অধ্যায় ১ – আলীবর্দীর শুরুর জীবন
আকবরেরও প্রায় দেড়শো বছর আগে ভারতীয় মুসলিম রা গড়ে উঠেছিল এর আগের কয়েক শতকের অভিবাসন, বসতি স্থাপন, রাজ্য জয় আর ধর্মান্তরের ভেতর দিয়ে। মুঘলদের সঙ্গে তরতাজা অতি-ভারতীয় তুর্কি উপাদান এখানে এলেও তার আগ্রহের জায়গা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বিচক্ষণ ছিল—রাজপুতদের সঙ্গে আর প্রথমদিকে অন্য বাইরের ভাগ্যান্বেষীদের এর বাইরে রেখে দেওয়ার প্রবণতা ছিল। আর যাদের এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি (যেমন উজবেক), একীভূত করা হয়েছিল মুঘল-রাজপুত অভিজাতদের কাতারে। কিন্তু, আওরঙ্গজিবের শাসনামলে ১৬১১ সাল থেকে নীতির পরিবর্তন হতে থাকে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজপুতদের স্থলাভিষিক্ত হতে থাকে কপাল ফেরাতে আসা ইরানি আর মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার অধিবাসীরা। বিভিন্ন কারণে কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হতে থাকলে, রাজকীয় বা জাতীয় কর্মকাণ্ডে এই নতুন উপাদানকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। আর এই বাইরের থেকে আগত মুসলিম ভাগ্যান্বেষীদের বাড়ন্ত স্বাধীনতা আর অভিলাষ মুঘল সাম্রাজ্যের ভিতের সমস্ত রস নিংড়ে বের করে নেয়। অষ্টাদশ শতকের ভারতের ইতিহাস যথেষ্ট প্রভাবান্বিত এ-ধরনের কপাল ফেরাতে আসা অভিযাত্রীদের সুবাদার, নায়িব সুবাদার হিসেবে উত্থানের মতো ঘটনায়। এভাবেই ১৭১৩ সালে দাক্ষিণাত্যে আসাফ জাহ নিজাম-উল- মুলক, ১৭২৩ সালে আওধে সাদাত আলী, আর ১৭১৩ সালে পাঞ্জাবে সাইফ- উদ-দৌলার উত্থান ঘটে। বাংলায় এর একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ মেলে ভারতীয় তুর্কি-আরব আলীবর্দীর কর্মজীবনে, যিনি তার উত্তরসূরি–মুর্শিদ কুলি জাফর খান ও সুজাউদ্দিনের মতোই এক ভাগ্যান্বেষী পরিবারের থেকে উঠে এসেছিলেন।
আলীবর্দীর পারিবারিক ইতিহাস
আলীবর্দী মূলত পরিচিত ছিলেন মির্জা বান্দে বা মির্জা মুহাম্মাদ আলী নামে। তার মা ছিলেন খোরাসানে বসতি গড়া আফসার নামের এক তুর্কি গোত্রের আর এভাবেই সেসময়ে তারা মুর্শিদ কুলি খানের জামাতা ও উড়িষ্যার সহ-প্রশাসক সুজাউদ্দিন মুহাম্মাদ খানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। তার দাদা ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত, সম্রাট আওরঙ্গজিবের পালিত ভাই, আর তার শাসনামলেই তিনি মুঘল মনসবদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন, আর তার বাবা মির্জা মুহাম্মাদ প্রথমে আওরঙ্গজিবের দ্বিতীয় সন্তান আযম শাহের পেয়ালা-বহনকারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। আওরঙ্গজিবের শাসনের শুরুর দিকে মির্জা মুহাম্মাদের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, যার নামকরণ করা হয় মির্জা আহমাদ, এর দশ বছর পর দাক্ষিণাত্যের কোনো এক শহরে জন্ম হয় মির্জা মুহাম্মাদ আলীর তাদের অভিভাবকদের প্রভাবে শৈশবেই মির্জা মুহাম্মাদ আলী ও তার ভাইয়ের জন্য সম্রাটের প্রাসাদের দ্বার ছিল অবারিত। দুই ভাই প্রাপ্তবয়স্ক হলে, আযম শাহ মির্জা আহমাদকে দিল্লির আবদার-খানা (ভাঁড়ারঘর) ও মির্জা মুহাম্মাদ আলীকে ফিলখানা-র (বাংলায় প্রচলিত পিলখানা অর্থাৎ হাতির আস্তাবল) তত্ত্বাবধায়ক আর যারদোযখানা-র (নকশা-তোলা কাপড়ের দফতর) দায়িত্ব দেন।
আযম শাহের মৃত্যুর পর মির্জা মুহাম্মাদ আলীর পরিবারের দুর্দশা
১৭০৭ সালের জুন মাসে আগ্রার কাছে জাজোর বিস্তীর্ণ প্রান্তে সিংহাসনের দাবি নিয়ে দু-ভাই প্রথম বাহাদুর শাহ ও আযম শাহের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, আর স্বাভাবিকভাবেই মির্জা মুহাম্মাদ আলী আযম শাহের পক্ষে ছিলেন আর শরীরে তিরের আঘাতও পেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধে তাদের পৃষ্ঠপোষক আযম শাহের মৃত্যু আর এর ফল হিসেবে মির্জা মুহাম্মাদ আলীর পরিবার বেকার হয়ে সমস্যায় পড়ে যায়। এই অবস্থায় দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পেতে মির্জা মুহাম্মাদ তার স্ত্রীকে নিয়ে কটকে সুজাউদ্দিন মুহাম্মাদ খানের অনুগ্রহ পেতে দরবারে গিয়ে উপস্থিত হন, তার স্ত্রীর সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে। সুজাউদ্দিন তার অনুরোধ দয়ার সঙ্গে বিবেচনা করে তাকে দরবারের চাকরিতে নিয়োজিত করেন। মির্জা আহমাদ এসময়ে কিছু বছরের জন্য ভারত ছেড়ে মক্কায় হজ করতে যান। জীবিকার তাগিদে মির্জা মুহাম্মাদ আলী আমানত খানের ও সামসাম-উদ-দৌলার দলে ওয়ালাশাহী (রাজকীয়) বাহিনীতে যোগ দেন ক, কিন্তু এই চাকরি তার মন-মেজাজ মতো না-হওয়ায় তিনি ছেড়ে দেন ও নিভৃত জীবন যাপন করেন।
মির্জা মুহাম্মাদ আলীর বাংলায় আগমন
কিন্তু ঘনকালো মেঘেরও রুপালি অবয়ব থাকে। মির্জা মুহাম্মাদ আলীর দারিদ্র্য আর দুর্দশা আসলে এ সময়ে সুপ্ত আশীর্বাদ হিসেবেই দেখা দেয়, ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে। কটকে উষ্ণ আতিথেয়তা পাওয়া বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি সুবাহ বাংলায় তার ভাগ্য পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন, যেটা তখনও অন্য এলাকার তুলনায় রাজনৈতিকভাবে কম অস্থির ছিল আর প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধার জন্য ভারতের অন্য এলাকার ভাগ্যান্বেষীদের তীর্থে পরিণত হচ্ছিল। ১৭২০ সালে, তিনি হতদরিদ্র অবস্থায় স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বাংলায় আসেন। তিনি মুর্শিদাবাদ এসে পৌঁছলে, মুর্শিদ কুলি জাফর খান তাকে সাদরে গ্রহণ করার পরিবর্তে ভাগ্যান্বেষীর দুর্দশা বাড়াতে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। তিনি, যদিও এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন মুর্শিদ কুলি খানের স্ত্রীর দেওয়া সময়োচিত সতর্কবার্তার মাধ্যমে, যার সঙ্গে তার দূরের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল।
মির্জা মুহাম্মাদ আলী সুজাউদ্দিনের উড়িষ্যার দরবারে
মুর্শিদাবাদ থেকে মির্জা মুহাম্মাদ আলী কটকের দিকে চলে যান, সেখানে সুজাউদ্দিন তাকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই মাসিক ১০০ রুপির বিনিময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। তার সহজাত বুদ্ধিমত্তা, বিচারক্ষমতা, জটিল সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান করার প্রবণতা, দুর্দান্ত প্রভাব ও নির্ভীক সাহসিকতায়, তিনি খুব সহজেই সুজাউদ্দিনের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ফলে তাকে অন্যান্য দায়িত্বও দেওয়া হতে থাকে। তার সন্তোষজনক ও আস্থাশীল কাজের পুরস্কার হিসেবে উড়িষ্যার ফৌজদারদের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি তার পৃষ্ঠপোষককে সহায়তা করেন অসন্তুষ্ট জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে, যারা তার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিল, আর সন্তোষজনক ব্যবস্থায় তাদের অধীনে থাকা গ্রামগুলোয় সুশাসন নিশ্চিত করেছিলেন। এই কাজগুলোর প্রতিদান হিসেবে তাকে আরও উঁচুপদে নিয়োজিত করা হয়।
উড়িষ্যায় মির্জা মুহাম্মাদ আলীর সাফল্য
উড়িষ্যায় মির্জা মুহাম্মাদ আলীর সাফল্য তাকে সাহস জোগায় দিল্লিতে পরিবারসহ বসবাসরত তার ভাই – মির্জা আহমাদকে (মক্কা থেকে ফেরার পর হাজী আহমাদ নামে পরিচিত) তার কাছে নিয়ে আসতে। তিনি বেশ ভালো অঙ্কের টাকা পাঠান তার ভাইকে যাত্রাপথের খরচ হিসেবে। হাজী আহমাদ বাংলায় আসেন ১৭২১ সালে তার মা, বোন আর তিন সন্তান—মুহাম্মাদ রেজা, আগা মুহাম্মাদ সৈয়দ আর মির্জা মুহাম্মাদ হাশিমকে নিয়ে। হাজী আহমাদকে প্রথমে ৫০ রুপির বিনিময়ে একটি পদ দেওয়া হয়, আর তার ছেলেদের যথাক্রমে ৩০, ২০ ও ১০ রুপির। ওর্ম লিখেছেন হাজী মুহাম্মাদ আলী ও তার ভাই দিল্লি থেকে বেশ শক্ত সুপারিশ নিয়ে এসেছিলেন যা সুজাউদ্দিনের মনে আশানুরূপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু সমসাময়িক অন্য কোনো লেখক কোনো সুপারিশের উল্লেখ করেননি; আর হাজী মুহাম্মাদ আলী প্রথমে সুজাউদ্দিনের কিস্তমাতগার বা খিদমতগার (খানসামা ) হিসেবে ও মির্জা মুহাম্মাদ আলী ছিলামপারদার (ছিলাম-বারদার, তামাক-বহনকারী ) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন প্রথমে – হলওয়েলের এই বক্তব্যের স্বপক্ষেও কোনো সমর্থন দেননি। কেবল তারিখ-ই-বাঙ্গালাহর লেখক সালিমুল্লাহ, যিনি সবসময় মির্জা মুহাম্মাদ আলীর বিরোধিতা করেছেন, তিনি তাকে ও তার ভাইকে সুজাউদ্দিনের মুসাহিব (তোষামোদকারী) বলে উল্লেখ করেছেন।
দুই ভাইয়ের ক্রমান্বয়ে উত্থান আর তার কারণ
দুই ভাই তাদের সহজাত অধ্যবসায়, কৌশল আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, নিজেদের সুজাউদ্দিনের প্রশাসনে সাহায্যকারী প্রভাবক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছিলেন। তাদের উদ্যোগে অর্থনৈতিক বিভাগ পুনর্গঠিত হয়েছিল আর উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে- তাদের শ্রম, নিরলস উদ্যোগ, আর কাজের প্রতি নিবেদন তাদের পৃষ্ঠপোষকের সরকারকে জনপ্রিয়, সম্মাননীয় ও সাম্রাজ্যের জন্য লাভজনক করে তুলেছিল। এভাবে উড়িষ্যা বাংলার ভবিষ্যৎ সুবাহদার মির্জা মুহাম্মাদ আলীর কাছে প্রশাসনিক ব্যাপারগুলো অনুশীলনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল।
সালিমুল্লাহ, হলওয়েল ও স্ক্র্যাফটনের বিবরণ হতে বোঝা যায় দুই ভাই তাদের প্রভাব তৈরি ও ছড়িয়ে দিয়েছিল নীচ ও অনৈতিকভাবে। সালিমুল্লাহ দেখেছেন যে তারা তাদের বেগমদের সুজাউদ্দিনকে হাস্যরসে মাতিয়ে রাখার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন। হলওয়েল লিখেছেন যে হাজী আহমাদ শীঘ্রই বের করলেন যে তার প্রভুর দুর্বলতা রয়েছে বিভিন্ন নারীর প্রতি, আর তাকে এই দুর্বলতায় ডুবে যেতে দিয়ে এবং আবেগকে জিইয়ে রেখে, তিনি প্রভুর উপর কর্তৃত্ব অর্জন করলেন, আর সব ব্যাপারেই নাক গলাতে লাগলেন, তা সে ছোট হোক বা গুরুত্বপূর্ণ; আর তিনি নিজেকে জনপ্রিয় হতে দেখে, সবধরনের মামলা ও আর্জি তার মাধ্যমেই পাঠাতে লাগলেন। স্ক্র্যাফটন আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন যে হাজী আহমাদ তার নিজের মেয়েকে বিসর্জন দিয়েছিলেন তার প্রভুর লালসার কাছে। অবশ্য এসব বিবরণের কোনো ভিত্তি নেই। সালিমুল্লাহ আলীবর্দীকে নিয়ে কখনোই ভালো কিছু লেখেননি, আর হলওয়ল ও স্ক্র্যাফটন পরোক্ষ সূত্রের সাহায্য নিয়েছেন যেগুলো আবার ভুলে ভরা। তাদের বক্তব্য, বিশেষত হলওয়েলের বক্তব্য ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত বলা যায় না, যতক্ষণ-না অন্য কারও বক্তব্য তাকে সমর্থন জোগায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে হাজী আহমাদ ধূর্ত, কৌশলী আর নীতিজ্ঞান বিবর্জিত ছিলেন; কিন্তু এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই যা আমাদের তাকে তার ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য পরিবারের নারীসহ বহু নারীর সম্মান বিসর্জনকারী হিসেবে ভাবায়, যদিও এটা বলতেই হয় যে সে সময়ে এ-ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরলও ছিল না। ইউসুফ আলী আর গোলাম হোসেনের মতে মির্জা মুহাম্মাদ আলী ও তার ভাইয়ের উত্থানের পিছে নিয়োগকর্তার প্রশাসনের প্রতি তাদের বিশ্বস্ত ও দক্ষ সেবাই মূল কারণ ছিল। সেসময়ের ইতিহাসের ব্যাপারে এই দুজন লেখক অন্য যে-কারো থেকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য; তবে এটাও সত্য যে তারা আলীবর্দীর পরিবারের ব্যাপারে কিছু ব্যাপার উপেক্ষা আর ঘষামাজা করে উপস্থাপন করে প্রশংসামূলক কথাবার্তা বলেছেন—যা স্বাভাবিক, কারণ তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে আসছিল তার থেকে। তারপরও তারা লেখক হিসেবে বিবেক-বোধসম্পন্ন ছিলেন। অন্যদিকে, এটা পরিষ্কার যে সালিমুল্লাহ, ক্র্যাফটন আর হলওয়েল প্রচলিত মুখরোচক গুজব তৈরি করেছেন বা প্রচলিত গুজবকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছেন, এমনটা কেন করেছেন এর পিছে অবশ্যই কোনো ভিত্তি রয়েছে। বিস্তারিত বিবরণ গ্রহণ না করে আমরা বলতে পারি হাজী আহমাদ অসাধু পন্থাতেই তার প্রভুর রুচি অনুযায়ী সাহায্য করেই উপরে উঠেছিলেন, আর সেসময়ে এটা ভাগ্যান্বেষীদের দরবারের উপরের সারিতে ওঠার এক পন্থাও ছিল বটে। কিন্তু আলীবর্দী তার কর্মদক্ষতার মেধার জোরেই শীর্ষে উঠেছিলেন।
মির্জা মুহাম্মাদ আলী ও হাজী আহমাদের সহায়তায় সুজাউদ্দিনের বাংলার মসনদে আরোহণ
উড়িষ্যায় তাদের সন্তোষজনক কাজের পাশাপাশি দুই ভাই সুজাউদ্দিনকে বাংলার মসনদ দখলেও সহায়তা করেন, তার শ্বশুর মুর্শিদ কুলি খানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। মুর্শিদ কুলির কোনো ছেলে না-হওয়ায় সুজাউদ্দিন ছিলেন সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী কিন্তু তাদের ভেতরে সদ্ভাব ছিল না। সুজাউদ্দিনের কাম-লালসার কারণে তার ধর্মপরায়ণা স্ত্রী জিবুন্নিসা পর্যন্ত তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি তাকে ছেড়ে ছেলে সারফারাজের সঙ্গে মুর্শিদাবাদে বাবার প্রাসাদে থাকতে শুরু করেছিলেন। এসময়ে যখন মুর্শিদ কুলি টের পেলেন তার সময় ফুরিয়ে আসছে পৃথিবীতে, তিনি দিল্লি থেকে তার নাতি আলা-উদ-দৌলা সারফারাজ খানের নামে বাংলার নিজামাত ঘোষণার চেষ্টা করলেন। এটা শুনে সুজাউদ্দিন মির্জা মুহাম্মাদ আলী ও হাজী আহমাদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করলেন আর সিদ্ধান্ত অনুসারে দিল্লিতে সম্রাটের কাছে উজির কামরুদ্দিন ও খান-ই-দাওরান সামসাম-উদ-দৌলার মাধ্যমে বহু মূল্যবান উপহার দিয়ে দূত পাঠালেন বাংলা ও উড়িষ্যার দিওয়ানি ও নিজামাত চেয়ে। মুর্শিদ কুলি খানের মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সড়কপথে উড়িষ্যা থেকে মুর্শিদাবাদে ডাক যায় একই সঙ্গে, সম্রাটের কাছেও আরেকটি ডাক যায় সড়কপথে উড়িষ্যা থেকে দিল্লিতে। সুজাউদ্দিন আপাতদৃষ্টিতে কিছু সৈন্যকে ছাঁটাই করেন, কিন্তু তারা আসলে মুর্শিদাবাদে মুর্শিদ কুলি খানের প্রাসাদে অবস্থান নিতে থাকে, যেন যে-কোনো পরিস্থিতিতে ত্বরিত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করতে পারে। বর্ষাকালের কথা মাথায় রেখে সবধরনের নৌযান প্রস্তুত করা হয় জরুরি অবস্থার জন্য। মুর্শিদাবাদ থেকে আসা এক চিঠি থেকে সুজাউদ্দিন যখন জানতে পারেন যে মুর্শিদ কুলি বড়জোর পাঁচ-ছ দিন টিকে থাকবেন, তিনি কটক থেকে যাত্রা শুরু করেন মুর্শিদাবাদের দিকে—সঙ্গে সৈন্য, তার কিছু বান্ধব আর মির্জা মুহাম্মাদ আলী। কটকে তার সহকারী পদ দিয়ে রেখে যান তার অন্য স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া মুহাম্মাদ তকি খানকে। পথেই তিনি মুর্শিদ কুলির মৃত্যুর সংবাদ পান আর বাংলার সরকারের ব্যাপারে দিল্লির রাজকীয় সনদও। খবর পেয়ে তিনি সেখানে খানিক অপেক্ষা করে ঐ স্থানের নতুন নামকরণ করেন মুবারাক মঞ্জিল বা শুভ মঞ্চ, এরপর দ্রুত মুর্শিদাবাদে রওনা হয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তিনি সবার আগে চিহিল সাতুন মুর্শিদ কুলির আদেশে নির্মিত চল্লিশ স্তম্ভের প্রাসাদকে মেরামত করেন, আর বাংলার মসনদে বসার দাবি করেন (জুলাই ১৭২৭) প্রধান কর্মকর্তা আর শহরের অধিবাসীদের সামনে। সারফারাজ খান, বাবার সঙ্গে মসনদ নিয়ে লড়াই করাটাকে প্রয়োজনহীন ভেবে তার আনুগত্য স্বীকার করে নেন।
হাজী আহমাদের আত্মীয়দের নিয়োগ ও উপাধি
এভাবে বাংলার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, সুজাউদ্দিন তার সরকার গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি পুরস্কার ও অনুগ্রহ বিলোতে থাকেন পরামর্শ দেওয়া ও সহযোগিতা করা মির্জা মুহাম্মাদ আলীর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের। হাজী আহমাদের বড়ছেলে মুহাম্মাদ রেজা ( পরবর্তীতে নাওয়াজিশ মুহাম্মাদ খান নামে পরিচিত) নবাব বাহিনীর বকশি ও মুর্শিদাবাদের রাজস্ব বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার দ্বিতীয় ছেলে আগা মুহাম্মাদ সৈয়দ (পরে সৈয়দ আহমাদ খান নামে পরিচিত) রংপুরের ফৌজদারী হিসেবে নিয়োজিত হন। আর তার সবচেয়ে ছোটছেলে মির্জা মুহাম্মাদ হাশিমকে (পরে জৈনুদ্দিন আহমাদ খান) হাশিম আলী খান উপাধি দেওয়া হয়। এ সময়েই হাজী আহমাদের সৎ-বোন শাহ খানম, সৈয়দ আহমাদ নাযাফি র ছেলে মীর মুহাম্মাদ জাফর খানকে বিয়ে করেন।
রাজমহলের ফৌজদার হিসেবে আলীবর্দীর প্রশাসনিক দক্ষতা
মির্জা মুহাম্মাদ আলী আকবারনগর (রাজমহল) চাকলার ফৌজদার নিযুক্ত হন ১৭২৮ সালে ও আলীবর্দী উপাধি লাভ করেন। ভৌগোলিকভাবে বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত রাজমহলের প্রশাসনিক দায়িত্বে মির্জা মুহাম্মাদ আলী ছাড়া আর কারো কথা ভাবা হয়নি, কারণ তিনি ইতোমধ্যেই তার কৌশল আর যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে ফেলেছিলেন। সুজাউদ্দিনের সিদ্ধান্ত সঠিক বলেও প্রমাণিত হয়। রাজমহলের লোকেরা নতুন ফৌজদারের যোগ্য শাসনে শান্তি ও সমৃদ্ধির ভেতর দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে থাকে। আলীবর্দী ও তার ভাই হাজী আহমাদ এরপর জলদিই নবাবের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন, সুজাউদ্দিনের রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে। আলীবর্দীর সিদ্ধান্তে নবাব এতটাই আস্থাশীল হয়ে পড়েছিলেন যে প্রতিবছরই তাকে রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদে তলব করতেন সুবাহ্র রাজনৈতিক ও রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো নিয়ে শলা-পরামর্শের জন্য।
বাংলার সঙ্গে বিহারের সংযুক্তি
বিহারের সরকারের পরিবর্তনে আলীবর্দীর ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। ১৭২৭ সালে বিহারের প্রশাসক নাসরাত ইয়ার খানের স্থলাভিষিক্ত হওয়া ফাখ্র-উদ- দৌলাহ পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অশিক্ষিত, উদ্ধত, গর্বিত আর নিজের মধ্যে ডুবে থাকা এক মানুষ, যে-কারণে তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি ঠিকমতো। এমনকি তিনি শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গেও ঝামেলা বাধিয়ে বসেন, যার প্রভাব এতটাই ছিল বিহারে যে, বিহারের প্রত্যেক প্রশাসক তাকে হয় সহকারী নয়তো রাজস্ববিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করতেন। এছাড়াও তিনি অবসর গ্রহণ করে আযিমাবাদে (পাটনা) ধর্ম-কর্মে নিবেদিত হয়ে যাওয়া খাজা মুতাসামকেও অপমান করেন। এটা ছিল মূর্খের মতো উত্ত্যক্ত করা, কারণ খাজা মুতাস্সাম তার ভাই সাম্সাম্-উদ-দৌলা খান-ই- দাওরানকে বিচার দেন, আর তারই প্রভাবে ফাখ্র-উদ-দৌলাকে পদচ্যুত করা হয়। বিহারকে তখন সুবাহ বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় আর তা নবাব সুজাউদ্দিনের অধীনে চলে আসে। সেই থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত বিহার বাংলার অংশ হয়ে থাকে।
বিহারের সহ-প্রশাসক আলীবর্দী
সুজাউদ্দিন বাংলা ও বিহারের পুরো ক্ষমতা নিজের হাতে রাখা সমীচীন মনে করেননি, আর নিজের আত্মীয়দের মধ্যেও কাউকে তিনি উপযুক্ত ভাবেননি বিহারের শাসনক্ষমতার ভার নেওয়ার মতন। তার সন্তান সারফারাজকে বিহারের সহ-প্রশাসকের দায়িত্বের কথা তুলতেই তা খারিজ হয়ে যায় জিবুন্নিসার আপত্তিতে, তিনি তার ছেলের থেকে আলাদা হয়ে থাকতে চাননি। এমনকি তিনি সারফারাজের সৎ-ভাইকেও এই পদে বসানোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিহারের প্রশাসনে বিভিন্ন ধরনের চাপ নেওয়ার মতো লোকের খোঁজেই তখন আলীবর্দী ছিলেন প্রথম পছন্দ। এটা তার সভাসদের সবাই মেনেও নিয়েছিলেন জিবুন্নিসাও। তিনি আলীবর্দীকে অন্দরমহলের তোরণে ডেকে পাঠান, দামি খেলাত (পোশাক) পরিয়ে দেন তার সন্তান সারফারাজের মাধ্যমে, আর বিহার সরকারের ফারমান প্রদান করেন। এই বিভূষণের পর সুজাউদ্দিন আলীবর্দীকে ডেকে পাঠান আর তার পক্ষ থেকে অন্যসব উপহারের সঙ্গে একটি হাতি, একটি তরবারি, একটি ছোরা, নকশা-করা পাগড়ি ও বিহারের সহকারী প্রশাসকের স্বত্ব প্রদান করেন।
মির্জা (সিরাজ-উদ-দৌলা) মুহাম্মাদের জন্ম
নতুন পদে নিয়োগের কিছুদিন আগে, তার সবচেয়ে ছোট ভাতিজাকে বিয়ে করা তারই ছোটমেয়ে আমিনা বেগমের গর্ভে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। আলীবর্দীর নিজের কোনো ছেলে ছিল না; তিনি তার নাতির নামকরণ করেন মির্জা মুহাম্মাদ (যিনি পরে পরিচিত হন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নামে), তাকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন আর তার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ ও স্নেহ দেখাতে থাকেন, কারণ তার জন্মের কিছুদিন বাদেই তিনি উঁচুপদে আসীন হয়েছিলেন। দুই জামাতা, সদ্যোজাত নাতি আর অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে, আলীবর্দী আযিমাবাদের (পাটনা) পথে বেরিয়ে পড়েন ১৭৩৩ সালে। সঙ্গে আরও ছিল পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলিয়ে পাঁচ হাজার সৈন্য। সেখানে পুরো এক বছর থাকার পর, সুজাউদ্দিন তাকে মুর্শিদাবাদ ডেকে পাঠান, যিনি তখন দিল্লির কেন্দ্রীয় দরবার থেকে তার জন্য মাহাব্বাত জঙ্গ, পাঁচহাজারি মনসবদার- এর পদ, আর ঝালরওয়ালা পালকি (পালঙ্কী), পতাকা ও দামামা ব্যবহারের অনুমতি আনিয়েছিলেন। এই সম্মান গ্রহণের পরপরই তিনি দ্রুত আযিমাবাদে ফিরে যান।
বিহারের কষ্টসাধ্য শাসন ও বাঞ্জারাদের শাস্তি
