অধ্যায়-২৭ : অতঃপর বর্তমান

অধ্যায় ২৭ : অতঃপর বর্তমান

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বেঞ্জামিন বা বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু জিতে যান, প্রধানমন্ত্রী হন ইসরাইলের। সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনি দাঙ্গায় ৮০ জন মারা যায়। ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ের নির্বাচনে এহুদ বারাক জিতে যান। কিন্তু ২০০১ সালে নির্বাচনে জেতেন এরিয়েল শ্যারন। তিনি ২০০২ সালে পশ্চিম তীরে ব্যারিয়ার বানানো শুরু করলেন। এর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনের গাজা থেকে সেখানে মর্টার হামলা হতে লাগল। আর লেবানন থেকে হিজবুল্লার আক্রমণ অব্যাহত ছিল। ২০০৪ সালে পুরোদমে গাজায় প্রতিশোধ নিতে নামে ইসরাইল। চলতে থাকে অপারেশন।

এর মাঝে চলতে থাকা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার কথা ভুললে চলবে না। সেটির শুরু হয়েছিল কীভাবে, তা বলা যাক। ২০০০ সালের ১১-২৫ জুলাই বিল ক্লিনটনের নিমন্ত্রণে ক্যাম্প ডেভিডে একটি সামিট অনুষ্ঠিত হয়, উদ্দেশ্য ছিল বরাবরের মতোই ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতি টানা। যোগ দেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এবং পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত। কিন্তু এই সামিটে কোনো একমতে পৌঁছানো যায়নি।

ঠিক তার পরপর সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন লিকুদ পার্টির প্রধান অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট বা আল-আকসা কম্পাউন্ডে যান, যা প্ৰবল বিতর্কের জন্ম দেয়। এর প্রতিবাদে যে দাঙ্গা শুরু হয়, তা পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও তেমন লাভ হয়নি। ইসরাইলিরা গুলি, ট্যাংক এবং এয়ার স্ট্রাইক ব্যবহার করতে শুরু করে; ওদিকে ফিলিস্তিনিরাও পাল্টা আক্রমণ চালায়, যদিও তাদের অস্ত্র ইসরাইলের সমান কিছু ছিল না। ৩,০০০ ফিলিস্তিনির বিপরীতে মারা যায় ১,০০০ ইসরাইলি। ২০০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিসরের শার্ম এল শেইখের সামিটের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার ইতি হয় বলে অনেকে মনে করে থাকেন। শ্যারন কথা দেন যে, তিনি ৭,৫০০ এর মাঝে ৯০০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দেবেন, আর ইন্তিফাদার সময় পশ্চিম তীরের যেটুকু ভূমি ইসরাইল দখল করেছিল, সেগুলো ফিরিয়ে দেবেন।

২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে জিতে আসে হামাস, এসেই তারা আগের সকল সাইন করা চুক্তি বাতিল বলে গণ্য করে। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী গণহত্যাকে জায়োনিস্টদের বানানো মিথ বা নিছক কিংবদন্তী বলে প্রচার করে বসে এবং UNRWA এর প্রধানকে চিঠি দেয় এ ব্যাপারে, যেন এ বিষয়ে তাদের স্কুলে পড়ানো না হয়। এটা তাদের বড় একটি ভুল ছিল। ২০০৬ সালে শ্যারন স্ট্রোক করায় প্রধানমন্ত্রী হন এহুদ ওলমার্ট।

২০০৬ সালের ১৪ মার্চ এক ফিলিস্তিনি কারাগারে অপারেশন চালায় ইসরাইল। জুন মাসে ফিলিস্তিনের হামাস গাজা বর্ডার পেরিয়ে ট্যাঙ্ক অ্যাটাক করে ইসরাইলি সেনাকে ধরে নিয়ে আসে। লেবাননের হিজবুল্লাও প্রায় একই কাজ করে, দুজন ইসরাইলি সেনাকে ধরে নিয়ে আসে। ফলে ইসরাইল দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধ শুরু করে দেয়। ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় হামাস।

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলি এয়ারফোর্স সিরিয়ার নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর ধ্বংস করে দেয়। ২০০৮ সালে হামাসকে শায়েস্তা করতে গাজায় অভিযান চালায় ইসরাইল। ২০০৯ সালে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় আসেন আবার। ২০১১ সালে হামাস আর ইসরাইলের চুক্তি হয়, ফলে সেই অপহরণ করা ইসরাইলি সেনার বিনিময়ে ইসরাইল ১,০২৭ ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দেয়।

