অধ্যায়-২৫ ইসরাইলের পতনের শুরু আহাব ও জেজেবেলের পরিণতি
সুলাইমানপুত্র রেহোবাম এহুদা রাজ্যের প্রথম রাজা। ৪১ বছর বয়সে তিনি ইসরাইলের রাজা হবার পর উত্তরের দশ গোত্র তাকে রাজা হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানায়, সেটা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৯৩২/৯৩১ সালের কথা। উত্তরের ইসরাইল রাজ্যের রাজা হলেন সুলাইমান (আ) এর এককালীন অফিসার ইয়ারাবাম, আর দক্ষিণের দুই গোত্র বা জুদাহ/এহুদা রাজ্যের রাজা থাকলেন রেহোবাম; রেহোবামের মা ছিলেন আমোন দেশ থেকে আগত নামাহ (বাইবেল, ফার্স্ট বুক অফ কিংস)। এ রাজ্য বিভক্তির মূল কারণ ছিল খাজনাজনিত জটিলতা এবং এর থেকে উদ্ভূত বিদ্রোহ।
ইয়ারাবাম উত্তরে রাজত্ব করেন নয় বছর, এরপর ছেলে নাদবকে রাজত্ব দিয়ে যান। আর দক্ষিণের রেহোবাম রাজরক্তের কারণেই রাজা হয়েছিলেন, তবে তিনি কোনোদিনই উত্তরের রাজত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেননি। উত্তর ও দক্ষিণ অর্থাৎ ইসরাইল ও জুদাহ মোটামুটি প্রায় সময়ই যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো।
পরবর্তী কয়েক দশক বাদশাহ পরিবর্তন চলতে থাকলো। এমন কেউ ছিলেন না যার কথা খুব মনে রাখবার মতো। কিন্তু মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৮৭১ সালের দিকে উত্তর ইসরাইলের বাদশাহ হন আহাব। ইয়ারাবামকে প্রথম ধরলে, আহাব ছিলেন সপ্তম রাজা। তিনি এ কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, তার অস্তিত্বের প্রমাণ ইতিহাসেও পাওয়া যায়, কেবল ধর্মীয়ভাবেই নয়! মেসোপটেমিয়ার অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজা তৃতীয় শালমানেসারের নথিতে পাওয়া যায়, তিনি বারোজন সংঘবদ্ধ রাজাকে পরাজিত করেন। তার মাঝে একজনের নাম ছিল, ইসরাইলের বাদশাহ আহাব। এমনকি মোয়াবীয় ভাষায় লেখা প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত মেশা ফলকেও তার নাম পাওয়া যায়।
হিব্রু বাইবেলে আহাবকে মূলত খারাপ রাজা হিসেবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে; অনেক নবীকেও তিনি হত্যা করেন। ঐতিহাসিক মেশা ফলকেও (Mesha Stele) বলা হয়েছিলো, রাজা আহাবের বাবা রাজা অমরি মোয়াব জাতিকে বহুদিন অত্যাচার করেন। আহাবের শাসনামলে মোয়াব মূলত খাজনা প্রদানকারী হিসেবে ছিল। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে জানাই, মোয়াব রাজ্য বর্তমানে জর্ডানে পড়েছে।
আহাব দক্ষিণের এহুদা রাজ্যের বাদশাহ জেহোশেফাতের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেন, ফলে দুই রাজ্যের মাঝে শত্রুতা কমে আসে। আহাব বাইশ বছর সামেরিয়াতে ইসরাইলে উপর রাজত্ব করেন। (১ বাদশাহনামা ১৬:২৯) তবে আহাব নিজে যতটা না তার খারাবির জন্য প্রসিদ্ধ- তার চেয়েও বেশি পরিচিত তার রানী জেজেবেলের কুকীর্তির জন্য।
জেজেবেলের আসল উচ্চারণ ইশেবল, কিন্তু ইংরেজিতে প্রচলিত জেজেবেল নামটিই বেশি খ্যাত। সিদোন (লেবানন) রাজ্যের রাজা প্রথম ইসোবালের কন্যা জেজেবেল। তার কাহিনী রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের ফার্স্ট বুক অফ কিংসে (১৬-২২)।
সিদোন রাজ্যে যেসব দেব-দেবীর উপাসনা করা হত, তাদের মাঝে প্রধান ছিল দেবতা বা আল এবং দেবী আশেরাহ। উত্তর- পশ্চিম সেমিটিক ভাষাতে ‘বা’আল’ বলতে ‘মালিক’ আর ‘প্রভু’ বোঝাতো। পবিত্র কুরআনেও এ সময়ের কথা উল্লেখ আছে, যখন নবী ইলিয়াস (আ) বলেছিলেন, “তোমরা কি ভয় করো না? তোমরা কি বা’আল দেবতার উপাসনা করবে এবং সর্বোত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করবে?” (সুরা সাফফাত ৩৭:১২৪-১২৫)
অন্যদিকে দেবী আশেরাহ এর উল্লেখ পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ার নানা আক্কাদীয় লেখনিতে। স্বর্গের রানী হিসেবে এই দেবী পূজিত হতো।
জেজেবেল বিয়ের পর ইসরাইলে এসেও তার পৈত্রিক ধর্ম চালিয়ে যায়। স্ত্রীকে খুশি করতে আহাব দেবতা বা’আলের জন্য মন্দির বানালেন সামেরিয়াতে, আবার আশেরাহ এর মূর্তিও বানিয়ে দিলেন।
আল্লাহ নবী ইলিয়াস (আ)-কে পাঠালেন তাদের দুজনের কাছে আল্লাহর পথে ফিরে আসবার জন্য আহবান করতে। কিন্তু তার বারংবার আহবানে একদমই সাড়া দিলেন না আহাব আর তার স্ত্রী।
কুরআনে রয়েছে, নিশ্চয়ই ইলিয়াস ছিল রাসুল। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল: “তোমরা কি ভয় করো না? তোমরা কি বা’আল দেবতার ইবাদত করবে এবং সর্বোত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করবে? যিনি আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের পালনকর্তা?” অতঃপর তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। অতএব তারা অবশ্যই গ্রেফতার হয়ে আসবে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার খাঁটি বান্দাগণ নয়। আমি তার জন্যে পরবর্তীদের মধ্যে এ বিষয়ে রেখে দিয়েছি যে: “ইলিয়াসের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক!” (কুরআন ৩৭:১২৩-১৩০)
ইলিয়াস (আ) ইংরেজিতে ইলাইজা নামে পরিচিত, আর হিব্রুতে ইলিয়াহু। তাঁকে নিয়েও পরবর্তীতে অনেক কিংবদন্তী তৈরি হয়।
রাজা আহাবের রাজদরবারে ওবাদিয়া নামের এক আল্লাহভীরুর নাম আছে ওল্ড টেস্টামেন্টে। তিনি জেজেবেলের খুনখারাবি থেকে পালিয়ে আসা একশত নবীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পঞ্চাশ করে করে তিনি তাদেরকে গুহাতে লুকিয়ে রাখেন, রুটি খাওয়ান।
বাইবেলে এ নবীর একটি কাহিনী বর্ণিত আছে। সিদোনের অন্তর্গত সারিফতে এক স্ত্রীলোকের ছেলে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে একবার। একপর্যায়ে ছেলেটি মারা যায়। সেই বাড়িতে ছিলেন ইলিয়াস (আ)। তখন স্ত্রীলোকটি ইলিয়াসকে বললো, “হে আল্লাহর লোক, আপনার সঙ্গে আমার কী কাজ? আপনি আমার অপরাধ স্মরণ করাতে ও আমার পুত্রকে মেরে ফেলতে আমার এখানে এসেছেন।” ইলিয়াস তাকে বললেন, “তোমার পুত্রটি আমাকে দাও।” পরে তিনি তার কোল থেকে ছেলেটিকে নিয়ে উপরে তাঁর থাকবার কুঠুরীতে গিয়ে তাঁর নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আর তিনি মাবুদকে ডেকে বললেন, “হে মাবুদ, আমার আল্লাহ, আমি যে বিধবার বাড়িতে প্রবাস করছি তুমি কি তার পুত্রকে মেরে ফেলে তার উপরে অমঙ্গল উপস্থিত করলে?” পরে তিনি বালকটির উপরে তিনবার তাঁর শরীর লম্বমান করে মাবুদকে ডেকে বললেন, “হে আল্লাহ, আরজ করি, এই বালকের মধ্যে প্রাণ ফিরে আসুক।” তখন মাবুদ ইলিয়াসের কথা শুনলেন, তাতে বালকটির প্রাণ তার মধ্যে ফিরে এলো, সে পুনর্জীবিত হলো। পরে ইলিয়াস বালকটিকে নিয়ে উপরিস্থ কুঠরী থেকে বাড়ির মধ্যে নেমে গিয়ে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন; আর ইলিয়াস বললেন, “দেখ, তোমার পুত্র জীবিত।” তাতে সেই স্ত্রীলোক ইলিয়াসকে বললো, “এখন আমি জানতে পারলাম, আপনি আল্লাহর লোক এবং মাবুদের যে কালাম আপনার মুখে আছে, তা সত্যি।” (১ বাদশাহনামা 1৯:1৯-২8 )
ওবাদিয়া আহাবের সাথে দেখা করতে গেলেন, আবার ওদিকে রাজা আহাব গেলেন ইলিয়াস (আ) এর সাথে দেখা করতে। দেখা হওয়া মাত্র আহাব বলে উঠলেন, “হে ইসরাইলের কাঁটা!”
ইলিয়াস (আ) বললেন, “আমি ইসরাইলের কাঁটা নই, কিন্তু আপনি ও আপনার পিতৃকুল ইসরাইলের কাঁটা; কেননা আপনারা মাবুদের সমস্ত হুকুম ত্যাগ করেছেন এবং আপনি বা’আল দেবদের অনুগামী হয়েছেন।
এখন লোক পাঠিয়ে সমস্ত ইসরাইলকে কর্মিল পর্বতে আমার কাছে জমায়েত করুন এবং বা’আলের পুরোহিত সেই
চারশত পঞ্চাশজন ও আশেরার পুরোহিত সেই চারশোজনকেও উপস্থিত করুন, যারা জেজেবেলের সঙ্গে একইসাথে ভোজন করে থাকে।” (১ বাদশাহনামা ১৮:১৮-১৯)
আহাব সবাইকে জড়ো করলেন কামিল পর্বতে (Mount Carmel)। হিব্রুতে হার হা-কারমেল নামের এ পাহাড়টি আরবিতে জাবাল আল কারমিল নামে পরিচিত। একে জাবাল মার ইলিয়াস নামেও ডাকা হয়। ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু হয়ে উত্তর ইসরাইলের উপকূলীয় এক পর্বতমালা কাৰ্মিল পাহাড়।
পরের ঘটনা ওল্ড টেস্টামেন্ট এভাবে বর্ণনা করে, ইলিয়াস (আ) বললেন, সরাসরি পরীক্ষা হয়ে যাক, কে আসল ঈশ্বর, বা’আল নাকি আল্লাহ? কার্মিল পাহাড়ের ওপর কোরবানগাহ বা বেদী বানানো হলো। বেদীর ওপর কাঠ বিছানো হলো। মহিষ জবাই করে তার মাংস কাঠের ওপর রাখা হলো। এরপর বা আলের পুরোহিতদের তিনি আহবান করলেন বা আলের কাছে প্রার্থনা করে সেই মাংসে আগুন ধরিয়ে দিতে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রার্থনা করেও তারা সেটা করতে পারলো না। ইলিয়াস (আ) বিদ্রূপ করে বললেন, “উচ্চস্বরে ডাক; কেননা সে দেবতা; সে ধ্যান করছে, বা কোথাও গেছে, বা পথে চলছে, কিংবা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে, তাকে জাগানো চাই।” তারা তাদের রক্তও যোগ করলো বেদীতে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।
যখন ইলিয়াস (আ) কোরবানগাহ বানিয়ে একই কাজ করলেন, তখন আকাশ থেকে আগুন এসে পুড়িয়ে দিলো মাংস, যার মানে আল্লাহ সত্যিকারের ঈশ্বর। তখন ইলিয়াস (আ) আদেশ দিলেন বা’আলের পুরোহিতদের হত্যা করতে।
ইলিয়াস (আ) দোয়া করলেন বৃষ্টির জন্য, এবং বহুদিন বাদে বৃষ্টি এসে ক্ষরার অবসান করলো।
বলা বাহুল্য, জেজেবেলের পুরোহিতদের হত্যার খবর যখন কানে পৌঁছাল তখন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো জেজেবেল। তাছাড়া ইলিয়াস (আ) জেজেবেলের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন। জেজেবেল তাই ইলিয়াস (আ)-কে হত্যার জন্য উঠে-পড়ে লাগলো।
ফলে তিনি পালিয়ে গেলেন মরুতে। এক গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়তেই আল্লাহর ফেরেশতা তাকে জেগে খেয়ে নিতে বললেন স্বপ্নে। ঘুম ভেঙে যেতেই তিনি দেখলেন তার সামনে রুটি আর পানি রাখা আছে। তিনি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। ফেরেশতা আবার এসে একই কাজ করলেন, কারণ সামনে তার লম্বা সফর আছে।
চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত ভ্রমণ করে ইলিয়াস (আ) পৌঁছালেন হোরেব পর্বতে, যেখানে মূসা (আ) তাওরাত পান। এ পাহাড়কে সিনাই পাহাড়ও বলে। মূসা (আ) এর পর এতদিন বাদে কেবল ইলিয়াস (আ) গিয়েছিলেন ঐ পাহাড়ে। এক পশলা প্রবল বায়ু, ভূমিকম্প ও আগুনের পর একটি স্বর শোনা গেল। তা শোনামাত্র ইলিয়াস (আ) শাল দিয়ে মুখ ঢাকলেন এবং বাইরে গিয়ে গহ্বরের মুখে দাঁড়ালেন। তাঁর প্রতি এই বাণী এলো, “ইলিয়াস, তুমি এখানে কী করছো?”
ইলিয়াস (আ) বললেন, “কেবল একা আমিই অবশিষ্ট রইলাম; আর তারা আমার প্রাণ নিতে চেষ্টা করছে।”
তখন আল্লাহ তাঁকে বললেন, “তুমি যাও, নিজের পথে ফিরে দামেস্কের মরুভূমিতে গমন কর, গিয়ে হসায়েলকে অরামের উপরে বাদশাহ পদে অভিষেক কর, এবং নিশির পুত্র যেহুকে ইসরাইলের উপরে বাদশাহ পদে অভিষেক কর; আর তোমার পদে নবী হবার জন্য আল-ইয়াসাকে অভিষেক কর।” (১ বাদশাহনামা ১৯)
ইলিয়াস (আ) গিয়ে এগুলোই করলেন। আল-ইয়াসা (আ) নতুন নবী হলেন। আল-ইয়াসা এলিশা (Elisha) নামেও প্রচলিত। কুরআনে দুবার আল-ইয়াসা (আ) এর কথা এসেছে-
“এবং ইসরাইল, ইয়াসা, ইউনূস, লূতকে প্রত্যেককেই আমি সারা বিশ্বের উপর গৌরবান্বিত করেছি।” (সুরা আনাম ৬:৮৬)
“স্মরণ করুণ, ইসমাঈল, আল ইয়াসা ও যুলকিফলের কথা। তারা প্রত্যেকেই গুণীজন।” (সুরা সোয়াদ ৩৮:৪৮ )
ধারণা করা হয়, আল-ইয়াসা (আ) এর কবর পূর্ব সৌদি আরবে আল- আওজাম স্থানে। উসমানি খেলাফতের সময় সেটি ছিল জনপ্রিয় একটি টুরিস্ট স্পট।
ইলিয়াস (আ) পরবর্তীতে আবারও মুখোমুখি হন আহাবের। আহাব জেজেবেলের মনতুষ্টির জন্য খুন করে এক আঙুর ক্ষেতের দখল নেন। আল্লাহ আহাবের কাছে পাঠান ইলিয়াস (আ)-কে এই প্রশ্ন নিয়ে, “তুমি খুনও করেছো, আবার অন্যায়ভাবে দখলও করেছ?”
এরপর এই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, “যে স্থানে কুকুরেরা আঙুর ক্ষেতের মালিক নাবোতের রক্ত চেটে খেয়েছে, সেই স্থানে কুকুরেরা তোমার রক্তও চেটে খাবে। কুকুরেরা যিথ্রিয়েলের দুর্গ-প্রাচীরের কাছে জেজেবেলকে খেয়ে ফেলবে।” (১ বাদশাহনামা ২১)
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আহাব অনুতপ্ত হয়ে যায়। ফলে শাস্তিটুকু আহাব না হয়ে জেজেবেল আর তার ছেলে আহাজিয়ার ওপর আসবে, এমনটাই বলা হয়।
আহাজিয়া বাড়ির সিঁড়ির দরজা থেকে পড়ে গিয়ে আহত হলো। এরপর দূত পাঠিয়ে ইক্রোনের দেবতা বিলজিবাবকে জিজ্ঞেস করতে বলল, সে সুস্থ হবে কি না। ইলিয়াস (আ) সেই দূতদের আটকালেন। তিনি গিয়ে আহাজিয়াকে বললেন, “ইসরাইলের কি আল্লাহ নেই যে, তোমরা ইক্রোনের দেবতার কাছে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছ? মাবুদ এই কথা বলেন, তুমি যে পালঙ্কে উঠে শুয়েছ, তা থেকে আর নামবে না, মরবেই মরবে।” পরে ইলিয়াস চলে গেলেন। (২ বাদশাহনামা ১)
আহাজিয়া তিনটি দল পাঠালেন ইলিয়াস (আ)-কে ধরবার জন্য। প্রথম দুটো দলকে আকাশ থেকে আগুন এসে পুড়িয়ে দিল। তৃতীয় দলকে দয়াপরবশ হয়ে ছেড়ে দিলেন ইলিয়াস (আ)। তাদের সাথে আহাজিয়ার কাছে গেলেন তিনি। আহাজিয়া আসলেই মারা গেলেন সেই পালঙ্কেই, যেমনটা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল।
আল-ইয়াসা (আ)-কে নিয়ে ইলিয়াস (আ) এরপর জেরিকো এলেন। সেখানে অন্যান্য নবীরা আল-ইয়াসাকে (আ) জিজ্ঞেস করলেন, “আজ মাবুদ আপনার কাছ থেকে ইলিয়াস নবীকে তুলে নেবেন, এই কথা কি আপনি জানেন?” তিনি জবাবে বললেন, “হ্যাঁ, আমি তা জানি; তোমরা নীরব হও।”
পরে জর্ডান নদীর ধারে গেলেন ইলিয়াস (আ)। পঞ্চাশজনের মতো নবী দূরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। ইলিয়াস (আ) তাঁর শাল ধরে গুটিয়ে নিয়ে পানিতে আঘাত করলেন, তাতে পানি এদিক-ওদিকে বিভক্ত হলো, এবং তাঁরা দুজন শুকনো ভূমি দিয়ে পার হলেন।
আল-ইয়াসার (আ) সাথে কথা বলতে বলতেই, আগুনের একটি রথ ও আগুনের কিছু ঘোড়া এসে তাঁদেরকে পৃথক করলো এবং ইলিয়াস ঘূর্ণি-বাতাসে আসমানে উঠে গেলেন। আল-ইয়াসা (আ) তাকে আর দেখতে পেলেন না। (২ বাদশাহনামা ২)
এরপর আল-ইয়াসা (আ) নবীত্ব চালিয়ে গেলেন, আর ওদিকে আহাবের ছেলে জিহোরাম ইসরাইলের রাজত্ব করতে লাগলেন সামেরিয়া থেকে। তিনিও ছিলেন বিপথগামী।
ইহুদী লোককাহিনী বলে, আসমানে আরোহণের পর ইলিয়াস (আ) ফেরেশতা হয়ে যান, নাম হয় সান্দালফন। তিনি প্রায়ই পৃথিবীতে আসেন এবং ঘুরে বেড়ান, কখনও কখনও দেখা দেন। তিনি কেয়ামতের আগে খ্রিস্টের আগমন নির্বিঘ্ন করতে ফেরত আসবেন বলে ইহুদী বিশ্বাস রয়েছে। কুরআনে বেশ ভালো করেই তাঁর প্রশংসা করা হয়েছে-
“(পথ প্রদর্শন করেছি) যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকে। তারা সবাই পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।” (সুরা আনাম ৬:৮৫)
তিন বছর পর এক যুদ্ধে রাজা আহাব মারা যান। আহাজিয়া দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মারা যাবার পর তার ভাই জোরাম রাজত্ব নেন। কিন্তু আল-ইয়াসা (আ) জোরামের সেনাপতি জেহুকে রাজা ঘোষণা করলেন। জেহু গিয়ে হত্যা করলেন জোরামকে। এরপর বাকি রইলো জেজেবেল। প্রাসাদে গিয়ে জেহুর এবার জেজেবেলকে মোকাবিলা করবার পালা।
জেহু আসছে জেনে জেজেবেল সাজগোজ করলেন, এবং জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তাকে কামার্থ আহবান করলেন। জেহু জেজেবেলের খোজা দাসদেরকে আদেশ করলেন তাকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে। জেজেবেলের দেহ মাটিতে পড়বার পর তার রক্ত দেয়াল আর ঘোড়ার গায়ে ছিটকে পড়ে। জেহু প্রাসাদে ঢুকে খাওয়াদাওয়া আর পান সারবার পর জেজেবেলের লাশ দাফনের আদেশ করলেন। দাসেরা লাশের কাছে গিয়ে দেখলো, কেবল তার মাথার খুলি, পায়ের পাতা আর কবজি থেকে হাত পড়ে আছে, কুকুর তার মাংস সব ছিঁড়ে খেয়ে নিয়েছে। (২ বাদশাহনামা ৯:৩৫-৩৬) ৮৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জেজেবেলের মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়।