অধ্যায় ২৩ : ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের বিভক্তীকরণ নিয়ে ভোটের আয়োজন করে। এ প্রস্তাবে বলা হয়, এ অঞ্চলে মুসলিম ও ইহুদীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রবর্তন করা হবে, আর জেরুজালেম থাকবে বিশেষ আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে। এ সময় পর্যন্ত ইরগুন আর লেহি ব্রিটিশ সেনা ও পুলিশদেরকে আক্রমণ করতে থাকে। প্রথমে হাগানাহ আর পালমাখ ব্রিটিশদের পক্ষেই ছিল, ইরগুন আর লেহির বিরুদ্ধে লড়ছিল; কিন্তু এরপর ইহুদী মুক্তিকামী হিসেবে ইরগুন আর লেহির পক্ষে যোগ দেয়। এর কিছুদিন পর তারা নিজেদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ দাবি করে। হাগানাহ নিজেও ফিলিস্তিনে ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। যেমন ধরুন, দেশের রেললাইন উড়িয়ে দেয়া, রাডার ধ্বংস করে দেয়া, ব্রিটিশ ফিলিস্তিনি পুলিশ স্টেশনগুলো ধ্বংস করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টা জুড়ে হাগানাহ আলিয়াহ বেৎ আয়োজন করতে থাকে।
১৯৪৬ সালের ২২ জুলাই ভরদুপুরে ইরগুনের বোমা বিস্ফোরণে কিং ডেভিড হোটেলের একটি পাশ (দক্ষিণ পাশ) পুরো উড়ে যায় আক্ষরিক অর্থেই। ৯১ জন মারা যান সেদিন। তারা ছিলেন নানা দেশের মানুষ, কারণ সে হোটেলে থাকতেন অনেক বিদেশী। এতজন মারা যাওয়ার পাশাপাশি গুরুতর আহত হন ৪৬ জন। যারা উড়িয়ে দিল, সেই ইরগুনের পুরো নাম ‘ইরগুন জাই লিউমি’ (এরেস ইসরাইল), হিব্রু থেকে বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায় ‘জাতীয় মিলিটারি সংঘ’ (ইসরাইল ভূমিতে)। ইরগুন সন্ত্রাসীরা আরবদেশী শ্রমিক আর ওয়েটার সেজে বোমা পেতে এসেছিল। তখন তেলআবিব (যেটা বর্তমানে ইসরাইলের রাজধানী) শহরে কারফিউ জারি করা হয়। ফিলিস্তিনের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ইহুদীকে জেরা করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য ইরগুনের নেতা মেনাখিম বেগিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদ পেয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে আর না পেরে ব্রিটিশরা ঘোষণা করে তারা ফিলিস্তিন ম্যান্ডেট ছেড়ে দেবে, তারা ফিলিস্তিন ছেড়েই চলে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের লেবার সরকার এই ‘ঝামেলা’ সদ্য গঠিত জাতিসংঘকে হ্যান্ডেল করতে দেবার জন্য প্রস্তুত হয়।
১৯৪৭ সালের ১৫ মে গঠিত হয় United Nations Special Committee on Palestine (UNSCOP), যা পরে প্রস্তাব দেয় “স্বাধীন এক আরব রাষ্ট্র, স্বাধীন এক ইহুদী রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম শহর” -এই তিন ভাগের। সামান্য কিছু এদিক- ওদিকের মাধ্যমে জাতিসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে এই প্রস্তাব বিষয়ে ভোট হয়। ফলাফল স্বরূপ, ইহুদী সমাজে উচ্ছ্বাস আর আরব সমাজে অসন্তুষ্টি ছড়িয়ে পড়ে।
ওই অঞ্চলে তখন দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। ইহুদী আর আরবদের মাঝে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে, ইহুদীরা আক্রমণ করছে, আরবরাও আক্রমণ করছে- সে এক এলাহী কাণ্ড। দুই মাসে মারা যায় ৮০০ মানুষ। ম্যান্ডেট বিলুপ্তির ছয় সপ্তাহ আগেই তর সইলো না হাগানাহ, ইরগুন, লেহিদের। তারা ভয়ংকর আক্রমণ চালালো সেই এলাকাগুলো দখলের জন্য, বিভক্তীকরণ প্রস্তাব অনুযায়ী যেগুলো ইহুদীদের হবার কথা। তাইবেরিয়া, সাফেদ, হাইফা, জাফা (ইয়াফা), আক্রা, বাইসানের মতো এলাকাগুলো থেকে পালিয়ে যায় আরবরা। ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় জেরুজালেম যুদ্ধ— দুই পক্ষই লড়াই করে জেরুজালেমের জন্য। তেলআবিব থেকে জেরুজালেম জুড়ে প্রায় সকল আরব গ্রাম দখল করে নেয় ইহুদী সন্ত্রাসী সংঘগুলো, মাটিতে গুঁড়িয়ে দেয় সেসব।
দামেস্ক ফটকে গাড়ি বোমা ফাটিয়ে ইরগুন ২০ জনকে হত্যা করে। মুসলিমদের প্যারামিলিটারি সংস্থা নাজ্জাদার হেডকোয়ার্টার ধ্বংস করতে লেহি ট্রাকবোমা ব্যবহার করে, মারা যায় ১৫ আরব, আহত হয় ৮০। জেরুজালেমের সেমিরামিস হোটেল উড়িয়ে দেয় হাগানাহ, মারা যায় ২৪ জন। পরদিনও ইরগুন সন্ত্রাসীরা পুলিশের ভ্যান চুরি করে ব্যারেল বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে জাফফা ফটকে বাসের জন্য অপেক্ষারত বেসামরিক লোকদের হত্যা করে; সেদিন মারা যায় ১৬ জন। রামলার বাজারে ইরগুনের বোমা বিস্ফোরণে ৬ জন মারা যায়, আহত হয় ৪৫ জন। পালমাখ বাকি থাকবে কেন, তারাও হাইফাতে বোমা ফাটায় এক গ্যারেজে, মারা যায় ৩০ জন। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল দেইর ইয়াসিন গণহত্যায় জেরুজালেমের নিকটস্থ দেইর ইয়াসিন গ্রামে ১০৭ জন ফিলিস্তিনি আরবকে হত্যা করে ইরগুন আর লেহি; এর মাঝে নারী ও শিশুও ছিল।
খুবই দ্বিমুখী ব্যাপার হলো, এরা একদম মোটা দাগেই সন্ত্রাসী সংঘ, এবং ব্যাপক সংখ্যক মানবহত্যার দায়ে দণ্ডিত। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিহাস বর্ণনা করতে গেলে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কখনও এ ইহুদী সন্ত্রাসী কর্মগুলো প্রচার করে না।
আর না পেরে জাতিসংঘ ইরগুনকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করে। এর পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকার, মার্কিন সরকার এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার মতো প্রভাবশালী পত্রিকাও তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়। এখানেই শেষ নয়, ইরগুনের নেতা মেনাখেম বেগিনকে খোদ আলবার্ট আইনস্টাইন এবং ২৭ জন ইহুদী বুদ্ধিজীবী ‘সন্ত্রাসী’ ডাকেন, এবং এ নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে পত্র দেন; ১৯৪৮ সালের ৪ ডিসেম্বর পত্রটি প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে লেহি-কে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয় কেবল জাতিসংঘ আর ব্রিটিশ সরকার।
সে সময় জায়োনিস্ট নেতা ডেভিড বেনগুরিয়ন বাধ্যতামূলক করলেন যে, সকল ইহুদী নারীপুরুষকে মিলিটারি ট্রেনিং নিতে হবে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, শেষ ব্রিটিশ সামন্ত এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সেদিন ইসরাইলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ন ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন, সেদিন ছিল ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের শেষ দিন। তিনি ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ গোপন ইন্টেলিজেন্সমূলক কাজের জন্য শিন-বেৎ সৃষ্টি করেন, আর আন্তর্জাতিক হুমকি সামাল দেবার জন্য তৈরি করেন দুর্ধর্ষ সিক্রেট সার্ভিস- ‘মোসাদ’। এই দুটো সংস্থার নাম ষাটের দশকের আগে মুখেই আনা নিষিদ্ধ ছিল। এতটাই গোপন ছিল এগুলোর কাজ কারবার!
তবে মোসাদ নিয়ে বিস্তারিত জানতে হলে পড়তে হবে আমার আরেক বই “সিক্রেট মিশনস : মোসাদ স্টোরিজ”।