২০১২ সালের নভেম্বরে হামাস নেতা আহমেদ জাবারিকে হত্যা করতে ইসরাইল গাজায় হামলা শুরু করে। যখন ২০১৪ সালে ফাতাহ আর হামাস একত্রে সরকার গঠন করতে রাজি হয়, তখন ইসরাইল শান্তিচুক্তি করতে বসার জন্য অস্বীকৃতি জানায়।

২০১৪ সালের ৮ জুলাই হামাসের রকেট হামলার উত্তরে ইসরাইল গাজা এলাকায় বড় আকারের আক্রমণ শুরু করে। সেই আক্রমণের পর বেশ কয়েক বছরে তেমন বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। ২০১৭ সালে রাজধানী তেলআবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেম নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বাদ দিলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা ম্রিয়মাণই ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে করোনাকালে এসে পরিস্থিতি হঠাৎ তুঙ্গে ওঠে কোভিড ভ্যাক্সিনেশন নিয়ে বৈষম্যের পাশাপাশি এবার শুরু হয় আবারও সশস্ত্র সংঘাত।

হঠাৎ কেন নারকীয় আক্রমণ শুরু করেছিল ইসরাইল? চলুন এবার জেনে নেয়া যাক ২০২১ এর এই আক্রমণের পেছনের ঘটনাগুলো, নির্যাতিত ফিলিস্তিনের আর্তনাদ আর কিংবদন্তিতুল্য ইসরাইলের আয়রন ডোমের বাস্তবতা।

ইসরাইল অনেক যুদ্ধেই জড়িয়েছে। যেমন, ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব- ইসরাইল যুদ্ধ, ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকট বা দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধ বা তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ইত্যাদি। আর ওদিকে গাজা ও পশ্চিম তীরে ধীরে ধীরে জায়গা দখল বাড়ছেই। এদেরকে আমরা বলি দখলদার ইসরাইলি, ইংরেজিতে বলে ইসরাইলি সেটলার, যারা ‘দখল’ করছে। শুরুর দিকে স্বল্প সংখ্যক ইহুদী হাজির হলেও, ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবী থেকে ইহুদীদেরকে ‘আলিয়া’র মাধ্যমে জড়ো করে ইহুদী জনসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, যেন একটি পর্যায়ে পবিত্র ভূমির দাবি আদায় করা যায় স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে।

২০২১ সালের মে মাসে রমজানের শুরু থেকেই পরিস্থিতি ছিল থমথমে। ইসরাইলি পুলিশ জেরুজালেমের ইহুদী অধ্যুষিত ওল্ড সিটির বাইরে দামেস্ক গেটে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জমায়েত নিষিদ্ধ করে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, দামেস্ক গেট কেন? ১৩০-১৩১ সালের দিকে রোমান সম্রাট হ্যাড্রিয়ান জেরুজালেম এলাকা পরিদর্শনে আসেন। এখানে একটি বিজয়স্তম্ভ ছিল, যার ওপরে সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের ভাস্কর্য। কালের বিবর্তনে এ ভাস্কর্য আর স্তম্ভ ধ্বংস হয়ে গেলেও, লোকে এখানে থাকা ফটকের আরবি নামের মধ্য দিয়ে মনে রাখে সে ঘটনা। আরবি নামটি ‘বাব আল-আমুদ’ বা স্তম্ভ ফটক। পরবর্তী সময়ে এ গেট দিয়ে বের হয়ে লোকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে যেত, তাই এর বিকল্প নাম হয়ে যায় দামেস্ক গেট। ইংরেজিতে এটিই প্রচলিত হয়, ডামেস্কাস গেট। এই দামেস্ক গেটটি ফিলিস্তিনি জাতিগত আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনি আর ইসরাইলি সেনা ও পুলিশদের মাঝে সংঘর্ষগুলো এই দামেস্ক গেট এলাকা ঘিরেই হয়ে আসছে, কারণ এখানেই ফিলিস্তিনিরা আন্দোলন আর প্রতিবাদের জন্য জড়ো হয়ে থাকেন। এজন্য কোনো প্রতিবাদের আভাস পেলেই এ এলাকায় জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়।

তবে যাই হোক, ফিলিস্তিনিরা সেখানে জড়ো হয়ই, এবং প্রতিবাদও হয়। সংঘর্ষ হয়। একটা পর্যায়ে ইসরাইলি পুলিশ ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। কিন্তু তখন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই। ওদিকে, ইফতারের পর ফিলিস্তিনি জমায়েত এমনিতেই নিষিদ্ধ।

রমজানের শেষ সপ্তাহে এসে ইহুদী অধ্যুষিত পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহ এলাকা থেকে বাদবাকি মুসলিম পরিবারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এই এলাকায় ত্রয়োদশ শতকের সুলতান সালাহউদ্দিন বা সালাদিনের চিকিৎসক শেখ জাররাহর সমাধি রয়েছে। সেখান থেকেই এলাকার এ নাম। পূর্ব জেরুজালেমের এ অংশে মুসলিম বেশি, মানে ফিলিস্তিনি বেশি। একটা সময় জেরুজালেমের বনেদি মুসলিমদের কেন্দ্র ছিল শেখ জাররা। কিন্তু ১৯৬৭ সালে পূর্ব জেরুজালেম দখলে চলে যায় ইসরাইলের হাতে। এখন এই শেখ জাররাহ থেকেও তাদের বিতাড়ন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ইহুদী জায়োনিস্টদের দাবি, ১৮৮৫ সালেই নাকি তারা এ এলাকা কিনে নিয়েছিল।

৭ মে রাত্রে শত শত ফিলিস্তিনির প্রতিবাদে বাধা দেয় পুলিশ। শেখ জাররাহর চার ফিলিস্তিনি মুসলিম পরিবারকে উৎখাতের বিষয়ে পূর্ব জেরুজালেমে কেন্দ্রীয় কোর্ট ইসরাইলের পক্ষে রায় দেয়। শুনানির তারিখ তারা ফেলে ২০২১ সালের মে মাসের ১০ তারিখে। বিশেষ এক দিন।

মে ইসরাইল পালন করে জেরুজালেম দিবস হিসেবে; ইয়ম ইয়েরুশালায়িম’। ইসরাইলের জাতীয় ছুটির এ দিনটি মূলত সেই যে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল আরবকে পরাজিত করেছিল, সেটির উদযাপন। এদিন জেরুজালেমের পুরনো শহর ইসরাইলিদের দখলে আসে। প্রতি বছর ইহুদীদের পতাকা মিছিল শুরু হয় সেই দামেস্ক গেট থেকে, আর শেষ হয় আল আকসা কম্পাউন্ড বা ইহুদীদের টেম্পল মাউন্ট তথা বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকার পশ্চিম দেয়ালে এসে, মাঝে দিয়ে তারা মুসলিম এলাকা পার হয়। এ বিশেষ দিনে শুনানির কারণ এদিন মুসলিমরা বাধা দিতে পারবে না, রাস্তাঘাট ইহুদীদের দ্বারাই পূর্ণ থাকবে।

কিন্তু বড় আকারের আন্দোলনের ভয়ে শেষমেশ এ পরিকল্পনা থেকেও সরে আসে ইসরাইল সরকার; মিছিলের গতিপথ বদলে দেয়ার নির্দেশ আসে। সুপ্রিম কোর্ট পিছিয়ে দেয় শুনানির তারিখ। পবিত্র রমজানে আল-আকসা মসজিদে জড়ো হওয়া শত শত ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীদের ওপর আক্রমণ করে ইসরাইলি ফোর্স। আহত হয় অসংখ্য ফিলিস্তিনি। এটি মে মাসের ১০ তারিখ, ২০২১।

গাজা উপত্যকার হামাস আল্টিমেটাম দিল, আল-আকসা আর শেখ জাররাহ থেকে ইসরাইলি ফোর্সকে চলে যেতে হবে, নাহলে আক্রমণ চালাবে তারা। সন্ধ্যার দিকে অনেক বছর পর ইহুদী অধ্যুষিত জেরুজালেম আর দক্ষিণ ইসরাইলের দিকে পাল্টা আক্রমণ চালায় হামাস মিসাইল ছুঁড়ে। হামাসের ভাষ্য জানা যায়নি, তবে ইসরাইলের মতে, প্রতি তিন মিনিটে নাকি একটি করে রকেট ছোঁড়া হয়েছে।

ইসরাইল তখন গাজায় এয়ারস্ট্রাইক চালাতে শুরু করে। হামাসের আক্রমণ ব্যাপক হলেও ইসরাইলের আক্রমণের মতো ভয়ংকর নয়। কারণ, মুসলিম অধ্যুষিত এ এলাকা অর্থাৎ ফিলিস্তিনের ডিফেন্স সিস্টেমের অভাব। এয়ারস্ট্রাইকগুলোর কারণে ১৩ তলার আবাসিক ভবন পর্যন্ত ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত, আগেই বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন অধিবাসীরা। কিন্তু তাই বলে সবাই এত ভাগ্যবান নয়। প্রতিনিয়তই আক্রমণ চলছে আর ইসরাইলের মতে, হামাস না থামলে তারা যুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত। যদি এটাকে ইতোমধ্যে যুদ্ধ না ডাকা হয় আরকি।

