অধ্যায়-২২ উইজডম অফ সলোমন সুলাইমানের (আ) অলৌকিকতা
সুলাইমান (আ) এর আল্লাহপ্রদত্ত প্রজ্ঞা এতই গভীর ছিল যে ‘উইজডম অফ সলোমন’ হয়ে গিয়েছিল প্রবাদতুল্য। তিনি নিখুঁতভাবে নানা মামলার ফয়সালা করে দিতেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাটি রয়েছে দুই মহিলা এবং তাদের একজনের সন্তান নিয়ে। বাইবেলের বুক অফ কিংস ঘটনাটি বর্ণনা করে এভাবে-
সেই সময়ে দুজন পতিতা স্ত্রীলোক বাদশাহর কাছে এসে তাঁর সম্মুখে দাঁড়ালো। একটি স্ত্রীলোক বললো, “হে আমার প্রভু, আমি ও এই স্ত্রীলোকটি দুজনে একটি ঘরে থাকি এবং সে যখন ঘরে ছিল তখন আমি একটি পুত্রসন্তান প্রসব করি। আমার প্রসবের পর তিন দিনের দিন এই স্ত্রীলোকটিও একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলো; তখন আমরা একত্রে ছিলাম, ঘরে আমাদের সঙ্গে অন্য কোনো লোক ছিল না, কেবল আমরা দুজন ঘরে ছিলাম। আর রাতে এই স্ত্রীলোকটির সন্তানটি মারা গেল, কারণ সে তার সন্তানের উপরে শয়ন করেছিল। তাতে সে মাঝ রাতে উঠে যখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন আমার পাশ থেকে আমার সন্তানটিকে নিয়ে নিজের কোলে শুইয়ে রাখল এবং নিজের মৃত সন্তানটিকে আমার কোলে শুইয়ে রাখল। খুব ভোরে আমি আমার সন্তানটিকে বুকের দুধ দিতে উঠলাম, আর দেখলাম ছেলেটি মৃত; কিন্তু সকালে তার প্রতি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম সে আমার গর্ভের সন্তান নয়।”
অন্য স্ত্রীলোকটি বললো, “না, জীবিত সন্তান আমার, মৃত সন্তান তোমার।”
প্রথম স্ত্রী বললো, “না, না, মৃত সন্তান তোমার, জীবিত সন্তান আমার।” এভাবে তারা দুজনে বাদশাহর সামনে ঝগড়া করতে লাগল।
তখন বাদশাহ সুলাইমান বললেন, “ একজন বলছে, এই জীবিত সন্তান আমার, মৃত সন্তান তোমার; অন্যজন বলছে, না মৃত সন্তান তোমার, জীবিত সন্তান আমার। আমার কাছে একটা তলোয়ার আন।”
তাতে বাদশাহর কাছে তলোয়ার আনা হলো। বাদশাহ বললেন, এই জীবিত ছেলেটিকে দুই খণ্ড করে ফেল এবং একজনকে অর্ধেক ও অন্যজন্যকে অর্ধেক দাও।”
তখন জীবিত ছেলেটি যার সন্তান, সেই স্ত্রীলোকটি সন্তানের জন্য তার অন্তঃকরণ ব্যাকুল হওয়াতে বাদশাহকে বললো, “হে আমার প্রভু, আরজ করি, জীবিত ছেলেটি ওকে দিয়ে দিন, ছেলেটিকে কোনোমতে হত্যা করবেন না।”
কিন্তু অপরজন বললো, “সে আমারও না হোক, তোমারও না হোক, দুই খণ্ড কর।”
তখন বাদশাহ জবাবে বললেন, “জীবিত ছেলেটি ওকে দাও, কোনোমতে হত্যা করো না; সে ঐ ছেলেটির মা।”
বাদশাহ বিচারের যে নিষ্পত্তি করলেন, তা শুনে ইসরাইলীদের মনে বাদশাহ সম্পর্কে ভয় জেগে উঠলো; কেননা তারা দেখতে পেল, বিচার করার জন্য তাঁর অন্তরে আল্লাহপ্রদত্ত জ্ঞান আছে। (১ বাদশাহনামা ৩:১৬-২৮)
এই একই ঘটনা ইসলামে বুখারি শরীফেও উল্লেখ আছে, তবে ভিন্নভাবে। আবু হুরাইরা (রা) এর সূত্রে বর্ণিত এ হাদিসে বলা হয়েছে, ঐ দুই মহিলা একসাথে সফর করছিলো, তাদের দুজনের কোলেই ছিল দুধের বাচ্চা। পথে এক শিশুকে বাঘ নিয়ে যায়। অবশিষ্ট শিশুকে উভয় মহিলা নিজের পুত্র বলে দাবি করে। এই মামলা নিয়েই তারা বাদশাহ দাউদ (আ) এর কাছে আসে। দাউদ (আ) বয়সে বড় মহিলার পক্ষে রায় দেন, কিন্তু সুলাইমান (আ) মীমাংসা করে দেন তার মতো করে। (বুখারি, নাসাঈ)
কুরআনে বলা হয়েছে, “আমি বাতাসকে তার অনুগত করে দিলাম, যা তার হুকুমে অবাধে প্রবাহিত হত যেখানে সে পৌঁছাতে চাইত। আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম অর্থৎ, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী। এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃঙ্খলে।” (সুরা সাদ ৩৮:৩৬-৩৮)
বলা হয়েছে, আল্লাহ বাতাসকে তার অধীন করে দেন, যা ছিল ঘোড়ার চাইতেও বেশি দ্রুতগামী ও শক্তিশালী। তার নির্দেশে বায়ু প্রবাহিত হত মৃদুমন্দ গতিতে। তিনি যখন যে শহরে যেতে মন চাইতেন, তখনই সে শহরে চলে যেতে পারতেন। কথিত আছে, তার ছিল কাঠের তৈরি বিশাল এক পাটাতন যেখানে পাকা ঘর, প্রাসাদ, তাঁবু, আসবাবপত্র, ঘোড়া, উট, ভারি জিনিস, মানুষ, জ্বিন, পশুপাখি সবকিছুরই জায়গা হয়ে যেত। বাতাস সেটি বয়ে নিয়ে যেত। এমনও হত, তিনি সকালবেলা বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে যাত্রা শুরু করলেন, দুপুরেই পৌঁছে গেলেন এমন এক জায়গায় যেখানে ঘোড়ায় করে যেতে লাগত এক মাস। সেখানে বিকেল পর্যন্ত থেকে আবার সন্ধ্যাতেই ফিরে এলেন বাইতুল মুকাদ্দাসে। হাসান বসরির কথায় উল্লেখ আছে, এখানে যে জায়গার কথা বলা হচ্ছে সেই শহরের নাম ছিল ইস্তাখার, যা জ্বিনরা তার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল, তখন নাকি সেটি প্রাচীন তুর্কিস্তানের রাজধানী ছিল।
কুরআন বলছে, “আমি সুলাইমানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্যে গলিত তামার এক ঝর্ণা প্রবাহিত করেছিলাম। কিছু জ্বিন তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, আমি জ্বলন্ত অগ্নির-শাস্তি আস্বাদন করাব। তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ।” (সুরা সাবা ৩৪:১২-১৩)
সুলাইমান (আ) এর ৭০০ স্ত্রী ছিল বলে বাইবেলে উল্লেখ আছে। তবে মতান্তরে সংখ্যাটি একশও রয়েছে। তাঁকে নিয়ে একটি হাদিস রয়েছে এরকম- আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, সুলাইমান (আ) বললেন : আজ রাতে আমি আমার নব্বইজন স্ত্রীর নিকট গমন করবো, তাদের প্রত্যেকে একেকজন এমন সন্তান প্রসব করবে যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। তাকে বলা হলোঃ ইন্শাআল্লাহ বলুন, তিনি বললেন না। তারপর তিনি প্রত্যেক স্ত্রীর নিকট গমন করলেন, কিন্তু একজন ব্যতীত কেউই সন্তান প্রসব করলো না। ঐ একজনও অর্ধ- অঙ্গবিশিষ্ট সন্তান প্রসব করলো। রাসুল (সা) বললেন: যদি তিনি ইন্শাআল্লাহ বলতেন, তবে কসম ভঙ্গ হতো না এবং তিনি কৃতকার্য হতেন। (নাসাঈ)
বাইবেলের ফার্স্ট বুক অফ কিংসে (১ বাদশাহনামা ১১) শেষ বয়সে সুলাইমান (আ) এর নামে অন্য দেব-দেবীর পূজা করবার অভিযোগ আছে। তিনি বিদেশি অনেক নারীকে বিয়ে করেছিলেন যারা সাথে করে তাদের দেব-দেবীর মূর্তি নিয়ে আসত এবং পূজা করত। সুলাইমান (আ) তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিদোনীয় দেবী আশতোরেথ (Ashtoreth) এবং আমোনীয় দেবতা মিলকমের (Milcom) পূজা করেন বলে বাইবেল বলছে, “অতএব মাবুদ সুলাইমানের প্রতি ক্রুদ্ধ হলেন; কেননা তাঁর অন্তঃকরণ ইসরাইলের আল্লাহ মাবুদের দিকে না থেকে বিপথগামী হয়েছিল, যিনি দুবার তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন, এই বিষয়ে মাবুদ তাঁকে হুকুম দিয়েছিলেন, যেন তিনি অন্য দেবতাদের অনুগামী না হন; কিন্তু মাবুদ যা হুকুম দিয়েছিলেন, তা তিনি পালন করলেন না। অতএব মাবুদ সুলাইমানকে বললেন, তোমার তো এই ব্যবহার, তুমি আমার নিয়ম ও আমার হুকুম করা সমস্ত বিধি পালন করোনি; এই কারণে আমি অবশ্যই তোমার থেকে রাজ্য চিরে নিয়ে তোমার গোলামকে দেব। তবে তোমার পিতা দাউদের জন্য তোমার বর্তমানকালে তা করবো না, কিন্তু তোমার পুত্রের হাত থেকে তা চিরে নেব। যা হোক, সারা রাজ্য চিরে নেব না; কিন্তু আমার গোলাম দাউদের জন্য ও আমার মনোনীত জেরুজালেমের জন্য তোমার পুত্রকে এক বংশ দেব (বারো বংশের মাঝে)।” (১ বাদশাহনামা ১১:৯-১৩)
অবশ্য বলা বাহুল্য, ইসলাম ধর্মে এমন কোনো কিছুই নেই; বরং বলা হয়েছে, সুলাইমান (আ) কখনও ‘কুফরি’ বা ‘অবিশ্বাস’ করেননি। বাইবেলে কোনো কিছু বলা না থাকলেও, ইহুদী নানা সূত্র জানিয়ে থাকে যে, এই বিশাল স্থাপনার জন্য পাথর ওঠানামা করানোর কাজকর্মগুলো মানুষ করতো না, করতো ফেরেশতারা, তবে বাধ্যগত হয়ে, স্বেচ্ছায় নয়। ইসলামি লেখনিতে বলা হয়েছে, সেগুলো জ্বিন জাতি করত।
হিব্রু উপকথা বলছে, সুলাইমান (আ) এর অধীনে ছিল শামির নামের এক পোকা, যা কাঠ, পাথর, হীরা বা লোহা সবকিছুই কেটে ফেলার ক্ষমতা রাখতো। এ পোকা ব্যবহার করে সুলাইমান (আ) বড় বড় পাথর কাটাতেন। কোনো ধারালো অস্ত্র ব্যবহার না করবার কারণ ছিল- এমন কিছু এখানে ব্যবহার করা যাবে না যা যুদ্ধে রক্তপাত করতে ব্যবহৃত হতে পারে, কারণ এ স্থাপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল শান্তি। ইহুদীদের তালমুদ গ্রন্থ অনুযায়ী, শামির মূসা (আ)-এর সময়েও ছিল। ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির সময় প্রথম শনিবারের আগের সন্ধ্যায় যে দশটি বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন তার মাঝে একটি ছিল শামির। বলা হয়, মূসা (আ) তৎকালীন বর্মে ধর্মীয় চিহ্ন খোদাই করবার জন্য শামির ব্যবহার করতেন। কিন্তু সুলাইমান (আ) জানতেন না কোথায় শামিরের খোঁজ পাওয়া যাবে। তাই তিনি তল্লাশির আয়োজন করেন শামির খুঁজে বের করবার, এবং তল্লাশি শেষে খোঁজ পাওয়া যায় মাত্র একটি শামির পোকার। অবশ্য অন্য এক ইহুদী উপকথা বলছে, জ্বিনজাতির রাজা আসমোদিয়াস (Asmodeus) সুলাইমানকে শামির উপহার দেন, কিংবা বলে দেন কোথায় খুঁজে পেতে হবে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, বাইবেলে এর উল্লেখ না থাকলেও, নামে না হলেও এ পোকার কথা এসেছে কুরআনে সুলাইমান (আ) এর কাহিনীতে-
“যখন আমি সুলাইমানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন তার লাঠি খেয়ে চলা এক মাটির পোকার দরুণই জ্বিনেরা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত হলো। যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জ্বিনেরা বুঝতে পারল যে, অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান থাকলে তারা এই লাঞ্ছনাপূর্ণ শাস্তিতে তারা আবদ্ধ থাকতো না।” (সুরা সাবা ৩৪:১৪ )
তৃতীয় শতকের রোমান সম্রাট ডায়োক্লিশান সম্পর্কে কথিত আছে, একবার তিনি এক উটপাখির বাচ্চাকে বন থেকে ধরে এনে প্রাসাদে কাচের ভেতর আবদ্ধ রাখেন। বাচ্চাটির মা পেছন পেছন ছুটে আসে তাকে মুক্ত করবার আশায়। তৃতীয় দিন মা পাখি ফেরত আসে মুখে শামির নিয়ে, সেটি কাচের ওপর ফেলে দিতেই একসময় বাচ্চাটি বেরিয়ে আসতে পারলো ভাঙা কাচ ভেদ করে। অ্যালবার্টাস ম্যাগনাসও এ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, শামিরের রক্ত যেকোনো কিছুকে ভেঙে ফেলতে পারে।
শামির অর্থ ‘পোকা’ ছাড়াও হতে পারে এক বিশেষ রকমের কঠিন পদার্থ যা যেকোনো পাথর থেকে শক্তিশালী। প্রাচীন আরামায়িক কথ্যভাষায় শামির বলতে এই বিশেষ পাথরকেই বোঝাতো। আলকেমিস্টদের নানা তল্লাশির বস্তু ছিল এই শামির।
সুলাইমান (আ) বাইবেলে বাইতুল মুকাদ্দাস বা ফার্স্ট টেম্পল অফ জেরুজালেম নির্মাণ শেষ করে ফেলেছিলেন, কিন্তু কুরআনে তা বলা নেই, বরং বলা হয়েছে তিনি তা নির্মাণাধীন থাকা অবস্থায় মারা যান, যা ওপরের আয়াত থেকেই বোঝা যায়।