অধ্যায়-২৪ সলোমন ও শেবার রানী
ইংরেজিতে প্রচলিত নাম ‘শেবা’ (Sheba) হলেও আরবি ও হিব্রুতে সেটি ‘সাবা’। হিব্রু বাইবেল ও কুরআনে উল্লেখিত বিখ্যাত এক রাজ্য। বাইবেলের শেবার রানীর এ রাজত্ব ইথিওপিয়ান খ্রিস্টানদের কাছেও খুব জনপ্রিয় I রানীর নাম বাইবেলে না থাকলেও, আরবি আর ইথিওপীয় কাহিনীতে তার নাম ‘বিলকিস’; বিলকিস বিনতে শারাহীল, বাবা যীশারখ আর মা বুলতাআহ। হিব্রুতে তাকে কেবল ‘মালকাত সাবা’ বা সাবার রানী নামেই ডাকা হয়; কুরআনেও তার নাম নেই। প্রাচীন সৌদি আরবের ‘সাবা’ রাজ্য আসলে এই শেবা হতে পারে বলে অনেকের ধারণা, বর্তমানে সেটি ইয়েমেনের একটি জায়গা।
বাইবেল বলছে (সেকেন্ড ক্রোনিকলস, ৯:১-৮), “সাবার রানী সুলাইমানের কীর্তি শুনে কঠিন কঠিন প্রশ্ন দ্বারা সুলাইমানকে পরীক্ষা করার জন্য বিপুল পরিমাণ ঐশ্বর্যসহ এবং সুগন্ধি দ্রব্য, প্রচুর সোনা ও মণিবোঝাই উট সঙ্গে নিয়ে জেরুজালেমে এলেন। তিনি সুলাইমানের কাছে এসে তাঁর নিজের মনে যা ছিল তাঁকে সবই বললেন। আর সুলাইমান তাঁর সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিলেন, সুলাইমানের বোধের অগম্য কিছুই ছিল না, তিনি তাঁকে সবই বললেন। এভাবে সাবার রানী সুলাইমানের জ্ঞান ও তাঁর নির্মিত বাড়ি দেখলেন। তিনি তাঁর টেবিলের খাদ্যদ্রব্য ও তাঁর কর্মকর্তাদের উপবেশন ও দণ্ডায়মান পরিচারকদের শ্রেণী ও তাদের পরিচ্ছদ এবং তাঁর পানপাত্র বাহকদের ও তাদের পরিচ্ছদ এবং মাবুদের গৃহে উঠবার জন্য তাঁর নির্মিত সিঁড়ি, এই সমস্ত দেখে হতভম্ভ হয়ে গেলেন।
আর তিনি বাদশাহকে বললেন, আমি আমার দেশে থেকে আপনার কথা ও জ্ঞানের বিষয় যে কথা শুনেছিলাম তা সত্যি। কিন্তু আমি যতক্ষণ এসে স্বচক্ষে না দেখলাম, ততক্ষণ লোকদের সেই কথায় আমার বিশ্বাস হয়নি; আর দেখুন, আপনার জ্ঞান ও মহত্ত্বের অর্ধেকও আমাকে বলা হয়নি; আমি যে খ্যাতি শুনেছিলাম তা থেকেও আপনার গুণ অনেক বেশি। ধন্য আপনার লোকেরা এবং ধন্য আপনার এই গোলামেরা, যারা প্রতিনিয়ত আপনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আপনার জ্ঞানের উক্তি শোনে। আপনার আল্লাহ মাবুদ ধন্য হোন, যিনি আপনার আল্লাহ মাবুদের হয়ে রাজত্ব করতে তাঁর সিংহাসনে আপনাকে বসাবার জন্য আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। ইসরাইলিদেরকে চিরস্থায়ী করতে চান বলে আপনার আল্লাহ তাদেরকে মহব্বত করেন, এজন্য ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতা প্রচলিত করতে আপনাকে তাদের উপরে বাদশাহ করেছেন।”
মিসরীয় কপ্টিক খ্রিস্টানদের মাঝে বারলিন প্যাপিরাসের মাধ্যমে প্রচলিত আছে, সাবার রানীর একটি স্তম্ভ ছিল যাতে পৃথিবীর সকল বিজ্ঞান লিখিত ছিল। সুলাইমান (আ) তার এক জ্বিনকে সেটি আনতে পাঠান, এবং সেই জ্বিন তা চোখের পলকে এনে হাজির করে ইথিওপিয়া থেকে।
খ্রিস্ট ধর্মের নিউ টেস্টামেন্টের গস্পেল অফ ম্যাথিউ (১২:৪২) আর গস্পেল অফ লুকে (১১:৩১) উল্লেখ পাওয়া যায় ‘দক্ষিণের রানী’র। এ শ্লোক থেকে নানা মুনির নানা মত পাওয়া যায়। সেখানে অবশ্য তার নাম বিলকিস নয়, বরং মাকেদা। এরকম একটি লোককাহিনী অনুযায়ী, বাদশাহ সুলাইমান (আ) দুনিয়ার নানা প্রান্তের ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন, যেন বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ সহজতর হয়। এর মাঝে একজন ছিলেন ইথিওপিয়া বা শেবার ব্যবসায়ী তামরিন। তামরিন জেরুজালেমে ব্যবসা সেরে যা যা দেখলেন আর জানলেন তা সব গিয়ে খুলে বললেন তার রানী মাকেদাকে। মাকেদা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি জেরুজালেম ভ্রমণ করবেন।
তিনি জেরুজালেম আসবার পর তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হলো। কেবল তার থাকার জন্যই আলাদা একটি প্রাসাদ দিয়ে দেয়া হলো, প্রতিদিন তার জন্য থাকতো নানা উপহার। সুলাইমান (আ) আর মাকেদা অনেক জ্ঞানের কথা বলতেন। তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেন।
চলে যাবার আগে এক রাতে সুলাইমান (আ) বিশাল ভোজসভার আয়োজন করেন। মাকেদা সেই রাত্রে সুলাইমানের (আ) প্রাসাদেই থেকে গেলেন। মাকেদাকে কথা দিলেন সুলাইমান কিছু করবেন না, যদি মাকেদা কথা দিতে পারেন যে সেই রাতে মাকেদা সুলাইমান (আ) এর প্রাসাদ থেকে কিছুই খাবেন না বা পান করবেন না, বা কিছু নেবেন না। রাতে মাকেদার ঘুম ভেঙে গেল তৃষ্ণায়। পানি পান করবার জন্য তিনি হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন, তখন সুলাইমান (আ) এসে তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন তার প্রতিশ্রুতির কথা। মাকেদা বললেন, “তোমার প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে না, আমাকে পানি পান করতেই হবে।” সেই রাতে মাকেদাকে দেয়া কথা ফিরিয়ে নিলেন সুলাইমান (আ)। এ কাহিনীতে ইঙ্গিত করা হয় যে, এরপর সুলাইমান (আ) মাকেদার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি মাকেদাকে একটি আংটি উপহার দেন।
দীর্ঘ সফরে নিজের রাজ্যে ফেরার পথে মাকেদা জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের। তিনি তার নাম রাখেন বাইনালেহকেম। (বিন আল হাকিম, অর্থ- জ্ঞানীর পুত্র) ছেলেটির নাম অবশ্য পরে মেনিলেক হয়ে যায়। সে বেড়ে ওঠে ইথিওপিয়াতে। সুলাইমান (আ) এর উপহার দেয়া সেই আংটি নিয়ে মেনিলেক ফিরে আসেন জেরুজালেমে। সুলাইমান (আ) খুশি হলেন। তিনি তার পুত্রকে অন্যান্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের পুত্রদের সাথে ইথিওপিয়া প্রেরণ করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সুলাইমান (আ) জানালেন, তিনি তৃতীয় এক পুত্রসন্তানের আশায় আছেন, যার সাথে তিনি রোমের বাদশাহর কন্যার বিয়ে দেবেন, তাহলে পুরো দুনিয়াই দাউদের বংশধরের হাতে চলে আসবে।
অতঃপর মেনিলেককে প্রধান ইমাম যাদোক আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নিলেন, এবং দাদার নামে তার নাম দিলেন দাউদ। আজও অনেক ইথিওপীয় নিজেদেরকে তার বংশধর দাবি করেন। মেনিলেক চলে যাবার সময় তার বাহিনীর ইমামের সন্তানেরা শরীয়ত সিন্দুক বা আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট চুরি করে নিয়ে যান বাহিনীর সাথে। মেনিলেকের একজন ইমাম আজারায়াস একজন ফেরেশতার পরামর্শে কুরবানি দিয়েছিলেন এর আগে। কথিত আছে, ফেরেশতা মিকাইল (আ) স্বয়ং তাদের সাথে ছিলেন যখন সেই আর্ক ইথিওপিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়।
লোহিত সাগরে আসবার পর আজারায়াস সকলকে জানালেন যে, সিন্দুক আসলে তাদের সাথেই আছে, এর আগে বাকিরা জানত না ব্যাপারটা। ঝড়ো আবহাওয়ার মাঝেও সিন্দুক সাথে থাকায় অলৌকিক ক্ষমতাবলে তারা সকলে লোহিত সাগর পাড়ি দিতে সক্ষম হলো।
যখন সুলাইমান (আ) জানতে পারলেন যে আর্ক চুরি গিয়েছে, তখন তিনি পেছনে ঘোড়সওয়ারদের পাঠালেন, এমনকি নিজেও গেলেন। কিন্তু তিনি তাদের ধরতে পারলেন না। সুলাইমান (আ) ফিরে এলেন জেরুজালেমে এবং ইমামদের আদেশ দিলেন যেন কেউ না জানতে পারে চুরির ব্যাপারটা। তিনি একটি রেপ্লিকা বানিয়ে সেটি জায়গামতো স্থাপন করবার নির্দেশ দিলেন, যেন বাইরের জাতি বলতে না পারে যে ইসরাইলের খ্যাতি কমে যাচ্ছে।
ইহুদী গ্রন্থ তানাখের বুক অফ এস্থারের অষ্টম শতকের একটি আরামায়িক অনুবাদ কুরআনের বক্তব্যের সাথে মিল রেখে জানায়, একটি হুদহুদ পাখি সুলাইমান (আ)-কে এ জাতির খোঁজ দেয়। বুক অফ এস্থার আরও জানায়, সাবা রাজ্য পৃথিবীর একমাত্র রাজ্য যা সুলাইমান (আ) এর অধীনে ছিল না, তারা ছিল সূর্যপূজারী। পরে সুলাইমান (আ) কিতোরে প্রেরণ করেন পাখিটিকে তার পাখায় রানীর জন্য আমন্ত্রণপত্র লাগিয়ে। রানী সেই পত্র পেয়ে তার সকল জাহাজ প্রেরণ করেন দামি দামি উপঢৌকনসহ, যাতে ছিল একই মুহূর্তে জন্ম নেয়া ৬,০০০ তরুণ, সকলের গায়ে বেগুনি জামা। তাদের সাথে লেখা পত্রে বলা ছিল, যদিও জেরুজালেমে পৌঁছাতে রানীর সাত বছর সময় লাগতে পারে, তবে তিনি চেষ্টা করবেন তিন বছরে পৌঁছে যেতে। রানী যখন সুলাইমান (আ) এর প্রাসাদে পৌঁছালেন তখন তিনি রানীকে এক পানির চৌবাচ্চার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন, তবে তার ওপরে কাচ বিছানো ছিল। কিন্তু রানী সেটা না বুঝেই তার কাপড় পা থেকে ওপরে ওঠালেন যেন ভিজে না যায়। তখন তার লোমশ পা উন্মুক্ত হয়ে গেলো, যা সুলাইমান (আ) খেয়াল করে তা নিয়ে কথা বললেন। তিনি তাঁকে তিনটি (বা উনিশটি) কঠিন প্রশ্ন করেন, যার উত্তর সুলাইমান (আ) দিয়ে দেন। ইহুদীদের মিদ্রাশে এ ধাঁধাগুলোর উল্লেখ আছে।
যেমন, “জীবিত অবস্থায় নড়ে না, কিন্তু মাথা কেটে ফেললে নড়ে। কী সেটা?”
