অধ্যায়-২১ : জায়োনিস্ট আন্দোলনের সূচনা

অধ্যায় ২১ : জায়োনিস্ট আন্দোলনের সূচনা

জেরুজালেম নগরীতে ছোট্ট বিশেষ এক পাহাড় আছে। ‘পাহাড়’ না বলে অবশ্য ‘টিলা’ বলাটাই বেশি সঠিক। নিচের ছবিতে যেমনটা দেখতে পাচ্ছেন— সুন্দর উঁচু নিচু পাহাড়ি এলাকা, এটাই সেই পাহাড়, বা টিলা। একে ডাকা হয় ‘হার সিওন’। হিব্রু ভাষায় ‘হার’ মানে ‘পাহাড়’, আর ‘সিয়ন’ মানে যে কী, সেটা হিব্রুভাষীরাই সঠিক জানে না, আমাদের তো জানার প্রশ্নই আসে না। এই ‘সিয়ন’ বা ‘জিয়ন’ পাহাড়কে ইংরেজিতে বলা হয় ‘মাউন্ট জায়োন’। আরবিতে ‘জাবালে স্বহ-ইউন’।

মাউন্ট জায়োনের ভেতরে এক কক্ষেই যীশু তার শিষ্যদের সাথে শেষ ভোজ বা ‘দ্য লাস্ট সাপার’ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। এই সেই ‘জায়োন’, যাকে নিয়ে এত রক্তপাত। এই সেই জায়োন, ইহুদীরা যাকে ‘পবিত্র ভূমি’ বা হোলি ল্যান্ডের কেন্দ্র হিসেবে জানে, যার কোলে রয়েছে- অন্তত তাদের বিশ্বাসমতে- হযরত দাউদ (আ)-এর সমাধি, বা ডেভিড’স টুম্ব। এই সেই জায়ন, যেখান থেকে জায়োনিজমের উৎপত্তি; যে জায়োনিজমের ফসল হলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইসরাইল-ফিলিস্তিন রক্তপাত।

১৮৭০ ও ১৮৮০-র দশকে ইউরোপের ইহুদী সমাজ জোরেসোরেই আলাপ করতে লাগলো প্রাচীন ইসরাইল ভূমিতে ফিরে যাবার ব্যাপারে। সেখানে গিয়ে তারা আদি মাতৃভূমি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। হিব্রু বাইবেলে জেরুজালেমে ফেরত যাওয়া নিয়ে করা ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবে পরিণত করা ছিল তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য; প্রথম বাইতুল মুকাদ্দাস বা টেম্পল অফ সলোমন ভাঙার পর রাজা সাইরাসের পৃষ্ঠপোষকতায় ইহুদীদের জেরুজালেমে ফিরে আসাকে উজাইর (আ) ও নেহেমিয়া (আ) বলেছিলেন ‘শিভাৎ সিওন’। আরেকটি শিভাৎ সিওনের খোঁজে ছিল ইউরোপীয় ইহুদীরা।

১৮৮১ সালে ‘হোভেভেই সিওন’ অর্থাৎ ‘জায়োনপ্রেমী’ বা ‘হিব্বাত সিওন’ নামে এক বা একাধিক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত রুশ সাম্রাজ্যে ইহুদী বিরোধী মনোভাবের প্রত্যুত্তরে এগুলোর জন্ম। ১৮৮২ সালে বর্তমান তেলআবিব শহরের ৫ মাইল দক্ষিণে রিশন লেসিওন নামে একটি শহর গড়ে তোলে এই হোভেভেই সিওনের সদস্যরা, যারা অভিবাসন করে ওই অঞ্চলে চলে যায়। এটি ছিল অটোমান ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইহুদী শহর। এর আগের গ্রাম ১৮৭৮ সালে তেলআবিবের কাছে গড়ে ওঠে। এর নাম ছিল পেতাহ তিকভা, কিন্তু ১৮৮৩ সালের আগে সেটি শহরে পরিণত হয়নি।

১৮৮২ সালের দিকে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসে ‘বিলু’ আন্দোলনের নেতারা। তাদের দাবি হলো, ইসরাইল ভূমিতে কৃষিকাজের মাধ্যমে স্থায়িত্ব অর্জন করতে হবে। এর সদস্যদের বলা হতো ‘বিলুইম’।

১৮৮৪ সালের নভেম্বরে বিভিন্ন দেশ থেকে হোভেভেই সিওনের সদস্যরা তৎকালীন জার্মানির (বর্তমান পোল্যান্ডের) কাতোভিস শহরে মিলিত হয়। সেখানে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা। রাশিয়া থেকে ২২ জনসহ মোট ৩২ জন সদস্য ছিল এ কনফারেন্সে। প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসেরও ১৩ বছর আগের কথা এটি।

ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে জায়োনিস্ট আন্দোলন, তার শুরুটা যে স্ক্যান্ডালের মাধ্যমে হয়েছিল, সেটা সম্পর্কে খুব কম লোকই জানেন। এটাকে “ড্রায়ফাস স্ক্যান্ডাল” বা “ড্রায়ফাস অ্যাফেয়ার” ( Dreyfus affair) বলা হয়। ঘটনাটা এরকম, ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বরে ফরাসি বাহিনীর আর্টিলারি অফিসার ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ড্রায়ফাসকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং উত্তর আটলান্টিকের ডেভিলস আইল্যান্ডে যাবজ্জীবন দণ্ড দেয়া হয়। অভিযোগ হলো, তিনি নাকি প্যারিসের জার্মান এমব্যাসিতে ফ্রেঞ্চ মিলিটারির গোপন তথ্য পাচার করছিলেন। সমস্যাটা হলো, ড্রায়ফাস ছিলেন ইহুদী, এবং ইহুদীরা তখন প্রতিবাদ শুরু করে। দুবছরের মাথায় তদন্তে বেরিয়ে এলো, আসলে তথ্য পাচার করছিলেন অন্য এক আর্মি মেজর, ড্রায়ফাস নন। ফ্রেঞ্চ আর্মি নতুন তথ্য-প্রমাণ ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু এক পর্যায়ে ফরাসি রাষ্ট্রপতির ক্ষমাও জুটে যায় ড্রায়ফাসের, সুপ্রিম কোর্টও তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে। তিনি আর্মিতে মেজর হিসেবে যোগ দেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশও নেন। ড্রায়ফাসের ঘটনা ওখানেই শেষ।

কিন্তু এই স্ক্যান্ডাল থেকে জনৈক ভদ্রলোক এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ইহুদীদের ইউরোপে আর থাকা যাবে না। এই ভদ্রলোকের নাম থিওডোর হার্ৎজেল (Theodor Herzl), অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির একজন ইহুদী সাংবাদিক ও লেখক। তাকে ‘আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্রের জনক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

‘ইহুদী রাষ্ট্র” (দ্য জ্যুয়িশ স্টেট) নামে তার জার্মান ভাষায় লেখা বইতে হার্ৎজেল লিখেন, ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় ইহুদীবিদ্বেষের একমাত্র সমাধান আলাদা এক ইহুদী রাষ্ট্র। ১৮৯৭ সালে জায়োনিস্ট সংঘ গড়ে তোলা হয়। প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে লক্ষ্য ধার্য করা হয়, ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি গড়ে তুলতে হবে। প্রথমে ফিলিস্তিনের নাম আসেনি, এর আগে এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার যেকোনো জায়গায় ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আসে। কিন্তু ১৯৭ জন ইহুদী প্রতিনিধিই একমত হন ফিলিস্তিনের ব্যাপারে।

১৯০২ সালের মাঝে ৩৫,০০০ ইহুদী চলে আসে ফিলিস্তিনে, যেটা বর্তমানে ‘ইসরাইল’ নামে পরিচিত। তখন সেটা অবশ্য মুসলিম অধিকারে। এটাকে বলা হয় ‘প্রথম আলিয়া’। আলিয়া হলো ইহুদী পুনর্বাসন, যখন অনেক ইহুদী একসাথে সরে আসে। তখন মুসলিম-প্রধান ফিলিস্তিনে দেখা গেল, জেরুজালেমের সিংহভাগই হঠাৎ করে ফিরে আসা ইহুদী।

১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদীদের জনসংখ্যা ছিল মোটে কয়েক হাজার। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার! ১৯১৪ সালের মাঝে দ্বিতীয় আলিয়া হয়ে গেল, ৪০,০০০ ইহুদী এ এলাকায় চলে এলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীরা সমর্থন দেয় জার্মানিকে, কারণ তারা শত্রু রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছিল। ভাগ্যের পরিহাসে, পরের বিশ্বযুদ্ধেই এই জার্মানি ইহুদীদের একদম নিশ্চিহ্ন করতে নেমে পড়েছিল!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৮ সালে, আর তাতে হেরে যায় কেন্দ্রীয় শক্তি (অক্ষশক্তি) বা সেন্ট্রাল পাওয়ার্স। এই বিজিত কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে ছিল জার্মান সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্য (উসমানি সাম্রাজ্য) আর বুলগেরিয়া। যুদ্ধে জিতে যায় মিত্রশক্তি (অ্যালাইড)। আসলে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর অস্ত্রবিরতি হলেও, কাগজে কলমে যুদ্ধের ইতি ঘটে ১৯১৯ সালের ২৮ জুন। সেদিন প্যারিস থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদ ভের্সাই প্রাসাদে সাক্ষরিত হয় ভের্সাই চুক্তি, যেখানে জার্মানি আর মিত্রশক্তির যুদ্ধের ইতি টানা হয়। ঠিক পাঁচ বছর আগে এক অস্ট্রিয়ান আর্চডিউকের গুপ্তহত্যার কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

বিশ্বযুদ্ধের পরপর মিত্রশক্তি ১৯১৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একটি সম্মেলন আয়োজন করে, একে ‘প্যারিস পিস কনফারেন্স’ বা ‘প্যারিস শান্তি সম্মেলন’ বলা হয় (যার ফল ছিল এ ভের্সাই চুক্তি)। সেখানে যোগদান করেন ৩২টিরও বেশি দেশ থেকে আসা কূটনীতিকগণ। এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল, এই যুদ্ধে হেরে গেল যে দেশগুলো, তাদের সাথে কী করা যায়, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। পরাজিত কেন্দ্রীয় শক্তির দেশগুলোর জন্য বিভিন্ন শর্ত তৈরি করা হয় এ সম্মেলনে। পুরো যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয় জার্মানিকে। দেশটিকে যুদ্ধের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার বহনের জন্য জরিমানা করা হয়। জার্মানি প্রচণ্ড অপমানিত হলেও ১৯৩১ সাল পর্যন্ত একটি বড় অংকের ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। তবে এর ফলে স্বভাবতই ইউরোপের অন্য দেশগুলোর প্রতি জার্মানদের মনে ঘৃণা তৈরি হয়।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে নেয়া দুটো বড় সিদ্ধান্ত আমাদের এ বইয়ের পটভূমি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্ত এক, একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে, যার নাম হবে ‘লিগ অফ ন্যাশনস’। আর দুই, জার্মানি আর অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে যে বিদেশী এলাকাগুলো ছিল, সেগুলো মিত্রশক্তির মাঝে বিলি করে দেয়া, বিশেষ করে ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মাঝে।

জাতিসংঘ সৃষ্টির আগে পুরো বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক যে সংঘের উপস্থিতি ছিল, সেটিই লিগ অফ ন্যাশনস (League of Nations), যাকে সংক্ষেপে LON-ও ডাকা হতো। প্যারিস শান্তি সম্মেলনের ফলশ্রুতিতে ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি জন্ম নেয় এ লিগ। জাতিসংঘ জন্ম নেবার আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত লিগ অফ ন্যাশনস তার কাজ চালিয়ে যায়। এর পতাকায় ব্রিটিশদের ভাষা ইংরেজি আর ফ্রান্সের ভাষা ফরাসিতে নাম লেখা ছিল (Société des Nations ), যেমনটি এখানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে-

লিগ অফ ন্যাশনসের পতাকা
লিগ অফ ন্যাশনসের পতাকা

তো যা বলছিলাম, যুদ্ধে পরাজিত দেশগুলোর বিদেশী অধিকৃত এলাকাগুলোকে বিলি করে দেবার কথা। এই এলাকাগুলোকে বলা হতো লিগ অফ ন্যাশনস ম্যান্ডেট। একেকটি ম্যান্ডেট একেক জয়ী দেশের অধীনে চলে গেল। তাদের দায়িত্ব- লিগ অফ ন্যাশনসের হয়ে এ জায়গাগুলোর দেখাশোনা করা, সেখানকার লোকদের অধিকার সংরক্ষণ করা। এই ম্যান্ডেটতন্ত্র তৈরি করা হয় লিগ অফ ন্যাশনস চুক্তিপত্রের আর্টিকেল ২২ অনুযায়ী। লিগ অফ ন্যাশনসের পর এগুলো জাতিসংঘের অধীনে চলে গিয়েছিল।

তিনটি শ্রেণী বা ক্লাসে ভাগ করা হয় ম্যান্ডেটগুলোকে। মোট ১৬টি ম্যান্ডেট। পশ্চিম এশিয়া কভার করা ক্লাস-এ’তে ৫টি, আফ্রিকা কভার করা ক্লাস-বি’তে ৭টি এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল কভার করা ক্লাস সিতে আছে ৪টি ম্যান্ডেট। আমাদের আলোচ্য বিষয় ক্লাস-এ, অর্থাৎ পশ্চিম এশিয়া। এতে আছে সিরিয়া, ট্রান্সজর্ডান, মেসোপটেমিয়া, লেবানন আর ফিলিস্তিন।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, ফিলিস্তিন কার অধিকারে যাবে?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছিল, তখন মুসলিম-প্রধান ফিলিস্তিন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে, খুব কম সংখক ইহুদীই সেখানে বসবাস করত। তখন থেকেই ব্রিটিশ ওয়ার কেবিনেট চিন্তা করা শুরু করে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তৈরি করা হয় ‘ব্যালফোর ঘোষণা’, যাকে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।

এই ঘোষণাটি মূলত একটি চিঠি, তাতে তারিখ দেয়া- ২ নভেম্বর, ১৯১৭। চিঠিটি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার ব্যালফোর সেখানকার ইহুদী সমাজের নেতা লর্ড রথসচাইল্ডকে পাঠান। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের জায়োনিস্ট সংঘে প্রচার করা। জায়োনিস্ট বলতে বোঝায়, ইহুদীদের নিজস্ব এলাকা প্রতিষ্ঠা এবং সারা দুনিয়ায় ইহুদীদের প্রতিরক্ষার আন্দোলন।

ব্যালফোর ঘোষণায় বলা হয়, ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য জাতীয় আবাসভূমি তৈরি করতে সায় দিচ্ছে, এবং এর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তবে এতে করে যেন সেখানকার অ-ইহুদী সম্প্রদায়ের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অন্যান্য দেশে বসবাসরত ইহুদীদের অধিকারও যেন অক্ষুণ্ণ থাকে, সেটিও খেয়াল করতে হবে।

ব্যালফোর ঘোষণায় ইহুদী আবাসভূমি বললেও সেটি আলাদা রাষ্ট্র হবে কি না, সেটা বলা নেই। ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছে করেই সেটি চেপে যায়। তারা আলাদা করে নিশ্চিত করে যে, ফিলিস্তিনকে ইহুদী আবাসভূমি বললেও তারা কখনও চায়নি, পুরো ফিলিস্তিন জুড়েই ইহুদী আবাস হোক।

আজকে যা সৌদি আরব, তখন তা হেজাজ নামের পরিচিত ছিল। সেখানকার ক্ষমতা ছিল হাশেমি পরিবারের অধীনে। হাশেমিদের নেতা শরিফ হুসাইন বিন আলী ১৯১৫-১৯১৬ সালে দশটি চিঠি আদানপ্রদান করেন মিসরের ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সাথে। ১৯১৫ সালের ২৪ অক্টোবর যে চিঠি পাঠানো হয়, তাতে স্পষ্ট করে লেখা- যদি বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে মক্কার নেতা শরিফ একটি বিদ্রোহ শুরু করতে পারে, তাহলে যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সরকার আরবদের স্বাধীনতা দেবে। মিত্রশক্তির বিরোধী পক্ষ ছিল অটোমানরা। যুদ্ধে জিততে হলে তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা ব্রিটিশ সরকারের জন্য খুব জরুরি ছিল। কারণ, তাদের শাসিত খোদ ভারতবর্ষেই ৭ কোটি মুসলিম তখন, তারা নৈতিকভাবে সমর্থন দেয় অটোমান খেলাফতকে; এরকম অনেকেই যোগ দিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, এদেরকে বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু তারা যদি দেখে যে মক্কা নিজেই অটোমানদেরকে সমর্থন দেয় না, বরং মিত্রশক্তিকে দেয়, তাহলে এই বিশাল জনসংখ্যাকে নিজেদের পক্ষে পাবে ব্রিটিশ সরকার।

মক্কার নেতা শরিফ হুসাইন নির্দিষ্ট করে দিলেন যে তিনি কোন কোন আরব এলাকার স্বাধীনতা চান। তবে তিনি ফিলিস্তিনের কথা বলেছিলেন কি বলেননি, সেটা আজও বিতর্কের বিষয়। অন্যদিকে একই সময়ে সোভিয়েত আর ইতালির সায় নিয়ে যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স নিজেদের মাঝে একটি গোপন চুক্তি সেরে নেয়। এই চুক্তিতে ব্রিটেনের অধীনে চলে যায় আজকের ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, ইরাকের দক্ষিণাংশ ইত্যাদি। এ তো গেল গোপনে হওয়া চুক্তি, কিছু সময় পরে সেটি জনসম্মুখেও চলে এলো। এবার আনুষ্ঠানিকতার পালা।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে এ নিয়ে আলোচনা হলো। ১৯২০ সালে লন্ডনের সম্মেলনেও সে আলোচনা চলতে থাকে। অবশেষে সে বছরের এপ্রিলে ইতালির উপকূলীয় শহর স্যানরেমোতে হওয়া সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়া হয়। মিত্রশক্তির সুপ্রিম কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ফিলিস্তিন আর মেসোপটেমিয়ার ম্যান্ডেট গেল ব্রিটেনের কাছে, আর সিরিয়া ও লেবানন গেল ফ্রান্সের কাছে।

আরও বলা হলো, হেজাজের রাজা শরিফ হুসাইনের তিন ছেলে বা আমিরগণ বিভিন্ন বিজিত মুসলিম অঞ্চলের রাজা হবেন। ব্রিটিশদের আমন্ত্রণে প্যারিস সম্মেলনে আরবদের পক্ষ থেকে যোগ দেন হাশেমিদের প্রতিনিধি আমির ফয়সাল। বিশ্ব জায়োনিস্ট সংঘের পক্ষ থেকে যে দল এসেছিল, তাদের নেতা ছিলেন রুশ বায়োকেমিস্ট হাইম আজরিয়েল ওয়াইজম্যান, যিনি পরে গিয়ে ইসরাইলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন।

এর আগেই অবশ্য ইহুদী জায়োনিস্টরা ফয়সালের সাথে দেখা করেছিল, প্রায় দুসপ্তাহ আগে। তখন তারা ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ইহুদী পরিকল্পনা নিয়ে ফয়সালের সায় নেয়। কিন্তু সম্মেলনে তারা ফয়সালের হাতে লেখা সে শর্ত উপস্থাপন না করে চেপে যায়, যেখানে আমির ফয়সাল লিখেছিলেন, তিনি এ শর্তে সায় দিচ্ছেন যে, ফিলিস্তিনকেও স্বাধীনতা দিতে হবে অন্যান্য আরব দেশের মতো। এই চেপে যাওয়ার মধ্য দিয়েই ১৯১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ফয়সালের সাথে ওয়াইজম্যানের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়।

ফিলিস্তিন এখন পরিচিত হবে ব্রিটিশদের ম্যান্ডেট হিসেবে – ফিলিস্তিন ম্যান্ডেট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *