অধ্যায়-১ – ভূমিকা

অধ্যায়-১ – ভূমিকা

মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কী হতে পারে? এই প্রশ্ন চিরকালই দূরকল্পী মানুষদের মনে সৃষ্টি হয়ে আসছে। প্রশ্নটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে আরও একটি প্রশ্নের—মানবজাতি ও পৃথিবীর চূড়ান্ত পরিণতি কী? কারও এমনতর প্রশ্নের আপাত যুক্তিসংগত উত্তর দেওয়ার জন্য বিজ্ঞান ও সৃষ্টিতত্ত্বে যে পরিমাণ অগ্রগতি অর্জনের প্রয়োজন তা অর্জিত হয়েছে কেবল গত দুই-তিন দশকে। জ্ঞানের বর্তমান অবস্থার নিরিখে বইটিতে আমি একটি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।

মহাবিশ্বের সুদূর ভবিষ্যতের সম্ভাবনাসমূহ উপলব্ধি করতে প্রথমেই মহাবিশ্বের বর্তমান গঠন এবং মহাবিশ্বের এরূপ বর্তমান অবস্থার কীভাবে সৃষ্টি হল তা জানা আবশ্যক। তৃতীয় অধ্যায়ে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হবে। ভূমিকায় পাঠককে সংক্ষেপে বইটির বিষয়বস্তুর একটি সামগ্রিক ধারণা দেব। আর এসব বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হবে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে।

মহাবিশ্বের বৃহৎ পরিসরের গঠনকে বিবেচনা করলে গ্যালাক্সিগুলোকে এর মৌলিক উপাদান হিসেবে ধরে নিতে হয়। গ্যালাক্সিদেরকে মনে হয় শূন্যতার সাগরে অসংখ্য নক্ষত্র দিয়ে গঠিত কতগুলো দ্বীপপুঞ্জ। একটি সাধারণ গ্যালাক্সি প্রায় শত বিলিয়ন (১০^১১) নক্ষত্রের সমাবেশ। আমাদের সূর্য এমনই একটি নক্ষত্র। এই নক্ষত্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে মহাকর্ষীয় বলে আবদ্ধ। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রসহ আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করি তাকে মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ বা সাধারণত গ্যালাক্সি বলা হয়। সূর্য এবং তার গ্রহদের নিয়ে গঠিত যে অবস্থায় আমরা বাস করি তাকে বলা হয় সৌরজগৎ

বলা যেতে পারে যে, পর্যবেক্ষণযোগ্য সকল গ্যালাক্সি এবং সংগতকারণেই এদের সম্পর্কযুক্ত সকল বস্তুর সামষ্টিক রূপই হল মহাবিশ্ব। জোরালো ইঙ্গিত রয়েছে যে, যে কোনও প্রদত্ত সময়ে গড়পড়তায় মহাবিশ্বের সর্বত্র গ্যালাক্সিগুলো সমানভাবে ছড়িয়ে আছে।

ফরন্যাক্স

চিত্র-১. ১ : ফরন্যাক্স (যজ্ঞকুণ্ড মণ্ডল) নক্ষত্রমণ্ডলে একটি সমৃদ্ধ স্তবক একটি গঠনগত বৈচিত্র্য প্রদর্শন করছে। কতগুলো গ্যালাক্সি পারস্পরিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণে আবদ্ধ হয়ে গঠন করে একটি স্তবক বা ক্লাস্টার। ১০^২৭ বছরে এরকম বিশাল একটি স্তবক সংকুচিত হয়ে একটি একক ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। আর তখন এই স্তবকের আকৃতি হবে সবচেয়ে ছোটো গ্যালাক্সির চাইতেও ছোটো।

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত যে সকল গ্যালাক্সি পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সুতরাং, মহাবিশ্ব স্থির নয় বরং এটি গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। গ্যালাক্সিদের এই সরণ মহাবিশ্বের প্রসারণকেই নির্দেশ করে। গ্যালাক্সিগুলো যে হারে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তা থেকে বোঝা যায় যে, ১০ থেকে ২০ লক্ষ বিলিয়ন বছর পূর্বে সকল গ্যালাক্সি একত্রে গাঁটবন্দি অবস্থায় ছিল। সাধারণত বিশ্বাস করা হয় ওই সময় একটি সর্বজনীন মহাবিস্ফোরণ হয়েছিল। ওই বিস্ফোরণ থেকে সকল পদার্থ প্রচণ্ড বেগে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে বস্তুগুলো আলাদা আলাদাভাবে ঘনীভূত হয়ে বর্তমান গ্যালাক্সিদের রূপ লাভ করেছে। এই প্ৰাথমিক মহাবিস্ফোরণটিই হচ্ছে তথাকথিত ‘বিগ ব্যাং’।

সৃষ্টিতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে—মহাবিশ্বের প্রসারণ কী চিরকাল চলতেই থাকবে, না কি ভবিষ্যতে কিছুকাল পর এই প্রসারণ থেমে গিয়ে সংকোচন শুরু হবে? এখনও পর্যন্ত এই প্রশ্নের স্পষ্ট কোনও উত্তর নেই। যে মহাবিশ্ব চিরকালই প্রসারিত সে মহাবিশ্বকে মুক্ত মহাবিশ্ব বলা হয়। অন্যদিকে মহাবিশ্বের প্রসারণ থেমে গিয়ে সংকোচন শুরু হলে এই মহাবিশ্বকে বলা হয় বদ্ধ মহাবিশ্ব। সুতরাং, সৃষ্টিতত্ত্বের প্রধান একটি সনির্বন্ধ প্রশ্ন হল আমরা কি মুক্ত মহাবিশ্বে বাস করছি না কি বদ্ধ মহাবিশ্বে? এই প্রশ্নোত্তরের ওপরই নির্ভর করে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি। অনেক ইঙ্গিত রয়েছে যে, মহাবিশ্ব মুক্ত। কিন্তু এ বিষয়টি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত নয়।

যদি মহাবিশ্ব মুক্তই হয় তবে এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে? যেহেতু গ্যালাক্সিগুলোই মহাবিশ্বের মূল উপাদান, তাই এ প্রশ্নটির অনুসন্ধান করতে পারি এই বলে—দূর ভবিষ্যতে একটি সাধারণ গ্যালাক্সির চূড়ান্ত পরিণতি কী? এবার একটি সাধারণ গ্যালাক্সির বিবেচনা করা যাক। এটি মূলত অনেক নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত। আর সব নক্ষত্রই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয় এবং অবশেষে মৃত্যুবরণ করে। কমপক্ষে দশ বিলিয়ন বছরে নক্ষত্রগুলো একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এই চূড়ান্ত পর্যায়ে এদের মৃত বলে ধরে নিতে হয় এবং এই পর্যায়ে এদের অতি ক্ষুদ্র পরিবর্তন ঘটে। নক্ষত্রগুলো তিনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় – শ্বেতবামন, নিউট্রন নক্ষত্র এবং ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে এই চূড়ান্ত পর্যায়গুলোকে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। আপাতত এটি লক্ষ করব যে, এই পর্যায়গুলোতে নক্ষত্রদের বস্তুগুলো খুবই ঘনীভূত অবস্থায় থাকে। এদের মধ্যে সর্বাধিক ঘনীভূত হচ্ছে ব্ল্যাকহোল। কোনও পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হলে দেখা যাবে যে, গ্যালাক্সির সব নক্ষত্র মারা যেতে প্রায় একশত বিলিয়ন থেকে এক হাজার বিলিয়ন বছরের প্রয়োজন। সুতরাং, এক হাজার বিলিয়ন বছরে বা তারও বেশি বছরে একটি গ্যালাক্সি মৃত নক্ষত্র, শীতল গ্রহ-উপগ্রহ ও অন্যান্য নাক্ষত্রিক বস্তু দ্বারা পরিপূর্ণ হবে। এসব গ্রহ-উপগ্রহ এবং অন্যান্য বস্তুর মধ্যে তখনও পারস্পরিক মধ্যাকর্ষণ বজায় থাকবে। গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। ফলে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যকার দূরত্ব বর্তমান দূরত্বের চেয়ে আরও বেশি হয়ে যাবে।

আরও দীর্ঘতম সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর গ্যালাক্সিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে। মৃত নক্ষত্র সে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। আর এ সংঘর্ষের ফলে বিপুল পরিমাণ নক্ষত্র গ্যালাক্সি হতে ছিটকে বেরিয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৯৯% শতাংশ নক্ষত্র গ্যালাক্সিটি থেকে বেরিয়ে যাবে। অবশিষ্ট ১ শতাংশ মৃত নক্ষত্র ক্রমান্বয়ে পিণ্ডিভূত হয়ে একটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এই ব্ল্যাকহোলটির ভর হবে প্রায় এক বিলিয়ন সূর্য ভরের সমান। আমরা একে গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল বা দানবীয় ব্ল্যাকহোল বলতে পারি। এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্রমপরিবর্তনকে আমরা গ্যালাক্সির গতিশীল বিবর্তনের পর্যায় বলে উল্লেখ করবো।

এখানে মৃত নক্ষত্রদের তিনটি চূড়ান্ত পর্যায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই পর্যায়গুলোতে এইসব মৃত নক্ষত্রের মাঝে অতি ক্ষুদ্র পরিবর্তন ঘটতেও ১০ বিলিয়ন বছর বা এরকম সময়ের প্রয়োজন। যখন সময়ের পরিসর কয়েক বিলিয়ন বছরেরও অধিক বেশি হয় তখন চূড়ান্ত পর্যায়গুলোতে পরিবর্তন ঘটে। মূলত সূর্য ভরের সমান একটি ব্ল্যাকহোল ধীরে ধীরে বিকিরণ করতে করতে তার ভর হারাতে থাকে। বিকিরণ করতে করতে সূর্য ভরের সমান একটি ব্ল্যাকহোল ১০^৬৫ বছরে অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই সময়টি অত্যন্ত বেশি যা আস্ত একটা গ্যালাক্সি একটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে যে সময় লাগে তার চেয়েও বেশি। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে পারেন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে সৃষ্ট একটি গ্যালাটিক (বৃহৎ) ব্ল্যাকহোল চিরকালই বেঁচে থাকবে? এই গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলের চূড়ান্ত পরিণতি কী? মূলত এই গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলটিও ১০^৯০ বছরে পুরোপুরিভাবে অদৃশ্য হয়ে যাবে। একটি সুপার গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল যা অনেক গ্যালাক্সির একটি বিরাট জোটের পতন অবস্থার ফল। এই সুপার গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলটি ১০^১০০ বছরে বাষ্পীভূত হয়ে পুরোপুরিভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এভাবে ১০^১০০

বছরে বা তারও কিছু বেশি বছরে সব ব্ল্যাকহোল অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং গ্যালাক্সিরাও পুরোপুরিভাবে বিলীন হয়ে যাবে। তখন মহাবিশ্বে পড়ে রইবে শান্ত নিউট্রন নক্ষত্রেরা এবং শ্বেতবাসনেরা। আর থাকবে মহাজাগতিক মাপকাঠিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুগুলো যেগুলো গ্যালাক্সিদের গতিশীল পরিবর্তনের সময় সংঘর্ষের দরুন গ্যালাক্সি থেকে বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এইসব মৃত নক্ষত্র আর বস্তুগুলো মহাবিশ্বের বিবর্ধনশীল বিশাল শূন্যতায় একা একা ঘুরে বেড়াবে।

দীর্ঘ কালক্ষেপণ শেষে অর্থাৎ ১০^১০০ বছরের মত অতি দীর্ঘ সময় পর এই অবশিষ্ট বস্তুগুলোর ধীর পরিবর্তন ঘটবে। এবার আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হয়—শূন্যতায় পড়ে থাকা এসব বস্তুর শেষ পরিণতি কী হতে পারে? বস্তুগুলোর দীর্ঘ স্থায়িত্বের ব্যাপারে এখানে আমরা আরেকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। কিছু সম্ভাবনা দশম ও চতুর্দশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নীতি অনুসারে একটি সম্ভাবনা হচ্ছে যে, শেতবাম এবং নিউট্রন নক্ষত্রগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে এবং ক্রমান্বয়ে এরা এখানেই বিলীন হয়ে যাবে। এই মৃত নক্ষত্রগুলো ১০^১০^৭৬ বছরে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এবার আমরা যদি ‘বিলিয়ন’ সংখ্যাটিকে এক বিলিয়ন বার লেখি তাতে যে সংখ্যা দাঁড়াবে তা ১০^১০^৭৬ সংখ্যাটির তুলনায় নগণ্য। সুতরাং, ১০^১০^৭৬ সংখ্যাটি অনেক বড়ো একটি সংখ্যা।

সুদীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি মুক্ত মহাবিশ্বে জীবন ও সভ্যতার নিয়তি কী? অতি দূর ভবিষ্যতে গ্রহের জীবন্ত প্রাণীরা কী প্রকারে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখবে? এসব বিষয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু, জীবন ও সভ্যতার টিকে থাকা নির্ভর করে শক্তির উৎসের উপযোগিতার ওপর। তত্ত্ব বলে যে, আগামী ১০^১০০ বছর বা তার কাছাকাছি সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তির উৎস মজুদ থাকবে। একাদশ অধ্যায়ে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হবে। এই সময় শেষে কি সভ্যতাকে টিকে থাকার সমস্যাগুলো অনিশ্চিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে? এটি একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন। তারপরও কিছু সম্ভাবনা রয়েছে যেগুলো একাদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হবে।

উপরে যে মহাজাগতিক চিত্রটি তুলে ধরেছি তা মুক্ত মহাবিশ্বের বেলায় প্রযোজ্য। এবার কী হবে যদি মহাবিশ্ব আবদ্ধ হয়? এরকম একটি বদ্ধ মহাবিশ্বের বিবেচনা করা যাক। ধরে নেওয়া যাক এর চূড়ান্ত প্রসারণের পর আন্তঃছায়াপথীয় দূরত্ব দাঁড়ায় বর্তমান দূরত্বের দ্বিগুণ। প্রায় ৪০ বিলিয়ন থেকে ৫০ বিলিয়ন বছরে মহাবিশ্ব এই চরম অবস্থায় পৌঁছবে। এই অবস্থায় পৌঁছার পর মহাবিশ্বের প্রসারণ থেমে যাবে এবং শুরু হবে উলটো প্রক্রিয়া। উলটো প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ঠিক যেরকম সিনেমাকে ব্ল্যাকওয়ার্ডের মাধ্যমে শেষ থেকে শুরুতে আনা হয়। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সংকোচন শুরু হবে। প্রায় ৯০ থেকে ১০০ বিলিয়ন বছর পর মহাবিশ্বের ঘনত্ব বেড়ে যাবে এবং প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে পড়বে। তারপরই ‘মহাসংকোচন’ সংঘটিত হবে। অগ্নিবৎ উত্তাপে সকল বস্তু একত্রে মিলিত হবে। এই পরিস্থিতিতে কোনও প্রকার প্রাণীর টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এবার প্রশ্ন আসে এই মহাসংকোচনের পর কী ঘটবে? তখনও প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে কি-না? এসব বিষয় আমাদের অজানা।

বলে রাখা উচিত যে, আমি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে এই বইটিতে এই চিত্রটি উপস্থাপন করেছি। এমনকি এই অনুবিধিটি আরও যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। আসলে মহাবিশ্বের একটি আদর্শ মডেল হচ্ছে এই বইয়ের ভিত্তি। তৃতীয় অধ্যায়ে একটি আদর্শ মডেল নিয়ে আলোচনা করা হবে। আমি মনে করি এটা বলা উচিত হবে যে, সৃষ্টিতত্ত্ববিদদের অনেকেই (সংখ্যাগরিষ্ঠ) বিশ্বাস করেন প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে মহাবিশ্বের আদর্শ মডেলই সঠিক। কিন্তু তাঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু দল নন-স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ধারণাকে মেনে চলেন। আমরা এই বইটিতে ‘স্থির বা অবিচল অবস্থার তত্ত্ব’কেই কেবল বিবেচনা করব। এছাড়া অন্য কোনও নন-স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে বিবেচনা করব না। এই ‘অবিচল অবস্থার তত্ত্ব’ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হবে। এছাড়া পাঠক লক্ষ করবেন যে, বইটিতে ব্ল্যাকহোলকে উল্লেখযোগ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব রয়েছে এমন বিশ্বাসের জন্য শক্তিশালী তাত্ত্বিক এবং পরোক্ষ পর্যবেক্ষণমূলক কারণ থাকলেও ব্ল্যাকহোল প্রত্যক্ষভাবে আবিষ্কৃত হয়নি। খ্যাতিমান কয়েকজন বিজ্ঞানী ব্ল্যাকহোলে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু মহাকর্ষীয় তত্ত্বে বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই বলেন, কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল অবশ্যই অস্তিত্বমান। এই বইটিতে আমরা মেনে নেব যে, মহাবিশ্বে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব রয়েছে।

পদার্থবিজ্ঞানীগণ প্রোটন সম্পর্কিত যে ধারণা দিয়েছেন সে অনুযায়ী মুক্ত মহাবিশ্বের ধারণাতে কিছু পরিবর্তন আসবে। বিজ্ঞানীগণ দেখিয়েছেন যে, প্রোটন অস্থায়ী তবে এদের আয়ুষ্কাল অতি দীর্ঘ। প্রোটন সকল পদার্থের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, বিজ্ঞানীগণ অনুমান করেন যে, শেষপর্যন্ত সকল প্রোটন ভেঙে নিষ্পিষ্ট হয়ে যাবে। আর এই অনুমানের ফলাফলের ওপরই নির্ভর করছে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি। চতুর্দশ অধ্যায়ে প্রোটনের স্থায়িত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি বা ভাগ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নটির উত্তর আরও একটি প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে মিলে যায়—মানুষ কেন সমস্যাকে উপেক্ষা করে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করে? মানব মনের প্রকৃতিই হচ্ছে চিরকাল অনুসন্ধান করে যাওয়া আর জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা। মহাবিশ্বের ও মানবসভ্যতার চূড়ান্ত পরিণতির বিষয়টি একটি কৌতূহলোদ্দীপক সমস্যা। কেননা আমরা বইটির ধারাবাহিকতায় লক্ষ করব যে, এই বিষয়টির সমাধান খুঁজতে গিয়ে পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিদ্যা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কিছু মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসবে। মহাবিশ্ব ও সভ্যতার পরিণতি সম্পর্কে জানার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে বিজ্ঞানের এই শাখাগুলোতে তাৎপর্যময় অগ্রগতি সাধিত হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *