অধ্যায়-১৯ তালুতের পতন, দাউদের (আ) আরোহণ
ওদিকে বাদশাহ তালুত ভয় পেয়ে গেলেন যখন দেখলেন ফিলিস্তিনিরা বিশাল বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছে। এত বড় বাহিনী দেখে তালুতের হৃদয়ে ভয় ঢুকে গেল। তালুত ভাবছিলেন, আল্লাহর কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা আসবে, কিন্তু একদমই কিছু না আসাতে তার ভয় আরও বেড়ে গেল। এমন সময় তিনি এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন, যা বাইবেল বলছে। (১ শামুয়েল ২৮)
তিনি মৃত আত্মার সাথে কথা বলতে পারে এমন এক মহিলা তান্ত্রিকের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন ছদ্মবেশ নিয়ে, সাথে দুজন লোক।
মহিলাকে খুঁজে বের করে তিনি তার কাছে মিনতি করলেন, “তুমি আমার জন্য মন্ত্র পড়ে রূহের সঙ্গে যোগাযোগ কর, যার নাম আমি তোমাকে বলবো, তাকে উঠিয়ে আনো।”
মহিলা বললেন, “আপনি কি জানেন যে তালুত তন্ত্রমন্ত্রের কাজ নিষিদ্ধ করেছেন দেশে? আমি এমন করলে আমাকে হত্যা করা হবে। তা-ই চান বুঝি?”
তালুত বললেন, “আমি আশ্বস্ত করছি, আপনার কিছুই হবে না।”
সেই স্ত্রীলোক জিজ্ঞাসা করলো, “আমি তোমার কাছে কাকে উঠিয়ে আনবো?”
তিনি বললেন, “শামুয়েলকে (আ) উঠিয়ে আনো।”
পরে মহিলা কাজ শুরু করলো। শামুয়েল (আ) হাজির হতেই মহিলা চিৎকার করে বলল, “আপনি কেন আমার সাথে প্রতারণা করলেন? আপনিই তো তালুত!”
তালুত জিজ্ঞাসা করলেন, “তাঁর আকার কেমন?”
মহিলা বললো, “একজন বৃদ্ধ উঠছেন, তিনি পরিচ্ছদে আবৃত।” তাতে তালুত বুঝতে পারলেন, তিনি (আ) শামুয়েল, আর ভূমিতে উপুড় হয়ে পড়ে সালাম জানালেন।
পরে শামুয়েল (আ) তালুতকে বললেন, “কেন আমাকে উঠিয়ে কষ্ট দিলে?”
তালুত বললেন, “আমি মহাসঙ্কটে পড়েছি, ফিলিস্তিনিরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, আল্লাহও আমাকে ত্যাগ করেছেন, আমাকে আর উত্তর দেন না, নবীদের দ্বারাও নয়, স্বপ্ন দ্বারাও নয়। অতএব আমার যা কর্তব্য, তা আমাকে জানবার জন্য আপনাকে ডেকে আনলাম।”
শামুয়েল (আ) বললেন, “যখন মাবুদ তোমাকে ত্যাগ করে তোমার বিপক্ষ হয়েছেন, তখন আমাকে কেন জিজ্ঞাসা কর? আল্লাহ আমার মধ্য দিয়ে যেরকম বলেছিলেন, সেরকম তার জন্য করলেন; আল্লাহ তোমার হাত থেকে রাজ্য কেড়ে নিয়েছেন ও তোমার প্রতিবেশী দাউদকে দিয়েছেন। যেহেতু তুমি মাবুদের কথা মান্য করোনি… এই কারণে আজ মাবুদ তোমার প্রতি এরকম করলেন। আর মাবুদ তোমার সঙ্গে ইসরাইলকেও ফিলিস্তিনিদের হাতে তুলে দেবেন। আগামীকাল তুমি ও তোমরা পুত্ররা আমার সঙ্গী হবে; আর মাবুদ ইসরাইলের সৈন্যদলকেও ফিলিস্তিনিদের হাতে তুলে দিবেন।”