বিহারের প্রশাসন সেসময়ে খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না, বিশেষত ফাখ্-উদ দৌলার সরকার বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা তৈরি করে গিয়েছিল। পুরো প্রদেশ বিভ্রান্তিকর ও অস্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। বেশিরভাগ জমিদারই অবাধ্য আর বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, আর পুরো প্রদেশ শিকার হয় বাঞ্জারা গোত্রের লোকেদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের, যারা বণিক ও পর্যটকের ছদ্মবেশে রাজ্যের সম্পদ লুট করছিল। কিন্তু এর কারণে সৃষ্ট বহুবিধ প্রতিকূলতা কোনোভাবেই দমন করা যাচ্ছিল না, আলীবর্দী নিজেকে দুর্দান্ত মনোবল ও সাহসিকতার সঙ্গে এই দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন। প্রথমে তিনি পাটনা শহরের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, তার প্রজাদের বিশ্বাস অর্জন ও সৈন্যদের সম্পৃক্ত করার জন্য। এরপর তিনি মনোযোগ দেন আশেপাশের সমস্ত এলাকা থেকে সৈন্য নিয়োগ করে তার সরকারের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে, আর এর ফলে অল্প সময়ের ভেতরেই তিনি সুপ্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি আবদুল করিম খান নামের এক রুহেলা (রোহিলা) আফগান সেনাপতিকে নিয়োগ করেন ১৫০০ দ্বারভাঙা আফগান সৈন্যদের প্রধান হিসেবে। এই আফগানদের সাহায্যে আলীবর্দী বাঞ্ছারাদের দমন করেন ও তাদের কাছ থেকে প্রচুর সম্পদ কেড়ে নেন।
অসন্তুষ্ট অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ
অসন্তুষ্ট অভিজাতেরা রাজ্যের জন্য বিপদের উৎস ছিল। আলীবর্দী তাই বিহারের প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বুদ্ধি খাটিয়ে অবাধ্য জমিদারদের দমন করার চেষ্টা করেন। তিনি তাদের মধ্যে মতভেদ তৈরির চেষ্টা করে তাদের দুর্বল করার চেষ্টা করেন, আর কিছু জমিদার শুরুতেই তার কাছে এসে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। কিন্তু কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া জমিদারদের ক্ষেত্রে শাহাবাদের ভোজপুরি জমিদার, টিকারির রাজা সুন্দর সিং ও নারহাট সামাইয়ের (বর্তমানে বিহারের নওয়াদা জেলার হিসুয়া) কামগার খান মাইয়ির বিরুদ্ধে, যারা আগের সহ-প্রশাসককে অস্বীকার করেছিলেন আর কেন্দ্রীয় সরকারের বকেয়া পাওনা দিতে গড়িমসি করছিলেন, তাদের অনুগত হতে বাধ্য করা হয় আর সমস্ত বকেয়া আদায় করা হয়। বেতিয়া ও ভাঁওয়ারার রাজাদেরও একই সঙ্গে দমন করা হয় আর তাদের এলাকা থেকে আলীবর্দী ধাতব মুদ্রা ও অন্যান্য সম্পদ মিলিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার সম্পদ করায়ত্ত করেন।
চকোয়ারদের দমন
এরপর আলীবর্দী মুঙ্গের জেলার বেগুসরাইয়ের সাম্ভোকে কেন্দ্র করে থাকা শক্তিশালী হিন্দুগোত্র চকোয়ারদের দিকে নজর দেন। তারা বাংলার সুবাহদারকে ও দিল্লির সম্রাটকে পাওনা রাজস্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেদের প্রায়-স্বাধীন করে রেখেছিল অন্তত অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে। তারা মুঙ্গেরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর (গঙ্গা) উপর দিয়ে চলাচল করা সবকিছু তাদের অধীনে রেখেছিল, আর ইউরোপীয় বসতিগুলোর পিছে প্রতিবছর বড় অঙ্ক খরচ করত সামরিক খাতে, যেন তারা পাটনায় তাদের পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রহরা দেয়। তাদের বয়স্ক ও সাহসী রাজা ১৭৩০ সালে মারা যান, আর তার স্থলাভিষিক্ত হন তার সতেরো বছরের ছেলে। তিনি বিহারের অন্য জমিদারদের অনুকরণ করেই প্রথমে সামান্য প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টার পর আলীবর্দীর কাছে নত হন আর দিল্লির সম্রাট ও বাংলার সুবাহদারের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন। বার্ষিক রাজস্ব ধার্য করে এর পরের চার বছর নিয়মিত তা আদায় করা হয়েছিল। চকোয়ারদের রাজধানী থেকে ত্রিশ মাইল দূরে একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে তাদের রাজা বাংলা সরকারের একজন প্রতিনিধি, কর্মকর্তাকে নির্ধারিত দিনে প্রতিশ্রুত কর প্রদান করতেন, দুপক্ষেরই কেবলমাত্র ত্রিশজন করে উপস্থিত হতেন।
আবদুল করিমের হত্যা
এর ভেতরেই আলীবর্দীর নির্ভীক আফগান সেনাপতি আবদুল করিম, নিজের পরাক্রম সম্পর্কে সচেতন, উদ্ধত ও স্বাধীনচেতা হয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দুশ্চিন্তায় ফেলেন। আফগান সেনাপতির এমন উদাহরণ তার সরকারের অন্যদেরও আক্রান্ত করতে পারে ভেবে, তিনি পাটনার চিহিল সাতুনে (দরবার-এ-আম/দরবার কক্ষে ) উপস্থিত হলে আলীবর্দী সুচতুর কৌশলে তাকে হত্যা করেন। গোলাম হোসেন যথারীতি আলীবর্দীর পক্ষ নিয়ে তাকে এই অপরাধ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন আবদুল করিমের সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা হয়ে গিয়েছিল কর্তৃপক্ষের প্রতি অসন্তুষ্ট ও অবাধ্য হওয়ার কারণে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যিনি গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিয়ে গেছেন, এমন একজনকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করা রীতিমতো অন্যায্য বলেই মনে হয়। এটা পরিষ্কারভাবে পথের কাঁটা সরানোর মতোই, প্রতিপক্ষকে হটিয়ে দেওয়া। ১৭৪৮ সালে আলীবর্দীর কর্মকর্তা ও সভাসদেরা অবশ্যই এই ঘটনা মনে করেছিলেন, যখন আফগানরা হত্যা করেছিল তার ভাতিজা হাইবাত জংকে একই জায়গায়।
আলীবর্দীর বিহার প্রশাসনের মূল্যায়ন
দমনের কঠোর নীতি অনুসরণ করে কখনো-সখনো সমঝোতা যোগ করে আলীবর্দী বিহারে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। ইউসুফ আলী, গোলাম হোসেন ও ওয়াফার মতো সমসাময়িক ইতিহাস-লেখকদের বক্তব্য থেকে তা আমরা জানতে পারি। আর তুলনামূলক পরের লেখক কল্যাণ সিং জানিয়েছেন যে তিনি প্রদেশ শাসন করেছিলেন চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে। জমিদারদের তার সামনে নত হতে বাধ্য করানো ছিল নিঃসন্দেহে সম্পদ আহরণের জন্য কঠোর হওয়ার উদাহরণ, কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতি তিনি নির্দয় ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে তার আগের শাসকদের সময়ে অভিজাতদের গণ্ডগোলের কারণে সৃষ্টি হওয়া খারাপ ব্যাপারগুলো প্রদেশের জন্য এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল যে সেটা গোলাপজল চিকিৎসায় শুধরানোর মতো ছিল না। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন আলীবর্দী তার সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন কেবল বাড়তি করারোপ করেই করেননি, জমিদারদের থেকে পুরনো ও বকেয়া রাজস্বও ঠিকমতো আদায় করেছিলেন। এর থেকেই তিনি দিল্লিতে বিহার সুবাহ থেকে ৩০ লক্ষ রুপি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে ফারুশিয়ারের আমলে তা ছিল ২০ লক্ষ রুপি। এভাবে বিহারের তেজস্বী প্রশাসন আলীবর্দীর কর্মজীবনের এক সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়, কারণ এটা তাকে সুজাউদ্দিনের কাছে সম্মানিত ও সুনামের অধিকারী করে তোলার পাশাপাশি তার নিজের অবস্থানও দৃঢ় করতে সহায়তা করে।