অধ্যায় ২৬ : অসলো অ্যাকর্ডস অবধি
১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে ইসরাইলি ফোর্স আক্রমণ করে ফিলিস্তিনি বাহিনী ফাতাহকে। তবে ফাতাহ আর পিএলও (Palestine Liberation Organization) তখন আরব জুড়ে নাম করে ফেলে। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে আবারো মিসরের সাথে ইসরাইলের যুদ্ধ লেগে যায়। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইলের নৌবাহিনী ৫ জন সোভিয়েত সেনাকে মেরে ফেলে, এরা সাহায্য করছিল মিসরকে। তখন পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায় ইসরাইলের জন্য। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে আমেরিকা কাজ করতে থাকে, ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয় দুপক্ষ। তখনও মিসরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জামাল আব্দেল নাসের।
পিএলও নিয়ে যেহেতু বললামই, ফাতাহ আর হামাস নিয়েও ছোট করে বলি। এ দুটো হলো ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক অঙ্গনের শক্তিশালী দুই পার্টি। একটু পরের ইতিহাস হলেও বলি, ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ পার্টিকে নির্বাচনে হারিয়ে গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। অল্প কথায় তাদের পার্থক্য হলো, হামাস যেখানে ইসলামিস্ট, ফাতাহ সেখানে সেকুলার। ইসরাইলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে হামাস যেখানে সশস্ত্র প্রতিরোধ করে থাকে, ফাতাহ করে আপস-আলোচনা। হামাস ইসরাইলের বর্তমান সীমানা স্বীকার করে না, বরং মানে ১৯৬৭ সালের বর্ডার, যেখানে ফিলিস্তিনের অধীনে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা; অন্যদিকে ফাতাহ ইসরাইলকে মেনে নিলেও তারাও ১৯৬৭ সালের বর্ডারে দেশ পুনর্গঠন করতে চায়। এ বই লেখা পর্যন্ত হামাসের নিয়ন্ত্রণে এখন গাজা, আর ফাতাহ চালায় পশ্চিম তীর। পিএলও মূলত অনেকগুলো সংগঠনের সমন্বয়, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফাতাহ হয়ে ওঠে পিএলও-র দলগুলোর মাঝে প্রধান। পিএলও বানানোই হয়েছিলো ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে।
১৯৭০ সালে জর্ডানের রাজা হুসাইন বিন তালালের ওপর আততায়ী হামলার জবাবে তিনি দেশজুড়ে সামরিক শাসন জারি করেন। তখন ১৬ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন পিএলও এবং রাজা হুসাইনের নেতৃত্বাধীন জর্ডান সামরিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অসংখ্য ফিলিস্তিনি যোদ্ধা নিহত হয় এবং জর্ডান থেকে ফিলিস্তিনিদেরকে বের করে দেয়া হয় লেবাননে। সেপ্টেম্বর মাসে এটি সংঘটিত হয়, তাই একে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ ডাকা হয়, আবার জর্ডানের গৃহযুদ্ধও বলা হয়। তখন এর প্রতিশোধে গঠিত হয় ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ সশস্ত্র সংঘ (আরবিতে মুনাজ্জামাত আয়লুল আল-আসওয়াদ) যারা হত্যা করে জর্ডানের প্রধান মন্ত্রী ওয়াসফি তালকে। দুবছর বাদে ১৯৭২ সালে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের কমান্ডার লুতিফ আফিফের দাবি ছিল, ২৩৪ জন ফিলিস্তিনিকে ইসরাইলি জেল থেকে মুক্তি দিতে হবে। এ দাবি আদায়ের জন্য ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক খেলতে যাওয়া ইসরাইলি অলিম্পিক দলকে জিম্মি করে। সেটিও ছিল সেপ্টেম্বর মাস, ৫ তারিখ। তারা প্রথমে হত্যা করে ২ জন খেলোয়াড়কে, আর ৯ জনকে জিম্মি করেছিল। তাদের দাবি অনুযায়ী ইসরাইলি জেল থেকে ২৩০ জন ফিলিস্তিনি এবং ২ জন জার্মানকে মুক্ত করা হয়। এরপর ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর খেলোয়াড়দের নিয়ে যায় মুক্ত করতে; ওদিকে জার্মান পুলিশ ছাদ থেকে তাদের ওপর গুলি করে এবং ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের তিনজনকে হত্যা করে। পুরো ঘটনা শেষে দেখা যায় মারা গিয়েছে ১৭ জন – ৬ জন ইসরাইলি কোচ, ৫ জন ইসরাইলি খেলোয়াড়, ১ জন জার্মান পুলিশ এবং ৫ জন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য।
এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে উঠে পড়ে লাগে ইসরাইল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোলদা মেইরের নির্দেশে ১৯৭২ সালে মোসাদের একটি দল নেমে পড়ে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যদের হত্যা করতে। ইসরাইলি টিমের ১১ সদস্যের নিহত হবার এ ঘটনা ‘মিউনিখ ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত। আর এর প্রতিশোধের মিশনের নাম ছিল অপারেশন ‘র্যাথ অফ গড’ (মিভজা জাআম হায়েল)। প্রায় বিশ বছর চলে এ মিশন। মোসাদের করা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্যদের প্রত্যেকের হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা আগে তাদের পরিবার ফুলসহ কার্ড পেতো, যেখানে লেখা থাকতো, “স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমরা ভুলি না, ক্ষমাও করি না।”
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের বাকি ফিলিস্তিনিদের জার্মান সরকার ছেড়ে দেয় এক হাইজ্যাক হওয়া বিমানের জিম্মিদের মুক্ত করতে। অপারেশন র্যাথ অফ গড়ের পাশাপাশি ইসরাইল মিউনিখ ম্যাসাকারের সম্মুখ জবাব দেয় বোমা বিস্ফোরণ, গুপ্তহত্যা এবং লেবাননে পিএলও হেডকোয়ার্টারে হামলার মাধ্যমে। হামলার নেতৃত্ব দেন এহুদ বারাক, যিনি পরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট হলেন আনোয়ার সাদাত। ইহুদীদের কাছে পবিত্রতম ঈদ হিসেবে পালিত হয় ‘ইয়ম কিপুর’। সেই সময় মিসর আর সিরিয়া মিলে অতর্কিত আক্রমণ করে ইসরাইলকে সেই ১৯৬৭ সালের অতর্কিত আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে। এ যুদ্ধ তাই ‘ইয়ম কিপুর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত, আবার একে ‘রামাদান যুদ্ধ’ বা ‘চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধ’-ও বলে। মূল যুদ্ধটা হয় গোলান মালভূমি ও সিনাই উপদ্বীপ এলাকায়। মিসরের উদ্দেশ্য ছিল সুয়েজ খালের অধিকার পাকাপোক্ত করা এবং সিনাই নিজ দখলে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু মিত্রের সহায়তায় ইসরাইল ভালো মতই যুদ্ধে ফেরে, এবং বলা চলে তারাই যুদ্ধে জেতে, তবে রাজনৈতিক লাভ হয় মিসর ও ইসরাইল উভয়েরই। এ যুদ্ধের ফলে সৌদি সরকার ১৯৭৩-এর তেল সংকটের সূচনা করে। আর ১৯৭৪ সালে ফিলিস্তিনের পিএলও জাতিসংঘে অবজার্ভার স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। ইয়াসির আরাফাত সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে ইছহাক রাবিন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৭৬ সালের জুলাইতে ফ্রান্সের ২৬০ জন যাত্রীসহ বিমান হাইজ্যাক করে দুজন ফিলিস্তিনি আর দুজন জার্মান, সেটি উগান্ডায় উড়িয়ে নেয় তারা, বিমানে ২৪৮ জন যাত্রী ছিল। তাদের দাবি ছিল ইসরাইলের জেল থেকে ৪০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিতে হবে, সেই সাথে আরও চারটি দেশের ১৩ জন বন্দীকেও। জার্মানরা এরপর অ-ইহুদী যাত্রীদের ছেড়ে দেয়, কিন্তু হত্যার হুমকি দেয় প্রায় ১০০ ইহুদী যাত্রীকে, অপারেশনে অবশ্য চারজন জিম্মি নিহত হয়। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী রাবিন তখন একটা উদ্ধার অপারেশন অর্ডার করেন, যার নাম ‘অপারেশন এনতেব্বে’। যেহেতু উগান্ডার সেই এয়ারপোর্টের নাম ছিল এনতেে এয়ারপোর্ট, সেখান থেকেই এ নাম। মিশনটি ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ নামেও পরিচিত। সত্যি সত্যি ইহুদী যাত্রীদের উদ্ধার করে ফেলে ইসরাইল ফোর্স। কিন্তু উগান্ডার মতো জাতিসংঘের এক রাষ্ট্রে এরকম উদ্ধার অভিযান সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ বলে মন্তব্য করেন জাতিসংঘ সেক্রেটারি ওয়াল্ডহাইম, যিনি আগে আবার নিজে নাৎসি ছিলেন।
১৯৭৭ সালে রাবিন এক কেলেংকারিতে সরে দাঁড়ান, আর শিমন পেরেজ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন। তবে নির্বাচনে জিতে মেনাখেম বেগিন প্রধানমন্ত্রী হয়ে ৩০ বছরের শত্রুতা ঝেড়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত জেরুজালেম ভ্রমণে যান।
১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আনোয়ার সাদাত আর মেনাখেম বেগিনের সাথে মিলিত হয়ে আমেরিকার ক্যাম্প ডেভিডে এক শান্তিচুক্তির রূপরেখা অংকন শুরু করেন যে, পশ্চিম তীর এবং গাজা এলাকা ফিলিস্তিনের অধিকারে থাকবে। ১২ দিন ধরে তারা সেখানে মিটিং করেন এবং দুরকম রূপরেখা আঁকা হয়, যার মাঝে গৃহীত হয় দ্বিতীয়টি। একে বলা হয় ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস (Camp David Accords)। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ সালের ২৬ মার্চ মিসর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। চুক্তিতে তারা তিনজনই স্বাক্ষর করেন, অর্থাৎ জিমি কার্টার, মেনাখেম বেগিন এবং আনোয়ার সাদাত। ১৯৭৮ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার যুগ্মভাবে জেতেন মেনাখেম বেগিন এবং আনোয়ার সাদাত।
ওদিকে ১৯৭৯ সালে ইরানি ইসলামি বিপ্লব থেকে পালিয়ে আসে ৪০ হাজার ইহুদী। ১৯৮৪ সালে ইথিওপিয়াতে দুর্ভিক্ষ চলাকালে ৮০০০ ইথিপিয়ান ইহুদীকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ইসরাইলে। ১৯৮৫ সালে লেবানন থেকে সব ইসরাইলি সামন্ত সরিয়ে নেয়া হয়। ১৯৯২ সালে আবারো জয়ী হন রাবিন। এর মাঝে জাবালিয়া ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির থেকে ১৯৮৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনি ‘ইন্তিফাদা’ শুরু হয়, যার শাব্দিক অর্থ ‘অভ্যুত্থান’। পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছিল এ অভ্যুত্থান। বলা বাহুল্য, ইসরাইল সশস্ত্রভাবে দমনের চেষ্টা চালায় ইন্তিফাদাকে। একটি নয়, দুটো ইন্তিফাদা হয়েছিল। এর মাঝে প্রথমটি চলে ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় ইন্তিফাদাকে ‘আল-আকসা ইন্তিফাদা’-ও বলা হয় (২০০০-২০০৫)। প্রথম ইন্তিফাদার ফলাফল হিসেবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তৈরি হয়, আর পিএলও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। ১,৯৬২ জন ফিলিস্তিনি এবং ১৭৯-২০০ জন ইসরাইলি মারা যায় প্রথম ইন্তিফাদায়। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো অসলো অ্যাকর্ডস।
১৯৯৩ সালের জুলাইতে, এক সপ্তাহ ধরে ইসরাইল লেবাননে আক্রমণ চালায় লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহ পার্টিকে দুর্বল করে দিতে। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের মৌলবাদী ইহুদী কাখ পার্টির সমর্থক বারুখ গোল্ডস্টাইন হেব্রনের পবিত্র প্যাট্রিয়ার্ক গুহাতে ২৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, আহত করে ১২৫ জনকে। কথিত আছে, এ গুহায় নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) এবং তার পরিবারের কবর আছে।
১৯৯৩ সালে ওয়াশিংটন ডিক্লারেশনে স্বাক্ষর করে জর্ডান আর ইসরাইল, সাক্ষী ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ফলে, দুই দেশের মাঝে চলমান দীর্ঘদিনের এক যুদ্ধ পরিস্থিতি শেষ হয়। ওদিকে রাবিন আর পিএলও-চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতও শান্তিচুক্তি সাক্ষর করেন, এটি প্রথম অসলো অ্যাকর্ডস বা অসলো চুক্তি নামে পরিচিত। দ্বিতীয় অ্যাকর্ড স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৫ সালে মিসরে। মূলত নরওয়ের রাজধানী অসলো শহরে পিএলও ও ইসরাইলের মাঝে আলাপ শুরু হয়েছিল, যার ফলে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল পিএলও এবং ইসরাইল মেনে নিয়েছিল পিএলও-কে ফিলিস্তিনের কর্তৃপক্ষ হিসেবে। সেই থেকে শুরু। তাই এ চূড়ান্ত চুক্তিকে অসলো চুক্তি (অসলো অ্যাকর্ডস) বলা হয়। অবশ্য, ফিলিস্তিনি সুন্নি সংগঠন হামাস এর বিরোধিতা করে। অসলো চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনি অর্থনীতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পশ্চিম তীরের ৬০% দখল নিয়ে নেয়। পঞ্চাশ বছরে ওয়েস্ট ব্যাংকে ৬ লাখ ইসরাইলি সেটলার এসেছে। গড়েছে ২৫০ সেটেলমেন্ট।
১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম অসলো অ্যাকর্ডসে স্বাক্ষরের সময় বাম থেকে যথাক্রমে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইছহাক রাবিন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত