর্ববর্তী অবিশ্বাসীদের মতো কথা বলে।” (সুরা তাওবা ৯:৩০)
তবে বর্তমানে কোনো ইহুদীই উজাইর (আ) বা এজরাকে ঈশ্বরপুত্র ভাবে না। বরং এটাকে ‘ধর্মত্যাগী’ বিশ্বাস বলেই মনে করে। তাফসিরে ইমাম কুরতুবী (র) বলেন, “কুরআনে ‘ইহুদীরা বলে’ এই কথাটি একটি সাধারণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে যদিও এর মানে সুনির্দিষ্ট, কারণ সব ইহুদী এমনটি (উজাইর আল্লাহর পুত্র] বলতো না। এটা তো আল্লাহর ঐ বক্তব্যের মত ‘যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে…’ (আলে ইমরান ৩:১৭৩) অথচ সব লোক তা বলেনি।”
বলা হয়, ইহুদীদের ঈশ্বরপুত্র এজরা ধারণাটি নিয়ে নবী (সা) এর কাছে আসে যারা তারা হচ্ছে- সাল্লাম ইবন মিশকাম, নু’মান বিন আবু আওফা, শাস ইবন কায়স ও মালেক ইবনুস সাইফ।
‘অ্যা হিস্ট্রি অফ দ্য জ্যুস অফ অ্যারাবিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “আমরা সহজেই ধরতে পারি যে হেজাজের [মক্কা-মদীনা] ইহুদীরা, যারা কিনা সুস্পষ্টভাবেই মোরাকাবার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মরমি ভাবধারায় আক্রান্ত ছিল, উজাইরকে সেই স্থান দিয়েছিল। এর কারণ ছিল তার কিতাবের অনুবাদের বিবরণ, তার ধার্মিকতা। এবং বিশেষত, ঈশ্বরের অনুলেখক হিসাবে তাকে হনোক (Enoch) এর সাথে তুলনা করা হত। এ দ্বারা ঈশ্বরের পুত্রদের একজনকেও বোঝায়। এবং নিঃসন্দেহে তিনি ধর্মীয় নেতাদের সকল বৈশিষ্ট্য বহন করতেন, যাকে ইহুদিরা বন্দনা করত।” (জি. ডি. নিউবাই)
উল্লেখ্য, বর্তমানে যে হিব্রু বর্ণমালা দেখতে পাওয়া যায়, সেটি এই উজাইর (আ)-এর আমলেই শুরু হয়, এর আগে হিব্রু বর্ণমালা পুরোপুরি দেখতে বর্তমানের মতো ছিল না।