অধ্যায় ২২ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইহুদী গণহত্যা
‘আলিয়াহ আলেফ’ আর ‘আলিয়াহ বেৎ’ ইহুদীদের মাঝে খুব গুরুত্ববহ দুটো বিষয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় আলিয়াহ। প্রথম আলিয়াহ বা আলিয়াহ আলেফ হলো, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ব্রিটিশ সরকার যখন বৈধভাবে ইহুদীদেরকে অভিবাসী হতে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু যখন থেকে সেটি সহজে দেয়া বন্ধ করে দেয় সরকার, তখন থেকে তারা অবৈধভাবে আসা শুরু করে। একেই বলা হয় দ্বিতীয় আলিয়াহ, বা আলিয়াহ বেৎ। আজকের ইসরাইলে একে ডাকা হয় ‘হাপালাহ’, যার অর্থ ‘আরোহণ’। প্রশ্ন আসতে পারে, অবৈধভাবে কেন আসতে হবে? ব্রিটিশ সরকার কি খুশি মনেই ইহুদীদেরকে আসতে দেবার কথা না এখানে?
ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে, আসলে তা নয়। এই দ্বিতীয় আলিয়াহ ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলে। এর বেশিরভাগ অবৈধ ইহুদী অভিবাসী ছিল নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা, কিংবা হলোকাস্ট থেকে বেঁচে আসা শরণার্থী ইহুদী। প্রথম দিকে ব্রিটেন ফিলিস্তিন আর ইউরোপীয় ইহুদীদের মধ্যে কোনো সম্পর্কই রাখতে চায়নি। সত্যি বলতে, খোদ ব্রিটেনেই আশি হাজার ইহুদীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতি বদলাতে থাকে, এবং সীমিত পরিসরে তারা অনুমতি দিতে থাকে ফিলিস্তিনের একটি অংশে ইহুদীদের অভিবাসনের। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ঘৃণা থেকে ধীরে ধীরে ইহুদী আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসী সংস্থাগুলো তৈরি হতে থাকে; যেমন, ইরগুন জাই লিউমি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্যাতিত ইহুদীরা মিত্রপক্ষের সাথেই ছিল, অর্থাৎ ব্রিটিশদের পক্ষে। তাই এ সময়টুকু ইরগুনও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে উৎপাত বন্ধ রাখে। ইহুদীরা এ সংঘগুলোকে ‘প্যারামিলিটারি’ সংস্থা ডাকত।
ইরগুনের পাশাপাশি ‘লেহি’ ছিল আরেকটি ‘প্যারামিলিটারি’ সংস্থা। লেহি ছিল হিব্রু ‘লোহামেত হেরুত ইসরাইল’-এর আদ্যক্ষর দিয়ে বানানো সংক্ষিপ্তরূপ, এর মানে ছিল ‘ইসরাইলের স্বাধীনতাযোদ্ধা’। এছাড়াও ছিল ‘হাগানাহ’ নামে আরেক সংস্থা, অর্থ ‘প্রতিরক্ষা’। ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত এটি ছিল ফিলিস্তিনের ইহুদীদের প্রধান ‘প্যারামিলিটারি’ সশস্ত্র দল। হাগানার ফ্রন্টে কাজ করা গ্রুপের নাম ছিল ‘পালমাখ’ বা ‘পালমাহ’, যার অর্থ ‘স্ট্রাইক ফোর্স’।
১৯২০ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের ফিলিস্তিনে ইহুদীবাদী হার্বার্ট স্যামুয়েলকে হাই কমিশনার করে পাঠানো হয়। তখন জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আগমনের ঢেউ শুরু হয়। আরব বাসিন্দারা ফিলিস্তিনে এরকম ইহুদীদের আগমনকে ভালো চোখে দেখেনি। ১৯২০ সালে আরব দাঙ্গা ও ১৯২১ সালে ইয়াফা দাঙ্গার পর ইহুদী নেতারা বুঝতে পারলো, ব্রিটিশদের আসলে এখানে আরবদের ঠেকানোর কোনো ইচ্ছে বা পরিকল্পনা নেই। তাই তখন তারা তাদের প্যারামিলিশিয়া বাহিনীগুলো তৈরি করা শুরু করে, যাদের অনেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। তবে দাঙ্গার শেষ নয় সেখানেই। ১৯২৯ সাল এবং ১৯৩৬-৩৯ সালে আরও দুটো বড় দাঙ্গা হয়ে যায় ফিলিস্তিনে
তবে স্ট্রাইক ফোর্স ঘরানার কোনো অবস্থা ইউরোপের ইহুদীদের ছিল না। তাই নাৎসি বাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার হতে হয় তাদের। সেই ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হলো, তাই এবার আলোচনা করা যাক।
ইহুদীদের নিজস্ব হিসেব মতে, ১৮৮০ সালের মাঝেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াই লাখ ইহুদীর বসবাস তখন। ১৮৮১-৮২ সালের দিকে জনসংখ্যা আরও বাড়তে শুরু করে। ১৮৮১ থেকে ১৯১৪ সালের মাঝে প্রায় সাড়ে সাতাশ লাখ পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদী দেশত্যাগ করে। এর মাঝে ২ লক্ষ ইহুদী যায় ইংল্যান্ডে, সাড়ে ৩ লাখ যায় পশ্চিম ইউরোপে, ৪০ হাজার যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়, ১ লাখ ১৫ হাজার যায় আর্জেন্টিনায়, ১ লাখ কানাডায় এবং প্রায় ২০ লাখ ইহুদী যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
হঠাৎ করে এত ইহুদী আমেরিকায় চলে আসায় আগে থেকে সেখানে থাকা ইহুদীদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রভাব পড়লো বেশ। আগে যেখানে সেফার্দি ইহুদীরা প্রভাব বিস্তার করতো, এখন সেখানে জার্মানি থেকে আসা ইহুদীরা প্রভাব খাটাতে লাগলো। পুরো দেশ জুড়েই ছড়িয়ে পড়লো তারা, পুরো দস্তুর আমেরিকান বনে গেল। সাথে বাকি পূর্ব ইউরোপীয় আশকেনাজি ইহুদীরা তো আছেই।
১৯০২ সালে জার্মানি থেকে আসা ইহুদীদের মাঝে যারা উচ্চশিক্ষিত ছিল। তারা নতুন ধারার ইহুদী বিশ্বাস তৈরি করতে চেষ্টা করলো, অর্থাৎ তারা ধর্মটিকে সংস্কারের চেষ্টা করে। পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদীরা এই নতুন সংস্কার বেশ আগ্রহ ভরেই গ্রহণ করে। ১৯০৬ সালে জার্মানি থেকে আসা ইহুদীরা দাতব্য সংস্থা গড়ে তোলে, প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকান জ্যুয়িশ কমিটি যা ইউরোপের দুঃখ-কষ্টে থাকা ইহুদীদের কল্যাণে কাজ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জায়োনিস্ট নানা কর্মকাণ্ডে তারা ছিল সর্বাগ্রে।
আমেরিকার ইহুদীদের জন্য সমস্যা বাঁধিয়ে দিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে মিত্রপক্ষ ও কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে লড়ে ইহুদীরা। রাশিয়াতে দুবছর যুদ্ধের পর ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জার শাসনের পতন হয়, এবং ইহুদীদের বিরুদ্ধে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়। নভেম্বরেই রাশিয়ার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে শুরু করে, শুরু হয় বলশেভিকদের বিপ্লব।
সংক্ষেপে যদি বলি, বলশেভিক হলো ভ্লাদিমির লেনিন প্রতিষ্ঠিত মার্কসবাদী রাশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির একটি উপদল। তারা ১৯০৩ সালে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে মেনশেভিক থেকে আলাদা হয়ে যায়। ‘বলশেভিক অর্থ ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা’, তারা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। এরপর তারা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। বলশেভিকরা ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সময় রাশিয়ার ক্ষমতায় আসে এবং প্রতিষ্ঠা করে রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোস্যালিস্ট রিপাবলিক। পরবর্তীতে এটিই ছিল ১৯২২ সালে গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান প্রশাসনিক অঞ্চল।
আমরা যদি রাশিয়ার তৎকালীন ভোটগুলো দেখি, দেখা যায় সাধারণ ইহুদীরা বলশেভিকদের পক্ষে তেমন ভোটই দেয়নি! অথচ, বলশেভিকদের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন ইহুদী। অবশ্য তারা ধর্মীয়ভাবে ছিলেন নাস্তিক, কিন্তু জাতিগত পরিচয়ে জন্মসূত্রে ছিলেন ইহুদী, তবে তারা নিজে থেকে ইহুদী পরিচয় দিতেন না। যেমন, লিওন ত্রোৎস্কিকে তার জাতিগত পরিচয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন, সমাজতান্ত্রিক।
১৯১৮ সালের মার্চ মাসে রাশিয়ার সাথে জার্মানির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড ও ইউক্রেন জার্মানির অধিকারে চলে যায়। আমেরিকা যুদ্ধে প্রবেশের পর ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পূর্ব ইউরোপে তখনও যুদ্ধ চলছে। জার্মানরা ইউক্রেন ছেড়ে চলে গেলে, ক্ষমতার জন্য অনেকগুলো দল মারামারি করতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে রেড আর্মি চেষ্টা করে বাহিনীর ভেতর ইহুদী-বিরোধী মনোভাব দূর করতে, কিন্তু অন্যান্য সেনারা ইহুদীদের হত্যা করে। ১৯২০ সালে এ যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু ততদিনে অনেক ইহুদীই মারা পড়েছে। আসল সংখ্যাটা কতো সেটি নিরপেক্ষ উৎস থেকে নির্ধারণ করা দুষ্কর। তবে ইহুদী মতে, ১ থেকে দেড় লাখ ইহুদী মারা যায়। রুশ অঞ্চলের ইহুদী নিধনকে সাধারণত ‘পোগ্রোম’ বলা হয়, যদিও সাধারণ অর্থে এটি যেকোনো গণহত্যাকে বোঝানোর কথা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় বেশ কিছু দেশ ইহুদীদের অভিবাসন করার প্রচেষ্টায় বাধা দেয়। তখন থেকে ইহুদীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পড়ে যেতে থাকে। আর যারা সফলতা লাভ করতে থাকলো, তারা স্থান পেলো সমাজের উঁচু মহলে। কেউ রাজনীতিতে নাম লেখালো, কেউ বা কলা, সঙ্গীত, বিজ্ঞান, বা সাহিত্যে। এ সময় পোল্যান্ডে বাস করত ৩০ লাখ ইহুদী, হাঙ্গেরিতে ৪ লাখ ৪৫ হাজার, রোমানিয়ায় সাড়ে ৮ লাখ, লাতভিয়াতে ৯৫ হাজার, লিথুয়ানিয়াতে ১ লাখ ১৫ হাজার, যুগোস্লাভিয়াতে ৬৮ হাজার, বুলগেরিয়াতে ৪৮ হাজার এবং গ্রিসে ৭৩ হাজার। এ দেশগুলো যুদ্ধে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফেডারেল প্রজাতন্ত্র হিসেবে জার্মানি ভালোই উন্নতি করে, কিন্তু ১৯৩০-৩২ সালের অর্থনৈতিক মন্দা তাদের পথে বসিয়ে দেয়, একটি বড় অংশ বেকার হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে, সরকারকে প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্রিতে চলার ব্যাপারে জোর করতে থাকা এক্সট্রিমিস্ট দলগুলো বেশ সমর্থন পেতে লাগলো। ন্যাশনাল সোশালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির (নাৎসি পার্টির) নেতা অ্যাডলফ হিটলারকে তখন চ্যান্সেলর বানিয়ে দেয়া হয়। নাৎসি পার্টির মূল ভিত্তি ছিল জার্মান জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ-বিরোধিতা এবং অ্যান্টি-সেমিটিজম (এখানে কেবল ‘ইহুদী’-বিরোধী অর্থে)। হিটলারের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হার এবং যুদ্ধের পর অর্থনৈতিক মন্দা- সবকিছুর পেছনেই দায়ী ছিল ইহুদীরা। রাশিয়ার বলশেভিক বিজয়কে ধরা হতো ইহুদীদের বিশ্বনিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনার অংশ। আর একে প্রতিহত করতে জার্মানির দরকার নিজের ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে পারা।
হিটলারের ইহুদীদের প্রতি ঘৃণা তার জীবনীতে বেশ ভালোমতোই লিখিত রয়েছে। যেমন ধরুন, ভিয়েনাতে থাকার সময় তার লেখা, “এবার শহরের ভেতর দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ দেখি কালো কাফতান আর জুলফিওয়ালা এক লোক। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, এ কি ইহুদী? কারণ, লিনজে যাদের দেখেছিলাম, তারা তো দেখতে এমন ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ আমি গভীরভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। এর চেহারা তো পুরোই বিদেশি! আমার প্রথম প্রশ্ন তখন নতুন এক প্রশ্নে রূপ নিল, এ কি আদৌ জার্মান?” [মেইন ক্যাম্ফ, পৃষ্ঠা ২৯]
নাৎসিরা ক্ষমতা হাতে পাবার পর ১৯৩৩ সালে অন্য সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বরে নুরেমবার্গ আইনের মাধ্যমে ইহুদীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়। ১৯৩৮ সালে তাদেরকে গেস্টাপো অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় গোপন পুলিশের নজদারিতে রাখা হয়। সে বছর বেশ কিছু ইহুদীকে হত্যা করা হয়, যা হলোকাস্টের সূচনা করে।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিয়ম জারি করা হলো, রাত ৮টার পর কোনো ইহুদী রাস্তায় থাকতে পারবে না। তাদের চলাফেরা সীমিত করা হলো, বিভিন্ন বাহন ও টেলিফোন ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হলো। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ইহুদীদের বাজার করার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হলো।
প্রথমদিকে কয়েক হাজার ইহুদীকে শ্রম শিবিরে নিয়ে যাওয়া হলো, সেখানে অনেকের মৃত্যু হয়। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল সব ইহুদীকে বের করে দেয়া, কিন্তু রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা মাঠে মারা পড়ে। তাই তখন কেবল ইহুদীদের মেরে ফেলার রাস্তাই খোলা ছিল নাৎসিদের জন্য।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে হিটলার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি পোল্যান্ডের একটা বড় অংশ জার্মানির অধিকারে নিয়ে নেবেন, এবং সব মিলিয়ে ৬ লাখের বেশি ইহুদীকে কেন্দ্রীয় একটি এলাকায় নিয়ে আসবেন। ততদিনে ইহুদীরা গেটোর অধীনে চলে এসেছে। তাদেরকে দিয়ে সারাদিন সারা সপ্তাহই কাজ করানো হতো, আর খাবার হিসেবে দেয়া হতে লাগলো রুটি, স্যুপ ও আলু। ১৯৪৪ সালের দিকে প্রায় ৪ লাখ ইহুদী এভাবে শ্রম দিত। এদেরকে নাম ধরে নয়, গায়ে ট্যাটু করে দেয়া সংখ্যা ধরে ডাকা হতো। কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুর তদন্ত না করে তার জায়গায় আরেকজনকে কাজে লাগিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু শুধু খাটিয়ে তো সবাইকে হত্যা করা সম্ভব না, তাই নতুন পরিকল্পনার সূচনা হয় ১৯৪১ সালে রাশিয়া অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। হিটলারের লক্ষ্য ছিল, ইহুদী বলশেভিক ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করা সেখানে।
ইহুদী গণহত্যার বৃহৎ পরিসরে সূচনা মূলত তখন থেকেই। ১৯৪১ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪২ সালের শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ ইহুদীকে এভাবে পর্যায়ক্রমে হত্যা করা হয়।
১৯৪২ সালের মাঝামাঝি থেকে তাদেরকে গেটো থেকে ধরে নিয়ে মালবাহী ট্রেনে সিল করে পাঠিয়ে দেয়া হতো ডেথ ক্যাম্পে। ট্রেন থেকে নামানোর সময় জীবিত থাকলে সেখানে তাদেরকে হত্যা করা হতো গ্যাস দিয়ে, প্রহার করে, খাটিয়ে, মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট করে, কিংবা ডেথ মার্চ করিয়ে। তাদেরকে হত্যা করার এ পরিকল্পনাকে নাৎসি বাহিনী অভিহিত করতো ‘দ্য ফাইনাল সলুশন’ বা ‘চূড়ান্ত সমাধান’ নামে। ১৯৪৫ সালের মে মাস পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ড চলে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত।
হলোকাস্টে মারা গিয়েছিল কত জন ইহুদী? এটিকে একটি বিতর্কের বিষয় হিসেবে ধরা হয়। একদিকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারকারীদের দাবি, হলোকাস্ট বলে কিছু হয়নি আদৌ, এগুলো মিডিয়ার বানানো। আরেকটি পক্ষ বলে, হলোকাস্ট হয়েছিল, তবে যত ইহুদী মারা গিয়েছে বলা হয়, আসলে তত মরেনি, এটি অতিরঞ্জন। তবে, মূলধারার নানা ইতিহাসবিদের হিসেব মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্টে নিহত ইহুদীর সংখ্যা ৪২ থেকে ৭০ লক্ষের মাঝামাঝি। আপনি হয়তো ৬০ লক্ষ নিহত ইহুদীর একটি হিসেব শুনে থাকবেন, এটি মূলত নাৎসিদের কাছ থেকে আসা হিসেব। ‘৬০ লাখ’ সংখ্যাটি ১৯৪৫ সালে হলোকাস্টের মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন নাৎসি অ্যাডলফ আইখম্যান বলেছিলেন। তিনি ছিলেন নাৎসি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং তৃতীয় রাইখ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
‘হলোকাস্ট’ (Holocaust) মূলত একটি গ্রিক (ókavaros) শব্দ, যার অর্থ ‘গণপোড়ানো’। তবে ইহুদীরা হলোকাস্টকে হিব্রুতে ‘শোয়াহ’ (niri) বলে, যার অর্থ ‘ধ্বংস’। হলোকাস্টের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইহুদী জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়, আর পুরো বিশ্বের ইহুদী জনসংখ্যা কমে যায় এক- তৃতীয়াংশ। হলোকাস্টের সবচেয়ে কুখ্যাত কেন্দ্র ছিল অসউইচ বন্দী শিবিরে, যা মূলত ছোট খাট ৪০টি শিবিরের যোগফল। কেবল এই শিবিরের গ্যাস চেম্বারেই হত্যা করা হয় প্রায় ১০ লাখ ইহুদীকে।
হিটলার খুব ছোট বয়সেই ইহুদী-বিরোধী মতবাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, বড় হয়ে নয়। ভিয়েনাতে তিনি যখন চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করতেন তখন তার মনোভাব আরও পরিপক্ব হয়। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তার সবচেয়ে বেশি পেইন্টিংয়ের ক্রেতা ছিলেন এক ইহুদী- স্যামুয়েল মর্গানস্টার্ন! তার ইহুদীদের প্রতি ঘৃণার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকে অনেক রকম গল্প ফাঁদেন, যেমন তিনি নাকি এক ইহুদী পতিতার কাছে গিয়ে যৌনরোগ বাঁধিয়ে এসেছিলেন, সেই থেকে তার রাগ। কেউ বা বলেন, তার মাকে জড়িয়ে ছোট বেলায় কোনো ইহুদী সংক্রান্ত কাহিনী রয়েছে, কিংবা কেউ বলেন, হিটলারের কোনো ইহুদী প্রেমিকা হয়তো তাকে ছেড়ে চলে যায়, ইত্যাদি। এসব থেকে যে তার ইহুদী বিদ্বেষ গড়ে ওঠেনি, তা বলাই যায়। তার অতিরিক্ত জার্মান জাতীয়তাই একটি পর্যায়ে কড়া ইহুদী বিদ্বেষ পোষণ করতে সাহায্য করে। ২০১৫ সালে ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, হলোকাস্ট আসলে হিটলার নিজে থেকে করতে চাননি, এটি নাকি তাকে জেরুজালেমের মুসলিম গ্র্যান্ড মুফতি হাজ আমিন আল-হুসাইনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। হিটলার কেবল চেয়েছিলেন, তাদেরকে বের করে দিতে। কিন্তু আল-হুসাইনি নাকি তাকে বলেন, বের না করে দিয়ে মেরে ফেলতে। নেতানিয়াহু এমন কথা বলার পর বেশ তোপের মুখে পড়েন, কারণ আল হুসাইনির সাথে হিটলারের যেদিন দেখা হয় (১৯৪১ সালের ২৮ নভেম্বর) সেদিন তাদের মাঝে কী কী আলাপ হয়েছিল, তার পুরো অনুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এমন কোনো আলাপ সেদিন হয়নি।
আর হ্যাঁ, একটি উদ্ধৃতি হিটলারের নামে চালানো হয়- “আমি ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব ইহুদীকে হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু কিছু ইহুদী বাঁচিয়ে রাখলাম এ জন্য যে পৃথিবীর মানুষ দেখুক, আমি কেন তাদের হত্যা করেছিলাম।” এমন কোনো কিছু হিটলার কোনোদিন বলেছিলেন বলে অবশ্য প্রমাণ নেই, তার বইতেও কিছু নেই। এটি মূলত একটি ভুয়া উদ্ধৃতি, তবে বেশ পরিচিতি পেয়ে যায়।