অধ্যায়-২৪ : ছয়-দিনের সেই যুদ্ধ

অধ্যায় ২৪ : ছয়-দিনের সেই যুদ্ধ

তেলআবিব মিউজিয়ামে জ্যুইশ পিপলস কাউন্সিল জড়ো হয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঘোষণা করা মাত্রই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিন স্বীকৃতি দেন ইসরাইলকে। অবশ্য ১৯৪৭ সালের ১১ মে জাতিসংঘে সদস্যপদ পেয়ে যায় ইসরাইল। তবে আরব লিগের মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এরা ইসরাইলের স্বাধীনতা প্রত্যাখ্যান করে।

ব্রিটিশরা যখন তাদের শেষ সেনাও সরিয়ে নেয় ফিলিস্তিন থেকে, তখন কিন্তু এ অঞ্চলে চলছিল বড় যুদ্ধ- ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, একে গৃহযুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।

১৯৪৮ সালের যুদ্ধটি ‘প্রথম’ আরব-ইসরাইলি যুদ্ধ নামে পরিচিত। যার মানে, এরপরেও এমন যুদ্ধ হয়েছে। অবশ্য ‘৪৮ এর যুদ্ধটি ১৯৪৭-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত চলা ফিলিস্তিন যুদ্ধের দ্বিতীয় ও শেষ অধ্যায়। ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হলো ১৯৪৮ সালের ১৪ মে মধ্যরাতে। ঠিক পরদিন রাত পেরুতেই, অর্থাৎ ১৫ মে আরব সম্মিলিত বাহিনী সেই ব্রিটিশ প্যালেস্টাইন অঞ্চলে প্রবেশ করে।

মিসর, ট্রান্সজর্ডান, সিরিয়া, ইরাক ইত্যাদি আরব রাষ্ট্রগুলো আক্রমণ করে ইসরাইলকে, কিন্তু সদ্যজাত ইসরাইলের তখনও কোনো ভারী অস্ত্র ছিল না। ফলে আরব রাষ্ট্রগুলো সহজেই দখল নিয়ে নিতে পারে বেশ কয়েকটি অঞ্চল। তখন জাতিসংঘ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে এ অঞ্চলে, ইসরাইলকে রক্ষা করতে। কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়া সেই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে ইসরাইলকে অস্ত্র যোগান দেয়। ১৯৪৮ সালের ১১ জুন দুপক্ষকে এক মাসের শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করে জাতিসংঘ। তবে তার মাঝে মারা যায় ইসরাইলের ৬,০০০ মানুষ, যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ছয় লাখ। অন্যদিকে, দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা ইসরাইল ৭ লাখ ২৬ হাজার ফিলিস্তিনিকে ভূমিত্যাগ করতে বাধ্য করে, ধ্বংস হয় প্রায় ৫০০ ফিলিস্তিনি গ্রাম। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে শুরু হয়ে ১৯৪৯ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলেছিল, অর্থাৎ প্রায় ১০ মাস। এ দুবছরের ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বলে থাকে, যার মানে ‘দুর্যোগ’। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের প্যালেস্টাইনের ৭৮% চলে যায় ইসরাইলের হাতে। এ যুদ্ধের পর পর ২ লাখ ৬০ হাজার ইহুদী চলে আসে ইসরাইলে।

যেহেতু হিব্রু পঞ্জিকার আইয়ার মাসের ৫ তারিখ ইসরাইল ব্রিটিশ ম্যান্ডেট থেকে ‘স্বাধীনতা’ অর্জন করে, তাই এ দিনটিকে তারা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে। তবে যেহেতু তা খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা নয়, তাই প্রতি বছর তা ১৪ মে এটি পড়ে না। ১৯৯৮ সালে ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনিদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ১৫ মে-কে (অর্থাৎ ইসরাইলের স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনকে) ‘নাকবা দিবস’ হিসেবে পালন করার।

ইসরাইলের সংসদ ‘কেনেসেত’ প্রথম মিলিত হয় তেলআবিবে, এরপর ১৯৪৯ সালের অস্ত্রবিরতির পর কেনেসেত (বা ‘কানেসাত’) চলে যায় জেরুজালেমে। হিব্রু এ শব্দের অর্থ ‘সমাবেশ’। কেনেসেতের মোট ১২০ জন সদস্য। ঠিক যেমন ইহুদীদের প্রাচীন নবীযুগে ‘কেনেসেত হাগদোলা’ অর্থাৎ ‘মহান সমাবেশে’ ১২০ জন সদস্য থাকতো, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে এটি শেষ হয়ে যায়। যাই হোক, ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে প্রথম নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ডেভিড বেনগুরিওন। ১৯৫১ সালের মাঝেই অভিবাসনের কারণে ইসরাইলের জনসংখ্যা হয়ে যায় দ্বিগুণ। ১৯৫৮ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় বিশ লাখে।

মিসরের একটি কৃত্রিম সামুদ্রিক খাল হলো সুয়েজ খাল, যা মিশরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। এটি ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করেছে লোহিত সাগরের সাথে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক দিক থেকে সুয়েজ খালের গুরুত্ব অকল্পনীয় রকমের বেশি। এই সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া ও মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরকে (আঞ্চলিক টানে ‘গামাল’-ও বলে) ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ইসরাইল ১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সকে মিত্র হিসেবে নিয়ে মিসর আক্রমণ করে বসে। শুরু হলো দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, যা ‘সুয়েজ সংঘাত’ নামেও পরিচিত। তবে আক্রমণ শুরু করতে না করতেই যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের তিরস্কারের মুখে তিন আক্রমণকারী দেশই পিছপা হতে বাধ্য হয়; আক্রমণ থেমে যায় ৭ নভেম্বর। অর্থাৎ মাত্র ১ সপ্তাহ ২ দিন টেকে এ যুদ্ধ, তবে ডুবে যায় ৪০টি জাহাজ। নাক কাটা পড়ে যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের, ঝামেলায় পড়ে ইসরাইল, আর অবস্থান শক্তিশালী হয় মিসরের প্রেসিডেন্টের।

ইসরাইল অবশ্য সুয়েজ সংকটের পেছনে যুক্তি দিয়েছিল- তারা চায় তিরান প্রণালী যেন খুলে দেয়া হয় তাদের জন্য। তিরান প্রণালী হলো সিনাই ও আরব উপদ্বীপের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সরু সামুদ্রিক পথ। এটি লোহিত সাগর থেকে গালফ অফ আকাবা বা আকাবা উপসাগরকে আলাদা করে। ১৯৫০ সাল থেকেই মিসর এটি বন্ধ করে দিয়েছে যেন ইসরাইল এটি ব্যবহার করতে না পারে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা এ শর্তে যুদ্ধ থেকে সরে আসে যে তিরান প্রণালী তাদের জন্য খুলে দেয়া হবে। খুলে দেয়া হয়ও। কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে সীমান্ত থেকে সেনা সরাবার ব্যাপারে কোনো চুক্তি হলো না।

এরপরের কয়েক বছর দুই দেশের মাঝে স্নায়ুযুদ্ধ চলে। ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে সেনাবিহীন এলাকায় একটি ইসরাইলি কৃষি ট্রাক্টর ধ্বংস করে দেয় সিরিয়া। এর ফলশ্রুতিতে আকাশপথে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় দু দেশের মাঝে। ১৯৬৭ সালের মে মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভুল কিছু তথ্যের কারণে মিসর ইসরাইলের পরিকল্পনা সম্পর্কে ভুয়া কিছু আন্দাজ করে এবং সুয়েজ সংকটের পর থেকে সিনাই উপদ্বীপে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের বহিষ্কার করে বসে। প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের আবার তিরান প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেন। ফলে ইসরাইল ক্ষেপে যায়। তারা তিরান প্রণালী বন্ধের ঘোষণাকে যুদ্ধের ইঙ্গিত ধরে নেয়।

এক মাসও যায়নি, ইসরাইল সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন মিসর আক্রমণ করে বসে। তারিখটি ছিল ১৯৬৭ সালের ৫ জন। ইসরাইল মিসরীয় এয়ারফিল্ড উদ্দেশ্য করে এয়ারস্ট্রাইক করে। শুরুতে তারা দাবি করে যে, মিসর তাদেরকে প্রথম আক্রমণ করেছে, কিন্তু পরে বলে যে তারা নিজেই ছুঁড়েছিল। আজও এ বিতর্কের অবসান হয়নি। অতর্কিত আক্রমণে মিসর পিছিয়ে পড়ে, ইসরাইল যায় এগিয়ে। ইসরাইলের তেমন ক্ষতি না হলেও, মিসরের প্রায় পুরো বিমান বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। একই সাথে ইসরাইল মিসরীয় অধিকৃত গাজা অঞ্চল এবং সিনাই উপদ্বীপে আক্রমণ চালায়। সেখানেও অবাক হয়ে যায় মিসরীয়রা। প্রথম দিকে একটু ঠেকানোর চেষ্টা করলেও প্রেসিডেন্ট নাসের পরে সিনাই খালি করে ফেলতে আদেশ দেন। মাত্র ছয় দিনের মাঝে পুরো সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয় ইসরাইল। ১১ জুন ইসরাইল অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়।

ছয়-দিনের এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসরাইল মিসর এবং তার মিত্র জর্ডান ও সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে তুলোধুনো করে ছাড়ে। ২০,০০০ আরব সেনা মারা যায়, যেখানে ইসরাইলের মারা যায় মাত্র ১,০০০। বিনিময়ে ইসরাইল সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি, জর্ডানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীর এবং মিসরের কাছ থেকে গাজা দখল করে নেয়। লজ্জায় প্রেসিডেন্ট নাসের পদত্যাগ করেন। যদিও প্রতিবাদের মুখে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট হন। ছয় দিনের যুদ্ধ (বা তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ) ৩ লাখ ২৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে পশ্চিম তীর থেকে এবং ১ লাখ সিরীয়কে গোলান মালভূমি থেকে ঘরছাড়া করে।

তবে এ ছয় দিনের যুদ্ধে একটি ভিন্ন ঘটনাও ঘটেছিল। ৮ জুন তারিখে ইসরাইল এয়ার ফোর্স আর নেভি মোটর টর্পেডো বোট মার্কিন জাহাজ ইউএসএস লিবার্টি আক্রমণ করে বসে। মারা যায় ৩৪ ক্রু, আহত হয় ১৭১ জন ক্রু। জাহাজটা ছিল মিসরীয় শহর আরিশ থেকে ২৫ নটিকাল মাইল দূরে। ইসরাইল দুঃখ প্রকাশ করে বলে, মিসরীয় জাহাজ ভেবে আক্রমণ করে ফেলেছিল। এখনকার হিসাব মতে ইসরাইল সরকার তিন দফায় ২২.৯, ২৩.৩ এবং ১৭.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয় সে ঘটনায় নিহতদের জন্য। তদন্ত রিপোর্ট বলে এটা ভুল ছিল, তবুও বেঁচে যাওয়া ভিক্টিমদের কারও কারও মত আবার ভিন্ন ছিল!

উল্লেখ্য, ছয়দিনের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসরাইল তার মানচিত্র আজকের অবস্থার কাছাকাছি নিয়ে আসে এক লাফে, সে বিষয়ে আলাপ হবে পরের অধ্যায়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *