অধ্যায়-২৬ বনী ইসরাইলের পারস্যে নির্বাসন
ইসরাইলের পরবর্তী বাদশাহরা একত্ববাদ থেকে দূরে সরে থাকলো। কয়েক পুরুষ রাজত্বের পর ইসরাইলের পতন চূড়ান্ত হয়ে পড়লো। খ্রিস্টপূর্ব ৬০৫ সালে ব্যবিলনের বাদশা নেবুকাদনেজার (বখতেনাসার) কারচেমিসের যুদ্ধে পরাজিত করেন মিসরীয় ও অ্যাসিরীয় বাহিনীকে। ফলে, অ্যাসিরিয়া রাজ্যের প্রতাপ ধূলিসাৎ হয়ে যায়, মিসরও বহু বছরের জন্য আর কোনো শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। এ যুদ্ধের পর পর ব্যবিলনের নেবুকাদনেজারের নজর পড়ে ইসরাইলের দিকে। তিনি জেরুজালেম অবরোধ করেন, জুদাহর রাজা জেহোকিম খাজনা দেবার শর্তে নেবুকাদনেজারের প্রজা হন। কিন্তু চার বছর যেতে না যেতেই জেহোকিম খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিদ্রোহ করে বসেন।
ফলে কয়েক বছর পর, ৫৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আবার জেরুজালেম অবরোধ করেন নেবুকাদনেজার (Nebuchadnezzar II)। তখন জুদাহ/এহুদার রাজা জেহোকিম মারা গেলেন, এবং তার জায়গায় রাজা হলেন ছেলে জোহাচিন। নেবুকাদনেজার জেরুজালেমে প্রবেশ করে বাইতুল মুকাদ্দাস লুণ্ঠন করলেন, জোহাচিন, সভাসদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের বন্দী করে নিয়ে গেলেন ব্যবিলনে। যদিও জোহাকিমের চাচা জেদেকিয়াকে রাজা বানানো হয়, তবে নির্বাসনরত ইসরাইলিরা জোহাচিনকেই তাদের রাজা মানতে লাগলো।
তখন ইসরাইলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী ছিলেন জেরেমায়া বা ইয়ারামিয়া (আ), ক্রন্দনরত নবী বলা হতো যাকে। ৫৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বাইতুল মুকাদ্দাসের পতনের সময় ইয়ারামিয়া (আ) ছিলেন সেখানে। ইয়ারামিয়া (আ) এবং ব্যাবিলনপক্ষের অন্যান্যরা রাজা জেদেকিয়াকে সতর্ক করেন যেন ব্যবিলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না বসেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। রাজা জেদেকিয়া ব্যবিলনের শত্রু মিসরের ফারাওয়ের সাথে মিত্রতা করে বসলেন। নেবুকাদনেজার এবার ফিরে এসে জেরুজালেমের দেয়াল আর বাইতুল মুকাদ্দাস গুঁড়িয়ে দিলেন, সাথে ঘরবাড়ি। জেদেকিয়ার চোখের সামনে আর পুত্রদের হত্যা করা হয়, এরপর তাকে অন্ধ করে দেয়া হয়। জেদেকিয়া ও অসংখ্য ইহুদীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যবিলনে। শুরু হয় ইহুদীদের ব্যবিলনে নির্বাসন, যেখানে আগে তারা নির্বাসিত ছিল মিসরে। এহুদা রাজ্য হয়ে দাঁড়ায় ব্যবিলনের একটি প্রদেশ, নাম হলো ইয়েহুদ।
ইয়েহুদ প্রদেশের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন যিনি তার নাম গেদালিয়া, তিনি স্থানীয় এহুদার বাসিন্দাই ছিলেন। গেদালিয়া পলাতক ইহুদীদেরকে মোয়াব, আমোন আর এদোম রাজ্য থেকে ফিরে আসতে বললেন। তিনি সকলকে নিয়ে রাজ্যের উন্নতি করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। একটা সময় চলে এলো কয়েক দশকের মাঝে যখন এহুদার অবশিষ্ট ইহুদীর চাইতে ব্যবিলনের ইহুদীই বেশি, তাদের মতের দামও বেশি। আর উত্তরের ইসরাইল রাজ্যের ইহুদীদের কী হলো তার খোঁজ আর পাওয়া গেল না।
ব্যবিলনে নির্বাসিত সময়কালে যে কয়জন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের কথা না বললেই নয় তাদের মাঝে আছেন রাজা সাইরাস, রাজা ড্যারিয়াস, উজাইর (আ), হিজকীল (আ), নেহেমিয়া আর দানিয়েল (আ)।
তবে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নবীর কথা বলতেই হয়, নাম তার ইশাইয়া (আ) বা আশিয়া (eli), ইংরেজিতে ডাকা হয় আইজায়া (Isaiah)। ইহুদী ও খ্রিস্টধর্মে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি মসীহ বা খ্রিস্টের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এমনকি ইসলামি লেখনিতে বলা হয়, তিনি ঈসা (আ) ও হযরত মুহাম্মাদ (সা) উভয়ের কথাই বলেছিলেন। তবে কুরআন ও হাদিসে তাঁর নাম উল্লেখিত নেই, আছে তাফসিরে। সেখানে ইশাইয়া (আ) এর নবীত্বকে তিনভাবে ভাগ করা হয়, প্রথম ভাগে তিনি রাজা হেজেকিয়ার রাজত্বকালে ইসরাইলের নবী। দ্বিতীয় ভাগে অ্যাসিরীয় রাজা সেন্নাকারিব কর্তৃক জেরুজালেম অবরোধের সময় তার কর্মকাণ্ড। আর তৃতীয় ভাগে তিনি ইসরাইল রাজ্যের পতন নিয়ে কথা বলেন।
তাফসির বলে, ইশাইয়া (আ) এর সময় রাজা ছিলেন হেজেকিয়া। নবীর কথা রাজা তখন শুনতেন, মানতেন। কিন্তু রাজা পারেননি ইসরাইলের কোন্দল দমাতে। রাজার মৃত্যুর পর ইশাইয়া (আ) লোকজনকে বললেন আল্লাহবিমুখ না হতে, নাহলে ইসরাইলের ওপর গজব নেমে আসবে। লোকে রেগে যায় ইশাইয়া (আ) এর ওপর, ইহুদী ও ইসলামি লেখনিতে আছে, ইসরাইলিরা ইশাইয়া (আ)- কে দুভাগে ভাগ করে মেরে ফেলে।
৮১৩ সালে ক্ষমতা নেয়া সপ্তম আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুনের দরবারে ইমাম আলী আল-রিযাকে এক ইহুদী র্যাবাই প্রমাণ করতে বলেন তাওরাতের সাহায্যে যে, মুহাম্মাদ (সা) এবং ঈসা (আ) দুজনেই নবী ছিলেন। ইমাম যে ক’টা প্রমাণ দিয়েছিলেন তার মাঝে একটি ছিলো ইশাইয়া (আ) এর উদাহরণ। ইশাইয়া (আ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “আমি দুজনকে দেখতে পেলাম যারা দুনিয়া আলোকিত করে দিলো, একজন চড়ছিলেন গাধার পিঠে, আরেকজন উটের পিঠে।” ইমাম জিজ্ঞেস করলেন র্যাবাইকে, “এ দুজন কে কে? কে গাধার পিঠে আর কে উটের পিঠে?” র্যাবাই উত্তর দিতে পারলেন না। ইমাম বললেন, “গাধার পিঠেরজন ঈসা (আ), আর উটের পিঠেরজন মুহাম্মাদ (সা)।” জেরুজালেমে ঈসা (আ) গাধার পিঠে করে প্রবেশ করেন, আর মুহাম্মাদ (সা) মদিনায় প্রবেশ করেন উটের পিঠে। ইমাম তখন বললেন, “আপনি কি অস্বীকার করেন যে এ কথা তাওরাতে আছে?” র্যাবাই বললেন, “না, আমি স্বীকার করি।”
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রত্নতত্ত্ববিদ এইলাত মাজার জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট এলাকার দক্ষিণে ওফেল খননে আবিষ্কার করেন একটি সীল, যাতে লেখা ছিল “নবী ইশাইয়ার (সম্পত্তি)”। তার কাছে মাত্র দশ ফুট দূরে পাওয়া যায় আরেকটি নিদর্শন, যেখানে লেখা ছিল “এহুদার বাদশাহ হেজেকিয়ার (সম্পত্তি)”।
সাইরাস দ্য গ্রেট বাইবেলের এক সম্মানিত চরিত্র, কারণ তিনি ইহুদীদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তার অধীনেই ইহুদীদের ব্যাবিলন নির্বাসনের ইতি শুরু হয়। ব্যাবিলন/পারস্যের প্রতাপশালী রাজা সাইরাস (হিব্রু কোরেস) ছিলেন প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ব্যাবিলন সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিলেন। তার একটি উপাধি ছিল ‘সারা পৃথিবীর বাদশাহ’। ত্রিশ বছর শাসন করা সাইরাসের মানবাধিকার নিয়ে কাজ, রাজনীতি আর সামরিক কৌশল ছিল ভুবনবিদিত।
বাইবেল তাকে মাবুদের অভিষিক্ত অভিহিত করে, “মাবুদ তাঁর অভিষিক্ত ব্যক্তি সাইরাসের (বা, কাইরাসের) বিষয়ে এই কথা বলেন, আমি তার ডান হাত ধরেছি, আমি তার সম্মুখে নানা জাতিকে পরাজিত করবো, আর বাদশাহদের রাজপোশাক খুলে ফেলবো; আমি তার আগে সমস্ত কবাট মুক্ত করবো, আর তোরণদ্বারগুলো বন্ধ থাকবে না।” (ইশাইয়া ৪৫:১)
বাইবেলে ২৩ বার তার নাম উল্লেখ রয়েছে। তার রাজত্বের প্রথম বছরে তিনি ঈশ্বরের নিকট থেকে বার্তা পান যে, বাইতুল মুকাদ্দাস পুনর্নির্মাণ করতে হবে, এজন্য ইহুদীদেরকে তাদের পবিত্র ভূমিতে ফিরে যেতে হবে। তাছাড়া বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে জব্দ করা জিনিসপাতিও ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি, দেন যথেষ্ট অর্থকড়িও।
লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয় কাদামাটির তৈরি সাইরাস সিলিন্ডার, যাতে সাইরাসের মহৎ কাজকারবার লিখিত আছে। কেউ কেউ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বদলে সাইরাস দ্য গ্রেটকে কুরআনের জুলকারনাইন হিসেবে অভিহিত করেন।
সাইরাস রাজত্বের শুরুতেই এহুদার রাজপুত্রের কাছে বাইতুল মুকাদ্দাসের জিনিসপাতি পাঠিয়ে দিলেন। এরপর ইহুদীদেরকে ফেরত যেতে বলেন আল্লাহর ঘর আবার বানাবার জন্য, যা সেকেন্ড টেম্পল হিসেবে পরিচিত হবে।
৪২,৩৬০ জন নারী পুরুষ ফিরে যায় ব্যাবিলন থেকে জেরুজালেমে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জেরুবাবেল এবং প্রধান ইমাম ইয়েওয়া। তারা জেরুজালেম পৌঁছে কোরবানগাহ নির্মাণ করলেন বাইতুল মুকাদ্দাসের, এবং এরপর উৎসবে মেতে উঠলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ৩৩০ সাল পর্যন্ত ইহুদীদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগে ছিলেন যথাক্রমে পারস্যের রাজা সাইরাস, ক্যাম্বিসেস, প্রথম ড্যারিয়াস, জার্জিস, আর্টাজার্জিস, দ্বিতীয় ড্যারিয়াস, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আর্টাজার্জিস, তৃতীয় ড্যারিয়াস।