ভয়ে তালুত মাটিতেই শুয়ে পড়লেন। রাত-দিন খেলেন না। তখন সেই মহিলা তাকে খাওয়া-দাওয়া করাবার চেষ্টা করলে তালুত বললেন, “খাবো না আমি।” তা-ও জোরাজুরি করাতে তালুত উঠে বিছানায় বসলেন। তার জন্য একটি বাছুর জবাই করে ফেললো। তালুত সেই রাতে ওখানে খেলেন, এবং রাতেই চলে গেলেন।
মজার ব্যাপার, এই একই শ্রুত ঘটনা অন্যভাবে অন্য চরিত্র দিয়ে অন্য নবীর নাম দিয়ে এসেছে ইসলামি লেখনিতে। ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে ইবনে কাসির বর্ণনা করেন, তালুত দাউদ (আ)-কে হত্যার পরিকল্পনা করলেও পরে সেটার জন্য অনুতপ্ত হন। অধিকাংশ সময় তিনি কান্নাকাটি করে কাটাতেন। রাতে কবরস্থানে গিয়েও কান্নাকাটি করতে থাকেন। কোনো কোনো সময় তার চোখের পানিতে মাটি পর্যন্ত ভিজে যেতো। এ সময় রাত্রে এক ঘটনা ঘটে। তালুত কাঁদছেন কবরস্থানে বসে। হঠাৎ কবর থেকে একটি শব্দ ভেসে এলো। “হে তালুত! তুমি আমাদের হত্যা করেছিলে, কিন্তু আমরা জীবিত। তুমি আমাদেরকে যন্ত্রণা দিয়েছিলে। কিন্তু আমরা এখন মৃত।”
এতে তালুত ভীত হয়ে পড়লেন, আর আরও বেশি কাঁদতে লাগলেন। তিনি লোকজনের কাছে এমন একজন বিজ্ঞ লোকের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন যার কাছ থেকে তিনি তার অবস্থা আর তার তওবা কবুল হবে কি না জিজ্ঞাসা করবেন। লোকেরা জবাব দিল, “আপনি কি আদৌ এমন কাউকে অবশিষ্ট রেখেছেন?” অবশেষে বহু চেষ্টার পর এক ‘পুণ্যবতী মহিলা’র খোঁজ পাওয়া গেল। মহিলাটি তালুতকে হযরত ইউশা (আ) এর কবরের কাছে নিয়ে গেলেন এবং ইউশাকে (আ) জীবিত করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করলেন।
হযরত ইউশা কবর থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “কিয়ামত কি হয়ে গেছে?”
উত্তরে মহিলা বললেন, “কিয়ামত হয়নি। তবে ইনি হচ্ছেন তালুত। তিনি আপনার কাছে জানতে চান, তার তওবা কবুল হবে কি না।”
ইউশা (আ) বললেন, “হ্যাঁ। কবুল হবে। তবে শর্ত হলো, তাকে বাদশাহী ত্যাগ করে শাহাদাত লাভের আগ পর্যন্ত আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে যেতে হবে। এ কথাগুলো বলতে না বলতেই ইউশা (আ) আবার মারা গেলেন।”
ঘটনার এই সংস্করণ বলে, তখন তালুত রাজত্ব দাউদের (আ) হাতে দিয়ে চলে যান, সাথে চলে যান তার তেরো পুত্র। তারা সবাই আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে শহীদ হন।
তবে এ কাহিনীর সমর্থক তেমন কেউ নেই। বরং অনেকেই পরে বলেন, সেই মহিলা তাকে শামুয়েল (আ) এর কবরে নিয়ে আসেন। আবার কেউ বলেন কবরে শায়িত সেই নবী ছিলেন আল-ইয়াসা ইবনে আখতুব (আ)। ফিরে আসা যাক মূল বিবরণে।
তালুত ভয়ে পড়ে থাকলেও, দাউদ কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন শত্রু আমালেকিয়দের সাথে, এবং সফলও হচ্ছিলেন। তালুতের অবশ্য ভাগ্য ভালো ছিল না এদিক থেকে। ফিলিস্তিনিদের হাতেই তার মৃত্যু লেখা ছিল।
ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করবার পর বনী ইসরাইলরা ফিলিস্তিনিদের সামনে থেকে পালিয়ে গেল এবং গিল্বোয় পর্বতে আহত হয়ে মারা পড়তে লাগল। আর ফিলিস্তিনিরা তালুত ও তার ছেলেদের পেছনে পেছনে তাড়া করলো। জোনাথানসহ তিন ভাই মারা গেলেন ফিলিস্তিনিদের হাতে।
এরপর তারা পিছু নিল বাদশাহ তালুতের, তীরন্দাজেরা তার নাগাল পেয়ে গেল; তীরের আঘাতে তিনি আহত হয়ে পড়ে গেলেন। তালুত তার রক্ষীকে বললেন, “তোমার তরবারি বের করো, আমাকে মেরে ফেলো। নাহলে আমাকে খৎনা-না-করা এই জাতির হাতে পড়তে হবে।” (১ শামুয়েল ৩১:৪)
কিন্তু তার রক্ষী এ কাজ করতে নারাজ। রক্ষীর অসম্মতি দেখে তালুত নিজেই নিজের তরবারি বের করে সেটির ওপর পড়ে গিয়ে আত্মহত্যা করলেন। তালুতকে মারা যেতে দেখার পর একইভাবে তার রক্ষীও আত্মহত্যা করলো। মৃতদেহগুলো থেকে মাথা কেটে নিয়ে ফিলিস্তিনিরা সাজপোশাকও খুলে ফেলল লাশ থেকে। এরপর সেগুলো ফিলিস্তিনজুড়ে প্রেরণ করলো। তালুত আর তার তিন ছেলের মারা যাবার খবর জানা মাত্রই নগর ত্যাগ করে পালিয়ে গেলো বনী ইসরাইলিরা।
উল্লেখ্য, কুরআনে তালুতের যতটুকু বিবরণ আছে তাতে তাকে খুবই ভালো ব্যক্তি হিসেবেই বোঝা যায়। সেই পর্যন্ত বাইবেলেও একই কথাই আছে। কিন্তু কুরআনে এর পরবর্তী কোনো কথাই বলা নেই তালুতকে নিয়ে। তার অবাধ্যতা বা দাউদের (আ) প্রতি ক্ষোভ, এগুলো ইসরাইলি বিবরণ। ইসলামি লেখনিতে তাফসিরে এগুলো ইসরাইলি রেওয়াত দিয়ে বর্ণিত আছে; তবে কুরআন এ ব্যাপারে নিশ্চুপই।
আল্লাহ দাউদ (আ)-কে বললেন এহুদা রাজ্যের হেবরনে চলে যেতে। সেখানে তিনি তাঁর দুই স্ত্রী অহিনোয়াম (Ahinoam) এবং আবিগন (Abigail)-কে নিয়ে চলে গেলেন, সাথে চললো তার সঙ্গীরা। পালিয়ে যাওয়া সেই বনী ইসরাইলিরা এসে দাউদ (আ)-কে নিজেদের বাদশাহ পদে অভিষিক্ত করলো। তিনি সাড়ে সাত বছর হেবরন থেকে শাসন করেন এহুদায়, কিন্তু ইসরাইলের বাকি স্থানে শাসন করতে লাগলো তালুতের আরেক পুত্র। তিনি মারা যাবার পর ইসরাইলের সকল বংশ দাউদের কাছে এসে তাঁকে পুরো ইসরাইলের বাদশাহ হবার অনুরোধ জানালো।
বাদশাহ হয়ে তেত্রিশ বছর দাউদ (আ) জেরুজালেম থেকে পুরো ইসরাইল ও এহুদা রাজ্যের ওপর রাজত্ব করেন। তবে জেরুজালেমকে রাজধানী করবার জন্য আগে তাকে জয় করে নিতে হয়েছিলো শহরটি, তখন সেটি ছিল জেবুসাইটদের (Jebusite) অধীনে। তিনি সিওন (তরড়হ) দুর্গ দখল করে নেন। সিওন আসলে জেরুজালেমের পাহাড় যার ওপর শহরটি গড়ে ওঠে। এখান থেকেই জায়োনিজম (Zionism) শব্দের উৎপত্তি। দাউদ (আ) এ শহর নিজের করে নেন দেখে জেরুজালেমকে বলা হয় ‘সিটি অফ ডেভিড’ বা দাউদের শহর।