কিন্তু এই কাউন্টার-অ্যাটাকে কেন কিছু হয় না ইসরাইলের? কারণ তাদের আছে অসম্ভব শক্তিশালী ‘আয়রন ডোম’ নামের এয়ার ডিফেন্স। এখন বলি সেটি কীভাবে কাজ করে।

ইসরাইলের নানা জায়গা জুড়ে বিরাজমান জালের মতো রাডার আর মিসাইল লঞ্চারের সমষ্টি এই আয়রন ডোম। কোনো জায়গা থেকে মিসাইল উৎক্ষেপিত হলে সাথে সাথে আয়রন ডোম সেটিকে চিহ্নিত করে এবং হিসেব শুরু করে এটি কোথায় গিয়ে আঘাত করবে, তা বের করতে। যদি সেটি কোনো জনবিরল এলাকায় পড়বে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাহলে আয়রন ডোম কিছুই করে না। আর যদি দেখা যায় এটি মানুষ অধ্যুষিত এলাকার দিকে আসছে, তাহলে সংশ্লিষ্ট এলাকা বা যেখান থেকে সুবিধা, সেখান থেকে কাউন্টার মিসাইল উৎক্ষেপিত হয়। সেগুলো আকাশে গিয়ে পিছু নেয় ছুটে আসা মিসাইলের এবং সেটিকে আকাশেই ধ্বংস করে দেয়। ২০১১ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ৯০% মিসাইলকে ইন্টারসেপ্ট বা মাঝ আকাশে ধ্বংস করে দিয়েছে আয়রন ডোম। প্রতিটি রকেটের পেছনে ইসরাইলের খরচ ২০,০০০ ডলার। এই বড় প্রক্রিয়াটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সমাপ্ত হয়। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো হামাস এত রকেট একবারে ছুঁড়ছে যে, আয়রন ডোমকেও হিমশিম খেতে হয়েছে; এই অতিমাত্রায় মিসাইল ছোড়াই আয়রন ডোমের দুর্বলতা আপাতত। যার ফলে সেই ৭ জন ইসরাইলির মৃত্যু হয় এখন পর্যন্ত। অর্থাৎ আয়রন ডোমের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঢুকে পড়েছে হামাসের মিসাইল। যে ভিডিও ক্লিপগুলো ছড়িয়ে পড়ে, সেগুলো ভালো করে দেখলে বোঝা যায় আয়রন ডোমের মিসাইলগুলো কীভাবে উৎক্ষেপিত হয়ে ইনকামিং মিসাইলগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে।

আয়রন ডোমকে হিব্রুতে ডাকা হয় ‘কিফাত বারজেল’। রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস আর ইসরাইল অ্যারোস্পেসের যৌথ উদ্যোগে এটি নির্মিত। ইব্রাহিম (আ) ও তার পুত্র ইসহাক (আ) এর স্মৃতিবিজড়িত বিরশেবা এলাকায় ইসরাইল এটি প্রথম লঞ্চ করেছিল ২০১১ সালে। ইহুদী ধর্মীয় নামের সাথে মিল রেখে নিজেদের সামরিক জিনিসগুলোর নাম দিতে দেখা যায় ইসরাইলকে। যেমন, গোলায়াথ বা জালুতের সাথে যুদ্ধে ডেভিড বা দাউদ (আ) গুলতির সাহায্যে পাথর ছুঁড়ে মেরে তৎকালীন ফিলিস্তিনিদের ওপর বনী ইসরাইলের বিজয় নিশ্চিত করেন। সেই ঘটনা থেকে আয়রন ডোমের চাইতেও শক্তিশালী ডিফেন্স আর অফেন্স সিস্টেম বানিয়ে চলেছে ইসরাইল, যার একটির নাম ‘কেলা ডেভিড’ বা ‘দাউদের গুলতি’ (২০১৭), একে তারা আবার ‘জাদুদণ্ড’-ও ডাকে। এরকম অনেকগুলো ডিফেন্স সিস্টেমের একটি হলো আয়রন ডোম। আপাতত ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে আসা মিসাইল থেকে ইসরাইলকে নিরাপত্তা দিলেও, ভবিষ্যতে সেটি ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত করার পরিকল্পনা আছে তাদের।

এখানে আরেকটা বিষয় বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে আয়রন ডোম কাজ করবে না বললেও, ২০২১ সালে তারাই ইসরাইল থেকে দুটো আয়রন ডোম সিস্টেম নিয়েছে বসানোর জন্য। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আয়রন ডোম নিতে চায় এক আরব দেশও! ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির খবর হলো, ইয়েমেনি হুসি বিদ্রোহীদের মিসাইল আক্রমণ সামাল দিতে ইসরাইলের কাছ থেকে আয়রন ডোম নিতে চায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার যে মিসাইল সিস্টেম তারা ব্যবহার করে আসছে, তা দিয়ে এখন তাদের আর চলছে না। তাই আপগ্রেড দরকার। এতে অবশ্য ইসরাইলের লাভ। কারণ আমিরাত যদি এ সিস্টেম নেয়, তবে ইরান থেকে কোনো আক্রমণ ইসরাইলের দিকে আসছে কি না, সেটি আরও আগে জেনে যাবে ইসরাইল। কেবল আমেরিকা ও আরব আমিরাতই নয়, ইউক্রেনও আয়রন ডোম চেয়েছে ইসরাইলের কাছে, যা জানা যায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বৈরথে ইসরাইল কোনো ক্রমেই জড়িত হতে চায় না বিধায় তারা না করে দিয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে চলেছে ইসরাইল। ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত যে আরব দেশগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেগুলো হলো মিসর, জর্ডান, বাহরাইন, সুদান, মরক্কো এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।

যাই হোক, যা বলছিলাম- ২০২১ সালের ৬ থেকে ২১ মে পর্যন্ত চলা এ রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ২৮২ জন ফিলিস্তিনি মারা যায়, চলে যেতে হয় ৭২,০০০ জনকে। আর এরপর চলে গণগ্রেফতার। ২৮২ জনের বিপরীতে ইসরাইলের মারা যায় ১২ জন। তবে অবাক করা ব্যাপার, অন্যবার যেখানে বেশিরভাগ পশ্চিমা মিডিয়াই চুপ থাকে, সেখানে এবার গাজা আক্রমণ নিয়ে বেশ প্রতিবাদমুখর দেখা যায় তাদের!

প্রশ্ন হলো, কেন অনেক দেশই তাদের এমন কাণ্ড কারখানা সমর্থন করে? প্রো-ইসরাইলি পলিটিক্যাল একটি প্রভাব কাজ করে অনেক দেশেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আইপ্যাকের কথা, American Israel Public Affairs Committee। ওয়াশিংটন ডিসিতে আইপ্যাক বার্ষিক কনফারেন্স করে, সেখানে যোগদান করেন উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ এবং প্রেসিডেন্টরা। ইসরাইলি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু সেখানে নিয়মিত যেতেন। প্রো-ইসরাইল গ্রুপগুলো ভালো ফান্ডিং করে, দান করে, স্পন্সর করে। এর ফলে বিজয় লাভের পর আসলে তাদের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না বা চান না নির্বাচিতরা। আমেরিকার ক্ষেত্রে দুই পক্ষকেই কিন্তু তারা দান করে। যেমন, ২০২০ সালের ক্যাম্পেইনে ৬৩% গিয়েছিলো ডেমোক্র্যাটদের কাছে, ৩৬% রিপাবলিকান।

জাতিসংঘের ১৯২টি দেশের মাঝে ১৬৪টি দেশের সাথেই কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে ইসরাইলের। আরব দেশগুলো এখন ইসরাইলের সাথে যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে, তা তো আগেই বললাম। আর আগে থেকেই প্রতিবেশী দেশ মিসর ও জর্ডান তো ছিলই। ইসরাইলের নেতৃত্বে বদল এসেছে বেশিদিন হয়নি; বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৬-৯৯ এবং ২০০৯ – ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১৫ বছর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এবং শেষমেশ দুর্নীতি মামলায় অপসারিত হন বলা যায়। এ বই লেখার সময় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট।

সুদূর অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান (এ বই লেখা শেষ করার সময়কাল অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ২০২২) পর্যন্ত এই হলো ইসরাইলের উত্থান-পতনের সংক্ষিপ্ত গল্প। হয়তো এটা ‘উত্থান-পতন’ নয়, বরং পতন-উত্থানের ইতিহাস।

বি. দ্র. এ ইতিহাস পড়তে গিয়ে আরও প্রশ্ন মাথায় জাগতে পারে, বা কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর না পেয়ে থাকতে পারেন। এ বইয়ের শেষ দিকে পাঠকের প্রশ্নোত্তর অংশে গিয়ে সবগুলো পড়ার অনুরোধ থাকলো। হয়তো আপনার না-করা প্রশ্নটি অন্য কেউ করে ফেলেছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *