অধ্যায়-১ : পূর্বকথন

অধ্যায় ১ : পূর্বকথন

আজকের ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের উত্থানের গল্প পুরোপুরি বুঝতে হলে জানতে হবে প্রাচীন “ইহুদী জাতির ইতিহাস”, যে ধর্মীয় ইতিহাসের সূচনা ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম আর ইহুদী ধর্মের আদি পিতা ইব্রাহিম (আ)-এর হাত ধরে। বিস্তারিত জানা থাকলে বুঝতে বেশি সুবিধা হবে, তবে অতি সংক্ষেপে যীশু খ্রিস্টের জন্ম পর্যন্ত ইহুদী জাতির খ্রিস্টপূর্ব ইতিহাসটুকু বলে নেয়া যাক। কারণ আমাদের এ বইতে থাকছে খ্রিস্টীয় শতকের সূচনা থেকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ইতিকথা, যার নেপথ্যে এই ইহুদী জাতি।

হিব্রু বাইবেল এবং ইসলামি ধর্মীয় ইতিহাস মোতাবেক, ঈশ্বর ‘ইয়াহওয়েহ’ (হিব্রুতে স্রষ্টাকে এ নামেই ডাকা হয়, আর আরবিতে ‘আল্লাহ’) নবী হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে প্রতিশ্রুতি দেন, পবিত্র ভূমি কেনান তার বংশধরকে দেয়া হবে। এটিই এখন ইসরাইল-ফিলিস্তিন অঞ্চল। অর্থাৎ তার উত্তরসূরিরা এ এলাকার মালিক হবে।

ঈশ্বরের নাম হিসেবে ‘ইয়াহওয়েহ (717)-কে এতটাই পবিত্রজ্ঞান করত ইহুদীরা, যে তারা উচ্চারণই করত না। বরং কোথাও নামটা লেখা থাকলে তারা সেটাকে পাঠ করত ‘আদোনাই’ (78) বলে, যার মানে ‘প্রভু আমার’। আর যদি সত্যি সত্যি পাশের শব্দটাই ‘আদোনাই’ হয়ে থাকে, তাহলে তারা ‘ইয়াহওয়েহ’ (YHWH)-কে ডাকত ‘এলোহিম’ (pix) বলে। অতিধার্মিক ইহুদীরা আজও এ রীতি মেনে চলে। প্রায় তিন সহস্র বছর আগের মোয়াবদেশীয় ফলকে আমরা ইয়াহওয়েহ নামখানা দেখতে পাই-

ইব্রাহিম (আ)-এর প্রধান দুই পুত্র ইসমাইল (আ) আর ইসহাক (আ)। ভাগ্যক্রমে, ইসমাইল (আ) ও তার মা হাজেরাকে আরবের মক্কায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। আর ওদিকে কেনান দেশে রয়ে যান ইসহাক (আ), যাকে ইংরেজিতে ডাকা হয় ‘আইজ্যাক’। তার পুত্র ছিলেন ইয়াকুব (আ), অর্থাৎ ‘জ্যাকব’। ইয়াকুব (আ)-এর আরেক নাম ছিল ‘ইসরাইল’, তার বারো সন্তানের নামে ইসরাইলের বারো গোত্রের নাম হয়।

ঘটনাক্রমে বারো পুত্রের একজন ইউসুফ (আ) ভাইদের চক্রান্তে মিসরে উপনীত হন দাস হিসেবে। জেলের ভাত খেয়ে সাত বছর পর ভাগ্যের চাকা ঘুরে নিজেকে মিসরকর্তার ডান হাত হিসেবে আবিষ্কার করেন তিনি, এবং একইসাথে হন নবী। দুর্ভিক্ষপীড়িত অন্য ভাইয়েরা তখন তার কাছে সাহায্য চাইতে মিসরে আসে। তারা তখনও জানতো না, ইনিই তাদের মৃত বলে ধরে নেয়া সেই ভাই ইউসুফ (আ), বা ‘জোসেফ’। ইউসুফ (আ) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং পুরো পরিবারকে নিয়ে আসেন মিসরে।

কালের পরিক্রমায় শত শত বছর বাদে এই ইসরাইলিরা মিসরের শাসনকর্তা অর্থাৎ ফারাওয়ের দাসে পরিণত হয়। তাদেরকে ‘হিব্রু’ জাতি বলে ডাকতো স্থানীয় মিসরীয়রা। একদিন ফারাওয়ের ঘরে পালিত হওয়া এক মিসরীয় যুবরাজ রাজপরিবারের সমস্ত আয়েশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বহু বছর বাদে নির্যাতিত ইহুদীদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি আর কেউ নন, নবী হযরত মূসা (আ)। ইসরাইল জাতিকে লোহিত সাগর পার করে তিনি নিয়ে যান ওপারে, ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করে।

নবী মূসা (আ) পেলেন আসমানি কিতাব তাওরাত। কিন্তু তখন একেশ্বরবাদী ইহুদীরা পৌত্তলিকতায় মগ্ন হয়ে পড়ে। ফলে আল্লাহ ৪০ বছর শাস্তি দেন তাদেরকে। মরুর বুকে ঘুরপাক খেতে থাকে তারা। অবশেষে নবী ইউশা (আ)- এর নেতৃত্বে তারা কেনান দেশে উপনীত হয়। এবার তাদের কেনান জয়ের পালা।

এখানে এসে আমরা বুঝতে পারি, কেনান দেশের আদি নাগরিক কারা ছিল। আমরা যাদেরকে আজ ফিলিস্তিনি বলি, বলা চলে তারাই। ফিলিস্তিনিরা এখানে আসে ইসরাইলিরা আসার কিছুটা আগে, খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতকে। ফিলিস্তিনিরা মূলত ইজিয়ান (Aegean) অরিজিনের, অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরের যে অংশ গ্রিস ও তুরস্কের মাঝে, সে এলাকার। তারা এসেছিল কাফতর থেকে। তার আগে এখানে ছিল হিভাইট, জেবুসাইট, এমরাইট, হিট্টাইট, পেরিসাইট-এরা। ফিলিস্তিনিরা পৌত্তলিক ছিল; তারা বা’ল, আশেরা ইত্যাদি দেব-দেবীর পূজা করত।

ইসরাইলিরা যখন কেনান দেশে থাকত, তখন তারা স্থানীয়দের বিয়ে করে। ফলে পরবর্তী বংশধর এমনভাবে বাড়তে থাকে যে, ৮৭.৫%-ই হলো কেনানীয় রক্ত। আর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের কেনানীদের বংশধর বলেই জানে। তাই জিনগতভাবে তারা আসলে প্রায় একই। কেবল ধর্মবিশ্বাসে ছিল আলাদা। ইসরাইলিরা যেখানে উপাসনা করত এক ঈশ্বরের, সেখানে ফিলিস্তিনিরা ছিল পৌত্তলিক।

ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রথম রাজা হন তালুত, যাকে বাইবেলে বলে সল (Saul)। বেথেলহেমের জেসি বা ইয়াসি-র ছোট ছেলে দাউদ (আ) [ইংরেজিতে তাকে বলা হয় ডেভিড] তালুতের সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে ফিলিস্তিনের জালুত বা গোলায়াথকে পরাজিত করেন একক যুদ্ধে এবং তখনই সবার নজরে আসেন। কালক্রমে তিনি ইসরাইলের জনপ্রিয় রাজা কিং ডেভিডে পরিণত হন। ইহুদী ধর্মে তেমন কিছু বলা না হলেও, ইসলাম মতে, তিনি নবীও। তার পুত্র সলোমন বা সুলাইমান (আ) তার রাজ্যকে আরো প্রসারিত করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’, যা আমরা ‘টেম্পল অফ সলোমন’ নামেও চিনি ইতিহাসে।

সুলাইমান (আ) বা সলোমন মারা যাবার পর পুত্র রেহোবামের রাজত্বকালে ইসরাইলের পতন শুরু হয়, পৌত্তলিকতায় ডুবে যেতে থাকে। শক্তিমান ব্যাবিলন রাজ্যের আক্রমণে ইসরাইলিরা বন্দী হয়ে পড়ে। তাদের নির্বাসন শুরু হয়, আর ওদিকে ইসরাইল রাজ্য ধুলোয় মিশে যায়।

কিন্তু আল্লাহর চোখে শাস্তি শেষ হলে, পারস্যের রাজা সাইরাস তাদের ব্যাবিলন থেকে মুক্ত করে দেন। এ সময় নবী দানিয়েল (আ)-এর কীর্তি উল্লেখযোগ্য। ফিরে এসে তারা পুনরায় বানায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’। আগেরটির স্থানেই নতুন করে গড়া এ উপাসনালয় সলোমনের দ্বিতীয় উপাসনালয় বা ‘সেকেন্ড টেম্পল অফ সলোমন’ নামে পরিচিত। আর নবী কিংবা সাধু ব্যক্তি হযরত উজাইর (আ) [যাকে ইহুদীরা ‘এজরা’ ডাকে] ও নেহেমিয়া (আ)-এর নেতৃত্বে ইসরাইল আবার উন্নতির দিকে ফিরতে থাকে। তাছাড়া সাহায্য করেন নবী হিজকিল (আ) [যাকে ইহুদীরা ডাকে ‘এজেকিয়েল’]।

সুলাইমানপুত্র রেহোবামের সময় রাজ্য দুভাগ হবার কথা বলছিলাম। উত্তরের রাজ্য ইসরাইল, আর দক্ষিণের রাজ্য জুদাহ (এহুদিয়া)। এটি মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৯ম-১০ম শতকের কথা। আর মাঝখানে এত কাহিনী হয়ে রাজা সাইরাসের হাতে তাদের উদ্ধার পাবার সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সাল।

যখন খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মারা গেলেন, তখন তার জেনারেলরা কামড়াকামড়ি শুরু করে দেন রীতিমতো। যেমন, টলেমি নিয়ে নিলেন পুরো ইহুদী অঞ্চলের দখল। যদিও পরে সিরিয়ার সেলুসিদদের কাছে খ্রিস্টপূর্ব ১৯৮ সালে টলেমি হারিয়ে ফেলেন এ অঞ্চল। ওদিকে গ্রিক সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ইহুদী ধর্ম প্রভাবিত হয়ে নতুন এক সেক্ট গড়ে ওঠে, যারা পরিচিত হয় হেলেনিস্টিক জ্যু (ইহুদী) নামে। তাদের মাঝে ছিল গ্রিক সংস্কৃতির ছোঁয়া। মূল ধারার ইহুদীরা তাদের ধর্মচ্যুত মনে করত।

খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান জেনারেল পম্পে জেরুজালেম দখল করে নেন। যীশুর জন্মের ৪৭ বছর আগে আলেক্সান্দ্রিয়ার যুদ্ধে ৩,০০০ ইহুদী সেনা পাঠানো হয়, যারা জুলিয়াস সিজার আর ক্লিওপেট্রাকে রক্ষা করে।

রোমান সংসদ হেরোদ নামের একজনকে ইহুদীদের রাজা হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরকম সময়ে এই ইহুদী অঞ্চল যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে, তখন জন্মগ্রহণ করেন যীশু খ্রিস্ট বা ঈসা (আ)। খ্রিস্ট আর ইসলাম ধর্মমতে, তিনি ছিলেন ‘মসীহ’ (অভিষিক্ত ত্রাতা) বা মেসায়াহ, যিনি কি না এই হতভাগ্য ইহুদী রাষ্ট্রকে উদ্ধার করবেন, নতুন আলোর পথ দেখাবেন। কিন্তু যখন যীশু ইহুদী ইমাম অর্থাৎ র‍্যাবাইদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে লাগলেন, তখন ইহুদী নেতারা চক্রান্ত শুরু করল যেন রোমান কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে শুনিয়ে যীশুকে সরিয়ে ফেলা যায়।

আমাদের এ বইয়ের বিষয়াদির সূচনা এই সময়কাল থেকেই। একে আমরা ডাকব ‘সেকেন্ড টেম্পলের যুগ’ বলে, কারণ তখনও টিকে আছে দ্বিতীয় বাইতুল মুকাদ্দাস।

পুনশ্চঃ কেউ এ পর্যন্ত সংক্ষেপে বলা ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ পড়তে চাইলে “ইহুদী জাতির ইতিহাস” বইটি পড়তে অনুরোধ করব। এতে করে পরের ঘটনাগুলো বুঝতে যেমন সহজ হবে, তেমনই আগের ঘটনাগুলোও পুরোপুরি জানা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *