অধ্যায়-২৩ লেজেন্ডস অফ সলোমন
একটু আগে যে জ্বিন জাতির রাজা আসমোদিয়াসের কথা বলো হলো, তাকে নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। ইহুদী কাব্বালাহ অনুযায়ী, ঘুমন্ত কিং ডেভিডের অজ্ঞাতসারেই তার সাথে জ্বিনদের রানী আগ্রাত-বাত-মাহলাতের সঙ্গমের কারণে আগ্রাত গর্ভবতী হয় এবং জন্ম দেয় জ্বিনদের পরবর্তী রাজা আসমোদিয়াসের। সুলাইমান (আ) এর সাথে তার ছিল প্রচণ্ড শত্রুতা।
যে কাহিনী এখন বর্ণনা করব সেটি ইবনে কাসির আর তাবারিতে বর্ণনার পাশাপাশি ইসরায়েলের লোককাহিনীতেও আছে। ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কুরআনের এই আয়াতটা চলে আসে ইবনে কাসিরে-
“আমি সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং রেখে দিলাম তার সিংহাসনের উপর একটি দেহ। অতঃপর সে অনুতপ্ত হলো।”
(“And We did try Solomon: We placed a body on his throne; then he repented”) [কুরআন ৩৮:৩৪]
কেন সুলাইমানকে পরীক্ষা করা হয়েছিল বলা হয়েছে? কী কারণে শাস্তি দেয়ার কথা আসলো? তার সিংহাসনে কী ছিল? সব শেষে সলোমন প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন কীসের জন্য?
সুলাইমানের (আ) তখন প্রচুর নামডাক। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়ে চলেছে। প্রবল প্রতাপ তাঁর।
তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণের কাজও শুরু করে দিয়েছেন। টেম্পল অফ সলোমন। অনেক মানুষ আর জ্বিন তিনি এ কাজে নিয়োগ দেন। সবচেয়ে কঠিন কাজগুলো তিনি রেখে দেন অবাধ্য এবং খারাপ জ্বিনদের জন্য। তারা কথা শুনতে চাইতো না, তাই তাদেরকে তার আংটির জোরে কাজে করাতেন। সুলাইমানের প্রতি তাই সেই জ্বিনদের ভয়াবহ আক্রোশ ছিল।
এরকম সময় তাঁর কাছে খবর এলো সমুদ্র তীরের এক রাজ্যের, নাম তার সিদোন (Sidon)। খুব শক্তিশালী রাজা সেখানে শাসন করত। তার বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধে জিততে পারত না, কারণ, তার আশপাশে সমুদ্র ছিল, এটি ছিল বড় একটা শক্তি।
সুলাইমানের বিশাল উড়ন্ত কাঠের যান থাকার কারণে তাঁর কাছে সমুদ্র পার হওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। তিনি বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে রওনা দিলেন।
সিদোন নগরীতে অবতরণ করার পর যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধে সেই প্রতাপশালী রাজা মারা যায়।
সেই রাজার এক মেয়ে ছিল, রাজকন্যা জারাদা। বলা হতো, জারাদা ছিল সেই সময়ের বিশ্বের সেরা সুন্দরী। জারাদা ইসরাইলের ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করল। তখন মানুষ বিশ্বাস করত, যে জাতি অন্য জাতিকে পরাজিত করবে, সেই বিজয়ী জাতির দেবতা সঙ্গত কারণেই বিজিত জাতির দেবতার চাইতে শক্তিশালী। সুলাইমান (আ) জারাদাকে বিয়ে করলেন।
রানীর হালে থাকা সত্ত্বেও জারাদা প্রচুর কাঁদত তার মৃত বাবার জন্য। উপকথা বলছে, সুলাইমান তখন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তাঁর অনুগত জ্বিনদের আদেশ করলেন জারাদার বাবার একটি নিখুঁত মূর্তি বানিয়ে দিতে। তারা তা-ই করল। এতে জারাদা বেশ খুশি হলো!
কিন্তু সুলাইমান (আ) যেটা জানলেন না সেটা হলো, জারাদা আর তার সহচারীরা (ঐ রাজ্য থেকে আনা দাসীরা) প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় সেই মূর্তির সামনে গিয়ে পূজা করে আসত। এটা সিদোন রাজ্যের রীতি ছিল- পূর্বপুরুষের পূজা করা, তাদের মাধ্যমে দেবতাদের খুশি করা ইত্যাদি। অথচ, জারাদা ইসরাইলি ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
সুলাইমানের উজির আসাফের কানে এ খবর পৌঁছাল এবং তিনি সেটা সুলাইমানকে (আ) বলে দিলেন। সুলাইমান (আ) সেটা শুনে রেগে গেলেন। তাঁর রাজ্যে, তাঁর নিজের প্রাসাদে, নিজের স্ত্রী মূর্তিপূজা করছে!
তিনি শাস্তি দিলেন তাকে, এবং সেই মূর্তিটি ধ্বংস করে দিলেন।
কিন্তু তাঁর কাজের ফলেই এই মূর্তিপূজা সংঘটিত হয়েছিল দেখে আল্লাহ নাখোশ হন। (বাইবেলে এ ঘটনাতেই সম্ভবত সুলাইমানকেও সেই মূর্তির উপাসক আখ্যায়িত করা হয়)
ক’দিন পরে, সুলাইমান (আ) তাঁর সিংহাসন-কক্ষ থেকে কিছুটা বিরতি নিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেলেন। যাবার আগে তিনি হাত থেকে আংটিটা খুলে তাঁর স্ত্রী জারাদাকে দিয়ে গেলেন (মতান্তরে আমিনাহ)। তিনি যেকোনো রকম অপবিত্রতার কাজ আসলেই আংটি খুলে রাখতেন এবং স্ত্রীকে দিয়ে যেতেন।
সুলাইমান (আ) চলে যেতেই অবাধ্য যে জ্বিনদের কথা বলা হলো একটু আগে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি
সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ছিল জ্বিনদের রাজা আসমোদিয়াসের, যাকে সুলাইমান আংটির বশে জোর করে বশীভূত করে রেখেছেন। আরবি তাফসিরে তার নাম পাওয়া যায় ‘সাখার’ নামে, তাই তাকে এ কাহিনীতে সাখার নামেই উল্লেখ করা হচ্ছে। সাখার সুলাইমানের (আ) বেশ ধরে চলে আসলো জারাদার কাছে। এসে বলল, “আংটিটা দাও।” স্ত্রী দিয়ে দিল।
এবং আংটি নিয়ে চলে গেল সাখার।
আসল সুলাইমান (আ) যখন ফিরে এলেন, বললেন, “আংটিটা দাও।” তখন স্ত্রী অবাক হয়ে বলল, “আপনি কে?”
“মানে কী? আমি সুলাইমান।”
“মিথ্যে বলছেন আপনি! একটু আগেই সুলাইমান (আ) এসে আংটি নিয়ে গেছেন। তিনি সিংহাসনে বসে আছেন।”
সুলাইমানের (আ) মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। প্রহরীরা তাকে ধরার আগেই তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কিছুতেই তিনি কাউকে বোঝাতে পারছিলেন না, তিনিই আসল সুলাইমান। লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা রাস্তায় যাকে পাচ্ছেন তাকেই বলছেন, “আমি সুলাইমান! দাউদের ছেলে! তোমাদের রাজা!”
আর লোকে তাকে মারতে লাগল, উপরে ময়লা ছুড়ে দিতে লাগলো। কারণ, সে নিজেকে রাজা সুলাইমান দাবি করছে। পাগল লোক!
সুলাইমানের (আ) চেহারাই পুরো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ।
ক্ষুধার তাড়নায় ক্লান্ত সুলাইমান (আ) নদীর তীরে পৌঁছালেন, গিয়ে জেলেদের বললেন, তাঁকে মাছ দিতে। “আমি তোমাদের রাজা সুলাইমান, কসম করে বলছি!”
এক জেলে তখন তাকে পেটাতে শুরু করল। রক্ত বের করে ফেলল মাথা থেকে।
রক্তাক্ত সুলাইমানকে (আ) রেখে সেই জেলে চলে গেল। তিনি নদীর পানি দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলেন।
অন্য জেলেরা তখন মার দিয়ে ফেরত আসা জেলেকে ধরল, “কী এমন অপরাধ করেছিল লোকটা যে এত পেটাতে হবে তোমার? সামান্য মাছই তো চেয়েছিল!”
“সেজন্য ওকে মারিনি। সে বলছিল, সে নাকি রাজা সুলাইমান। আমাদের রাজার নামে মিথ্যে বলছিল!”
এরপর আর বাকিদের কোনো কথা নেই মুখে, যেন মারাটাই ঠিক হয়েছে।
সুলাইমান (আ) এরপর থেকে খেটে খেতে লাগলেন। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি জেলেদের মাছগুলো বাজার পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতেন। সন্ধ্যা হলে পরে লোকেরা তাকে পারিশ্রমিক হিসেবে দুটো মাছ দিত। তিনি একটা বিক্রি করে সেটা দিয়ে রুটি কিনতেন। আর অন্যটা আগুনে পুড়িয়ে খেতেন সেই রুটি দিয়ে।
এভাবে দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল।
ওদিকে, শয়তান সুলাইমানের (আ) রূপ ধরে বসে ছিল সিংহাসনে, রাজ্যচালনা করছিল। কিন্তু লোকে বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করল, তার বিচারগুলো আর আগের মতো নেই! আগে যেখানে মানুষ তার প্রশংসা করত ন্যায়বিচারের কারণে, সেখানে এখন প্রায়ই ভুল করেন তিনি।
উজির আসাফ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি লোকদের বললেন, “তোমরা কি দাউদের ছেলের বিচারগুলো দেখেছো? তোমাদের কি মনে হয়েছে তিনি ভুল করছেন?”
“জি, উজির।”
“আমাকে কিছু সময় দাও। অন্দরমহলে আমি খোঁজ নেই। বাইরের সলোমনের মতো অন্দরমহলের সলোমনেরও একই অবস্থা কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
তিনি সুলাইমানের স্ত্রীদের কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি সুলাইমানের আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখেছো? কোনো ভুল করছেন তিনি? সত্যি করে বলবে!”
সত্যি, আমাদের সন্দেহ হয়েছে। তার মাথা গেলো কী না।” এরপর তারা সুলাইমানের অসদাচরণগুলো বললেন। তারা এখন সুলাইমান থেকে দূরে থাকেন। এ কথা শুনে আসাফ বললেন, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবো… বোঝাই যাচ্ছে, একটা স্পষ্ট পরীক্ষার মধ্যে পড়েছি আমরা।”
তিনি ফিরে এসে লোকদের বললেন, “তিনি অন্দরে যা করতে চান সেটা বাইরের থেকেও খারাপ।”
তখন আসাফ পরিকল্পনা করতে লাগলেন। কী করা যায়। এ অবশ্যই সুলাইমান না। তার আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে, যেখানে দরবারে প্রতিদিন তাওরাত আর যাবুর তিলাওয়াত করা হতো, এখন সেখানে সুলাইমান নিজে থেকে বলছেন এগুলো থাক!
ওদিকে সাখার বুঝতে পারল, লোকে সন্দেহ করা শুরু করে দিয়েছে। সে তখন শেষ কামড়টা বসাতে চাইলো। তার জানা যত কালো জাদু ছিল, সবগুলো কিছু বইয়ে লিখিয়ে নিল, এরপর সেটা সিংহাসনের নিচে লুকিয়ে রাখল। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, আগে থেকেই অনেক কালো জাদুর বই জব্দ করে সুলাইমান (আ) সেগুলো সেখানে রেখেছিলেন, যেন কারো হাতে না পড়ে সেগুলো। এগুলোর সাথে যোগ হলো সাখারের বইগুলো। বইগুলার ওপরে লেখকের নাম হিসেবে লেখা হয়েছিল ‘আসিফ বারখিয়া’।
একদিন আসাফ জোর করে দরবারে তাওরাত তিলাওয়াত শুরু করালেন। ‘সুলাইমান’ নিষেধ করা সত্ত্বেও। এতে শয়তানের অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। একটা পর্যায়ে সে আর স্থির থাকতে পারল না, প্রকাশ করে ফেলল যে সে সুলাইমান না প্রকৃতপক্ষে।
সে বুঝতে পারল এখন তাকে পালিয়ে যেতে হবে। যাবার আগে সে একটা কাজ করে বসলো, বলল, “তোমরা জানো না তোমাদের সুলাইমান কীসের জোরে রাজ্য শাসন করতেন। সব কালো জাদু। কুফরির জোরে। তোমাদের রাজা এত কিছু করেছেন সব এই কুফরির বলে! চিন্তা করো কার শাসনে আছো তোমরা।”
এই বলে সে উড়ে চলে গেল। কিন্তু তার হাতে আর সেই আংটিটা বসছিলই না। কোনো এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে হাত থেকে খুলে গেল আংটিটা। সেটা উপর থেকে এসে পড়লো সাগরে, যেখানে একটা মাছ সেটা খেয়ে ফেলল। আংটির পরোয়া না করে পালিয়ে গেল সাখার বা আসমোদিয়াস।
অন্যান্য দিনের মতোই সুলাইমান (আ) সেদিন কাজ করছিলেন সকাল- সন্ধ্যা। অবশেষে মজুরি পেলেন দুটো মাছ। জেলেপাড়ায় ফিরে এলেন তিনি। একটা মাছ বিক্রি করে রুটি নিয়ে এসেছেন, আর এখন অন্য মাছটা কাটলেন। কাটতেই সেটা থেকে বেরিয়ে এল সেই আংটিটা। সেই জায়গাটার নাম ছিল ‘আসকালান’।
তিনি আংটিটা পরে নিলেন। সাথে সাথে আল্লাহ তার চেহারা ঠিক করে দিলেন। পাখিরা সব তার আশপাশে এসে কিচিরমিচির শুরু করল। লোকজন তখন চিনে ফেলল তাঁকে। সবাই তাঁর সামনে এসে জড়ো হলো। এমনকি তাঁকে যে পিটিয়েছিল সে-ও, এসে ক্ষমা চাইলো সে।
তিনি বললেন, “তুমি ক্ষমা চাইছো দেখে আমি তোমার প্রশংসা করব না। তবে তুমি আমাকে মেরেছো দেখে আমি তোমার দোষও দেব না। যা হবার কথা ছিল তা-ই হয়েছে।” পুরোটাই একটা পরীক্ষা ছিল।
তিনি সম্পূর্ণ পায়ে হেঁটে নিজ প্রাসাদে ফিরলেন।
ইবনে আব্বাস (রা) এর বর্ণনা মতে, তাঁকে চল্লিশ দিন পর্যন্ত এভাবে কষ্ট করতে হয়েছিল, কড়ায় গণ্ডায় ঠিক যতদিন তাঁর স্ত্রী প্রাসাদে মূর্তিপূজা করেছিল আগে।
ওদিকে শয়তান সাখার পালিয়ে গিয়ে সবার আগে যে কাজটা করল, ছড়িয়ে দিল এ কথাটা যে, সুলাইমানের (আ) সিংহাসনের নিচে কী সব জিনিস আছে, সুলাইমান কালু জাদু করেন ইত্যাদি।
সুলাইমান (আ) প্রাসাদে ফিরে তার জিনবাহিনীকে আদেশ করলেন সাখারকে খুঁজে বের করতে। যথাসময়ে তাকে খুঁজে এনে তাঁর সামনে উপস্থিত করা হলো। একটা বিশাল পাথরে ছিদ্র করে ভেতরে জায়গা করলেন তিনি, এরপর তাকে বাধ্য করলেন ভেতরে ঢুকতে আংটির জোরে। এরপর সেই ছিদ্র লাগিয়ে দিলেন। এর উপর কয়েক স্তর সীসা আর লোহার আস্তরণ করে দিলেন। এরপর সেটাকে গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন।
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, কেবল একটা লোহার সিন্দুকে নিজে আংটি দিয়ে সীলগালা করে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়।
সাখারের নাম কোনো কোনো জায়গায় হাকীক বা হাবাকীক লেখা হয়েছে। আর আসমোদিয়াস তো আছেই।
এই কাহিনীর উপর ভিত্তি করে অনেক অনেক গল্প বলা হয়েছে। বিশেষ করে মাছের পেটে আংটি পাওয়ার গল্প তো আরব্য রজনীতে পরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে অনেকভাবেই বলা এসব গল্পের মূল ছিল সুলাইমান (আ) এর এই কিংবদন্তী। তাছাড়া, সিন্দুকে করে সাগরে ফেলে দেয়া জ্বিনের পরবর্তীতে কোনো এক জেলের জালে উঠে আসার গল্প ও ব্যাপক জনপ্রিয়। আলিফ লায়লার কল্যাণে এ গল্প সবারই পরিচিত
যে কাহিনীটা এখানে বলা হলো, সেটা ইসরায়েলি কিংবদন্তী।
সুলাইমান (আ) রাজ্য ফিরে পেলেন, এবং আবারও সুন্দরভাবে শাসন করতে লাগলেন। কিন্তু একটাই সমস্যা ছিল। সেটা হলো, রাজ্যে গুজব রটে গেছে যে, তিনি কুফরি করেন। তিনি কালো জাদু করেন এবং এর সাহায্যেই রাজ্য পরিচালনা করেন। সবাইকে বশ করেন। প্রকৃতপক্ষে, যেটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। কিন্তু কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতোই যেন রাজ্যে সেই জাদুবিদ্যা আরও জোরসে শেখাতে লাগলো শয়তানেরা।
কুরআনের সূরা বাকারার ১০২ নাম্বার আয়াত এ প্রসঙ্গেই বলছে:
“তারা ঐ বিদ্যার (যাদুবিদ্যা) অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আওড়াতো। সুলাইমান কুফরি করেননি; কুফরি করেছিল শয়তানরাই। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা শিখিয়েছিল এবং তারা সেটাও শিক্ষা দিত যেটা ব্যাবিলন শহরে হারুত ও মারুত ফেরেশতা দুজনের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। (কিন্তু) ফেরেশতা দুজনই এ কথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, ‘আমরা তো কেবল পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না।’ অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তা দ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না। তারা তা-ই শেখে যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে। তারা (ইসরাইলি ইহুদীরা) ভাল করেই জানতো যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা নিজেকে বিক্রি করেছে, তা যে কী খারাপ, যদি তারা জানত!” [কুরআন ২:১০২]
সুলাইমান (আ) সেগুলো পুড়িয়ে ফেলেন পরে।
কিন্তু, এখনও পর্যন্ত সুলেমানি জাদু, সুলেমানি খোয়াবনামা, সুলেমানি তাবিজ- এরকম হরেক রকম নামে অনেক কিছুই প্রচলিত আছে।
কিন্তু ইহুদীদের একটি গ্রুপ গোপনে আলাদা হয়ে যায়। তারা চর্চা করতে থাকে ‘গোপন জ্ঞানের’, নিজেদের তারা ‘কাব্বালিস্ট’ বলত। কাব্বালা মূলত ইহুদী একটি উপদল বা সম্প্রদায়, যেখানে ‘স্পিরিচুয়াল সেন্সে শেখানো হয় নশ্বর আর অবিনশ্বর সম্পর্ক’। কাব্বালার মূল গ্রন্থের নাম ‘জোহার’।
একপর্যায়ে কাব্বালাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ষোড়শ শতকে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় ইহুদী র্যাবাই আব্রাহাম আজুলাইয়ের চেষ্টায়। তার মতে, তারা অপেক্ষায় আছেন ইহুদীদের রাজা আসবেন। যিনি এসে ইহুদীদের রক্ষা করবেন। তিনি হবেন ‘খ্রিস্ট’, ‘ক্রাইস্ট’ বা ‘মাসিহ’।
বলা বাহুল্য, যদিও সুলাইমানের সময় থেকেই অপেক্ষায় থাকা সেই খ্রিস্টের আগমন ০০০০ সালের আশেপাশে হলেও, যীশুকে ইহুদীরা খ্রিস্ট বলে মানেনি। বরং, তারাই গর্ব করে যীশুকে হত্যার দায়টা নিয়ে নেয়। এবং, পুনরায় খ্রিস্টের আগমনের প্রতীক্ষায় থাকে।
সেই ঘটনা অবশ্য আরও গভীর, এবং প্রচলিত জানার বাইরেও আছে অনেক কিছু, সেটি নিয়ে আরেকটি বই লেখা হয়ে যেতে পারে। তবে হারুত মারুত, ব্যবিলনের মতো বিষয়াদি নিয়ে আরও জানতে হলে পাঠক আমার অন্য বই ‘অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে’ পড়ে নিতে পারেন।
ইহুদীরা যেমন দাবি করে, কাব্বালা হলো খাঁটি আর্ট, সেরকম অইহুদীরা বলে যে, কাব্বালা হলো ইহুদী ধর্মের কালো দিক। কোনো কাব্বালিস্ট অস্বীকার করে না যে, এর সাথে অতিপ্রাকৃত কাজকর্ম জড়িত। বরং, কাব্বালার ইতিহাসে এমন অস্বাভাবিক আর ভয়ংকর কাহিনী আছে যে সেটা উল্লেখ করারই যোগ্য না। তবে, যারা কেবলমাত্র যাত্রা শুরু করেছে তাদের সেগুলো শেখানো হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’ বাণী দিয়ে দেয়া হয় প্রথমে, কেননা এ পথে শেখা দক্ষতা “বিপদজনক এবং দায়িত্বজ্ঞানশূন্যতার পরিচায়ক” হবে। তাছাড়া, “প্র্যাক্টিকাল কাব্বালা” বলে একটা ব্যাপার আছে ইহুদী ধর্মের কালো দিকে, যেগুলো খুব বেশি রকমের ভয়ংকর ফলাফল বয়ে আনে দেখে সেগুলো আগেকার দিনে জনসাধারণকে দেয়াই হত না। কেবলমাত্র দক্ষ কাব্বালিস্টরা সেটার দেখভাল করত। ইহুদীরা বলতো, যীশু/ঈসা (আ) যেসব অলৌকিক কাজ করে দেখাতেন সেগুলো কাব্বালা বা কালো জাদু শিখেই করেছিলেন।
অনেকে জিজ্ঞেস করে থাকেন- সুলাইমানের (আ) সেই আংটিটি এখন কোথায়। আংটিটি আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্টের ভেতরে রেখে দেয়া হয়েছিল বলে শোনা যায়, যেখানে মূসা (আ) এর আসল লাঠিও ছিল। সাথে বেহেশতি খাবার মান্না আর সালওয়ার কিছু নমুনা।
কথিত আছে, একবার উড়ন্ত যানে করে চলবার সময় সুলাইমান (আ) এক অসাধারণ প্রাসাদ দেখতে পেলেন। কিন্তু সেই প্রাসাদে ঢুকবার কোনো রাস্তা নেই। তিনি জ্বিনদের আদেশ করলেন প্রাসাদের দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে ছাদে, কোনো জীবিত কাউকে ভেতরে তারা পায় কি না। তারা কেবল একটি ঈগলকে পেলো আশপাশে, যার বয়স ছিল ৭০০ বছর। ঈগল জানালো, সে কখনও এ প্রাসাদে ঢোকার রাস্তা দেখেনি। সেই ঈগলের বড় ভাইকে খুঁজে আনা হলো, যার বয়স ৯০০ বছর। সে-ও কখনও প্রবেশপথ দেখেনি। তাদের আরেক বড় ভাই ১৩०০ বছরের ঈগল জানালো, তাদের প্রয়াত বাবা তাকে এই প্রাসাদের পশ্চিমদিকের একটি প্রবেশপথের কথা বলে গিয়েছিলেন। বালুর তলা থেকে সেই প্রবেশপথ খুঁজে বের করলেন সুলাইমান (আ), সেখানে এক মূর্তি পাওয়া গেল। মূর্তির মুখে একটি রূপালি ফলকে লেখা, এটি শাদ্দাদ বিন আ’দের মূর্তি। “শাদ্দাদ লাখো শহর জয় করেছে, লাখো ঘোড়ার পিঠে চড়েছে, লাখো প্রজার রাজা হয়েছে, লাখো যোদ্ধার হত্যাকারী হয়েছে, কিন্তু পরাজিত হয়েছে মৃত্যুর ফেরেশতার কাছে।”
মোটামুটি ৬০ বছর বয়সের দিকে মৃত্যুবরণ করা সুলাইমান (আ)-এর শাসনকালের সবচেয়ে চমকপ্রদ কাহিনীর একটি ছিল শেবার রানীর আগমন। এবার তাহলে সেই ঘটনাতেই যাওয়া যাক।