উত্তর ছিল, “গাছ। কারণ, এর মাথা কেটে ফেলে তা দিয়ে জাহাজ বানানো যায়, যা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে।’
আরেকটি ধাঁধা ছিল, “মাটি থেকে জন্মায়, মানুষই একে জন্মায়, কিন্তু এর খাবার হলো মাটির ফল।”
এর উত্তর ছিল, “লণ্ঠনের সলতে।”
ভাষান্তরে অর্থ হারিয়ে যাওয়া এ অদ্ভুত ধাঁধাগুলোর একটাতেও পরাজিত হননি সুলাইমান (আ)।
মধ্যযুগের দ্য অ্যালফাবেট অফ সিরাখ গ্রন্থ বলে থাকে, বাদশাহ নেবুকাদনেজার (বখতেনাসার) ছিলেন সুলাইমান (আ) আর সাবার রানীর পুত্র। ইহুদী কাব্বালাতে, সাবার রানীকে জ্বিনরানী অপশক্তি লিলিথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আরব উপকথা অনুযায়ী, রানী বিলকিস আসলে আধা জ্বিন আধা মানব ছিলেন।
এবার আসা যাক, কুরআনের ভাষ্যে। এতক্ষণে পূর্বের লোকদের কাহিনী জানা থাকাতে কুরআনে বর্ণিত কাহিনী সহজেই বুঝে ফেলা যাবে-
“সুলাইমান পক্ষীদের খোঁজ খবর নিলেন, অতঃপর বললেন, কী হলো, হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা হত্যা করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ
কিছুক্ষণ পড়েই হুদ এসে বলল, আপনি যা অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার কাছে সাবা থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি। আমি এক নারীকে সাবাবাসীদের উপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সেজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতএব তারা সৎপথ পায় না। তারা আল্লাহকে সেজদা করে না কেন, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের গোপন বস্তু প্রকাশ করেন এবং জানেন যা তোমরা গোপন কর ও যা প্রকাশ কর। আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই; তিনি মহা আরশের মালিক।
সুলায়মান বললেন, এখন আমি দেখব তুমি সত্য বলছ, না তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি আমার এ পত্র নিয়ে যাও এবং এটা তাদের কাছে অর্পণ কর। অতঃপর তাদের কাছ থেকে সরে পড়ো এবং দেখ, তারা কী জওয়াব দেয়।
রানী বলল, হে পরিষদবর্গ, আমাকে একটি সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে। সেই পত্র সুলাইমানের পক্ষ থেকে এবং তা এই: ‘অসীম দাতা, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে শুরু; আমার মোকাবেলায় শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে উপস্থিত হও।’ হে পরিষদবর্গ, আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দাও। তোমাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোনো কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না।
তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই। অতএব আপনি ভেবে দেখুন, আমাদেরকে কী আদেশ করবেন।
রানী বলল, রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গকে অপদস্থ করে। তারাও এরূপই করবে। আমি তাঁর কাছে কিছু উপঢৌকন পাঠাচ্ছি; দেখি প্রেরিত লোকেরা কী জওয়াব আনে।
অতঃপর যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বললেন, তোমরা কি ধনসম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে প্রদত্ত বস্তু থেকে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক। ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমি তাদের বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমি অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কৃত করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত।
সুলায়মান বললেন, হে পরিষদবর্গ, তারা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে রানীর সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?
জনৈক দৈত্য-জিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং আমি এ কাজে শক্তিবান, বিশ্বস্ত।
কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, আপনার দিকে আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দেব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা নিজের চোখের সামনে দেখলেন, তখন বললেন এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের উপকারের জন্যেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত, কৃপাশীল।
সুলায়মান বললেন, রানীর সামনে তার সিংহাসনের আকার-আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বুঝতে পারে, নাকি সে তাদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের দিশা নেই?
অতঃপর যখন রানী এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তোমার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটাই। আমরা পূর্বেই (সিংহাসন চুরি যাবার ব্যাপারে) সমস্ত অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহও হয়ে গেছি।
আল্লাহর পরিবর্তে সে যার এবাদত করত, সে-ই তাকে ঈমান থেকে নিবৃত্ত করেছিল। নিশ্চয়ই সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তাকে বলা হলো, এই প্রাসাদে প্রবেশ কর। যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল সে ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। রানী বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।” (সুরা সাবা ২৯:২০-8০)
ইবনে কাসিরের তাফসিরে উল্লেখ আছে যে, হুদহুদ পাখি সুলাইমান (আ) এর জন্য গণৎকারের কাজ করত। পানি কোথায় আছে তা বলতে পারত। মাটির নিচের পানির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানালে সুলাইমান (আ) জ্বিনদেরকে দিয়ে খনন করিয়ে ফেলতেন। কথিত আছে, সেই পাখিটির নাম ছিল আম্বার। সে জানায়, সাবার রানীর উপদেষ্টা ও উজিরের সংখ্যা তিনশো বারোজন। প্রত্যেকের অধীনে ছিল ১০,০০০ জন করে দল। সাবা রাজ্যের সেই জায়গাটির নাম মারিব। আরও শোনা যেত, সুলাইমান (আ) এর কাছে রানীর দূতেরা পৌঁছাবার আগেই তার নির্দেশে এক হাজার প্রাসাদ বানানো হয়ে যায়। যখন রানীর দূতেরা রাজধানীতে পৌঁছাল তখন প্রাসাদগুলো দেখে তাদের আক্কেল গুড়ুম। তারা বলল, “বাদশাহ তো আমাদের উপহারগুলো ঘৃণার চোখে দেখবেন, এখানে দেখছি স্বর্ণ মাটির সমানও মর্যাদা রাখে না।”
যে লোকটি সিংহাসন চোখের পলকে হাজির করেছিলো বলে উল্লেখ আছে, তাফসিরে তার নাম আসিফ ইবনে বারখিয়া। তিনি আল্লাহর নাম অর্থাৎ ইসমে আজম জানতেন, যে নাম জপলে যেকোনো কাজ চোখের নিমিষে সাধিত হয় বলে শোনা যায়। তা ব্যবহার করেই তিনি সিংহাসন হাজির করেন।
লোকে বলত, সাবার রানীর মা জ্বিন হওয়াতে রানীর পা চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষুরের মতো। শ্রুতি কাহিনী অনুযায়ী, এ কারণেই সুলাইমান (আ) দেখতে চেয়েছিলেন তার পায়ের অবস্থা। তার উদ্দেশ্য ছিল বিলকিসকে বিয়ে করা। কিন্তু যখনই রানী পা থেকে কাপড় তুললেন তখনই সুলাইমান (আ) দেখে ফেললেন যে, তার পা আসলে খুবই স্বাভাবিক, কেবল লোম বেশ বেশি, যার সাথে জ্বিন বাবা কিংবা মা হবার কোনো সম্পর্কই নেই। তিনি লোমগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে বলেন। ইমাম আবু বকর (র) অবশ্য এ গল্পটিকে ভিত্তিহীন বলেছেন।
কোনো কোনো কাহিনীতে, এরপর সুলাইমান (আ) সাবার রানীকে বিয়ে করেন। আবার কেউ বলেন, তিনি হামদানের রাজার সাথে তার বিয়ে দেন। আল হামদানির মতে, সাবার রানী আসলে নাজরানের হিমিয়ার রাজা ইলশারাহ ইয়াহদিবের কন্যা ছিলেন।
সুলাইমান (আ) ছিলেন সংযুক্ত ইসরাইল রাজ্যের শেষ রাজা। তিনি মারা যাবার পর তার পুত্র রেহোবাম সিংহাসনে আরোহণ করেন। এবং তখন থেকেই শুরু ইসরাইলের পতন।
সুলাইমান (আ) এর পর থেকে যীশু খ্রিস্টের সময়ের আগপর্যন্ত খুব কম ঘটনাই ইসলামি লেখনিতে পাওয়া যায়, এজন্য শূন্যস্থান পূরণের জন্য নজর দিতে হয় নানা ঐতিহাসিক লেখনি, হিব্রু ইতিহাস আর ওল্ড টেস্টামেন্টের পাতায়। আর ক্ষণে ক্ষণে কিছু তাফসিরের সাহায্য নেয়াটা জরুরি।